সরকার চেষ্টা করলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারে। সে জন্য প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরিবর্তন করতে হবে।
মেধা বিকাশের সর্বোচ্চ পীঠস্থান আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কিন্তু দুঃখজনক যে প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে এসে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এসব ঘটনায় শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এসব ন্যক্কারজনক কর্মকা-ের জন্য অসুস্থ ছাত্ররাজনীতিকেই দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। ছাত্ররা আধিপত্য বজায় রাখতে অহেতুক সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় যে শিক্ষার্থীদের হাতে বইয়ের বদলে অস্ত্র শোভা পাচ্ছে। যা আমাদের জন্য সত্যিকারের লজ্জার বিষয়। আমরা লক্ষ্য করছি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন কারণে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও শিবিরের সংঘর্ষে দুইজন নিহত হওয়ার ঘটনা এ অসন্তোষের ধারাবাহিক ঘটনা এবং আমাদের অসুস্থ রাজনীতির ফল বলেই আমরা মনে করি। ছাত্ররা লেখাপড়া ছেড়ে কেন সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত হবে_ এ বিষয়টি সরকার এবং সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি দেশের মূলধারার রাজনীতির বাইপ্রডাক্ট হলেও একসময় ছাত্ররাজনীতির গৌরব ছিল। আমাদের জাতীয় আন্দোলন-সংগ্রাম ও বিভিন্ন দাবি আদায়ে ছাত্ররাজনীতির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু দেশের মূল রাজনীতি নানা কারণে দূষিত ও দুর্বৃত্তায়িত হয়ে পড়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ছাত্ররাজনীতিতে। আর এ কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুস্থ ও স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। কাজেই মূলধারার রাজনীতি ঠিক না হলে বাইপ্রডাক্ট ঠিক হবে, এমনটি আশা করা বাতুলতা মাত্র। মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়, রাজনৈতিক দলের দোহাই দিয়ে ছাত্ররা টেন্ডার-সন্ত্রাস, আবাসিক হল দখল, ভর্তি বাণিজ্য, রাজনৈতিক সন্ত্রাস ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়েছে। এমনকি নিজ দলের ছাত্রদের ওপর তারা চালাচ্ছে অকথ্য নির্যাতন। কখনো খুন করছে নিজ দলের ছাত্রদের। যত দিন যাচ্ছে ততই এ প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির নামে সন্ত্রাসী কর্মকা- কখনো সমর্থনযোগ্য ঘটনা নয়। আমরা এ কলামের মাধ্যমে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের বারবার বলে আসছি শিক্ষাঙ্গনগুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে। কিন্তু সরকার, রাজনৈতিক দল বা কেউই কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি।
তথ্য অনুযায়ী আধিপত্যের রাজনীতির জের ধরে সংঘর্ষের কারণে গত ২৪ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ জন শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। এসব হত্যাকা-ের পর তদন্ত কমিটিও গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। মামলাও করা হয় নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে। কিন্তু হত্যাকা-ে জড়িতরা শাস্তি পেয়েছে এমন দৃষ্টান্ত নেই। কিন্তু এমনটি কেন ঘটবে? আমরা মনে করি, অপরাধী যে দলেরই হোক না কেন তার উপযুক্ত শাস্তির বিধান করা দরকার। কোনো ছাত্র 'সন্ত্রাসী' দোষী প্রমাণিত হওয়ার পরও শাস্তি না পেলে সন্ত্রাস দূর হবে না। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের হোতাদের খুঁজে বের করে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আমরা লক্ষ্য করি রাজনৈতিক দলগুলো অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে দল থেকে বহিষ্কার করে তাদের দায়িত্ব শেষ করে। কিন্তু বহিষ্কার কোনো সমস্যার সমাধান নয় এটি রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে।
আমরা মনে করি সরকার চেষ্টা করলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারে। সে জন্য প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরিবর্তন করতে হবে। 'ছাত্ররাজনীতি' সম্পর্কে আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন দরকার। শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এবং দেশে ছাত্ররাজনীতির সমৃদ্ধ ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। ছাত্রসমাজ থেকে সন্ত্রাসের মূলোৎপাটন করা সরকারের একটি পবিত্র দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি।