Flickr

Wednesday, 28 May 2014

আমাদের গৌরবের র‌্যাব

আমাদের গৌরবের র‌্যাব
র‌্যাবের একটি ইউনিট টাকার বিনিময়ে খুনের কাজ করেছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। র‌্যাব ও পুলিশ  অনেক আগে থেকেই নানা অপকর্ম ও আইন ভঙ্গ করার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আসছে। অবশেষে এই ঘটনাটি মানুষকে স্তম্ভিত করেছে, অবাক করেছে। খবরে প্রকাশ র‌্যাবের একটি ইউনিট অথবা ইউনিটের কতিপয় সদস্য ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে নারায়ণগঞ্জে সাতজন বিশিষ্ট লোককে হত্যা করেছে। ঘটনাটি এখনো তদন্ত পর্যায়ে থাকলেও র‌্যাবের সংশ্লিষ্ট ইউনিটের তিন জন সদস্যকে বরখাস্ত করেছে । র‌্যাবের বিভাগীয় তদন্ত ছাড়াও হাইকোর্টের নির্দেশে নিরপেক্ষ তদন্তেরও ব্যবস্থা হয়েছে। সবাই আশা করছে ঘটনার গডফাদারসহ দায়ী সকলে দিনের আলোতে আসবে এবং উপযুক্ত শাস্তিও তাদের হবে।
র‌্যাবের এই ঘটনা ক্ষোভের চেয়ে বেদনার সৃষ্টি করেছে বেশি। আশার এক আলোকবর্তিকা হিসাবে চারদলীয় জোটের শাসনামলে র‌্যাবের জন্ম হয়েছিল। বিশেষ এলিট ফোর্স হিসাবে র‌্যাব গঠন করা হয়েছিল। পুলিশবাহিনী ও সেনাবাহিনী থেকে চৌকস, সৎ, সাহসী, কর্মঠ লোকবল নিয়ে র‌্যাব গঠন করা হয়। বড় বড় সন্ত্রাসী ও অপরাধ কর্মের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবহার করা ছিল উদ্দেশ্য। পুলিশের গতানুগতিকতা থেকে ভিন্নতর র‌্যাব বা র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন সমাজে অপরাধের বিস্তার থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য বিরাট ভূমিকা পালন করবে। একটা সময় পর্যন্ত র‌্যাব দেশের মানুষের আশা পূরণ করেছে। র‌্যাব মানুষের কাছে গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের ক্ষিপ্রতা, কর্মতৎপরতা, সাফল্য মানুষের গল্পের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই র‌্যাবের আজ এই পরিণতি কেন? কেন তারা গর্বের বদলে মানুষের কাছে অভিযুক্ত হচ্ছে গর্হিত কাজের জন্য? কেন তারা আশার বদলে আতঙ্কে পরিণত হয়েছে? কেন আজ র‌্যাব ভেঙ্গে দেয়ার প্রশ্ন উঠছে? এই দুরবস্থার জন্য কি র‌্যাব দায়ী কিংবা র‌্যাব একাই কি দায়ী।
সবাই একমত হবেন যে দেশে আজ আইনের শাসন ভেঙ্গে পড়েছে। প্রশাসনের শীর্ষ থেকে নিম্নতম পর্যায় পর্যন্ত ‘চেইন অব কমান্ড’ নেই বললেই চলে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মীরা যে যেমন পারে তেমন কাজ করছে। স্বীকার না করে উপায় নেই প্রশাসনের রাজনীতিকরণ বিশেষ করে র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা, প্রতিপক্ষ দমনে কাজে লাগানো, একজনের বদলে এক হাজার জনকে আসামী করা এবং গ্রেফতার বাণিজ্যকে অব্যাহতভাবে চলতে দেয়া ইত্যাদি অপরাজনীতি র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর পেশাদারিত্বকে আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। রাজনৈতিক ফ্রন্টে লুটপাট চলছে। সেই লুটপাটের দৃষ্টান্ত প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীতেও অনেকেই অনুসরণ করছে। এটা অনেকটা ওপেন সিক্রেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। র‌্যাবের কতিপয় সদস্য কর্তৃক তথাকথিত ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে সাতজনকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এটাই যে শেষ ঘটনা তা আমরা মনে করতে পারছি না। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক মহলে যদি লুটপাট বন্ধ না হয়, র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকে যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সরকার ব্যবহার বন্ধ না করে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিকদের শায়েস্তা করার জন্যে যদি গ্রেফতার ও গ্রেফতার বাণিজ্য উৎসাহিত করা হয়, তাহলে আইনের শাসন ফিরে আসবে না এবং আমাদের আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীরও নীতি নিয়ম ও আইন মানার দায় থাকবে না। আইন মান্য করার দায় উপর থেকে আসে, নীচ থেকে নয়।

Saturday, 24 May 2014

স্বাধীনতার চেতনা ও ইতিহাসের সংরক্ষণে বাংলা ব্লগ ও বাঙালি ব্লগারদের ভূমিকা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা ও ইতিহাসের সংরক্ষণে বাংলা ব্লগ ও বাঙালি ব্লগারদের যে ভূমিকা তার চূড়ান্ত প্রকাশ আমরা দেখেছিলাম শাহবাগ আন্দোলনের মাধ্যমে। এবং বাংলাদেশের অস্তিত্ববিরোধী শক্তির হাতিয়ার হিসেবে ধর্মের ব্যবহারটাও আমরা দেখতে পেরেছিলাম সেই একই সময়ে। দেখেছিলাম ধর্মকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে নব রূপে জন্ম নিয়েছে রাজাকার বান্ধব হেফাজতী আন্দোলন। এরই প্রেক্ষিতে পহেলা এপ্রিল ২০১৩ তারিখে চারজন নাস্তিক ব্লগারকে ডিবি পুলিশ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এর ৫৭ (১) ধারায় গ্রেফতার করা হয়েছিলো। যে ধারাটির সন্নিবেশন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন, মহান সংবিধানের ধর্ম-নিরপেক্ষতার মূলনীতি এবং বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত অবমাননা। [১] এরপরে জল গড়িয়েছে অনেকটাই, অসাংবিধানিক এই ধারাটি তার বিষবৃক্ষের ডালপালা ছড়িয়েছে আরো বহুদূর।

এই কালো আইনের সর্বশেষ শিকার চট্টগ্রাম নিবাসী দুই কিশোর ব্লগার কাজী রায়হান রাহী ও উল্লাস ডি ভাবন। গত ৩০ মার্চ’ ২০১৪ তারিখে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে নিজেদের আসন্ন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রবেশপত্র সংগ্রহ করতে গেলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ি তাদের উপর আক্রমণ চালায় জামাত-শিবির মনষ্ক ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা। [২] পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা সংগ্রহ করে- অপর এক ধর্মান্ধ সন্ত্রাসি এবং একাধিক হত্যার হুমকি ও জঙ্গিতৎপরতায় উষ্কানিদাতা ফারাবি শফিউর রহমান’এর সাথে, প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসে দ্বিমত পোষণকারী রাহি ও উল্লাসের কিছু কথপোকথন। [৩] “অপরাজেয় সঙ্ঘ” নামক এই জামাতমনষ্ক সন্ত্রাসি দলটির সাথে ফারাবি’র যোগাযোগের প্রমাণও স্পষ্ট। এরই প্রেক্ষিতে, আক্রান্ত ব্লগারদের উপরে হামলা করবার পূর্বে তারা তৈরি করে ধর্মীয় উষ্কানিমূলক প্রচারপত্র এবং সময় বুঝে ঝাপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র দুই কিশোরের ওপর। গুরূতরভাবে আক্রান্ত কিশোরদ্বয়কে স্থানীয় পুলিশ সুরক্ষা প্রদানের পরিবর্তে ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করে তথতাকথিত ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেবার অজুহাতে।

উল্লেখ্য যে, অভিযুক্ত ব্লগার দুজনই অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোর এবং এই বারের অনুষ্ঠিতব্য এইচ,এস,সি, পরীক্ষার্থী। তা হওয়া স্বত্বেও তাদের সাথে পুলিসের আচরণ মোটেও কিশোর অপরাধীর মত ছিল না। এমনকি অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক হওয়া সত্তেও এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার কারণবশতও, ৫৭ ধারার অবাস্তব মারপ্যাঁচে পড়ে তাদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর হয়ে যায়। সেই সাথে, নিরাপত্তাজনিত কারণে এই কিশোরদ্বয়ের পক্ষে স্থানীয় আইনজীবিরাও দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছেন বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে। উল্লাস, ইসলাম ভিন্ন অন্য ধর্মাবলম্বী বলে অনেক আইনজীবিই তার পক্ষে মামলা লড়তে অস্বীকৃতি জানান বলেও জানা গেছে। তাছাড়া এদের পরিবারও স্পষ্ট নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এই পুরো ব্যাপারটাই দেশের মধ্যে একটি নষ্ট, জঙ্গিবান্ধব ও ধর্মান্ধ পরিবেশ তৈরি হবার প্রমাণ বহন করে।

তবে এরথেকেও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে- এই ঘটনার পরেই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাহি ও উল্লাসের উপর চলা জীবন সংশয় সৃষ্টিকারী এই হামলার হোতা “অপরাজেয় সঙ্ঘ” নামক ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী সঙ্গঠনটির একাধিক সদস্যের দাম্ভিক স্বীকারোক্তি থাকা সত্তেও তাদের বিরূদ্ধে কোনো প্রকার আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি তারা প্রকাশ্যে এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির হুমকি প্রদান করা সত্তেও তারা নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে। [৩] অথচ এগুলোর সবই বাংলাদেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনে স্পষ্ট দন্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এদের বিরূদ্ধে কোনোপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহন করা তো হয়ইনি, বরং এদের নির্বিঘ্ন চলাফেরার সুযোগ দিয়ে প্রশাসন এই ব্লগারদের পরিবারকেও হুমকির মুখে ফেলছে।

উল্লেখ্য যে, তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাটি প্রথম থেকেই মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের কারণে বিতর্কিত। সেই সাথে স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে বার বার ব্লাসফেমী আইনের বিকল্প হিসেবে এর ব্যবহার যথেষ্টই আশংকার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি, দেশের প্রচলিত অন্যান্য আইনের সাথেও এই ধারাটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কেউ চুরি করুক, ডাকাতি করুক, খুন করুক, ধর্ষন করুক- তার জামিন আছে। কিন্তু, ৫৭ ধারার অপরাধের কোন জামিনের সুযোগ রাখা হয়নি। সেই সাথে এই ধারায় কৃত অপরাধ-এর ন্যুণতম শাস্তি ৭ বছরের কারা দন্ড, যেখানে ধর্ষনের মত জঘন্যতম একটি অপরাধের ন্যুনতম শাস্তিও এরচেয়ে কম। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে ফেইসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে ধর্মীয় মৌলবাদি ও রাজাকারদের সংগঠন জামাতে ইসলামীর কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের রায়ের আগে ও পরে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের উস্কানি, পরিকল্পনা কোন রকম বাধা ছাড়াই করেছে। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কোনপ্রকার আইনের আওতায় নেয়া না হলেও সামান্য ফেইসবুক স্ট্যাটাস যেগুলোতে কারো কোন শারীরিক ক্ষতি বা এমন কিছুর দুরতম সম্ভাবনাও নেই সেখানে ধর্মীয় অবমাননার অজুহাতে ব্লগ ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকারিরা গ্রেফতার ও হেনস্থার স্বীকার হচ্ছে।

বিসিবিএ বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের মহান সংবিধান কোনো ব্যক্তিবিশেষকে যেমনটি নির্দিষ্ট ধর্মবিশ্বাস লালল করায় বাঁধা দেয় না, তেমনি কারো ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসেরও পালন, প্রচার এবং প্রকাশকে রূদ্ধ করে না। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে বিসিবিএ ঘৃণাভরে বলতে বাধ্য হচ্ছে, স্পষ্টতঃই সরকারের মধ্যে হেফাজতী, ধর্মান্ধ একটি অংশ প্রবল ভাবে প্রভাব বলয় সৃষ্টি করেছে। এবং এদেরই প্রত্যক্ষ উষ্কানীতে জাতির সংবিধানের রক্ষক হয়েও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মতো সংবিধানের প্রতি চরম অবমাননামূলক একটি আইন প্রণয়ন করেছে সরকার। এবং ক্রমাগত অপব্যবহারের মাধ্যমে এই আইনটিকেই ব্লাসফেমি আইনের আদলে গড়ে তুলে বাংলাদেশের পাকিস্তান যাত্রা নিশ্চিত করছে তারা।

এই অবস্থায় বাংলা কমিউনিটি ব্লগ এলায়েন্স অন্ত্যন্ত দৃঢ়ভাবে জানাতে চায় যে, ইতিমধ্যেই আমাদের পক্ষ থেকে আক্রান্ত দুই ব্লগারকে সর্বোচ্চ আইনী সহায়তা দেবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেই সাথে যে ঘৃণ্য ৫৭ ধারার অজুহাতে বারবার মুক্তমতকে দলিত করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধেও সর্বাত্মক প্রতিরোধ এবং জনসংযোগ সৃষ্টি করতে আমরা সচেষ্ট। এই প্রেক্ষিতেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নিম্নলিখিত দাবীসমূহ উপস্থাপন করা হচ্ছে-

ক) আটককৃতদের অবিলম্বে মুক্তি দিয়ে তাদের শিক্ষাজীবনের সুস্থ প্রবাহ ও পারিবারিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে
খ) আক্রমণকারী সন্ত্রাসিদের উষ্কানিদাতা, সঙ্গঠকসহ জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে প্রশাসনের যথাযথ ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে
গ) সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মচারী এবং কর্মকর্তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে
ঘ) আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল/সংশোধন করে মুক্তমতের প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে
ঙ) ভবিষ্যতে এ ধরণের ঘটনা প্রতিরোধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকরি ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে।

এছাড়াও আটককৃত ব্লগারদের মুক্তি ও নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে বিসিবিএ সচেষ্ট থাকবে এবং আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা রদকল্পে ক্রমাগত কর্মসূচি প্রদান করে যাবে বলে আমরা শতভাগ নিশ্চয়তা দিচ্ছি।

Wednesday, 7 May 2014

হত্যার উল্লাস

হত্যার উল্লাস
সারা দেশে এমনিতেই প্রতিদিন ডজন ডজন মানুষ খুন হচ্ছে, গুম হচ্ছে আরও দু’চারজন করে। সবক্ষেত্রে গুম হওয়া নাগরিকদের কোনো হদিসই মেলে না। অজ্ঞাত স্থান থেকে পাওয়া যায় অজ্ঞাত পরিচয়ের মানুষের লাশ। প্রধানত বাংলাদেশে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম এসব লাশ দাফনের আয়োজন করে। এর বাইরে আরও কোনো সংগঠন থাকতে পারে, আমার জানা নেই। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম সংগঠনটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিব শাসনকালে দুর্ভিক্ষের সময়। শেখ মুজিব সরকারের ভয়াবহ অপশাসন ও লুণ্ঠনের ফলে, ব্যাপক চোরাচালানের কারণে বাংলাদেশে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সূচনা হয়। প্রতিদিন রাস্তাঘাটে, বন-বাদাড়ে, এখানে-সেখানে ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ মৃত্যুবরণ করে। তখন আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম এসব বেওয়ারিশ লাশ দাফনের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়। তারা প্রতিদিন কাগজে বিজ্ঞপ্তি দিত যে, ঐদিন তারা কত সংখ্যক বেওয়ারিশ আদম সন্তানকে দাফন করেছে। ১৯৭৪ সালের সেই ভয়াবহ মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ তৈরি হয়েছিল রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির জন্য। ভারতের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার গবেষণায় সেটি দেখিয়েছেন। তার নোবেল পুরস্কার বিজয়ের একটি উপাদান বাংলাদেশের ১৯৭৪ সালে সংঘটিত দুর্ভিক্ষ।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় আঞ্জুমান কয়টি লাশ দাফন করলো সেটি প্রকাশের ক্ষেত্রে শেখ মুজিব সরকার কোনো বাধা দেয়নি। তবে যা মনে আছে তা হলো, শেখ মুজিব সরকার সংবাদপত্রের ওপর এই মর্মে নির্দেশ জারি করেছিল যে, কেউ দুর্ভিক্ষে মারা গেছে এ কথা লেখা যাবে না; বরং ঐ দুর্ভিক্ষে যারা মারা গেছে তাদের ক্ষেত্রে বলতে হবে, তারা মারা গেছে অপুষ্টিতে। এখন আর আঞ্জুমান প্রতিদিন তেমন বিবৃতি দেয় না কিংবা দিতে পারে না। আমরা সংবাদপত্রের চাকুরেরা যথারীতি অপুষ্টির আদেশ পালন করে গেছি। এখন অবশ্য আদেশও দিতে হয় না, সংবাদপত্রের মালিকরা নিজে থেকেই বুঝতে পারেন যে, কী তাদের লিখতে হবে, কী তারা লিখবেন না। কীভাবে তারা সরকারকে সন্তুষ্ট রাখবেন। মিডিয়া যে নিছক একটি বাণিজ্য নয়, এটি যে একটি বিশাল দায়িত্ব সেটি বোঝার মতো বিদ্যা-বুদ্ধি এখনকার মিডিয়ার মালিকদের ও তাদের নিয়োজিত কর্মচারীদের আছে বলে মনে হয় না। সাংবাদিকতা পেশা যে নিছক চাকরি নয়, এটি যে একটি বড় ধরনের সেবাÑ এটা তরুণদের বোঝাতে গলদঘর্ম হয়ে যাই।
বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতার নামে যা চলছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে তা এর আগে খুব কমই দেখা গেছে। সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা সবসময় অবিচল। আদর্শগত পার্থক্য সত্ত্বেও নীতির প্রশ্নে, সাংবাদিকতার স্বাধীনতার প্রশ্নে তারা দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। এখন নেই। ফলে সংবাদপত্রগুলোকে মালিকের স্বার্থের সংঘাতে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করতে দেখি। সেটি বেদনাদায়ক। সমষ্টির স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে। মালিকদের দস্যুতার অংশ হতে বাধ্য হচ্ছেন সাংবাদিকরা। হ্যাঁ, চাকরি দরকার। কিন্তু চাকরি রক্ষার জন্য সাংবাদিকরা এমন কি সত্তরের দশকেও এমন হীন কাজ করতে সম্মত ছিলেন না। সন্দেহ নেই, সাংবাদিকতা পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশার একটি। যারা এ পেশায় আসেন, তাদের সেটি মেনে নিয়েই আসতে হয়। এ পেশার চ্যালেঞ্জও তাই। কিন্তু কখনও কখনও এই পড়ন্ত বয়সে এ সে বেদনায় নীল হয়ে যায়। কী করছে আমার সাংবাদিক সহকর্মীরা!
পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক যখন অপহৃত হলেন, তখন আবারও এই হলুদ বা অপসাংবাদিকতার কুৎসিত দিকটা পুনরায় দেখতে পেলাম। জনস্বার্থে পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব রিজওয়ানা তার কর্মকা-ের জন্য বিশ্বব্যাপী নন্দিত ম্যাগসাসে পুরস্কার লাভ করেছেন। বাংলাদেশে এর সংখ্যা হাতেগোণা মাত্র কয়েকজন। গোটাদেশ যখন রিজওয়ানা পরিবারের পাশে দাঁড়ালো, তখনও লক্ষ্য করলাম, দু-একটি সংবাদপত্র কী কুৎসিতভাবে রিজওয়ানার চরিত্র হননের জন্য উঠেপড়ে লেগে পড়লো। সেসব সংবাদও পড়েছি। পড়ে মনে হয়েছে, সাংবাদিকতা পেশাকে আমরা কোথায় নামিয়ে এনেছি।
গত ২৭ এপ্রিল দিনে-দুপুরে নারায়ণগঞ্জ থেকে অপহৃত হলেন সেখানকার সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাত ব্যক্তি। তার অপহরণের পরপরই নজরুল ইসলামের স্ত্রী থানায় এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করেন যে, কাউন্সিলর নূর হোসেন এই অপহরণের এক নম্বর হোতা। কিন্তু দলীয়করণকৃত প্রশাসন, পুলিশ, আওয়ামী লীগের গডফাদারখ্যাত মনোনীত এমপি শামীম ওসমান প্রমুখের কারণে পুলিশ কেবলই বলেছে, ‘দেখছি’, ‘খুঁজছি’। কিন্তু নূর হোসেনকে আটক বা জিজ্ঞাসাবাদ কিংবা তার বাড়িতে কোনোরকম তল্লাশি চালায়নি। ২৮-২৯ তারিখ পর্যন্ত নূর হোসেন এলাকায় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। এই অপহরণ নিয়ে ব্যাপক সামাজিক চাপের সৃষ্টি হয়। সারা দেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। এরপর ৩০ এপ্রিল দেখা গেল, এই সাতজনেরই লাশ ভেসে উঠেছে শীতলক্ষ্যায়। একই কায়দায়, একইভাবে এই সাতজনকে একই সময়ে খুন করে অপহরণকারীরা। তাদের হাত-পা শক্ত রশি দিয়ে বাঁধা। প্রত্যেকের ঘাড়ের স্পর্শকাতর স্থানে গুরুতর আঘাত করে তারপর নাভির নিচ থেকে পেট চিরে দিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। এরপর সিলিকনের বস্তায় ২৪টি করে ইট ঢুকিয়ে সেলাই করে দেয়া হয়। পরে সেই বস্তা তাদের গায়ের সঙ্গে বেঁধে শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেয়া হয়। হত্যাকারীদের পরিকল্পনা ছিল পেট ফেড়ে দিলে লাশের পেটে গ্যাস জমবে না। ফলে লাশগুলো আর কোনোদিন ভেসে উঠবে না। নজরুল ও এডভোকেট চন্দনসহ ঐসব নিহত ব্যক্তি চিরতরে গুম হয়ে যাবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আল্লাহ তায়ালা করেন আর এক। প্রতিটি লাশই শেষ পর্যন্ত ভেসে উঠেছে।
এই গণহত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী ও মন্ত্রি¿চ্ছু ব্যক্তিরা এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের দায় এড়িয়ে তা বিএনপির কাঁধে তুলে দেয়ার চেষ্টা করে। পহেলা মে গাজীপুরের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী সংশয় প্রকাশ করেন যে, সম্ভবত বিএনপি এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে। রেলের বস্তা বস্তা টাকা চুরির হোতা বলে মন্ত্রিসভা থেকে বিতাড়িত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন যে, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানই এদেশে হত্যার রাজনীতি শুরু করেছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এতটাই হৃদয়হীন ও বিবেকহীন মানুষ (?) যে, তিনি বলে বসলেন, এই সাত হত্যাকা- বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। দুর্নীতির দায়ে মন্ত্রিসভা থেকে বিতাড়িত হাছান মাহমুদ বললেন, বিএনপি এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে। এরপর আবার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বললেন, দেশব্যাপী শোরগোল হচ্ছে বলেই খুনিদের ধরা যাচ্ছে না। শোরগোল থামলে ধরা যাবে। কেন ধরা যাচ্ছে না? তার জবাবে তিনি বললেন, নইলে খুনিরা পালিয়ে যেত না। তারা আশপাশেই থাকত আর মন্ত্রী তাদের একবারে টপ করে বেলে মাছের মতো ধরে ফেলতেন। আমি জানি না, তাকে বেওয়াকুফ বলে সম্বোধন করা যায় কিনা।
অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের চুনোপুঁটি মন্ত্রীরা পর্যন্ত এই হত্যাকা-ের দায় এড়িয়ে যেতে চাইলেন। না হয় সাতজন মানুষ খুনই হয়েছে, ১৬ কোটি লোকের দেশ। সাতজন মানুষ খুন হলে কী হয়। সেটা তো হতেই পারে। এমনই ভাব। আইনজীবীদের প্রতিবাদের দিন সেখানে গিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। নারায়ণগঞ্জে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে, এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি প্রশিক্ষিত অংশ। অপহরণের ধরন, হত্যার ধরন দেখে নিশ্চিতভাবেই মনে হয়, যারা হত্যা করেছে, তারা এ ধরনের গুপ্তহত্যায় অত্যন্ত প্রশিক্ষিত ও পারদর্শী। জনসাধারণও তাই মনে করে।
এরপর জনমতের চাপে সরকার ও তার বশংবদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কমিশনার নূর হোসেনের বাসভবনে এক লোক দেখানো অভিযানের আয়োজন করে। সেখান থেকে জব্দ করা হয় রক্তমাখা কালো কাঁচে ঘেরা একটি নীল রঙের মাইক্রোবাস। গ্রেফতার করা হয় ১৬ জনকে, তা নিয়েও রহস্যের শেষ নেই। এই ১৬ জন কারা, সেটি জানাতে অস্বীকার করে পুলিশ। এর মধ্যে নূর হোসেনের কোনো স্বজন আছে কিনা, সেটিও ‘তদন্তের স্বার্থে’ জানাতে তারা অস্বীকার করে। কোনো সাংবাদিককে প্রথমে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। পরে ঢুকতে দেয়া হলেও একতলা, দোতলার কোনো কক্ষে তাদের প্রবেশ করতে দেয়নি। আর কী আলামত পাওয়া গেছে? সেটিও ‘তদন্তের স্বার্থে’ জানাতে অস্বীকার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটি বলতেই হয় যে, এই তল্লাশিও ছিল নিতান্তই লোক দেখানো। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে সাতদিন সময় নিয়েছিল, যাতে ঘাতকরা এই ভবন থেকে হত্যাকা-ের সকল আলামত ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে পারে। এখন তো মনে হচ্ছে ঘাতকরা তা পারেনি। আর তাই সাংবাদিকদের ভেতরে যেতে দেয়া হলো না। সময় দেয়ার আরও এক কারণ হলো, হত্যায় সহযোগীরা যাতে নির্বিঘেœ পালিয়ে যেতে পারে। এই হত্যাকা-ে নূর হোসেনের সহযোগীদের দুজন ইতোমধ্যে বিদেশে পালিয়ে গেছে। একজন সিঙ্গাপুর, অপরজন ভারতে। নজরুল ইসলামের স্ত্রী আর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন তাদের টিকিটেরও নাগাল পওয়া যাচ্ছে না। ফলে এটা ধারণা করা সঙ্গত যে, প্রশাসন ও পুলিশ তাদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দিয়েছে। যেহেতু সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি, তাতে মনে হয়, এখনও যে কক্ষে হত্যাকা-টি ঘটানো হয়েছে সেখানে বিপুল আলামত পড়ে আছে। সাত-সাতটা মানুষকে তুলে নিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলার জন্য কমপক্ষে ২০/২৫ জন লোকের দরকার হয়েছে। তার জন্য প্রয়োজন হয়েছে তিন-চারটি মাইক্রোবাসের। রক্তমাখা একটি মাইক্রোবাস পাওয়া গেল, বাকিগুলো কোথায়? এসবের কোনো সদুত্তর মিলছে না। সরকার সবকিছু গোপন করার চেষ্টা করছে।
একই কা- ঘটেছিল ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারিতে বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা  হত্যাকা-ের সময়। হত্যাকারীদের সঙ্গে আলোচনার নামে হত্যাকা- শেষে হত্যাকারীদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দেয়া হয়েছিল। এমনও অভিযোগ আছে যে, হত্যাকারীদের কাউকে কাউকে বিমানে তুলে দিয়ে দেশ থেকে চলে যেতে দেয়া হয়েছিল। আর পুলিশের জানার বাইরে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির এমপি বিডিআর সদর দফতরের চারপাশের এলাকাবাসীদের বাসা খালি করে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভয়ে-আতঙ্কে অনেক মানুষ চলেও গিয়েছিল। আর সেই সুযোগে মূল ঘাতক ও হত্যার পরিকল্পনাকারীরা নির্বিঘেœ পালিয়ে যেতে  পেরেছিল।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুন নিয়ে সরকার যা করলো, তা নিষ্ঠুর, অমানবিক ও বর্বরোচিত। এরা আল্লাহ-খোদায় বিশ্বাস করে কিনাÑ জানি না। কারণ এদের ভাষায় ‘মা দুর্গা’র আশীর্বাদে শস্যের ফলন ভালো হয়। আল্লাহ-খোদাকে না মানলে না-ও মানতে পারে। তবে যাদের দৃষ্টিতে ‘মা দুর্গা’র আশীর্বাদে শস্য ভালো হয়, তারা আর যাই হোক, মুসলমান নয়। কিন্তু এদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ’।
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter