জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ
বছরের অন্যতম ঋতু বর্ষা চলছে। এরই মধ্যে টানা ও ছাড়া ছাড়া বৃষ্টিপাতে রাজধানী ঢাকা মহানগরীসহ সারাদেশের অধিকাংশ এলাকায়ই সৃষ্টি হয়েছে প্রকট জলাবদ্ধতার। রাজধানী ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতার সমস্যাটি অনেক পুরনো এবং অনেকটা যেন দুরারোগ্য ও নিরাময়ের অযোগ্য ব্যাধির মতো। ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালে ঢাকা মহানগর পানিতে ৯ দিন তলিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্ন, এরপরও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ তথা সরকারের টনক নড়েনি কেন? গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে রাজধানী ঢাকা মহানগরীর বেশিরভাগ এলাকায় মারাত্মক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়ার কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে। এর ফলে সর্ব সাধারণের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে হয়েছে ব্যাহত। রিকশাসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল হয়েছে বিঘ্নিত। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারেনি। অফিস-আদালত-ব্যাংক-বীমার স্বাভাবিক কাজকর্ম হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। রাস্তায় নজিরবিহীন যানজটে জনদুর্ভোগ উঠেছে চরমে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় সীমাহীন দুর্গতি হয়েছে লাখ লাখ বস্তিবাসীর। লাখ লাখ খেটে খাওয়া মানুষ কাজের সন্ধানে বেরুতে পারেনি। হাট-বাজারে বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অসংখ্য মানুষকে অনাহারে থাকতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এর অর্থ দাঁড়ায় একটাই- আধুনিক যুগে এসেও আমরা নিজেদের স্বাভাবিক বর্ষা ও বৃষ্টির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারিনি। বরং সর্বতোভাবেই ব্যর্থ হয়েছি। এ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে কী?
সুষ্ঠু ও সমন্বিত পয়ঃনিষ্কাশন ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা যেকোনো আধুনিক নগর স্থাপত্যবিদ্যা ও পরিকাঠামোর জন্য অবশ্য পালনীয় শর্ত। সত্যি কথা হলো, দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্র পরিচালকরা এবং তাদের আজ্ঞাবহ প্রজাতন্ত্রের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল আমলারা মিলে ৪০ বছর ধরে একটি আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার জন্য কোনো মাস্টারপ্ল্যান কিংবা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেননি। ঢাকা ওয়াসার হিসাবেই এক সময় প্রবহমান ছোট-বড় ৫৩টি খাল বিলীন বা বেদখল হয়ে গেছে। সরকারের অসংখ্য সংস্থার চোখের সামনে প্রতিদিন নতুন নতুন বহুতল ভবন, স্থাপনা ও হাউজিং কোম্পানিগুলোর অসংখ্য আবাসিক ভবন গড়ে উঠছে। কোনো সন্দেহ নেই, এটি একটি আধুনিক নগর উন্নয়নের ভিত্তিকেই চিহ্নিত করে। তবে সেটি কোনো অবস্থাতেই একটি পরিকল্পিত নগর গড়ে তোলার ইঙ্গিত বহন করে না। রাজধানী ঢাকা এখন ইট-বালি-সিমেন্ট-পাথর মিশ্রিত লাখ লাখ দালান-কোঠা শোভিত একটি বিশাল মহানগর হিসেবে গড়ে উঠলেও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা তথা বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, পয়ঃনিষ্কাশন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা ইত্যাদি পরিকাঠামোর দিক থেকে বলা যায় রয়ে গেছে প্রায় মান্ধাতা আমলেই। মহানগরীর খালগুলোর একে একে ভূমিদস্যুদের দখলে চলে গেছে। যে দু'চারটি এখনো টিকে আছে, সেগুলো শুধু নামেই খাল। অথচ সেগুলো উদ্ধারের নামে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার ভূগর্ভস্থ নর্দমা ও ডিসিসি'র ভূউপরিস্থিত ড্রেন মিলিয়ে পানি নিষ্কাশনের লাইন মাত্র আড়াই হাজার কিলোমিটার। প্রতি দিনের নিক্ষিপ্ত পলিথিন ও ময়লা-আবর্জনায় সেগুলোর বেশিরভাগই থাকে বন্ধ। এর ওপর রয়েছে যখন-তখন যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়া-খুঁড়ির উপদ্রব। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসাসহ নাগরিক সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর কোনোটির সাথে কোনোটির সমন্বয় নেই। কয়েকটি পয়েন্টে স্টর্ম স্যুয়ারেজ লাইন ও পাম্প মেশিন বসানো হলেও সেগুলো বিদ্যুৎ সংকটসহ নানা কারণে কাজ করে না। ফলে নগরীতে একবার জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলে তা সেরে উঠতে সময় লেগে যায় কয়েকদিন। বর্ষা-বৃষ্টিতে পানিবন্দি জীবন কাটাতে হয় নগরবাসীকে। গত ক'বছর ধরে শোনা যাচ্ছে, একটি সমন্বিত মেট্রোপলিটন কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা। তবে কোনো সরকারই এতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেননি। মহানগরবাসীকে প্রতি বছরই জলাবদ্ধতার দুর্ভোগে নিক্ষেপ করাটাই কী গণতান্ত্রিক রীতি হয়ে গেলো, তার জবাব দেবেন কে?
No comments:
Write comments