|
You may fool all
the people some of the time; you can even fool some of the people all the time;
but you can not fool all of the people all the time. অর্থাৎ, সকল মানুষকে কিছু
সময়ের জন্যে বোকা বানানো যায়। কিছু কিছু মানুষকে সকল সময়ের জন্যে বোকা বানানো যায়,
কিন্তু সকল মানুষকে সকল সময়ের জন্যে বোকা বানানো যায় না।– (মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন, ১২
ফেব্রুয়ারি, ১৮০৯—১৫ এপ্রিল, ১৮৬৫)
প্রতিটি মানব
সমাজে বিশৃঙ্খলা, মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি, আর্থ-সামাজিক অবনতির অনেকগুলো
কারণের মধ্যে প্রধান ও অন্যতম কারণ হচ্ছে ‘ধর্ম’ (Religion)। সমাজবিজ্ঞান আর নৃবিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণা
থেকে আমরা জানতে পারি আদিম-অসহায় মানুষদের অজ্ঞতা, কল্পনা আর ভয়ভীতি থেকে একদা
ধর্মের উৎপত্তি; এবং এর যাত্রা শুরু আজ থেকে প্রায় চল্লিশ থেকে পঁচিশ হাজার বছর
আগের মানুষের পূর্বপ্রজাতি নিয়ান্ডার্থাল প্রজাতির মধ্যে। আস্তে আস্তে সময়ের
পরিক্রমায় মানুষের যেমন ক্রমবিকাশ ঘটেছে,
চিন্তাচেতনার নানা
স্বরূপ প্রস্ফুটিত হয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিকে, বিভিন্ন দর্শনে, তেমনি ধর্মীয় চেতনারও
বিস্তৃতি ঘটেছে ভিন্ন ভিন্নরূপে। বিচ্ছিন্ন মানুষ বনে-জঙ্গলে বন্য-হিংস্র পশুর
আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য সংগ্রহের সুবিধার্থে
আর ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা, খরা, অধিক বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, দাবানল
ইত্যাদি) থেকে বেঁচে থাকতে গিয়ে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েছে, গোষ্ঠীবদ্ধ থেকে সমাজবদ্ধ
হয়েছে, সমাজ থেকে রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি করেছে। এই সমাজ কাঠামো টিকিয়ে রাখার জন্য
নিজেদের মতো করে কিছু নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়েছে। সে সময়কার
মানুষের জীবন-জগৎ সম্পর্কে পরিপূর্ণ কিংবা বিশ্লেষণী জ্ঞান না থাকার দরুন তাদের
মধ্যে প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য, বন্য পশুর হাত থেকে নিজেদের
রক্ষার জন্য, পেটপুরে কিছুটা খাবার সংগ্রহের নিশ্চয়তা লাভের উদ্দেশ্যে মানুষের
মধ্যে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রাক-ধর্মীয় চেতনা বিস্তার লাভ করে। প্রাক-ধর্মীয়
চেতনার ধারণার মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ সময়ে আত্মার ধারণা থেকে টোটেমবাদ, টোটেমবাদ থেকে
সর্বপ্রাণবাদ, সর্বপ্রাণবাদ থেকে সর্বেশ্বরবাদ, সর্বেশ্বরবাদ থেকে বহুঈশ্বরবাদ-এ
মোড় নিয়েছে, সমন্বয় ঘটেছে; তবে এগুলো সবসময় সবজায়গায় কখনো একরৈখিক ছিল না।
স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে পরিবর্তিত হয়েছে, সমন্বিত হয়েছে। ধীরে
ধীরে বহুঈশ্বরবাদ থেকে আবার একেশ্বরবাদে পৌঁছেছে। এখন সময় এসেছে ধর্মীয়
একেশ্বরবাদকে ছেঁটে ফেলে নিরীশ্বরবাদের দিকে যাত্রা শুরু করার। এগুলো আজ
নৃবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত সত্য।
বর্তমানে প্রচলিত একেশ্বরবাদ বা বহুঈশ্বরবাদের ধর্মীয় শাস্ত্রগুলো কঠোর
পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিতে রচিত, যেখানে নারী নরকের কীট। শাস্ত্রগুলি স্পষ্ট ঘোষণা
দিয়েই রেখেছে, নারী পুরুষের অধীন, নারী শয়তানের বেশ ধরে আসে, শয়তানের বেশ ধরে যায়!
নারীর কোনো গুণ নেই, তার কাজ শুধু পুরুষদের দূষিত করা ইত্যাদি। বাইবেলে ঈশ্বর
বলেন, তিনি তার মতো করেই মানুষ সৃষ্টি করছেন (God created man in his own image)
(জেনেসিস, ১:২৭)। কিন্তু তৌরাত, ইঞ্জিল, বেদ, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, কোরান
ইত্যাদি বর্তমানে প্রচলিত তথাকথিত ধর্মীয় শাস্ত্রগুলো নির্মোহভাবে পাঠ করলে বোঝা
যায় এগুলো চরম পিতৃতান্ত্রিকতার ধ্বজাধারী পুরোহিত-মোল্লা-পাদ্রিরাই ‘ভগবান’, ‘ঈশ্বর’, ‘আল্লাহ’, ‘গড’-এর মুখ দিয়ে তাঁদের নিজস্ব চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন।
নিজেরা যেভাবে জগতকে দেখতেন, বিচার করতেন, তেমনি কায়েমী স্বার্থ রক্ষা করার তাগিদ
থেকে হোক কিংবা নিজের উদরপূর্তির জন্যই হোক, অথবা নিজের ভয়-ভক্তি-বিশ্বাস থেকে
উদ্ভূত ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে সৎ উদ্দেশ্য থেকেই হোক, তারা শাস্ত্রগুলোর
বক্তব্যকে ‘সৃষ্টিকর্তা’, ‘সর্বশক্তিমান’ ঈশ্বরের নামে
রটিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। যে ধর্ম ছিল একসময় মানুষের কল্পিত আশ্রয়, হতাশ
মানুষদের নিরাপত্তার আচ্ছাদন, সভ্যতার আলো না-পাওয়া, যুক্তি-বিবেকের সমন্বয় ঘটাতে
না-পারা কতিপয় দুর্বল মানুষের ভ্রান্ত অবলম্বনমাত্র; সেই ধর্মই আজকের যুগে গোটা
সমাজের জন্য দানবরূপে দেখা দিয়েছে। শোষিত মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে ক্ষমতায় টিকে
থাকার স্বার্থে, ধর্মকে শাসকগোষ্ঠীর সর্বনাশা ব্যবহার আর বোকার স্বর্গে বাস করা
কতিপয় কাণ্ডজ্ঞানহীন (কিংবা শাসকগোষ্ঠীর সহযোগী অতি ধুরন্ধর) লোকের তথাকথিত
আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা-চর্চার দ্বারা ধর্ম আজ গোটা মানবজাতির জন্যে এক বিরাট
বিষবৃক্ষ। গোটা ধর্মটাই ‘মৌলবাদ’ আর ‘রাজনীতি’র মিশেলে তৈরি; এই
দুটি ধারণা ব্যতীত পৃথিবীতে কোনো ধর্মের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া বর্তমানে দুষ্কর এবং
তা কোনো ধর্ম থেকেই কোনোকালে বিচ্ছিন্ন ছিল না। ফলে অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই
সৃষ্টি হয়েছে নানা মতভেদ, নানা বিভ্রান্তি, নানা বিদ্বেষ। নিজ নিজ ধর্মের প্রসার
আর তালুক দখলের লোভ সবই একসূত্রে গাঁথা; যা মানুষে-মানুষে শুধু জিঘাংসাই বৃদ্ধি
করেছে। ধর্মগুলো তাদের নিজস্ব গ্রন্থে (যেমন হিন্দুদের বেদ, মনুসহিংতা, গীতা
ইত্যাদি, ইহুদিদের ওল্ডটেস্টামেন্ট, খ্রিস্টানদের ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্ট,
মুসলমানদের কোরান-হাদিস) যেসকল সদাচার-ধর্মাচারের সুনির্দিষ্ট নির্ঘণ্ট বয়ান দিয়েছে,
তা’ই আজকের যুগে
ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল উৎস। ধর্মবাদীদের দৃষ্টিতে সেখান থেকে এক চুল পরিমাণ নড়বার
উপায় নেই! প্রতিটি ধর্মই কর্তৃত্ববাদ বা প্রভুত্ববাদ (Authoritarianism)-এর
পরিচায়ক। এক ধর্মের সাথে আরেক ধর্মের এই যে এতো মতভেদ-বিভেদ বিদ্যমান, এগুলোকে
মনীষী রাহুল সাংকৃত্যায়ণের ভাষায় চিহ্নিত করা যায় এভাবে :
“একজন যদি পুবমুখো
হয়ে পূজার বিধান দেয় তো অন্যজন পশ্চিমে। একজন মাথার চুল বড়ো রাখতে বলে তো অন্যজন
দাড়ি। একজন গোঁফ রাখার পক্ষে তো অন্যজন বিপক্ষে। একজন পশুর কণ্ঠনালী কাটার নিয়মের
কথা বলে তো অন্যজন মুণ্ডচ্ছেদ করতে বলে। একজন জামার গলা ডানদিকে রাখে তো অন্যজন
বাঁ-দিকে। একজনের যদি এঁটোকাঁটার বাছ বিচার না থাকে তো অন্যজনের নিজের জাতের
মধ্যেও তেরো হাড়ি। একজন পৃথিবীতে শুধু খোদার নাম ছাড়া আর কিছু থাকতে দিতে রাজি নয়
তো আর-একজনের দেবতার সংখ্যা অগণিত। একজন গো-রক্ষার জন্য জান দিতে রাজি তো অন্য
জনের কাছে গো কোরবানি অত্যন্ত পুণ্যের কাজ।” (দ্রষ্টব্য : তোমার ক্ষয়, পৃষ্ঠা ২০)।
‘বাংলাদেশের সক্রেটিস’ হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ তার
বিখ্যাত প্রবচনগুচ্ছে বলেছিলেন, “হিন্দুরা
মূর্তিপূজারী; মুসলমানরা ভাবমূর্তিপূজারী। মূর্তিপূজা নির্বুদ্ধিতা; আর
ভাবমূর্তিপূজা ভয়াবহ।” অধ্যাপক আজাদ
মুসলমানদের ভাবমূর্তিপূজারী হিসেবে অভিহিত করলেও আরো অনেক আগেই আরবের (উত্তর
সিরিয়া) অন্ধকবি আবু-আল-আলা আল মারি (৯৭৩-১০৫৭) তাঁর ‘লুজুমিয়াত’ কাব্যে মুসলমানদের হজের সময় কাবা শরিফকে বাঁ দিকে রেখে ডাইনে থেকে
বাঁয়ে সাতবার প্রদক্ষিণ করা, কালো পাথরে চুম্বন বা মাথা নোয়ানো, সাফা-মারওয়া
পর্বতের মাঝখানে দৌড়াদৌড়ি করা, মিনাতে ‘শয়তান’ লক্ষ্য করে পাথর
মারা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডকে ইসলামের (মুসলমানদের) ‘পৌত্তলিক ভ্রমণ’ হিসেবেই উল্লেখ
করেছেন। ধর্ম কিংবা ধর্মবাদীদের কাছে একজন ব্যক্তির চিন্তার স্বাধীনতা, কর্মের
স্বাধীনতার মূল্য অত্যন্ত গৌণ; গুরুতর গর্হিত কাজ! গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চাতো
ধর্মবাদীদের কাছে ঈশ্বরদ্রোহের সমতুল্য! আজকের যুগেও স্বাধীনতার সংজ্ঞা এখানে
নির্ধারিত হয় কিংবা নিয়ন্ত্রিত হয় কতিপয় প্রাগৈতিহাসিককালের ধ্যান-ধারণাকে অবলম্বন
করে। বসে থাকা অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মোল্লা-পুরোহিতরা, একজন সাধারণ ব্যক্তির
নিজস্ব বোধ-অনুভূতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেন প্রতিনিয়ত, কিংবা
চাপিয়ে দিতে চান নিজেদের মত। কোনো ব্যক্তির জন্মের পর থেকে তার কী নাম হবে, সে কী
কাপড় পরবে, কাপড় কতটুকু লম্বা হবে, গোড়ালির উপর উঠবে কি উঠবে না, মাথায় টুপি না
টিকি দিবে, সে কী খাবে, গরু না শূকরের মাংস, কাকে বিয়ে করবে, কীভাবে করবে, কোন্
জাত-গোত্র-বর্ণের সাথে আত্মীয়তা হবে, তার সন্তানকে মসজিদ-মাদ্রাসা না গীর্জা
মন্দিরে পাঠাবে, সে মারা গেলে সৎকার কীভাবে হবে, কবর দেয়া হবে, না আগুনে পোড়ানো
হবে ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত বক্তব্যই ধর্মবাদীদের কাছে একমাত্র
অনুসরণ ও অনুকরণের বিষয়; এর বাইরে কোনো ভিন্নমত কোনোভাবেই বরদাশত যোগ্য নয়।
আজ থেকে অনেক আগে
রোমান দার্শনিক-রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত লুসিয়াস আনায়েউস সেনেকা (৪
খ্রিস্টপূর্ব-৬৫ খ্রিস্টাব্দ) ধর্মের স্বরূপ উন্মোচন করেছিলেন এভাবে :
“সাধারণ মানুষের কাছে ধর্ম সত্য বলে
বিবেচিত, জ্ঞানীর কাছে মিথ্যে আর শাসকগোষ্ঠীর কাছে তা শোষনের হাতিয়ার।” আমাদের প্রাচীন ভারতের লোকায়ত দার্শনিক
চার্বাকবাদীরা প্রকাশ্যেই ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা প্রচারিত
ঈশ্বর-স্বর্গ-নরক-আত্মা-পাপ-পূন্য-যজ্ঞ ইত্যাদির বিরোধিতা করে বলতেন: “ন স্বর্গো নাপবর্গো বা নৈবাত্মা
পারলৈাকিকঃ/নৈব বর্ণাশ্রমাদীনাং ক্রিয়াশ্চ ফলদায়িকাঃ”। অর্থাৎ, “স্বর্গ বলে কিছু নেই; অপবর্গ বা মুক্তি বলেও নয়, পরলোকগামী আত্মা
বলেও নয়। বর্ণাশ্রম-বিহিত ক্রিয়াকর্মও নেহাতই নিষ্ফল।” (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা ১৬-১৭)
তারা আরো বলতেন; “যাদের না-আছে
বুদ্ধি, না খেটে খাবার মুরোদ, তাদের জীবিকা হিসাবেই বিধাতা যেন সৃষ্টি করেছেন
অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, তিন বেদ, সন্নাসীদের ত্রিদণ্ড, গায়ে ভষ্মলেপন প্রভৃতি ব্যবস্থা;
চোরেরাই মাংস খাবার মতলবে যজ্ঞে পশুবলির বিধান দিয়েছেন; ব্রাহ্মণদের জীবিকা
হিসেবেই মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে (শ্রাদ্ধাদি) প্রেতকার্য বিহিত হয়েছে। তাছাড়া
এসবের আর কোনো উপযোগিতা নেই। যারা তিনবেদ রচনা করেছেন তাঁরা নেহাতই ভণ্ড, ধূর্ত ও
চোর। জর্ফরীতুর্ফরী প্রভৃতি অর্থহীন বেদমন্ত্র ধূর্ত পণ্ডিতদের বাক্যমাত্র।”
বৈদিক ধর্ম ও
ব্রাহ্মণ সম্পর্কে চার্বাকবাদীদের এরকম চাঁছাছোলা সমালোচনার কারণেই আমরা
রামায়ণ-মহাভারতে পাই চার্বাকদের ‘রাক্ষস’, ‘দুর্বৃত্ত’, ‘কূটকৌশলী’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদেরকে নানাভাবে হেনস্থা করার কথা; তাদের
বইপত্র পুড়িয়ে ফেলা, সমুদ্রে নিক্ষেপ করা, চার্বাকবাদীদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা
ইত্যাদি। প্রতিটি ধর্মের ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, তাদের স্ব-স্ব
ধর্মীয়-সমালোচকগনকে কী নির্দয়ভাবে দলন, দমন পেষণ করা হয়েছে এবং আজ ও করা হচ্ছে।
রোমান সম্রাট সেনেকার বক্তব্য থেকে আরো স্পষ্টভাবে খোলাখুলি বলেছেন, হিন্দুদের
পবিত্র ধর্মগ্রন্থ মহাভারতের কুরু-পাণ্ডবের গুরু ভীষ্ম; তিনি বলেন :
“রাজাদের পক্ষে
ধর্মকর্মের অনুষ্ঠানই লোকসাধারণকে বশীভূত রাখার শ্রেষ্ট উপায়। রাজদণ্ডের প্রভাবেই
পৃথিবীতে ধর্মের প্রচার সম্ভব হয়েছে। রাজার দণ্ডনীতি না থাকলে বেদ ও সমুদয় ধর্ম এক
কালে বিনষ্ট হয়ে যায়। রাজধর্মের প্রাদুর্ভাব না থাকলে কোনো মানুষই নিজ ধর্মের
প্রতি আস্থা রাখে না।” (দ্রষ্টব্য:
ধর্মের ভবিষ্যৎ, পৃষ্ঠা ১১০ (মহাভারতের শান্তিপর্ব, ১২/৫৮-৫৯, ১২/৬৩))।
রাজদণ্ডের সাথে
ধর্মপ্রচারের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, যেসকল ধর্ম
রাষ্ট্র- ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে বা ধর্মবাদীদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়ণ ঘটেছে,
কিংবা রাষ্ট্র বা শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে,
তারাই আজ প্রবল বিক্রমে বেঁচে রয়েছে; আর যারা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ক্ষমতার
কাছাকাছি থাকতে পারেনি তাদের ইতিহাস বা বর্তমান অবস্থা জানতে আজ আমাদের মিউজিয়ামে
যেতে হয়! আলোচনার পরিসর সীমিত রাখার স্বার্থে আমরা এখানে সংক্ষেপে হিন্দু
ধর্মবাদীদের ক্ষমতায়ণের ধারাটি জেনে নেই : এখন পর্যন্ত অর্জিত জ্ঞান থেকে জানা
যায়, হিন্দু ধর্মের প্রবর্তক আর্যরা মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব পনেরশো শতাব্দীর দিকেই
ইরান-আফগানিস্তান অঞ্চল থেকে ভারতীয় অঞ্চলে আসে এবং আস্তে আস্তে এ অঞ্চলের আদি
অধিবাসী ভূমিপুত্র অনার্যদের (শূদ্র) হটিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করতে শুরু করে, এবং
একসময় তারা সফল হয় প্রচার করতে, বেদভিত্তিক বৈদিক ধর্ম। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়
শতাব্দীর দিকে সম্রাট অশোক (২৬৪-২৩৮ খ্রিস্টপূর্ব) রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা বৌদ্ধ
ধর্মের বিস্তৃতি ঘটলে, বৈদিক ধর্মের সাথে তীব্র দ্বন্দের সৃষ্টি হয়। মৌর্য বংশের
পতন, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে সুঙ্গ বংশের অভ্যুত্থান এবং খ্রিস্টীয় পঞ্চম
শতাব্দী সাতবাহন এবং গুপ্ত রাজাদের রাষ্ট্রীয় সমর্থন-পৃষ্ঠপোষকতা এবং ব্রাহ্মণ
শ্রেণীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য বা হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থান
ত্বরান্বিত হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে সেনরাজারা হিন্দুধর্মের গাছে জল-সার দিয়ে
চাষাবাদ করেছেন। কিন্তু যখন রাষ্ট্রশক্তি পুনরায় ইসলাম ধর্মাবলম্বী
আফগান-তুর্কিদের হাতে চলে যায় তখন আবার হিন্দু ধর্মটি অস্তিত্বের সংকটে ভোগতে শুরু
করে। পরে ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে মুসলমানদের হটিয়ে ক্ষমতা দখল করলে কিছুটা হলেও
প্রাণশক্তি ফিরে পায় ব্রাহ্মণ্যবাদের দোসর এই ধর্ম। বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়
গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ভারতে প্রকাশ্যে এবং পরোক্ষভাবে সুবিধা পেয়ে চলছে
হিন্দু ধর্মটি!
ধর্ম আর
ধর্মবাদীদের ব্যাপারে ‘মানবজাতির বিবেক’ বলে পরিচিত ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের
(১৬৯৪-১৭৭৮) একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। দার্শনিক ভলতেয়ার বলেন : ‘The first clergyman was the first sly
rogue that met the first fool…, অর্থাৎ পৃথিবীর
প্রথম পুরোহিত বা মোল্লা ব্যক্তিটি হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম ধূর্ত বাটপাড়, যার মোলাকাত
হয়েছিল প্রথম বোকা-নিবোর্ধ ব্যক্তিটির সঙ্গে; বাটপাড় ব্যক্তিটি নির্বোধ ব্যক্তিকে
বুঝিয়ে-পাড়িয়ে নিজের অনুগত প্রথম ভক্ত বানিয়ে ফেলে। ক্রমে পুরোহিত তথা ধর্মযাজকেরা
নতুন নতুন সুযোগ বুঝলো—সৃষ্টি হল
পুরোহিততন্ত্র (Priestcraft); তারা সহজ সরল মানুষের অন্ধবিশ্বাসের সুযোগে সাধারণ
মানুষ অপেক্ষা উৎকৃষ্টতা ও ডিভিনিটি দাবি করলো। মানুষ তাদের দাবি মেনে নিল, সঙ্গে
সঙ্গে ধর্মযাজকেরা উৎপাদনশ্রম থেকে রেহাই পেল। পুরুষ মৌমাছি (Drone) মধুমক্ষিকার
মতো তারা সাধারণের কষ্টার্জিত সম্পদ শুয়ে-বসে ভোগ করতে লাগলো। মানুষের
ধর্ম-বিশ্বাস, দুর্বলতা, বিশ্বাসপ্রবণতা, সরলতা ইত্যাদিকে হাতিয়ার করে নিজেদের
স্বার্থের অনুকূলে যুগে যুগে অনাচার, রক্তপাত, ডাইনি শিকার, শোষণ, নিপীড়ণ প্রভৃতির
মহড়া চালিয়ে আসছে তথাকথিত ডিভিনিটির দাবিদার ডিভিন পুরোহিতেরা।” (দ্রষ্টব্য : পার্থিব জগৎ, পৃষ্ঠা ১২৭)।
খ্রিস্টধর্ম, পুরোহিত শ্রেণী ও রোমান ক্যাথলিক চার্চকে লক্ষ্য করে ভলতেয়ারের একটি
বিখ্যাত স্লোগান ছিল এরকম, “এই কুখ্যাত
বস্তুটাকে গুড়িয়ে দাও!” (Crush the
Infamy!)| শুধু ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার নয়, পৃথিবীর অনেক দার্শনিক, চিন্তাবিদ,
মনীষী, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি যুক্তিসঙ্গত কারণে কঠোর ভাষায় ‘ধর্ম’কে আক্রমণ করেছেন। ইউরোপের অষ্টাদশ শতকের জ্ঞানবাদী আন্দোলনের
তাত্ত্বিক নেতা Baran D Holbach (১৭২৩-১৭৮৯) বলেছিলেন : ‘We find in all the religions of the
earth, ‘a God of armies’, ‘a jealous God’, ‘an avenging God’, ‘a destroying God’, ‘a God who is pleased with Carnage’… এ জ্ঞানবাদী আন্দোলনের অসীম সাহসী নেতা ও
পণ্ডিত হিসেবে পরিচিত ডেনিস দিদেরো (১৭১৩-১৭৮৪) পোপ তৃতীয় ক্লেমেন্ট রাষ্ট্রের
প্রবল বাধা অতিক্রম করে ষোল খণ্ডে পৃথিবীর প্রথম বিশ্বকোষ বা এনসাইক্লোপেডিয়ার
সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। দিদেরো মনে করতেন, “ধর্মের প্রতি যেকোনো ধরনের সহানুভূতি প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের
সঙ্গে আপোষেরই নামান্তর।” (দ্রষ্টব্য :
ধর্মের ভবিষ্যৎ, পৃষ্ঠা ১৬১)। শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির দিশারী-বস্তুবাদী দার্শনিক
মনীষী কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) ইউরোপের ভাববাদী দার্শনিক হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১)
আইনের দর্শনের পর্যালোচনার ভূমিকাতে বলেন : “ধর্ম হল নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, ঠিক যেমন
সেটা হল আত্মবিহীন পরিবেশের আত্মা। ধর্ম হল জনগণের জন্য আফিম। মানুষের মায়াময় সুখ
হিসেবে ধর্মকে লোপ করাটা হল মানুষের প্রকৃত সুখের দাবি করা। বিদ্যমান হালচাল
সম্বন্ধে মোহ পরিত্যাগ করার দাবিটা হল যে-হালচালে মোহ আবশ্যক, সেটাকে পরিত্যাগ
করার দাবি। তাই ধর্মের সমালোচনা হল ধর্ম যার জ্যোতির্মণ্ডল সেই অশ্রু উপত্যকার (এই
পার্থিব জীবনের) সমালোচনার সূত্রপাত।” (দ্রষ্টব্য : ধর্ম প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা ৩১-৩২)। ‘ঈশ্বর মৃত’ (God is dead) ঘোষণাকারী হিসেবে খ্যাত জার্মান দার্শনিক ফ্রাহিদ্রিশ
ভিল্হ্লেম নীট্শে (১৮৪৪-১৯০০) বলেন: “যারই ধমনীতে ধর্মতাত্ত্বিকের রক্ত আছে তিনি একেবারে প্রথম থেকেই
সবকিছুর প্রতি ভ্রান্ত ও অসৎ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন।… ধর্মতাত্ত্বিক যাকে সত্য বলে মনে করেন তা
অবশ্যই মিথ্যা; এটিই সত্যতা নির্ণয়ের একটি মাপকাঠি।” এলবার্ট হিউবার্ট (১৮৫৯-১৯১৫) বলেন : “ধর্মতত্ত্ব হলো কিছু লোকের একটি বিষয়ের
ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা, যে বিষয়টি তাঁরা বোঝেন না। সত্য কথা বলা
ধর্মতাত্ত্বিকদের উদ্দেশ্য নয়, ধর্মানুসারীদের খুশী করাই তাঁদের উদ্দেশ্য।” (দ্রষ্টব্য : পার্থিব জগৎ, পৃষ্ঠা ১৭)।
আলবেয়ার কাম্যু (১৯১৩-১৯৬০) তাঁর ‘The Rebel’ গ্রন্থে বলেন : ‘One must learn to live and to die and in
order to be a man, to refuse to be a God’. (অর্থাৎ একজনকে বাঁচা এবং মরার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং
মানুষের মতো বাঁচতে হলে ঈশ্বরকে অস্বীকার করতেই হবে।) ভারতীয় বস্তুবাদী পণ্ডিত
রাহুল সাংকৃত্যায়ণ (১৮৯৩-১৯৬৩) ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব’ সম্পর্কে বলেন :
“অজ্ঞানতার অপর নাম
ঈশ্বর”। আমরা আমাদের
অজ্ঞানতাকে স্বীকার করতে লজ্জা পাই এবং তার জন্য বেশ ভারী গোছের একটা নামের আড়ালে
আত্মগোপন করি। সেই ভারী গোছের আড়ালটির নামই ঈশ্বর। ঈশ্বর বিশ্বাসের আরও একটি কারণ
হল বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের অপারগতা ও অসহায়ত্ব। …অজ্ঞানতা আর অসহায়ত্ব ছাড়া আর কোনো কারণ যদি ঈশ্বর বিশ্বাসের পিছনে
থেকে থাকে তা হল ধনী ও ধূর্ত লোকদের নিজ স্বার্থ রক্ষার প্রয়াস। সমাজে চলতে থাকা
সহস্র অন্যায় অবিচারকে বৈধতা দেবার জন্য তারা ঈশ্বরের অজুহাতকে সামনে এনে রেখেছে। …ঈশ্বর বিশ্বাস এবং একটি সহজ সরল ছোটো শিশুর
নিজস্ব বিশ্বাস, বস্তুত একই। পার্থক্য শুধু এইটুকুই ছোটো শিশুটির যুক্তি ভাঙার,
উদাহরণ ইত্যাদির পরিমাণ খুবই সামান্য, আর বড়োদের ওগুলো খানিকটা বিকশিত।” (দ্রষ্টব্য : তোমার ক্ষয়, পৃষ্ঠা ৩৫)।
এখানে একটি বিষয়
পরিষ্কার করা দরকার, এ প্রবন্ধের শিরোনাম ‘বোকার স্বর্গ’। এই শিরোনাম দেখে
ধর্মবিশ্বাসীদের উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ এর দ্বারা ধর্মবিশ্বাসীদের
কোনোভাবেই বোকা বা নির্বোধ বলা হচ্ছে না। ‘বোকার স্বর্গ’ বলতে বোঝানো
হচ্ছে শুধু ‘ধর্ম’ নামক ব্যবস্থাকেই; যার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে
ঈশ্বর/আল্লাহ/ভগবান ইত্যাদি ধারণা, উপাসনার নিয়ম-নীতি, রীতি-নীতি, বৈশিষ্ট্য,
প্রথা ইত্যাদি। সোনার পাথর বাটি বা অশ্বডিম্ব যেমন অসম্ভব, তেমনি ধর্ম নামক
সিস্টেমটি সমাজের জন্য মঙ্গলময়, কল্যাণকর ইত্যাদি মিথ্যে ধারণার খোলস উম্মুচন করে
দেওয়ার জন্যই ‘বোকার স্বর্গ’ নামটি বেছে নেওয়া হয়েছে। এই ‘বোকার স্বর্গ’ ধর্ম নামক ব্যবস্থার কারণেই মানুষ কীরকম
নির্বিবেক, অপরিণামদর্শী, কাণ্ডজ্ঞানহীন, অবৈজ্ঞানিক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে যায়
তার ভুড়িভুড়ি উদাহরণ আমাদের চোখের সামনেই ঘটে চলছে সুদীর্ঘকাল ধরেই। দু-একটি
উদাহরণ দেয়া যাক: খ্রিস্টানরা চতুর্থ শতাব্দীর দিকে প্রাচীন প্যাগান (Pagan)
জার্মানদের ‘সভ্য’ করার নামে, ধর্ম প্রচারের নামে গণহত্যা
চালিয়েছিল বিভৎস পন্থায়। ঐ সময় কোনো কোনো প্যাগান জার্মান গোষ্ঠী ওক গাছের পূজা
করতো। যদি ওক গাছ সভ্য! হওয়া জার্মানদের পুরানো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়, আবার
তাদের পথভ্রষ্ট করে ফেলে, সেজন্য খ্রিস্টধর্মাবলম্বী রোমান সৈন্যরা জার্মানিতে
প্যাগানদের হত্যা করার পাশাপাশি একটি ওক গাছও আস্ত রাখেনি, কেটে সাফ করে দিয়েছিল!
ধর্ম নামক ব্যবস্থা বলবৎ থাকার কারণে কিংবা ধর্মে বিশ্বাস রাখার কারণেই তো
শিক্ষিত-অশিক্ষিত হিন্দুরা নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধি, কাণ্ডজ্ঞান ‘সিন্ধুকে তালা মেরে দিয়ে’ সাপের পূজা করে (মনসা দেবী), নদীর পূজা
করে (গঙ্গা), গরুর পূজা করে, গরুকে নিজের মায়ের সঙ্গে তুলনা করে, গরুর মলমূত্র
দিয়ে ঘরবাড়িসহ নিজেদের পবিত্র করে, বাঁদরের (হনুমান) পূজা করে! মুসলিমরা অন্য
ধর্মের উপাসনার রীতিনীতিকে কঠোর ভাষায় নিন্দা-সমালোচনা করলেও নিজেদের বোধবুদ্ধি,
জ্ঞানকে ‘বগলদাবা’ করে কোরান শরিফের বাণী অনুসরণ করে পরম
পুণ্যের কাজ ভেবে প্রতি বছর সৌদি আরবে হজের সময় কাবা ঘরকে কেন্দ্র করে সাতবার
প্রদক্ষিণ (তাওয়াফ) করে, বহু শতাব্দী প্রাচীন ‘হজরে-আসওয়াদ’ বা কালো পাথরে
(ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেন, এটি একটি উল্কাপিণ্ড) আধ্যাত্মিক উল্লাস লাভের জন্য হুমড়ি
খেয়ে চুমো খায়; হাজিদের কাছে এ-তো শুধু পাথরে চুমু খাওয়া নয়, নবী মুহাম্মদের হস্ত
মুবারকেই চুমু খাওয়া! যদিও খলিফা ওমরের একটি বক্তব্য অনেক মুসলমানের জানা আছে; ওমর
(রাঃ) একদা কাবা ঘরের ঐ কালো পাথরকে সম্বোধন করে বলেছিলেন : “আমি জানি তুমি একটা পাথর ছাড়া কিছুই নও,
মানুষকে সাহায্য করা বা ক্ষতি করার তোমার কোনো ক্ষমতা নেই। যদি আমি আল্লাহর রসুলকে
না দেখতাম তোমায় চুম্বন করতে, আমি তোমাকে কখনো চুম্বন করতাম না; বরং কাবাঘর হতে
বহিষ্কৃত করে তোমাকে দূরে নিক্ষেপ করতাম।” (দ্রষ্টব্য : ফাউন্ডেশন অব ইসলাম, পৃষ্ঠা ৪১ এবং আরজ আলী মাতুব্বর
রচনা সমগ্র ১, পৃষ্ঠা ১০৬)।
ধর্মের ইতিহাস
থেকে আমরা দেখেছি, একশ্বেরবাদী ধর্মগুলো সংগঠিত এবং বিস্তৃত হওয়ার পূর্বে মানুষ
বিভিন্নভাবে প্রাক-ধর্মীয় ‘টোটেম-প্রথা’ (Totemism) অনুসরণ করতো। টোটেম অর্থ
সাধারণভাবে বিশেষ প্রজাতির প্রাণী; তবে বিশেষ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং জড়বস্তুকেও
টোটেম হিসেবে পূজা করা হয়; যেমন হিন্দুরা নির্দিষ্ট ধরনের কালো রঙের পাথরকে ‘শিবলিঙ্গ’ বানিয়ে পূজা করে। ইসলামপূর্ব আরবেও কাবা ঘরের এই পাথরকে পবিত্র মনে
করা হতো, পূজা করা হতো। বর্তমানে হাজিদের কাবা শরিফে তাওয়াফের সময় পাথরে চুম্বন
করা টোটেম-প্রথারই রূপান্তর মাত্র। হজের সময় হাজিরা মাথার চুল কামিয়ে ফেলেন, সাদা
কাপড় (ইহরাম) পরিধান করেন, মক্কার কাবা ঘর থেকে কয়েকশো গজ দূরে সাফা-মারওয়া
পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকা অঞ্চলে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করেন, মিনাতে কংক্রিটের তিনটি
স্তম্ভকে ‘শয়তান’ বানিয়ে সাতবার করে মোট একুশটি ঢিল
ছোঁড়েন। সেই ঢিলে আহত হয়ে এতোদিনে শয়তান মারা গিয়েছে কিনা জানা যায়নি, তবে
শয়তানকে মারতে গিয়ে নিজেদের প্রচণ্ড অন্ধবিশ্বাস আর আবেগের আতিশয্যে সৃষ্ট
হুড়োহুড়ির কারণে পদপিষ্ট হয়ে নিরীহ হাজিরা প্রায়শঃই মারা যান! ২০০৫ সালে ‘শয়তান’কে মারতে গিয়ে অর্ধশতাধিক বাংলাদেশিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের
তিনশতাধিক হাজি মারা গেছেন! হিন্দুরা প্রতি বছর দুর্গা পূজা কালী পূজাতে
মহাধূমধামের সাথে পাঠা বলি দিয়ে থাকেন। বৃটিশ রাজত্বেই এই অঞ্চলে হিন্দু
রাজা-জমিদারেরা এই দুই পূজাতে আয়োজন করে নরবলি দিতেন! বর্তমানে নরবলি দেওয়ার প্রথা
রহিত হয়ে গেলে পূজা উপলক্ষে পাঠা বলি দেওয়া বেশ প্রচলিত। ইহুদি-খ্রিস্টান-ইসলামের
ধর্মগ্রন্থ থেকে জানা যায়, আব্রাহাম বা ইব্রাহিম একটি স্বপ্ন দেখেই অন্ধের মতো
নিজের সন্তানকে কোরবানি দিতে নিয়ে যান, তবে শেষমেশ ঐশীবাণী পেয়ে সন্তানকে কোরবানি
না দিয়ে একটি দুম্বাকে কোরবানি দেন! আব্রাহামের এই বাণী-কর্মকে বিশ্বাস করে সারা
বিশ্বের মুসলমানরা প্রতি বছর কোরবানির ঈদে লক্ষ লক্ষ নিরীহ পশু কোরবানি দিয়ে
থাকেন। এতে তাদের মন বিন্দুমাত্র চিত্তবিচলিত হয় না, মনে কোনো সংশয় জাগে না; এ
অপচয়-বাহুল্য ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয় না। বাংলাদেশের অন্যতম লোকায়ত দার্শনিক আরজ
আলী মাতুব্বর এ নিয়ে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রশ্ন তুলেছিলেন :
“কোরবানি প্রথার
ভিত্তিমূল সুদৃঢ় নয়। একটি স্বপ্নের উপর ভিত্তি করিয়া প্রতি বৎসর লক্ষ লক্ষ পশুর
জীবন নষ্ট হইতেছে। উপন্যাসকে ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করিলে যেরূপ ভুল করা হয়, স্বপ্নের
রূপককে বাস্তব বলিয়া গ্রহণ করিলে সেইরূপ ভুল হইতে পারে না কি?… বর্তমান কোরবানি প্রথায় পশুর কোনো সম্মতি
থাকে কি? একাধিক লোকে যখন একটি পশুকে চাপিয়া ধরিয়া জবেহ করেন, তখন সে দৃশ্যটি
বীভৎস বা জঘন্য নয় কি? মনে করা যাক, মানুষের চেয়ে বেশি শক্তিশালী এক অসুর জাতি
পৃথিবীতে আবির্ভূত হইয়া, তাহারা পুণ্যার্থে মহেশ্বর নামক এক দেবতার নামে জোরপূর্বক
মানুষ বলি দিতে আরম্ভ করিল। তখন অসুরের খাঁড়ার (ছুরির) নীচে থাকিয়া মানুষ কি কামনা
করিবে? ‘মহেশ্বরবাদ ধ্বংস
হউক, অসুর জাতি ধ্বংস হউক, অন্ধ বিশ্বাস দূর হউক’―ইহাই বলিবে না কি?… কোরবানি প্রথায়
দেখা যায় যে, কোরবানিতে পশুর হয় ‘আত্মত্যাগ’ এবং কোরবানিদাতার হয় ‘সামান্য স্বার্থত্যাগ”। দাতা যে মূল্যে পশু খরিদ করেন, তাহাও
সম্পূর্ণ ত্যাগ নহে। কেননা মাংসাকারে তাহার অধিকাংশই গৃহে প্রত্যাবর্তন করে,
সামান্যই হয় দান।… বলির পশুর
আত্মোৎসর্গ না মাংসোৎর্গ? মাংস তো আহার করি এবং আত্মা তো ঐশ্বরিক দান। উৎসর্গ করা
হইল কি?”
কতো সাধারণ প্রশ্ন
অথচ কী তার গভীরতা। নৃতত্ত্ববিদ Robertson Smith তাঁর Religion of The Semites
গ্রন্থে দেখিয়েছেন, পশু কোরবানি প্রথার মূলে রয়েছে মানুষের টোটেম-প্রথার অনুসরণ।
বিশেষ অনুষ্ঠানে বা উৎসবে টোটেম প্রাণীকে হত্যা করে তাকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করার
রীতি বিভিন্ন ধর্মে বেশ প্রচলন রয়েছে। প্রাক ইসলামি আরব-সমাজেও পশু ও মানুষ
কোরবানির ব্যাপক প্রচলন ছিল; কিন্তু, সমাজ বিকাশের সাথে-সাথে এবং সামাজিক প্রয়োজনে
‘মানুষ’ কোরবানির রীতি ধীরে ধীরে রহিত হয়ে গেছে
কিন্তু আদিম সংস্কৃতির কিছু কিছু অবশেষ যেমন পশু কোরবানির প্রথা এখনো টিকে রয়েছে।
Samuel M. Zwemer তাঁর The Influence of Animism on Islam: An account of Popular
Superstitions গ্রন্থে অত্যন্ত চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন মুহাম্মদ একেশ্বরবাদের চর্চার
অংশ হিসেবে ইসলাম ধর্ম তৈরি এবং প্রচার করলেও সম্পূর্ণরূপে সফল হতে পারেননি; তিনি
সময় এবং পরিবেশ দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। ইসলাম ধর্মের প্রচুর উপাদান
যেমন নামাজ পড়ার রীতি, সন্তান জন্মের পর আকিকা করা, শয়তান-ফেরেশতা-জীনের ধারণা,
হজ, কোরবানি ইত্যাদি সর্বপ্রাণবাদী (Animist) রীতি ইসলাম পূর্ব আরবে বহুল প্রচলিত
ছিল এবং এগুলো মুহাম্মদ দু’হাতে ইসলামে
আত্তীকরণ ঘটিয়েছেন; আবার কিছু কিছু বাদও দিয়েছেন। ইসলামপূর্ব আরবে সার্বিয়েনরা ছিল
নক্ষত্র পূজারী, হিমিয়ারবাসীরা সূর্যের উপাসনা করতো, আসাদ ও কিয়ানা গোত্রের লোকেরা
‘আল্লাত’ দেবী হিসেবে চন্দ্রের, ‘মানাত’ দেবী হিসেবে ভেনাসের (শুক্র গ্রহ) ও ‘উজ্জা’ দেবী হিসেবে
সাইরিয়াসের (লুব্ধক নক্ষত্র) পূজা করতো। কোরানে আমরা দেখি, সুরা নজমে স্পষ্টভাষায়
বলা হয়েছে, তিনি শিরা নক্ষত্রের মালিক That He is the Lord of Sirius (the Mighty
Star) “আল্লাহ সাইরিয়াসের
প্রভু।” (সুরা নজম ৫৩,
আয়াত ৪৯)। অনেকগুলির সুরার নামকরণ হয়েছে প্যাগান দেব-দেবীর নামে, যেমন : সুরা ৮৬ ‘তারিকা’ নক্ষত্র দেবতার নাম, সুরা ১১০ ‘নসর’ প্রাচীন
আরব্যগোষ্ঠী হিমিয়ারদের দেবতার নাম, সুরা ৯১ ‘শামস্’ মধ্যপ্রাচ্যে এক
সময় ব্যাপকভাবে পূজিত সৌরদেবীর নাম।
আজকের যুগে
কোরবানির জন্য কেউ কেউ অজুহাত খাড়া করেন, এই কোরবানির ফলে নাকি গরীবের মাংস চাহিদা
মিটবে কিছুটা হলেও। সারা বছর খোঁজ নেই, আর বছরে একবার মাংস খেয়ে গরীবেরা তাদের
শরীরের প্রোটিন-চাহিদা মিটিয়ে ফেলবে। আরো বলা হয়, মুসলিমদের রোজা কিংবা হিন্দুদের
উপবাসের কথা। এ নিয়ে উভয় ধর্মাবলম্বীরা প্রায় সমার্থক ‘বৈজ্ঞানিক যুক্তি’ প্রদান করে থাকেন। মুসলিম বুজুর্গরা
আমাদের জ্ঞান দেন, বছরে একমাস দিনের বেলায় উপবাসী থাকা (সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত
পর্যন্ত খাদ্য-পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকা) স্বাস্থ্যপ্রদ এবং সে কারণে ইসলাম
ধর্মের এই বিধান ‘বিজ্ঞানসম্মত’। এমনও প্রচার আছে যে, রোজা রাখলে নাকি
পেটের আলসার (পেপটিক আলসার, যা মূলত খাদ্যগ্রহণের অনিয়ম থেকে হয়) সেরে যায়! এ
ধরনের অবৈজ্ঞানিক ‘গুজব’ সম্পর্কে ডা. মনিরুল ইসলাম তাঁর ‘বিজ্ঞানের মৌলবাদী ব্যবহার’ গ্রন্থে বলেছেন :
“রোজাকে মোটা দাগে
স্বাস্থ্যপ্রদ বলা মোটেও সঠিক নয়। মানুষের যে জৈবিক ঘড়ি (Biological Clock) থাকে,
রোজার সময় তার হেরফের হয় এবং শরীরে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, অবশ্য অধিকাংশ
মানুষের শরীর এই অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। দিনের বেলায় মানুষ যখন জেগে থাকে এবং
কাজ করে তখন শরীরে ক্ষয়মূলক অপচিতির (Catabolism) মাধ্যমে প্রচুর ক্যালরি (শক্তি)
নির্গত হয়। এ সময় বিশেষত যারা কায়িক পরিশ্রম করেন তাদের পক্ষে খাদ্য গ্রহণ না করা
মোটেও স্বাস্থ্যপ্রদ নয় বরং স্বাস্থ্যহানিকর। বলা হয়, রোজার সময় খাদ্যনালী বিশ্রাম
লাভ করে এবং সবল হয়ে ওঠে। এটি কোনো পরীক্ষিত ব্যাপার নয়। দীর্ঘ উপবাস (৮ ঘণ্টার
উপরে) অন্ত্রের আলসার বা ঘা বাড়িয়ে তোলে। কিছু কিছু পেটের রোগে সাময়িক উপবাস চিকিৎসার
একটি অঙ্গ কিন্তু সে সব রোগগ্রস্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক মানুষের সাথে তুল্য নয়। এবং
এদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় খাদ্যপুষ্টি ও ঔষধ শিরার মাধ্যমে প্রদান করা হয়ে থাকে” (‘বিজ্ঞানের মৌলবাদী ব্যবহার’ পৃষ্ঠা ৩০-৩১)।
আমরা দেখেছি একটি
সমাজের জনসাধারণের পক্ষে অর্থসম্পদজনিত সমস্যার সমাধান মোটেই অসম্ভব নয়। বর্তমানে
পশ্চিমের অনেক দেশেই বিভিন্ন ধরনের সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে সেই সমস্যার
সমাধান করতে পেরেছে; কিন্তু সমাজে ধর্মকর্তৃক সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা, মারামারি, সংঘাতের
সমাধান আদৌ লক্ষণীয় নয়। এক ধর্ম অন্য ধর্মকেই শুধু ঘৃণা করে না, নিজেদের মধ্যেও
প্রচণ্ড ঝগড়া, ফ্যাসাদ, আগ্রাসন, হত্যা, হুমকি, উন্মাদনা সৃষ্টি করে। হিন্দু,
মুসলিম, খ্রিস্টান কেউই দাবি করতে পারবে না যে, তাদের মধ্যে ধর্মীয় মতানৈক্য,
দলাদলি, মারামারি নেই।
যারা এই সত্যকে
অস্বীকার করেন তারা অবশ্যই প্রতারক বা জ্ঞান-পাপী। ধর্মের প্রতি মোহমুক্ত হয়ে
তাকালেই দেখা যায়, ধর্মকে যতটা মানবিক হিসেবে প্রচার করা হয়, আসলে তা নয়। ধর্মটা
মনুষ্যত্বের নয়, কতিপয় গোষ্ঠীর-গোত্রের। ধর্ম মানুষের মাঝে একতা গড়ে তোলে না, আনে
বিদ্বেষ; যা আসলে উগ্র, হিংস্র, জংলী আচরণে পর্যবসিত হয়। কোনো ধর্মই গণমানুষের
সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখায়নি; শাসকগোষ্ঠীর তাবেদারি করা ছাড়া।
‘মানব মুক্তি’র যে ধর্মীয় ফর্মুলা দেয়া হয়ে থাকে তা
কল্পিত, পারলৌকিক, ইহজাগতিক নয়, তাই গরীব মানুষ আরো গরীব হয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান,
নিয়ম-নীতি, কঠোরভাবে পালন ও অনুসরণ করেও; আর ধনী আরো ধনী হয়—ভণ্ডামির মধ্যে লালিত হয়ে। ধর্মের মূলে
কুঠারাঘাত পড়েছে বলেই ধর্মবাদীরা মাঝেমাঝে সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে মিলে-মিশে থাকার
কথা ঘোষণা করেন, শান্তিবাদী হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করে্ন, সেটা আসলে মস্ত বড়
শুভঙ্করের ফাঁকি; কারণ জগতে ধর্মের নামে, এক ধর্ম অন্য ধর্মের ওপর নিজের
শ্রেষ্ঠত্ব-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে মানব সভ্যতার গোড়া থেকেই অগণিত, অসংখ্য মানুষ
খুন করেছে এবং আজও সে ধারা অব্যাহত আছে। হাজার বছর ধরে টিকি, দাড়ি আর ক্রুশের
বাড়াবাড়িতে সাধারণ মানুষ নাজেহাল। ফলে ধর্ম আজ মানব-সভ্যতার কলঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে।
হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্রাহ্মণ্যবাদীরা কোনো হিন্দু স্বামী মারা গেলে তার বিধবা
স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলে ‘সতী’ বানা্তেন, ইংরেজ
আমলে আইন করে এ ধর্মীয় বর্বর প্রথাকে রুখতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কেইনের
(Kane) ‘ধর্মশাস্ত্রের
ইতিহাস’ (আট খণ্ড)
গ্রন্থের ‘সতী’ বিষয়ক কয়েকটি অধ্যায়ে বেশ কিছু পরিসংখ্যান
তুলে ধরেছেন। এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৮১৫ সাল থেকে ১৮১৮ সাল পর্যন্ত মাত্র
তিন বছরে নারীর সতীত্ব (?) রক্ষার ধুয়া তুলে কেবলমাত্র বাংলোতেই (যা তখন বারাণসী
পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল) ২৩৬৬ জন নারীকে আগুনে পুড়িয়ে সতী বানানো হয়েছিল, যার মধ্যে
কলকাতাতেই সতীদাহের সংখ্যা ১৮৪৫। আর ১৮১৫ থেকে ১৮২৮ সাল পর্যন্ত বাংলাতে ৮১৩৫ জন
নারীকে আগুনে পুড়িয়ে সতী বানিয়েছিলেন ঠাকুর-পুরহিতগণ। এটা কি গণহত্যা নয়? এ কি
জঘন্য-বর্বর ধর্মীয় রীতি নয়? বীভৎস ধর্মীয় রীতিনীতির প্রতি ইঙ্গীত করে Pascal বলেছেন
Men never do evil so completely and cheerfully as when they do it from
religious conviction. হিন্দু নারীরা কি স্বামীর মৃত্যুর পর স্বেচ্ছায় স্বামীর
চিতায় ওঠে সহমরণে যেতেন? মোটেই তা নয়। ঐতিহাসিকগণ জানিয়েছেন, কয়েকটি ব্যতিক্রম
ছাড়া, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সদ্য বিধবা নারীকে উত্তেজক পানীয় পান করিয়ে কিংবা নেশা
জাতীয় দ্রব্য শুঁকিয়ে অজ্ঞান করে কিংবা অর্ধচেতন অবস্থায় স্বামীর চিতায় তুলে দেওয়া
হতো। এ বিষয়ে ভারতের অন্যতম মানবতাবাদী লেখক ড. সুকুমারী ভট্টাচার্য তার ‘প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন :
“সদ্যবিধবা নারী নববধূর মতো সাজে, তার
শ্রেষ্ঠ পোষাক পরে, সিঁদুর, কাজল, ফুলমালা, চন্দন, আলতায় সুসজ্জিত হয়ে ধীরে ধীরে
সে চিতায় ওঠে, তার স্বামীর পা দুটি বুকে আঁকড়ে ধরে কিংবা মৃতদেহকে দুই বাহুতে
আলিঙ্গন করে, এইভাবে যতক্ষণ না আগুন জ্বলে সে বিভ্রান্তির সঙ্গে অপেক্ষা করে। যদি
শেষ মুহূর্তে বিচলিত হয় এবং নীতিগত, দৃশ্যগতভাবে ছন্দপতন ঘটে তাই শুভাকংখীরা তাকে
উত্তেজক পানীয় পান করান। এমন কি পরে যখন আগুনের লেলিহান শিখা অসহনীয় হয়ে ওঠে,
পানীয়র নেশা কেটে যায়, তখন যদি সেই বিধবা বিচলিত হয়ে পড়ে, ‘সতী’র মহিমা ক্ষুণ্ন হবার ভয় দেখা দেয় তখন সেই শুভাকাংখীরাই তাকে বাঁশের
লাঠি দিয়ে চেপে ধরে যদি সে চিতা থেকে নেমে আসতে চায়, প্রতিবেশী, পুরোহিত,
সমাজকর্তা সকলেই অনুষ্ঠানের সাফল্যের জন্য অতিমাত্রায় সাহায্য করতে চায়। তারা গান
করে, ঢাক বাজায় এতো উচ্চ জয়ধ্বনি দেয় যে সতী যা কিছু বলতে চায় সবই উচ্চনাদে ঢেকে
যায়।” (প্রাচীন ভারতে
নারী ও সমাজ, পৃষ্ঠা ১৪৭)।
বর্তমানকালের
তথাকথিত ‘মডারেট’ হিন্দুরা স্বীকার করতে চাইবেন না, অথবা
অনেকেই জানেন না তাদের ধর্মগ্রন্থে ‘স্বামী মারা গেলে বিধবাকে স্বামীর চিতায় আগুনে পুড়ে মরে সতী হওয়ার’ সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। প্রমাণ চাই তো,
দেখুন ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১৮নং সূক্তের ৭ নং শ্লোক(১০/১৮/৭) শ্লোকটির ইংরেজি
হচ্ছে : Let these women, whose husbands are worthy and are living, enter the
house with ghee (applied) as collyrium (to their eyes). Let these wives first
step into the pyre, tearless without any affliction and well adorned. অথর্ববেদে
রয়েছে, “আমরা মৃতের বধু
হবার জন্য জীবিত নারীকে নীত হতে দেখেছি।” (১৮/৩/১,৩)। পরাশর সংহিতায় পাই, “মানুষের শরীরে সাড়ে তিন কোটি লোম থাকে, যে নারী মৃত্যুতেও তার
স্বামীকে অনুগমন করে, সে স্বামীর সঙ্গে ৩৩ বৎসরই স্বর্গবাস করে।” (৪:২৮)। দক্ষ সংহিতার ৪:১৮-১৯নং শ্লোকে
বলা হয়েছে, A sati who dies on the funeral pyre of her husband enjoys an eternal
bliss in heaven. (যে সতী নারী স্বামীর মৃত্যুর পর অগ্নিতে প্রবেশ করে সে স্বর্গে
পূজা পায়)। এই দক্ষ সংহিতার পরবর্তী শ্লোকে (৫:১৬০) বলা হয়েছে, “যে নারী স্বামীর চিতায় আত্মোৎসর্গ করে সে
তার পিতৃকুল, স্বামীকুল উভয়কেই পবিত্র করে।” যেমন করে সাপুড়ে সাপকে তার গর্ত থেকে টেনে বার করে তেমনভাবে সতী তার
স্বামীকে নরক থেকে আকর্ষণ করে এবং সুখে থাকে। ব্রহ্মপুরাণ বলে, “যদি স্বামীর প্রবাসে মৃত্যু হয়ে থাকে তবে
স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর পাদুকা বুকে ধরে অগ্নিপ্রবেশ করা।” (প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ, পৃষ্ঠা ১৪০)।
মহাভারতের মৌষল পর্বে আমরা দেখি, ভগবান কৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর চার স্ত্রী
রুক্কিণী, রোহিণী, ভদ্রা এবং মদিরা তাঁর চিতায় সহমৃতা হয়েছিলেন। এমন কি বসুদেবের
আট পত্নীও তাঁর মৃত্যুর পরে সহমরণে গিয়েছিলেন। ব্যাসস্মৃতি বলছে, চিতায় বিধবা নারী
তার স্বামীর মৃতদেহে আলিঙ্গন করবেন অথবা তার মস্তকমুণ্ডন করবেন। (২:৫৫)। ষষ্ঠশতকের
বরাহমিহির তার বৃহৎসংহিতায় বলেন, “অহো নারীর প্রেম কি সুদৃঢ়, তারা স্বামীর দেহ ক্রোড়ে নিয়ে অগ্নিতে
প্রবেশ করে।” (৭৪:২৩)। এ
কুযুক্তি শুধু বরাহমিহির কেন, আজকের একুশ শতকের কতিপয় পুরোহিত-ঠাকুর গর্বভরে ঘোষণা
করেন, “নারী তার স্বামীর
প্রতি ভালোবাসার জন্যই সহমরণে যায়; এ হিন্দু নারীর বৈশিষ্ট্য, ঐতিহ্য, মমত্ব,
স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসার দুর্লভ উদাহরণ।” ঠাকুর-পুরহিতের প্রচলিত ভণ্ডামিপূর্ণ বক্তব্যের স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন
ড. সুকুমারী ভট্টাচার্য; তিনি বলেন : “বৃহৎসংহিতার যুগ থেকেই সমাজ এই অতিকথা ঘোষণা করে আসছে যে নারী তার
স্বামীর প্রতি ভালোবাসার জন্যই সহমরণে যায়। এই মিথ্যার অবসান হওয়া উচিৎ। যদি
স্বামীর প্রতি প্রেমে এক নারী আত্মহত্যা করে তবে কেন আজ পর্যন্ত কোনো স্বামী তার
স্ত্রীর চিতায় আত্মহত্যা করেনি? এ তো হতে পারে না যে আজ পর্যন্ত কোনো স্বামী তার
স্ত্রীকে ভালোবাসেনি। যদি সতীদাহের ভিত্তি হতো প্রেম, তবে আমরা অবশ্যই কিছু কিছু
ঘটনা দেখতে পেতাম যেখানে মৃত স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীও সহমরণে গেছেন। কিন্তু তা হয়নি,
এ বিষয়ে কোনো শাস্ত্রীয় বিধিও নেই। সুতরাং মূল ব্যাপার হল স্বামীর স্বার্থে
স্ত্রীর সম্পূর্ণ আত্মবিসর্জন; আর সতীদাহ এই আজীবন নাটকেরই পঞ্চমাংকের শেষ দৃশ্য।” (দ্রষ্টব্য : প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ,
পৃষ্ঠা ১৪৮) হিন্দু ধর্মের বেদ-গীতা, মনুসংহিতা, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত,
পুরাণপাচালি ইত্যাদির মধ্যে এতো জাতপাতের বৈষম্য, বর্ণভেদ, গোত্রবিভেদ, ধর্মভেদ,
ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতা, নারীর প্রতি কুসংস্কার, বিরূপ
ধারণা, ভয়, ঘৃণা, জংলী আইন-কানুন একই ধর্মাবলম্বী বলে ঘোষণা করেও শূদ্র-বৈশ্যর
প্রতি ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের শ্রেণীবিভেদের বিপুল সমাহার আর সরব উপস্থিতি ও চর্চা
দেখেই হয়তো উপনিবেশিক ভারতবর্ষে বাংলার রেনেসাঁসের অন্যতম প্রাণপুরুষ বলে পরিচিত
হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) ও তাঁর অনুসারীরা Athenium নামক মাসিক
পত্রিকায় সোচ্চারে ঘোষণা দিয়েছিলেন, If there is anything that we hate from the
bottom of our heart, it is Hinduism.
ইহুদিরা অগণিত
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদেরকে গলা কেটে হত্যা করেছেন, আগুনে পুড়িয়েছে্ন, তা-তো
ধর্মগ্রন্থেই লিখিত আছে; খ্রিস্টানরা স্বধর্মাবলম্বী-বিধর্মী অগণিত নারীদের ‘ডাইনি’ ঘোষণা দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের
অন্তর্গত তৌরাত শরিফের Exodus -এর ২২:১৮ নং শ্লোকে সরাসরি বলা হয়েছে, Thou shalt
not suffer a witch to live (কোনো জাদুকারিণীকে বেঁচে থাকতে দেবে না।) স্প্রেঙ্গার
হিসাব দিয়েছেন, তৌরাত শরিফের এই আয়াতের উপর ভিত্তি করে নব্বই লক্ষ ভূতগ্রস্ত
ব্যক্তিকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। তিন থেকে চার বছরের শিশুরাও পর্যন্ত খ্রিস্টান
মৌলবাদীদের নৃশংস ও বীভৎস কালো হাত থেকে রেহাই পায়নি। (দ্রষ্টব্য-The Malleus
Maleficarum (The Witch Hammer) of Heinrich Kramer and James Sprenger.) আসলে কেউ
কোনদিন ভূতগ্রস্ত হয়নি, ভূত বলতে কোন জিনিষ কোন কালেই ছিলনা, আজও নেই। কুমারী (!)
মাতা মেরির কোলে ছোট্ট, সুন্দর, শুভ্র, নিষ্পাপ যিশুর ছবি দ্বারা যেসব খ্রিস্টান
মিশনারিজরা শান্তিবাদী-করুণাময় যিশুর রূপ তুলে ধরতে চান, তাদের গালে চপোটাঘাত
করেছেন যিশু নিজেই :“আমি দুনিয়াতে
শান্তি দিতে এসেছি এ কথা মনে করো না। আমি শান্তি দিতে আসিনি বরং আমি এসেছি মানুষের
বিরুদ্ধে মানুষকে; ছেলেকে বাবার বিরুদ্ধে, মেয়েকে মায়ের বিরুদ্ধে, স্ত্রীকে
শাশুড়ীর বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে।” (মথি, ১০:৩৪-৩৫)
ব্ল্যাসফেমির (ঈশ্বর নিন্দা) কারণে যে কোনো ব্যক্তিকেই পাথর ছুড়ে হত্যার নির্দেশ
দেওয়া আছে এই তৌরাত শরিফের Leviticus (লেবীয়)-এর ২৪:১৬ নং শ্লোকে! বাইবেলের এসব
নিষ্ঠুর, আগ্রাসী আয়াতের উপর নির্ভর করে যুগে যুগে কত যে স্বাধীন চিন্তাবিদ, লেখক,
মুক্তচিন্তার অধিকারী ব্যক্তিকে নির্যাতন, বন্দীত্ব বরণ, অঙ্গচ্ছেদ, আগুনের ছেঁকা
ইত্যাদির শিকার হতে হয়েছে তার কোনো ইয়াত্তা নেই। এমন কি, যে ইহুদিরা একসময়
খ্রিস্টানদের উপর গণহত্যা চালিয়েছিল, সেই ইহুদিরাও খ্রিস্টানদের হাতে কম
নির্যাতনের শিকার হতে হয়নি। খ্রিস্টানদের অত্যাচার, নির্যাতনের ভয়ে ইহুদিদের
যাযাবরের জীবন বেছে নিতে হয়। পঞ্চম শতাব্দীতে পোপ প্রথম লিও বাইবেল সম্পর্কে
ভিন্নমতপোষণকারী স্বাধীন চিন্তাবিদদের ধরে এনে মৃত্যুদণ্ড দিতেন। নবম শতাব্দীতে
রোমান ক্যাথলিক চার্চ এক লক্ষ ভিন্নমতাবলম্বীকে হত্যা করে; দুই লক্ষ লোককে দেশ থেকে
বিতাড়িত করে। ফ্রান্সের আবেলার পীয়রকে (১০৭৯-১১৪২) ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে কারাগারে
নিক্ষেপ করা হয়, তাঁর পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা হয়, তার সব রচনা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
ফ্লোরেন্সের স্যা ভোনা রোলা (১৪৫২-১৪৯৮) খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের স্বেচ্ছাচারিতার
বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ছিলেন, গির্জার সংস্কার দাবি করেছিলেন; এজন্য তাঁকে
গ্রেফতার করে কারাগারের মধ্যে যাতা কাঁধে তুলে দিয়ে পৈশাচিক পন্থায় নির্যাতন
চালানো হয়। স্পেনের মনীষী মাইকেল সারভেন্টাস খ্রিস্টানদের ‘ট্রিনিটী’ Trinity অস্বীকার করেছিলেন এবং ঈশ্বরের পুত্রের অবিনশ্বরত্বকে অবিশ্বাস
করেছিলেন, যার জন্য তাঁকে খোঁটায় বেঁধে শ্বাসরোধ করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়।
যাজকতন্ত্রের নিন্দা করায় আলেকজান্ডার লেটনকে (১৫৬৮-১৬৪৯) বেত্রাঘাত করা হয়, তাঁর
নাক-কান কেটে ফেলা হয়। খ্রিস্টান পোপ নবম গ্রেগরি ১২৩৩ খ্রিস্টাব্দে
ধর্মীয়-বিরুদ্ধবাদীদের (বাইবেল সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণকারী) খুঁজে বের করে তাদের
ফাঁসিতে কিংবা আগুনে পুড়িয়ে হত্যার জন্য ‘ইনকুইজিশন’ বা ধর্মীয় বিচার
সভার প্রবর্তন করেন। এই ইনকুইজিশনের মাধ্যমে খ্রিস্টধর্মবিরোধী যেকোনো ব্যক্তিকে
নির্যাতনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিওরদানো ব্রুনোকে
(১৫৪৮-১৬০০) ধর্মান্ধদের হাত থেকে বাঁচতে সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডে
পালিয়ে বেড়াতে হয়। অবশেষে তাঁকে গ্রেফতার করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে ধর্মান্ধের
দল। বৃদ্ধ গ্যালিলিও গ্যালিলিকে অত্যাচারের শিকার হতে হয়, তাকে গির্জার সামনে
নতজানু হয়ে পাদ্রীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়। দার্শনিক স্পিনোজাকে সপ্তদশ
শতাব্দীর প্রথম দিকে আমস্টারডামের সিন্যাগগ (ইহুদিদের ধর্মমন্দির) সমাজচ্যুত করে,
নির্বাসন দেয়। বার্থৌলোমিউ লির্গেটকে (১৫৭৫-১৬১১) নিজের চিন্তা প্রচারের অভিযোগে
আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়; ১৬১৮ সালে স্যার ওয়াল্টার রাওয়ালকেও ধর্মবিরোধিতার কারণে
হত্যা করা হয়। জানা যায়, তাকে শিরোচ্ছেদ করার পর তাঁর মাথাকে মমি করে তাঁর স্ত্রীর
কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তুলুজে লুচিলিও ভানিনিকে ১৬১৯ সালে ‘নাস্তিকতার’ অপরাধে জিহ্বা ছিড়ে ফেলা হয়, পরে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। মুহাম্মদ
(দঃ) ও তাঁর অনুসারীগণ খ্রিস্টান ও ইহুদিদের ওপর সীমাহীন জুলুম অত্যাচার চালিয়ে,
তাদের ভিটে-বাড়ি থেকে উৎখাত করে, নির্যাতন চালিয়ে, তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে,
ধর্মান্তরিত করে, তাঁদের শিশু, নারী-পুরুষ, সহায়-সম্পত্তিসহ গোটা দেশ দখল করে
নিয়েছিলেন; ইসলামি ইতিহাস এর গর্বিত সাক্ষী। খ্রিস্টান ধর্মের মতো ইসলামও
ধর্মত্যাগী কিংবা নিরীশ্বরবাদীদের শাস্তি হিসেবে যুগ যুগ ধরে মৃত্যুদণ্ড প্রদান
করে আসছে। এমন কি রোমান ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক ‘ইনকুইজিশন’ প্রতিষ্ঠার অনেক
আগেই ইসলামি রাষ্ট্রে এই ধরনের ব্যবস্থা বহুল প্রচলিত ছিল। নবী মুহাম্মদ নিজেই ‘মুরতাদ’-‘কাফের’ এবং তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে ভীষণ
কঠোর ছিলেন এবং এ ধরনের প্রচুর লোককে তিনি কঠোর হস্তে দমন করেছেন কিংবা প্রাণদণ্ড
দিয়েছেন। নবী মুহাম্মদের আদেশ ছিল, কোনো লোক ধর্মদ্রোহী বা ধর্মান্তরিত হলে শাস্তি
হিসেবে কখনো আল্লাহর শাস্তি ‘আগুনে পুড়িয়ে
হত্যা করবে না’, তবে তরবারি দিয়ে
হত্যা করতে পারো। হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করছেন-
Allah’s Apostle sent us in a mission and said, “If you find so-and-so and so-and-so, burn
both of them with fire.” When we intended
to depart, Allah’s Apostle said, “I have ordered you to burn so-and-so, and
it is none but Allah Who punishes with fire, so, if you find them, kill them.”(সহিহ বোখারি শরিফ, ভলিউম ৪, বুক ৫২,নম্বর
২৫৯)
কিন্তু অন্য
হাদিসে প্রমান আছে,হযরত আলি কয়েকজন লোক ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে পুনরায় তাদের ধর্মে
ফিরে গেলে, তাদেরকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিলেন।
ইকরিমা থেকে
বর্ণীত, হজরত ইবনে আব্বাসের (রাঃ) কাছে যখন সংবাদ পৌছিল যে হজরত আলী (রাঃ) কয়েকজন
মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন,ইবনে আব্বাস বললেন- আলীর জায়গায় আমি হলে অবশ্য
তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে মারতাম না,তবে নিশ্চয়ই হত্যা করতাম যেহেতু নবীজীনির্দেশ
দিয়েছেন ধর্মত্যাগীদেরকে হত্যা করতে। (সহিহ বোখারি শরিফ, ভলিউম ৪, বুক ৫২, নম্বর
২৬০)
অন্য একটি হাদিসে
আছে-
একজন ইহুদি লোক
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, কিছুদিন পর সে আবার ইহুদি ধর্মে ফিরে যায়; এ খবর শুনে নবী
মুহাম্মদ হজরত মুয়াদ বিন জবলকে নির্দেশ প্রদান করেন ঐ লোকটিকে হত্যা করতে। মুয়াদ
বিন জবল ঐ লোকটিকে হত্যা করতে গেলে সাহাবী আবু মুসা (রাঃ) ‘ধর্মদ্রোহী’ লোকটিকে গ্রেফতার করে হাতে-পায়ে বেড়ি পড়িয়ে নিয়ে আসেন; এরপর মুয়াদ
বিন জবল ঐ লোকটিকে হত্যা করেন। (দ্রষ্টব্য : সহি বোখারি, ভলিউম ৯, বুক ৮৪, নম্বর
৫৮ এবং ভলিউম ৯,বুক ৮৯, নম্বর ২৭১)।
৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে
আব্বাসী খলিফা মেহদি ইবন মনসুর সর্বপ্রথম ‘মিহনা’(Mihna) নামের
একটি ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন; যার কাজ ছিল খোঁজে খোঁজে মুরতাদ, কাফেরদেরকে
শাস্তি দেওয়া। বর্তমানযুগে সারা বিশ্বে ‘ইসলাম’ নানা কারণেই
আলোচনার বিষয়; স্বীকার করতে হবে ৯/১১-এর পর এ আলোচনার গতি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইসলামকে নতুন যুগের আলোয় পুনর্মূল্যায়ণ করা হচ্ছে। কালোপযোগী করার লক্ষ্যে সময়ের
পরিবর্তনে যুগে যুগে ইহুদি, হিন্দু , খ্রিস্টান ধর্মসমূহে, কিছুটা হলেও পরিবর্তন
এসেছে। মেয়েশিশু হত্যা, ডাইনি হত্যা, সতীদাহ প্রথা, বিধবা প্রথা, আজ আর নেই।
গির্জায় নারী নেত্রীত্ব, সমকামী বিবাহ আজ আইনতঃ বৈধ। এমনকি আধুনিক বিজ্ঞানের সামনে
মাথানত করে ধর্মযাজকেরা তাদের ধর্মগ্রন্থের ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন এবং ক্ষমা
চেয়েছেন তাদের পুর্বসূরীগণকর্তৃক অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যার জন্যে। খ্রিস্টান জগতের
ধর্মগুরু পোপ দ্বিতীয় জন পল বিগত দু’হাজার বছরে খ্রিস্টান জনগণ, শান্তি, প্রেম, মানবাধিকারের বিরুদ্ধে
যেসব পাপ করেছেন, তার জন্য ঈশ্বরের মার্জনা ভিক্ষা করেছেন। কিন্তু ইসলাম ঠিক তার
বিপরীত; অমানবিক, সন্ত্রাসী আদি অবস্থানে আজও অনড় অটল। জেহাদের মাধ্যমে
বিধর্মীদের-অবিশ্বাসীদের হত্যা করে গোটা বিশ্বটাকে ‘দারুল-ইসলাম’ বানানোর
প্রচেষ্টাকে ইসলামি বিশ্ব খুবই মর্যাদার সঙ্গে দেখে। ইসলাম অস্বীকার করে বিজ্ঞানের
ধারা প্রমাণিত সত্যকে, সংস্কার-পরিবর্তন ইসলামে ক্ষমার অযোগ্য মহাপাপ।
বাংলাদেশের অত্যন্ত
সুপরিচিত মনীষী, নির্ভিক নিরীশ্বরবাদী বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ তাঁর ‘গণতন্ত্র, সংস্কৃতি, স্বাতন্ত্র ও
বিচিত্র-ভাবনা’ গ্রন্থে বলেছিলেন
: “মানুষের
অবচেতন-অস্পষ্ট জীবন চেতনার মূলে রয়েছে ভয়-বিস্ময়, ভক্তি-ভরসা ও কল্পনা। এতে বলতে
গেলে জ্ঞান-বুদ্ধি যুক্তির ঠাঁই সংকীর্ণ ও নিতান্ত সামান্য।” বিধাতা, গড, আল্লাহ্ ভগবান বা ঈশ্বরকে
চেনার জন্য আমাদের বাংলাদেশেরই ড. আহমদ শরীফের ‘গণতন্ত্র, সংস্কৃতি, স্বাতন্ত্র্য ও বিচিত্র-ভাবনা’, আরজ আলী মাতুব্বরের ‘সত্যের সন্ধানে’, মোস্তফা মীরের ‘উল্লেখ্য’, ড. হুমায়ুন আজাদের ‘আমার অবিশ্বাস’, মাহমুদ শামসুল
হকের ‘নারী কোষ’,শফিকুর রহমানের ‘পার্থিব জগৎ’ ও ‘হিউম্যানিজম’—এই ক’টি বই-ই যথেষ্ট। উপরোল্লিখিত লেখকদের যুক্তি, তত্ত্ব-তথ্যবহুল লেখা
বা তাদের কোনো প্রশ্নের উত্তর, তাদের দার্শনিক জিজ্ঞাসার সমাধান, ধর্মে-বিশ্বাসীরা
কোনোদিন দিতে পারেন নি, বিভ্রান্তি ছড়ানো ছাড়া। ধর্ম মানুষকে-সমাজকে-জাতিকে পেছনের
দিকে টানে। যে কোনো ধর্মাবলম্বীর ধার্মিক হওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো-স্বধর্মকে
Superior শ্রেষ্ট আর অন্য ধর্মকে Inferior নিকৃষ্ট মনে করা। কোরান শরিফের ১০৯
নম্বর সুরা ‘কাফেরুনে’র শেষ আয়াত ‘লাকুম দ্বী-নুকুম ওয়ালিয়াদ্বীন’ অর্থাৎ তোমার ধর্ম তোমার,আমার ধর্ম আমার, আর বাইবেলের Love thy
neighbours (প্রতিবেশীকে ভালোবাসো), হিন্দুদের ‘অতিথি নারায়ণ’-এর মতো কাল্পনিক
অসাড় মিথ্যা শ্লোক-বাণী প্রত্যেক ধর্মগ্রন্থেই কম-বেশি আছে। কিন্তু আসল সত্য হচ্ছে
বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন নেই চর্চাও নেই। ভারতে হিন্দু মৌলবাদীরা প্রত্যেক বছরই
মুসলিম, খ্রিস্টানদের পাইকারিহারে হত্যা করছে, তাদের উপাসনালয় ভেঙে-গুড়িয়ে দিচ্ছে,
বাংলাদেশে মুসলিমরা হিন্দুদের, আহমদিয়াদের কিংবা পাহাড়ী আদিবাসীদের উপর যেভাবে
অত্যাচার, হত্যা, ধর্ষণ, পরিকল্পিত গুম-সন্ত্রাস পরিচালনা করছে। বাংলাদেশে
আহমদিয়াদের সমস্ত ধর্মীয় প্রকাশনা বিএনপি-জামাতের চার দলীয় জোট সরকার ২০০৪ সালে
নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, পাকিস্তানে মুসলিমরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী খ্রিস্টানদের উপর
যেসব সংঘবদ্ধ আক্রমণ পরিচালনা করছে, সেটা ডিঙিয়ে এখন শিয়া-সুন্নি-আহমদিয়া
দ্বন্দ্ব, একে অপরের উপাসনালয়ে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে নিজেদের ঈমানের পরীক্ষা
দিচ্ছে। তা দেখে যে কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক-বিবেক, জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের তথাকথিত
পবিত্র ধর্মগুলোর শান্তিময় বাণীর উপর আস্থা রাখা অত্যন্ত কষ্টকর ও দুঃসাধ্য বটে।
আধুনিক যুগের শিক্ষিত, মডারেইট মুসলমানদের অনেকে আশা পোষণ করেন আরেকটা
আকবরের ‘দ্বীন-ই এলাহি’ ধর্ম আবিষ্কার করার। আরবের রাজতন্ত্র তারা মানেন
না, ৯/১১ তে ইহুদি-নাসারা, খ্রিস্টানদের অকাল মৃত্যুতে তাদের প্রাণ কাঁদে, তারা
হিন্দু-মুসলিম ভাই-ভাই শ্লোগান দেন, তারা আফগানিস্থানের বৌদ্ধমূর্তি ভাঙা সমর্থন
করেন না। তারা সিলেটের শ্রীমঙ্গলের কমলগঞ্জ গ্রামের ব্যাভিচারীনী নূরজাহানের পক্ষ
নিয়ে মৌলানা মান্নানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন। হুমায়ুন আযাদ, রাজীব খুন হওয়ায় মৌন
আক্ষেপ করেন। ব্যাভিচারী নরনারীকে পাথর মেরে হত্যা, চোরের হাত কাটা তারা সমর্থন করেন
না। ইসলাম সংস্কার করবেন ভাল কথা, ১৫শো বছর পূর্বের সমাজ আর আজকের সমাজ, সমাজের
চাহিদা প্রয়োজন, বিশ্বসংস্কৃতি সমান নয়। ১৫শো বছর পূর্বের সব কিছু মেনে চলা সম্ভব
নয়। অন্যান্য ধর্মগুলোর সংস্কার সম্ভব হয়েছে কিন্তু ইসলাম যে সংস্কার সম্ভব নয় তা
এই তথাকথিত মডারেইট মুসলমানগণ ভাল করেই জানেন। তাদের নাকের ডগার উপর দিয়ে, তাদের
চোখের সামনে ধর্মের নামে খুন-খারাবী, ধর্ষণ হত্যা জিহাদের নামে জ্বালাও-পুড়াও চলছে
অবিরাম। আজও ফতোয়া দেয়া হয় পাথর মারা হয়, নারীকে তেঁতুল বলা হয়, শ্রমিক মহিলাদের
বেশ্যা বলা হয় কিন্তু মডারেইট মুসলমানগন এ ব্যপারে সম্পূর্ণ নীরব নিশ্চুপ।
জিহাদীরা ইসলামী সন্ত্রাস, ফতোয়াবাজরা শরিয়ার ফতোয়া ধর্মগ্রন্থ হাতে নিয়েই করছে।
প্রকাশ্যে খোলা মাঠে কোরান হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে জিহাদ ও শরিয়া আইনের প্রচারণা
করছে। মডারেইট মুসলমানগণ তা দেখেও না দেখার, শোনেও না শোনার ভান করেন। তার মা’নে হলো তারাও ইসলামী সন্ত্রাস সমর্থন করেন তবে
মুখে নয় অন্তরে। দেখা যাক ইসলামি সন্ত্রাস আর শরিয়ার অমানবিক আইনের উৎসটা কোথায়;
হাদিস সাক্ষী দিচ্ছে, নবী মুহাম্মদ (দঃ) তাঁর জীবদ্দশায় ‘রজম’ (পাথর মেরে
হত্যা) নামক শরিয়ার আইন দ্বারা বহু ব্যাভিচারী নরনারীকে পাথর মেরে হত্যা করেছিলেন।
দু একটি প্রমাণ নিচে দেয়া হলো;
হজরত আস্ শাবানী থেকে বর্ণীত- ‘আমি আব্দুল্লাহ
বিন আবু আউফকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আল্লাহর রাসুল
কি ‘রজম’ বিধান (পাথর মেরে হত্যা) কারো উপর প্রয়োগ
করেছিলেন’? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি
বললাম, সুরা ‘নুর’ নাজিল হওয়ার আগে না পরে। তিনি বললেন, তা জানিনা’। (সহি বোখারি শরিফ, ভলিউম ৮, বুক ৮২, নম্বর ৮০৪)
হজরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ আল্ আনসারী বর্ণনা করছেন-
‘বনি আসলাম গোত্রের একজন
বিবাহিত লোক এসে নবীজীর কাছে চারবার বল্লো যে, সে একজন নারীর সাথে অবৈধ সঙ্গম
করেছে। নবীজী তাকে পাথর মেরে হত্যার আদেশ দিলেন, যেহেতু সে বিবাহিত ছিল। পাথর
মারায় আমিও অংশ গ্রহন করেছিলাম। মুসালা’য় তাকে পাথর
মারা শুরু হলো। পাথরের আঘাত সহ্য করতে না পেরে লোকটি দৌড়ে পালাতে থাকলো, আমরা তাকে
দৌড়ায়ে আল্ হারা’য় ধরে ফেললাম এবং সেখানেই
তাকে পাথর মেরে হত্যা করলাম’। (সহি বোখারি
শরিফ, ভলিউম ৮, বুক ৮২, নম্বর ৮০৫)।
ঘঠনাটি ৮১৪ নং হাদীসে হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) একই ভাবে বর্ণনা করেছেন। পাথর
মেরে হত্যার বিধান সম্পর্কিত হাদিস জানতে দেখুন : সহি বোখারি শরিফ, ভলিউম ৮, বুক
৮২, নম্বর ৮০৩, ৮০৪, ৮০৫, ৮০৬, ৮০৭, ৮০৮, ৮০৯, ৮১০, ৮১২, ৮১৩, ৮১৪, ৮১৫, ৮১৬)।
প্রশ্ন উঠতে পারে ব্যাভিচারী নরনারীকে পাথর মেরে হত্যা কি কোরান সমর্থিত? এর উত্তর
খোঁজার আগে আমরা আরো একটি হাদিস জেনে নেই। দীর্ঘ এ হাদিসটিতে হজরত ওমর (রাঃ) হজরত
আবুবকরের (রাঃ) খেলাফত গ্রহনকালের কিছু ঘঠনা উল্লেখ করেছেন, আমরা সংক্ষিপ্তাকারে ‘রজম’ (পাথর মেরে
হত্যা) সম্পর্কিত অংশটুকু ইংরেজিতে তুলে দিলাম।
Narrated ibn’ Abbas: ‘Umar sat on the pulpit and when the callmakers
for the prayer had finished their call, Umar stood up and having glorified and
praised Allah as He desereved, he said, ‘Now then, I am
going to tell you something which Allah has written for me to say, Allah sent
Mohammed with the Truth and revealed the Holy Book to him, and among what Allah
revealed, was the verse of the ‘Rajam’ (the stoning to death of married person) who
commits illegal sexual intercourse, and we did recite this Verse and understood
and memorized it. Allah’s Apostle did carry out the
punishment of stoning and so did we after him. (Bukhari Sharif, Volume 8, Book
82, Number 817)
কোথায় সেই আয়াত? কে কবে আয়াতটি হাইজ্যাক করলেন? উৎসাহী কোন পাঠক যদি
আয়াতটির সন্ধানে কোরান তছনছ করতে চান, তাহলে বলে রাখি যে, কেউ কেউ বলেছেন ঐ আয়াতটি
নাকি হজরত আয়েশার বালিশের নিচে থেকে বের করে এক দাঁড়িওয়ালা ছাগলে খেয়ে ফেলেছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, মুহাম্মদ (দঃ) সুরা ‘নুর’ রচনা করেছিলেন
আয়েশার উপর ব্যাভিচারীনীর বদনাম রটনার একমাস পরে।
স্মরণ করা যেতে পারে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ১১ জানুয়ারি মক্কা বিজয়ের দিনের
কথা। সেদিন আবু সুফিয়ানের বংশধরের অতি আদরের অসীম ভক্তির, বহু কষ্টে গড়া ৩৬০টি
দেবতার মাথা ভেঙে চুরমার করা হলো তাদের চোখের সামনে একজন সাহাবিও উঁহু করলেন না।
অথচ এ মূর্তিগুলোর পূজা একসময় মুহাম্মদের পিতা-মাতা, পূর্বপুরুষেরা অত্যন্ত
ভক্তিভরেই করতেন। একই বছরের (৬৩০ খ্রিস্টাব্দ) জুলাই মাসে নবীজি হযরত আলিকে দিয়ে
তাঈ সম্প্রদায়ের এক পৌত্তলিক গোত্রের ফালস্ (Fuls) দেবতার মনুষ্যাকৃতির মূর্তি ও
উপাসনালয় ভেঙে গুড়িয়ে দিলেন, তাদেরকে অস্ত্রের মুখে জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণে বাধ্য
করলেন। নবী মুহাম্মদের জীবনবৃত্তান্ত পাঠ করলে আমরা দেখতে পাই, মুহাম্মদের মদিনায়
অবস্থানকালীন সময়ে আউস গোত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আবু আমির, মুহাম্মদের ‘নবীত্ব’কে অস্বীকার
করেছিলেন। তিনি অন্যান্য গোত্রপ্রধানদের কাছে অভিযোগ জানিয়ে ছিলেন, “মুহাম্মদ ঐশী বাণীর দোহাই দিয়ে একেশ্বরবাদকে বিকৃত
করেছেন।” এমন কি আরবের বিভিন্ন
এলাকার ব্যবসায়ী যাত্রীদলের উপর মুহাম্মদের আক্রমণকে আবু আমির ‘রাহাজানি’, ‘লুণ্ঠন’হিসেবে চিহ্নিত
করেন এবং মুহাম্মদকে ‘বিপজ্জনকভাবে উচ্চাকাংখী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আবু আমিরের অনুসারীরা
মদিনার ওয়েসিসের কাছে প্রার্থনা ঘর হিসেবে একটি মসজিদ স্থাপন করেছিল; পাশাপাশি এটি
দুঃস্থ ও দরিদ্রদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কোরানে উল্লেখ আছে :
(মুনাফিকদের মধ্যে) যারা ক্ষতিসাধন, সত্য প্রত্যাখ্যান ও বিশ্বাসীদের মধ্যে বিভেদ
সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিল, যে পূর্বে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের
বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিল, তারা হলফ করে বলবে, ‘আমরা সৎ
উদ্দেশ্যেই এটা করেছি, আল্লাহ সাক্ষী, নিশ্চয়ই ওরা মিথ্যেবাদী।”(সুরা তওবা ৯, আয়াত ১০৭) কোরানে মুহাম্মদ তাঁর
সঙ্গী-সাথীদের আবু আমিরের মসজিদের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি করে দিলেন : “তুমি নামাজের জন্য এর মধ্যে কখনো দাঁড়াবে না…। ওদের ঘর যা ওরা তৈরি করেছে তা ওদের সন্দেহের
কারণ হয়ে থাকবে, যে-পর্যন্ত না ওদের অন্তর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।” (সুরা তওবা ৯, আয়াত ১০৮, ১১০)। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে
সিরিয়াতে আবু আমির মারা গেলে এই প্রার্থনা-ঘরটি নবী মুহাম্মদের নির্দেশে তাঁর
অনুসারীরা আগুনে পুড়িয়ে ফেলে এবং পরবর্তীতে এ স্থানকে মলমূত্রের স্থান হিসেবে
রূপান্তরিত করা হয়। তাহলে বলা যায়, মূর্তি-উপাসনালয়-ভাস্কর্য ভাঙা ইসলামের সহজাত
এবং তা প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই চলে আসছে। এরই ধারাবাহিকতা আমরা দেখতে পাই ২০০১
সালের মার্চ মাসে আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশে তালেবানদের দ্বারা বৌদ্ধদেবের
মূর্তি ভাঙায়। তেমনি ১৪ই অক্টোবর, ২০০৮ তারিখে ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
গোলচত্বরে বাংলার চারণ কবি লালনের স্মরণে নির্মাণাধীন বাউল ভাস্কর্যটি কওমি
মাদ্রাসার কয়েকশ ছাত্র ভেঙে গুড়িয়ে দিল। এরপর ২৯শে নভেম্বর তারিখে ‘আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত’ নামের আরেকটি মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রায় চারশ কর্মী
হাতুড়ি-শাবল দিয়ে রাজধানী ঢাকার মতিঝিলে ‘বলাকা’ ভাস্কর্যটিও ক্ষতিগ্রস্থ করলো। তাদের উভয়ের দাবি
ভাস্কর্য ইসলাম-বিরোধী তাই বাংলাদেশ থেকে সব ভাস্কর্য, মূর্তি, ছবি নিশ্চিহ্ন ও
ধ্বংস করে ফেলা চাই।
শিক্ষিত মুসলমানেরা দাবি করেন, কোরান শরিফেই লিপিবদ্ধ আছে অর্থনীতি, পৌরনীতি,
রাজনীতি, সমাজ-বিজ্ঞান, ভূ-বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ দুনিয়ার
যাবতীয় সব জ্ঞান; একমাত্র এই বইয়েই আছে, জগতের সকল মানুষের ইহলোক ও পরলোকের সকল
সমাধান! পনেরশত বৎসর যাবৎ বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান বইখানি সাদরে, সমাদরে, মগজে,
বুকে-অন্তরে ধারণ করে রাখলেন, ফল কী হলো? পনেরশত বৎসর কোরান পড়ে কোন্ বিজ্ঞানী
কোন্ জিনিষটা আবিষ্কার করলেন? অথচ বিজ্ঞানের যে কোনো নূতন আবিষ্কারের কিছুদিন পরই
দেখা যায়, ঐ আবিষ্কারের তথ্য মুসলমানেরা কোরানের মধ্যে খুঁজে পেয়ে গেছেন! বলা হয়,
অমুসলিমরা বিজ্ঞানের নতুন তথ্য-তত্ত্ব আবিষ্কার করে কোরান গবেষণা করেই। অথচ
অমুসলিমদের দ্বারা বিজ্ঞানের কোন বিষয়ে আবিষ্কারের আগে কোনো মুসলিম কিন্তু কোরানে
ঐ বিষয়ে কি ইঙ্গিত দেওয়া আছে, সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ব্যাখ্যা দিতে পারেন না বা
দেন না। মজার ব্যাপার হচ্ছে বিজ্ঞান আজ যেসব বিষয়ে এখনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে
পারেনি, যেমন পৃথিবীর বাইরে কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে কিনা কিংবা থাকলে সেই
প্রাণের স্বরূপ কী, অথবা মহাবিশ্বের সঠিক আয়তন, আকৃতি কেমন, ডার্কম্যাটারের
অস্তিত্ব, আয়তন ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞানের গবেষণা নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলছে, তবে এখনো এ
বিষয় সম্পর্কে পরিপূর্ণ তথ্য আমাদের হাতে নেই। আশ্চর্যের বিষয়, ইসলামের আলেম-ওলামা
থেকে মডারেইট আধুনিক মুসলিমরাও এ বিষয়ে নীরব। তাদের কেউই বলছেন না, কোরান-হাদিসের
কোথায় এ বিষয়ে কী বলা আছে? অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণে আমরা আশঙ্কা করতে পারি
আগামীতে যেই জ্যোতির্বিজ্ঞান এ বিষয়গুলি নিয়ে তার গবেষণালব্ধ ফলাফল ঘোষণা করবে
অমনি বিজ্ঞানের বক্তব্যকে আজ থেকে প্রায় পনেরশত বছর আগে ‘কাব্যিক ঢঙে লেখা’ কোরান-হাদিসের
আয়াতগুলিকে ‘অনুবাদের চাতুরী আর
গোঁজামিলের মাধ্যমে’ বিজ্ঞানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ
প্রমাণের জন্য উঠেপড়ে লেগে যাবেন ইসলামি পন্ডিতগণ। ইতিমধ্যে আমরা তো দেখেছি,
বিজ্ঞানের যেসব আবিষ্কারের নমুনা তারা এরই মধ্যে কোরান-হাদিসের মধ্যে খুঁজে
পেয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই এই ধরনের কাজটি করেছেন। একটা সময় ছিল, ধর্মগুলো
বিজ্ঞানের কণ্ঠ চেপে ধরেছিল ওগুলো প্রচলিত বিশ্বাস-প্রথাবিরোধী-ঈশ্বরদ্রোহী বলে,
অথচ আজ ধর্মগুলো নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই বিজ্ঞানের কাঁধে চড়ে বসতে
চাচ্ছে; ধর্ম আর ঈশ্বর বিশ্বাসের মাপকাঠি হয়ে উঠেছে বিজ্ঞান। অনেক মুসলমান
বলেন-বৈজ্ঞানিকরা নতুন এমন কিছু আবিষ্কার করতে পারবে না, যার সূত্র বা ইঙ্গিত আগে
থেকেই কোরানে দেয়া হয় নাই। সু্ত্র বা ইঙ্গিত যদি আগে থেকেই কোরানে লেখা থাকে তাহলে
মুসলিম পন্ডিতগন খুঁজে দেন না কেন কোথায় লুকানো আছে এইডস আর ক্যান্সার রোধের ডি এন
এ কোডটা? কিংবা বলতে পারছেন না কেন, আগামী এক শো বছরে বিজ্ঞান নতুন কী কী আবিষ্কার
করবে? Stephen Hawkins- এর Pre History of Time পড়ে যারা বিগব্যাং-এর ইঙ্গিত
কোরানের আয়াতে (‘কুন ফা-ইয়াকুন’ সুরা ইয়াসিন, আয়াত ৮২) পান, যারা কোরান পড়ে
আবাবিল পাখির পায়ের মধ্যে আকাশ থেকে বোমা নিক্ষেপনের সূত্র খুঁজে পান, (সুরা ফিল,
আয়াত ৩) যারা জগতের প্রথম মানবের দেহ ৬০ হাত লম্বা আর তার বয়স ৮ হাজার বছর ঘোষণা
দেন তারা আসলেই বোকার স্বর্গে বাস করেন।
ইসলাম ধর্মের সব
থেকে সম্মানিত পবিত্র কেতাব কোরান শরিফ। ইসলামিক থিওলজি মতে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে
নবী মুহাম্মদের কাছে নাজিল হওয়া কেতাব সম্পর্কে মুসলমানদের ‘সম্মান ও পবিত্রতার’ ধারণাকে প্রাচ্য গবেষক আলফ্রেড গিয়োম অল্প
কথায় বর্ণনা করেছেন এভাবে :
It is the holy of
holies. It must never rest beneath other books, but always on top,
one must never drink or smoke when it is being read aloud, and it must be
listened to in silence. It is a talisman against disease and disaster.
one must never drink or smoke when it is being read aloud, and it must be
listened to in silence. It is a talisman against disease and disaster.
আসুন সেই
গ্রন্থখানি নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। “নিশ্চয়ই এ কোরান বিশ্বাসীদের জন্য একটি সঠিক নির্দেশনামা, আর যারা
ভাল কাজ করে,তাদের জন্য ঘোষণা করে পরকালে মহাপুরস্কার।” (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ১০) এখানে ‘বিশ্বাস’ বলতে কী বুঝানো হয়েছে? অন্য ধর্মগ্রন্থানুসারীরা যারা ভাল কাজ করেন
এবং বিশ্বাস করে্ন তাদের ধর্মগ্রন্থ সত্য, তাদের নবী সত্য,তারা কি এই আয়াতের
অন্তর্ভুক্ত লোক? বিশ্বাসী কি তাদেরকেই বলা হয়েছে যারা মুহাম্মদের (দঃ) দলভুক্ত?
মহাপুরস্কারের লোভ কি দেখানো হয়েছে, মানুষকে নিজ দলভুক্ত করে সঙ্গবদ্ধ করার
লক্ষ্যে? সুরা বনি ইসরাইলের ১১নং আয়াতে বলা হয়েছে : “তাদের জন্য সতর্কবাণী যারা পরকালে বিশ্বাস
করে না, আর তাদের জন্য তৈরি করে রেখেছি ভয়ঙ্কর শাস্তি।” ভয়ঙ্কর শাস্তির ভয় দেখানোর মানেটা কি?
জগতের কিছু মানুষ পরকালে বিশ্বাস না করুক, মুহাম্মদ (দঃ) ও আল্লাহকে অমান্য করুক,
সেটা তো আল্লাহরই কাম্য। মানুষ সৃষ্টির আগেই আল্লাহ নরক সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর
নরক সৃষ্টির কারণই কি প্রমাণ করেনা যে, তিনি নিশ্চয়ই চান না, সকল মানুষ বেহেস্তি
হউক? সুরা বাকারার ৯৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “আমি নিশ্চয়ই তোমার কাছে সুস্পষ্ট কোরানের আয়াতসমূহ পাঠিয়েছি (যাতে
রয়েছে ইহুদি ও তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত বিবরণ) অবাধ্যরা ব্যতীত কেউ এগুলো
অস্বীকার করে না”। কোরানের
আয়তসমূহে যারা বিশ্বাস করে না তারাই অবাধ্য, দুর্বৃত্ত? বুঝা গেল—ভাল মানুষ হওয়ার শর্তই হলো কোরানে ঈমান
আনতে হবে, মুহাম্মদের দলে আসতে হবে, অন্যথায় সকল সততা, সকল মহৎ কাজ, সবই ব্যর্থ।
এই আয়াতের মাধ্যমে সমগ্র মানব জাতিকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছে; যারা কোরানের
আয়াতসমূহে বিশ্বাস করেন তারা মুহাম্মদের বেহেস্তি দল, আর যারা বিশ্বাস করে্ন না
তারা অবাধ্য, দুর্বৃত্ত নরকে শাস্তি প্রাপ্যের দল। কোরান মানবতা শিক্ষা দেওয়ার,
নাকি শত্রু চিহ্নিত করার বই? কোরানে যে সকল জাতি বা সম্প্রদায়ের কথা (ইহুদি ও
খ্রিস্টান) বারবার বলা হয়েছে তারা তো নির্দিষ্ট একটি এলাকার মানুষ, এই বই সারা
পৃথিবীর মানুষের জন্যে নির্দেশক হয় কী ভাবে? মানুষ জানবে কী ভাবে যে, কোরান নামের
এক খানা বই আল্লাহ দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন যা জগতের সকল মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে মানতে
হবে, না মানলে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে তারা নরকবাসী হবে? কোরান যখন লেখা হয় তখন
আরব ছাড়া কি দুনিয়ায় আর কোন জাতি, ধর্ম বা সম্প্রদায় ছিলনা?
মদিনায় যাওয়ার পর
মুহাম্মদ যখন দেখলেন কিছু লোককে কোনোভাবেই বিশ্বাস করানো সম্ভব হচ্ছে না যে, তিনি ‘নবী’ ও তাঁর ‘কোরান’ একখানি ধর্মগ্রন্থ, তিনি আল্লাহ’র নামে লেখালেন- “ইহুদি ও খ্রিস্টানগণ কখনই তোমার ওপর
সন্তুষ্ট হবে না যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্ম মেনে নাও। তাদেরকে বলো, আল্লাহর
হেদায়েতই (ইসলামি আদর্শ) একমাত্র হেদায়েত, আর তোমার কাছে যা নাজেল হয়েছে তার পরেও
তুমি যদি ইহুদি বা খ্রিস্টানদের ধর্ম অনুসরণ করো, তাহলে তোমাকে সাহায্য বা রক্ষা
করার কেউ থাকবে না।” (সুরা বাকারা,
আয়াত ১২০) আল্লাহর কি সন্দেহ হয়েছিল যে, মুহাম্মদ অন্যধর্ম মেনে নিতে পারেন? সুরা
বাকারার ১৪৫নং আয়াতে আল্লাহ আরও বলেন; “আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে (ইহুদি, খ্রিস্টান), তাদের কাছে যদিও
তুমি সকল আয়াত (প্রমাণ-নিদর্শন) নিয়ে আসো, তবুও তারা তোমার পথ মানবে না, আর তুমিও
তাদের পথ অনুসরণ করতে পারো না। আবার তাদের কেউ কেউ পরস্পরের অনুসারী নয়। আর তোমার
কাছে জ্ঞানের যা কিছু এসেছে তারপরেও তুমি যদি তাদের পথ অনুসরণ করো তাহলে নিশ্চয়ই
হবে জালিমদের অন্তর্ভুক্ত।” এই আয়াতের ইংরেজি
করা হয়েছে এভাবে : And even if you were to bring to the people of the Scripture
(Jews and Christians) all the Ayat (proofs, evidences, verses, lessons, sings,
revelations etc.), they would not follow your Qiblah (prayer direction), nor
are you going to follow their Qiblah (prayer direction). And they will not
follow each other’s Qiblah (prayer
direction). Verily, if you follow their desires after that which you have
received of knowledge (from Allah), then indeed you will be one of the Zalimun
(polytheists, wrong-doers etc)
আল্লাহর কি সন্দেহ
হয়েছিল মুহাম্মদ (দঃ) তাঁর অবাধ্য হয়ে যাচ্ছেন যে তাকে বলতে হলো, “তুমি যদি তাদের পথ অনুসরণ করো তাহলে
নিশ্চয়ই তুমিও হবে জালিমদের অন্তর্ভুক্ত?” সুরা বাকারার ১৯১নং আয়াতে বলা হয়েছে, “তাদেরকে হত্যা করো যেখানেই তাদের দেখা পাও,
আর তাদেরকে তাড়িয়ে দাও যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে তাড়িয়েছিল, আর উৎপীড়ন হত্যার
চেয়ে নিকৃষ্ট। আর মাসজিদুল হারাম মক্কার আশেপাশে তাদেরকে হত্যা করো না যদি না তারা
তোমাদেরকে সেখানে হত্যা করে, কিন্তু যদি তারা তোমাদেরকে সেখানে আক্রমণ করে, তোমরা
তাদেরকে খুন করো। এটাই অবিশ্বাসীদের প্রাপ্য।” এটা একজন সৃষ্টি কর্তার বাক্য হলো? আল্লাহ নিজে খুন না করে মানুষ
দিয়ে মানুষ খুন করান কেন? এই আয়াতে আল্লাহ অথবা মুহাম্মদ (দঃ) যাদেরকে খুন করার
কথা বলছেন এবং খুন করেছেন, এদের অবিশ্বাসী দাবি করা হলেও তারা তো আসলেই
নাস্তিক-নিরীশ্বরবাদী বা অবিশ্বাসী ছিলেন না;তাদের বেশিরভাগই ছিলেন ইহুদি,
খ্রিস্টান অথবা অন্য বহু-ঈশ্বরবাদী, সর্বপ্রাণবাদী ধর্মাবলম্বী। এখানে বলা হয়েছে- ‘কিন্তু যদি তারা তোমাদেরকে সেখানে আক্রমণ
করে’ এই লাইনটা নিয়ে
কথার চাতুরী বা মারপ্যাচ হতে পারে। আক্রমণটা কে আগে করলো, কেন করলো আর তা
ডিফেন্সিভ না অফেন্সিভ ছিল তা জানবো কী করে? ওটা নির্ভর করে ঘটনা বা ইতিহাস
লিখেছেন কারা। ইরাক বা আফগানিস্থান আক্রমণ করে আমেরিকা যদি বলে সেটা আত্মরক্ষার
যুদ্ধ ছিল তা কি গ্রহণযোগ্য হবে? কোন দেশ দখল করার অজুহাতে আমেরিকা তো বলবেই যে,
সে দেশ তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি ছিল। সে আক্রমন করবে কখনও বিপন্ন গনতন্ত্র
উদ্ধারের নামে , কখনো ভুলুন্টিত মানবাধিকার পুনঃ প্রতিষ্ঠার নামে, কখনও ডব্লিউ এম
ডি বা নিউক্লিয়ার অস্ত্রভান্ডার ধ্বংসের নামে আবার কখনও ধর্মীয় সন্ত্রাস নির্মূলের
নামে। মুহাম্মদ তার মদিনার জীবনে যত যুদ্ধ করেছেন , সকল যুদ্ধই কি ডিফেন্সিভ বা
আত্মরক্ষামূলক ছিল? আমরা এ বিষয়ের উপর পরে আরো বিস্তারিত আলোচনা করবো।
কোরান একদিকে বলে-‘লা ইকরাহা ফিদ্দীন’ অর্থাৎ, ধর্মে জবরদস্তি নেই, অপরদিকে আবার
বলে : “যুদ্ধ তোমাদের
জন্যে ফরজ (বাধ্যতামূলক) করা হলো যদিও তোমরা তা পছন্দ করো না।” (সুরা বাকারা, আয়াত ২১৬)। এই আয়াত থেকে
পরিষ্কার বুঝা যায়, মানুষ (আরবের তৎকালীন জনসাধারণ, এমন কি নতুন যারা ইসলাম ধর্ম
গ্রহণ করেছিলেন তারা যুদ্ধ পছন্দ করতেন না, অথচ কোরান উৎসাহ দিচ্ছে যুদ্ধের।
কোরানে আমরা আরো
দেখতে পাই, “আর মুশরিক নারীকে
বিয়ে করো না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ঈমান এনেছে, অবশ্যই একজন ক্রীতদাসী ঈমানদার নারী
একজন স্বাধীন নারীর চেয়ে উত্তম,যদিও সে তোমাদেরকে মোহিত করে। আর (তোমাদের
মহিলাগণকে) বিয়ে দিও না মুশরিকদের সাথে, যে পর্যন্ত না তারা ঈমান আনে, নিশ্চয়ই
একজন ঈমানদার গোলাম, স্বাধীন মুশরিকের চেয়ে ভাল যদিও সে তোমাদেরকে তাজ্জব করে দেয়।” (সুরা বাকারা, আয়াত ২২১) জাতিভেদ বা
সাম্প্রদায়ীকতা শিক্ষার এর চেয়ে আর কী উত্তম সবক হতে পারে?
হাদিস শরিফে হজরত
আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করছেন, “আল্লাহর রসুল (দঃ) বলেছেন, ইহুদি-খ্রিস্টানরা তাদের পাকা সাদা চুলে
রঙ দেয় না, সুতরাং তোমরা তার উল্টোটা করবে অর্থাৎ তোমাদের পাকা সাদা চুলে ও দাড়িতে
রঙ দেবে।” (দ্রষ্টব্য : সহি
বোখারি শরিফ, ভলিউম ৪, বুক ৫৬, নম্বর ৬৬৮) স্রষ্টা কীভাবে তার সৃষ্টিকে ঘৃণা,
অপমান, হিংসা, বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা শিক্ষা দিতে পারে? এই শিক্ষা দিয়ে
মানবকল্যাণ সাধন বা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা হয় কীভাবে? সম্পূর্ণ বইখানি রাজনৈতিক
স্বার্থে রচিত। তাহলে স্বর্গ, মহাপুরস্কার, নরক, ভয়ঙ্কর শাস্তি,তকদির, ফেরেস্তা,
শয়তান এগুলো কি মিথ্যা? হ্যাঁ, এগুলো হলো সাধারণ মানুষের দৃষ্টি এড়ানোর লক্ষ্যে
সম্পূর্ণরূপে গোপন রাজনৈতিক স্বার্থের ওপর মিথ্যার আবরণ। এ বইখানি পড়ে, এ ধর্মে
পূর্ণবিশ্বাস স্থাপন করে কোনো মুসলমান, অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষকে, জগতের কোনো
অমুসলিমকে ভালোবাসতে পারেনা। অনেকেই হয়তো বলবেন, মুসলমানদের মধ্যে কি সহনশীল,
মহৎহৃদয়ের ব্যক্তি নেই? অবশ্যই আছেন এবং অনেক আছেন। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে তাদের
নন-মসুলিমদের প্রতি সহনশীলতা, প্রেম-ভালোবাসা, মৈত্রী ইত্যাদি তৈরি হয়েছে দীর্ঘদিন
ধরে কিংবা ছোটবেলা থেকে নন-মুসলিমদের সাথে পাশাপাশি থাকার কারণে, সামাজিকীকরণের
সময় নিজেদের মধ্যে কাণ্ডজ্ঞান, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় নিয়ম-নীতি সম্পর্কে
বোধ-বুদ্ধি-ধারণা-নীতি-নৈতিকতা সৃষ্টির ফলে আর ধর্মগ্রন্থের তথাকথিত ঐশ্বরিক
নির্দেশ থেকে কিছুটা উদাসীন থাকার কারণে। তবে অবশ্যই ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে উৎসাহিত
হয়ে নয়। বইখানি পড়ে, জেনে, বুঝে যারা বলেন ইসলাম মানবতার ধর্ম, বিশ্ব-শান্তির
ধর্ম, কোরান সাম্য-মৈত্রীর বাণী বহন করে, তাঁরা অবশ্যই ভান করেন, মিথ্যা বলেন,
প্রতারণা করেন, অথবা সম্পূর্ণ না-জেনে বোকার স্বর্গে বাস করে নিজের মনগড়া
ভালো-ভালো কথাগুলোকে ইসলামের কথা বলে চালিয়ে দেন।
কোরান না হয় অন্য
ধর্মের ও ধর্মগ্রন্থের নিন্দা, সমালোচনা করলো, তাদের সত্যতা অস্বীকার করলো। কিন্তু
স্ব-ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এতো মতভেদ, মারামারি, খুনোখুনি কেন? এই যে শিয়া-সুন্নি,
আহমদিয়া, ওয়াহাবি, হানিফি,হাম্বলি, মালিকি ইত্যাদি স্বগোত্রে, স্বজাতিতে, স্বধর্মে
এই মতভেদ মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনির কারণ কি ধর্মগ্রন্থ বোঝার ভুল,
ধর্মগ্রন্থের ভুল ব্যাখ্যা, অপব্যাখ্যা, নাকি এর কারণ স্বয়ং ধর্মগ্রন্থের
রচয়িতাগণ, ধর্ম প্রবর্তকগণ? মুসলমানদের দাবি মতো ‘পৃথিবীর শেষ ধর্ম ইসলাম’ তার পূর্ববর্তী সবগুলো ধর্মকে বাতিল ঘোষণা করেছে। কোরান স্পষ্টভাষায়
বলে দিয়েছে, আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম হলো ইসলাম (৩:১৯); এবং মুসলমানরা
বেহেস্তে যাবে আর অমুসলিমরা যাবে দোযখে (২:৩৯)। সুতরাং যে ধর্মগুলো আল্লাহকর্তৃক
বাতিল, পরিত্যক্ত,ভ্রান্তিপূর্ণ, বর্জনীয়, অগ্রহণযোগ্য, অচল হয়ে গেছে, সেগুলো নিয়ে
আলোচনা-সমালোচনা করার কোনো যুক্তি নেই। নূতনের প্রতিই মানুষ আগ্রহী হয়, নূতনকেই
গ্রহণ করে-বর্জন করে; নূতনকে নিয়েই হয় গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা,আলোচনা-সমালোচনা।
কিন্তু লক্ষণীয় যে, কেউ ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কোরান নিয়ে সামান্য যৌক্তিক
আলোচনা-সমালোচনা করলেই তাঁকে কথায় কথায় ইসলাম-ব্যাশার, ইসলাম-বিদ্বেষী, কাফের,
মুরতাদ, অথবা ফ্যানাটিক,ইহুদি-নাসারাদের দালাল ঘোষণা করা হয়। আসলে তাঁরা ইসলাম
সম্পর্কে সত্যকে গ্রহণ করতে ভয় পান, নয়তো সত্যকে ঘৃণা করেন। আজকাল পশ্চিমা শিক্ষায়
শিক্ষিত কিছু লোক উদারতার সাথে দাবি করেন, ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কোরান স্বকালের
সামাজিক পরিবেশ, ইতিহাস ও বাস্তবতার নিরিখে সমাজ পরিবর্তন বা সমাজ উন্নয়নের
লক্ষ্যে লিখিত। আবার কিছু লোক, আল্লাহ ও আল্লাহর মনোনীত রসুল ও তাঁর লিখিত
ধর্মগ্রন্থকে সুকৌশলে নিষ্কলঙ্ক, নির্ভুল প্রমাণ করে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেন
এবং সকল কলঙ্ক ধর্মানুসারীদের ওপর চাপিয়ে দেন। তাঁরা এ কাজটি করার জন্যে আল্লাহ ও
তাঁর বাণীপ্রচারক মুহাম্মদ ও তার লেখা গ্রন্থ কোরানকে জগতের তাবৎ মুসলমান থেকে
পৃথক করে নিয়েছেন। তারা নিজেদেরকে ‘কোরান অনলি’ অনুসারী বলে দাবী
করেন। বাকী ইসলামকে তার নাম দিয়েছে ‘মৌলবাদী’ বা ‘রাজনৈতিক ইসলাম’। অর্থাৎ পৃথিবীতে ইসলামের নামে যত
যুদ্ধ-বিগ্রহ, অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি, অমঙ্গল,অকল্যাণ
হয়েছে এবং হচ্ছে, তার সবগুলো হয় কোরানের অপব্যাখ্যাকারী ঐ মৌলবাদী ও রাজনৈতিক
ইসলামের দ্বারা। আল্লাহ, মুহাম্মদ (দঃ) ও তাঁদের কোরান সর্বদাই নমস্য, নিষ্কলঙ্ক,
নির্ভুল, নির্ভেজাল। তাঁদের ভাষায়—হযরত আয়েশা (রা.), হযরত আবুবকর, হযরত ওমর, হযরত ওসমান, হযরত আলি,
মোয়াবিয়া, ইমাম আবুহানিফাসহ আজকের পৃথিবীর আলেম, উলামা, মশায়েখ, হাফিজ, মোহাদ্দিস
সবাই মৌলবাদী ও রাজনৈতিক ইসলামের সমর্থক। এ হলো আল্লাহ, মুহাম্মদ (দঃ), ও কোরানকে
সত্য ও নির্ভুল প্রমাণ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। ইসলামের মৌলবাদ ও রাজনৈতিক
দৃষ্টিভঙ্গি ব্যতীত কোরান রচনার ও প্রয়োগের উদ্দেশ্য হবে নিষ্ফল অর্থহীন।
আদ্যপান্থ স্ববিরোধী বক্তব্যে ভরপুর কোরান স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম সমাজে
বিভ্রান্তি-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আসছে যুগ-যুগ ধরে।
আজকাল প্রকৃত
ইসলাম, মসজিদ, মক্তব, মাদ্রাসায় আর নেই। কোরান-হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যাকারী ও
মুহাম্মদ (দঃ)-কে প্রকৃতভাবে চেনার মতো কোনো আলেম, মৌলানা, হাফেজ, ক্বারী,
মোহাদ্দিস, মুফাস্সিরিন মনে হচ্ছে এ জগতে অবশিষ্ট নেই। কোরান, আল্লাহ ও মুহাম্মদ
(দঃ)-কে হেফাজত করার পবিত্র দায়িত্ব নিয়েছেন ‘মডার্ন ইসলামিষ্ট’ নামের স্কুল কলেজ
পড়ুয়া তথাকথিত শিক্ষিত মুসলমান। ইসলাম নিয়ে তাদের আবার একেকজনের একেক মত,একেক
ব্যাখ্যা। তাঁদের মডার্ন ইসলামের অস্তিত্ব শুধুমাত্র কাগজে-কলমে, পত্রিকার পাতা আর
ইন্টারনেটের ওয়েব ব্লগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সমাজে এর কোনো অস্তিত্ব বা বাস্তব
প্রতিফলন নেই। বাস্তবে আমরা দেখি মুসলমানকে সামাল দিতে (ইংল্যান্ডের ইস্ট লন্ডন)
মসজিদের ভেতর পুলিশের কুকুর, বাংলাদেশের বায়তুল মোকাররম মসজিদে লাথালাথি,
জুতাজুতি। এই হাতা-হাতি লাথা-লাথি জুতাজুতি ১৫শো বছর আগেও ছিল, আজও আছে। ১৫শো বছর
আগে ইসলামের হাতে ছিল তীর-বর্শা, তলোয়ার, আর এখন বন্দুক, বোমা গ্রেনেড। আমাদের
বাংলাদেশে অর্ধশত ইসলামি দলের নাম শুনে অবাক হওয়ার কী আছে? পনেরশত বছর আগেই তো
মুহাম্মদ বলে গেছেন, “কেয়ামতের দিন
উম্মতে মুহাম্মদী তেহাত্তর দলে বিভক্ত হবে, তন্মধ্যে মাত্র একদল হবে বেহেস্তি।
(দ্রষ্টব্য : আবু দাঊদ শরিফ, বুক ৩, নম্বর ৪৫৮০)। আর এই ঘোষণার পর সকলেই যে
নিজেদেরকে জান্নাতি দলের দাবি করবে এবং জাহান্নামি বাকি বাহাত্তর দলের সাথে
খুন-খারাবি, ঝগড়া-ফ্যাসাদে লিপ্ত থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। আমরা এখন ধারণা করতে
পারি, অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন মুহাম্মদ নিশ্চয়ই আঁচ করতে পেরেছিলেন ‘স্ববিরোধী’ বক্তব্যে ভরপুর কোরান ও কোরানের অনুসারীদের ভবিষ্যৎ। তাই বলেছিলেন—মতবিরোধ, মতানৈক্য আমার উম্মতের জন্যে
আশীর্বাদ! নবী চেয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জামাতা আলি (রাঃ) ইসলামের প্রথম
খলিফা হবেন; কিন্তু তাঁর আশাপূর্ণ হয়নি। হয়েছিলেন তাঁর সর্বকণিষ্ঠ এবং প্রিয় পত্নী
আয়েশার পিতা হযরত আবু বকর (রাঃ)। জানা যায়, নবী মুহাম্মদ জীবিত থাকতে একবার মক্কা
ও মদিনার মধ্যবর্তী ‘গাদির আল-খুম’ নামক একটি ঝরণার (কেউ কেউ বলে কূপ) কাছে
দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন : “ আমি যাদের নেতা আমার আলিও তাদের নেতা।” এই ঘোষণার দিনটি স্মরণে রেখে এখনো শিয়ারা
আনন্দোৎসবের আয়োজন করে থাকে। (দ্রষ্টব্য : আরব জাতির ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৪৬০, ৪৭২)।
মুহাম্মদের মৃত্যুর সাথে-সাথেই ক্ষমতা দখল নিয়ে লড়াই, ফ্যাসাদ,প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের
যাত্রা শুরু হয়। মুহাম্মদ (দঃ) নিজেই মুসলমানদের জন্যে প্রথম বিষবৃক্ষ রোপন করে
গেছেন। মুহাম্মদের রচিত কোরান-হাদিস তার প্রিয় স্ত্রী আয়েশা ও জামাতা আলির জন্যে
মঙ্গল বয়ে আনতে পারেনি। মোয়াবিয়া ও আলির (রাঃ) মধ্যকার শত্রুতা নিরসন করতে পারেনি;
পারেনি হাসান, হোসেনকে মোয়াবিয়ার পুত্র এজিদের হাত থেকে রক্ষা করতে। ওহাবি, শিয়া,
সুন্নি, শরিয়ত, মারিফত, তরিকত, হানিফি, মালিকি, হাম্বলি, শাফিই, জামাতি, জমিয়তি,
কাদিয়ানি, হিজবুত, জে এম বি সবকিছুই মুহাম্মদ (দঃ) ও তাঁর কোরান-হাদিসের সৃষ্টি।
একই বিষ-বৃক্ষের বহু শাখা-প্রশাখামাত্র।
শুরুটা বলতে হবে পরিবারের হাত ধরেই….
জন্মাবার পরে আমার বাবা-মা আমাকে একটি নিখাঁদ
বাংলা নাম দেন। এবং ছোটবেলায় যে এলাকায় বেড়ে উঠি সেখানে বেশ কিছু হিন্দু পরিবার
ছিল, যাদের সাথে খুব স্বাভাবিক-সাধারণ সুসম্পর্ক ছিল- মানে পুঁজায় তাদের বাসায়
আমাদের দাওয়াত খাওয়া- আমাদের ঈদে আমাদের বাসায় তাদের দাওয়াত খাওয়াটা নৈমত্তিক বিষয়
ছিল। এটা আপাতভাবে সামান্য ব্যাপার মনে হতে পারে, তবে আমি মনে করি- আমার নিজের
অসাম্প্রদায়িক হওয়ার পেছনে এ দুটি বিষয়ের ব্যাপক ভূমিকা আছে।
আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (বেবি-ওয়ান-টু) এক
হিন্দু শিক্ষক আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন- এবং মাঝে মধ্যে তার সাথে স্কুলে যাওয়া
আসা করতাম। তো, আমার বাংলা তথা হিন্দু নাম এবং একজন হিন্দু শিক্ষকের সাথে স্কুলে
যাতায়াতের কারণে সেই ওয়ান-টু তেই ক্লাসের বিভিন্ন ছেলেমেয়ের কাছ থেকে একটা ছড়া
মাঝে মধ্যেই শুনতে হতো- “হিন্দু হিন্দু
তুলসীর পাতা, হিন্দু খায় গরুর মাথা”। আমাকে হিন্দু
হিন্দু বলে খেপানো হতো (খেপাতো বাচ্চারাই- এখন যখন ভাবি, শিউরে উঠি- কত বাচ্চাকাল
থেকেই এরা সাম্প্রদায়িক হয়ে গড়ে উঠে!!)। “হিন্দু” যেন একটা গালি!! আমার নামটিই যেন আমাকে বাচিয়ে
দেয় ওদের মত সাম্প্রদায়িক হওয়ার হাত থেকে- এবং সেই বাচ্চাকাল থেকেই এই
মুসলমান-হিন্দু বিভেদ মনে কষ্টের অনুভূতিই তৈরী করতো।
কিন্তু নাস্তিক্যের পাঠ আরো পরের ঘটনা, আরো কিছুটা
বড় হয়ে।
ক্লাসের ধর্মের বই খুব মনোযোগ সহাকারে পড়া ও খুব আগ্রহ নিয়ে কায়দা-আমপারা- তারপরে কোরআন পড়াও শিখে নেই। পাড়ায় কম্পিটিশন করে নামাজ পড়া, বাসায় জোর করে রোযা রাখা এসবও চলতে থাকে। আর ধর্মের প্রতি এই আগ্রহের কারণে এমনটা অবস্থা হলো যে- ধর্মীয় বা ইসলাম সংক্রান্ত বই পেলেই তা মনোযোগ সহকারে পড়তাম। এটা করতে গিয়ে- একদম প্রাথমিক কিছু কিছু প্রশ্নও মনে তৈরী হতে থাকে।
ক্লাসের ধর্মের বই খুব মনোযোগ সহাকারে পড়া ও খুব আগ্রহ নিয়ে কায়দা-আমপারা- তারপরে কোরআন পড়াও শিখে নেই। পাড়ায় কম্পিটিশন করে নামাজ পড়া, বাসায় জোর করে রোযা রাখা এসবও চলতে থাকে। আর ধর্মের প্রতি এই আগ্রহের কারণে এমনটা অবস্থা হলো যে- ধর্মীয় বা ইসলাম সংক্রান্ত বই পেলেই তা মনোযোগ সহকারে পড়তাম। এটা করতে গিয়ে- একদম প্রাথমিক কিছু কিছু প্রশ্নও মনে তৈরী হতে থাকে।
তবে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সর্বপ্রথম মাথায় আসে-
সেটা এখনো মনে আছে: ঠিক প্রশ্ন না- বলা যায় একটা আঘাত। তখন সম্ভবত ক্লাস ফাইভ কি
ফোরে পড়ি। বাসায় এক স্যার বিজ্ঞান-অংক করাতেন, নামাজের সময় হলে একসাথে নিয়ে নামাজ
পড়ান। ওনার সংস্পর্শেই বলা যায় নামাজের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস হয়েছিলাম। সেই স্যার
একদিন বিজ্ঞান পড়াচ্ছিলেন- তো সূর্য ও পৃথিবীর আবর্তনের বিষয়টি বই এ যা ছিল; ঠিক
বিপরীত একটি আলোচনা তিনি উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, বিজ্ঞান যতই বলুক পৃথিবী
সূর্যের চারদিকে ঘুরুক; আসলে সূর্যই ঘুরে। কোরআনে এটা আছে- আল্লাহর সবকিছু সৃষ্টির
মূলে আছে মানুষ- মানুষের পৃথিবীকেই কেন্দ্র করেই সূর্য ঘুরছে।
এই কথায় ঠিকই একটা ধাক্কা খাই। কোনটি ঠিক? বিজ্ঞান
না ধর্ম? ওনার কথা পুরো বিশ্বাস করতে পারলাম না- আবার অবিশ্বাসও করতে পারিনি।
মাথার মধ্যে থেকে গিয়েছিল। আরো পরে অবশ্য অন্য ইসলামী আলোচনায় দেখেছি- কোরআন এ
কোথাও বলা হয়নি যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে- বরং পৃথিবীর ঘুর্ণনের ব্যাপারেই
নাকি কোরআনের আলোচনায় সমর্থন পাওয়া যায়, তথাপি মনের মধ্যে এটি ভালো দাগ ফেলেছিল।
একজন মানুষের ভীষণ ভূমিকা আছে। তিনি সরাসরি
নাস্তিকতার কোন পাঠ আমাকে দেননি- তবে বিজ্ঞানমনস্ক করার ব্যাপারে তার অবদান
প্রথমেই স্বীকার করি। তিনি আমার এক দূরসম্পর্কীয় কাকা, আমাদের গ্রামের বাড়ির এক
মাদ্রাসার বিজ্ঞানের শিক্ষক। এবং একজন বিজ্ঞান সাধক। বিজ্ঞান পাগল এই মানুষটি
বিজ্ঞান সম্পর্কিত যে কোন বই পেলেই হলো- তা সংগ্রহ করেন এবং গভীর মনোযোগের সাথে
পড়েন, নিজ হাতে টেলিস্কোপ, রেডিও… এরকম নানারকম
জিনিস তৈরী করেন- তার সংস্পর্শেই আমার নিজেরো বিজ্ঞানের প্রতি একটা ভালোবাসা
জন্মে।
একদিন তার সাথে আলোচনা কালে তিনি (তখন সম্ভবত
সেভেন-এইটে পড়ি) বললেন,
“বিজ্ঞানের একদম ছোট থেকে বড়
যেকোন বিষয়ের আলোচনায় আল্লাহ-ভগবান-দেবতা-ফেরেশতা কারোরই কোন আলোচনা পাবেনা।
বৃষ্টি কিভাবে হয়? এটার জবাবে যে পানি চক্র বা অন্যান্য সমস্ত বিষয়ে যত যাই আলোচনা
করা হবে- সেখানে কিন্তু কোন মিকাইলের বা কোন অতিপ্রাকৃত কোন কিছুর আলোচনা নেই।”
এই কথাটি আমার সামনে একটা নতুন দিগন্ত খুলে দেয়
বলা যায়। অনেক অনেক ভাবতে থাকি। এর আগে- ধর্ম ও বিজ্ঞানের যে দ্বন্দ্ব তৈরী
হয়েছিল- সেখানে নিজের পক্ষপাত বিজ্ঞানের প্রতি ঝুকতে থাকে।
দ্বিতীয় পর্বে বলেছিলাম, একটা সময় বাংলা কোরআন পড়া
আরম্ভ করি। বেশীদূর যেতে হয়নি- ২য় সুরাতেই মানে সুরা বাকারা পড়তে গিয়েই হোচট খাওয়া
আরম্ভ করি। কোরআনের অনেক কিছুই আছে যা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মেলে না- কিন্তু ঐ সময়ে সবচেয়ে
বেশী ধাক্কা খাই- অলৌকিক ঘটনাগুলোতে, বিভিন্ন নবী-রাসুলের অলৌকিক ক্ষমতা বা মু’জিজা ছিল এটা বিশ্বাস করতেই হবে। কিন্তু পারছিলাম
না। নবীজীর হাতের ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল? মুসা আ এর লাঠি সাপ হয়ে যেত,
লাঠির আঘাতে নীল দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল? আবাবিল পাখির পাথর নিক্ষেপ দিয়ে বড় বাহিনী
পরাস্ত হয়েছিল? নবীজী এক গ্লাস দুধ দিয়ে অনেক সাহাবী পেট পুরে খাওয়া হয়েছিল? ঈসা আ
এর হাতের ছোয়ায় কুষ্ঠ রোগ, অন্ধত্ব ভালো হয়ে যেত? মরা বেচে উঠতো? পুরো অবিশ্বাস
করতে না পারলেও দিনে দিনে এসবে বিশ্বাস করাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।
ক্লাস এইট পর্যন্ত ক্লাসে আরবী আবশ্যিক ছিল- পাশে
ছিল অনেক বড় এক মাদ্রাসা- সেই মাদ্রাসার এক হুজুর বাসায় এসে আরবী পড়াতো- বয়সে বছর
৩/৪ বড়, বন্ধুর মতই সম্পর্ক হয়েছিল। তার সাথেও অনেক কথা হতো- মুজিজা নিয়ে কথা বলায়
তিনি নিশ্চিত করেন যে- এটাতে বিশ্বাস রাখতেই হবে। তিনি একে একে অনেকগুলো মু’জিজার কথা জানান- একটা বই দেন, যেখানে কোরআনে
উল্লেখিত বিভিন্ন মু’জিজার কথা উল্লেখ ছিল। এছাড়া
শুক্রবারে জুমার নামাজে মসজিদের ঈমামও প্রায়ই বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনার কথা বলতেন।
নবী-রাসুলের মু’জিজার ব্যাপারে সন্দেহ
থাকতো- কিন্তু পুরো অবিশ্বাস হয়তো তখনো করে উঠতে পারিনি- কিন্তু ঈমাম সাহেব
বর্তমানেরও বিভিন্ন জায়গার নানা অলৌকিক ঘটনার বয়ান দিতেন- সেগুলোকে সে সময়েই ভুয়া
মনে হয়েছিল।
যাহোক, দিনে দিনে সন্দেহ বাড়তেই থাকে। এককালের
প্রাণের ধর্ম- গর্বের ধর্ম ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়েই প্রশ্ন তৈরী হতে থাকে। একটি
তো বললাম- বিজ্ঞানের সাথে দ্বন্দ্ব। দ্বিতীয়টি হলো- অন্য ধর্মের প্রতি এর
দৃষ্টিভঙ্গি। আগেই বলেছি- আমার বাংলা নাম (হিন্দু! নাম) এর কারণে হিন্দু(!) গালিটা
অনেকবারই শুনতে হয়েছে। এমনকি একবার এলার্জীর কারণে বেশকিছুদিন গরুর মাংস খাওয়া
নিষেধ ছিল- সেটার জন্য শুনতে হয়েছে- হিন্দু না-কি? আর এই গালি শুনতে শুনতে এবং
হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশীদের সাথে মেশা- হিন্দু বন্ধু- খেলার সাথী থাকার
কারণে, ওদের প্রতি একটি সফট কর্ণার জন্মে গিয়েছিল- মানে “হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানেরা ভালো” এমন চিন্তাকে খুব খারাপ চোখে দেখতাম। আর ঠিক এই
জায়গাটিতেই আমার মুসলমান বন্ধু/পাড়ার বড় ভাইদের সাথে দারুন তর্ক হতো। যত তর্ক
করেছি, দেখেছি আগের চেয়ে আরেকটু ভালো ভাবতে পারছি- অনেক সময় দেখা গেছে, তর্ক করতে
করতে এমন একটি যুক্তি করে ফেলেছি- আগে তেমনটি সচেতন ভাবে নিজেও ভাবিনি। এভাবেই
শুরু….। বিশেষ করে স্কুলে কয়েকজন
বন্ধুর সাথে নিয়মিত তর্ক হতো- সেটা আমার চিন্তাগুলোকে অনেক গুছিয়ে আনতে সাহায্য
করে।
তো যেটা বলছিলাম…
ক্লাসের বই এ শিরক সম্পর্কে পড়লাম। টিচার-ছাত্ররা হিন্দুদের মুর্তি নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসি করলো। প্রাণ নেই- কিছু করার ক্ষমতা নেই- সে আবার দেবতা!!! বিষয়টি ভালো লাগে না। পড়লাম, সবচেয়ে ভয়াবহ পাপ শিরক!! এটার কোন ক্ষমা নেই!! প্রচণ্ড খারাপ লাগলো- কুফরি বা আল্লাহকে অস্বীকার/অবিশ্বাস করলেও মাফ আছে, অন্য ঈশ্বরকে মানলেও হয়তো মাফ আছে- কিন্তু শিরক এর কোন মাফ নেই!!!! এমনটা কেন হবে? এই প্রশ্ন মাথায় আসতে থাকলো। হিন্দু কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম- এরকম মাটির মুর্তিকে পুজা করেন কেন? তিনি বললেন- মাটির মুর্তি হিসাবে তো পুজা করিনা- আসলে তো পুজা করি দেবতাকে। মুর্তি তো মাধ্যম মাত্র। অনেক ভাবতে থাকি। ভাবতে ভাবতে দেখি একসময় মনে হলো- আসলে ইসলাম, হিন্দু, খৃস্টানেরা যা পালন করে তা অনুশাসন মাত্র। সেখান থেকেই মনে হলো- এসবে তো কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহকে ডাকতে গেলেও মুসলামনদের কিছু কাজ করতে হয়- নামাজ পড়তে হয়, মসজিদে যেতে হয়, পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হয়…., তাহলে হিন্দুরা মুর্তি বানিয়ে দেবতাকে ডাকলে দোষ কি? ছোটবেলা থেকে মসজিদকে আল্লাহর ঘর বলে এসেছি- আল্লাহর যদি ঘর থাকতে পারে- তবে মুর্তিতে দোষ কি? ক্লাসে হজ্জের নিয়ম পড়তে গিয়ে দেখি- এখনও কাল্পনিক শয়তানের দিকে পাথর ছুড়তে হয়। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে যদি শয়তানের দিকে পাথর ছুড়া যায়- তবে মুর্তি পুজায় সমস্যা কি? ক্লাসের ধর্ম স্যার হজরে আসওয়াদের কাহিনী শুনালেন। সেই পাথরে এখনো মুসলমানেরা চুমু খায়, মনে হলো তবে মুর্তি পুজায় সমস্যা কি? আল্লাহর যদি গণ্ডায় গণ্ডায় ফেরেশতা থাকে তবে ভগবানের দেবতা-দেবী থাকতে দোষ কি? ফেরেশতারা যদি মানুষের রূপ নিয়ে আসতে পারে, তবে এক ভগবান-ই বা বিভিন্ন রূপ নিতে পারবে না কেন?
ক্লাসের বই এ শিরক সম্পর্কে পড়লাম। টিচার-ছাত্ররা হিন্দুদের মুর্তি নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসি করলো। প্রাণ নেই- কিছু করার ক্ষমতা নেই- সে আবার দেবতা!!! বিষয়টি ভালো লাগে না। পড়লাম, সবচেয়ে ভয়াবহ পাপ শিরক!! এটার কোন ক্ষমা নেই!! প্রচণ্ড খারাপ লাগলো- কুফরি বা আল্লাহকে অস্বীকার/অবিশ্বাস করলেও মাফ আছে, অন্য ঈশ্বরকে মানলেও হয়তো মাফ আছে- কিন্তু শিরক এর কোন মাফ নেই!!!! এমনটা কেন হবে? এই প্রশ্ন মাথায় আসতে থাকলো। হিন্দু কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম- এরকম মাটির মুর্তিকে পুজা করেন কেন? তিনি বললেন- মাটির মুর্তি হিসাবে তো পুজা করিনা- আসলে তো পুজা করি দেবতাকে। মুর্তি তো মাধ্যম মাত্র। অনেক ভাবতে থাকি। ভাবতে ভাবতে দেখি একসময় মনে হলো- আসলে ইসলাম, হিন্দু, খৃস্টানেরা যা পালন করে তা অনুশাসন মাত্র। সেখান থেকেই মনে হলো- এসবে তো কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহকে ডাকতে গেলেও মুসলামনদের কিছু কাজ করতে হয়- নামাজ পড়তে হয়, মসজিদে যেতে হয়, পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হয়…., তাহলে হিন্দুরা মুর্তি বানিয়ে দেবতাকে ডাকলে দোষ কি? ছোটবেলা থেকে মসজিদকে আল্লাহর ঘর বলে এসেছি- আল্লাহর যদি ঘর থাকতে পারে- তবে মুর্তিতে দোষ কি? ক্লাসে হজ্জের নিয়ম পড়তে গিয়ে দেখি- এখনও কাল্পনিক শয়তানের দিকে পাথর ছুড়তে হয়। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে যদি শয়তানের দিকে পাথর ছুড়া যায়- তবে মুর্তি পুজায় সমস্যা কি? ক্লাসের ধর্ম স্যার হজরে আসওয়াদের কাহিনী শুনালেন। সেই পাথরে এখনো মুসলমানেরা চুমু খায়, মনে হলো তবে মুর্তি পুজায় সমস্যা কি? আল্লাহর যদি গণ্ডায় গণ্ডায় ফেরেশতা থাকে তবে ভগবানের দেবতা-দেবী থাকতে দোষ কি? ফেরেশতারা যদি মানুষের রূপ নিয়ে আসতে পারে, তবে এক ভগবান-ই বা বিভিন্ন রূপ নিতে পারবে না কেন?
এমন চিন্তা করা শুরু করেছি, বন্ধুদের সাথে
যুক্তি-তর্ক করি; কেউ কেউ ভয়ে আমার সাথে ধর্ম নিয়ে কথা বলতে আসে না- ধর্ম বিষয়ক
কথা শুরু হলেই দেখা যায়- কেউ কেউ কথা বন্ধ করে দেয়- জানায়, এ বিষয়ে নাকি আমার সাথে
কথা বলা যাবে না। তারপরেও অনেকের সাথে যুক্তি-তর্ক হতো। এবং এই তর্ক করতে গিয়ে
হঠাৎ করেই একজনকে বলে ফেলি- “তুই আজ ইসলামের
নামে এত বড় বড় কথা বলছিস- এই তোর জন্ম একটা হিন্দুর ঘরে হলে- মা কালীর নামে তোর
মুখ দিয়ে ফেনা ছুটতো!” এটা বলার
দেখি আমি চুপ- সেই বন্ধুও চুপ। সে-ও প্রচণ্ড ধাক্কা খায়, আর আমার ভাবনার আরেকটি
দিক উন্মোচিত হয়ে যায়….
এই চিন্তাটিই আমাকে আমার ধর্মীয় বিশ্বাসকে দূরে
ঠেলে দিতে দারুন সাহায্য করে। আমি মুসলমান কারণ আমার বাবা-মা মুসলমান, পারিবারিক
পরিবেশ মুসলমান, জন্ম পরবর্তী সমস্ত কিছুই আমাকে মুসলমান হিসাবে গড়ে তুলেছে। একজন
হিন্দু বা একজন খৃস্টানের ক্ষেত্রেও তা-ই। তাহলে আমার আল্লাহ বা অন্যদের ভগবান বা
গড এর ভূমিকা কি?
এবারে চিন্তার ক্ষেত্রটিতে ঝড় আসে আল্লাহর
অস্তিত্ব নিয়ে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে। সন্দেহ তৈরী হয়- কিন্তু পুরো নিসন্দেহ হতে
পারি না….
আমার ক্লাস নাইন আর টেন- দুটো বছরই গেছে প্রচণ্ড
দ্বিধায়, অস্থিরতায়। এই সময়কালটাকেই বলবো আমার ট্রানজিশন পিরিয়ড। ইসলাম ধর্মের
অসংখ্য বিষয় নিয়ে প্রশ্ন চলে এসেছে- অন্যান্য প্রচলিত ধর্ম সম্পর্কে তো আগে থেকেই
খারাপ ধারণা ছিল- গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে যতটুকু পড়েছি ভালোই লাগে- কিন্তু বৌদ্ধ
মন্দিরে তো দেখি বুদ্ধ মূর্তি- তাকে কেন্দ্র করে পুজার মত অনুষ্ঠানও হয়- শুনলাম
বৌদ্ধরা নাকি বুদ্ধরে ভগবানও বলে। কি করি?
ঈশ্বর/আল্লাহকে নিয়ে ভাবলাম, অনেক চিন্তা করলাম-
অনেক সন্দেহ তৈরী হয়েছে- কিন্তু মন থেকে পুরো নাস্তিক হতে পারছি না। বিজ্ঞানকেই
আকড়ে ধরে চিন্তাগুলোকে সাজাবার চেষ্টা করছি- এইট/নাইন পর্যন্ত বিজ্ঞানের বই-ই
ভরসা- অনেক কিছুই জানি না; তবু সেই সময়ে বস্তু-শক্তির নিত্যতা সূত্র আর গণিতের
সংখ্যা রেখা দিয়ে নিজের মত কিছু যুক্তি বানিয়ে নিলাম। ডিটেইলস না জেনেই বিজ্ঞানের
বিবর্তনকেই সঠিক মনে হতে থাকে। ক্লাসের বই এ ছিল, অভিযোজন। সেটাকে কেন্দ্র করে
নিজের মত করে বিবর্তনবাদকে সাজালাম (আজ বুঝি ল্যামার্কীয় ভুল ধারণার মধ্যে ছিলাম)।
কিন্তু তারপরেও নাস্তিকতার ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চিত হতে পারিনা।
সে সময়ের ডায়েরী এখনো মাঝে মধ্যে উল্টে পাল্টে
নাড়ি। সেখানকার তিনটি লেখা এখানে তুলে দিচ্ছি- এটাতে আমার ট্রানজিশন পিরিয়ডের
চিন্তার গতি বুঝা যেতে পারে। লেখা তিনটি সম্ভবত আমার ক্লাস নাইন/টেনের দিককার
লিখা। তবে মজার ব্যাপার হলো- এগুলোর কোনটি কোনটি আমি পরে (ঐ নাইন টেনেই) আবার কেটে
দিয়ে পাশে লিখেছি- “আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি”, “আমার পুরা
বিশ্বাস আছে”, “আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দাও”… ইত্যাদি।
প্রথমটি:
“আমার ধর্ম কি?”
আমার বাবা-মা দুজনই মুসলমান। সুতরাং জন্মের পর থেকেই আমিও মুসলমান ছিলাম। কিন্তু বর্তমানে এই ধর্মের বেশ কয়েকটি ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করায় আমি কাফির। যেমন, খাবারের ব্যাপারেই ধরা যাক। কাছিম, কুচে বা যেকোন খাবার যা হিন্দুদের বা অন্য দেবদেবীর নামে উৎসর্গ করা হয়েছে, সবই হারাম করা হয়েছে এই ধর্মে। কিন্তু এটা আমি মানতে পারিনা। কাছিম-ব্যঙ-কুচে হয়তো আমি ঘৃণার কারণে খেতে পারবো না, কিন্তু ওটা খেলেই আমার ধর্ম আমাকে ত্যাগ করবে, এটা আমি মানতে পারছি না। যেখানে অন্য ধর্মের লোকেরা এসব খেতে পারছে সেখানে মুসলমানেরা এসব খাবার খেতে পারবে না কেন? আর, দেবদেবীর নামে উৎসর্গ করলে তা খাওয়া যাবে এই নিয়মকে বলতে গেলে আমি ঘৃণা করি। কেননা এভাবে আমাদের ধর্মে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। কোন খাবার দেবদেবী আর জাহান্নামের (নরক) নামেই উৎসর্গ করা হোক- তাতে খাবারটির গুনগত মানের কোন পার্থক্য হয় না, এটা যেকেউ ১০০% নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারবে। তাহলে সেই খাবার খেতে অসুবিধা কোথায়? অবশ্য সকল ধর্মেই এ ধরণের কুসংষ্কার আছে। যেমন: হিন্দু ধর্মে গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। এটাও আমি মানতে পারিনা। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, বর্তমানে আমি কোন ধর্মেই নেই, অর্থাৎ আমি নাস্তিক। তবে ইসলাম ধর্মের বেশ কিছু জিনিস অবশ্য ভালোলাগে। তাই এই ধর্ম এখনো আমি পুরোপুরি ছাড়িনি।
সুতরাং আমি ৭০% নাস্তিক, এবং ২৯% মুসলমান, ০.৯% বৌদ্ধ ও ০.১% অন্যান্য।
“আমার ধর্ম কি?”
আমার বাবা-মা দুজনই মুসলমান। সুতরাং জন্মের পর থেকেই আমিও মুসলমান ছিলাম। কিন্তু বর্তমানে এই ধর্মের বেশ কয়েকটি ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করায় আমি কাফির। যেমন, খাবারের ব্যাপারেই ধরা যাক। কাছিম, কুচে বা যেকোন খাবার যা হিন্দুদের বা অন্য দেবদেবীর নামে উৎসর্গ করা হয়েছে, সবই হারাম করা হয়েছে এই ধর্মে। কিন্তু এটা আমি মানতে পারিনা। কাছিম-ব্যঙ-কুচে হয়তো আমি ঘৃণার কারণে খেতে পারবো না, কিন্তু ওটা খেলেই আমার ধর্ম আমাকে ত্যাগ করবে, এটা আমি মানতে পারছি না। যেখানে অন্য ধর্মের লোকেরা এসব খেতে পারছে সেখানে মুসলমানেরা এসব খাবার খেতে পারবে না কেন? আর, দেবদেবীর নামে উৎসর্গ করলে তা খাওয়া যাবে এই নিয়মকে বলতে গেলে আমি ঘৃণা করি। কেননা এভাবে আমাদের ধর্মে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। কোন খাবার দেবদেবী আর জাহান্নামের (নরক) নামেই উৎসর্গ করা হোক- তাতে খাবারটির গুনগত মানের কোন পার্থক্য হয় না, এটা যেকেউ ১০০% নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারবে। তাহলে সেই খাবার খেতে অসুবিধা কোথায়? অবশ্য সকল ধর্মেই এ ধরণের কুসংষ্কার আছে। যেমন: হিন্দু ধর্মে গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। এটাও আমি মানতে পারিনা। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, বর্তমানে আমি কোন ধর্মেই নেই, অর্থাৎ আমি নাস্তিক। তবে ইসলাম ধর্মের বেশ কিছু জিনিস অবশ্য ভালোলাগে। তাই এই ধর্ম এখনো আমি পুরোপুরি ছাড়িনি।
সুতরাং আমি ৭০% নাস্তিক, এবং ২৯% মুসলমান, ০.৯% বৌদ্ধ ও ০.১% অন্যান্য।
দ্বিতীয়টি:
“এলেবেলে”
সৃষ্টিকর্তা আসলেই কি আছে? সৃষ্টিকর্তা আসলেই কি আছে? সৃষ্টিকর্তা আসলেই কি আছে? এই প্রশ্নটা প্রায়শই আমার মনে উদিত হয়। নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করি, যদিও এখনো সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারিনি।
“এলেবেলে”
সৃষ্টিকর্তা আসলেই কি আছে? সৃষ্টিকর্তা আসলেই কি আছে? সৃষ্টিকর্তা আসলেই কি আছে? এই প্রশ্নটা প্রায়শই আমার মনে উদিত হয়। নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করি, যদিও এখনো সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারিনি।
আচ্ছা, আমাদের এই পৃথিবীকেই নিয়ে শুরু করা যাক। এই
পৃথিবীর জন্ম কিভাবে? সঠিক উত্তর পাওয়া না গেলেও অনেকে মনে করেন- সূর্যেরই একটা
অংশ পৃথিবী। তাহলে সূর্যের জন্ম কোথা থেকে বা কিভাবে? হয়তো বলা যাবে- সূর্য জন্ম
নিয়েছে বড় কোন ধুমকেতু বা জ্যোতিস্ক থেকে। কিন্তু সেই বড় জ্যোতিস্কই বা কোথা থেকে
এসেছে? ….. আমরা বস্তুর নিত্যতা
সূত্র থেকে জানতে পারি সৃষ্টির পর থেকে কোন বস্তুর বা বস্তুর ভরের কোন পরিবর্তন
ঘটেনি। তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে, এসব গ্রহ-উপগ্রহ কোন বিন্দু থেকে উৎপন্ন হয়নি।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এসব উৎপন্ন করতে নিশ্চয়ই কারো হাত আছে, তিনিই সৃষ্টিকর্তা।
উপরের আলোচনা হতে বুঝা গেল যে, কোন জিনিসের
সৃষ্টির জন্যই প্রয়োজন সৃষ্টিকর্তা। তাহলে আরেকটি প্রশ্ন জাগে এই সৃষ্টিকর্তার
সৃষ্টিকর্তা কে, তার সৃষ্টিকর্তা কে? এক্ষেত্রেও আমরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছি।
সুতরাং এতটুকু আলোচনা হতে আমরা যেমন নিশ্চিতভাবে বলতে পারবো না যে সৃষ্টিকর্তা
নেই, তেমনি নিশ্চিতভাবে বলতে পারবো না যে সৃষ্টিকর্তা আছে।
এবার আলোচনার একটু গভীরে প্রবেশ করি। সংখ্যারেখায়
সবচেয়ে বড় সংখ্যা কত? আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারেনি সবচেয়ে বড় সংখ্যাটি কত, কেউ
পারবেও না। তেমনি আমাদের মহাবিশ্বের বিস্তৃতি কত ব্যাপক তার শেষ কারও পক্ষে দেখা
সম্ভব হবে না। একজন মানুষের মগজ তার তুলনায় নগন্য, মানুষটি আবার পৃথিবীর তুলনায় নগণ্য,
পৃথিবী আবার সৌরজগতের তুলনায় নগন্য, সৌরজগৎ আবার আমাদের গ্যালাক্সির তুলনায় খুবই
নগন্য। অসংখ্য গ্যালক্সির সমন্বয়ে গঠিত বিশ্বজগতের তুলনায় সেই গ্যালাক্সি নগন্য,
তেমনি অসংখ্য বিশ্বজগৎ নিয়ে তৈরী হয় আরেকটি জগৎ, তাদের নিয়ে তৈরী হয় আরো বিশাল
একটি জগৎ……… আর বিশালতার মাঝে সৌরজগৎ বা
পৃথিবীর সৃষ্টি কোন ঘটনাই না। বস্তুর নিত্যতা সূত্র থেকে জানি- বস্তুর রূপান্তর
সম্ভব- সৃষ্টি বা ধংস হয় না। পৃথিবী বা সৌরজগৎ সৃষ্ট তেমনি একটি রূপান্তর।
প্রকৃতপক্ষে এই ধরণের বিশ্বজগৎ অসীম-অনন্ত।
অনুরূপভাবে আমরা বিশ্বজগৎ সৃষ্টিকে অর্থাৎ এর সময়কালকেও
আমরা অসীম বা অনন্ত বলতে পারি। অর্থাৎ অনন্তকাল ধরেই চলে আসছে এই প্রকৃতিজগৎ।
সামগ্রিকভাবে (সম্পূর্ণ) বিশ্বজগৎ কিভাবে এবং কখনো সৃষ্টি হলো- তা ঐ সংখ্যারেখার
সবচেয়ে বড় সংখ্যার মতই অসীম ও অনন্ত।
আবার সৃষ্টিকর্তা যদি সত্যিই থেকে থাকেন- তবে
এক্ষেত্রেও প্রশ্ন রয়েছে, তিনি কে? তিনি কেমন? অর্থাৎ তার স্বরূপ কিরূপ? আমাদের
পৃথিবীতে এতগুলো ধর্মের মধ্যে কোনটির প্রভু আসল সৃষ্টিকর্তা? সকল ধর্মের জন্ম ঘটনা
থেকে জানা যায় যে, একজন রক্ত মাংসের মানুষ এসে সেই ধর্ম প্রবর্তন করেন। এবং বেশীর
ভাগ ক্ষেত্রেই সেই ধর্মপ্রচারক তার নিজের সাথে প্রচারিত সৃষ্টিকর্তার যে একটা
সম্পর্ক আছে তা প্রচার করেন। (যেমন মুহম্মদ সা আল্লাহর বন্ধু, যীশুখৃস্ট ঈশ্বরের
পুত্র। কৃষ্ণ-দেবতা-দেবী তারা তো ভগবানেরই ভিন্ন রূপ)।
তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে প্রতিটা ধর্মেরই কেরামতি
মৃত্যু বা মৃত্যু পরবর্তী জগৎ নিয়ে। কেননা মৃত্যু বা মৃত্যু পরর্বর্তী জগৎ
সম্বন্ধে সবাই অজ্ঞ।
যাহোক, সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে নেগেটিভ দিকে আছি ৬০%
এবং পজিটিভ দিকে ৪০%।
যাহোক, সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে নেগেটিভ দিকে আছি ৬০%
এবং পজিটিভ দিকে ৪০%।
তৃতীয়টি (ঈষৎ সংক্ষেপিত)
“নাস্তিক বনাম গোঁড়া ধার্মিক”
আমার কেন জানি নাস্তিকদের একটা আলাদা টান রয়েছে, … গোড়া ধার্মিকদের প্রতি কেমন যেন একটা অবজ্ঞাভাব প্রকাশ করে। কারণ কি? কারণ সম্ভবত:
ক) নাস্তিকেরা সাহসী, গোড়া ধার্মিকেরা ভীতু। সাহস না থাকলে কেউ নাস্তিক হতে পারেনা।
খ)নাস্তিকদের চিন্তাশক্তি প্রখর। নাস্তিকেরা তীক্ষ্ণভাবে চিন্তা করতে পারে, যুক্তিতর্কের মাঝ্যমে তারা সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করে। কিন্তু গোঁড়া ধার্মিকরা কোন রকম যুক্তিতর্ক ছাড়াই অন্ধভাবে সৃষ্টিকর্তাকে মনে করতো!!!!!!! এদের অনেকের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার ভয় এমনভাবে গাঁথা যে তারা কোন যুক্তিতর্কই মানতে চায় না, তাদের চিন্তাগত শক্তি ভোঁতা হয়ে থাকে। তারা যা বিশ্বাস করে তা কখনোই প্রমাণ করতে পারে না….
গ) নাস্তিকেরা পরোপকারী কিন্তু গোড়া ধার্মিক: যারা নাস্তিক- তারা পরোপকারী, তারা পরের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে। অপরপক্ষে ধর্মকর্ম সবসময়ই মানুষকে স্বার্থপর হতে শেখায়। একজন মুসলমান নামাজ, রোযা, হজ্জ পড়ে তার নিজের পূণ্য হাসিলের জন্য বা বেহেশত লাভের লোভে।
“নাস্তিক বনাম গোঁড়া ধার্মিক”
আমার কেন জানি নাস্তিকদের একটা আলাদা টান রয়েছে, … গোড়া ধার্মিকদের প্রতি কেমন যেন একটা অবজ্ঞাভাব প্রকাশ করে। কারণ কি? কারণ সম্ভবত:
ক) নাস্তিকেরা সাহসী, গোড়া ধার্মিকেরা ভীতু। সাহস না থাকলে কেউ নাস্তিক হতে পারেনা।
খ)নাস্তিকদের চিন্তাশক্তি প্রখর। নাস্তিকেরা তীক্ষ্ণভাবে চিন্তা করতে পারে, যুক্তিতর্কের মাঝ্যমে তারা সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করে। কিন্তু গোঁড়া ধার্মিকরা কোন রকম যুক্তিতর্ক ছাড়াই অন্ধভাবে সৃষ্টিকর্তাকে মনে করতো!!!!!!! এদের অনেকের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার ভয় এমনভাবে গাঁথা যে তারা কোন যুক্তিতর্কই মানতে চায় না, তাদের চিন্তাগত শক্তি ভোঁতা হয়ে থাকে। তারা যা বিশ্বাস করে তা কখনোই প্রমাণ করতে পারে না….
গ) নাস্তিকেরা পরোপকারী কিন্তু গোড়া ধার্মিক: যারা নাস্তিক- তারা পরোপকারী, তারা পরের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে। অপরপক্ষে ধর্মকর্ম সবসময়ই মানুষকে স্বার্থপর হতে শেখায়। একজন মুসলমান নামাজ, রোযা, হজ্জ পড়ে তার নিজের পূণ্য হাসিলের জন্য বা বেহেশত লাভের লোভে।
এগুলোকে একজন ক্লাস নাইন/টেনের ছেলের চিন্তাভাবনা
হিসাবে দেখলেই বুঝা যাবে- কিভাবে কোন পদ্ধতিতে ঈশ্বর ভাবনার দীর্ঘদিনের জেঁকে বসা
পাথরটি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে- নাস্তিকতার প্রতিই প্রধানত
ঝোঁক- কিন্তু তারপরেও একটা ভয়: যদি শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর বলে কিছু থেকেই থাকে? ফলে আর
পুরো নাস্তিক হওয়া হলো না। কোন দুর্বল মুহুর্তে- যেমন পরীক্ষার আগে আগে- যখন
কোনভাবেই পড়ায় মন বসাতে পারছি না- তখন হয়তো ডায়েরীর এরকম নাস্তিক কথা কেটে তার
পাশে বিশ্বাসের কথা লিখছি- এককথা অসংখ্যবার লিখছি (যেনবা জিকির করছি!), মাঝে মধ্যে
ভালো করে নামাজ পড়া শুরু করছি…।
এমনই অস্থিরভাবে কেটেছে আমার এই ট্রানজিশন
পিরিয়ডটা।
(২)
একদিন এক আস্তিক বন্ধুর সাথে তর্ক করছিলাম। আগেই
বলেছি- এই তর্ক-বিতর্ক সবসময়ই আমার চিন্তাকে গুছিয়ে নিতে সাহায্য করেছে, বিপরীত
যুক্তি-মত-প্রশ্ন আমাকে নতুন ভাবনার খোরাকই দিয়েছে। তো- সেই বন্ধুর সাথে
যুক্তি-তর্ক করছি, আমি একেক করে বিজ্ঞানের কথা বলছি- সবগুলোতেই সে আল্লাহর মহিমা
খুঁজে পাচ্ছে। এমনি যুক্তি করতে করতে অনেকটা বিরক্ত হয়ে আল্লাহকেই চ্যালেঞ্জ
জানাই।
পাশে একটা ইট ছিল- সেটা ধরে একটু উচুতে নিয়ে ফেলে
দিলাম। দিয়ে বললাম- আল্লাহ তো শুধু “হও” বললেই সব হয়ে যায়, তাঁর তো অসীম ক্ষমতা- এখন দেখি
আল্লাহ কেমনে পারে- এই ইটকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে চালিত করুক। নিজে আবার
আমি ইটকে উপরে তুলে বললাম- এই যে আমি কিন্তু ঠিকই উপরে তুলতে পারছি- কিন্তু আল্লাহ
পারলো না- আবার ছেড়ে দিয়ে বলি, কই আল্লাহর ক্ষমতা তো কিছু দেখছি না। বন্ধুটি কি
বলবে- খুঁজে পাচ্ছিল না, এবং ধীরে ধীরে ক্ষেপে উঠছিল। স্বীকার করছি- তার এই যে
অক্ষম ক্রোধ, এটাতে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। (নাস্তিকতার শুরুর দিকে- আস্তিকরা যুক্তিতে
না পেরে যখন ক্ষেপে যেত- সেটা অনেকদিন পর্যন্ত খুব আনন্দ দিত; কিন্তু একটা সময় এই
এপ্রোচের ভুল ধরতে পারি- কেননা আস্তিকদের খেপানোর মাধ্যমে শুধু দূরত্বই তৈরী হতো-
আর কিছু হতো না। এপ্রোচের কথা যদি বলতেই হয় বলবো আরজ আলী মাতুব্বরের কথা। যার কাছ
থেকে এপ্রোচের স্টাইল সম্পর্কে শিখেছি ও এখনো শিখছি- তিনি আরজ আলী মাতুব্বর।)
এই যে আল্লাহকে অক্ষম বলে প্রমাণ করে দেয়া- সেটা
শুরুতে যুক্তি-পাল্টা যুক্তির ধারাবাহিকতায় বলেছিলাম- অনেকটা ঝোঁকের মাথায়। সেটা
আমার জন্য তখনও সহজ ছিল না, কারণ আমি তখনও আল্লাহর অনস্তিত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত
নই। ভয় ছিল যে, সত্যি আল্লাহ যদি থেকে থাকেন- এবং এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে হঠাৎ কোন
গজব নামিয়ে দেন!! তো প্রথম চ্যালেঞ্জ এই জিতে যাওয়ার পরে যেন সাহস আরো বাড়তে থাকে-
চ্যালেঞ্জ বাড়াতে বাড়াতে একসময় নিজেকে নিয়েও চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকি। বলি- আল্লাহ
যদি সত্যি থেকে থাকেন, তবে চ্যালেঞ্জ জানানচ্ছি- আমাকে এই মুহুর্তে টুপ করে মেরে
ফেলুক.. ইত্যাদি। আস্তিক বন্ধুদের কেউ আমার জন্যে ভয়ে তওবা করে, আবার কেউবা
যথারীতি ক্ষেপে ভূত!!
তো, কেউ কেউ যুক্তি করতো – আল্লাহর তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই- যার তার
চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে? আমি বুঝতে পারি – আল্লাহর
খেয়েদেয়ে কোন কাজই আসলে নেই। আল্লাহ যদি থেকেই থাকেন, প্রচণ্ড অথর্ব টাইপের কেউ-
কেননা প্রকৃতির কোন একটি নিয়ম ভাঙ্গার মতো সামর্থ বা ক্ষমতা তার নেই। (অনেক
পরে দেখি আইনস্টাইনও একই রকমের কথা বলেছেন!!)
এগুলো- প্রশ্ন হিসাবেই ছিল- কিন্তু কেউ তো তার
জবাব দিতে পারতো না, উল্টো যা দিতো তা প্রশ্নকেই বরং বাড়িয়ে তুলতো। এর মধ্যেই
আস্তিকদের কাছ থেকে আরেক ধরণের যুক্তির সাথে পরিচিত হলাম। সবকিছুই কোরআন-হাদীসের
মাধ্যমে প্রমাণ করে দেয়া। আল্লাহ আছেন কিনা- এটার জবাব আল্লাহ কোরআনে কি বলেছেন
সেটা দিয়ে দেয়া!!
ক্লাস টেনে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত একটা স্যারের
কাছে ব্যাচে পড়তে যেতাম- মাঝখানে এশার নামাজ পড়ার জন্য স্যার সবাইকে ধরে মসজিদে
নিয়ে যেত। আমি আর একদুজন যথারীতি ফাকি দিতাম। তো একদিন ব্যাচেরই এক আস্তিক বন্ধু
স্যার মসজিদে যাওয়ার পরে আমাকেও মসজিদে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করছিল। শেষে
বলতেই হলো- আমার ধর্ম নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। সে খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো- কি?
আমার ইন্সট্যান্ট জবাব(মানে প্রশ্ন): “এই যে নামাজের
আগে আমরা ওযু করি- ওযু ভঙ্গের অন্যতম কারণ বায়ু নির্গত করা ও ওযু ভেঙ্গে গেলে নিয়ম
আবার ওযু করা। এখন, ধর- আমি মাত্রই ওযু করেছি- এখনও আমার হাত-পা-মুখ ভেজা, এমন সময়
আমার বায়ু নির্গত হলো- আমাকে কেন ওযুর নাম করে আবার সেই ভেজা হাত-পাগুলোই ধুতে
হবে? এমনতো নয় যে- আমি পশ্চাদ্দেশ পরিষ্কার করার মাধ্যমে ওযু করছি?” বেচারি জবাব দিতে না পেরে স্যারকে জানিয়ে
দিল। পিঠে বেতের বাড়ি খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম- কিন্তু সে পথে না গিয়ে স্যার
জবাব দেয়ার চেষ্টা করলেন। স্যার কোরআন-হাদীস থেকে কোট করলেন- পুরো আরবীতে, মুখস্থ।
বাংলায় জানালেন- আল্লাহ জানিয়েছেন- পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ, ফলে মুমীনদের
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, প্রতিদিন গোসল করা- পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে ওযু
করার মাধ্যমে মুসল্লীরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে…… ইত্যাদি।
কিন্তু আমার জবাব আর পাওয়া হলো না। যাহোক- ততদিনে এধরণের যুক্তি শুনে অভ্যস্ত হয়ে
গিয়েছিলাম- কি আর করা….।
এভাবেই বিভিন্ন টুকরো টুকরো ঘটনায়-ভাবনায়-প্রশ্নে
মোটাদাগে আমার নাস্তিকতার সূত্রপাত। অন্য অনেকের ক্ষেত্রে যেমন আরজ আলী, হুমায়ুন
আজাদ, আহমদ শরীফ প্রমুখের বই পড়ে বিশ্বাসে আঘাত খাওয়া, প্রশ্ন তৈরী হওয়া- আমার
ক্ষেত্রে তেমনটি নয়। এনারা আমার জীবনে এসেছেন- নাস্তিক হওয়ার অনেক পরে। এঁদের
কাছেও আমার অবশ্যই অনেক ঋণ, তাঁদের কাছ থেকে আমি অনেক যুক্তি পেয়েছি। কিন্তু
নাস্তিকতার প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁদের ভূমিকা নেই। ভূমিকা যদি কারও থেকেই থাকে- তবে
এ মুহুর্তে তিনজনের নাম বলবো- কাজী নজরুল ইসলাম- হুমায়ুন আহমেদ ও তসলিমা নাসরিনের।
পরিচিত অধিকাংশ ছেলেমেয়েদের দেখেছি- প্রিয় কবি বা
লেখকের কথা আসলেই যার যার ধর্ম অনুযায়ী প্রিয় নির্ধারিত হয়। মুসলমান বন্ধুর
অবধারিত নজরুল, আর হিন্দু বন্ধুটি রবীন্দ্রনাথ বলতে অজ্ঞান। এটা প্রায় কমন। শুধু
এতটুকু থাকলেই হতো- কিন্তু দেখা গেল, মুসলমান বন্ধুরা একটা বড় অংশই রবীন্দ্রনাথ
বিরোধি আর হিন্দু বন্ধুদের বড় অংশ নজরুল বিরোধি। আমি ক্লাস এইট/নাইন/টেনের কথা
বলছি। আমারও সে সময়ে প্রিয় কবি ছিল সুকান্ত আর নজরুল- বলাই বাহুল্য তেজী কবিতা
সেসময়ে পছন্দ করতাম। নজরুল প্রিয় হলেও- ধর্মানুযায়ী এই ভালো লাগালাগিতে বিরক্তি
তৈরি হতো। অনেকে নজরুলের হামদ-নাতের কথা, ইসলামী গানের কথা বলতো। মেলাতে পারতাম
না। প্রিয় কবিতা “বিদ্রোহী”র কিছু লাইন খুব ভালো লাগতো- “ভয়ে হাবিয়া দোযখ নিভে নিভে যায় কাপিয়া”, “আমি জাহান্নামের
আগুনে বসি হাসি পুষ্পের হাসি”, “ধরি জীব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি”, “ভগবান বুকে একে
দেই পদচিহ্ন”। এলাইন কটি
থেকে একটা ধারণা ছিল- তিনি অন্যরকম। পরে এক কাকুর (বাবার বন্ধু) কাছ থেকে শুনি-
নজরুলের বিরুদ্ধেও মুরতাদ/কাফির ঘোষনা হয়েছিল। তিনি যেমন হামদ-নাত লিখেছেন-
লিখেছেন রাধা-কৃষ্ণ কীর্তন। শুনে খুব ভালো লাগে।
হুমায়ুন আহমেদের “শ্রাবণ মেঘের
দিন” বইটিতে দুটি বাক্য
মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়েছি। “আল্লাহর অংক
জ্ঞান কাঁচা”আর “ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেনি- ম্যান ক্রিয়েটেড গড”। সুরা নিসা মিলিয়ে দেখি আসলেই আল্লাহর
(প্রকৃতপক্ষে নবীজীর) অংকজ্ঞান মারাত্মক কাঁচা। আর- দ্বিতীয় বাক্যটি দীর্ঘদিন আমার
কানে বাজতো। এবং অনুরূপ বাক্য পরে পেয়েছি- নজরুলের কবিতায়- যার জন্য তাকে মুরতাদ
ঘোষনার দাবি তুলেছিল মোল্লারা:
“মানুষ এনেছে গ্রন্থ; –
গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!”
বা আরেক জায়গায় দেখেছিলাম- “পথ মানুষের সৃষ্টি- উল্টোটা নয়”। অর্থাৎ চালু একটা পথ অনেক পথিককে কাছে টানে ঠিকই- পথ আছে জন্যই সে পথ দিয়ে পথিক চলাচল করে বটেই- কিন্তু শুরুর কথা যদি আমরা দেখি- অবশ্যই একদম শুরুতে মানুষের দ্বারাই পথের সৃষ্টি হয়েছে। “মুহম্মদ সা:-ই ইসলাম- আল্লাহ- কোরআন প্রভৃতির স্রষ্টা” – এই ভাবনাটি অনেক বেশী যৌক্তিক মনে হতে লাগলো।
“মানুষ এনেছে গ্রন্থ; –
গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!”
বা আরেক জায়গায় দেখেছিলাম- “পথ মানুষের সৃষ্টি- উল্টোটা নয়”। অর্থাৎ চালু একটা পথ অনেক পথিককে কাছে টানে ঠিকই- পথ আছে জন্যই সে পথ দিয়ে পথিক চলাচল করে বটেই- কিন্তু শুরুর কথা যদি আমরা দেখি- অবশ্যই একদম শুরুতে মানুষের দ্বারাই পথের সৃষ্টি হয়েছে। “মুহম্মদ সা:-ই ইসলাম- আল্লাহ- কোরআন প্রভৃতির স্রষ্টা” – এই ভাবনাটি অনেক বেশী যৌক্তিক মনে হতে লাগলো।
আমি যখন ক্লাস নাইনে- তখন সারাদেশে ঘাদানিক এর
যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে ব্যাপক আন্দোলন চলছে। আমি আমার এলাকাতে বসেই সে আন্দোলনের তেজ
টের পাচ্ছিলাম, ঘাদানিক এর সিগনেচার ক্যাম্পেইন আমার জীবনের প্রথম রাজনৈতিক
অংশগ্রহণ। জামাত উল্টোদিকে ব্লাসফেমী আইনের জন্য আন্দোলন করছে, তসলিমা নাসরিনকে
মুরতাদ ঘোষণার জন্য আন্দোলন করছে। এসময়টিতে আমার অনেকের সাথে এ বিষয়গুলো নিয়ে
প্রচুর তর্ক করতে হয়েছে এবং তসলিমাকে নিয়ে তর্ক করতে গিয়ে তার বই পড়া আরম্ভ করে
দেই। তার নির্বাচিত কলাম বলতে গেলে গোগ্রাসে গিলি। এখান থেকে প্রচুর আয়াত-হাদীস
টুকে রাখি, মুখস্থ করি। মুসলমান মাত্রেরই মুহম্মদ সা এর প্রতি দারুন শ্রদ্ধা ও
ভক্তি থাকে, কলেমা তাইয়েবা থেকে সকল মুসলমান জানে শুধু আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আনলেই
হবে না- নবীজীকেও রাসুল হিসাবে মানলে পরে ঈমান পূর্ণ হবে। সে হিসাবে আমার নিজেরও
নবীজীর প্রতি ভক্তির জায়গা ছিল। মনে হতো- নবীজী যদি সত্যি থেকে থাকেন- তবে কোরআনও
আছে। কোরআন থাকলে তো আল্লাহও আছে- কেননা নবীজী তো আর মিথ্যা কথা বলতে পারেন না। এই
গদগদ ভক্তিভাব কাটাতে তসলিমা নাসরিন কিছুটা হলেও সাহায্য করেছেন। তার আক্রমনাত্মক
ভঙ্গিতে ইসলাম-কোরআন-মোহাম্মদ সা কে উড়িয়ে দেয়া, বিশেষ করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে
কোরআন-হাদীস দেখিয়ে নবীজীর একের পর এক বিয়ে করা, নারীদের প্রতি অবমাননাকর
হাদীস-কোরআন লিপিবদ্ধ করা এসব আমার খুব কাজে দেয়।
এমন করে বলতে গেলে হয়তো আরো অনেক কিছুই বলা যেতে
পারে। তবে মনে হয়- এরই মধ্যে যথেষ্ট বলেছি, পাঠকেরাও যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে
কৃতজ্ঞ করেছেন। এই হলো আমার অবিশ্বাসের শুরুর গল্প। পুরোপুরি- দ্বিধা-দ্বন্দ্ব
কাটিয়ে উঠি বলা যায় এসএসসি পরীক্ষার পরে। এসময়টায় অনেক বই (গল্প-উপন্যাস) হাতে
পাই, একাডেমিক পড়ার চাপবিহীন কিছু ফ্রি সময়ও পাই- ফলে চাপমুক্ত ভাবার অবকাশও তৈরী
হয়। প্রথম ভাবনাটা আসে- পরীক্ষার আগে আগে ভয়ে অস্থিরতায় অনেকটা কুপোকাত হওয়ার জন্য
একটা লজ্জাবোধ। সেখান থেকে আরেকটা চিন্তা মাথায় আসে- সেটা হলো: বুঝতে পারি- ঈশ্বর
বিশ্বাস মানুষের দুর্বল মুহুর্তের সঙ্গী। অবলম্বনহীন অবস্থায় মানসিক শক্তি পাওয়ার
একটা বায়বীয় অবলম্বন মাত্র। নিজেকে এমন দুর্বল ভাবতে ইচ্ছা করলো না। এই
চিন্তাকে সাথে নিয়ে আল্লাহ বা ঈশ্বর, কোরআন-ইসলাম-মুহম্মদ সা সবকিছু নিয়ে আবার
ভালো করে ভাবতে লাগলাম- শুরু শেষ পর্যন্ত। একসময় বুঝতে পারলাম- এতদিন অহেতুক ভয়
পেয়েছি- দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সব ছুড়ে ফেলে ঝেড়ে কাশার সময় এসেছে।
একজন মুসলমানের
তুলনায় একজন হিন্দুর নাস্তিক হয়ে উঠা অনেক সহজ। হিন্দু একটি প্রাচীন ধর্ম। এর কোন
নির্দিষ্ট প্রচারক নেই। প্রাচীন কাল থেকেই নানাজন নানা রকম সংযোজন করেছেন। ফলে
ভারতে যখন জনসংখ্যা তিরিশ লাখও ছিলনা, দেবতার সংখ্যা ছিল তিরিশ কোটি। ২০০১ সালে
দেশে গেছি। মাত্র সাড়ে বার বছরের ব্যবধান। গিয়ে দেখি নতুন এক ভগবানের সৃষ্টি হয়ে
গেছে। তেনার নাম, “লোকনাথ বাবা।” এই বাবাটি বল্টু ওয়ালা খড়ম পায়ে দিয়ে প্রথমে
মক্কা, তারপর আফগানিস্তান, ওখান থেকে ইরাক গিয়েছিলেন মুসলিম পন্ডিতদের সাথে ধর্ম
নিয়ে আলোচনা করতে। লক্ষ্য করুন, তেনার ভুগোল বিষয়ে কি রকম জ্ঞান ছিল! তেনার এক কথা
– “জলে, স্থলে, বনে-জংগলে, যেখানেই আমাকে স্মরণ
করিবে, আমি উদ্ধার করিব।”
বাংলাদেশীরা
ভারতের অনেক ভগবানদের নামই শোনে নাই। রাম-লক্ষ্মনের নাম জানে সবাই। কিন্তু আমি যত
টুকু জানি, বাংলাদেশে রামের কোন মন্দির নেই। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের হিন্দুরা শুধু
শুধুই মার খেল।
অন্যদিকে,
মুসলিম ধর্ম শক্ত কাঠামোর উপর নির্মিত। হযরত মুহম্মদ অত্যন্ত বিচক্ষন ও কৌশলী
ছিলেন। নিজের কথা না বলে দোহাই দিয়েছেন এমন কাউকে যিনি কখনোই ছিলেন না। (নজরুল
যথার্থই বলেছেন – মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ
আনেনি মানুষ কোন) এক হাতে তিলে তিলে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ধর্মটি। ফলে
ত্রুটি-বিচ্যুতি সহজে বোধগোম্য নয়। এখান থেকে বেরিয়ে আসা চাট্টিখানি কথা নয়।
স্কুল জীবনেই আমি আমার পৈত্রিক ধর্মের প্রতি আস্থা
হারাই। এক সময় মুসলিম ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হই। কোরান পড়ার পর আমার জ্ঞানবুদ্ধির
প্রসার ঘটে। আমার মোহ কেটে যায়। আমি তখন একই ভাবে ঝেড়ে কেশে সব কিছু থেকে বেরিয়ে
আসতে সক্ষম হই।সংগৃহীত
No comments:
Write comments