Flickr

Friday, 2 December 2011

মাটির এই পৃথিবী দানবের জন্য নয়

Posted by   on

মাটির এই পৃথিবী দানবের জন্য নয়
 দেশ নিয়ে আমরা গর্ব করতে চাই, গর্ব করতে চাই সরকারের সাফল্য নিয়েও। কারণ সরকার সফল হলে দেশ এগিয়ে যায়, জনগণ সুখে থাকে। আর জনগণ যখন সুখে থাকে, তখন তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় সন্তুষ্টির কথা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জনগণ কি এখন তেমন কথা উচ্চারণ করছে? দেশকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী তার এই দায়িত্ব পালন করে থাকেন মন্ত্রী পরিষদের মাধ্যমে। যেহেতু সরকারের সফলতা-ব্যর্থতার মূল দায়িত্ব বর্তায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর, তাই মন্ত্রীদের ক্রিয়া-কর্মের ব্যাপারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন প্রধানমন্ত্রী। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই দৃষ্টিতে কখনো যে তারতম্য কিংবা রকমফের ঘটে না তা কিন্তু নয়। এমন কিছু ঘটলে যে শুধু নীতির লঙ্ঘন হয় তা নয়, এই পথে সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়, পতনও ঘটে। কিন্তু এই বিষয়টি সবসময় সরকার তথা মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী উপলব্ধি করতে সক্ষম হন না। এখানেই সরকারের জন্য সুপ্ত থাকে ট্র্যাজেডির বীজ।
দেশ এখন কেমন চলছে? এ বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলের বক্তব্যে মিল নেই। মিডিয়ায় উভয়পক্ষের বিপরীতমুখী বক্তব্য প্রতিদিনই শোনা যাচ্ছে। তবে জনগণ যাদের বক্তব্যে সায় দেবে আখেরে বিজয় তাদেরই হবে। জনগণ কখনো গণআন্দোলনের মাধ্যমে তাদের রায় প্রকাশ করে, আবার কখনো প্রকাশ করে ব্যালটের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলগুলো জনমত গঠনে কথার মারপ্যাঁচ ও প্রোপাগান্ডা কৌশলকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তবে এখানে বলে রাখা ভাল যে, দেশ কেমন চলছে প্রাত্যহিক জীবন-যাপনের মাধ্যমেই জনগণ তা উপলব্ধি করে থাকে। এই উপলব্ধিই জনমত গঠনের আসল নিয়ামক। শুধু কৌশলে জনসমর্থন পাওয়া যায় না, বরং তাতে হিতে বিপরীত হয়। অথচ এই বিষয়টি আমাদের রাজনীতিবিদরা, বিশেষ করে সরকারের মন্ত্রী বাহাদুররা বুঝতে চান না। পরিণামে যা হবার তাই হয়। তখন শত আফসোসেও কোনো কাজ হয় না।
প্রধানমন্ত্রী ২৮ নবেম্বর বললেন, তিন বছরে মন্ত্রীদের কাজে আমি সন্তুষ্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবার বঙ্গভবনে নতুন মন্ত্রীদের শপথ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের একথা বলেন। সরকারের তিন বছরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা দেশের উন্নয়নে কাজ করছি। তবে কেউ কেউ চোখ থাকিতে অন্ধ। তারা আমাদের অর্জন দেখতে পায় না। প্রধানমন্ত্রী গত তিন বছরে মন্ত্রীদের কাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন এবং সরকারের উন্নয়ন তৎপরতায়ও তিনি গর্ববোধ করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জনগণ কি দেশের উন্নয়ন কর্মে মন্ত্রীদের তৎপরতায় সন্তুষ্ট হতে পেরেছে? দেশের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের কী অবস্থা? শেয়ারবাজার ও অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন? বেকারদের জন্য কি চাকরি-বাকরির ব্যবস্থা হয়েছে? দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ কেন? আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতিতে জনগণ আতঙ্কিত কেন? সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে নানা বুলি আওড়ালেও স্বয়ং তাদের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে কেন? সরকারের কাছে এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব না থাকলে জনগণ কেমন করে ভাববে, দেশ ঠিকমত চলছে? জনগণ লক্ষ্য করছে, জনদুর্ভোগ দূর করার পরিবর্তে সরকার যেন হামলা-মামলা ও বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের কাজকেই তাদের মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। এমন তৎপরতায় তো জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবার নয়। তাইতো দেশ পরিচালনায় কিংবা মন্ত্রীদের তৎপরতায় প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করলেও জনগণ তাতে সায় দিতে পারছে না। এমন বক্তব্যকে সরকার বিরোধী দলের প্রোপাগান্ডা হিসেবে হয়তো উড়িয়ে দিতে চাইবে। কিন্তু বক্তব্য তো শুধু বিরোধী দলই রাখছে না, অন্যরাও রাখছে। এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের বিশ্লেষণ উল্লেখ করা যায়। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দৈনিক গালফ নিউজে প্রকাশিত এক লেখায় কুলদীপ নায়ার বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। দেশের সর্বত্র দুর্নীতি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে যে, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ভয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে তাদের সহায়তা তুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে পাঁচ দিন থাকার পর আমার মনে হয়েছে, হাসিনা শুধু যে তার কারিশমাই হারিয়েছেন তা নয়, এক সময় যাদের বিশ্বাস করতেন তাদেরও হারিয়েছেন তিনি। তিস্তার পানি চুক্তি এবং টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যু আগামী নির্বাচনে নিঃসন্দেহে প্রভাব ফেলবে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন কুলদীপ নায়ার। তিনি উল্লেখ করেন, জনপ্রিয়তা একটি দুর্লভ ব্যাপার। প্রয়োজনের সময় শাসকরা জনপ্রিয়তা পান না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। যখন তার জনপ্রিয়তা আসলেই দরকার তখন তিনি তা হারাচ্ছেন। বিপুল সংখ্যক মানুষ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অপশাসন না হলেও সুশাসনের অভাবে বাংলাদেশের মানুষের জীবন শুধু দুর্বিষহই হয়ে ওঠেছে। আর ক্ষমতায় বসার ৩ বছর পার হওয়ার পরও তিনি তা বুঝতে পারছেন না। জনগণ তার কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করেছিল কিন্তু বলার মতো কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ জনগণ দেখতে পাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে তিনি বিদ্যুৎ খাতের কথা উল্লেখ করেন। নায়ার বলেন, স্বল্প সম্পদ দিয়ে দারিদ্র্য হ্রাস করা সব সময়ই চ্যালেঞ্জের বিষয় কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এ বাস্তবতা মানতে নারাজ। তিনি যা করছেন তা নিয়ে তাকে বেশ সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে। তিনি একপক্ষীয়ভাবে ভারতের সাথে ট্রানজিটের বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছেন। নায়ার বলেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যার জায়গাটি হলো, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। বাংলাদেশ সরকার মনে করছে, নয়াদিল্লী এবং কলকাতার মধ্যকার রাজনৈতিক টানাপড়েনের কারণে চুক্তিটি হচ্ছে না। তবে ভারতের মনিপুরে বরাক নদীর উপরে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প যখন সামনে এলো তখন ঐ বিষয়টি আবারও পেছনে চলে গেলো। মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরের এক মাস পর ২৩ অক্টোবর মনিপুর সরকার এবং নয়াদিল্লীর সঙ্গে এই চুক্তিটি হয়। আর এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশ বাস্তবিক অর্থেই আঘাত পেয়েছে। কারণ এই চুক্তির ফলে প্রমাণ হয়, নয়াদিল্লী বাংলাদেশের সুবিধা-অসুবিধার কথা ভাবছে না। ভারতের এ পদক্ষেপে কোণঠাসা হাসিনার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ভারতের সঙ্গে হাসিনার বন্ধুত্বের চেষ্টা উপেক্ষিত হয়েছে। কুলদীপ নায়ার তার লেখায় আরো অনেক কথাই বলেছেন। সেখান থেকে কিছু নেয়ার আছে কি না তা শেখ হাসিনার সরকার ভেবে দেখতে পারে।
এতো গেলো প্রতিবেশী দেশ ভারতের এক প্রবীণ সাংবাদিকের বিশ্লেষণ। এবার দেশের লোকের বিশ্লেষণ শুনি। জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছেন, দেশে যে ধরনের গণবিস্ফোরণ ঘটতে যাচ্ছে তা অতীতে আমরা কেউ দেখিনি। পাপ চরম পর্যায়ে গেলে আল্লাহর তরফ থেকে গজব নেমে আসে। সামগ্রিকভাবে দেশে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে অচিরেই আমরা এক ভয়ঙ্কর অবস্থা প্রত্যক্ষ করবো। এ জন্য কোনো দল লাগবে না। সাধারণ মানুষই রাস্তায় নেমে আসবে। অন্যায়-অত্যাচার আজ মাথার তিন হাত উপরে উঠে গেছে। তিনি একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘মানুষের তরে মাটির এ পৃথিবী, দানবের তরে নহে।' গত রোববার রাজধানীতে এক সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদানকালে তিনি এসব কথা বলেন। জানি না সাবেক এ মন্ত্রীর বক্তব্য আওয়ামী লীগ সরকার কিভাবে নেবে। তবে একথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মাটির এই পৃথিবী মানুষের জন্যই দানবের জন্য নয়। মানুষ যখন অন্যায়-অত্যাচারের মাধ্যমে দানব চরিত্র অর্জন করে তখন তার বিরুদ্ধে চলে মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। মানব জাতির ইতিহাস আসলে এই মুক্তি সংগ্রামেরই ইতিহাস। বাংলাদেশের বিবেকবান মানুষ মাত্রই চান আমাদের এই সমাজ মানুষের বসবাসযোগ্য হয়ে উঠুক। তবে এ আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রয়োজন সরকার বিরোধী দল এবং নাগরিকদের যথা আচরণ। কারণ নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথা আচরণের বদলে কোনো সমাজের মানুষ যদি শুধু পরস্পরের বদনাম গেয়ে যায়, তবে তাতে প্রগতি অর্জিত হয় না, পাওয়া যায় না শান্তির নিবাসও। তবে এসব বিষয় উপলব্ধির জন্য নিজের সাথে কথা বলতে হয়, আত্মসমালোচনায় অভ্যস্ত হতে হয়। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে এখন এসব বিষয় লক্ষ্য করা যায় না। তাই দেশের অগ্রগতি ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে যে কর্ম-সংস্কৃতি প্রয়োজন তা এখনই লক্ষ্য করা যাবে কি না সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই। তবে এ বিষয়টি আমরা উপলব্ধি করি যে, আরো ক্ষতি থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে এবং জনগণের দুর্ভোগ হ্রাস  করতে হলে সরকারের এখনই ভুলপথ পরিহার প্রয়োজন। এমন চিত্র লক্ষ্য করা গেলে বিরোধী দলের ভূমিকায়ও হয়তো পরিবর্তন আসবে। না আসলে তা দেখার জন্য তো দেশের জনগণ রয়েছেই। আর আখেরে রায় তো জনগণই দেবে।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter