যুদ্ধাপরাধের বিচার
যুদ্ধাপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালের গঠন প্রক্রিয়া, বিচারের কার্যক্রম এবং উদ্দেশ্যের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে দেশের বিভিন্ন মহলে যেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বিভিন্ন লক্ষণের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠেছে। যেমন সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্ক সফরকালে যখন হিল্টন হোটেলে তার সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান চলছিল, তখন বিএনপি ও কোয়ালিশন ফর আমেরিকান এসোসিয়েশন হিল্টন হোটেলের পাশেই বিক্ষোভ করছিল। এসোসিয়েশনের ব্যানারে ২০টি সংগঠনের পাঁচ হাজার নেতা-কর্মী বিক্ষোভে মুখরিত করে তোলে পুরো এলাকা। তাদের অভিযোগ, সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে বিরোধী দলীয় নেতাদের নির্যাতন আর হয়রানি করছে এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করছে। সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নামে বিরোধী দল নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে নেমেছে। বিক্ষোভকারীরা অবিলম্বে বিরোধীদলের সব নেতার মুক্তি দাবি করেন। কোয়ালিশন ফর আমেরিকান এসোসিয়েশনের ব্যানারে অংশ নেয় বাংলাদেশ আমেরিকান প্রগ্রেসিভ ফোরাম, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ পরিষদ, সাঈদী মুক্তি আন্দোলন, বাংলাদেশ আমেরিকান প্রফেসরস এসোসিয়েশন, এসোসিয়েশন অব আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার্স ইন নর্থ আমেরিকা, এসোসিয়েশন অব আমেরিকান ব্যাংকার্স ইন নর্থ আমেরিকা, বাংলাদেশ বিজনেস এসোসিয়েশন, টিচার্স এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা, বাংলাদেশ আমেরিকান ক্যাবি এন্ড লিমো সোসাইটি, মহিলা কল্যাণ সংস্থা নিউইয়র্ক, ইমাম এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা, প্রবাসী কল্যাণ সংস্থা।
উক্ত ট্রাইব্যুনালের ব্যানারে তেমনি গত সোমবার (২৮/১১/১১ইং) যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র্যাপ দু'দিনের বাংলাদেশ সফরের শেষ পর্যায়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁর সুপারিশধর্মী ঐ বক্তব্যের মধ্য দিয়েও অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রকাশ ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র্যাপ আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে তাঁর ইতোপূর্বে দেয়া সুপারিশ পুরোপুরি গ্রহণ না করাতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। মি. স্টিফেন বলেন, ‘‘আমার ১০টি সুপারিশের ৫টি আংশিক গ্রহণ করা হয়েছে। আমি দুঃখের সাথে বলতে চাই যে, গত জুন মাসে বিচার কাজের ধারাসমূহে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছে তাতে আরও অনেক কিছু আনা সম্ভব ছিল।’’ বাংলাদেশে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ কি তার সঠিক সংজ্ঞায়নও হয়নি বলে স্টিফেন অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ থাকা উচিত। বিচারের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হয়েছে- যুক্তরাষ্ট্র এমনটি দেখতে চায়। ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ সরাসরি রেডিও-টিভিতে প্রচারের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বের সব মানুষের কাছে এ বিচারপ্রক্রিয়া উন্মুক্ত থাকতে হবে। যারা আগ্রহী তাদের এ বিচার কাজ সম্পর্কে জানতে দিতে হবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে আদালতের অধিবেশনে যোগ দেয়া সহজ ও সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সিয়েরালিয়নে যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্যে গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে প্রতিদিন যে কার্যক্রম হয়, তা ইংরেজি এবং সে দেশের ভাষায় বিস্তারিত লিখে ওয়েবসাইটে দিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশেও এটা করা উচিত। এমনভাবে বিচার কাজ পরিচালনা করা দরকার, যাতে তা স্বচ্ছ এবং বিশ্বের সবার জন্যে উন্মুক্ত হয়।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়ে যখনই কোথাও ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি ঘটে, সেখানেই অশান্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এজন্যে বিশ্বের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল দেশে সকল সমাজেই আবহমানকাল থেকেই ন্যায়বিচারের বিষয়টি যেমন সকলের কাঙ্ক্ষিত, তেমনি এর প্রতিষ্ঠার দাবি সর্বত্র অভিন্ন এবং এর চাহিদা সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তবে যে-কোন বিচারকার্যের মূল লক্ষ্যে যেমন বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও কার্যক্রমের দ্বারা সত্য উ ঘাটন ও সে অনুযায়ী ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণের জন্যে নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধস্পৃহা বর্জিত মানসিকতা অপরিহার্য, তেমনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বেলায় তা আরও বেশি অপরিহার্য। এক্ষেত্রে উল্লিখিত বিষয়াদির ব্যতিক্রম ঘটলে তা যেমন বিচারের নামে হবে প্রহসন, তেমনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোথাও তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। মাঝখানে জাতীয় ঐক্য-সংহতি বিনষ্ট হয়ে জাতীয় জীবনের অশান্তিই বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের উন্নতি অগ্রগতির পথে হবে প্রতিবন্ধক। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র্যাপ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও এর সুষ্ঠু কার্যক্রমের ব্যাপারে উত্থিত প্রশ্নাবলীর নিরসনকল্পে যেসব প্রস্তাব ও পরামর্শ দিয়েছেন, এসব প্রস্তাব-পরামর্শ অতীব গুরুত্বপূর্ণ, যা বিশ্বজনীন স্বীকৃত। দেশে-বিদেশে এ ট্রাইব্যুনালের বিচারের গ্রহণযোগ্যতার জন্যে স্টিফেন জে. র্যাপের প্রদত্ত প্রস্তাবাবলীর আলোকে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত ও সে অনুযায়ী এর কার্যক্রম নিশ্চিত করা উচিত। তাতে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধিই পাবে। এই সঙ্গে জামায়াতসহ অন্যায়ভাবে বিরোধী দলীয় যেসব নেতাকে গ্রেফতার ও এ মামলায় জড়ানো হয়েছে, তাদের আশু মুক্তিদান গণতন্ত্র, মানবতা ও মানবাধিকারের দাবি বলে আমরা মনে করি।
No comments:
Write comments