Flickr

Sunday, 10 October 2010

বিবেকের দংশন ও বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মন্তব্য

Posted by   on

সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতির উপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন যে, দেশ এখন বাজিকরদের হাতে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দলবাজি, নিয়োগবাজি, মতলববাজি, দখলবাজি, ভর্তিবাজির মতো বিভিন্ন বাজির আস্ফালন দেখে দেশের মানুষ এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি প্রশ্ন তুলে আরো বলেছেন যে, যেখানে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী চাকরির জন্য তিন লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয় সেখানে মেধাভিত্তিক প্রশাসন গড়ে তোলার সম্ভাবনা কোথায়?
সাবেক এই বিচারপতি স্বাধীনতার প্রত্যাশা ধ্বংস করা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পদদলন এবং ক্ষমতায় যাবার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ধ্বংসাত্মক তৎপরতার আশ্রয় গ্রহণ ও জনগণের সাথে প্রতারণার বিরুদ্ধেও তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি পরিবারতন্ত্র এবং দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক হানাহানি ও প্রতিহিংসার সংস্কৃতিতে উষ্মা প্রকাশ করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সুশাসন ও জাতীয় সংহতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে বিবেকের দংশন তাকে এই মন্তব্যে উদ্বুদ্ধ করেছে বলে মনে হয়।
বিচারপতি হাবিবুর রহমানের উপরোক্ত অভিমত ও পরামর্শকে আমরা আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। দেশে সুশাসন, সহনশীলতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার এই মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আমাদের ধারণা। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় ব্যর্থতার মূলে রয়েছে লোভ-লালসা, একনায়কতান্ত্রিক প্রবণতা, ফ্যাসিবাদ এবং শাসকদলের দুর্বল জবাবদিহিতা। একটি দল দেশকে তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি বলে মনে করে। তারা আরো মনে করে যে, শাসন করার অধিকার একমাত্র তাদেরই, অন্য কোনও দল বা গোষ্ঠীর নয়। এই প্রবণতা তাদেরকে চরম ফ্যাসিবাদের দিকে ঠেলে দেয়, নির্বাচনে কারচুপি ও পেশীশক্তির ব্যবহার এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বনিদ্বদের নির্যাতনে অনুপ্রেরণা যোগায়। তারা যখন সরকারে থাকে তখন দেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হয়, দেশ তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়, মানুষের জীবন, সম্পত্তি ও সম্মানের নিরাপত্তা থাকে না, প্রতিদ্বনদ্বী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা হামলা, মামলা, হত্যা ও গুমের শিকার হয়। এ প্রেক্ষিতে বিচারপতি হাবিবুর রহমান যথার্থই বলেছেন যে, দেশ এখন বাজিকরদের অধীনে চলে গেছে। এই বাজিকররা হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহের চিহ্নিত চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ভর্তিবাজ, নিয়োগবাজ, দলবাজ, মতলববাজ ও দখলবাজ নেতাকর্মী, তাদের অত্যাচারে দেশের মানুষ এখন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। সরকার তার দলীয় সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে দেশব্যাপী সন্ত্রাসী জঙ্গি খুঁজে বেড়াচ্ছে। সততা, দেশপ্রেম ও নিষ্ঠা তথা আদর্শ দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিদ্বনিদ্বদের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে বানোয়াট অভিযোগে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে তাদের অভিযুক্ত করে বিচারের নামে প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের গত ২২ মাসের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে এক হতাশাব্যঞ্জক চিত্রই ফুটে ওঠে। পাঁচ বছর মেয়াদী এই সরকারের এক-তৃতীয়াংশ মেয়াদ পার হয়ে গেলেও বিরোধীদলের উপর নির্যাতন, লুটপাট এবং ধর্মবিরোধী তৎপরতা ছাড়া তার উল্লেখযোগ্য কোনও সাফল্য জনগণের দৃষ্টিতে পড়ে না। বলাবাহুল্য, বিগত নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করেছিল। এই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ক্ষমতায় গিয়ে তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাঁচটি কাজ করার কথা ছিল। এই কাজগুলো ছিল : এক. দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। সরকার গত ২২ মাসে এক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন জনসভায় দশ টাকা কেজি চাল এবং বিনামূল্যে সার দেয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তার দল এই প্রতিশ্রুতিটি অস্বীকার করেন। চাল, ডাল, তেল, নুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্য এখন সাধারণ মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, চারদলীয় জোট সরকারের আমলের তুলনায় পণ্য ভেদে শতকরা ১২৫ ভাগ থেকে ৩০০ ভাগ বেশি। তাদের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল দুর্নীতি রোধ। এক্ষেত্রে তারা সুনির্দিষ্টভাবে চাঁদাবাজি, ঘুষ, রিসওয়াত, টেন্ডারবাজি, চোরাকারবার প্রভৃতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এ কাজটিও তারা করতে পারেননি। নিজ দলের শীর্ষ নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে আদালতে বিচারাধীন সকল দুর্নীতি এমনকি খুনের মামলাও প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, দলীয় চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ ও দখলবাজদের হাতে দেশকে তুলে দিয়ে এক নৈরাজ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। ফলে দুর্নীতি বেড়েছে এবং দেশে এক অসহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের তৃতীয় অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং ২০১১ সালের মধ্যে ৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে লোডশেডিংকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা। এক্ষেত্রেও তাদের ব্যর্থতা প্রণিধানযোগ্য। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতো দূরের কথা, পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বিদ্যমান উৎপাদন লেভেলও তারা ঠিক রাখতে পারছেন না। বিদ্যুতের নতুন আবাসিক ও শিল্প সংযোগ বন্ধ রয়েছে এবং দেশব্যাপী লোডশেডিং মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এর সাথে যোগ হয়েছে গ্যাসসংকট। ফলে মানুষের জীবন এখন ওষ্ঠাগত।
দারিদ্র্যবিমোচন ও সমাজের অসাম্য দূরীকরণ ছিল ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির চার নম্বর অগ্রাধিকার। এক্ষেত্রেও তাদের ব্যর্থতা সর্বকালের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। খাদ্যসামগ্রীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর ঊর্ধ্বমূল্যের ফলে দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এখন বিরাট হুমকির মুখে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ায় দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধা সাংঘাতিকভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা আছে ক্ষমতাসীন দলের উৎপাতে সাধারণ মানুষ তার নাগাল পাচ্ছে না। ফলে দারিদ্যের মাত্রা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠা তাদের পঞ্চম অগ্রাধিকার ছিল এবং এই প্রতিশ্রুতিতে বলা হয়েছিল যে, তারা দেশে আইনের শাসন কায়েম করবেন, প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করবেন এবং বিচার বিভাগকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবেন এবং পুলিশ বিভাগ নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে। এছাড়াও তারা সন্ত্রাস, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ দমন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করবেন। তাদের প্রতিশ্রুত সুশাসন এখন দুঃশাসনে পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাস দমনের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দলীয় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, দখলবাজরা এখন দেশ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সরকারের সমস্ত সম্পদ এবং মনোযোগ এখন বিরোধীদল দমনের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে বলে মনে হয়। ধর্মীয় জঙ্গিবাদ দমনের নামে তারা এখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুশাসনগুলোকে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। নিরপরাধ আলেম-ওলামা, ইসলামী রাজনীতিবিদ ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা এখন তাদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছেন এবং নির্যাতিত হচ্ছেন। এই অবস্থার অবসান প্রয়োজন। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের অভিমত আমরা মনে করি সরকারকে তার নীতি ও কর্মপদ্ধতি সংশোধনে সহায়তা করবে। আর যদি না করে তাহলে দেশ এবং জাতির জন্য তা যেমন দুঃখজনক হবে তেমনি সরকারের জন্যও তা কল্যাণকর হবে বলে আমরা মনে করি না। কেননা ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে, যারা জনগণের কল্যাণে কাজ করেন না, ব্যক্তি ও দলীয় উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে গিয়ে নির্যাতনের আশ্রয় নেন এবং ইতিহাসের শিক্ষাকে উপেক্ষা করেন তারা ইতিহাসের অাঁস্তাকুড়েই নিক্ষিপ্ত হন।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter