বিদেশী আইনজীবীদের এত ভয় কেন?
আমার পাশের বাড়ির ভদ্রলোক আমার সাথে জমির সীমানা নির্ধারণের সময় অত্যন্ত ভদ্র ও নরম কণ্ঠে বলেছিলেন ‘‘আপনি আর আমি থাকলেই হবে অন্যলোকের কি দরকার’’ আমি সরল মনে তাকে ভদ্রলোক মনে করে একমত হলাম। পরে দেখি লোকটি চতুরতার সাথে আমার জমির মধ্যে বেশ খানিকটা ঢুকে গেছেন। অর্থাৎ আমার বেশ খানিকটা জায়গা হজম করে ফেলেছেন। আমার সরলতাকে দুর্বলতা ভেবে চতুরতার সাথেই কাজটি করেছেন। দুদিন পরেই এলাকার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি আমাকে বললেন, একি? আপনার জায়গায় উনি ঢুকে পড়েছেন। পরে অবশ্য আমার অংশ দখল পেয়েছি। কথাগুলো বললাম এজন্য যে, যারা সমাজ সচেতন এবং বিজ্ঞ ব্যক্তি তারা যদি ফয়সালা করেন তাহলে দুর্বল লোকেরা সঠিক বিচারটা পায়। বর্তমান সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল তথা ক্ষমতায় চিরদিন থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে। তারা জানে সরকারের অন্যায় ও অনৈতিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম আর আন্দোলন কারা করতে পারে। এরশাদ সরকারের সময় জনাব এরশাদ বিদেশ সফরে যাওয়ার সময় বিমান বন্দরে সাংবাদিকগণ জিজ্ঞেস করেছিল আপনি বিরোধীদলের আন্দোলনকে ভয় পান কি না? উত্তরে জনাব এরশাদ বলেছিলেন ‘‘কেবল জামায়াতকে ভয় পাই’’। সত্যি কথাটাই বলেছিলেন সাবেক এ রাষ্ট্রপতি। জামায়াত যে কি জিনিস তিনি তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা এ দেশবাসী জানে। জামায়াতের প্রশংসা করতে গিয়ে জনাব এরশাদ বলেন, ‘‘জামায়াত একটি সুশৃক্মখল দল। জনাব আববাস আলী খানের জানাযায় গিয়ে আমি দেখেছি, মাওলানা নিজামী যখন বললেন, আপনারা দুপা পিছনে যান অমনি সবাই পিছনে চলে গেলেন, মনে হল যেন কোন সেনাবাহিনীর কমান্ডার নির্দেশ দিচ্ছেন’’ কথাগুলো জনাব এরশাদ বলেছিলেন আল-ফালাহ মিলনায়তনে, আববাস আলী খান (র.) এর দোয়া অনুষ্ঠানে। উপরোক্ত কথাগুলো বললাম এজন্য যে, জনাব এরশাদ যে জামায়াতকে চিনেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি সে জামায়াতকে চিনতে পারেননি? চিনেছেন। আর চিনেছেন বলেই জামায়াতকে কোণঠাসা করে রেখে ক্ষমতায় থাকতে চান। এ দলের শীর্ষ নেতাদের উপর নির্যাতনের পর নির্যাতন করে যাচ্ছেন। জামায়াত নেতাদের সাথে আলোচনা করে দেখা গেছে তারা আইনের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল, তাই তারা সবকিছুকেই আইনের মাধ্যমে এবং নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে মোকাবিলা করতে চান। এদেশের বর্তমান সরকারের সাজানো ট্রাইব্যুনালে যেন জুলুমের শিকার হতে না হয় সে জন্য তারা প্রয়োজনে বিদেশী আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন এটা তাদের যেমন মৌলিক অধিকার তেমনি বিচার আন্তর্জাতিক মানের হওয়ার জন্যেও জরুরি। আন্তর্জাতিক মানের বিচার হবে আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পর্যবেক্ষক থাকবেন না, আন্তর্জাতিক মানের আইনজীবী নিয়োগ দেয়া যাবে না, কেবল আমাদের শাসকগোষ্ঠী নিজেদের মতো করে বিচার মঞ্চ তৈরি করবে তাই সবাইকে আন্তর্জাতিক মানের বিচার বলে মেনে নিতে হবে বিষয়টি কি এমনই? ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও চিটাগাং হিলট্রাক্টস কমিশনের কো-চেয়ারম্যান লর্ড এরিক অ্যাভেবুরি আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদকে বলেছেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে সম্পূর্ণরূপে অনীহা প্রকাশ করেছে। ট্রাইব্যুনাল যদি নিজেদের দেশীয় বিচার ব্যবস্থার একটি অঙ্গ মনে করেন তবে তাদের দেশীয় আইন মেনে চলা উচিত। আর যদি তারা এটাকে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল মনে করেন তাহলে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা উচিত। কিন্তু তারা এ দুটির একটির মধ্যেও নেই।’’ লর্ড এরিক আরো অনেক কথা বলেছেন, অনেক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। সমস্যা হলো আওয়ামী লীগ তো পারলে লর্ড এরিককে জামায়াতে ইসলামীর রুকন বানিয়ে ফেলবে। কারণ তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে হয় দেশদ্রোহী, না হয় রাজাকার অথবা জঙ্গি কিংবা স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী। প্রশ্ন হলো, একজন আসামী তার আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবে না এটা কেমন জুলুম? লর্ড এরিক যথার্থই বলেছেন, ট্রাইব্যুনাল যদি তাদেরকে দেশীয় আদালতের একটি অংশ মনে করে তাহলে দেশের আইন মানতে হবে আর যদি নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইব্যুনাল মনে করে তবে আন্তর্জাতিক আইন মানতে হবে। অথচ তারা কোনটার ধার ধারছে না। গায়ের জোরে আর সংখ্যাগরিষ্ঠতার অহংকারে যেন কিছুই মানতে চাইছে না। বিদেশী আইনজীবীকে এতো ভয় কেন? তবে কি সরকারের সকল প্রকার বেআইনি তৎপরতা বিদেশীরা জেনে ফেলবে তাই? আজ না জানুক কাল জানবে কোন কিছু কি গোপন থাকার কথা? জামায়াতের মতো একটি দেশপ্রেমিক সুশৃক্মখল দলের শীর্ষ নেতাদের সাথে এ আচরণ এর কি কোন প্রতিকার হবে না? দলটির প্রথিতযশা নেতারা আজ কারাগারে। আর তাদের পক্ষে বলিষ্ঠভাবে যদি কথা বলা হয় ঐ নেতাকেই টার্গেট করে সরকার কিভাবে তাকে দমানো যায়? হয় গাড়ি ভাঙ্গার মামলা অথবা গ্রেনেড হামলা কিংবা রাষ্ট্রপতির গাড়ি বহরে বাধাদান, আরো আছে পুলিশের কাজে বাধাদান, জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া কত কি। শোনা যাচ্ছে, আগামীতে নাকি মোবাইল চুরি, সরকারের সমালোচনা, রাষ্ট্রপতির সমালোচনা ইত্যাদি কারণেও মামলা দেয়া হবে। জামায়াতের এক নেতা ডাঃ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের এক বক্তৃতায় সরকারের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। এতো ভয় যাদের ভিতর তারা সাঈদী-নিজামীর মতো মহান ব্যক্তিত্বের সাথে এ ন্যক্কারজনক আচরণ করে কি করে? তা অনেক বিশ্লেষকেরই নাকি বুঝে আসে না। এমন একটি দলের লাখ লাখ কর্মী বেঁচে থাকতে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর কিছু হবে আর তারা ঘরে বসে থাকবে বিষয়টা কি এমন? এ ধরনের কথাই মনে হয় ডা. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছিলেন। এর অর্থ কি সরকারকে হুমকি দেয়া? এটা একটা সাধারণ কথা ‘‘যদি অন্যায়ভাবে নিজেদের ইচ্ছে মতো আইন শানিয়ে দেশের বরেণ্য আলেমদের ওপর কোন নির্যাতন চালানো হয় তাহলে জামায়াত-শিবিরের কয়েক লক্ষ নেতাকর্মী বসে থাকবে না।’’ এমন কথার অর্থইকি কাউকে মেরে ফেলার হুমকি? বাংলা ব্যাকরণ অধ্যয়ন করলে কি তাই অনুভব হয়? না এর অর্থ নেতার জন্য দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবো। প্রয়োজনে নিজেদের জীবন ও সম্পদের সর্বোচ্চ কুরবানী দিবো এমনটি বুঝায়? আর জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের জন্য তো এটা খুবই স্বাভাবিক। যারা নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আন্দোলন করে তাদের দ্বারা কোন অন্যায় তো প্রশ্নই আসে না তবে ন্যায়সঙ্গতভাবে তারা সব কিছু ত্যাগ করতে পারবে। অতএব আন্তর্জাতিক আইন মেনে আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইব্যুনাল করে যেকোন অপরাধীদের বিচার করার ক্ষেত্রে জামায়াতের কোন আপত্তি নেই বলে তারা বলে যাচ্ছেন। সরকার কেন এদিকে যাচ্ছে না? আন্তর্জাতিক মান কি জামায়াতের পকেটে? বিশ্ববিবেক কি একচেটিয়া জামায়াতের দখলে? বিদেশীরা জামায়াতের বন্ধু আর সরকারের শত্রু? যদি নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচার সরকার চায় তবে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে সমস্যা কোথায়? আর আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখলেই তো আসামী পক্ষকে প্রয়োজনে বিদেশী আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার সুযোগ দিতে হবে। সরকার কেন তা চাচ্ছে না ভয়টা কোথায়?
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জামায়াতের নেতাদের নির্যাতনে যত অর্থ ও সময় ব্যয় আর অপকৌশল চালিয়েছে তার কিঞ্চিৎ যদি দেশের জনগণের দুর্দশা লাঘবে ব্যয় করতো তাহলে দেশের জনগণের কত উপকার হতো। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, আইন-শৃক্মখলা, দ্রব্যমূল্যের পাগলাঘোড়া, চুরি, ডাকাতি, অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা, দুর্ঘটনা এগুলো এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যেন মানুষ আজ দিশেহারা অথচ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী এমনভাবে কথা বলছে মনে হয় তারা জান্নাতের মধ্যে বসবাস করছে। করবেই তো কারণ তারা যে রঙিন চশমা পরে সবকিছু দেখে- সবুজ অথবা জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে বিরোধীদের সবকিছুতে দুর্গন্ধ অনুভব করে। সরকারকে দেশের অভ্যন্তরে শান্তি-শৃক্মখলা বজায় রাখার জন্য দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে অন্যথায় দেশের মধ্যে কোন অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে এর দায়-দায়িত্ব কোনভাবেই সরকার এড়াতে পারবে না বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণের মত। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে।