গুম, অপহরণ, গুপ্ত হত্যার নামে নতুন কৌশলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড চলে বছর জুড়ে
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া পরিধির ৫৭ হাজার বর্গমাইলের বিস্তৃত বাংলাদেশের ২০১১ সাল ছিল গুম, অপহরণ, গুপ্ত হত্যার মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বছর। বছরের শুরু জানুয়ারি থেকে শেষ মাস ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিটি প্রান্তর হয়ে উঠেছিল আইনশৃক্মখলা লঙ্ঘনের বছর। বছরের শুরু থেকে চলা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের মাত্রা বছরের শেষ দিকে এসে শনৈঃ শনৈঃ বাড়তে থাকে। এই বাজার হার দেশ-বিদেশে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এতে আলোচিত ও সমালোচিত হয়ে পড়ে সরকার ও তার সংশ্লিষ্ট দফতরসমূহ।
২০১১ সালে যেসব ঘটনা জনগণকে উদ্বিগ্ন করে তোলে তার মধ্যে গুপ্তহত্যা অন্যতম। সারাদেশে আতঙ্ক ছিল গেল বছর জুড়ে। বর্তমানেও এ আতঙ্ক চলছে জনমনে। আইনশৃক্মখলা রক্ষাকারীবাহিনী পরিচয়ে সাদা পোশাকে অপহরণের পর গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছেন নাগরিকরা। কিন্তু পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, গুপ্তহত্যার সঙ্গে তারা কোনভাবেই জড়িত নয়। সাদা পোশাকে আইনশৃক্মখলা রক্ষাকারীবাহিনীর পরিচয়ে অন্য কেই গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে। তাহলে সাদা পোশাকে অভিযান চালানো ব্যক্তিরা আসলে কারা- তা নিয়ে ধুম্রজাল ছিল বছর জুড়ে। তবে কোন সংস্থা গুপ্তহত্যার কথা স্বীকার না করলেও গুপ্তহত্যার শিকার স্বজনেরা এর জন্য দায়ী করছেন আইনশৃক্মখলা রক্ষাকারী বিশেষ বাহিনীকে। ২০১১ সালে দেশের বিভিন্নস্থানে রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক প্রতিহিংসার জের ধরে এসব গুপ্তহত্যা সংঘটিত হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য : মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী ২০১১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে গুম হয়েছেন ৪২ ব্যক্তি। এর মধ্যে লাশ মিলেছে ১৮ জনের। এর মধ্যে শুধু ঢাকা শহর থেকেই ৩০ ব্যক্তি নিখোঁজ হন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে ১২ জনের লাশ পাওয়া যায় গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, আশুলিয়া, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও সাভার এলাকায়। এক সঙ্গে সাতজনকে অপহরণের পর দু'জনকে ছেড়েও দেয়া হয়। অপহৃত ৩০ জনের মধ্যে ১৬ জন এখনও নিখোঁজ। শুধু এসব ঘটনার মধ্যে ৫ মাস আগে ঢাকা সুপার মার্কেটের সভাপতি মোহাম্মদ ওয়াজিউল্লাহর নিখোঁজ হওয়া, ঢাকার ৫০নং ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি অপহরণ ও পরে লাশ উদ্ধার, ৮ ডিসেম্বর যুবলীগ নেতা আফজাল হোসেন নিখোঁজ ও ৯ ডিসেম্বর তার লাশ উদ্ধার, ১৯ অক্টোবর ঢাকা ৪১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদকে র্যাব পরিচয়ে অজ্ঞাত পরিচয় কিছু লোক ধরে নিয়ে যায়, একইভাবে ৮৭নং ওয়ার্ড সভাপতি কাজী আতাউর রহমান নিখোঁজ হওয়া, ২৬ অক্টোবর ফকিরাপুলের একটি হোটেল থেকে যুবলীগ নেতা সরোয়ার জাহান অপহরণ এবং বিএনপি নেতা নাজমুল ইসলামের হত্যা উল্লেখযোগ্য।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতে, নিখোঁজ বা গুম হওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে আইনশৃক্মখলা রক্ষাকারীবাহিনী আন্তরিক না হলে দেশে এ ধরনের অঘটন বেড়ে যাবে। এ ব্যাপারে এ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান তার এক বক্তব্যে বলেন, ক্রসফায়ারের স্থান দখল করে নিয়েছে গুপ্তহত্যা। ফলে ক্রসফায়ারের সংখ্যা কমে গিয়ে গুপ্তহত্যার সংখ্যা বেড়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, যেসব মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন তাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র এটা না করতে পারলে দায়-দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তাবে।
২০১১ সাল জুড়ে চলা গুম, গুপ্তহত্যার আলোচিত ঘটনাগুলো নিম্নরূপ :২ মাসে গুম ৩০ || গুপ্ত হত্যার শিকার ১৭: গত ১৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার মুন্সিগঞ্জের ধলেশ্বরী নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে শার্ট-প্যান্ট পরিহিত গুলীবিদ্ধ তিনজনের ভাসমান লাশ। এর আগে ৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার একই নদী থেকে উদ্ধার হয় ঢাকার ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি ইসমাইল হোসেন ওরফে আল-আমিনসহ দুজনের মৃতদেহ। ধলেশ্বরী নয়, রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ মহাসড়কের পাশে এমনকি ট্রেনের রাস্তা, ম্যানহোল ঢোবা-নালায় পাওয়া যাচ্ছে লাশের মিছিল। এর অধিকাংশই গুম হওয়া।
৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল নেতা ইসমাইল হোসেনের মামা আব্দুল খালেক বলেন, ইসমাইল অপহরনের পর র্যাবের সোর্স পরিচয়ে টুন্ডা রফিক নামে একজন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। তিনি ১ লাখ টাকার বেশি দিতে রাজি না হওয়ায় টুন্ডা রফিক-এর পরিণতি ভয়ানক হবে বলে হুমকিও দেয়। এর পরই ধলেশ্বরী নদীতে লাশের সন্ধান মেলে। মাসুমের স্ত্রী হাওয়া বেগম বলেন, অন্য লাশটি পঁচে গলে যাওয়ার কারণে তার স্বামী কি না নিশ্চিত হতে পারছেন না। এর আগে ২ ডিসেম্বর সাভার মহাসড়কের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় গুলীবিদ্ধ দুটি লাশ। এদের একজন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক মাহামুদুল হক খান হলেও আরেকজনের পরিচয় মেলেনি। গত ২ নবেম্বর থেকে পাওয়া যাচ্ছে না রাজধানীর ৪০ মগবাজারের টিএন্ডটি কলোনীর বাসিন্দা রিয়াজুল ইসলামকে (৩০)। লাল রঙ্গের একটি মোটরসাইকেলসহ তাকে গুম করা হয়। বহু খোঁজাখুঁজির পর সর্বশেষ র্যাব-পুলিশের কাছে গিয়ে সন্ধান চান পাননি পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু সেখানেও কোন হদিস নেই। পরিবারের সদস্যরা জানে না রিয়াজুল কবে ফিরবে। অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীর ৪১ নম্বর ওয়ার্ড (আগারগাঁও) আওয়ামী লীগ সভাপতি নূর মোহাম্মদ হাজী ওরফে হাজী নূর (৭৫) নিখোঁজ হয়েছেন গত ১৮ অক্টোবর। পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, সাভারের কাতলাপুরের বটতলাস্থ বাসায় ঢুকে সাদা পোশাকধারী ২০-২৫ যুবক র্যাব পরিচয়ে গভীর রাতে তাকে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যায়। এর আগে মাদকের ব্যবসা ও আওয়ামী লীগ নেতা ফজলুল হক হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। তবে, র্যাব-পুলিশ হাজী নূরকে ১৮ অক্টোবর ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসছেন। এরপর পরিবারের সদস্যরা তার আশাই ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু হাজী নূর নিখোঁজ হওয়ার পর পরিবারে আতঙ্ক না কাটতেই ৩ ডিসেম্বর আগারগাঁওয়ের শাপলা হাউজিং থেকে অপহরণ হয় নূরের বড় মেয়ের জামাই আব্দুল মান্নান (৪০)। এ সময় মান্নানের সঙ্গী ইকবাল হোসেনকেও ধরে নিয়ে যায় অজ্ঞাত অস্ত্রধারীরা। মান্নান জমি কেনা-বেচনার দালালি ও এলাকায় একটি রিকশা গ্যারেজের মালিক। ইকবালেরও রয়েছে পৃথক রিকশা গ্যারেজ। এদের ধরে নেয়ার ব্যাপারেও র্যাব-পুলিশ এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত করেনি।
মান্নানের স্ত্রী স্বপ্না বেগম জানান, ৪ ডিসেম্বর তার ছোট ভাই মামুনের মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। এজন্য আব্দুল মান্নান ওই দিন সন্ধ্যায় স্থানীয় বাজারে গিয়ে কাঁচাবাজার করে দারোয়ানের হাতে ব্যাগ তুলে দেন। পরে ঘনিষ্ট বন্ধু ইকবাল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেল যোগে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে র্যাব পরিচয়ে অস্ত্রধারীরা দুজনকে ধরে নিয়ে যায়। ইকবালের মা ফরিদা বেগম জানান, তার ছেলে রাজনীতি, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি কোনটার সঙ্গে জড়িত ছিল না। তার শত্রুও ছিল না। একটি রিকশা গ্যারেজ পরিবারকে নিয়ে সুখে শান্তিতে ছিল। তাহলে মান্নানের সাথে থাকার কারণটাই কি তার অপরাধ? ২ অক্টোবর পল্লবী থানা আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল করিম হাওলাদারকে (৫০) হাতকড়া পরিয়ে অপহরণ করে র্যাব পরিচয়ে ৫/৬ যুবক। থানায় মামলাসহ র্যাব, পুলিশ এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার ধর্ণা ধরেও এই ঝুট ব্যবসায়ীরা খোঁজ পাওয়া যায়নি বলে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্ত্রী নাসিমা বেগম। ৬ অক্টোবর একই এলাকার নবর আলী নামে অপর এক ব্যবসায়ী নিখোঁজ হয়। পরিবারের দাবি তাকেও গুম করা হয়েছে। গত ২৬ অক্টোবর ঢাকার ফকিরাপুল থেকে তুলে নেয়া হয় ফেনী সোনাগাজীর বাসিন্দা সারোয়ার জাহান বাবুলকে। তিনি সোনাগাজী উপজেলা যুবলীগ নেতা। ঘটনার দিন হাইকোর্ট থেকে একটি মামলার জামিন নেয়ার জন্য ঢাকায় আসলে রাত ৮টার দিকে হোটেল আসরের সামনে থেকে পুলিশ পরিচয়ে কয়েক যুবক তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায। ৪০ দিনেও জীবিত অথবা মৃত না পেয়ে এ ব্যাপারে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে তার ভাই মানিক। দাবিকরে বেঁচে না থাকলে অন্তত তার লাশটি যেন পরিবারকে ফেরত দেয়া হয়। ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ীর ৮৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি কাজী আতাউর রহমান ওরফে লিটুকে দয়াগঞ্জ থেকে প্রশাসন পরিচয়ে সাদা পোশাকধারীরা তুলে নিয়ে যায়। ১ অক্টোবর গুলশানে যাওয়ার কথা বলে ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম দক্ষিণখানের আশকোনার বাসা থেকে বের হন। এরপর থেকেই তার খোঁজ নেই। ২ জুলাই তেজগাঁও থানা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মিজানুর রহমান ও তার সহযোগী আলী আকবর গুম হন। তিন দিন পর তাদের লাশ পাওয়া যায় তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে। ১৭ নবেম্বর বিকালে মালিবাগ থেকে অপহরণ করা হয় ভোলা বোরহানউদ্দিনের ৭ যুবককে। তারা হলেন, আরিফ, জসিম, জুয়েল, শেখ সাদী, দিদার, মিরাজ এবং আকাশ। সাদা পোশাকধারীরা মাইক্রোবাসে তুলে প্রত্যকের কাছে ২ লাখ টাকা চাইলে শেখ সাদী ও মিরাজ জবাব দেয় ‘স্যার আমরা গরিব মানুষ, এত টাকা দিবো কিভাবে।' মোবাইল সেট কেড়ে নিয়ে পরে কুড়িল বিশ্বরোডে এই দু'জনকে নামিয়ে দেয়া হলেও ২৮ নবেম্বর জসিমের লাশ আবিস্কার হয় আশুলিয়ায়। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করলেও এখনো অপর ৪ জনের হদিস মেলেনি।
৩১ জুলাই দয়াগঞ্জ মোড় থেকে জুয়েল উল্লাহ সরদার, রাজীব উল্লাহ সরদার ও মিজানুর হোসেন নামে তিন যুবককে প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনার পাঁচ দিন পর তাদের হাত-পা বাধা গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৮ জুলাই নারিন্দা থেকে নুরুল ইসলাম বাবু নামে এক যুবককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই দিন পর একই এলাকায় তার লাশ পাওয়া যায়। ৪ জুলাই রাজধানী মার্কেট এলাকা থেকে সজল (১৯) ও ইমরান (২০) নামে দুই যুবককে ধরে নিয়ে যান সাদা পোশাকের আইনশৃক্মখলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যরা। আট দিন পর সজলের লাশ গাজীপুর ও ইমরানের লাশ কেরানীগঞ্জ থেকে উদ্ধার করা হয়। এছাড়া কুরবানীর ঈদের পরদিন পুরনো ঢাকার সূত্রাপুর থেকে গুম হয়েছেন ব্যবসায়ী মনির হোসেন। বরিশালের উজিরপুরের বিএনপি নেতা ও ঢাকার ব্যবসায়ী হুমায়ুন খান। এছাড়া গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর মাত্র ৭২ ঘণ্টার ব্যবধানে দেশে ১২টি গুপ্ত হত্যার সংবাদ পাওয়া যায়। তবে এসব হত্যাকান্ডের সবগুলো ওই ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সংঘটিত হয়নি। এদের অধিকাংশকেই অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়। ৭২ ঘণ্টায় পাওয়া ১২টি লাশের মধ্যে ১৩ ডিসেম্বর তিনটি লাশ পাওয়া যায় মুন্সিগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীতে, ১৪ ডিসেম্বর পাওয়া যায় ৫টি লাশের খবর আর ১৫ ডিসেম্বর পাওয়া যায় বাকি ৪টি লাশ। এগুলো পাওয়া যায় গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রাজশাহী থেকে। গাজীপুর সদর উপজেলার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ১৫ ডিসেম্বর সকালে যশোর জেলা বিএনপির অর্থ বিষয়ক সম্পাদক ও ঝিকরগাছা থানা বিএনপির সভাপতি নাজমুল ইসলামের (৪৫) লাশ উদ্ধার করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থেকে ১৪ ডিসেম্বর রাতে মুক্তার হোসেন (২৭) নামের এক যুবকের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। মুক্তারের বাড়ি নবীনগর পৌরসভার আলীয়াবাদ গ্রামে। তিনি ভাড়ায় যাত্রী নিয়ে মোটরসাইকেল চালাতেন। অন্যদিকে রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলায় ১৫ ডিসেম্বর সকালে আলম (৫০) ও শামছুল ইসলামের স্ত্রী সাহারা খাতুনের (৩৫) লাশ উদ্ধার করা হয়। আলমের লাশ গলা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পাওয়া গেছে। আর সাহারা খাতুনের দুই পায়ের রগ কাটা ও গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় পাওয়া যায়।
৭২ ঘণ্টায় ১২ গুপ্তহত্যামাত্র ৭২ ঘণ্টার ব্যবধানে দেশে ১২টি গুপ্তহত্যার সংবাদ পাওয়া গেছে। তবে এসব হত্যাকান্ডের সবগুলো গত ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সংঘটিত হয়নি। এদের অধিকাংশকেই অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এখনো পর্যন্ত আইনশৃক্মখলা বাহিনী এসব হত্যাকান্ডের পেছনে জড়িতদের শনাক্ত করতে পারেনি। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন গত ১৪ ডিসেম্বর দাবি করেছেন, তিনি গুপ্তহত্যার খবর জানেন না। পত্রিকা পড়ে খবরটি শুনেছেন।
গত ৭২ ঘণ্টায় পাওয়া ১২টি লাশের মধ্যে ১৩ ডিসেম্বর তিনটি লাশ পাওয়া যায় মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীতে, ১৪ ডিসেম্বর পাওয়া যায় ৫টি লাশের খবর আর ১৫ ডিসেম্বর পাওয়া যায় বাকি ৪টি লাশ। এগুলো পাওয়া যায় দেশের নানা প্রান্তে। এদিকে গুম হত্যাকান্ড নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, দেশের আইনশৃক্মখলা পরিস্থিতি খুব খারাপ। গুপ্ত হত্যা, অপহরণ বেড়ে গেছে। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, দেশের আইনশৃক্মখলা পরিস্থিতি যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো।
জানা যায়, দেশের তিনটি স্থান থেকে গত ১২ ঘণটায় বিএনপি নেতাসহ চার ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব লাশ উদ্ধার করা হয় গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রাজশাহী থেকে। গাজীপুর সদর উপজেলার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ২৫ ডিসেম্বর সকালে যশোর জেলা বিএনপির অর্থবিষয়ক সম্পাদক ও জিকরগাছা থানা বিএনপির সভাপতি নাজমুল ইসলামের (৪৫) লাশ উদ্ধার করা হয়। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে যশোর জেলা বিএনপি সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে পরদিন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থেকে ১৪ ডিসেম্বর রাতে মুক্তার হোসেন (২৭) নামের এক যুবকের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। মুক্তারের বাড়ি নবীনগর পৌরসভার আলীয়াবাদ গ্রামে। তিনি ভাড়ায় যাত্রী নিয়ে মোটরসাইকেল চালাতেন। অন্যদিকে রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলায় ১৫ ডিসেম্বর সকালে আলম (৫০) ও শামছুল ইসলামের স্ত্রী সাহারা খাতুনের (৩৫) লাশ উদ্ধার করা হয়। আলমের লাশ গলা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পাওয়া গেছে। আর সাহারা খাতুনের লাশের দু'পায়ের রগ কাটা ও গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় পাওয়া যায়। ওই দিন সকাল নয়টার দিকে গাজীপুর সদর উপজেলার ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের পাশে দক্ষিণ শালনা সাকুরা এতিমখানার পাশ থেকে নাজমুল ইসলামের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার চোখে মলম ও গলায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
এদিকে বিদেশগামী আত্মীয়কে বিদায় জানাতে গত ১৭ নভেম্বর সকালে ভোলার বোরহানউদ্দিন থেকে ঢাকায় এসেছিলেন পাঁচজন। ওই দিন দুপুরে রাজধানীর মালিবাগ এলাকা থেকে তাদেরসহ সাতজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর দু'জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। আর ১০ দিন পর আশুলিয়া এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় তাদের একজন জসীমউদ্দীনের (৩৫) লাশ। আর ২৮ নভেম্বর সকালে আশুলিয়ার ঘোষবাগ ও ইপিজেড নতুন জোনের সামনে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশ থেকে প্রায় একই বয়সের দু'যুবকের গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর কয়েক দিন পর ঘোষবাগ থেকে উদ্ধার করা লাশটি জসীমউদ্দীনের বলে শনাক্ত করেন তার ভাই জাহাঙ্গীর আলম। এদিকে ১৩ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ ধলেশ্বরী নদী থেকে ভাসমান অবস্থায় পুলিশ অজ্ঞাত তিন যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে। লাশগুলোর প্রত্যেকটির হাত পেছনের দিকে ও পিঠ বরাবর সিমেন্টের বস্তা বাধা ছিল। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, তাদের গুলী করে হত্যা করা হয়েছে।
আড়াই মাসে ১৯ লাশ উদ্ধার : গাজীপুর জেলার বিভিন্নস্থান থেকে গত আড়াই মাসে ১৯ জনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে যশোর জেলা বিএনপির নেতা নাজমুল ইসলাম, একজন পোলট্রি ব্যবসায়ী ও একজন অটোরিকশাচালকসহ কয়েকজনের পরিচয় মিলেছে। লাশগুলো পাওয়া গেছে রাস্তার পাশে, জঙ্গলে, বিলে ও পুকুরে। নয়জনকে শ্বাসরোধ করে, চারজনকে আঘাত ও জখম ও এবং একজনকে গুলী করে হত্যার পর লাশগুলো ফেলে রাখা হয়। আড়াই মাসে এতগুলো হত্যাকান্ড হলেও একটি ছাড়া অন্যগুলোর রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। পরিচয়হীন লাশগুলো গাজীপুর পৌরসভার কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। দাফনের আগে নিয়মানুযায়ী তাদের ছবি তুলে রেখেছে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ।
অক্টোবরে সাতজনের লাশ উদ্ধার : ৩ অক্টোবর কালিয়াকৈর উপজেলার সারাবাড়ি গ্রামের একটি বিল থেকে ওই গ্রামের লিটনের (২৮) লাশ পাওয়া যায়। পুলিশের ধারণা, দুর্বৃত্তরা লিটনকে শ্বাসরোধে হত্যা করেছে। এক দিন পর টঙ্গীর মধুমিতা এলাকায় রেললাইনের পাশ থেকে এক নারীর লাশ পাওয়া যায়। তার মুখ থেঁতলানো ও শরীরের বিভিন্নস্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। ৭ অক্টোবর জেলার শ্রীপুর উপজেলার গোসিঙ্গার হায়াত খাঁর চালা এলাকা থেকে হারিছ মোল্লা নামের এক ব্যক্তির (৭০) লাশ পাওয়া যায়। তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। এক দিন পর কালিয়াকৈরের ভান্নারা এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবকের লাশ। ১৫ অক্টোবর গাজীপুর পৌরসভার পূর্ব ভুরুলিয়ার একটি বিলে গলায় গামছা পেঁচানো অবস্থায় পোলট্রি ব্যবসায়ী শাহজাহান মিয়ার (৩৫) লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় করা হত্যা মামলার বাদি নিহতের ছোট ভাই মো. সাহিদ বলেন, ব্যবসায়িক কাজে তার ভাই মজনু তার কাছে ১৪ লাখ টাকা পেতেন। ওই টাকা চাওয়ায় মজনু ও তার বন্ধু জিয়ারুল দু'তিন দিন আগে তার ভাইকে অপহরণের পর হত্যা করে। ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জয়দেবপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, গ্রেফতারের পর জিয়ারুল ও মজনু স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এদিকে ২৭ অক্টোবর সদর উপজেলার শালনা বাজারের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় শেরপুরের নকলা উপজেলার নয়ন মিয়ার (২৪) লাশ। তার গলায় রশি পেঁচানো ছিল। এক দিন পর কালিয়াকৈরের শাকাস্বর এলাকা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের (২৫) লাশ পাওয়া যায়। তার গলায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
নবেম্বরে আটজনের লাশ : ১ নবেম্বর ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে কালিয়াকৈরের সাহেব বাজার এলাকার একটি পুকুর থেকে এক ব্যক্তির (৪০) লাশ উদ্ধার করা হয়। তার গলায় গামছা পেঁচানো ছিল। ৪ নবেম্বর সদর উপজেলার হোতাপাড়া এলাকার রংমিস্ত্রি ডিপজল (৩৮) কাজের কথা বলে বাসা থেকে বের হন। এর সাত-আট দিন পর ওই এলাকায় রুদ্রপুর সড়কের পাশের একটি জঙ্গল থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ডিপজলের শরীরের বিভিন্নস্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। গাজীপুর কৃষি ডিপ্লোমা কলেজ চত্বরের ডোবা থেকে ১০ নবেম্বর সন্ধ্যায় এক তরুণীর কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এটি সদর উপজেলার চতর নয়াপাড়া এলাকার মৃত আলতাফ হোসেনের মেয়ে মুক্তা আক্তারের (২০) কঙ্কাল। তার মা বাহাতুন্নেছা বলেন, মুক্তি পোশাক কারখানায় চাকরি করত। ১২ নবেম্বর সদর উপজেলার ভোগড়া এলাকায় গলায় রশি পেঁচানো অবস্থায় আসমা আক্তার (২১) নামের এক নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একই দিন কালিয়াকৈর উপজেলার মাটিকাটা এলাকা থেকে অজ্ঞাতপরিচয়ের এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। তার হাতে শাখা ও মাথায় সিঁদুর দেয়া ছিল। ১৬ নবেম্বর কালিয়াকৈরের রতনপুর রেললাইনের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবকের (২৮) লাশ। তার চোখে, গলায় ও শরীরে ছিল আঘাতের চিহ্ন। ১৮ নবেম্বর সদর উপজেলার ভাওয়াল মির্জাপুর রক্ষিতপাড়া গজারি বন থেকে উদ্ধার করা হয় অটোরিকশাচালক শহদুল ইসলামের (২৮) লাশ। তার মাথায় দু'টি ও বাম গালে একটি গুলীর চিহ্ন ছিল। ২৭ নবেম্বর সদর উপজেলার রাজেন্দ্রপুর এলাকার ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান থেকে অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের (৩০) অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার হয়।
ডিসেম্বরে চারজনের লাশ :
৯ ডিসেম্বর টঙ্গীর মুদাফা প্রত্যাশার মাঠের পাশে একটি ধানখেত থেকে অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের লাশ উদ্ধার হয়। ১১ ডিসেম্বর কালিয়াকৈরের শেওড়াতলী এলাকার সেতুর নীচ থেকে রিপন মিয়া (৪০) নামের এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৪ ডিসেম্বর রতনপুর এলাকার রেললাইনের পাশ থেকে অজ্ঞাতপরিচয় কিশোরের লাশ উদ্ধার হয়।
সর্বশেষ ১৫ ডিসেম্বর সকালে গাজীপুরের দক্ষিণ শালনায় গলায় গামছা পেঁচানো অবস্থায় উদ্ধার করা হয় যশোর জেলা বিএনপির নেতা ও ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি নাজমুলী ইসলামের (৪৫) লাশ। এসব গুপ্তহত্যা ও গুমের ঘটনার সঠিক কোন কারণ না পাওয়া গেলেও ভুক্তভোগীরা র্যাব-পুলিশকে দায়ী করেছে। এ বিষয়ে র্যাব বলছে গুম গুপ্তহত্যাকে প্রশ্রয় নয়, অপহৃত ব্যক্তি ও লাশ উদ্ধারের সপক্ষে তারা। আর পুলিশ বলছে তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক সময় গুম হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে পরিবার-পরিজনের মনে সন্দেহ জাগে যে তিনি অভিমান করে লুকিয়ে রয়েছে। এ জন্য অনেক সময় থানায় অভিযোগও করা হচ্ছে না। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর তাদের দিয়ে ফলাফলের খাতা অধিকাংশে শূন্য। গুপ্তহত্যার শিকার এসব লাশের মিছিল অজ্ঞাত পরিচয়ে নিয়মিতই যাচ্ছে ঢাকা মেডিকেলসহ অন্যান্য হাসপাতালের মর্গে। পরিচয় মেললেও অধরাই থেকে যাচ্ছে খুনীরা।
অভিযোগ ছুঁড়লেও পরিবার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না র্যাব-পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী এসব অস্ত্রধারী কারা। ধরা পড়ছে না ঘাতকরা। তাহলে এসব লাশের বহর বাড়াচ্ছে কারা? সকলের এমনটাই প্রশ্ন। একের পর এক গুম-গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছে দেশের রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ীরা।
গুম ও গুপ্তহত্যার ব্যাপারে র্যাবের পরিচালক (লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া) কমান্ডার এম সোহায়েল বলেন, এ বছরে তারা অন্তত ১শ' ৫০ জন অপহৃত ব্যক্তিকে জীবিত ও লাশ উদ্ধার করে স্বজনদের ফিরিয়ে দিয়েছে। আর প্রতিষ্ঠা লগ্ন ২০০৪ থেকে ১ হাজার জন। তাহলে র্যাবের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আসবে কেন। একটি বিশেষ মহল র্যাবের সফলতার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছেন বলে তার দাবি। র্যাবের এই পরিচালক বলেন, যারা এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে, অপহৃত ব্যক্তিদের পরিবারকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্ররোচিত করছে তাদেরও চিহ্নিত করার কাজ র্যাব ইতিমধ্যে শুরু করেছে। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন গত বুধবার দাবি করেছেন, তিনি গুপ্তহত্যার খবর জানেন না। পত্রিকা পড়ে খবরটি শুনেছেন। তিনি আরও বলেন, দেশের আইনশৃক্মখলা পরিস্থিতি যে কোনো সময়ের তুলনায় ভালো। এদিকে গুম হত্যাকান্ড নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, দেশের আইনশৃক্মখলা পরিস্থিতি খুব খারাপ। গুপ্ত হত্যা, অপহরণ বেড়ে গেছে। বিএনপি গত ১৫ ডিসেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে অভিযোগ করেছে, এ ধরনের গুম ও খুনের পেছনে সরকারের হাত রয়েছে। বিষয়টি রাজনৈতিক বলেও দলটি অভিযোগ করেছে। ডিসেম্বরে হঠাৎ করেই এ ধরনের ঘটনা বেড়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো দাবি করছে।
মানবাধকার সংগঠন অধিকারের সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খান অপহরণের পর গুম ও হত্যার এই ঘটনাকে আইনশৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নতুন কৌশল বলে সন্দেহ করছেন। আগে যে বিচার বহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটতো ইদানীং তা কমে গেলেও এটা তারই একটি পরিবর্তিত রূপ বলে তিনি মত দেন। মি. খান জানান, ঘটনার পর মৃত ব্যক্তির পরিবারের সাথে কথা বলে তারা এ ধরনের অভিযোগ পেয়েছেন।
বাংলাদেশে গুমের হার আশঙ্কাজনক : এএফএডিদেশে গুমের ঘটনা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার সংগঠন। গত ১৬ ডিসেম্বর সংগঠনগুলোর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবনধারণের অধিকারের সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব সরকারেরই। বিবৃতিতে সংগঠনগুলো দাবি করেছে, বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই নিখোঁজ নাগরিকদের উদ্ধারে কাজ করতে হবে। দোষীদের শাস্তি দিতে হবে এবং গুম প্রতিরোধে যে সব মানবাধিকার সংগঠন কাজ করছে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে। সংগঠনগুলো জানিয়েছে, অনেক পরিবারই দাবি করছে, তাদের স্বজনদের আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে গেছে এরপর তাদের আর পাওয়া যায়নি। সংগঠনগুলোর জোট ‘দি এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স' (এএফএডি) তাদের বিবৃতিতে বলছে, শুধু একটি জেলাতেই এক সপ্তাহে গুম হওয়া আটজনের লাশ পাওয়া গেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, গুমের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশীদের জন্য নতুন নয়, ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ও পরের ৪০ বছর ধরে লোকজন গুম হচ্ছে।
ফিলিপাইনের কয়েকজন সিটির সদর দফতর থেকে পাঠানো বিবৃতিতে জোটটি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছে, ‘‘গুমের ঘটনার সাম্প্রতিক বৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনক। বাংলাদেশে বিদ্যমান মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা, দীর্ঘদিন ধরে দায়মুক্তির চর্চা ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার চিত্র আবারো সামনে নিয়ে এসেছে এই পরিস্থিতি। জোটটির সভাপতি মুগিয়াতো ও সম্পাদক আইলিন বাকালসো স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘গুম প্রতিরোধে প্রণীত ১৯৯২ সালের আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করে তার আওতাভুক্ত হতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে এই দাবি জানাচ্ছি।’’
গুম করা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদটি ১৯৯২ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গ্রহণ করা হলেও কার্যকর হতে লেগে যায় দীর্ঘ আট বছর। সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত ছিল কমপক্ষে ২০টি সদস্যরাষ্ট্র এ সনদের আওতাভুক্ত হলে পরে তা কার্যকর হবে। সে অনুযায়ী ২০টি সদস্যরাষ্ট্র সনদটির আওতাভুক্ত হতে রাজি হলে ২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বরে কার্যকর হয় সনদটি। এ পর্যন্ত মোট ২৩টি দেশ সনদটির আওতাভুক্ত হয়েছে।
মানবাধিতার সংগঠনগুলোর দাবি, বাংলাদেশ যদি সনদটির আওতাভুক্ত হয় তবে গুম হওয়ার কবল থেকে আইন সুরক্ষা পাবার পথ প্রশস্ত হবে নাগরিকদের। গুম করার বিরুদ্ধে সচেনতা তৈরি এবং এমন ঘটনা প্রতিরোধে সরকারগুলোকে চাপ দিতে এশিয়ার দেশগুলোর মানাবধিকার সংগঠনগুলো অনেক বছর ধরে এএফডি নামের জোট তৈরি করে কাজ করে আসছে। ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন এ জোটে সক্রিয় রয়েছে।