ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা কি ধর্মনিরপেক্ষ?
সাংবিধানিকভাবে ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সে দেশের সংবিধানের ১৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, "The State shall not discriminate against any citizen on grounds only religion, race, caste, sex, place of birth or any of them." বাস্তবে কিন্তু এ ধারাকে নানাভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। অহিন্দুদের মৌলিক নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে হিন্দু নেতারা যে আন্তরিক ছিলেন না, তার প্রমাণ সংবিধান পাস হওয়ার সাথে সাথে এর সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে Directive Principle. এ নীতির মূল কথা হচ্ছে জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার নাগরিক সাধারণ বিধিমালা (Civil Code) তৈরি ও প্রয়োগ করবে। সহজ কথায় এর অর্থ হচ্ছে, সবাইকে হিন্দু বানাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
উল্লেখিত নাগরিক সাধারণ বিধিমালা (Civil Code)'র আওতায় অভিন্ন বিধি চালু করার নামে ইসলামের উত্তরাধিকার, বিবাহ, তালাক প্রভৃতি আইনকে পরিবর্তন করার চেষ্টা অহরহ চলছে। কিন্তু মুসলমানদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সন্যাল ল' বোর্ড'র তীব্র বিরোধিতার কারণে সরকার এ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত করতে পারেনি। তবে আরএসএস, বিশ্বহিন্দু পরিষদ প্রভৃতি হিন্দুত্ববাদী দল এ ব্যাপারে সরকারের উপর চাপ অব্যাহত রেখেছে।
এ নীতির আওতায় ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, চিন্তা-চেতনা এবং ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার প্রতিফলন হয়েছে। এ কারণেই দেখা যায়, সে দেশের পাঠ্যক্রমে রয়েছে হিন্দু সংস্কৃতির নানাবিধ আচার-আচরণ, মূর্তি-পূজার মাহাত্ম্য, পৌরাণিক বীরপুরুষদের কাহিনী ইত্যাদি। পাঠ্য পুস্তকগুলো হিন্দু দেব-দেবীদের কাহিনীতে ভরপুর। শিক্ষা বোর্ডের নির্ধারিত পুস্তকের পাঠে রয়েছে মুসলমানগণ কর্তৃক হিন্দু নারীদের উপর জুলুম-অত্যাচার, ধর্ষণ, বলপ্রয়োগ দ্বারা মুসলমান বানানো ইত্যাদি কল্প-কাহিনী এবং হিন্দু দেবদেবীকে পূজা করার জন্য কচি শিশুদের উৎসাহ দান। এ হচ্ছে সাধারণভাবে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসের বৈশিষ্ট্য। নিবন্ধের আকারকে সীমিত রাখার উদ্দেশ্যে এ আলোচনা কেবল আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকসংঘ) পরিচালিত বেসরকারি শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে সীমিত থাকবে।
আরএসএস'র শিক্ষা কার্যক্রম : আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকসংঘ) হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে বড় হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। এ সংগঠনের রাজনৈতিক ফ্রণ্ট বিজেপি কেন্দ্রে ও বিভিন্ন প্রদেশে সরকার গঠন করেছে। আরএসএস অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে সারা ভারতে প্রতিষ্ঠা করেছে হাজারো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। হিন্দুত্ববাদ প্রচারের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্ব যে সর্বাধিক, এ অনুভূতি থেকেই আরএসএস এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। ভারতের প্রত্যেকটি প্রদেশ ও অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে বিভিন্ন নামের নানা সংগঠন। আরএসএস'র প্রতিষ্ঠিত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশের শিক্ষা বিভাগের কারিকুলাম ও দিক-নির্দেশনা (Guidelines) অনুসরণ করা হয়, তবে শিক্ষার্থীদের মনে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢুকিয়ে দেবার জন্য রয়েছে অতিরিক্ত পাঠ্যপুস্তকসহ শিক্ষা বহির্ভূত বাড়তি নানা কার্যক্রম। এসব পাঠ্যপুস্তক তৈরি করার জন্য রয়েছে ‘সংস্কার ভারতী প্রকাশন' এবং ‘ভারতীয় শিক্ষা সমিতি' নামের বিশেষ প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান। সংঘ পরিবারই এসব প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনা করে থাকে।
বিদ্যাভারতী : আরএসএস ‘বিদ্যাভারতী' নামে স্কুলের এক বিরাট নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের যে শিক্ষা দেয়া হয়, তার দ্বারা তারা হিন্দুত্ববাদের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয় এবং হিন্দুত্বের জন্য ভবিষ্যৎ জীবনে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত হয়। বিদ্যাভারতী স্কুল সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ১৯৫২ সালে। পরবর্তীকালে এসব স্কুল অত্যন্ত ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করেছে। ১৯৯৮ সালে এসব স্কুলের সংখ্যা ছিল ১৯,৭৪১। তখন এসব স্কুলে ছিল চবিবশ লাখ ছাত্র-ছাত্রী এবং সত্তর হাজারেরও অধিক শিক্ষক।১ পরবর্তী বছরগুলোতে এসব সংখ্যা যে অনেকগুণ বেড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। বিদ্যাভারতী স্কুলগুলো বেসরকারি হলেও ভারতের কেন্দ্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড (CBSE) এবং প্রাদেশিক সরকারের শিক্ষা বোর্ডের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। অঞ্চলভেদে বিদ্যাভারতী স্কুলগুলোর জন্য বিভিন্ন নাম রাখা হয়েছে। এসব নামের মধ্যে রয়েছে বিদ্যাভারতী, জ্ঞানভারতী, সরস্বতী মন্দির, গীতা নিকেতন, বিবেকানন্দ বিদ্যালয় ইত্যাদি।
সারা ভারতব্যাপী যেসব বিদ্যাভারতী স্কুল রয়েছে সেগুলোর শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রয়েছে বিদ্যাভারতীর তৈরি ওয়ার্কবুক সিরিজ। এসব পুস্তক অনুসরণ করে শিক্ষা দেয়া হয় সংস্কৃতি জ্ঞান। সংস্কার সম্পর্কে এসব স্কুলে ব্যাপকভাবে আলোচনা করা হয়। সংস্কার শিক্ষার মধ্যে রয়েছে সংস্কৃত ভাষায় প্রার্থনা, শিক্ষকদের আচার্য বলা এবং শিক্ষকদের পদধূলি নেয়া। পরিবেশ সচেতনতা জাগাবার উদ্দেশ্যে স্কুল ক্যাম্পাসে রোপণ করা হয় তুলসী গাছের চারা, যা হিন্দুদের নিকট অতি পবিত্র। স্কুলগুলোর দেয়াল জুড়ে রয়েছে হিন্দুত্ববাদ প্রবর্তকদের চিত্র। এরা হলেন আরএসএস'র আদর্শিক গুরু গোলওয়াকার, আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা হেজওয়ার, আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠাতা শঙ্করাচার্য দয়ানন্দ সরস্বতী, বিবেকানন্দ, শিবাজী, রানা প্রতাপ, সুভাষচন্দ্র বসু, চন্দ্রশেখর আজাদ এবং বল্লবভাই প্যাটেল। লক্ষণীয়, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনটার দেয়ালেই ভারতবাসীর জাতীয় পিতা করমচাঁদ মোহনদাস গান্ধীর চিত্র নেই।
পাঠ্যক্রম
বিদ্যাভারতী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কৃতি জ্ঞান পাঠ্যক্রমের আওতায় যা শিখানো হয় তার কিছুটা নমুনা নীচে দেয়া গেল :
০ সর্বপ্রথম যারা চীন দেশে বসতি স্থাপন করে তারা ছিল ভারতীয়।
০ সর্বপ্রথম যারা ইরানে বসতি স্থাপন করেছিল তারা ছিল ভারতীয়।
০ মূর্তিপূজা বিরোধী ইসলামের অনুসারী হাজার হাজার লোক মুসলিম সম্প্রদায়ের হজ্বকেন্দ্র কাবায় যায় শিবলিঙ্গ পূজা করার জন্য।২
আরও শিখানো হয় :
০ তাজমহলে আসলে কোন কবর নেই, এটা একটি হিন্দু মন্দির।
০ ভারত একটি অতি উন্নত দেশ, এখানে একটি সবুজ বিপ্লব চলছে।
০ ভারতে সবচেয়ে অধিক দুধ উৎপাদন হয়। ডেনমার্কের দুগ্ধ উৎপাদনকারী গাভী ভারত থেকে নেয়া হয়েছে।
০ গাভী আমাদের মা। এদের ভেতর দেবতাগণ অবস্থান করেন। গাভীর মাথা যেদিকে থাকে সেদিক থেকে প্রবাহিত হয় বিশুদ্ধ হাওয়া। গোমূত্র ব্যতীত ক্যান্সারের আর কোন ওষুধ নেই।৩
কিছুদিন পূর্বে বিদ্যাভারতী স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য তৈরি কিছু প্রশ্ন ও উত্তর ছিল নিম্নরূপ :
প্রশ্ন : বাবরী মসজিদকে মসজিদ বলা যাবে না কেন?
উত্তর : কারণ, আজ পর্যন্ত কোনদিন মুসলমানগণ সেখানে নামায পড়েনি।
প্রশ্ন : ১৫২৮ এবং ১৯১৪ সালের মধ্যে কতজন রামভক্ত রামমন্দিরকে মুক্ত করার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন?
উত্তর : তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার জন।
আরও কয়েকটি প্রশ্ন ছিল নিম্নরূপ :
০ কখন রামভক্ত করসেবকগণ শ্রীরাম জন্মভূমির উপরে গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করেছিল?
০ গেরুয়া পতাকা উত্তোলনকালে যেসব তরুণ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল, তাদের নাম উল্লেখ করো।৪
আরএসএস কর্তৃক প্রবর্তিত পাঠ্যপুস্তকের মূল ফোকাস হচ্ছে ধর্মীয় উন্মাদনা এবং বাণী হচ্ছে সাম্প্রদায়িক চেতনার উপর। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি, পৌরাণিক কাহিনী, মুসলমান শাসকদের (কল্পিত) জুলুম-অত্যাচারের কথা এবং তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হিন্দু রাজাদের (কল্পিত) বীরত্বগাঁথা, এসবই হচ্ছে ঐসব পুস্তকের মূল উপাদান। সাম্প্রদায়িকতার যে মূল বাণী এসব পুস্তকে রয়েছে, তরুণ শিক্ষার্থীদের মনে তা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এ কারণেই বলা যায়, বিদ্যাভারতী স্কুলগুলোই হচ্ছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক প্রপাগান্ডার সর্বাধিক কার্যকরী বাহন এবং হিন্দুত্ববাদী ক্যাডার রিক্রুট করার উর্বরতম ভূমি। একটি স্কুল থেকে প্রতি বছর যদি মাত্র পঞ্চাশজন ছাত্রছাত্রী বের হয়, তবুও সংঘপরিবারের আদর্শিক সমর্থকদের সংখ্যা হবে প্রচুর। এ কারণেই বলা হয়, বিদ্যাভারতী স্কুল হচ্ছে সংঘপরিবারের স্বর্ণখনি।৫
বিজেপি শাসনকালে ভারতের উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশের সরকারি স্কুলগুলোকে আরএসএস'র সরস্বতী মন্দির নামক স্কুলে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এসব স্কুলে নতুনভাবে লিখিত ইতিহাত পুস্তক চালু করা হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ের পাঠ্যপুস্তকে, এমনকি গণিত শাস্ত্রেও, হিন্দু মৌলবাদবিষয়ক উপাদান ঢুকানো হয়েছে এবং সংস্কৃতকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর বহু আগে থেকে রাজস্থান প্রদেশে ‘সংস্কার সৌরভ' সিরিজের পুস্তকের মাধ্যমে শিশুদের কচি মনে হিন্দু সাম্প্রদায়িক চেতনা ও মৌলবাদী উন্মাদনা সৃষ্টি করা হচ্ছে। শিক্ষাবহির্ভূত কর্মকান্ডের অধীনে হিন্দু-ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং উৎসবাদিও চালু করা হয়েছে।৬
স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের মুসলিম-বিদ্বেষ কিভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে, তার আরও কিছু নমুনা নীচে দেয়া গেল:
পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্য ‘ইতিহাস গা রহা হায়' পুস্তকে বলা হয়েছে: (মুসলিম) আক্রমণকারীগণ এক হাতে তরবারি ও অপর হাতে কুরআন নিয়ে আসল। অসংখ্য হিন্দুকে তরবারি মুখে জবরদস্তিমূলকভাবে মুসলমান বানানো হল। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম একটি ধর্মীয় যুদ্ধে পরিণত হল। ধর্মের জন্য অগণিত প্রাণ বিসর্জন দেয়া হল। এক যুদ্ধের পর আরেক যুদ্ধে জয়ী হয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে থাকলাম। বহিরাগত শাসকদের আমরা কখনও স্থায়ীভাবে বসতি করতে দেইনি তবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আমাদের ভাইদের (অর্থাৎ, ভারতীয় মুসলমানদের) এখনও হিন্দুধর্মে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে পারিনি।৭
বিজেপি নেত্রী হৃতম্বরার একটি উক্তি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, Wherever you find ruins, Wherever you come upon broken mounments, you will find the signature of Islam, Wherever you find creation, you discover the signature of Hindu.8
অর্থাৎ, যেখানেই কোন ধ্বংসের চিহ্ন দেখবেন, যেখানেই কোন ভগ্ন স্তম্ভ দেখবেন, তাতে পাবেন ইসলামের স্বাক্ষর। আর যেখানেই কোন সৃষ্টি দেখবেন, সেখানেই আবিষ্কার করবেন হিন্দুর স্বাক্ষর।
হিন্দু মৌলবাদীদের উক্ত দৃষ্টিভংগীর প্রতিফলন হয়েছে যুগ যুগ ধরে লালিত ইতিহাসকে বিকৃত করে রচিত নতুন পাঠ্যপুস্তক। ‘গৌরবগাথা' নামক চতুর্থ শ্রেণীর একটি পাঠ্যপুস্তকে অতি পরিষ্কারভাবে লেখা হয়েছে, দিল্লীর কুতুব-মিনারের প্রকৃত নাম ছিল বিষ্ণুস্তম্ভ এবং এর নির্মাতা ছিলেন সমুদ্রগুপ্ত। পরবর্তীতে পৃথ্বীরাজ স্তম্ভটির সংস্কার করেছিলেন। কুতুবুদ্দীন আইবক স্তম্ভটির কিছু অংশকে ভেংগে ফেলে দিয়ে এর নমা পরিবর্তন করেছিলেন। স্তম্ভটি এভাবেই কুতুব-মিনার নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
ইতিহাস বিকৃতির আরেকটি উদাহরণ উপরে উল্লেখিত ‘গৌরবগাথা' নামক পাঠ্য পুস্তক থেকে দিচ্ছি : রাজা পুরুর সাথে আলেকজান্ডারের যে যুদ্ধ হয়েছিল, তাতে আলেকজান্ডার দারুণভাবে মার খেয়েছিলেন। হাতির পদতলে হাজার হাজার যবন (বিদেশী) সেনা পিষ্ট হয়েছিল। হাতিগুলো তাদেরকে উপরে তুলে নেয়া মাত্র মাহুতগণ তরবারির আঘাতে তাদের মাথাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। আলেকজান্ডার নিজে বাধ্য হয়ে রাজা পুরুর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। এ কারণেই পুরু আলেকজান্ডারকে তাঁর রাজ্য ফেরত দিয়েছিলেন।
G. K. Singh'র ভাষায়: The textbooks are written in a highly provocative language and present a 'patriotic' view in which Indian history is southt to be presented as an endless saga of victoties by Indian rulers, who are shown as heroes even if they were on the losing side.9
অর্থাৎ, পাঠ্যপুস্তকগুলো লেখা হয়েছে অত্যন্ত উষ্কানিমূলক ভাষায়। এগুলোতে ‘দেশপ্রেমের' ভাবধারাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যার ফলে ভারতের ইতিহাস হয়ে গিয়েছে ভারতীয় (হিন্দু) শাসকদের অন্তহীন বিজয়লাভের কাহিনী। যেখানে তারা হয়েছে কেবল বীর, এমনকি যে সব ক্ষেত্রে তারা পরাজিত হয়েছিলেন সেখানেও।
পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে ভারতীয় তরুণ সমাজের মনমানসিকতাকে কিভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলা হচ্ছে, তার আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি। মহারাষ্ট্রের বি.এ ক্লাসের ইতিহাস পুস্তকে লেখা হয়েছে: হতে পারে, ইসলামের আগমন আরবদের জন্য ছিল এক আশির্বাদ যার ফলে তারা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে যুদ্ধাভিযান করেছিল। কিন্তু আরবের বাইরের লোকদের জন্য এসব অভিযান ছিল অভিশাপস্বরূপ। কারণ, ইসলামী হানাদারবাহিনী যেখানেই গিয়েছে, তারা কেবল দেশ জয় করেনি। তারা লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে, তাদের ঘরবাড়ি এবং পবিত্র স্থানসমূহ লুটপাট ও ধ্বংস করেছে এবং সর্বোপরি তাদের শিল্পকর্মকে ধ্বংস করেছে। এসব বর্বরতার কারণ কী? এর কারণ হচ্ছে, ইসলাম কেবল নৃশংসতা ও বর্বরতাই শিক্ষা দেয়।১০
বিদ্যাভারতী স্কুলগুলোর শিক্ষা কার্যক্রমে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয় ভারতীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাসের উপর। চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সংস্কৃতি-জ্ঞান শিক্ষার আওতায় অত্যন্ত সুচতুরভাবে শিক্ষার্থীদের সংঘ পরিবারের প্রবর্তিত ও অনুমোদিত ইতিহাস শিক্ষা দেয়া হয়। শুদ্ধিকরণের নামে ভারতের প্রকৃত ইতিহাসকে ব্যাপকভাবে বিকৃত করা হয়েছে। যে দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস পরিবর্তন করা হচ্ছে তা হলো, শিক্ষার্থীদের মনে হিন্দু শাসক ও বীরপুরুষদের কল্পিত গৌরবময় কাহিনী তুলে ধরা এবং মুসলমানদের সম্পর্কে তাদের মনকে তীব্রভাবে বিষিয়ে তুলা।
ভারতীয় সংস্কৃতি শিক্ষা দেবার বেলায় প্রায় প্রতিটি বিষয়েই ভারতীয় গৌরবময় ঐতিহ্যের অস্তিত্ব দেখানো হয়। জনৈক ইংরেজি শিক্ষক বলেন, ‘এ সংক্রান্ত প্রতিটি পাঠেই গীতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের বলি, এমনকি এসব বিদেশী লেখকদের লেখাতেও তোমরা গীতার প্রভাব দেখতে পার।'
বিকৃত ইতিহাস শিক্ষা দেবার সময় শিক্ষকগণ যে কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন না, তা নয়। এ ব্যাপারে জনৈক হিন্দী শিক্ষক বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ভুল ধারণা অপনোদন করা একটি দুরূহ কাজ। এটা তাদেরকে বুঝানো বড়ই কঠিন যে, কুতুব-মিনার মুসলমানরা নির্মাণ করেননি। তারা শুধু মিনারটির গা থেকে দেবদেবীর চিহ্ন মুছে ফেলে দিয়ে তাকে আরবি হরফ দিয়ে ঢেকে ফেলেছিল। আর পৃথ্বীরাজ চৌহানের বোনও মিনারের চূড়ায় বসে যমুনা নদীর দৃশ্য অবলোকন করতেন' অত্যন্ত জোর দিয়ে এ শিক্ষক বলেন, যদি একটি মিথ্যাকে দশবার সত্য বলে চালানো হয়, তবে তা সত্য হতে বাধ্য। অতীতে তা-ই হয়েছে, এমনকি আজকালও তা হচ্ছে।
নবম ও দশম শ্রেণীর হিন্দী পুস্তকে ছাত্রছাত্রীগণ পড়ে: তারা বলে হিন্দুরা গো-খাদক। এটা মিথ্যা। তারা বলে হিন্দুরা গো-খাদক। এটা মিথ্যা। তারা বলে আর্যগণ বহিরাগত। এ ধারণা অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। তারা বলে, গুরূ তেগবাহাদুর ছিলেন লুণ্ঠনকারী, অথচ তিনি জাতির জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন।১১
কোন এক স্কুলের প্রিন্সিপাল বলেন, এসব স্কুলের লাইব্রেরীর পুস্তক নির্বাচনের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। এমন সব বই নির্বাচন করা হয় যাতে রয়েছে, ‘গৌরব কি রাতে, গুলামী কি বাতে নেহি।' যাতে বলা হয়েছে, তাজমহল কোন মুসলমানের কবর নয়, আসলে এটা একটি মন্দির।
১৯৯৮ সালে উত্তর প্রদেশ সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে দৈনিক কাজ শুরু করার আগে প্রদেশের প্রতিটি স্কুলে ভারতমাতার পূজা এবং ‘বন্দে মাতরম' আবৃত্তি করা হবে। তা ছাড়া, ‘রলকলের' সময় Yes Sir, Present Sir না বলে বলতে হবে ‘বন্দে মাতরম'। যেহেতু প্রতিমা-পূজা ইসলামে নিষিদ্ধ, তাই অল ইন্ডিয়া মুসলিম লো বোর্ড সরকারি এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন এবং এ আদেশ অমান্য করার জন্য প্রদেশের মুসলমান শিক্ষার্থীদের নির্দেশ দেন। মুসলমানদের বিরোধিতার কারণে সরকার এ সিদ্ধান্তে কিছুটা পরিবর্তন করে। এ পরিবর্তনের ফলে ‘বন্দে মাতরম' আবৃতি করাকে বাধ্যতামূলক রাখা হয় এবং ভারত মাতার পূজাকে প্রতিদিনের পরিবর্তে বছরে দুই/এক দিনের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়।১২ গুটরাট সরকার ২০০২ সালের জানুয়ারি থেকে প্রতিটি সরকারি স্কুলে ভূমিপূজাকে বাধ্যতামূলক করেছে।১৩
সংস্কারকেন্দ্র
বস্তিবাসী এবং পাহাড়ী পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জন্য আরএসএস'র রয়েছে একটি বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম। এসব অঞ্চলে স্থাপন করা হয়েছে সংস্কার কেন্দ্র নামক বহু প্রতিষ্ঠান, যেখানে এসব এলাকাবাসীকে হিন্দুত্বের চেতনায় দীক্ষা দেয়া হয়। বিশেষত, নেপাল এবং বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের উপজাতিদের এ ধারণা দেয়া হচ্ছে যে, তারা আসলে আদিবাসী নয় বরং বনবাসী এবং হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। বহিরাক্রমণের (অর্থাৎ, মুসলমানদের আক্রমণের) কারণেই তাদের পূর্বপুরুষগণ হিন্দুদের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। আদিবাসী অঞ্চলে ‘একাল বিদ্যালয় ফাউন্ডেশন' নামক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনাধীন রয়েছে হাজার হাজার স্কুল, যেখানে উপজাতি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শিক্ষার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এসব স্কুলে যেসব উপজাতি ও খ্রিস্টান শিক্ষার্থী রয়েছে, তাদের প্রিয় খাদ্য গরুর গোশত। তাদেরকে এটা বুঝানো কঠিন যে, গরুর গোশত খাওয়া ঠিক নয়। এ জন্য তাদেরকে সুন্দরভাবে বলা হয় যে, ‘গাভী হলো আমাদের মাতা। এর ভেতর ভগবান অবস্থান করেন। যে দিকে গাভীর মাথা থাকে সেদিক থেকে যে বায়ু আসে, তা বিশুদ্ধ। গোমূত্র ব্যতীত ক্যান্সারের দ্বিতীয় কোন ওষুধ নেই।
ফ্রি আবাসিক স্কুল
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদ প্রচারের কাজ অত্যন্ত ফলপ্রসূ হওয়ার কারণে আরএসএস প্রতিষ্ঠা করেছে ফ্রি আবাসিক স্কুল। সংঘ পরিবারের এনজিও ‘সেবা ভারতী' কর্তৃক পরিচালিত এ ধরনের বহু স্কুল রয়েছে ভারতের বিভিন্ন স্থানে। সাধারণত তফশিলি সম্প্রদায় ও উপজাতি লোকদের সন্তানকে এসব স্কুলে ভর্তি করা হয়। এসব স্কুলের ব্যয় নির্বাহের অর্থ যোগান দেয় প্রবাসী ভারতীয়গণ। এরা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটিশ যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে বসবাসরত কয়েক মিলিয়ন এবং মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত কয়েক মিলিয়ন ভারতীয় হিন্দু নাগরিক।
বন্দে মাতরম
উপরের আলোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের উত্তর প্রদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন ‘বন্দে মাতরম' আবৃত্তি করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ‘বন্দে মাতরম' শব্দগুচ্ছের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘মাতাকে বন্দনা (পূজা) করি।' দেশাত্ববোধক এ গানটি হচ্ছে একটি রণসঙ্গীত, যা চরম উগ্রবাদী ও মুসলিম-বিদ্বেষী ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন তার আনন্দমঠ উপন্যাসে। মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়কে উস্কানী দেয়া এবং হিন্দু জাতীয়তার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই তিনি এ গান রচনা করেছিলেন। গানটিতে দেশমাতৃকাকে একটি ঐশ্বরিক পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে। পৌত্তলিকতায় পরিপূর্ণ এ গানে হিন্দু দেবতা দূর্গা ও লক্ষ্মীর বন্দনাও করা হয়েছে। এসব কারণে মুসলমানদের নিকট গানটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ভারতীয় পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু করার সময় জাতীয় সঙ্গীতের সাথে এ গানটি গাওয়ার জন্য একবার বিজেপি সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, কিন্তু মুসলমানদের তীব্র বিরোধিতার কারণে তা বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকে।
শিরকের সয়লাবের মুখে ঈমান বাঁচানোর লড়াই
ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাচীন যুগের পৌত্তলিকতার অনুশীলন, পরিচর্যা ও প্রসার যে ব্যাপকভাবে ঘটছে, এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। শিরকের এ সয়লাব মুসলমানদের সন্তান-সন্তুতির আকিদা-বিশ্বাসের জন্য এক বিরাট হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। এ অভিশাপ থেকে বেঁচে থাকার জন্য ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একটি উত্তম উপায় হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন। কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগ তারা যখনই গ্রহণ করেন, তখন সরকারের পক্ষ থেকে নানা প্রকার বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের অর্ধেক অমুসলমান হওয়াকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এদিকে মাদরাসাগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যাপকভাবে অপপ্রচার করা হচ্ছে যে, এসব মাদরাসায় জিহাদ ও সন্ত্রাস শিক্ষা দেয়া হয় এবং এগুলো থেকেই পাকিস্তানের আইএসআই'র লোক নিয়োগ করা হয়। মাদরাসা শিক্ষাকে নিষিদ্ধ করার জন্য বিশ্বহিন্দু পরিষদের তরফ থেকে জোর দাবিও জানানো হচ্ছে।
উপসংহার
ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা একদিকে হিন্দু তরুণদের যেমন চরম সাম্প্রদায়িক ও মুসলিম বিদ্বেষী করে তুলছে, তেমনি মনমানসিকতার দিক থেকে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদেরকে মুশরিক বানাবার ব্যবস্থাও করে রেখেছে। ভারতের শিক্ষা ক্ষেত্রে এই অবস্থা যখন বিরাজ করছে, তখন নতুন শিক্ষা নীতির মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ইসলামকে উৎখাত করার জোর চেষ্টা চলছে। এত্থেকে এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, ভারত ও বাংলাদেশের (নতুন) শিক্ষানীতির লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। আর তা হল, মুসলমান এদেশে থাকুক আর ওদেশে, তাদেরকে শিকড়বিহীন করে বৃহত্তর পৌত্তলিক সমাজের সাথে বিলীন করা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে, বাঙালিত্বের নামে এদেশের নববই শতাংশ মুসলমানকে মুশরিক বানানোর যে কার্যক্রম চলছে, তাকে বাধাহীন করা। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, ভিন্ন সম্প্রদায়ের স্বার্থে প্রণীত নতুন এ শিক্ষানীতি বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মেনে নেবে কিনা।
উল্লেখিত নাগরিক সাধারণ বিধিমালা (Civil Code)'র আওতায় অভিন্ন বিধি চালু করার নামে ইসলামের উত্তরাধিকার, বিবাহ, তালাক প্রভৃতি আইনকে পরিবর্তন করার চেষ্টা অহরহ চলছে। কিন্তু মুসলমানদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সন্যাল ল' বোর্ড'র তীব্র বিরোধিতার কারণে সরকার এ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত করতে পারেনি। তবে আরএসএস, বিশ্বহিন্দু পরিষদ প্রভৃতি হিন্দুত্ববাদী দল এ ব্যাপারে সরকারের উপর চাপ অব্যাহত রেখেছে।
এ নীতির আওতায় ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, চিন্তা-চেতনা এবং ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার প্রতিফলন হয়েছে। এ কারণেই দেখা যায়, সে দেশের পাঠ্যক্রমে রয়েছে হিন্দু সংস্কৃতির নানাবিধ আচার-আচরণ, মূর্তি-পূজার মাহাত্ম্য, পৌরাণিক বীরপুরুষদের কাহিনী ইত্যাদি। পাঠ্য পুস্তকগুলো হিন্দু দেব-দেবীদের কাহিনীতে ভরপুর। শিক্ষা বোর্ডের নির্ধারিত পুস্তকের পাঠে রয়েছে মুসলমানগণ কর্তৃক হিন্দু নারীদের উপর জুলুম-অত্যাচার, ধর্ষণ, বলপ্রয়োগ দ্বারা মুসলমান বানানো ইত্যাদি কল্প-কাহিনী এবং হিন্দু দেবদেবীকে পূজা করার জন্য কচি শিশুদের উৎসাহ দান। এ হচ্ছে সাধারণভাবে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসের বৈশিষ্ট্য। নিবন্ধের আকারকে সীমিত রাখার উদ্দেশ্যে এ আলোচনা কেবল আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকসংঘ) পরিচালিত বেসরকারি শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে সীমিত থাকবে।
আরএসএস'র শিক্ষা কার্যক্রম : আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকসংঘ) হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে বড় হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। এ সংগঠনের রাজনৈতিক ফ্রণ্ট বিজেপি কেন্দ্রে ও বিভিন্ন প্রদেশে সরকার গঠন করেছে। আরএসএস অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে সারা ভারতে প্রতিষ্ঠা করেছে হাজারো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। হিন্দুত্ববাদ প্রচারের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্ব যে সর্বাধিক, এ অনুভূতি থেকেই আরএসএস এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। ভারতের প্রত্যেকটি প্রদেশ ও অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে বিভিন্ন নামের নানা সংগঠন। আরএসএস'র প্রতিষ্ঠিত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশের শিক্ষা বিভাগের কারিকুলাম ও দিক-নির্দেশনা (Guidelines) অনুসরণ করা হয়, তবে শিক্ষার্থীদের মনে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢুকিয়ে দেবার জন্য রয়েছে অতিরিক্ত পাঠ্যপুস্তকসহ শিক্ষা বহির্ভূত বাড়তি নানা কার্যক্রম। এসব পাঠ্যপুস্তক তৈরি করার জন্য রয়েছে ‘সংস্কার ভারতী প্রকাশন' এবং ‘ভারতীয় শিক্ষা সমিতি' নামের বিশেষ প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান। সংঘ পরিবারই এসব প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনা করে থাকে।
বিদ্যাভারতী : আরএসএস ‘বিদ্যাভারতী' নামে স্কুলের এক বিরাট নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের যে শিক্ষা দেয়া হয়, তার দ্বারা তারা হিন্দুত্ববাদের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয় এবং হিন্দুত্বের জন্য ভবিষ্যৎ জীবনে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত হয়। বিদ্যাভারতী স্কুল সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ১৯৫২ সালে। পরবর্তীকালে এসব স্কুল অত্যন্ত ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করেছে। ১৯৯৮ সালে এসব স্কুলের সংখ্যা ছিল ১৯,৭৪১। তখন এসব স্কুলে ছিল চবিবশ লাখ ছাত্র-ছাত্রী এবং সত্তর হাজারেরও অধিক শিক্ষক।১ পরবর্তী বছরগুলোতে এসব সংখ্যা যে অনেকগুণ বেড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। বিদ্যাভারতী স্কুলগুলো বেসরকারি হলেও ভারতের কেন্দ্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড (CBSE) এবং প্রাদেশিক সরকারের শিক্ষা বোর্ডের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। অঞ্চলভেদে বিদ্যাভারতী স্কুলগুলোর জন্য বিভিন্ন নাম রাখা হয়েছে। এসব নামের মধ্যে রয়েছে বিদ্যাভারতী, জ্ঞানভারতী, সরস্বতী মন্দির, গীতা নিকেতন, বিবেকানন্দ বিদ্যালয় ইত্যাদি।
সারা ভারতব্যাপী যেসব বিদ্যাভারতী স্কুল রয়েছে সেগুলোর শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রয়েছে বিদ্যাভারতীর তৈরি ওয়ার্কবুক সিরিজ। এসব পুস্তক অনুসরণ করে শিক্ষা দেয়া হয় সংস্কৃতি জ্ঞান। সংস্কার সম্পর্কে এসব স্কুলে ব্যাপকভাবে আলোচনা করা হয়। সংস্কার শিক্ষার মধ্যে রয়েছে সংস্কৃত ভাষায় প্রার্থনা, শিক্ষকদের আচার্য বলা এবং শিক্ষকদের পদধূলি নেয়া। পরিবেশ সচেতনতা জাগাবার উদ্দেশ্যে স্কুল ক্যাম্পাসে রোপণ করা হয় তুলসী গাছের চারা, যা হিন্দুদের নিকট অতি পবিত্র। স্কুলগুলোর দেয়াল জুড়ে রয়েছে হিন্দুত্ববাদ প্রবর্তকদের চিত্র। এরা হলেন আরএসএস'র আদর্শিক গুরু গোলওয়াকার, আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা হেজওয়ার, আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠাতা শঙ্করাচার্য দয়ানন্দ সরস্বতী, বিবেকানন্দ, শিবাজী, রানা প্রতাপ, সুভাষচন্দ্র বসু, চন্দ্রশেখর আজাদ এবং বল্লবভাই প্যাটেল। লক্ষণীয়, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনটার দেয়ালেই ভারতবাসীর জাতীয় পিতা করমচাঁদ মোহনদাস গান্ধীর চিত্র নেই।
পাঠ্যক্রম
বিদ্যাভারতী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কৃতি জ্ঞান পাঠ্যক্রমের আওতায় যা শিখানো হয় তার কিছুটা নমুনা নীচে দেয়া গেল :
০ সর্বপ্রথম যারা চীন দেশে বসতি স্থাপন করে তারা ছিল ভারতীয়।
০ সর্বপ্রথম যারা ইরানে বসতি স্থাপন করেছিল তারা ছিল ভারতীয়।
০ মূর্তিপূজা বিরোধী ইসলামের অনুসারী হাজার হাজার লোক মুসলিম সম্প্রদায়ের হজ্বকেন্দ্র কাবায় যায় শিবলিঙ্গ পূজা করার জন্য।২
আরও শিখানো হয় :
০ তাজমহলে আসলে কোন কবর নেই, এটা একটি হিন্দু মন্দির।
০ ভারত একটি অতি উন্নত দেশ, এখানে একটি সবুজ বিপ্লব চলছে।
০ ভারতে সবচেয়ে অধিক দুধ উৎপাদন হয়। ডেনমার্কের দুগ্ধ উৎপাদনকারী গাভী ভারত থেকে নেয়া হয়েছে।
০ গাভী আমাদের মা। এদের ভেতর দেবতাগণ অবস্থান করেন। গাভীর মাথা যেদিকে থাকে সেদিক থেকে প্রবাহিত হয় বিশুদ্ধ হাওয়া। গোমূত্র ব্যতীত ক্যান্সারের আর কোন ওষুধ নেই।৩
কিছুদিন পূর্বে বিদ্যাভারতী স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য তৈরি কিছু প্রশ্ন ও উত্তর ছিল নিম্নরূপ :
প্রশ্ন : বাবরী মসজিদকে মসজিদ বলা যাবে না কেন?
উত্তর : কারণ, আজ পর্যন্ত কোনদিন মুসলমানগণ সেখানে নামায পড়েনি।
প্রশ্ন : ১৫২৮ এবং ১৯১৪ সালের মধ্যে কতজন রামভক্ত রামমন্দিরকে মুক্ত করার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন?
উত্তর : তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার জন।
আরও কয়েকটি প্রশ্ন ছিল নিম্নরূপ :
০ কখন রামভক্ত করসেবকগণ শ্রীরাম জন্মভূমির উপরে গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করেছিল?
০ গেরুয়া পতাকা উত্তোলনকালে যেসব তরুণ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল, তাদের নাম উল্লেখ করো।৪
আরএসএস কর্তৃক প্রবর্তিত পাঠ্যপুস্তকের মূল ফোকাস হচ্ছে ধর্মীয় উন্মাদনা এবং বাণী হচ্ছে সাম্প্রদায়িক চেতনার উপর। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি, পৌরাণিক কাহিনী, মুসলমান শাসকদের (কল্পিত) জুলুম-অত্যাচারের কথা এবং তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হিন্দু রাজাদের (কল্পিত) বীরত্বগাঁথা, এসবই হচ্ছে ঐসব পুস্তকের মূল উপাদান। সাম্প্রদায়িকতার যে মূল বাণী এসব পুস্তকে রয়েছে, তরুণ শিক্ষার্থীদের মনে তা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এ কারণেই বলা যায়, বিদ্যাভারতী স্কুলগুলোই হচ্ছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক প্রপাগান্ডার সর্বাধিক কার্যকরী বাহন এবং হিন্দুত্ববাদী ক্যাডার রিক্রুট করার উর্বরতম ভূমি। একটি স্কুল থেকে প্রতি বছর যদি মাত্র পঞ্চাশজন ছাত্রছাত্রী বের হয়, তবুও সংঘপরিবারের আদর্শিক সমর্থকদের সংখ্যা হবে প্রচুর। এ কারণেই বলা হয়, বিদ্যাভারতী স্কুল হচ্ছে সংঘপরিবারের স্বর্ণখনি।৫
বিজেপি শাসনকালে ভারতের উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশের সরকারি স্কুলগুলোকে আরএসএস'র সরস্বতী মন্দির নামক স্কুলে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এসব স্কুলে নতুনভাবে লিখিত ইতিহাত পুস্তক চালু করা হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ের পাঠ্যপুস্তকে, এমনকি গণিত শাস্ত্রেও, হিন্দু মৌলবাদবিষয়ক উপাদান ঢুকানো হয়েছে এবং সংস্কৃতকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর বহু আগে থেকে রাজস্থান প্রদেশে ‘সংস্কার সৌরভ' সিরিজের পুস্তকের মাধ্যমে শিশুদের কচি মনে হিন্দু সাম্প্রদায়িক চেতনা ও মৌলবাদী উন্মাদনা সৃষ্টি করা হচ্ছে। শিক্ষাবহির্ভূত কর্মকান্ডের অধীনে হিন্দু-ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং উৎসবাদিও চালু করা হয়েছে।৬
স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের মুসলিম-বিদ্বেষ কিভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে, তার আরও কিছু নমুনা নীচে দেয়া গেল:
পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্য ‘ইতিহাস গা রহা হায়' পুস্তকে বলা হয়েছে: (মুসলিম) আক্রমণকারীগণ এক হাতে তরবারি ও অপর হাতে কুরআন নিয়ে আসল। অসংখ্য হিন্দুকে তরবারি মুখে জবরদস্তিমূলকভাবে মুসলমান বানানো হল। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম একটি ধর্মীয় যুদ্ধে পরিণত হল। ধর্মের জন্য অগণিত প্রাণ বিসর্জন দেয়া হল। এক যুদ্ধের পর আরেক যুদ্ধে জয়ী হয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে থাকলাম। বহিরাগত শাসকদের আমরা কখনও স্থায়ীভাবে বসতি করতে দেইনি তবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আমাদের ভাইদের (অর্থাৎ, ভারতীয় মুসলমানদের) এখনও হিন্দুধর্মে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে পারিনি।৭
বিজেপি নেত্রী হৃতম্বরার একটি উক্তি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, Wherever you find ruins, Wherever you come upon broken mounments, you will find the signature of Islam, Wherever you find creation, you discover the signature of Hindu.8
অর্থাৎ, যেখানেই কোন ধ্বংসের চিহ্ন দেখবেন, যেখানেই কোন ভগ্ন স্তম্ভ দেখবেন, তাতে পাবেন ইসলামের স্বাক্ষর। আর যেখানেই কোন সৃষ্টি দেখবেন, সেখানেই আবিষ্কার করবেন হিন্দুর স্বাক্ষর।
হিন্দু মৌলবাদীদের উক্ত দৃষ্টিভংগীর প্রতিফলন হয়েছে যুগ যুগ ধরে লালিত ইতিহাসকে বিকৃত করে রচিত নতুন পাঠ্যপুস্তক। ‘গৌরবগাথা' নামক চতুর্থ শ্রেণীর একটি পাঠ্যপুস্তকে অতি পরিষ্কারভাবে লেখা হয়েছে, দিল্লীর কুতুব-মিনারের প্রকৃত নাম ছিল বিষ্ণুস্তম্ভ এবং এর নির্মাতা ছিলেন সমুদ্রগুপ্ত। পরবর্তীতে পৃথ্বীরাজ স্তম্ভটির সংস্কার করেছিলেন। কুতুবুদ্দীন আইবক স্তম্ভটির কিছু অংশকে ভেংগে ফেলে দিয়ে এর নমা পরিবর্তন করেছিলেন। স্তম্ভটি এভাবেই কুতুব-মিনার নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
ইতিহাস বিকৃতির আরেকটি উদাহরণ উপরে উল্লেখিত ‘গৌরবগাথা' নামক পাঠ্য পুস্তক থেকে দিচ্ছি : রাজা পুরুর সাথে আলেকজান্ডারের যে যুদ্ধ হয়েছিল, তাতে আলেকজান্ডার দারুণভাবে মার খেয়েছিলেন। হাতির পদতলে হাজার হাজার যবন (বিদেশী) সেনা পিষ্ট হয়েছিল। হাতিগুলো তাদেরকে উপরে তুলে নেয়া মাত্র মাহুতগণ তরবারির আঘাতে তাদের মাথাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। আলেকজান্ডার নিজে বাধ্য হয়ে রাজা পুরুর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। এ কারণেই পুরু আলেকজান্ডারকে তাঁর রাজ্য ফেরত দিয়েছিলেন।
G. K. Singh'র ভাষায়: The textbooks are written in a highly provocative language and present a 'patriotic' view in which Indian history is southt to be presented as an endless saga of victoties by Indian rulers, who are shown as heroes even if they were on the losing side.9
অর্থাৎ, পাঠ্যপুস্তকগুলো লেখা হয়েছে অত্যন্ত উষ্কানিমূলক ভাষায়। এগুলোতে ‘দেশপ্রেমের' ভাবধারাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যার ফলে ভারতের ইতিহাস হয়ে গিয়েছে ভারতীয় (হিন্দু) শাসকদের অন্তহীন বিজয়লাভের কাহিনী। যেখানে তারা হয়েছে কেবল বীর, এমনকি যে সব ক্ষেত্রে তারা পরাজিত হয়েছিলেন সেখানেও।
পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে ভারতীয় তরুণ সমাজের মনমানসিকতাকে কিভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলা হচ্ছে, তার আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি। মহারাষ্ট্রের বি.এ ক্লাসের ইতিহাস পুস্তকে লেখা হয়েছে: হতে পারে, ইসলামের আগমন আরবদের জন্য ছিল এক আশির্বাদ যার ফলে তারা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে যুদ্ধাভিযান করেছিল। কিন্তু আরবের বাইরের লোকদের জন্য এসব অভিযান ছিল অভিশাপস্বরূপ। কারণ, ইসলামী হানাদারবাহিনী যেখানেই গিয়েছে, তারা কেবল দেশ জয় করেনি। তারা লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে, তাদের ঘরবাড়ি এবং পবিত্র স্থানসমূহ লুটপাট ও ধ্বংস করেছে এবং সর্বোপরি তাদের শিল্পকর্মকে ধ্বংস করেছে। এসব বর্বরতার কারণ কী? এর কারণ হচ্ছে, ইসলাম কেবল নৃশংসতা ও বর্বরতাই শিক্ষা দেয়।১০
বিদ্যাভারতী স্কুলগুলোর শিক্ষা কার্যক্রমে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয় ভারতীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাসের উপর। চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সংস্কৃতি-জ্ঞান শিক্ষার আওতায় অত্যন্ত সুচতুরভাবে শিক্ষার্থীদের সংঘ পরিবারের প্রবর্তিত ও অনুমোদিত ইতিহাস শিক্ষা দেয়া হয়। শুদ্ধিকরণের নামে ভারতের প্রকৃত ইতিহাসকে ব্যাপকভাবে বিকৃত করা হয়েছে। যে দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস পরিবর্তন করা হচ্ছে তা হলো, শিক্ষার্থীদের মনে হিন্দু শাসক ও বীরপুরুষদের কল্পিত গৌরবময় কাহিনী তুলে ধরা এবং মুসলমানদের সম্পর্কে তাদের মনকে তীব্রভাবে বিষিয়ে তুলা।
ভারতীয় সংস্কৃতি শিক্ষা দেবার বেলায় প্রায় প্রতিটি বিষয়েই ভারতীয় গৌরবময় ঐতিহ্যের অস্তিত্ব দেখানো হয়। জনৈক ইংরেজি শিক্ষক বলেন, ‘এ সংক্রান্ত প্রতিটি পাঠেই গীতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের বলি, এমনকি এসব বিদেশী লেখকদের লেখাতেও তোমরা গীতার প্রভাব দেখতে পার।'
বিকৃত ইতিহাস শিক্ষা দেবার সময় শিক্ষকগণ যে কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন না, তা নয়। এ ব্যাপারে জনৈক হিন্দী শিক্ষক বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ভুল ধারণা অপনোদন করা একটি দুরূহ কাজ। এটা তাদেরকে বুঝানো বড়ই কঠিন যে, কুতুব-মিনার মুসলমানরা নির্মাণ করেননি। তারা শুধু মিনারটির গা থেকে দেবদেবীর চিহ্ন মুছে ফেলে দিয়ে তাকে আরবি হরফ দিয়ে ঢেকে ফেলেছিল। আর পৃথ্বীরাজ চৌহানের বোনও মিনারের চূড়ায় বসে যমুনা নদীর দৃশ্য অবলোকন করতেন' অত্যন্ত জোর দিয়ে এ শিক্ষক বলেন, যদি একটি মিথ্যাকে দশবার সত্য বলে চালানো হয়, তবে তা সত্য হতে বাধ্য। অতীতে তা-ই হয়েছে, এমনকি আজকালও তা হচ্ছে।
নবম ও দশম শ্রেণীর হিন্দী পুস্তকে ছাত্রছাত্রীগণ পড়ে: তারা বলে হিন্দুরা গো-খাদক। এটা মিথ্যা। তারা বলে হিন্দুরা গো-খাদক। এটা মিথ্যা। তারা বলে আর্যগণ বহিরাগত। এ ধারণা অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। তারা বলে, গুরূ তেগবাহাদুর ছিলেন লুণ্ঠনকারী, অথচ তিনি জাতির জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন।১১
কোন এক স্কুলের প্রিন্সিপাল বলেন, এসব স্কুলের লাইব্রেরীর পুস্তক নির্বাচনের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। এমন সব বই নির্বাচন করা হয় যাতে রয়েছে, ‘গৌরব কি রাতে, গুলামী কি বাতে নেহি।' যাতে বলা হয়েছে, তাজমহল কোন মুসলমানের কবর নয়, আসলে এটা একটি মন্দির।
১৯৯৮ সালে উত্তর প্রদেশ সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে দৈনিক কাজ শুরু করার আগে প্রদেশের প্রতিটি স্কুলে ভারতমাতার পূজা এবং ‘বন্দে মাতরম' আবৃত্তি করা হবে। তা ছাড়া, ‘রলকলের' সময় Yes Sir, Present Sir না বলে বলতে হবে ‘বন্দে মাতরম'। যেহেতু প্রতিমা-পূজা ইসলামে নিষিদ্ধ, তাই অল ইন্ডিয়া মুসলিম লো বোর্ড সরকারি এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন এবং এ আদেশ অমান্য করার জন্য প্রদেশের মুসলমান শিক্ষার্থীদের নির্দেশ দেন। মুসলমানদের বিরোধিতার কারণে সরকার এ সিদ্ধান্তে কিছুটা পরিবর্তন করে। এ পরিবর্তনের ফলে ‘বন্দে মাতরম' আবৃতি করাকে বাধ্যতামূলক রাখা হয় এবং ভারত মাতার পূজাকে প্রতিদিনের পরিবর্তে বছরে দুই/এক দিনের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়।১২ গুটরাট সরকার ২০০২ সালের জানুয়ারি থেকে প্রতিটি সরকারি স্কুলে ভূমিপূজাকে বাধ্যতামূলক করেছে।১৩
সংস্কারকেন্দ্র
বস্তিবাসী এবং পাহাড়ী পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জন্য আরএসএস'র রয়েছে একটি বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম। এসব অঞ্চলে স্থাপন করা হয়েছে সংস্কার কেন্দ্র নামক বহু প্রতিষ্ঠান, যেখানে এসব এলাকাবাসীকে হিন্দুত্বের চেতনায় দীক্ষা দেয়া হয়। বিশেষত, নেপাল এবং বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের উপজাতিদের এ ধারণা দেয়া হচ্ছে যে, তারা আসলে আদিবাসী নয় বরং বনবাসী এবং হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। বহিরাক্রমণের (অর্থাৎ, মুসলমানদের আক্রমণের) কারণেই তাদের পূর্বপুরুষগণ হিন্দুদের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। আদিবাসী অঞ্চলে ‘একাল বিদ্যালয় ফাউন্ডেশন' নামক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনাধীন রয়েছে হাজার হাজার স্কুল, যেখানে উপজাতি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শিক্ষার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এসব স্কুলে যেসব উপজাতি ও খ্রিস্টান শিক্ষার্থী রয়েছে, তাদের প্রিয় খাদ্য গরুর গোশত। তাদেরকে এটা বুঝানো কঠিন যে, গরুর গোশত খাওয়া ঠিক নয়। এ জন্য তাদেরকে সুন্দরভাবে বলা হয় যে, ‘গাভী হলো আমাদের মাতা। এর ভেতর ভগবান অবস্থান করেন। যে দিকে গাভীর মাথা থাকে সেদিক থেকে যে বায়ু আসে, তা বিশুদ্ধ। গোমূত্র ব্যতীত ক্যান্সারের দ্বিতীয় কোন ওষুধ নেই।
ফ্রি আবাসিক স্কুল
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদ প্রচারের কাজ অত্যন্ত ফলপ্রসূ হওয়ার কারণে আরএসএস প্রতিষ্ঠা করেছে ফ্রি আবাসিক স্কুল। সংঘ পরিবারের এনজিও ‘সেবা ভারতী' কর্তৃক পরিচালিত এ ধরনের বহু স্কুল রয়েছে ভারতের বিভিন্ন স্থানে। সাধারণত তফশিলি সম্প্রদায় ও উপজাতি লোকদের সন্তানকে এসব স্কুলে ভর্তি করা হয়। এসব স্কুলের ব্যয় নির্বাহের অর্থ যোগান দেয় প্রবাসী ভারতীয়গণ। এরা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটিশ যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে বসবাসরত কয়েক মিলিয়ন এবং মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত কয়েক মিলিয়ন ভারতীয় হিন্দু নাগরিক।
বন্দে মাতরম
উপরের আলোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের উত্তর প্রদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন ‘বন্দে মাতরম' আবৃত্তি করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ‘বন্দে মাতরম' শব্দগুচ্ছের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘মাতাকে বন্দনা (পূজা) করি।' দেশাত্ববোধক এ গানটি হচ্ছে একটি রণসঙ্গীত, যা চরম উগ্রবাদী ও মুসলিম-বিদ্বেষী ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন তার আনন্দমঠ উপন্যাসে। মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়কে উস্কানী দেয়া এবং হিন্দু জাতীয়তার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই তিনি এ গান রচনা করেছিলেন। গানটিতে দেশমাতৃকাকে একটি ঐশ্বরিক পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে। পৌত্তলিকতায় পরিপূর্ণ এ গানে হিন্দু দেবতা দূর্গা ও লক্ষ্মীর বন্দনাও করা হয়েছে। এসব কারণে মুসলমানদের নিকট গানটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ভারতীয় পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু করার সময় জাতীয় সঙ্গীতের সাথে এ গানটি গাওয়ার জন্য একবার বিজেপি সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, কিন্তু মুসলমানদের তীব্র বিরোধিতার কারণে তা বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকে।
শিরকের সয়লাবের মুখে ঈমান বাঁচানোর লড়াই
ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাচীন যুগের পৌত্তলিকতার অনুশীলন, পরিচর্যা ও প্রসার যে ব্যাপকভাবে ঘটছে, এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। শিরকের এ সয়লাব মুসলমানদের সন্তান-সন্তুতির আকিদা-বিশ্বাসের জন্য এক বিরাট হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। এ অভিশাপ থেকে বেঁচে থাকার জন্য ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একটি উত্তম উপায় হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন। কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগ তারা যখনই গ্রহণ করেন, তখন সরকারের পক্ষ থেকে নানা প্রকার বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের অর্ধেক অমুসলমান হওয়াকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এদিকে মাদরাসাগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যাপকভাবে অপপ্রচার করা হচ্ছে যে, এসব মাদরাসায় জিহাদ ও সন্ত্রাস শিক্ষা দেয়া হয় এবং এগুলো থেকেই পাকিস্তানের আইএসআই'র লোক নিয়োগ করা হয়। মাদরাসা শিক্ষাকে নিষিদ্ধ করার জন্য বিশ্বহিন্দু পরিষদের তরফ থেকে জোর দাবিও জানানো হচ্ছে।
উপসংহার
ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা একদিকে হিন্দু তরুণদের যেমন চরম সাম্প্রদায়িক ও মুসলিম বিদ্বেষী করে তুলছে, তেমনি মনমানসিকতার দিক থেকে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদেরকে মুশরিক বানাবার ব্যবস্থাও করে রেখেছে। ভারতের শিক্ষা ক্ষেত্রে এই অবস্থা যখন বিরাজ করছে, তখন নতুন শিক্ষা নীতির মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ইসলামকে উৎখাত করার জোর চেষ্টা চলছে। এত্থেকে এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, ভারত ও বাংলাদেশের (নতুন) শিক্ষানীতির লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। আর তা হল, মুসলমান এদেশে থাকুক আর ওদেশে, তাদেরকে শিকড়বিহীন করে বৃহত্তর পৌত্তলিক সমাজের সাথে বিলীন করা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে, বাঙালিত্বের নামে এদেশের নববই শতাংশ মুসলমানকে মুশরিক বানানোর যে কার্যক্রম চলছে, তাকে বাধাহীন করা। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, ভিন্ন সম্প্রদায়ের স্বার্থে প্রণীত নতুন এ শিক্ষানীতি বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মেনে নেবে কিনা।