সমাজতন্ত্র বিদায়ের কুড়ি বছর পরে
ইতিহাস বলছে কোনও সাম্রাজ্য বা শাসন চিরস্থায়ী হয় না। আর শাসনটি যদি হয় শোষণ ও অত্যাচারে ভরপুর, তাহলে বিদায় বা পতন হয় অতি দ্রুত এবং সেই পতনটি নেমে আসে অতি লজ্জায়, অপমানে, রক্তাক্ত বিয়োগান্ত পরিণতিতে। বিশ্ব বরেণ্য ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন ইতিহাসে কোনও শাসন বা সাম্রাজ্যের গড়পড়তা আয়ু হিসাব করেছিলেন একশত কুড়ি বছর। এই হিসাবটি যান্ত্রিক মনে হতে পারে, কিন্তু এর মধ্যে যে সত্যটি পরিস্ফুট তা হলো, যে কোনও সাম্রাজ্যের কোনও-না-কোনও সময়ে মৃত্যু ও পতন অনিবার্য। বহুবিধ অত্যাচার ও পীড়নের মাধ্যমে কোনও কোনও পতন অগ্রিম চলে আসে; রক্তের বন্যায় ভেসে যায়; জনগণের ঘৃণায় ও প্রতিবাদে জীবন্তসমাধিপ্রাপ্ত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে, দক্ষিণ এশিয়ায়, বাংলাদেশে উত্থান-পতনের বহু ঘটনা সাম্প্রতিক ইতিহাসের অংশ বিশেষ। প্রবল স্বৈরাচারী দম্ভ, একদলীয় বর্বরতা, অতিজনপ্রিয়তা থেকে জনধিক্কার ইত্যাদি রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় পাতায় বিদায়, পতন ও অপমানের স্মারক হয়ে কলঙ্কের হরফে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ইবনে খালদুন বর্ণিত একশত কুড়ি বছরের পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার সৌভাগ্যও তখন সেইসব স্বৈরশাসনের হয় না; হয় বেদনাদায়ক ও অপমানের-লাঞ্ছনার পতন। ইতিহাসের সেইসব নির্মম পতনকে স্মরণ করে জনতা তাদের আশপাশে চিরস্থায়ী হয়ে ওঠার দিবাস্বপ্নে-বিভোর নব্য স্বৈরাচারী-একদলীয়-তা-বতার অপমানকর বিদায় আর আসন্ন পতনেরই অপেক্ষা করতে থাকে।
চলতি ২০১১ সাল ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে সমাজতন্ত্র-পতনের কুড়ি বছর পূর্তি উপলক্ষে। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে ১৯৯১ সালের ৭ আগস্ট ছিল সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের দিন। কতগুলো সম্প্রসারণবাদী অলীক স্বপ্নে কার্ল মার্ক্সের মানসপুত্র ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব করলেন; রাশিয়ার আশপাশের মধ্য এশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রসমূহসহ অন্যান্য দেশগুলো দখল করে তৈরি করলেন কল্পিত স্বর্গ: সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারপর সেই স্বর্গকে লৌহ প্রাচীরে আড়াল করে জোসেফ স্টালিন অত্যাচার, নিপীড়ন, হত্যা, নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের রামরাজ্য বানালেন সোভিয়েত দেশকে এবং আরও দখলদারিত্ব চালাতে লাগলেন বিশ্বের দেশে দেশে। পূর্ব ইউরোপের রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়ার তথাকথিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারাবাহিকতার নামে সামাজিক-সম্প্রসারণবাদেও দানব-ট্র্যাঙ্কে চেপে আগ্রাসন চলে আসে উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, চীনে। আগ্রাসী রক্তস্রোত গিয়ে পৌঁছেছিল সুদূর দক্ষিণ আমেরিকাতেও। হুগো শাভেজের ভেনেজুয়েলা বা নেপালের পুকমলদাহাল বা প্রচন্ডের মতোই কিউবাতেও সমাজতন্ত্র বৃদ্ধ-বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর অনুকরণে এখন মৃত্যুশয্যায়। ভিয়েতনামে টিমটিম করে জ্বলছে নিভু নিভু সমাজতান্ত্রিক বাতি। চীনে এক ধরনের ‘সিউডো কমিউনিস্ট' কাঠামোর মধ্যে এবং উত্তর কোরিয়ায় রাষ্ট্রভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শুধু কয়েকটি অক্ষরের সমাবেশে নামমাত্র নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে অন্তঃসারশূন্য-সমাজতন্ত্র। এমন কি, পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সুদৃঢ় ৩৪ বছরের কমিউনিস্ট সাম্রাজ্যের পতন দক্ষিণ এশিয়ায় সমাজতন্ত্রের বেঁচে থাকার ক্ষীণ সম্ভাবনাটিকেও এক ফুৎকারে নিভিয়ে দিয়ে গেল বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের পতনের কুড়ি বছর পূর্তির সময়ে।
এ যেন তাসের ঘরের মতো পতন, খোদ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে একে একে সবগুলো লাল দূর্গের ধ্বংস-এর মূল কারণ কি? আসলে মানুষ সমাজতন্ত্রের ফাঁকা বুলির মধ্যে এটুকু বুঝতে পেরেছে যে, সমাজতন্ত্র-কমিউনিজম-সাম্যবাদ ইত্যাদিতে অতি নাটকীয় রোমান্টিকতা আছে; আছে শিহরণ ও উত্তেজনা এবং এহেন স্বৈরতন্ত্রী-একদলীয় সমাজতন্ত্রের সঙ্গে মানুষের স্বাধীন মত ও বিশ্বাসের চর্চা ও প্রকাশের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এমন কি, সমাজতন্ত্রে কথিত প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার তত্ত্বের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিক, আদর্শিক, ধর্মীয়, মানবিক, আত্মিক স্বভাবের এক ধরনের তীব্র-বিরোধ আছে। যে পুঁজিবাদী, ভোগবাদী, বিলাসী, অপচয়ী, অমানবিক ব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের কথা বলা হলো, সেই সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদই অসৎ নেতৃত্বের হাতে পড়ে সুবিধাবাদে রূপান্তরিত হয়। (বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রীরা কি হয়েছেন সেটা আরও চমকপ্রদ গবেষণার বিষয়!) মানুষ তখন বাধ্য হয়েই পুঁজিবাদের মতো সমাজতন্ত্র থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেয়। সমাজতন্ত্রের খোলসে সুবিধাবাদের খেলা মানুষ শেষ পর্যন্ত আর দেখতে চায়নি বলেই সারা পৃথিবী জুড়ে সমাজতন্ত্রের এই পতন ও পলায়নী পরিণতি। সর্বশেষ বিয়োগান্ত ও লজ্জাজনক পতনচিহ্নিত বিদায়টি ঘটলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, গত ১৩ মে, ২০১১ সালে।
সমাজতন্ত্রের করুণ পতনে বা গণধিক্কারে সারা পৃথিবী লজ্জা পেলেও সোভিয়েত ইউনিয়নে কিংবা পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা বিন্দুমাত্র লজ্জিত বোধ করবার প্রয়োজনই মনে করলো না। পতনকালী সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ বেহায়ার মতো বলছিলেন, ‘এর নাম পতন নয়, এর নাম গ্লাসনস্ট, পেরেস্ত্রোইকা।' বাংলাদেশে গর্বাচেভপন্থী পেরেস্ত্রোইকা-গ্লাসনস্টিরা কমিউনিস্ট পার্টির অফিস ও সম্পদ ভাগ করে নিল। এই চক্রের যে তিন পালা, যাদেরকে সাধারণভাবে ডাকা হয় ঢাকা ও চট্টগ্রামের ‘কুচক্রী তিন ম' নামে, তারা সেই বাটোয়ারায় জেহাদি উত্তেজনায় অংশ নিয়েছিল। সর্বপ্রথম আলো জ্বেলে গর্বাচেভকে ‘সাধু-সাধু' ধ্বনি দিয়েছিল তারই। তারা সব সময়ই লাভ ও লোভের ক্ষেত্রে প্রথম হতে ভালোবাসে। গর্বাচেভিয় প্রথম আলোটি প্রথম ছড়ানোর মতোই তারা প্রথম সুযোগেই লাফ দিয়ে পশ্চিমা গোষ্ঠী, পুঁজিবাদ ও মাল্টিন্যাশনালের কোলে গিয়ে ওঠলো। তারপরের কাহিনী সকলেরই জানা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামকে নিয়ে ব্যঙ্গ-রসিকতা-কার্টুন আঁকা (নাউযুবিল্লাহ) থেকে শুরু করে ১/১১-এর যাবতীয় দেশ-জাতিবিরোধী শাঠ্য-ষড়যন্ত্রেও তারা প্রথম বা অগ্রগামী হয়ে রইলো এখন পর্যন্ত। হালে তাদের প্রতিদ্বনদ্বী এক মিডিয়া গ্রুপ অস্ত্র-জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের সঙ্গেও এই চক্রের নানা সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রচার করছে। চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় ‘কুচক্রী গ্রুপ'-এর যেমন সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, বাংলাদেশেও জাতি-ধর্ম-শিষ্টাচার বিরোধী সমাজতন্ত্রে আলখাল্লাধারী এই কুচক্রীদের সাম্প্রতিক সময়ে খুবই তৎপর দেখা যাচ্ছে। (এদের নিয়ে বিশদে লিখার সুযোগ ও প্রয়োজন রয়েছে, এখানে আজকের মূল বিষয়কে ব্যাখ্যা করার স্বার্থে সেদিকে আলোকপাত করা হচ্ছে না। ভবিষ্যতে আলাদাভাবে দেশ ও জাতিবিরোধী কুচক্রী গোষ্ঠীর চরিত্র ও কর্ম চিত্রণ করা হবে।)
সোভিয়েতের পতিত-সমাজতন্ত্রীদের মতোই সদ্য-পতিত পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজতন্ত্রীরা আরও এক ধাপ বেশি বেহায়াপনা করলো। পতনের সঙ্গে সঙ্গে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু নির্লজ্জের মতো বললেন: ‘কেউ হারলে যেমন তাকে সমবেদনা জানানোর কিছু নেই, তেমনই জিতলে তাকে নিয়ে উদ্বাহু নৃত্য করারও কিছু নেই!' তার মানে কি ? পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের এতো কা- কিংবা সোভিয়েতে ১৯১৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত ৭০ বছরেরও বেশি সময়ের কোনও দায়-দায়িত্বই নেই? সব খালাস? এরচেয়ে বড়ো দম্ভোক্তি ও অগণতান্ত্রিক হুঙ্কার আর হতে পারে না। যে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার জুজু দেখিয়ে সমাজতান্ত্রিক-সাম্প্রদায়িকতা প্রতিটি নির্বাচনে ‘সংখ্যালঘু কার্ড' ব্যবহার করেছে; মুসলিম সংখ্যালঘুদের ভীতি ও আতঙ্কের মধ্যে রেখে ভোট দিতে বাধ্য করেছে, সেটার কি হবে? সমাজতান্ত্রিক ধর্মহীনতায় মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতিকে ভাসিয়ে দিয়ে বিগত ৩৪ বছরে পশ্চিমবঙ্গের সমাজতন্ত্রীরা গণতন্ত্রের কোনও লাভ-ক্ষতি করুক বা না করুক, মুসলমানদের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। হিন্দু-মুসলিম বিবাহ, মুসলিম ধর্ম-সংস্কৃতি-মূল্যবোধকে ধর্মহীন বা ধর্মনিরপেক্ষ করার কাজটি তারা এতই যোগ্যতার সঙ্গে করেছে যে, ইসলাম এখন পশ্চিমবঙ্গে এক অতি কোনঠাসা, অতি প্রান্তিক, অতি কোণঠাসা ধর্ম। মাদ্রাসা শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ওয়াকফ ইত্যাদি ব্যবস্থাকেও তছনছ করে দিয়েছে সমাজতন্ত্রীরা। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মহাস্লোগান দিয়ে পুঁজিবাদের একটি লোমও ছিড়তে পারেনি তার। অথচ মুসলমানদের চরম ক্ষতিসাধন করেছে এই সমাজতন্ত্রীরা। (পশ্চিমবঙ্গের দাদাদের তাবেদার বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রী নামধারীরা পুঁজিবাদের কিছু করতে না পারলেও এদেশে ঠিকই ইসলামের বিরুদ্ধে বন্য মোষের মতো তেড়ে আসতে পারে!) একদা অবিভক্ত বঙ্গে যে মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, তার পশ্চিমবঙ্গ অংশে এখনও রয়ে গেছে মুসলিম ঐতিহ্য, শিক্ষা, শাসনের অনেক স্মৃতি ও প্রত্ন নিদর্শন; সেই পশ্চিমবঙ্গে সমাজতন্ত্রীরা মুসলমানদের পিষতে পিষতে তলানিতে নিয়ে গেছে। কমিউনিস্ট শাসনের ফলে বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে এমনই যে, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান মানেই দরিদ্র, পশ্চাৎপদ, অবহেলিত, বঞ্চিত, অনাদৃত এবং ধর্মীয় আচার-আচরণে শ্লথ। যদিও বামবাবুরা ধুতি-পাঞ্জাবী চাপিয়ে দিব্যি হিন্দু ধর্ম-কর্ম করছেন। কিন্তু মুসলমানদের বলছেন, ধর্ম মেনো না, ধর্ম পালন করলে সাম্প্রদায়িক (?) হয়ে যাবে!! (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী সুবিধাপ্রাপ্ত একজন সমাজতন্ত্রী অধ্যাপক সর্বদা পূজা কমিটির সভাপতি হয়ে বিশিষ্ট হিন্দু ভদ্রলোকের ধর্মনিষ্ঠ চরিত্র বজায় রেখেও নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল নামে পরিচিত করেন! তাদের ধর্মপালন প্রগতিশীলতা ও সেকুলারিজমকে ক্ষুণ্ণ করে না। ইসলাম ধর্ম প্রতিপালিত হলেই মুসলমান ব্যক্তিটি ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী হয়ে যায়! সেলুকাস আবার এসে দেখে যান, আসলেই কি বিচিত্র এই দেশ!)
সমাজতন্ত্রে ইসলাম ধর্ম কেবল পশ্চিমবঙ্গেই আক্রান্ত ও বিপদগ্রস্ত হয়নি। বিশ্বব্যাপী পুরো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই হয়েছে। খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নে মুসলমানরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হন। তাদের আত্মপরিচয় মিটিয়ে দেয়া হয়। এমন কি, তাদের নাম বদলিয়ে রাখা হয় করিমভ, রহিমভ ইত্যাদি। যে মধ্য এশিয়ায় ইমাম বোখারী, নকশবন্দিসহ শত-সহস্র অলিআল্লাহ-বুজুর্গের জন্ম হয়েছিল, সেই সমরকন্দ, বোখরা, তাসখন্দ, ফারগানা তথা উজবেকিদস্তান, কাজাকিস্তান, তুর্কিস্তান, আজারবাইজানের মসজিদগুলোতে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। পবিত্র কোরআন, হাদিস চর্চা করা হয় নিষিদ্ধ। প্রকাশ্যে আযান দিয়ে নামাজ আদায়কে বন্ধ করে দেয়া হয়। ইসলাম ধর্ম পালনের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট-সমাজতন্ত্রীদের মতো এতো বিরাট প্রতিবন্ধতা আর কেউই সৃষ্টি করতে পারেনি। জাগরণের জন্য ইসলাম তীব্র গণআন্দোলনে বার বার ফুঁসে ওঠলেও সাবেক সোভিয়েত স্বৈরশাসন রক্ত ও মৃত্যুর নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল অসংখ্য ইসলামী আন্দোলনকে। চেচনিয়া যার জ্বলন্ত উদাহরণ।
গত শতাব্দীর ইতিহাস তথাকথিত পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের নামে একটি সাজানো লড়াইয়ের নাটক দেখলেও প্রকৃত পক্ষে সেই ষড়যন্ত্রমূলক প্রহসনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসলাম ও মুসলমানগণ। পশ্চিমা সভ্যতার তাত্ত্বিকগণ সুকৌশলে জন্ম দিয়েছে তাদের দুইটি অবৈধ-জারজ সন্তান--- একটি পুঁজিবাদ, আর অন্যটি সমাজতন্ত্র। উদ্দেশ্য, সারা বিশ্বকে, বিশেষ করে মুসলিম জগতকে এমন ফাঁদে ফেলে দেয়া, যাতে তারা হয় পুঁজিবাদ, নয় সমাজতন্ত্রের দাসত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়; স্বাধীনভাবে ইসলাম চর্চা করতে না পারে।
যখন উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে পশ্চিমা খ্রিস্ট-ইহুদি জগৎ পুরো পৃথিবীকে অধীনস্ত করে রাখতে পারছিল না, সর্বত্র স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠছিল, তখন পুঁজিবাদের নকল-প্রতিপক্ষরূপে ইসলাম-ঠেকানোর লক্ষ্যে মাঠে ছেড়ে দেয়া হয় ইহুদি কালমার্ক্সের গর্ভজাত সমাজতন্ত্রকে। অর্থডক্স রুশিয় খ্রিস্টান লেনিন এবং স্টালিন সেই সমাজতন্ত্রকে ইসলামের বিরুদ্ধে আরও সূচারু ও কার্যকর হাতিয়াররূপে নির্মমভাবে ব্যবহার করে। ইসলাম হৃত-গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য আরব থেকে এশিয়ায়, সমগ্র মুসলিম জাহানে পুনরুত্থানের প্রাণাবেগ বেজে ওঠতে থাকলে সমাজতন্ত্রের নানা প্রলোভনের মিথ্যার জালে আটকে দেয়া হয় মুক্তিকামী মুসলিম গণমানুষকে। মুসলমানদের দেশে দেশে একদিকে পুঁজিবাদীরা ইসলামকে দমনের এজেন্ডা দিয়ে যেমনভাবে ইরানের শাহ, মিসরের আনোয়ার সাদাত, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, পাকিস্তানের আয়ুব খানের মতো পদলেহী তাবেদারদের বসিয়ে দেয়; অন্যদিকে তেমনিভাবে সমাজতন্ত্রীরাও বসিয়ে দেয় আলবেনিয়ায় আনভার হোসকা (আসলে আনোয়ার হোজ্জা, কিন্তু কমিউনিস্ট হয়ে ইসলামিক আনোয়ার হোজ্জা বদলে রাখেন সেক্যুলার আনভার হোসকা), আফগানিস্তানে নূর মোহাম্মদ তারাকি কিংবা বারবাক কারমালকে। ধূর্ত পশ্চিমা জগৎ এভাবে একহাতে পুঁজিবাদকে আর অন্য হাতে সমাজতন্ত্রকে ব্যবহার করে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ফলে সমাজতন্ত্র পতনের কুড়ি বছর পূর্তিতে এবং কুড়ি বছরের মাথায় পাশের পশ্চিমবঙ্গেও সমাজতন্ত্রীদের বিদায়ের ঐতিহাসিক ঘটনা ‘চুপ থাকা বা উল্লসিত হওয়ার' বদলে মুসলিম ব্যক্তি ও সমাজকে প্রবল আত্মসমালোচনা এবং কর্মকৌশল নির্ধারণের প্রেরণা দিচ্ছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই কালো ইতিহাস, যা অতীতে সমাজতন্ত্রের ভ্লাদিমীর ছদ্মাবরণে এবং বর্তমানে পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী শোষণের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলমানদের নিধন করতে উদ্যত। আফ্রিকা, এশিয়া, আরব কিংবা যেখানেই ইসলামের বিজয় ও উত্থানের সামান্যতম সুযোগ আর সম্ভাবনাও সৃষ্টি হচ্ছে, সেখানেই পশ্চিমা বিশ্বের সদস্যভুক্ত দেশসমূহ--- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি, ইতালি এবং তাদের গোপন-অবৈধ সন্তান ইসরায়েল এসে তীব্র বেগে হাজির হচ্ছে ইসলামি অভ্যুত্থানকে ঠেকাতে। অস্ত্রের জোরে, প্রচারণার কৌশলে, রাজনীতির মারপ্যাঁচে, অর্থাৎ যেভাবে সম্ভব সেভাবেই দমানো ও ঠেকানো হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানদের।
বিশেষ করে সমাজতন্ত্রের পতনের পর পুঁজিবাদী শোষণ-নিপীড়ণকে চ্যালেঞ্জ করে মানুষের মুক্তি ও প্রকৃত স্বাধীনতা আনয়নের একমাত্র বিশ্বব্যাপী শক্তিরূপে ইসলামকে স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়। আর তখনই নতুন করে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ নামক আরোপিত লেবেল দিয়ে দেয়া হয়েছে ইসলাম, ইসলামি আন্দোলন ও মুসলমানদের ওপরে। অতএব সমাজতন্ত্রের বিদায় বা পতনের কুড়ি বছরের প্রাক্কালে প্রতিটি মুসলমানের উচিত আত্মউপলব্ধির আলোয় নিজের কর্ম ও ভবিষ্যতকে নির্মাণ করা। ইসলামের সুমহান আহবানের সঙ্গে আত্মিক ও মানসিক একাত্মতার মাধ্যমে পশ্চিমা শক্তির আর্দশিক জিঞ্জির ছিন্ন করা। পৃথিবীর মানুষের সামনে মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রকৃত রাজতোরণ-ইসলামকে অনুসরণের মাধ্যমে আদিঅন্তহীন মুক্তির মিছিলে এসে সমবেত হওয়া।
মনে রাখা দরকার যে, ইসলামী পুনর্জাগরণ বা ইসলামী গণসচেতনতা কোনও মধ্যযুগীয় ঘটনা নয়। এটি পুরোপুরি সমকালীন বাস্তবতা। আধুনিক পরিস্থিতির ব্যর্থতাজাত সঙ্কটসমূহ এবং সমাজতন্ত্র-পুঁজিবাদ-সৃষ্ট সমস্যাসমূহ মোকাবিলার বৈজ্ঞানিক ও গণতান্ত্রিক বিকল্পরূপে ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই ইসলামী আদর্শ বিশ্ব মানবতার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের চরম ব্যর্থতার পর সাম্প্রতিক সময়ে অর্ধ-ব্যর্থ সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী চক্রের কবল থেকে বিশ্ব ও মানব সমাজকে রক্ষার জন্য প্রায়োগিকভাবে সবচেয়ে সফল, শক্তিশালী ও পূর্ণাঙ্গ মতাদর্শ হিসাবে ইসলামে উত্থান একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে। বস্তুতপক্ষে, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ ইত্যাদি সকল ধর্মনিরপেক্ষ বা সেক্যুলার মতাদর্শ বা ইডিয়লজির মতাদর্শিক ও প্রায়োগিক দুর্বলতা-ব্যর্থতা-অসারতা প্রকাশ পাবার পর সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের সামনে শ্বাশত সৌন্দর্য ও স্বক্ষমতায় কেবলমাত্র ইসলামই একটি প্রেরণা সৃষ্টিকারী পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শরূপে প্রতিভাত হয়েছে। এটি অবশ্যই একটি ধর্ম বিশ্বাস এবং সেই সঙ্গে জীবন বিশ্বাসও। এই বিশ্বাসের পেছনে রয়েছে ইতিহাসচেতনা, বিজ্ঞানবোধ, সাম্যের ভিত্তি, মানবিকতার জয়গান এবং মুক্ত মন; রয়েছে বৈজ্ঞানিক যুক্তি। ইসলাম কেবল স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণকর স্বপ্নের কথা ইসলাম বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করেছে মানুষের পৃথিবীতে, চোখে দেখা বাস্তবতার ও কর্মের মাটিতে। ইসলামের বাস্তব ভিত্তি, বৈজ্ঞানিক যুক্তি, সাম্য, মৈত্রী এবং কল্যাণধারার দিকে তাকিয়ে রয়েছে পতিত সমাজতন্ত্রের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত পৃথিবী ও পৃথিবীর মানবমন্ডলী; তাকিয়ে রয়েছে বর্তমানে ফণা-উদ্যত পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদের নিত্য ছোবলে রক্তাক্ত-জর্জরিত আজকের পৃথিবী ও পৃথিবীর মানববংশ। ইতিহাসের এই প্রত্যাশাকে সত্যে প্রতিপন্ন করে আজ এবং আগামীর প্রকৃত স্বাধীনতা ও মুক্তির বরাভয় নিয়ে ইসলাম আসবেই। প্রকৃতি, পৃথিবী ও মানুষের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের জন্য ইসলামকে আসতেই হবে।
No comments:
Write comments