Flickr

Tuesday, 28 June 2011

মুজিবের বাকশাল আর নিজে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার জন্য নীতি-নৈতিকতা পদদলিত করলেন তিনি


মুজিবের বাকশাল আর নিজে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার জন্য নীতি-নৈতিকতা পদদলিত করলেন তিনি
 
দু'জন বিচারপতিকে সুপারসিড করে এবিএম খায়রুল হককে দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয় বর্তমান সরকার। তাঁর নিয়োগের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন যতটুকু না উত্তপ্ত ছিল তার থেকে অনেক বেশি উত্তপ্ত ও সরগরম ছিল সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণ। তাও মনে হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। কারণ অধিকাংশ রাজনৈতিক ইস্যুগুলোর সমাধান এ সময় আদালতই নিত্তি করেছে। ফলে আদালতই হয়ে ওঠে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। যদিও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তা কারোই কাম্য নয়। তা ছাড়া এর সুদূরপ্রসারী ক্ষতির দিকও কম নয়। প্রতিটি নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। আর রাজনৈতিক ইস্যুগুলোই যখন আদালত সমাধানের উদ্যোগ নেয় তখন স্বভাবতই সমালোচনার মুখে পড়ে আদালত। এদিক থেকে অবশ্য জনাব হকের জুড়ি তিনি নিজেই।
অথচ এই বিতর্কের জন্য রয়েছে সংসদ। কিন্তু সেইরকম অনেকগুলো মামলার রায় হয়েছে প্রধান বিচারপতি জনাব এবিএম খায়রুল হকের সময়ে। এই বিচারপতিকে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই এবং আপাতদৃষ্টিতে সহজে থামারও কোন সম্ভাবনা নেই। বরং ক্রমান্বয়ে দেশ সংঘাতমুখী হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক যতগুলো জটিল মামলার রায় দিয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই তিনি অনেক দুঃসাহসিক মানুষ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এতগুলো ঝুঁকি তিনি দেশ, জাতি ও আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়েছেন, নাকি প্রধান উপদেষ্টার পদটি গ্রহণ করার জন্য- সেই প্রশ্নটি এখন সবার আগে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাহলে প্রধান উপদেষ্টা যেই হোক না কেন জনাব হক যে এই মহান দায়িত্বের জন্য নৈতিকভাবে অযোগ্য এটি এখন দেশের মানুষ কারোই অজানা নয়। এখন রায় সংসদের মাধ্যমে বাতিল না করলে পরিস্থিতি অনেক জটিল হবে। আর যিনি এতগুলো সংকটের নেতৃত্ব দিলেন তাঁর ব্যাপারে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, বিচারপতি খায়রুল হকের মতো বিচারপতি শতাব্দীতে একজনই জন্মান। খায়রুল হক ছিলেন বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বর্ণযুগে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে অন্যতম কান্ডারি।
আমি এটর্নি জেনারেল সাহেবের কথাকে একটু শুধরিয়ে বলবো, বিচারপতি হক বিচার বিভাগকে স্বর্ণযুগে প্রবেশ করাননি, বরং জনাব হক প্রত্যেকটি মামলার রায় আওয়ামী লীগ স্বর্ণযুগে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে অন্যতম কান্ডারিই শুধু নয়; দিকপাল হিসেবে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন। আমি মনে করি বিচারপতি হক যদি এমন ভূমিকা না রাখেন তাহলে দু'জন বিচারপতিকে সুপারসিড করে তাঁকে প্রধান বিচারপতি করে আওয়ামী লীগের লাভ কী? এই আনুগত্যপরায়ণ মানুষ আওয়ামী লীগের সমপরিমাণ আর কোন রাজনৈতিক দলেই নেই। তিনি ১০০% দলীয় আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। এদিক থেকে অবশ্য জনাব হক মোবারকবাদ পাবার যোগ্য। বিএনপি এইদিক থেকে অনেক পেছনের সারিতে অবস্থান করছে। যদি আওয়ামী লীগের মতো দলীয় আনুগত্যপরায়ণ আরও কিছু মানুষ এ দলে থাকতো তাহলে বিএনপির এ জনসমর্থন নিয়ে তাদের ভাগ্য আজ অন্যভাবে লেখা হতো।
বিচারপতি হকের মতো এত বিতর্কিত ও সংঘাতমুখী রায় আর কেউ দিয়েছেন কিনা তা আইনজীবীরাই ভাল বলতে পারবেন। যেমন : তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলা, ৫ম সংশোধনীর রিভিউ'র (পর্যালোচনার) মামলা, ৭ম সংশোধনীর মামলা, ফতোয়ার মামলা, ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অব্যাহতি প্রদানের মামলা, খালেদা জিয়ার বাড়ির মামলাসহ সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলাগুলো বিশেষ উদ্দেশে নিজ ইচ্ছায় তিনি আগে নিত্তি করেছেন। তা ছাড়া সরকারের বিপক্ষে সোচ্চার দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ‘চেম্বার জজ মানেই সরকার পক্ষে স্টে' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপানোর পর পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ৬ মাসের জেল ও একলাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের সাজা দেন। একলাখ টাকা জরিমানার বিধান আইনে না থাকলেও এটা করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে মনে করেন আইনজীবীরা। দেশের ১৮তম প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম সরকারের নিয়োগ দেয়া হাইকোর্টের দু'জন বিতর্কিত অস্থায়ী বিচারপতিকে শপথ পড়ানো থেকে বিরত ছিলেন। কারণ হিসেবে ওই দু'জন বিচারপতির মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতির কক্ষে লাথিমারা ও ভাংচুর চালানোর অভিযোগ এবং অপরজন রাবিতে শিবির নেতার খুনের মামলার আসামী ছিলেন। জনাব হক গত বছর ১ অক্টোবর দায়িত্ব নেয়ার পরপরই ওই দু'জন বিচারপতির শপথ পড়ান।
এছাড়া হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালে এবিএম খায়রুল হক ২০০৯ সালে জনস্বার্থের একটি মামলায় জিয়াউর রহমানের স্থলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক স্বীকৃতি দিয়ে রায় দিয়েছেন। এ ধরনের রায়কে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন আইনজীবীরা। এ রায়ের মাধ্যমে তিনি বঙ্গবন্ধুকে খাটো করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। তিনি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘‘বঙ্গবন্ধু জাতির জনক। তিনি কখনোই স্বাধীনতার ঘোষক হতে পারেন না। জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক।’’
২০০৫ সালে তিনি ৫ম সংশোধনী বাতিল করে ওই রায় দেন। পাশাপাশি প্রধান বিচারপতি থাকাকালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলকে অবৈধ ঘোষণা করে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল ঘোষণার রায় বহাল রেখে গেছেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ, বঙ্গবন্ধু যেখানে দাঁড়িয়ে ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন সেই স্থানের সংরক্ষণ, পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের স্থান সংরক্ষণসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সব স্থান সংরক্ষণের রায়ও তিনি দিয়ে গেছেন। এতসব রায় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেয়া হয় বলে মনে করা হয়।
কিন্তু তার বিদায়ের মাত্র কিছু আগে রাজধানীর কাকরাইলে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের জন্য বহুতল বাসভবন ও বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণ কাজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের মধ্যে যে বাদানুবাদ হয়েছে তা যেন পূর্ববর্তী সকল সন্দেহ সত্য প্রমাণের সার্টিফিকেট দিয়ে গেলেন তিনি।
আইনমন্ত্রী তার বক্তব্যে বললেন ‘‘২০০৭ সালের নবেম্বরে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেয়া হয়। কিন্তু তাতে বিচারের কাজে মোটেও অগ্রগতি হয়নি’’। এরপর আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে হক বলেন, ‘তিনি কি জানেন, চারজন ম্যাজিস্ট্রেটকে একটি কোর্ট ব্যবহার করতে হয়? এর উত্তর কে দেবে? আমরা স্বাধীন হয়েছি, কী রকম স্বাধীন? আমাদের হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে দেয়া হয়েছে। এ রকম স্বাধীন আমরা হয়েছি! কাজেই মাননীয় আইনমন্ত্রী আপনার ঘর আগে সামাল দেন।’’ প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীর এই বাদানুবাদের সময় অনুষ্ঠানের মঞ্চে প্রধান অতিথির চেয়ারে বসা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পাঠকবৃন্দ লেখার কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে আমি বাদানুবাদ বিস্তারিত উল্লেখ করলাম না। তাহলে এই প্রশ্ন যদি স্বয়ং আইনমন্ত্রীর আর জনাব হকের বাদানুবাদের ভাষা হয় এমন, তাহলে আমাদের জনসাধারণের আর কী বলার আছে? তাহলে এখন কি জনমনে প্রধান বিচারপতি হকের রায় নিয়ে প্রশ্ন আসবে না? তিনি কি তাহলে কারো রিমোট কন্ট্রোল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলেন? ‘‘আমাদের হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে দেয়া হয়েছে’’। কথাগুলো যেন তাঁর অনেক অর্জনকেই ম্লান করেছে। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে বিরোধীদল থেকে তাহলে হাত-পা বাঁধা বিচারপতির রায় কতটুকু স্বাধীন ও কার্যকর। তাহলে তিনি কতটুকু যোগ্য ও সাহসী ?
জনাব হক আইনমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো বলার সময় তাঁকে অনেক ক্ষুব্ধ মনে হয়েছে। অথচ বিচারপতিরা যখন শপথ নেন তখন বলেন, আমি অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোন কিছুই করবো না। আইনজীবীদের মতে, তিনি এ শপথ ভঙ্গ করেছেন। তিনি বিশেষ উদ্দেশে হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ, অভিজ্ঞ ও দক্ষ বিচারপতি যারা নিরপেক্ষভাবে রায় দিতেন, সরকারের বিপক্ষে রায় দিতেন তাদের বেঞ্চ ভেঙে দিতেন। তিনি জ্যেষ্ঠ, অভিজ্ঞ বিচারপতিদের মূল্যায়ন না করে জুনিয়র বিচারপতিদের গুরুত্বপূর্ণ বেঞ্চের দায়িত্ব পালন করতে দিতেন। যার ফলে শুধু বিচারপ্রার্থীরাই নয়, আইনজীবীরাও ক্ষতিগ্রস্ত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আর এরকম শপথ ভঙ্গকারী ব্যক্তি কি প্রধান উপদেষ্টার জন্য যোগ্য হতে পারেন? যিনি আদালতে ন্যায়বিচার করতে পারলেন না তিনি ষোল কোটি মানুষের জিম্মাদারি পালন করতে পারবেন কি?
ন্যায়বিচার করার শপথ নিয়ে যিনি বিচারকের আসনে বসেন তাঁর দায়িত্ব কত কঠিন-জটিল তা কি আমাদের অনেক বিচারকই উপলব্ধি করেন না। অথচ মহানবী (সা.) বলেছেন, ৬৫ বছরের নফল ইবাদত অপেক্ষা একটি ন্যায়বিচার শ্রেষ্ঠ। ‘‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবু আউফা (র.) বলেন, রাসুূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা একজন বিচারকের সাথে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ তিনি বিচারকার্যে জুলুম-অত্যাচারের ঊর্ধ্বে থাকেন, যখন তিনি জুলুম ও বেইনসাফি করেন তখনই আল্লাহ তার থেকে পৃথক হয়ে যান এবং শয়তান এসে তার সাথী হয়ে যায়।’’ (তিরমিযী, ইবনে মাযা) ‘‘হযরত আয়েশা (রা.) রাসূলুল্লাহ’’ (সা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ন্যায়বিচারক কেয়ামতের দিন এই আকাঙ্ক্ষা করবেন যে, দু'ব্যক্তির মধ্যে সামান্য খেজুরের ফয়সালাও যদি তাকে পৃথিবীতে না করতে হতো, তবে কতই না ভাল হতো।’’ (মুসনাদে আহমদ) এই চেতনা নিয়ে আদালত বিচার করতো তাহলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতো কি?
আজ সর্বস্তরের মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল উচ্চ আদালতও বিতর্কিত হতে শুরু করেছে। বিরোধী পক্ষ একদিকে বিতর্কিত রায় ও দলীয়করণের অভিযোগ এনে বিদায়ী প্রধান বিচারপতির কুশপুত্তলিকা দাহ করছে এবং জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের অভিযোগে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনকেও স্বাগত জানায়নি সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি। বিচারপতি খায়রুল হককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে না মানার ঘোষণাও দিয়েছে বিরোধীদল বিএনপি। তাহলে আমরা কি আবার কেএম হাসানকে কেন্দ্র করে যেমনি ২৮ অক্টোবর রাজপথে লগি-বৈঠা দিয়ে আওয়ামী লীগ মানুষ হত্যা করেছে সেই ভয়াবহতার দিকেই রওয়ানা হয়েছি? রাজনীতির এ খেলা বন্ধ হবে কবে?
রাজনীতির কালোছায়া আজ যেন আমাদের বিচার বিভাগকেও বিতর্কিত করছে। ওয়ান-ইলেভেনের পর রাজনীতিবিদদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে উচ্চ আদালতকেই গণ্য করা হতো। অনেক সমস্যা ও সংকটের পরও আটক অবস্থায় দুই নেত্রী ও দেশের রাজনীতিবিদরা উচ্চ আদালতেই গিয়েছিলেন। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর বাড়াবাড়ির কারণে বিচার বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হলে মানুষের আর দাঁড়ানোর জায়গাটুকু থাকবে কি? আমরা দেশের আইন বিশেষজ্ঞদের, রাজনীতিবিদদের নিকট থেকে আবারও আশঙ্কা আর অনিশ্চয়তার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আবারও লগি-বৈঠা আর রাজপথে মানুষের রক্ত আর গোলাবারুদের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছি। তাহলে এর সকল দায়দায়িত্ব সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সাহেব বহন করবেন কি? জনাব হক সবার শাসন অবৈধ ঘোষণা করে নিজের শাসন পাকা করার স্বপ্ন আদৌ পূরণ হবে তো?
জনাব হকের সময়কে এভাবে মূল্যায়ন করেছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। সুপ্রিমকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ‘‘সবচেয়ে খারাপ প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এ ধরনের কর্মকান্ড কাম্য নয়।
ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, ‘‘রাজনৈতিক দলগুলোর দূরদর্শিতা এবং আইনজীবীদের বিচক্ষণতার অভাবে হঠাৎ করে চরম অবস্থানের তৈরি হয়েছে। এতে দেশের সাধারণ মানুষের অকল্যাণই হবে।’’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘‘সুপ্রিমকোর্টে রাজনৈতিক মেরুকরণ আগেও ছিল, বর্তমানে এটা চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। এজন্য সব দলই কমবেশি দায়ী’’। সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘‘তিনি তার কর্মকান্ডের মাধ্যমে জনগণের উপকারের পরিবর্তে দেশে সাংবিধানিক সংকট আর রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে গেছেন। এসব কর্মকান্ডের জন্য একদিন তাকে জাতির কাছে জবাবদিহি করতে হবে।’’
সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি সুপ্রিমকোর্টকে রাজনৈতিক দল ও সরকার এবং পার্লামেন্টের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে গেছেন। স্বাধীনতার ঘোষক স্বীকৃতি একটি রায়ের মাধ্যমে দিতে হবে-এটা পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। জাতীয় পার্টির অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য এডভোকেট কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, ‘‘আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার প্রত্যাশায় বিদায়ী প্রধান বিচারপতি আদালতের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে গেছেন। তিনি ইতিহাসে বিতর্কিত ও খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন।’’
আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা এবিএম খায়রুল হক বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার সর্বশেষ কর্মদিবসটিও শেষ করলেন আওয়ামী লীগের কল্যাণে। জনাব হক মুখে বিচার বিভাগের দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির ব্যাপারে সোচ্চার থাকার কথা বললেও আপিল বিভাগে ১০ হাজারেরও বেশি মামলা বিচারাধীন থাকলেও এ ব্যাপারে তিনি কোন ব্যবস্থা নেননি।
যেসব রাজনৈতিক রায়ের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কাছে তিনি সংবিধানরক্ষাকর্তা বীরবিচারক ও শতাব্দীর সেরা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। দলটির প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে একদলীয় শাসন প্রবর্তন করার জন্য সংবিধানের যেই সংশোধন করেছিলেন- সেই চতুর্থ সংশোধনটির গা বাঁচিয়ে অন্যান্য প্রায় সব সংশোধনীকে আদালতের রায়ে অবৈধ ঘোষণা করতে জনাব হকের অবদান অনন্য ও অবিস্মরণীয়। জনাব হক বাংলাদেশের দীর্ঘ ৩৫ বছরের শাসন অবৈধ ঘোষণা করলেন শেখ মুজিবের বাকশালকে নিরাপদ রেখে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ করলেন কিন্তু নিজের জন্য প্রধান উপদেষ্টার পথটি নিরাপদ খোলা রেখে। সত্যিই বলতে হয় জনাব এবিএম খায়রুল হকের তুলনা ইতিহাস তিনি নিজেই। এক সময় ইতিহাসই তার বিচার করবে, ঠিক করবে ইতিহাসে তার অবস্থান।
শেষ কর্মদিবসে তার উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনকে (ট্রুথ কমিশন) অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রাখা এবং পঞ্চাশজন বিচারকের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে আপিল বিভাগে সরকারের নিয়োগ দেয়া দুই বিচারকের শপথদান। যাদের মধ্যে একজন বিচারক একসময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গোপালগঞ্জ জেলার সভাপতি ছিলেন। এর আগেও সরকার কর্তৃক হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত দু'জন বিচারক যাদের একজন সুপ্রিমকোর্টে একটি ভাংচুরের ঘটনায় জড়িত ছিলেন এবং আরেকজন একটি দন্ডযোগ্য হত্যা মামলার অভিযুক্ত ছিলেন- এমন দুই বিচারককে শপথ দিয়েছিলেন বিদায়ী প্রধান বিচারপতি।
সর্বশেষ গত ১১ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী বিষয়ে তার দেয়া রায়ে বেসিক স্ট্রাকচার তত্ত্বানুযায়ী তিনি একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক অবৈধ বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, অন্যদিকে আগামী দুইটি সংসদ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজনীয় বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সেই প্রয়োজনীয়তার মতবাদ দেখিয়ে। অর্থাৎ তারই দেয়া রায় অনুযায়ী ‘অসাংবিধানিক' তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পথ খোলা রাখলেন শুধুমাত্র নিজের জন্য। যার মধ্যে প্রথমবার এই অনির্বাচিত সরকারের প্রধান হওয়ার সুযোগটি পাচ্ছেন জনাব এবিএম খায়রুল হক নিজেই।
অবশ্য সুযোগটি তিনি নিজে একাকী তৈরি করতে পারেননি। সরকার জনাব হকের প্রতি উপহার স্বরূপ আবারো সুপারসিডের পথ অনুসরণ করলেন? জনাব হকের উত্তরসূরী হিসেবে যদি জ্যেষ্ঠ বিচারক শাহ আবু নাইম মোমিনুর রহমানকে যথানিয়মে নিয়োগ দেয়া হতো তবে জনাব রহমানই হতেন আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। কারণ, সেক্ষেত্রে জনাব হক নন, বরং জনাব রহমানই হতেন আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। কাজেই আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু জনাব রহমানের জ্যেষ্ঠতা ডিঙিয়ে রাষ্ট্রপতি একজন কনিষ্ঠ বিচারককে ২০তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সেই আশঙ্কা বা সম্ভাবনা দূর করেছেন। নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি জনাব মোঃ মোজাম্মেল হোসেন অবসর নেবেন ২০১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি। ফলে সর্বশেষ আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগে প্রধান বিচারপতি হিসেবে সবশেষে অবসর নেয়া জনাব হকই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগ পেতে যাচ্ছেন?
একই সাথে এই তত্ত্ব ও মতবাদের যুগলে আগামীতে যে রাজনৈতিক সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তাতেও কোন সন্দেহ নেই। এখন মনে হচ্ছে জনাব হক এক লাঠিতে অনেক সাপ মারলেন কিন্তু লাঠি ভাঙ্গেননি। আওয়ামী লীগের নিকট এখন জনাব হক সাহেবের সকল রায় ও সমীকরণ পক্ষে মনে হলেও একসময় দেশে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির নায়ক হিসেবে জনাব হককে জাতি চিহ্নিত করার সম্ভাবনাও কি উড়িয়ে দেয়া যায়? সংসদকে পাশ কাটিয়ে জনাব হকের এত অতি উৎসাহী রায়কে আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতারাই পছন্দ করছেন না। কিন্তু রাজনৈতিক সমীকরণে জনাব হক যদি প্রধান উপদেষ্টা হতে না পারেন, তাহলে গ্রাম্য প্রবাদ ‘‘আমও গেল ছালাও গেল’’ সেই প্রবাদই কি জনাব হকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে?

Thursday, 2 June 2011

সমঝোতার সূত্র

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে উচ্চ আদালতের রায়ের পর দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পয়েন্ট অব নো রিটার্ন অবস্থান গ্রহণ করেছিল বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল ধারণা করছিল। আওয়ামী লীগের তরফে বলা হচ্ছিল, উচ্চ আদালতের রায়ের কারণে এ ব্যবস্থা বহাল রাখার সুযোগ নেই। অপরদিকে বিরোধী দল অনড় প্রতিবাদী অবস্থান গ্রহণ করায় সাধারণ নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত সময়ের পৌনে তিন বছর আগেই রাজনৈতিক অস্থিরতার যুগে দেশ প্রবেশ করল বলে শঙ্কা সৃষ্টি হয়। তবে দুটি দলের সর্বশেষ অবস্থান পর্যালোচনা করলে টানেলের অপর প্রান্তে খানিকটা আশার আলো হয়তো দৃশ্যমান। বিএনপি ১২ ও ১৩ জুনের হরতালের পর আরও হরতাল ও লংমার্চের কর্মসূচি প্রদানের ঘোষণা দিয়েও পিছিয়ে এসেছে। বিএনপি চেয়ারপারসন গত ১৬ জুন বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ কী হবে, কে প্রধান উপদেষ্টা হবেন এবং নির্বাচন কমিশনের প্রধান কে হবেন_ এসব বিষয় নিয়ে তার দল সংসদের ভেতরে কিংবা বাইরে যে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনায় রাজি। আমরা এ অবস্থানকে স্বাগত জানাই। দেশবাসীও এ ধরনের অবস্থানে স্বস্তিবোধ করবে। 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত আওয়ামী লীগ'_ শুক্রবার এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রদত্ত এ অভিমতকে বিএনপির সর্বশেষ অবস্থানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে আশার আলোর শিখা আরও কিছুটা উজ্জ্বল হলো বলেও আমরা ধরে নিতে পারি। সংবিধান সংশোধন কিংবা এ ধরনের যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতেই আলোচনা সর্বোত্তম উপায় বলে আমরা মনে করি। সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছেন। কিন্তু একই সঙ্গে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে তারা জাতীয় সংসদের হাতেই নির্বাচনকালীন বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের ভার অর্পণ করেছেন। আদালতের রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশিত হলে বিষয়টি সম্পর্কে সংসদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হবে, তাতে সন্দেহ নেই। বিএনপিকে তাদের অভিমত তুলে ধরার জন্য সংসদেই যেতে হবে। ১৯৯৬ সালে সফল অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কিছুটা আপারহ্যান্ড পেলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত কিন্তু ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদেই গৃহীত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে যে নেপথ্যে রাজনৈতিক সমঝোতাও কাজ করেছিল সেটা স্পষ্ট। এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেই সেটা রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থিতি আনতে পারে না। জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনামলে জাতীয় সংসদ সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, যা আদালতে নাকচ হয়ে গেছে। বিচারকদের বয়স দুই বছর বাড়ানোর জন্য সংবিধান সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল জাতীয় সংসদেই। কিন্তু এর পরিণতিতে রাজনৈতিক অঙ্গন অশান্ত হয়ে উঠেছিল এবং এর মূল খেসারত দিতে হয় তার উদ্যোক্তা দল বিএনপিকেই। নিকট অতীতের এসব অভিজ্ঞতা সব পক্ষই বিবেচনায় রাখবে বলে আমরা আশা করি। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যে কতটা অপরিহার্য সেটাও সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং দলীয় মুখপাত্র। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চায় না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে। বিএনপিও রাজপথ উত্তপ্ত করার পরিবর্তে সমঝোতার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, এটাই কাম্য। এ ধরনের মনোভাব থাকলে সমঝোতার সূত্র মিলবেই।
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter