সংবাদপত্রকে নসিহত করার পুরনো তরীকা
তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ সম্পাদক ও সাংবাদিকদের প্রতি সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে কিছু নসিহত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভিত্তিহীন কোন সংবাদ পরিবেশন করবেন না।' তার মতে, ‘কোন কোন পত্রিকা এমন ভিত্তিহীন খবর পরিবেশন করে, যা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা সাংবাদিকদের দায়িত্ব।'
তথ্যমন্ত্রী হিসেবে এসব কথা বলা হয়তো তার দাফতরিক কাজেরই অংশ। অতীতের তথ্যমন্ত্রীরাও কম-বেশী সংবাদপত্রকে নসিহত করার ট্রাডিশন এস্তেমাল করেছেন কম-বেশি। আমরা যতোদূর জানি, বর্তমান তথ্যমন্ত্রীর সাংবাদিকতার একটা অতীত ইতিহাস আছে। সেই সুবাদে তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবেরও সদস্য। সংগত কারণেই এ ধরনের একজন ব্যক্তির তথ্যমন্ত্রী হওয়ায় পেশাজীবী সাংবাদিকদের স্বস্তি পাবার কথা। বিশেষ করে মিডিয়া বান্ধব একজন তথ্যমন্ত্রী থাকার সুবাদে মিডিয়ার সাথে তথ্যমন্ত্রণালয় তথা সরকারের একটা সুখকর সম্পর্ক তৈরি হবার প্রত্যাশা স্বাভাবিকভাবেই সঞ্চারিত হতে পারে। তবে বর্তমান সরকারের এক বছরের শাসন-সংস্কৃতি, বিশেষ করে তথ্যমন্ত্রণালয়ের দিক থেকে সংবাদপত্রের প্রতি একটা সার্বজনীন গণতান্ত্রিক ও সুষম আচরণ প্রত্যাশিত ছিল, তার বদলে নগ্ন দলবাজির বিভেদাত্মক নীতির প্রতিফলন দেখা গেছে। এটা শুধু ভিন্নমতের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ প্রদর্শনেই নয়, রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানসহ রাষ্ট্র-সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানাদিতে বিরোধীদল বা ভিন্নমতের সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ না জানানোর অশোভন আচরণেও প্রতিফলিত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকদের সাথে যতোগুলো মতবিনিময় সভা হয়েছে, তাতে বিরোধী মতের সম্পাদকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যদিও এ সরকারের আমলে অতীতের ধারাবাহিকতায় ‘তথ্য অধিকার আইন' পাস হয়েছে। এছাড়াও গণতান্ত্রিক সমাজে জনগণের নির্বাচিত সরকারের নীতি-নির্ধারকরা সাংবাদিকদের তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করতে পারেন না। ভিন্ন মতের মিডিয়ায় সরকারের কোন ক্রোড়পত্র প্রদান করা হয় না। একইভাবে সরকারি বলয়ের বাইরের মিডিয়াগুলোকে সরকারি বিজ্ঞাপন-সংকোচন নীতির ফাঁদে ফেলে এসব মিডিয়ার আর্থিক বুনিয়াদ ধ্বংস করা হচ্ছে। ভিন্নমতের মিডিয়ার প্রকাশিত রিপোর্টের বস্তুনিষ্ঠতা ও সত্যাসত্য যাচাইয়ের আগেই সরকার তার নির্বাহী ক্ষমতার দাপটে একজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে দুই ডজন মামলা দায়ের করার ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। মানহানির মামলায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সমনজারী না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও সরকারের বশংবদ না হবার কারণে এ আইন তাদের বেলায় প্রযোজ্য না করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সরকার।
তথ্যমন্ত্রী সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তার অভিভাবকত্ব কতটা পালন করছেন, সে প্রশ্ন উহ্য রেখেও আমরা বলতে চাই, তথ্যমন্ত্রী কথায় ও কাজে সাংবাদিকদের মাঝেও একটা ভেদরেখা তৈরিতে বেশ সফল হয়েছেন। প্রজাতন্ত্রের একজন শপথগ্রহণকারী মন্ত্রী যখন দলীয় রাজনৈতিক ক্যাডারের ভূমিকা নিতে উৎসাহী হয়ে উঠেন, তখন তার কাছে কেউ সংবাদিকতার বস্তুনিষ্ঠতার নসিহত শুনতে চাইবে না। অতীতেও যে সব রাজনীতিক সাংবাদিকতার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় আলোকিত করতে এসেছিলেন, তাদের প্রায় সবাই ফ্লপ করেছেন। এ ধরনের তথ্যমন্ত্রীদের কারণে বরং সংবাদপত্রের সাথে সরকারের দূরত্ব বেশি তৈরি হয়েছে।
তথ্যমন্ত্রী সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিকদের বিভক্তি ও বিভেদ নিয়েও কটাক্ষ করেছেন। তিনি বলেছেন, সাংবাদিকদের মধ্যে এত বিভক্তি সাংবাদিক সমাজের জন্য ক্ষতিকারক। তিনি সাংবাদিক সমাজে বিদ্যমান সকল ভেদাভেদ দূর করার শপথ নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। এই ইতিবাচক অবস্থানকে আমরা সাধুবাদ জানিয়েও বলতে চাই যে, মৌলিক ইস্যুতে সাংবাদিকরা বিভক্ত নন। সাংবাদিকদের মধ্যে যতোটুকু বিভক্তি দৃশ্যমান তার পেছনে রাজনীতির বিভক্তিই দায়ী। বিগত সময়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে আসলে সাংবাদিকদের একাংশ পেশাগত অবস্থান ছেড়ে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কালোব্যাজ ধারণ করে প্রতিবাদ জানানোর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সূত্রপাত করেন। এখান থেকেই সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়নের বিভক্তির সূত্রপাত এবং ঐ কালোব্যাজধারী সাংবাদিক নেতাকে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার বিদেশে প্রেস মিনিস্টার করে পাঠিয়েছিলেন। এর আগে ‘দৈনিক মিল্লাত'-- পত্রিকার প্রকাশনার ওপর স্বৈরশাসক এরশাদ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তার প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়ন সারাদেশে সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় এবং দেশব্যাপী সকল সংবাদপত্র এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করলেও আওয়ামী লীগের তদানীন্তন দলীয় ‘মুখপত্র' বাংলার বাণী ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত নাকচ করে তাদের প্রকাশনা অব্যাহত রাখে। ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত ও গঠনতন্ত্র লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে কিছু সাংবাদিক রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ইউনিয়নের বিভক্তিকে অনিবার্য করে। এসব সাংবাদিকরা বাকশাল সরকারের সংবাদপত্র নিধনে ১৬ জুনকে ‘কালো দিবস' হিসেবেও পালন করেন না। সুতরাং সাংবাদিকতার পেশাদারীত্বের চেয়ে যারা রাজনৈতিক অবস্থানকে বড়ো করে দেখেন, তাদের কাছে বিভেদই কাম্য। তবে সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ড আন্দোলন ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ইস্যুতে সাংবাদিকদের বৃহত্তর ঐক্যও দৃশ্যমান। সাংবাদিকদের রাজনৈতিক ভাড়াটে বানানোর চেষ্টা না করলে সাংবাদিকদের বিভেদ সহজেই দূর হতে পারে।
তথ্যমন্ত্রী শক্তিশালী গণতন্ত্রের দিকে ধাবিত করতে এবং সমাজের সর্বস্তরের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের মাধ্যমে একটি ভারসাম্য সমাজ গড়তে গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, গণমাধ্যমের ওপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এসব কথার বস্তুনিষ্ঠতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রক সরকার যখন বিরোধী দল নির্মূল করে একটা ভারসাম্যহীন ও নৈরাজ্যকর সমাজ তৈরি করে ফেলেছে, সেখানে মিডিয়া কোনভাবেই সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার একক দায় বহন করতে পারে না। সরকারের স্বচ্ছতা থাকলে প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার দুর্নীতি নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টের জন্য সাংবাদিককে হত্যার চেষ্টা করা এবং সম্পাদক ও রিপোর্টারের বিরুদ্ধে দুই ডজন মামলা হতে পারে না। এসব মামলা লড়তে এটর্নী জেনারেল অফিসে নগ্নভাবে লিপ্ত হয়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের একটা নমুনা প্রদর্শন করেছেন। কোন রিপোর্ট তথ্যনিষ্ঠ না হলে বা ভিত্তিহীন হলে তার প্রতিবাদ ছাপার পরও সাংবাদিকের ওপর শারীরিক আঘাত হানা এবং সম্পাদক-প্রকাশক-রিপোর্টারের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক সিরিজ মামলা করা হলে বুঝতে হবে প্রকাশিত রিপোর্টের সত্যতা আছে। যা প্রকাশিত হোক, অন্যপক্ষ তা চায় না। এ অবস্থায় বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা কে করবে? আলোচ্য বিতর্কিত রিপোর্টের বিষয়বস্তু নিয়ে সরকারের তদন্তের ফলাফল আজ পর্যন্ত মিডিয়াকে জানানো হয়নি।
এদিকে একটি সংসদীয় কমিটি সরকারের কাছে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে নয়া নিবর্তনমূলক আইন-বিধি প্রণয়নের সুপারিশ করেছেন। এ থেকে মিডিয়ার স্বাধীনতার প্রতি সরকারের মনোভাবের কিছু নমুনা পাওয়া যায়। উদ্দেশ্যমূলক ও বানোয়াট রিপোর্ট কখনও পাঠকের গ্রহণযোগ্যতা পায় না। সুতরাং মিডিয়া তার পাঠক-গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখা ও নীতিগত কারণেই বস্তুনিষ্ঠতা অনুসরণ করবে। যারা এটা করতে ব্যর্থ হবে, তারা হারিয়ে যাবে। সুতরাং সরকারের মন্ত্রীদের নসিহত ছাড়াই মিডিয়া সতর্ক ও বস্তুনিষ্ঠ- হতে বাধ্য। তবে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথে সরকারকে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। বহুমাত্রিক গণতান্ত্রিক দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কারো দয়ার দান নয়। এটা সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক সমাজের অর্জন।
তথ্যমন্ত্রী হিসেবে এসব কথা বলা হয়তো তার দাফতরিক কাজেরই অংশ। অতীতের তথ্যমন্ত্রীরাও কম-বেশী সংবাদপত্রকে নসিহত করার ট্রাডিশন এস্তেমাল করেছেন কম-বেশি। আমরা যতোদূর জানি, বর্তমান তথ্যমন্ত্রীর সাংবাদিকতার একটা অতীত ইতিহাস আছে। সেই সুবাদে তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবেরও সদস্য। সংগত কারণেই এ ধরনের একজন ব্যক্তির তথ্যমন্ত্রী হওয়ায় পেশাজীবী সাংবাদিকদের স্বস্তি পাবার কথা। বিশেষ করে মিডিয়া বান্ধব একজন তথ্যমন্ত্রী থাকার সুবাদে মিডিয়ার সাথে তথ্যমন্ত্রণালয় তথা সরকারের একটা সুখকর সম্পর্ক তৈরি হবার প্রত্যাশা স্বাভাবিকভাবেই সঞ্চারিত হতে পারে। তবে বর্তমান সরকারের এক বছরের শাসন-সংস্কৃতি, বিশেষ করে তথ্যমন্ত্রণালয়ের দিক থেকে সংবাদপত্রের প্রতি একটা সার্বজনীন গণতান্ত্রিক ও সুষম আচরণ প্রত্যাশিত ছিল, তার বদলে নগ্ন দলবাজির বিভেদাত্মক নীতির প্রতিফলন দেখা গেছে। এটা শুধু ভিন্নমতের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ প্রদর্শনেই নয়, রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানসহ রাষ্ট্র-সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানাদিতে বিরোধীদল বা ভিন্নমতের সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ না জানানোর অশোভন আচরণেও প্রতিফলিত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকদের সাথে যতোগুলো মতবিনিময় সভা হয়েছে, তাতে বিরোধী মতের সম্পাদকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যদিও এ সরকারের আমলে অতীতের ধারাবাহিকতায় ‘তথ্য অধিকার আইন' পাস হয়েছে। এছাড়াও গণতান্ত্রিক সমাজে জনগণের নির্বাচিত সরকারের নীতি-নির্ধারকরা সাংবাদিকদের তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করতে পারেন না। ভিন্ন মতের মিডিয়ায় সরকারের কোন ক্রোড়পত্র প্রদান করা হয় না। একইভাবে সরকারি বলয়ের বাইরের মিডিয়াগুলোকে সরকারি বিজ্ঞাপন-সংকোচন নীতির ফাঁদে ফেলে এসব মিডিয়ার আর্থিক বুনিয়াদ ধ্বংস করা হচ্ছে। ভিন্নমতের মিডিয়ার প্রকাশিত রিপোর্টের বস্তুনিষ্ঠতা ও সত্যাসত্য যাচাইয়ের আগেই সরকার তার নির্বাহী ক্ষমতার দাপটে একজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে দুই ডজন মামলা দায়ের করার ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। মানহানির মামলায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সমনজারী না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও সরকারের বশংবদ না হবার কারণে এ আইন তাদের বেলায় প্রযোজ্য না করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সরকার।
তথ্যমন্ত্রী সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তার অভিভাবকত্ব কতটা পালন করছেন, সে প্রশ্ন উহ্য রেখেও আমরা বলতে চাই, তথ্যমন্ত্রী কথায় ও কাজে সাংবাদিকদের মাঝেও একটা ভেদরেখা তৈরিতে বেশ সফল হয়েছেন। প্রজাতন্ত্রের একজন শপথগ্রহণকারী মন্ত্রী যখন দলীয় রাজনৈতিক ক্যাডারের ভূমিকা নিতে উৎসাহী হয়ে উঠেন, তখন তার কাছে কেউ সংবাদিকতার বস্তুনিষ্ঠতার নসিহত শুনতে চাইবে না। অতীতেও যে সব রাজনীতিক সাংবাদিকতার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় আলোকিত করতে এসেছিলেন, তাদের প্রায় সবাই ফ্লপ করেছেন। এ ধরনের তথ্যমন্ত্রীদের কারণে বরং সংবাদপত্রের সাথে সরকারের দূরত্ব বেশি তৈরি হয়েছে।
তথ্যমন্ত্রী সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিকদের বিভক্তি ও বিভেদ নিয়েও কটাক্ষ করেছেন। তিনি বলেছেন, সাংবাদিকদের মধ্যে এত বিভক্তি সাংবাদিক সমাজের জন্য ক্ষতিকারক। তিনি সাংবাদিক সমাজে বিদ্যমান সকল ভেদাভেদ দূর করার শপথ নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। এই ইতিবাচক অবস্থানকে আমরা সাধুবাদ জানিয়েও বলতে চাই যে, মৌলিক ইস্যুতে সাংবাদিকরা বিভক্ত নন। সাংবাদিকদের মধ্যে যতোটুকু বিভক্তি দৃশ্যমান তার পেছনে রাজনীতির বিভক্তিই দায়ী। বিগত সময়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে আসলে সাংবাদিকদের একাংশ পেশাগত অবস্থান ছেড়ে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কালোব্যাজ ধারণ করে প্রতিবাদ জানানোর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সূত্রপাত করেন। এখান থেকেই সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়নের বিভক্তির সূত্রপাত এবং ঐ কালোব্যাজধারী সাংবাদিক নেতাকে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার বিদেশে প্রেস মিনিস্টার করে পাঠিয়েছিলেন। এর আগে ‘দৈনিক মিল্লাত'-- পত্রিকার প্রকাশনার ওপর স্বৈরশাসক এরশাদ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তার প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়ন সারাদেশে সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় এবং দেশব্যাপী সকল সংবাদপত্র এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করলেও আওয়ামী লীগের তদানীন্তন দলীয় ‘মুখপত্র' বাংলার বাণী ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত নাকচ করে তাদের প্রকাশনা অব্যাহত রাখে। ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত ও গঠনতন্ত্র লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে কিছু সাংবাদিক রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ইউনিয়নের বিভক্তিকে অনিবার্য করে। এসব সাংবাদিকরা বাকশাল সরকারের সংবাদপত্র নিধনে ১৬ জুনকে ‘কালো দিবস' হিসেবেও পালন করেন না। সুতরাং সাংবাদিকতার পেশাদারীত্বের চেয়ে যারা রাজনৈতিক অবস্থানকে বড়ো করে দেখেন, তাদের কাছে বিভেদই কাম্য। তবে সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ড আন্দোলন ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ইস্যুতে সাংবাদিকদের বৃহত্তর ঐক্যও দৃশ্যমান। সাংবাদিকদের রাজনৈতিক ভাড়াটে বানানোর চেষ্টা না করলে সাংবাদিকদের বিভেদ সহজেই দূর হতে পারে।
তথ্যমন্ত্রী শক্তিশালী গণতন্ত্রের দিকে ধাবিত করতে এবং সমাজের সর্বস্তরের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের মাধ্যমে একটি ভারসাম্য সমাজ গড়তে গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, গণমাধ্যমের ওপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এসব কথার বস্তুনিষ্ঠতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রক সরকার যখন বিরোধী দল নির্মূল করে একটা ভারসাম্যহীন ও নৈরাজ্যকর সমাজ তৈরি করে ফেলেছে, সেখানে মিডিয়া কোনভাবেই সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার একক দায় বহন করতে পারে না। সরকারের স্বচ্ছতা থাকলে প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার দুর্নীতি নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টের জন্য সাংবাদিককে হত্যার চেষ্টা করা এবং সম্পাদক ও রিপোর্টারের বিরুদ্ধে দুই ডজন মামলা হতে পারে না। এসব মামলা লড়তে এটর্নী জেনারেল অফিসে নগ্নভাবে লিপ্ত হয়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের একটা নমুনা প্রদর্শন করেছেন। কোন রিপোর্ট তথ্যনিষ্ঠ না হলে বা ভিত্তিহীন হলে তার প্রতিবাদ ছাপার পরও সাংবাদিকের ওপর শারীরিক আঘাত হানা এবং সম্পাদক-প্রকাশক-রিপোর্টারের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক সিরিজ মামলা করা হলে বুঝতে হবে প্রকাশিত রিপোর্টের সত্যতা আছে। যা প্রকাশিত হোক, অন্যপক্ষ তা চায় না। এ অবস্থায় বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা কে করবে? আলোচ্য বিতর্কিত রিপোর্টের বিষয়বস্তু নিয়ে সরকারের তদন্তের ফলাফল আজ পর্যন্ত মিডিয়াকে জানানো হয়নি।
এদিকে একটি সংসদীয় কমিটি সরকারের কাছে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে নয়া নিবর্তনমূলক আইন-বিধি প্রণয়নের সুপারিশ করেছেন। এ থেকে মিডিয়ার স্বাধীনতার প্রতি সরকারের মনোভাবের কিছু নমুনা পাওয়া যায়। উদ্দেশ্যমূলক ও বানোয়াট রিপোর্ট কখনও পাঠকের গ্রহণযোগ্যতা পায় না। সুতরাং মিডিয়া তার পাঠক-গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখা ও নীতিগত কারণেই বস্তুনিষ্ঠতা অনুসরণ করবে। যারা এটা করতে ব্যর্থ হবে, তারা হারিয়ে যাবে। সুতরাং সরকারের মন্ত্রীদের নসিহত ছাড়াই মিডিয়া সতর্ক ও বস্তুনিষ্ঠ- হতে বাধ্য। তবে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথে সরকারকে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। বহুমাত্রিক গণতান্ত্রিক দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কারো দয়ার দান নয়। এটা সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক সমাজের অর্জন।