জর্ডানে সম্প্রতি অনলাইন ভিত্তিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় এমন একটি আইন অনুমোদন করেছেন জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ। এতে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। নতুন আইনে বলা হয়েছে, ইলেকট্রনিক প্রকাশনার জন্য ওয়েবসাইটকে অবশ্যই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। এই আইন অনুযায়ী ওয়েবসাইট বন্ধ ও অনলাইনে প্রকাশিত যেকোনো বিষয় কাটছাঁট করার ক্ষমতা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদ বা লেখার জন্য প্রকাশিত পাঠক মন্তব্যের জন্য দায়ী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠানের মালিককে আটক করার বিধানও রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ বিধানের সমালোচনা করে বলেছে, সরকার বিরোধী মতাবলম্বী ও সমালোচকদের হেনস্তা করতে এ আইন প্রয়োগ করবে। গণমাধ্যমের কর্মী ও সাধারণ নাগরিকদের তাদের মন্তব্যের জন্য এ আইনের অধীনে অভিযুক্ত করে শাস্তির মুখোমুখি করার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছে সংগঠনটি। বার্তা সংস্থা এপি জানিয়েছে, নতুন এই আইনের কারণে দেশটির প্রায় ৪০০ ওয়েবসাইট ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জর্ডানের মতো একই কায়দায় বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীন মতামতের উপর হস্তক্ষেপ করার পাঁয়তারা চলছে। সরকার অনলাইন গণমাধ্যমগুলোকে আগামী অক্টোবরের মধ্যেই নীতিমালার আওতায় আনতে চায়। এ জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে। চলতি মাসের ১২ তারিখে কতিপয় অনলাইন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের ডেকে এ তথ্য জানিয়েছেন তথ্যসচিব, প্রস্তাবিত নীতিমালা সরবরাহ করে তাদের মতামত জানতে চেয়েছেন। খুব দ্রুত ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মতামত দিতে হবে। সভায় তথ্য সচিব বলেন, সরকারি হিসেবে সারা দেশে ২০০ অনলাইন সংবাদপত্র রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনলাইন সংবাদ মাধ্যম পরিচালনার জন্য দেশে কোন আইন, নীতিমালা ও অধ্যাদেশ নেই। সে কারণে নীতিমালা জরুরি। তিনি জানান, বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার অনলাইন সংস্করণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আলাদাভাবে আলোচনায় বসা হবে। সরকারি হিসাব মতে দেশে ২শ' অনলাইন গণমাধ্যম থাকলেও মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মাত্র ১১ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন!
কোনো গণমাধ্যমের ওপর সরকারকে নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দন্ডবিধি প্রণয়ন চলতে না পারলেও অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা তৈরিতে এমনটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ নীতিমালাকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার বর্তমান সরকারের ঘোষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও অনলাইনের সঙ্গে যুক্ত সম্পাদকগণ। খসড়ায় বলা হয়েছে, অনলাইন গণমাধ্যমের লাইসেন্স নেয়ার ক্ষেত্রে এককালীন পাঁচ লাখ টাকা তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। পরে প্রতি বছর ৫০ হাজার টাকায় লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে। ইত্যাদি। মন্ত্রণালয়ের করা নীতিমালয় অসঙ্গতি থাকায় বৈঠকেই এর বিরোধিতা করেন সম্পাদক ও অনলাইন গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা। তারা জানিয়েছেন, ‘নিয়ন্ত্রণ' আরোপের উদ্দেশ্যে এই নীতিমালা করা হলে দেশের অনলাইন গণমাধ্যমের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে সরকার ‘ডিজিটাল' বাংলাদেশ গড়ার যে লক্ষ্য নিয়েছে এই খসড়া সরকারের এই লক্ষ্যের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, সরকার যে পদ্ধতিতে নীতিমালা করতে যাচ্ছে এই পদ্ধতিটিই ভুল। নীতিমালা করার আগে যারা এই অনলাইন গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গে আলোচনা করে মতামত নিয়ে খসড়া তৈরি করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে খসড়া করে তার ওপর মতামত দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। এছাড়া লাইসেন্স নেয়া এবং নবায়নের জন্য যে পরিমাণ অর্থের কথা বলা হয়েছে তা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ আরোপের মতোই।
সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এমন সময় সরকার হঠাৎ করে অনলাইনের ওপর ক্ষেপে গেল কেন? তাড়াহুড় করে দ্রুত সময়ের মধ্যে অনলাইন পরিচালক/সম্পাদকদের পরামর্শ দিতে বলা হলো কেন? এই অসম অবাস্তব নীতিমালা তৈরি করতে গিয়েই কিন্তু সরকার ধরা খেয়ে গেছে। একথা না বললেও চলে যে, গত কয়েক বছরে সরকার সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে অনলাইন গণমাধ্যম ও কমিউনিটিগুলোতে। অনলাইনে খুব দ্রুত জনমত গড়ে উঠছে। কারো মতে, বস্তাভর্তি টাকার গোপন রহস্য যাতে উদঘাটিত হতে না পারে অথবা কালো বিড়াল সাদা করতেই অনলাইন গণমাধ্যম বন্ধ করার ফ্যাসিবাদী উদ্যোগ! সোনার ছেলেদের বেপরোয়া টেন্ডারবাজি আর অস্ত্রের মহড়ার সচিত্র প্রতিবেদন জনসম্মুখে মুহূর্তেই উপস্থাপন করা হচ্ছে, তাই এদের মুখটা বন্ধ করার জন্য এখনই উদ্যোগ নেবার সঠিক সময়। সরকারি হিসাবে সারা দেশে ২ শতাধিক অনলাইন সংবাদপত্র রয়েছে। যাদের অনেকেই ‘ডিজিটাল কারচুপি'র অন্তরায় হবে সম্ভবত এই জন্যই সময়মতোই ব্যবস্থা আর শায়েস্তা! সরকারের পক্ষ থেকে অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা সম্পর্কে ঘোষণাটি আসার পর থেকে এ যাবত ফেসবুক ও বিভিন্ন অনলাইনে যেসব মন্তব্য বিশ্লেষণ আমার নজরে পড়েছে, এর নির্যাস হলো যে বা যারাই খসড়া নীতিমালাটি উপহার দিয়েছেন, তারা আর যাই হোন, অন্তত সোশ্যালমিডিয়ার সাম্রাজ্যের কিছুই জানেন না বা বুঝেন না, এটা প্রমাণিত সত্য। অনলাইন গণমাধ্যম ‘‘সম্প্রচার, প্রকাশনা, প্রদর্শন ও পরিচালনা সম্পর্কিত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। এ লক্ষ্যে সরকার সম্প্রতি যে খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, তার অধিকাংশই বিরক্তি সৃষ্টিকারক ও একই সাথে ব্যাপক হাস্যরসের ব্যবস্থা রয়েছে নীতিমালাটিতে। কারণ, সরকার একদিকে বলছে ডিজিটাল বাংলার কথা অন্যদিকে স্ববিরোধী কর্মসূচি প্রণয়ন। নীতিমালার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো এর লাইসেন্স ফি, নবায়ন ফি ইত্যাদি। যেমন লাইসেন্স নিতে ৫ লাখ টাকা দিতে হবে, ২ লাখ দিতে হবে জামানত, ৫ লাখ টাকা ব্যাংকে ডিপোজিট রাখতে হবে, ৫ হাজার টাকা দিয়ে আবেদন ফরম নিতে হবে! যেখানে প্রিন্ট পত্রিকা বের করতে লাইসেন্স ফি দিতে হয় না সেখানে অনলাইন পত্রিকার জন্য ৫ লাখ টাকা লাইসেন্স ফি, সম্ভবত নীতিমালা লেখকরা এটাকে টিভি বা তার চেয়ে ব্যয়বহুল বা আরও জটিল কোনো গণমাধ্যম মনে করেছেন। খসড়া নীতিমালা যারা তৈরি করেছেন অনলাইন গণমাধ্যম সম্পর্কে তাদের ধারণা কতটুকু এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। এই খাতে সরকারের কোনো আর্থিক প্রণোদনা নেই। তার পরও কেন এতো কড়াকড়ি তা বোধগম্য নয়। শুধু বর্গীর মতো খাজনা আদায়ে মত্ত না হয়ে এই শিশু শিল্পের বিকাশে সরকারি সহায়তা-পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন। আর যদি পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্যই ৫ লাখ আর ২ লাখ করে নেয়ার পরিকল্পনা হয়ে থাকে তাহলে মন্ত্রী-এমপিদের অন্তত এক বছরের বেতন ভাতা কর্তন করা হোক, সচিবগণ সপ্তাহের একদিনের বেতন-ভাতা রাষ্ট্রিয় কোষাগারে জমা দিন। আর এটাই হবে দেশপ্রেমের উজ্বল দৃষ্টান্ত!
দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এখনো অনলাইনের সাথে পরিচিত নয়। তাই অনলাইন পত্রিকাগুলো জন্মকাল থেকে বিজ্ঞাপনের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। যা পাওয়া যায় তা দিয়ে ডোমেইন হোস্টিংয়ের দামও উঠে না। ইন্টারনেট হল অনলাইনের প্রধান কাঁচামাল। এতো বছরেও এটা সরকার সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে এনে দিতে পারলো না। হোস্টিং ও ডোমেইনের দাম পরিশোধ করার জন্য বিদেশে থাকা বন্ধুদের সহায়তা নিতে হয়। অনলাইনে সরকার এখনো বিজ্ঞাপন দেয় না, উপরন্তু সরকার বিজ্ঞাপন ফ্রি দেবার আবদার করেছে। অনলাইন গণমাধ্যম এখনো টাকা কামানোর উৎস হয়ে উঠতে পারেনি, কোন সুদূর ভবিষ্যতে পারবে তা অনিশ্চিৎ। বাংলাদেশের কোনো অনলাইন গণমাধ্যম এখনো লাভের মুখ দেখেনি। দুই/চারটা অনলাইন পত্রিকা বড় কোনো বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠানের প্রচার ও প্রভাব সৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে চালু হয়েছে, সেগুলোর লাভের মুখ দেখা খুব প্রয়োজনীয় নয়। বাকিগুলোও অলাভজনকভাবে কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে, বেশিরভাগ স্থানীয়ভাবে চলছে, নিজের জেলা বা উপজেলাকে তুলে ধরার জন্য, যার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশীরা উপকৃত হচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ' গঠনের ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি ভূমিকা রাখছে এসব অনলাইন গণমাধ্যমগুলো। অনলাইন মাধ্যমগুলোর লাভ তো দূরে থাক খরচের ১০%ও উঠে না, এরা কিভাবে ৭,০০,০০০ টাকা সরকার কে দিবে, কেন দিবে?
অনলাইন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী যেমন (অফিস অবকাঠামো, মোট জনবল ও নির্ধারিত ব্যাংক ব্যালেন্স, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র, সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞতার সনদপত্র এসব বিষয় চাওয়ার কিছুটা যুক্তি থাকলেও নীতিমালায় এমন কিছু বিষয় যুক্ত করা হয়েছে, যা অযৌক্তিক এবং অস্বাভাবিক। সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ‘সকল অনলাইন গণমাধ্যম বাংলাদেশে স্থাপিত সার্ভারে হোস্টিং করতে হবে। ডিএনএসআই (ডোমেইন নেইম সার্ভার ইন্টারনেট প্রটোকল) সম্পর্কে তথ্য মন্ত্রণালয় অবহিত থাকতে হবে।' এমন নীতি মেনে চলতে অসুবিধা নেই। তবে বাংলাদেশে হোস্টিং খরচ তাছাড়া দেশের হোস্টিংগুলোর মান উন্নয়নে যত্নশীল হতে হবে। ‘অনলাইন গণমাধ্যমের অন্য কোন দেশী বা বিদেশী গণমাধ্যম লিংক করা যাবে না।' এমন নীতিও সঠিক নয়। এই খসড়া নীতিমালা বাস্তবায়িত হলেই তো ৩/৪ অনলাইন সংবাদপত্র টিকে থাকবে, ফলে জাতি আরেকটি... দেখতে পারবে।
অনলাইন সংবাদ মাধ্যম আর দৈনিক পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করণের বিষয়ে পৃথক আইন কেন? এটাও বোধগম্য হচ্ছে না। ‘‘অনলাইন সংবাদপত্র যদি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা পালন করে, তাহলে বিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। সকল অনলাইন পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে সে সকল পত্রিকা প্রচলিত প্রিন্ট মিডিয়ার ডিক্লারেশন নীতিমালার আলোকে আরো সহজ শর্তে অনুমোদন দেয়া দরকার। এছাড়া অনলাইন পত্রিকা অনুমোদনের জন্য কোন জামানত কিংবা ফি গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত হবে না।
‘‘তথ্য মন্ত্রণালয় শুধু একটা কাজ করতে পারে। সংবাদপত্র প্রকাশের নীতিমালা অনুসরণ করে আবেদনকারীকে অনলাইন পত্রিকা প্রকাশনার জন্য একটা ‘ডিক্লারেশন' দিতে পারে। প্রকাশক যদি ডিক্লারেশন পাওয়ার যোগ্য হন, তাহলে ছাড়পত্র দিয়েই তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব শেষ'' হতে পারে। আমাদের ধারণা ছিল ডিজিটাল বাংলা গড়তে সরকার অনলাইন মিডিয়ার বিকাশ সাধনে একে প্রণোদনা দিয়ে সহায়তা করা। কিন্তু আমরা একি দেখছি! জানি না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই নীতিমালাটি পড়েছেন কি না? ভালো করে অধ্যয়ন করলে তিনি নিশ্চয় বুঝতে পারবেন তার সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলার' স্বপ্ন বাস্তবায়ন আর এই নীতিমালা স্ববিরোধী। আপনার সরকারের আমলে অবাধ তথ্য প্রযুক্তির সুযোগ দিয়ে দেশকে আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার এক যুগান্তকারী ইতিহাস সষ্টি করলেও অনলাইন মিডিয়ার নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে চরম অজ্ঞতার পরিচয় দেয়া হয়েছে। এজন্য অভিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন। চূড়ান্ত নীতিমালা প্রস্তুতের জন্য মোস্তফা জববার, জাফর ইকবাল প্রমুখের নেতৃত্বে দক্ষ লোক নিয়োজিত করা হোক।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে আইপিআইয়ের একটি প্রতিনিধিদল দেখা করতে এলে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন পুরোপুরি স্বাধীনতা ভোগ করছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়নি।’’ গণমাধ্যমগুলোর বিকাশে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি। সংবাদটির শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রীর নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিটি ছিল, ‘‘বর্তমান সরকার সাংবাদিকদের হয়রানিতে বিশ্বাস করে না। গত তিন বছরে সরকার কোনো সাংবাদিক বা সম্পাদকের বিরুদ্ধে একটিও মামলা করেনি।’’ (সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১২)
বর্তমান সরকারের সময়ে বাংলাদেশে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার' চিত্রটা কেমন? বিভিন্ন সূত্রের তথ্য মতে ২০০৯ সালের ৯ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতা নেয়ার ৩ বছর শাসনকালে ১৪ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং আলোচিত ঘটনাটি হলো মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন নিউজ' এর সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি'র হত্যাকান্ড। সাগর-রুনির হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে অনেক আন্দোলন হয়েছে। যা এখনো চলছে। কিন্তু ফলাফল কিছুই নেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাওয়া হয়েছিল, এর জবাবে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘‘কারো বেডরুম পাহারা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের নয়।’’ এই মহাসত্য ভাষণ থেকেই বুঝা যায় দেশে সংবাদপত্র আর সাংবাদিকতা কেমন নিরাপদে! আমাদের দেশে সাংবাদিক ও সংবাদপত্র ক্ষমতাসীনদের রোষানলে নতুন নয়। শুধু সাংবাদিকরাই ছিলেন তা নয়। সাথে আছেন দেশের প্রখ্যাত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরাও। বিভিন্ন সময়ে তারা সরকারের মদদপুষ্ট মহলের হামলা-হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ সরকারের আমলে দু'টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ হয়েছে। সরকার অনিয়মের অভিযোগ এনে ২০১০ সালের ২৭ এপ্রিল চ্যানেল ওয়ান ও যমুনা টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়। এতে প্রায় সহস্রাধিক মিডিয়াকর্মী বেকারত্বের ফলে চরম মানবেতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এছাড়া আরো একাধিক চ্যানেলের উপর যেকোন সময় বন্ধ হয়ে যাওয়ার খড়গ নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা আছে। সরকারি হস্তক্ষেপে জোর করে দৈনিক পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। ২০১০ সালের ১ জুন সরকার আমার দেশের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। ৪৭ দিন পর আদালতের রায় পেয়ে পুনঃপ্রকাশিত হয় পত্রিকাটি।
২০১১ সালে ৩১ জুলাই গ্রেফতার করা হয় জনপ্রিয় অনলাইন দৈনিক শীর্ষনিউজডটকম ও সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ সম্পাদক একরামুল হককে। তার গ্রেফতারের কয়েকদিনের মাথায় সরকারের চাপে কর্তৃপক্ষ শীর্ষনিউজডটকম বন্ধ করতে বাধ্য হয়। তখনই বাতিল করা হয় সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজ-এর ডিক্লারেশনও। এছাড়া সাংবাদিক সমাজের বারবার অনুরোধের পরও সরকার কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় প্রকাশনার ৬১ বছরের মাথায় এ সরকারের আমলে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের প্রাচীনতম জাতীয় ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভার। গত ১২ মার্চ ২০১২ তে বিরোধী দলগুলো মিলে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার বিরোধী মহাসমাবেশ আয়োজন করে। ঐ সমাবেশ নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি সমাবেশের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিলে প্রায় সব বেসরকারি টিভি তা সরাসরি সম্প্রচারের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু আগের দিন রাতে সব টিভিকেই সরাসরি প্রচার না করার জন্য বলে দেয় সরকার। অন্যরা তা মেনে নিলেও একুশে টিভি, বাংলা ভিশন ও আরটিভি সরকারের সতর্কতা না মানার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে সরকারি কর্তৃপক্ষ সমাবেশ চলাকালিন কয়েকঘণ্টা এই তিন টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার সম্পূর্ণ অবৈধভাবে বন্ধ করে দেয়। সাধারণ গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাতেই বর্তমান সরকারের ‘মিডিয়া দমন' সীমাবন্ধ নেই। বিকল্প গণমাধ্যমও বাদ যায়নি এই দমন-পীড়ন থেকে। সরকারের সমালোচনা ও শেখ হাসিনাকে হুমকি দেয়ার অভিযোগে ২০১০ সালের ২৯ মে বাংলাদেশে সরকার বন্ধ করে দেয়া হয় সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুক। অবশ্য পরে খুলে দিতে বাধ্য হয়। শেষতক কঠোরতার মোড়কে চলছে, অনলাইন গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। জানি না কতটুকু সফল হবে সরকার।
কোনো গণমাধ্যমের ওপর সরকারকে নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দন্ডবিধি প্রণয়ন চলতে না পারলেও অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা তৈরিতে এমনটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ নীতিমালাকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার বর্তমান সরকারের ঘোষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও অনলাইনের সঙ্গে যুক্ত সম্পাদকগণ। খসড়ায় বলা হয়েছে, অনলাইন গণমাধ্যমের লাইসেন্স নেয়ার ক্ষেত্রে এককালীন পাঁচ লাখ টাকা তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। পরে প্রতি বছর ৫০ হাজার টাকায় লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে। ইত্যাদি। মন্ত্রণালয়ের করা নীতিমালয় অসঙ্গতি থাকায় বৈঠকেই এর বিরোধিতা করেন সম্পাদক ও অনলাইন গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা। তারা জানিয়েছেন, ‘নিয়ন্ত্রণ' আরোপের উদ্দেশ্যে এই নীতিমালা করা হলে দেশের অনলাইন গণমাধ্যমের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে সরকার ‘ডিজিটাল' বাংলাদেশ গড়ার যে লক্ষ্য নিয়েছে এই খসড়া সরকারের এই লক্ষ্যের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, সরকার যে পদ্ধতিতে নীতিমালা করতে যাচ্ছে এই পদ্ধতিটিই ভুল। নীতিমালা করার আগে যারা এই অনলাইন গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গে আলোচনা করে মতামত নিয়ে খসড়া তৈরি করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে খসড়া করে তার ওপর মতামত দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। এছাড়া লাইসেন্স নেয়া এবং নবায়নের জন্য যে পরিমাণ অর্থের কথা বলা হয়েছে তা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ আরোপের মতোই।
সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এমন সময় সরকার হঠাৎ করে অনলাইনের ওপর ক্ষেপে গেল কেন? তাড়াহুড় করে দ্রুত সময়ের মধ্যে অনলাইন পরিচালক/সম্পাদকদের পরামর্শ দিতে বলা হলো কেন? এই অসম অবাস্তব নীতিমালা তৈরি করতে গিয়েই কিন্তু সরকার ধরা খেয়ে গেছে। একথা না বললেও চলে যে, গত কয়েক বছরে সরকার সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে অনলাইন গণমাধ্যম ও কমিউনিটিগুলোতে। অনলাইনে খুব দ্রুত জনমত গড়ে উঠছে। কারো মতে, বস্তাভর্তি টাকার গোপন রহস্য যাতে উদঘাটিত হতে না পারে অথবা কালো বিড়াল সাদা করতেই অনলাইন গণমাধ্যম বন্ধ করার ফ্যাসিবাদী উদ্যোগ! সোনার ছেলেদের বেপরোয়া টেন্ডারবাজি আর অস্ত্রের মহড়ার সচিত্র প্রতিবেদন জনসম্মুখে মুহূর্তেই উপস্থাপন করা হচ্ছে, তাই এদের মুখটা বন্ধ করার জন্য এখনই উদ্যোগ নেবার সঠিক সময়। সরকারি হিসাবে সারা দেশে ২ শতাধিক অনলাইন সংবাদপত্র রয়েছে। যাদের অনেকেই ‘ডিজিটাল কারচুপি'র অন্তরায় হবে সম্ভবত এই জন্যই সময়মতোই ব্যবস্থা আর শায়েস্তা! সরকারের পক্ষ থেকে অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা সম্পর্কে ঘোষণাটি আসার পর থেকে এ যাবত ফেসবুক ও বিভিন্ন অনলাইনে যেসব মন্তব্য বিশ্লেষণ আমার নজরে পড়েছে, এর নির্যাস হলো যে বা যারাই খসড়া নীতিমালাটি উপহার দিয়েছেন, তারা আর যাই হোন, অন্তত সোশ্যালমিডিয়ার সাম্রাজ্যের কিছুই জানেন না বা বুঝেন না, এটা প্রমাণিত সত্য। অনলাইন গণমাধ্যম ‘‘সম্প্রচার, প্রকাশনা, প্রদর্শন ও পরিচালনা সম্পর্কিত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। এ লক্ষ্যে সরকার সম্প্রতি যে খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, তার অধিকাংশই বিরক্তি সৃষ্টিকারক ও একই সাথে ব্যাপক হাস্যরসের ব্যবস্থা রয়েছে নীতিমালাটিতে। কারণ, সরকার একদিকে বলছে ডিজিটাল বাংলার কথা অন্যদিকে স্ববিরোধী কর্মসূচি প্রণয়ন। নীতিমালার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো এর লাইসেন্স ফি, নবায়ন ফি ইত্যাদি। যেমন লাইসেন্স নিতে ৫ লাখ টাকা দিতে হবে, ২ লাখ দিতে হবে জামানত, ৫ লাখ টাকা ব্যাংকে ডিপোজিট রাখতে হবে, ৫ হাজার টাকা দিয়ে আবেদন ফরম নিতে হবে! যেখানে প্রিন্ট পত্রিকা বের করতে লাইসেন্স ফি দিতে হয় না সেখানে অনলাইন পত্রিকার জন্য ৫ লাখ টাকা লাইসেন্স ফি, সম্ভবত নীতিমালা লেখকরা এটাকে টিভি বা তার চেয়ে ব্যয়বহুল বা আরও জটিল কোনো গণমাধ্যম মনে করেছেন। খসড়া নীতিমালা যারা তৈরি করেছেন অনলাইন গণমাধ্যম সম্পর্কে তাদের ধারণা কতটুকু এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। এই খাতে সরকারের কোনো আর্থিক প্রণোদনা নেই। তার পরও কেন এতো কড়াকড়ি তা বোধগম্য নয়। শুধু বর্গীর মতো খাজনা আদায়ে মত্ত না হয়ে এই শিশু শিল্পের বিকাশে সরকারি সহায়তা-পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন। আর যদি পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্যই ৫ লাখ আর ২ লাখ করে নেয়ার পরিকল্পনা হয়ে থাকে তাহলে মন্ত্রী-এমপিদের অন্তত এক বছরের বেতন ভাতা কর্তন করা হোক, সচিবগণ সপ্তাহের একদিনের বেতন-ভাতা রাষ্ট্রিয় কোষাগারে জমা দিন। আর এটাই হবে দেশপ্রেমের উজ্বল দৃষ্টান্ত!
দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এখনো অনলাইনের সাথে পরিচিত নয়। তাই অনলাইন পত্রিকাগুলো জন্মকাল থেকে বিজ্ঞাপনের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। যা পাওয়া যায় তা দিয়ে ডোমেইন হোস্টিংয়ের দামও উঠে না। ইন্টারনেট হল অনলাইনের প্রধান কাঁচামাল। এতো বছরেও এটা সরকার সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে এনে দিতে পারলো না। হোস্টিং ও ডোমেইনের দাম পরিশোধ করার জন্য বিদেশে থাকা বন্ধুদের সহায়তা নিতে হয়। অনলাইনে সরকার এখনো বিজ্ঞাপন দেয় না, উপরন্তু সরকার বিজ্ঞাপন ফ্রি দেবার আবদার করেছে। অনলাইন গণমাধ্যম এখনো টাকা কামানোর উৎস হয়ে উঠতে পারেনি, কোন সুদূর ভবিষ্যতে পারবে তা অনিশ্চিৎ। বাংলাদেশের কোনো অনলাইন গণমাধ্যম এখনো লাভের মুখ দেখেনি। দুই/চারটা অনলাইন পত্রিকা বড় কোনো বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠানের প্রচার ও প্রভাব সৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে চালু হয়েছে, সেগুলোর লাভের মুখ দেখা খুব প্রয়োজনীয় নয়। বাকিগুলোও অলাভজনকভাবে কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে, বেশিরভাগ স্থানীয়ভাবে চলছে, নিজের জেলা বা উপজেলাকে তুলে ধরার জন্য, যার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশীরা উপকৃত হচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ' গঠনের ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি ভূমিকা রাখছে এসব অনলাইন গণমাধ্যমগুলো। অনলাইন মাধ্যমগুলোর লাভ তো দূরে থাক খরচের ১০%ও উঠে না, এরা কিভাবে ৭,০০,০০০ টাকা সরকার কে দিবে, কেন দিবে?
অনলাইন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী যেমন (অফিস অবকাঠামো, মোট জনবল ও নির্ধারিত ব্যাংক ব্যালেন্স, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র, সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞতার সনদপত্র এসব বিষয় চাওয়ার কিছুটা যুক্তি থাকলেও নীতিমালায় এমন কিছু বিষয় যুক্ত করা হয়েছে, যা অযৌক্তিক এবং অস্বাভাবিক। সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ‘সকল অনলাইন গণমাধ্যম বাংলাদেশে স্থাপিত সার্ভারে হোস্টিং করতে হবে। ডিএনএসআই (ডোমেইন নেইম সার্ভার ইন্টারনেট প্রটোকল) সম্পর্কে তথ্য মন্ত্রণালয় অবহিত থাকতে হবে।' এমন নীতি মেনে চলতে অসুবিধা নেই। তবে বাংলাদেশে হোস্টিং খরচ তাছাড়া দেশের হোস্টিংগুলোর মান উন্নয়নে যত্নশীল হতে হবে। ‘অনলাইন গণমাধ্যমের অন্য কোন দেশী বা বিদেশী গণমাধ্যম লিংক করা যাবে না।' এমন নীতিও সঠিক নয়। এই খসড়া নীতিমালা বাস্তবায়িত হলেই তো ৩/৪ অনলাইন সংবাদপত্র টিকে থাকবে, ফলে জাতি আরেকটি... দেখতে পারবে।
অনলাইন সংবাদ মাধ্যম আর দৈনিক পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করণের বিষয়ে পৃথক আইন কেন? এটাও বোধগম্য হচ্ছে না। ‘‘অনলাইন সংবাদপত্র যদি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা পালন করে, তাহলে বিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। সকল অনলাইন পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে সে সকল পত্রিকা প্রচলিত প্রিন্ট মিডিয়ার ডিক্লারেশন নীতিমালার আলোকে আরো সহজ শর্তে অনুমোদন দেয়া দরকার। এছাড়া অনলাইন পত্রিকা অনুমোদনের জন্য কোন জামানত কিংবা ফি গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত হবে না।
‘‘তথ্য মন্ত্রণালয় শুধু একটা কাজ করতে পারে। সংবাদপত্র প্রকাশের নীতিমালা অনুসরণ করে আবেদনকারীকে অনলাইন পত্রিকা প্রকাশনার জন্য একটা ‘ডিক্লারেশন' দিতে পারে। প্রকাশক যদি ডিক্লারেশন পাওয়ার যোগ্য হন, তাহলে ছাড়পত্র দিয়েই তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব শেষ'' হতে পারে। আমাদের ধারণা ছিল ডিজিটাল বাংলা গড়তে সরকার অনলাইন মিডিয়ার বিকাশ সাধনে একে প্রণোদনা দিয়ে সহায়তা করা। কিন্তু আমরা একি দেখছি! জানি না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই নীতিমালাটি পড়েছেন কি না? ভালো করে অধ্যয়ন করলে তিনি নিশ্চয় বুঝতে পারবেন তার সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলার' স্বপ্ন বাস্তবায়ন আর এই নীতিমালা স্ববিরোধী। আপনার সরকারের আমলে অবাধ তথ্য প্রযুক্তির সুযোগ দিয়ে দেশকে আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার এক যুগান্তকারী ইতিহাস সষ্টি করলেও অনলাইন মিডিয়ার নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে চরম অজ্ঞতার পরিচয় দেয়া হয়েছে। এজন্য অভিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন। চূড়ান্ত নীতিমালা প্রস্তুতের জন্য মোস্তফা জববার, জাফর ইকবাল প্রমুখের নেতৃত্বে দক্ষ লোক নিয়োজিত করা হোক।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে আইপিআইয়ের একটি প্রতিনিধিদল দেখা করতে এলে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন পুরোপুরি স্বাধীনতা ভোগ করছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়নি।’’ গণমাধ্যমগুলোর বিকাশে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি। সংবাদটির শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রীর নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিটি ছিল, ‘‘বর্তমান সরকার সাংবাদিকদের হয়রানিতে বিশ্বাস করে না। গত তিন বছরে সরকার কোনো সাংবাদিক বা সম্পাদকের বিরুদ্ধে একটিও মামলা করেনি।’’ (সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১২)
বর্তমান সরকারের সময়ে বাংলাদেশে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার' চিত্রটা কেমন? বিভিন্ন সূত্রের তথ্য মতে ২০০৯ সালের ৯ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতা নেয়ার ৩ বছর শাসনকালে ১৪ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং আলোচিত ঘটনাটি হলো মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন নিউজ' এর সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি'র হত্যাকান্ড। সাগর-রুনির হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে অনেক আন্দোলন হয়েছে। যা এখনো চলছে। কিন্তু ফলাফল কিছুই নেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাওয়া হয়েছিল, এর জবাবে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘‘কারো বেডরুম পাহারা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের নয়।’’ এই মহাসত্য ভাষণ থেকেই বুঝা যায় দেশে সংবাদপত্র আর সাংবাদিকতা কেমন নিরাপদে! আমাদের দেশে সাংবাদিক ও সংবাদপত্র ক্ষমতাসীনদের রোষানলে নতুন নয়। শুধু সাংবাদিকরাই ছিলেন তা নয়। সাথে আছেন দেশের প্রখ্যাত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরাও। বিভিন্ন সময়ে তারা সরকারের মদদপুষ্ট মহলের হামলা-হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ সরকারের আমলে দু'টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ হয়েছে। সরকার অনিয়মের অভিযোগ এনে ২০১০ সালের ২৭ এপ্রিল চ্যানেল ওয়ান ও যমুনা টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়। এতে প্রায় সহস্রাধিক মিডিয়াকর্মী বেকারত্বের ফলে চরম মানবেতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এছাড়া আরো একাধিক চ্যানেলের উপর যেকোন সময় বন্ধ হয়ে যাওয়ার খড়গ নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা আছে। সরকারি হস্তক্ষেপে জোর করে দৈনিক পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। ২০১০ সালের ১ জুন সরকার আমার দেশের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। ৪৭ দিন পর আদালতের রায় পেয়ে পুনঃপ্রকাশিত হয় পত্রিকাটি।
২০১১ সালে ৩১ জুলাই গ্রেফতার করা হয় জনপ্রিয় অনলাইন দৈনিক শীর্ষনিউজডটকম ও সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ সম্পাদক একরামুল হককে। তার গ্রেফতারের কয়েকদিনের মাথায় সরকারের চাপে কর্তৃপক্ষ শীর্ষনিউজডটকম বন্ধ করতে বাধ্য হয়। তখনই বাতিল করা হয় সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজ-এর ডিক্লারেশনও। এছাড়া সাংবাদিক সমাজের বারবার অনুরোধের পরও সরকার কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় প্রকাশনার ৬১ বছরের মাথায় এ সরকারের আমলে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের প্রাচীনতম জাতীয় ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভার। গত ১২ মার্চ ২০১২ তে বিরোধী দলগুলো মিলে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার বিরোধী মহাসমাবেশ আয়োজন করে। ঐ সমাবেশ নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি সমাবেশের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিলে প্রায় সব বেসরকারি টিভি তা সরাসরি সম্প্রচারের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু আগের দিন রাতে সব টিভিকেই সরাসরি প্রচার না করার জন্য বলে দেয় সরকার। অন্যরা তা মেনে নিলেও একুশে টিভি, বাংলা ভিশন ও আরটিভি সরকারের সতর্কতা না মানার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে সরকারি কর্তৃপক্ষ সমাবেশ চলাকালিন কয়েকঘণ্টা এই তিন টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার সম্পূর্ণ অবৈধভাবে বন্ধ করে দেয়। সাধারণ গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাতেই বর্তমান সরকারের ‘মিডিয়া দমন' সীমাবন্ধ নেই। বিকল্প গণমাধ্যমও বাদ যায়নি এই দমন-পীড়ন থেকে। সরকারের সমালোচনা ও শেখ হাসিনাকে হুমকি দেয়ার অভিযোগে ২০১০ সালের ২৯ মে বাংলাদেশে সরকার বন্ধ করে দেয়া হয় সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুক। অবশ্য পরে খুলে দিতে বাধ্য হয়। শেষতক কঠোরতার মোড়কে চলছে, অনলাইন গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। জানি না কতটুকু সফল হবে সরকার।
No comments:
Write comments