Flickr

Saturday, 23 February 2008

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস : লোক হাসানো বিতর্ক আর কতকাল

Posted by   on

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস : লোক হাসানো বিতর্ক আর কতকাল
স্বাধীনতার চারদশক ধরে আজও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং তাতে যার যতটুকু অবদান, তার স্বীকৃতি মিলেনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস দখল ও বিকৃতির উন্মত্ততা ক্ষমতার প্রশ্রয়ে আরও বিশ্রী ও বেপরোয়া দৃশ্যপট তৈরি করেছে। একই সাথে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের লড়াকু জনগণের অবদান কতটুকু তা নিরূপিত হয়নি। আর প্রতিবেশী ভারতের ভূমিকার বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নও হয়নি।

ক্ষমতার দাপটে ইতিহাসের গোটা প্রচ্ছদপট দখল করা সহজ। কিন্তু তাকে নিজেদের মানসিক বিকৃতি ও অভিলাষের মুখাপেক্ষী করে রাখা সম্ভব নয়। ইতিহাস কখনও কাউকে মহানায়কের মর্যাদায় ভূষিত করে বটে। তবে কেউ কখনও একক শক্তিতে ইতিহাসের মহানায়ক হতে পারেন না। ইতিহাসের মহানায়কের পাশে আরও অনেক কুশীলব, পাত্র-পাত্রী, সান্ত্রী থাকেন। তাদেরকে বাদ দিয়ে যদি ইতিহাস বানাতে হয়, তবে সেটা হবে স্বৈরতান্ত্রিক বিকৃতির দলিল।
১৯৭১-এর ৭ই মার্চের শেখ মুজিবের ভাষণকে যদি স্বাধীনতার কুশলী ঘোষণা বলে দাবী করা হয়, তাহলে তার আগে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন এবং স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের ঐতিহাসিক ঘটনা দুটিকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে? সম্প্রতি স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনকারী আ.স.ম আব্দুর রব এবং স্বাধীনতার ইশতেহারের আনুষ্ঠানিক উত্থাপক ও ঘোষক শাহজাহান সিরাজ দুটি আলাদা অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যদি স্বাধীনতার মহানায়ক হন, তাহলে সিরাজুল আলম খান তার নেপথ্য নায়ক।' আ স ম রবের সাথে একই অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবীর' কাদের সিদ্দিকী একই কথা বলেছেন। তবে শাহজাহান সিরাজ আরও কিছু ব্যতিক্রমধর্মী কথা বলেছেন। সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় শাহজাহান সিরাজ বলেছেন : ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বিডিআর বা অন্যকোন ধরনের ঘোষণা আমি শুনিনি। তবে ২৭ মার্চ বেলা ১১টায় জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে একটি ঘোষণা শুনতে পাই। সে ঘোষণায় বঙ্গবন্ধুর নাম না থাকায় আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। তবে এর পরে বিকেল ৩টায় আবারো জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকালে সেখানে তার কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর নাম শুনতে পাই।' [দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৪ঠা মার্চ, ২০১০]
একই অনুষ্ঠানে তৎকালীন অবিভক্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ আরো বলেছেন, ‘‘স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে কেউ কোনো মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকলে তা শোধরাতে হবে।
....... স্বাধীনতা যুদ্ধে সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা ছিল। ২ মার্চ, ১৯৭১ আ স ম রব বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম রব, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন-এই চারজনের অবদানকে স্বীকার করে নিতে হবে।
১৯৬২ সালে স্বাধীনতার ভ্রূণ হিসেবে ‘নিউক্লিয়াস' সৃষ্টি হয়। যার নেপথ্যে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তিনি ভূমিকা না রাখলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এসব কিছু স্বীকার করেই স্বাধীনতার ইতিহাস লিখতে হবে। [প্রাগুক্ত]
উল্লেখিত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একমাত্র আবদুল কুদ্দুস মাখন ছাড়া আর সবাই বেঁচে আছেন। এদের মধ্যে একমাত্র নূরে আলম সিদ্দিকী ছাড়া আর কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে নেই। তবে তাকেও তোফায়েল-রাজ্জাকদের মতো রাজনীতির সাইডলাইনে ফেলে রাখা হয়েছে। সিরাজুল আলম খান, আ স ম রব এবং শাহজাহান সিরাজরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতি পরিত্যাগ করে সিরাজুল আলম খানের ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের' স্বপ্নে গড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) রাজনীতিতে যুক্ত হন। এখান থেকেই তাদের রাজনৈতিক মত, পথ ও সংগঠন আলাদা হয়ে যায় এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ ও লক্ষ্য উদ্দেশ্যের ভিন্নতার জন্যই জাসদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য ‘থ্রেট' হয়ে দাঁড়ায়। কাদের সিদ্দিকীই একমাত্র বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক, যিনি দেশের ভেতরে থেকেই হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে সংগঠিত করে অসম সাহসিকতায় যুদ্ধ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর শেখ হাসিনা যখন স্বামী-সন্তান নিয়ে জার্মানী থেকে দিল্লী এসে ভারত সরকারের রাজঅতিথি হিসেবে স্বেচ্ছানির্বাসন গ্রহণ করে মোটামুটি নিশ্চিত জীবন খুঁজে নেন, তখন কাদের সিদ্দিকী তার আরো কিছু অসম সাহসী যোদ্ধাদের নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারত যান। সেখান থেকে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার' প্রতিশোধ নিতে বেশ কিছু সশস্ত্র অভিযানও চালান দেশের ভেতরে। তবে তদানীন্তন আওয়ামী লীগের সমর্থন না পাওয়ায় এবং ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী ও নীতি-অবস্থান পরিবর্তন হওয়ায় হতাশা ও বিবেকের দংশন নিয়ে কাদের সিদ্দিকী অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দেশে ফিরে আসেন। আওয়ামী লীগ কাদের সিদ্দিকীর অবদান অস্বীকার করেই শুধু তাদের সহজাত রাজনৈতিক সংকীর্ণতার পরিচয় দেয়নি। শেখ হাসিনা কাদের সিদ্দিকীর মতো মুক্তিযুদ্ধে কিংবদন্তীতুল্য অবদানের কুশীলবকে আওয়ামী লীগে সহ্য করতে না পেরে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। বহিষ্কৃত কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের বেয়ারা তরুণ-তুর্কদের হাতে হেনস্তাও হয়েছেন এবং এর পেছনে ‘নেত্রীর' নির্দেশনা ছিল বলে গুজব রয়েছে। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত শেখ সাহেবের ছায়াসঙ্গী ড. কামাল হোসেনও আওয়ামী লীগে টিকতে পারেননি। যদিও দিল্লী থেকে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীত্ব পদে অধিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে ড. কামালের বিশেষ ভূমিকা ছিল। শেখ হাসিনা দেশে আসার পূর্ব পর্যন্ত জোহরা তাজউদ্দীন ও ড. কামালরা দলকে সামলে রেখেছেন। তাঁরা আজ আওয়ামী লীগে নেই। জোহরা তাজউদ্দীন স্বামী হারানোর পর তাঁর পুত্র সোহেল তাজকেও ক্ষমতার আওয়ামী লীগ থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গৌরব দখলই নয়, খোদ আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কান্ডারীদেরও আওয়ামী লীগে জায়গা হয়নি। এসবই হচ্ছে সম্মিলিত রাজনৈতিক অর্জনকে কোন এক ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানানোর ফ্যাসিবাদী মানসিকতার পরিণাম।
তাজউদ্দীন আহমদের রাজনীতি কিংবা প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতের সাথে তাঁর সম্পাদিত বিতর্কিত চুক্তি সম্পাদন নিয়ে নানা বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও তাজউদ্দীনকে ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ন' মাসের ইতিহাস লেখা যাবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কোথায় রেখেছে? শেখ সাহেব নিজে তাজউদ্দীনকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করেছেন। যদিও তাঁর এটা প্রাপ্ত ছিল না। ভারত-তোষণের জন্য সেদিন শেখ সাহেবের তাজউদ্দীনকে নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ যদি সঠিক হয়ে থাকে, তবে তাঁর কন্যা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সাথে যে অসম ও বিতর্কিত চুক্তি করে বাংলাদেশের সার্বভৌম সত্তাকে ভারতের কাছে উপঢৌকন হিসেবে সমর্পণ করে এসেছেন, তাতে তো শেখ সাহেবের কবরে শুয়েও অস্বস্তিতে থাকার কথা। তাজউদ্দীন এক নাজুক মুহূর্তে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতের আশ্রিত অবস্থায় যে বিতর্কিত ও অপমানজনক চুক্তি করে ‘বিশ্বাসঘাতকতার' খেতাব অর্জন করেছেন, বাংলাদেশের সুদিনে একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হয়েও ভারতের সাথে শেখ হাসিনা তার চেয়েও ভয়ংকর ও দেশবিরোধী চুক্তি সম্পাদন করে জনগণের কাছে কীভাবে পুরস্কার চাইতে পারেন?
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে জেনারেল ওসমানীর গণ-স্বীকৃতি ইতিহাসের দলিল হিসেবে নন্দিত। কিন্তু ইদানীং আওয়ামী বলয় থেকে বলা হচ্ছে যে, জেনারেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন না। তাহলে তারা কি জেনারেল ওসমানীর জায়গায় ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের তদানীন্তন প্রধান জেনারেল অরোরাকে বসাতে চান? মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘মুজিব বাহিনী' গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সামরিক কর্ম-কৌশল নিয়ে জেনারেল ওসমানী ভিন্নমত পোষণ করে পদত্যাগপত্র পর্যন্ত লিখে রেখেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তা কার্যকর করতে পারেননি। স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী পুনর্গঠন ও সেনাপ্রধান নিয়োগের ব্যাপারে শেখ সাহেব জেনারেল ওসমানীর পরামর্শ নেননি। ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি একদলীয় বাকশাল গঠনের প্রতিবাদে আজীবন গণতন্ত্রের প্রতি কমিটেড জেনারেল ওসমানী সংসদ থেকে পদত্যাগ করে ইতিহাস তৈরি করেন। জেনারেল ওসমানীকে আওয়ামী লীগ বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দিয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ও প্রকৃত ইতিহাস পাঠের উপদেশ দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সকল মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। জেনারেল ওসমানী-তাজউদ্দীনকে বাদ দিয়ে যে ইতিহাস, সেটা কী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হবে? নাকি সেটা আওয়ামী লীগের ইতিহাস বিকৃতির দলীয় গল্প-কাহিনী হবে?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন : ‘হঠাৎ করে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। দীর্ঘদিনের প্রস্তুতিতেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল।' তবে এই দীর্ঘ প্রস্তুতিকালীন রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একা শেখ মুজিবই নায়ক বা মহানায়ক ছিলেন না। শেখ সাহেবের রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর অবদানকে অস্বীকার করে আওয়ামী লীগ একক ব্যক্তি-বন্দনার যে উপাখ্যান তৈরি করেছে, তা প্রকৃতির ধৈর্যকেও আঘাত করছে।
মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হয়েও শেখ মুজিব নিঃশঙ্কভাবে ইয়াহিয়া-টিক্কার মতো নৃশংস শত্রুশিবিরে ঢুকে পড়ার অসীম সাহস দেখিয়েছেন। আর মওলানা ভাসানীর মতো ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যবাদবিরোদী রাজনৈতিক আইকন ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানের দুরন্ত সাহস দেখিয়েছেন। যদিও ভারতে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস মওলানা ভাসানীকে ‘র'-এর গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের আওতায় ‘নজরবন্দী' হয়ে নিষ্ক্রিয় সাক্ষীগোপাল হয়ে থাকতে হয়েছিল। মওলানা ভাসানীর ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান' দাবিকে আওয়ামী লীগ প্রতিক্রিয়াশীল-হঠকারিতা হিসেবে চিহ্নিত না করে তাঁর সাথে মিলে যৌথ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারলে ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্তে শেখ সাহেবের পাকিস্তানী সামরিক জান্তার কাছে আত্মসমর্পণ করায় মিসেস ইন্দিরাগান্ধীও তাজউদ্দীনের কাছে তাঁর উষ্মা প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেছেন, যুদ্ধ ঘোষণা করে কোন সেনাপতি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে শত্রুর কাছে ধরা দিতে পারেন না। শেখ মুজিব স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দিলে একাত্তরের ২৭ মার্চ কেন দেশব্যাপী হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন? আওয়ামী লীগের কাছে এর কোন জবাব পাওয়া যায়নি। মওলানা ভাসানী বুঝেছিলেন, বাঙালির গোটা মুক্তিযুদ্ধ ভারতের কাছে জিম্মি হয়ে যেতে বসেছে। এ অবস্থায় তিনি পূর্বাহ্নেই বাংলাদেশের ভারতভুক্তি বা ভারতের স্যাটেলাইট রাষ্ট্রের পরিণতি বরণের দুর্ভোগ এড়াতে ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের' ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু কোন পক্ষই তার এ ডাকে সাড়া দেয়নি। শেষ পর্যন্ত মওলানা ভাসানীও মুক্তিযুদ্ধের ভারতীয় পরিকল্পনার ফাঁদে ধরা দিলেন। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা মওলানা ভাসানীকে ধরার অভিযান চালিয়ে সেদিন শেখ মুজিবের একক নেতৃত্ব রক্ষায় হয়তো সহযোগিতাই দিয়েছিল। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে ২৫ মার্চ '৭১-এর পূর্ব পর্যন্ত শেখ সাহেবের কয়েকদফা গোপন রাজনৈতিক আপোষ-নিত্তি সফল হলে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অভিভাবকত্বের দখলী স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারতো না। শেখ সাহেব প্রথমদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে প্রলুব্ধ হলেও পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা জেড এ ভুট্টো এবং পাঞ্জাবী সামরিক ও অসামরিক ব্যুরোক্রেসীর আচরণে শেষের দিকে ৬ দফাকেন্দ্রিক স্বাধীন বাংলাদেশের দাবিতে অনঢ় থাকেন। এ পর্যায়ে তিনি কার্যত আলোচনার টেবিলে পাকিস্তানের বিভক্তি দাবি করলে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা তার ঝুঁকি নিতে পারেননি। তবে দেশের ভেতরের অবস্থা এবং ভারতের ‘পাকিস্তান ভাঙ্গার' দীর্ঘকালীন প্রস্তুতির ক্লাইমেক্স-পর্যায়কে বিবেচনায় নিলে শেখ সাহেবের হাতে আপোষে পূর্ব পাকিস্তান তুলে দিয়ে রক্তপাত, জিল্লতি ও ভারতের ‘হাজার বছরের বদলা' নেবার পরিতৃপ্তির সাফল্য-এড়াতে পারতো। যুদ্ধের নামে পাকিস্তানী জান্তা কার্যত: ‘পূর্ব পাকিস্তানকে' পরিত্যাগ করেছেন বলে যুদ্ধকালীন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী দাবি করছেন। জেনারেল নিয়াজীর লেখা ‘দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান' বইয়ের ভাষ্য এরকমই। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া মৃত্যুর আগে আদালতের কাছে [লাহোর হাইকোর্ট] যে এফিডেভিট দাখিল করে গেছেন, তাতে জুলফিকার আলী ভুট্টোর চেয়ে শেখ মুজিবকে ‘উত্তম' পাকিস্তানী বলে উল্লেখ করেছেন। এ অর্থের পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব ভুট্টো সাহেবের বেশি। প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে কিন্তু প্রমাণ হয় না যে, আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতাপ্রাপ্তির সুযোগ নাকচ করে সশস্ত্র লড়াইয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছিল। বরং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের পাঠোদ্ধারের চূড়ান্ত রাজনৈতিক সত্য হচ্ছে এই যে, ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্রের ২৫শে মার্চের ক্র্যাকডাউন ও গণহত্যাই আওয়ামী লীগকে জনগণের নির্বাচিত দল হিসেবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বাধ্য করেছে। এই সূত্রে শেখ সাহেবের স্বাধীনতার ঘোষণার চিরকুটের ঐতিহাসিকতা তারা নিজেরাই নাকচ করে দিয়ে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষক হিসেবে ‘মেজর জিয়ার' দাবিকেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে' ‘মেজর জিয়ার' স্বাধীনতার ঘোষণাটুকু মেনে নিলে একটা অনাবশ্যক ও লজ্জাজনক বিতর্কের অবসান হতে পারে। শেখ হাসিনা শুধু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বারবার অমীমাংসিত ও বিতর্কিতই করছেন না, মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব এক ব্যক্তির যক্ষের ধন বানিয়ে আগলে রাখার বালখিল্যতায় মুক্তিযুদ্ধের অবিসম্বাদিত মহানায়ককেও বারবার বিতর্কিত করে তুলেছেন। এর ফলে ইতিহাসের অন্দরমহলে অনুসন্ধিৎসু গবেষকদের ঔৎসুক্য তৈরি হচ্ছে। এতে আওয়ামী লীগের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। মুক্তিযুদ্ধে জেনারেল জিয়া ও অন্যান্যদের অবদান মুছে ফেলার প্রতিহিংসা যতদিন চলবে, ততদিন দেশ বিভক্ত থাকবে, জনমত বিভ্রান্ত হবে এবং রাজনীতি হবে সংঘাতমুখী।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter