Flickr

Tuesday, 12 July 2011

বিচার বিভাগের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ

Posted by   on

বিচার বিভাগের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ এবং বিতর্কিত বিচারক নিয়োগের প্রতিবাদে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আহূত ‘গণ-অবস্থান' কর্মসূচি গত বুধবার ঢাকায় অভাবনীয় সাফল্যের সাথে সমাপ্ত হয়েছে। এ কর্মসূচি পালনের মধ্যদিয়ে বিরোধীদলীয় রাজনীতিতে আর এটি বড় ধরনের রাজনৈতিক জাগরণ দৃশ্যমান হয়েছে। বিএনপি-র আহূত আসছে ২৭ জুন দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা ঘোষিত হরতালের প্রতি জামায়াতে ইসলামীসহ চারদলীয় জোটের অংশীদার দলসমূহ এবং দেশের সকল জাতীয়তাবাদী ইসলামী শক্তিসমূহ ইতোমধ্যেই সমর্থন ব্যক্ত করেছে। হরতালের কর্মসূচি ঘোষণার সময় বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেছিলেন, এ কর্মসূচি সরকারের জন্য সতর্ক সংকেত। সরকারের আচরণের ওপর নির্ভর করবে ভবিষ্যতে বিরোধী দলের আন্দোলনের কর্মসূচির প্রকৃতি ও প্রক্রিয়া কেমন হবে। হরতাল-পূর্ব কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত বুধবার ঢাকায় বিরোধী দল ও তার সহযোগী দলগুলো গণ-অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। এ উপলক্ষে সমাবেশে বিরোধী দলীয় নেত্রী ঘোষণা করেছেন, সরকারের দিক থেকে আঘাত আসলে পাল্টা আঘাত হানা হবে।
উল্লেখ্য, আসন্ন হরতালসহ বিরোধী দলের ভবিষ্যৎ আন্দোলন দুর্বল ও বানচাল করতেই সরকার সম্প্রতি ‘দৈনিক আমার দেশ' এর ডিক্লারেশন বাতিল করেছে, সম্পাদককে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশী রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে এবং পত্রিকার বেশ কিছু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এদিকে সরকারি দল সংসদকে একটি একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক মঞ্চ হিসেবে গড়ে তোলায় বিরোধী দল সংসদের বাইরে সাংবাদিক সম্মেলন করে একটি বিকল্প বাজেট পেশ করেছে। সরকারি দল একে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে একটি জনকল্যাণমুখী সমন্বিত বাজেট তৈরির সুযোগকে কাজে না লাগিয়ে রাজনৈতিক বাহাস শুরু করেছে। সরকারি দলের কোন কোন সংসদ সদস্য সংসদের বাইরে বিরোধী দলীয় নেত্রীর বাজেটভাবনা পেশ করাকে সংবিধান লঙ্ঘন বলে বর্ণনা করেছেন। অথচ গণতান্ত্রিক সমাজে এটাই শোভন ও শুদ্ধরীতি। কেননা মিডিয়া হচ্ছে জনগণের পার্লামেন্ট এবং মিডিয়া গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত। সরকারি দল গণতান্ত্রিক সমাজে মিডিয়ার চিরন্তন ভূমিকা দেখতে চায় না বলেই অকার্যকর ও একদলীয় সংসদে গিয়ে বিরোধী দলকে বাজেট-ভাবনা পেশ করার ভাঁওতাবাজির আহবান জানাচ্ছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে বিরোধী দলের বাজেট-প্রস্তাবনা পর্যালোচনায় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে তাদের সুপারিশ বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে সমন্বিত বাজেট তৈরি করতে পারতো। কিন্তু দেশী-বিদেশী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর সাথে সরকারের গাঁটছড়া বাঁধার কারণে তারা প্রস্তাবিত বাজেট প্যাকেট থেকে সরে এসে বিরোধী দলের সুপারিশকে আত্মস্থ করতে পারছে না।
এদিকে বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ এবং বিতর্কিত বিচারক নিয়োগের প্রতিবাদে সম্মিলিত বিরোধী দলের গণ-অবস্থান কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি সরকার বিচার বিভাগসহ বিচারিক প্রক্রিয়াকে দলীয়করণের কলংকজনক ইতিহাস তৈরিতে চ্যাম্পিয়ান হতে চলেছে। অতীতেও আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখন তারা বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপসহ সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ এবং সাংবাদিক নির্যাতনকে তাদের ফ্যাসীবাদী রাজনীতির অনুপান হিসেবে ব্যবহার করেছে। ১৯৭৫-এর একদলীয় বাকশাল গঠন করে বিচারবিভাগকে কার্যত: দলের শাখা সংগঠনে পরিণত করা হয়েছিল। বিচার বিভাগের স্বাধীন-সার্বভৌম সত্তাকে একদলীয় ফ্যাসীবাদী ক্ষমতার উদরে বিলীন করে দেয়া হয়েছিল। ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা বিচারপতিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে রাজপথে লাঠিমিছিল পর্যন্ত বের করেছিল। বস্তি উচ্ছেদ সংক্রান্ত হাইকোর্টের বিচারিক রায়ের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর নির্দেশনায় সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে বস্তি বসানোর মতো ঔদ্ধত্যও তারা দেখিয়েছিলেন। বিচার নিত্তিতে হাইকোর্টের বিচারকদের ‘বিব্রত' হবার ঘটনা নিয়ে তারা বিচারকদের বিরুদ্ধে হুমকি ও হয়রানিমূলক কর্মসূচি নিয়েছে। আওয়ামী ঘরানার আইনজীবীদের উস্কানি দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে বিচারিক পরিবেশ বিঘ্নিত করা হয়। বিচারকদের জামিন দানের এখতিয়ারে হস্তক্ষেপসহ তাদের ওপর প্রশাসনিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। দলীয় ফ্যাসীবাদী নৈরাজ্যের কাছে বিচার বিভাগকে নতি স্বীকার করতে আওয়ামী আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির কক্ষের ওপর লাথি মারাসহ অবমাননাকর কার্যক্রম চালিয়েছেন। এসব আইনজীবীদের বিরুদ্ধে চলমান মামলা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। আদালতে মাস্তানী করা এসব আইনজীবী-বিচারবিভাগের বিরুদ্ধে অবমাননাকর ভূমিকা নিয়েও দলীয় বিবেচনায় শাস্তি বা মুচলেকা ছাড়াই মুক্তি পেয়েছেন।
এবারে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসন নিয়ে আওয়ামী লীগ মহাজোট ক্ষমতায় এসে বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণে সরাসরি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়ংকর থাবা বিস্তার করে। কার্যত: বিগত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে বিচার বিভাগকে বন্দুকের নলের মাথায় অশুভ কাজে এবং রাজনীতিক-ব্যবসায়িক-নাগরিকদের নির্যাতনে ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমানে নির্বাচিত সরকার বিচার বিভাগকে তার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কাজে নগ্নভাবে ব্যবহার করে সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের রেকর্ড অতিক্রম করেছে।
বর্তমান সরকার তার এটর্নী জেনারেলের অফিস এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে বিচারপতিদের ওপর প্রভাব বিস্তার ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে বিচার-প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। সরকারের পক্ষে এটর্নী জেনারেলের অফিসের আইনী প্রক্রিয়া ও আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে প্রকাশ্য এজলাশে হাইকোর্ট বন্ধ করে দেবার কথা বলেছেন। বিচার বিভাগের বর্তমান দুর্গতি দেখে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি দুঃখ করে বলেছেন: ‘‘বিচার বিভাগ কাচের ঘরে বন্দী হয়ে আছে।’’
এদিকে সরকার বিচার বিভাগকে ফ্যাসীবাদী রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে অযোগ্য, বিতর্কিত ও মামলার আসামীদেরও বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বিচার বিভাগের মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সম্প্রতি উচ্চআদালত সরকারের প্রতি রুল জারী করে বিচারক নিয়োগের নীতিমালা সম্পর্কে সরকারের অবস্থান জানতে চেয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের একটি ঐতিহাসিক রায়ের ভিত্তিতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং বিচারবিভাগকে প্রশাসন তথা নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসীবাদী আচরণে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হতে বসেছে। ম্যাজিস্ট্রেসী আদালতগুলোকেও মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুযায়ী স্বাধীন ও বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোকে সরকার তার রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। মিথ্যা-বানোয়াট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা মামলায় যাকে তাকে গ্রেফতার এবং দফায় দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সহায়তা করাই যেন নিম্নআদালতের ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে প্রমাণ করা হচ্ছে যে, উচ্চআদালতের কোন নিয়ন্ত্রণ নিম্নআদালতে কার্যকর নেই। বরং সরকারই তার পুলিশী নির্যাতন ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থে ম্যাজিস্ট্রেসী আদালতগুলোকে ব্যবহার করছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়া দুরূহ হয়ে উঠেছে।
বিচারিক প্রক্রিয়াকে সরকার দলীয় বিবেচনায় কত নোংরাভাবে প্রভাবিত করছে, তার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে, বিগত সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক যেসব মামলায় সকল রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের জব্দ করা হয়েছিল, ঐসব মামলা থেকে বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রী-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো চালু রেখে সরকার দলীয় নেতা-নেত্রী-কর্মীদের প্রায় সকল মামলা ঢালাওভাবে ক্ষমতার জোরে তুলে নেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত তারা ১,৭৪৬টি মামলা প্রত্যাহার করে দিয়েছে, যার মধ্যে বিরোধীদলের মাত্র ২টি মামলা রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী সবকটি মামলা থেকে মুক্ত হয়েছেন। কিন্তু একই সময়ে ও প্রক্রিয়ায় দায়ের করা বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পুরনো মামলা ছাড়াও নতুন নতুন মামলা দেয়া হচ্ছে। জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা সাজানোর পাঁয়তারা চলছে। বিচার প্রক্রিয়া ও বিচার বিভাগের ওপর সরকারের অব্যাহত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নাগরিকদের ন্যায়বিচার পাবার সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেবার অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এটাই ফ্যাসীবাদী রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নমুনা। সরকারের এই হিংস্র ও নিপীড়নকারী-ফ্যাসীবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে একটি প্রবাহে, একই কেন্দ্রবিন্দুতে মিলিত হবার মধ্য দিয়েই বিচারবিভাগের স্বাধীনতাসহ নাগরিক অধিকার পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter