Flickr

Friday, 24 May 2013

আতঙ্কিত জনপদে বসবাস

আতঙ্কিত জনপদে বসবাস
বর্তমানে আতঙ্কিত এক জনপদের নাম বাংলাদেশ। সর্বত্র, খুন, গুম, হত্যা, অপহরণ, লাশ এ যেন এক নিত্য-নৈমিত্তিক দৃশ্য। লাশের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। ঘরে ঘরে কান্নার রোনাজারি আর আহাজরি। প্রতিনিয়ত চেনা পরিচিত মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। কারো লাশ পাওয়া যাচ্ছে। কারো কোন সন্ধান-ই পাওয়া যাচ্ছে না। সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য, সাবেক ছাত্র নেতা এম ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হয়েছেন এক বছর পেরিয়ে গেছে। আজো তার পরিবার তার সন্ধানে চেয়ে আছেন। প্রধানমন্ত্রী তার পরিবারকে আশ্বস্ত করার পর দেশবাসী ভেবেছিল ইলিয়াস আলীকে হয়তো সরকার ফিরিয়ে দিবে কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। প্রায় দেড় বছর আগে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মেধাবী ছাত্র ওয়ালিউল্লাহ ও মোকাদ্দেসকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার পথে পঞ্চাশ জন যাত্রীর সামনেই র‌্যাব সদস্যরা তুলে নিয়ে যায় আজ পর্যন্ত তাদের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম নিখোঁজ হয়েছেন দুই বছর অতিবাহিত হয়েছে তার পরিবার এবং দলের পক্ষ থেকে বার বার দাবি করা  হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে তুলে নিয়ে গেছে কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। জয়পুরহাট জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি প্রভাষক নজরুল ইসলাম আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে নিখোঁজ আছেন। গত ১১ এপ্রিল রাত আনুমানিক ১২টার সময় ডিবি পুলিশের পরিচয়ে ১৫-২০ জনের একদল সাদা পোশাকধারী লোক তাকে ধস্তাধস্তি করে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। অপহরণকারীরা জয়পুরহাট সদর থানা থেকে প্রায় ৩শ’ গজ দূরে মেইন রোডের সাহেবপাড়া মহল্লার বাসার কলাপসিবল গেটের তালা ভেঙ্গে ৩ তলার ওপরে উঠে যায়। তার স্ত্রী সালমা সুলতানা জানান, ‘ঘটনাটি পুলিশকে জানিয়ে ইতোমধ্যেই জয়পুরহাট সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেছি।’ পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে খুঁজে বের করার আশ্বাস দিয়েছেন। তারা বলেন, দেশে চলছে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে দমন করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীর বিশেষ বাহিনীর পরিচয়ে বাসা-বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে খুন ও গুম করা হচ্ছে। একই অবস্থা রাজশাহীর শিবির নেতা মাসুমের।  শিবির নেতা মাসুমকে গত ৪ এপ্রিল রাত আড়াইটায়  র‌্যাব সদস্যরা ঘুমন্ত অবস্থায় ধরে নিয়ে যায় বলে শিবিরের অভিযোগ। কিন্তু এই লেখাটি লেখা পর্যন্ত ১৭ দিন অতিবাহিত হলেও এখনো তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এভাবে প্রতিনিয়ত নাম না জানা অসংখ্য বণি আদম হারিয়ে যাচ্ছে। কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে, কাউকে নেয়া হচ্ছে কোন পরিচয় দেয়া ছাড়াই। প্রতিনিয়ত এখানে সেখানে পাওয়া যাচ্ছে লাশ। লাশের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে ।  ২১ এপ্রিল দৈনিক আমাদের সময়ে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়, ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ৩ মাসে ২৬৭ ‘বেওয়ারিশ’ লাশ- আশুলিয়ার গাজীরচট এলাকার সড়কের পাশ থেকে গত ৮ এপ্রিল বিচ্ছিন্ন দুটি পা উদ্ধার করে পুলিশ। চারদিন পর উত্তরার আবদুল্লাপুরে একটি পরিবহন কাউন্টারের সামনে পড়ে থাকা লাগেজে দুই পা কাটা এক তরুণীর লাশ পাওয়া যায়। পুলিশের ধারণা, উদ্ধার হওয়া পা দুটি ওই তরুণীর। গতকাল শনিবার পর্যন্ত পা ও হতভাগ্য তরুণীর পরিচয় পাওয়া যায়নি। এভাবেই প্রতিদিন ঢাকা ও এর আশপাশের সড়কের পাশে, নদী, খাল-বিল, ডোবানালা থেকে অজ্ঞাত লাশ পাওয়া যাচ্ছে।..... এক্ষেত্রে  পুলিশী অবহেলারও প্রমাণ মিলেছে। এসব কারণে অজ্ঞাতপরিচয় খুনিরা থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ময়নাতদন্তের পর পরিচয়হীন এসব লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। রাজধানী ও এর আশপাশে বছরে কত অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয় তার সুনির্দিষ্ট হিসাব পুলিশের কাছে নেই। দীর্ঘদিন ধরেই বেওয়ারিশ লাশ দাফন করছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব অনুযায়ী গত বছর বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২৪৭। চলতি বছরের তিন মাসেই এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬৭-তে। ....ডিএমপি সূত্র জানায়, ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরী নদী এবং বিভিন্ন ডোবানালা, মহাসড়ক-সড়কের পাশ থেকে পরিচয়হীন এসব লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশগুলোর কোনওটি থাকে গুলীবিদ্ধ, কোনওটি ধারালো অস্ত্রে জখমি, হাত-পা বাঁধা, আবার  কোনওটি মস্তকবিহীন। সংঘবদ্ধ অপরাধীরা হত্যার পর গুমের কৌশল হিসেবে লাশ এসব স্থানে ফেলে যায়। অনেক লাশই পচে-গলে বিকৃত হয়ে যায়। ফলে পরিচয় শনাক্ত করা যায় না।’ ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য, সরকারদলীয় বাহিনীর সন্ত্রাস, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গুম আজ নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। মানুষের জীবনের যেন আজ কোন নিরাপত্তা নেই। ভয়ঙ্কর খুনি সন্ত্রাসীদের দলীয় বিবেচনায় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ফাঁসির আসামীকে রাষ্ট্রপতির বিশেষ বিবেচনায় জেলখানা থেকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। অপরদিকে নিরপরাধ মানুষদের গ্রেফতার করে হামলার মামলা দিয়ে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ক্যাম্পাসে রাজপথে প্রতিনিয়ত দিবালোকে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের মহড়া, হামলা, খুন, দখল দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে বারবার। কিন্তু এ ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী সংগঠনটির ক্যাডাররা সবসময় থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। যারা অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়, হামলা করে, খুন করে তাদেরই কাউকে কাউকে আবার দেখা যায় পুলিশের সাথে সখ্যতায়। যার ছবি বেশ কয়েকবার বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে। একদিকে সরকারদলীয় সন্ত্রাস অপরদিকে সরকারি বাহিনীর মানুষ খুনের নেশায় বাংলাদেশকে যেন এক খুনের জনপদে পরিণত করেছে। বাংলাদেশ যেন আজ এক মৃত্যু উপত্যকা। যেখানে জীবন সম্পদের কোন নিরাপত্তা নেই। নিরাপত্তা নেই ঘরে, বাইরে, রাস্তায় কোথাও। মানুষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যায় নিরাপত্তার জন্য। কিন্ত আজ নিজের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থেই জনগণ তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে। গ্রেফতারের পরে গুম, খুন ছাড়াও কোন কারণ ব্যতীত-ই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যে কোন সময়, যে কোন স্থানে নির্বিচার গুলি করতে এখন আর দ্বিধা করে না। বিরোধী দলের মিছিল সমাবেশে এখন তারা গুলী করতে যেন একটু আনন্দ-ই পায়। দেশবাসী এ দৃশ্য দেখছে বেশ কিছুদিন যাবত। ২৭-২৮ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নির্দেশে যে গণহত্যা চালিয়েছে- পৃথিবীর কোন স্বাধীন দেশের জনগণের ওপর এমন গুলী, এমন গণহত্যার কোন নজির নেই। এ গণহত্যার পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খুনিদের পক্ষ নিয়ে নিরস্ত্র, নিরপরাধ মানুষদের বিরুদ্ধে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে স্পষ্ট হয়েছে যে, রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ নির্দেশে আজ গণহত্যা চলছে। সে দিনের সে গণহত্যার রেশ এখনো কাটেনি। এখনো নিহতের পরিবারে কান্না আর শোকের আহাজারিত। পুলিশের গুলী এবং হামলায় অসংখ্য মানুষ এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অপরদিকে আহত-নিহত পরিবারগুলোতে প্রতিনিয়ত চলছে পুলিশের অভিযান। এ গণহত্যার পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন ‘ আমি স্তম্ভিত। আমি ক্ষুব্ধ। আমি গভীরভাবে মর্মাহত। নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাবার কোনো ভাষা আমার নেই। আমাদের এই দেশে আবার চলছে পৈশাচিক গণহত্যা। পাখিরমতো গুলী করে মানুষ হত্যা চলছে। গণহত্যার পৈশাচিক তা-বে মেতে ওঠেছে সরকার। ফ্যাসিবাদের নগ্ন থাবায় রক্ত ঝরছে, প্রাণ যাচ্ছে দেশের শান্তিপ্রিয় নিরস্ত্র নাগরিকদের। বৃদ্ধ, শিশু-কিশোর এমনকি কুলবধূরা পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না এই নির্মম হত্যাকা- থেকে। মনে হচ্ছে, কোনো ভিনদেশী হানাদাররা যেন বাংলাদেশের মানুষের ওপর পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠেছে। কোনো একটি সরকার নিজের দেশের নাগরিকদের ওপর এমনভাবে গণহত্যা চালাতে পারে তা আমাদের কল্পনারও অতীত। এধরনের গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই আমরা ১৯৭১ সালে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছিলাম। সেই স্বাধীন দেশে আবার অন্য কোনো অজুহাতে কখনো কোনো সরকার গণহত্যার পথ বেছে নেবে তা আমরা মেনে নিতে পারি না। আমি এই মুহূর্তে এই গণহত্যা বন্ধের দাবি জানাচ্ছি। আমি সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলতে চাই, এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। .... ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকে স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসর হিসেবে চিত্রিত করে সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে। সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা মসজিদে ঢুকে মুসল্লী, খতীব ও ইমামদের পর্যন্ত হেনস্তা করেছে। প্রতিবাদ মিছিল থেকে কিশোর-তরুণদের ধরে নিয়ে তাদের গায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলী করে হত্যার মতো পৈশাচিক ঘটনা ঘটিয়েছে। নিজ গৃহে গৃহবধূকে পর্যন্ত গুলী করে হত্যা করা হয়েছে। ... সরকার ভিন্নমতাবলম্বীদের ধরে ধরে জবাই করার আওয়াজ তুলছে। বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাংচুরে উৎসাহিত করছে। এসব তৎপরতার মাধ্যমে আমাদের জনজীবনে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও জাতীয় অর্থনীতিকে যারা নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সরকার তাদের বাধা দেয়ার পরিবর্তে সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে। সরকারের মন্ত্রীরা তাদের কাছে গিয়ে এসব কর্মকা-ে সমর্থন যোগাচ্ছে। ...ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টির সমস্ত দায়-দায়িত্ব এই সরকারকেই বহন করতে হবে।’
২১ এপ্রিল বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে- ‘বাংলাদেশে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বড় বাধা, গণগ্রেফতার বিচার বহির্ভূত হত্যা ও পুলিশের গুলীতে মৃত্যু: এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট বি.বি.সি. প্রকাশ করে তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে গণগ্রেফতার, বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- ও পুলিশের গুলীতে মৃত্যু। সরকার দুর্নীতি দমনে ব্যর্থ হয়েছে বলেও ঐ রিপোর্টে দাবি করা হয়।
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে দুর্বল হিসেবে উল্লেখ করে রিমান্ডে নির্যাতনকে গুরুতর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে রিপোর্টটি। গত বছর ৭২ ব্যক্তি এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৭ জন। বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ব্যাপারে সরকার জিরো টলারেন্সের কথা বললেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হত্যাকা- অব্যাহত রয়েছে। ২০১২ সালে ৭০ জনের বেশি মানুষকে বিচার ছাড়া হত্যা করা হয়েছে। ৪০টি হত্যাকা-ের জন্য র‌্যাবকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে। এসব তথ্যের সূত্র হিসেবে স্থানীয় মিডিয়াকে দেখানো হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের বরাত দিয়ে বলা হয়, রাজনৈতিক সংঘর্ষে মারা গেছেন ১৬৯ জন। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের হাতে বিশ্বজিৎ দাসের প্রাণহানির কথা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, বাকস্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশ করার অধিকার খর্ব করা হচ্ছে, সাংবাদিক নির্যাতন বৃদ্ধি ও সংবাদ-মিডিয়ায় সেন্সরশিপও বাধ্য হচ্ছে। সহিংসতা, সংঘাত ও অব্যাহত দুর্নীতিকে একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে মিছিল-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। ২০১২ সালে ১০৫টি সমাবেশ সরকার ভ-ুল করে দেয় বলে রিপোর্টে বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, বাংলাদেশে সন্দেহের ভিত্তিতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- ও গুমের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর যোগসাজশের বিষয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ সত্ত্বেও তা অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরে বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি গত শুক্রবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সংবাদ সম্মেলনে কেরি বলেন, এই প্রতিবেদন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিচ্ছে, সার্বজনীন মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিটি সরকার দায়বদ্ধ।’ একই ধরনের একটি রিপোর্ট তৈরি করেছে ১৯টি মানবাধিকার সংগঠনের সম্মিলিত ফোরাম হিউম্যান রাইটস ফোরাম, যা আগমী ২৯ এপ্রিল জেনেভায় অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পেশ করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্র স্থানীয় মিডিয়ার বরাত দিয়ে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থার রিপোর্ট আসেনি, প্রকৃত অবস্থা এর চেয়েও ভয়াবহ। কারণ স্থানীয় মিডিয়ার দু’একটি বাদ দিলে প্রায় সবগুলোই সরকারদলীয় সমর্থক এবং তাদের সংবাদে সরকারের ও সরকারি দলের প্রতি একটি প্রকাশ্য অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। যে সংবাদ একেবারে প্রকাশ করলে নয় তা-ই শুধু প্রকাশ করে। এর প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, গত ২৭-২৮ ফেব্রুয়ারি এবং ১ মার্চ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক যে গণহত্যা পরিচালিত হয় তাকে সরকার সমর্থক সব মিডিয়া বিরোধী দলের সহিংসতা হিসেবে উল্লেখ করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্বিচার গুলীতে প্রায় দুইশত লোক মারা গেল, প্রায় দশ হাজার লোক আহত হলো আর সরকার সমর্থক মিডিয়াগুলো বলেছে জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা বিপরীত পক্ষে ফটিকছড়িতে সরকারদলীয় ক্যাডার বাহিনী মারাত্মক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দুইশত মোটরসাইকেল নিয়ে মাদরাসা, মসজিদ এবং গ্রামবাসীর উপর হামলা করতে গেলে গ্রামের সাধারণ জনতা লাঠিসোঁটা নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করে। এতে জনতার গণধোলাইয়ে তিনজন নিহত হয়। তাকে সরকার সমর্থক মিডিয়াগুলো বারবার বিভিন্ন আঙ্গিকে, বিভিন্ন রংয়ে, বিভিন্ন ঢংয়ে প্রচার করছে। আমি এ নিহতের ঘটনাকে সমর্থন করছি না। তবে একটি বিষয় বুঝতে হবে- কেন গ্রামের সাধারণ জনগণ লাঠিসোঁটা নিয়ে সরকারি দলের ক্যাডার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে? এর কারণ, জনগণ সরকারের জুলুম, নির্যাতন, গুম, খুনে অতিষ্ঠ। নির্যাতিত জনতা তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছে মাত্র। সরকার তাদের জুলুমের মাত্রা না কমালে ভবিষ্যতে হয়তো আরো ভয়াবহ হতে পারে, যা থেকে সরকারকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।
স্বাধীন-সার্বভৌম এ জনপদের মানুষ স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ন্যায়বিচার, সুশাসন, গণতান্ত্রিক অধিকার, আইনের শাসন এবং সুখী-সমৃদ্ধ জীবনের জন্য বারবার লড়াই করেছে। দুশ’ বছরের বৃটিশের গোলামীর জিঞ্জির ছিন্ন করতে বারবার আন্দোলন ও বিদ্রোহ হয়েছে। আন্দোলনকারীদের জেল, জুলুম, নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রেখে স্বাধীনতাকামী জনতার মন থেকে আন্দোলনের চিন্তা দূরীভূত করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী, হাজী শরীয়ত উল্লাহ, মীর নিসার আলী তিতুমীরসহ অনেক নেতার নেতৃত্বে এ জনপদে স্বাধীনতার লড়াই হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই নিজেদের সঙ্গী-সাথীসহ  জীবন দিয়েছেন কিন্তু স্বাধীনতার আন্দোলন, জনগণের দাবি আদায়ের আন্দোলন থেকে পিছু হটেননি। তাদের দেখানো পথেই জনতার তীব্র প্রতিরোধ এবং আন্দোলনের মুখে ইংরেজরা বিদায় নেয়, জনতা দুশ’ বছরের ইংরেজদের গোলামী থেকে মুক্তি পায়।  এ পথ ধরেই আসে ৫২’র ভাষা  আন্দোলন এবং  ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ। যদিও আমাদের নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতা মানে ’৭১-এর বাইরে কিছু নেই। এ ইতিহাস বোঝানোর, শেখানোর, পড়ানোর, বলানোর এবং এ চেতনার কথা বলে স্বকীয়তা এবং আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তরুণদের বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে অতি আধুনিকতার নামে ধর্মনিরপেক্ষ তথা ধর্মহীন হওয়া। বাম-পতিত কমিউনিস্ট যারা এখন বর্তমান আওয়ামী সরকারের কাঁধে সওয়ার হয়ে তরুণ প্রজন্মকে আত্ম পরিচয়হীন এক জাতিতে পরিণত করার সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করার চেষ্টা করছে। একদিকে আত্মপরিচয়হীন, চেতনাহীন একটি জাতি তৈরির চেষ্টা চলছে, অপরদিকে প্রতিবাদী তরুণদের হত্যা করা হচ্ছে। গ্রেফতার করা হচ্ছে, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে জীবনের জন্য পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে। গ্রেফতার করার পর অথবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাবার পর মানুষগুলোকে গায়েব করে ফেলা হচ্ছে। সরকার হয়তো ভাবছে এভাবেই প্রতিরোধের ভাষাকে স্তব্ধ করে দেয়া যাবে, মানুষ প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী- কোন অত্যাচারী শাসকই অত্যাচার চালিয়ে নিজের ক্ষমতার মসনদ স্থায়ী করতে পারেনি। হিটলার চেয়েছিল সমগ্র পৃথিবী জয় করতেত। কিন্ত পরিণতিতে তাকে পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল। ইংরেজরা অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও তাদের এ দেশ ছেড়ে যেতে হয়েছিল। ইহাহিয়া এবং ভুট্টোকে জনতার দাবির সামনে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল। মিসরের ত্রিশ বছরের শাসক হোসনী মোবারককে এখন কারাগারে দিন যাপন করতে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় প্রমাণ সরকারের দুর্দিনের বন্ধু বলে পরিচয় দেয়া সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদ সাহেব। এখানেও হয়তো সরকার ভাবতে পারে কোন আন্দোলন এবং প্রতিবাদই করতে দেবো না, রাস্তায় নামতে দেবো না। সরকার বিরোধী কোন সংবাদপত্র রাখবো না। যেমন এক অভিনব কায়দায় এখন আমার দেশ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কিন্তু জনতার প্রতিবাদের ভাষা মাঝে মাঝে এমন ভয়ানক হয় কোন প্রতিরোধ দিয়ে তা আর ঠেকিয়ে রাখা যায় না।

Wednesday, 8 May 2013

হেফাজতের ওপর নিষ্ঠুরতা

অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামও আওয়ামী লীগ সরকারের সশস্ত্র বিভিন্ন বাহিনী এবং সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে রেহাই পায়নি। গত রোববার ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগারদের গ্রেফতার ও শাস্তিসহ ১৩ দফা আদায়ের দাবিতে ঢাকা অবরোধের কর্মসূচি পালন করছিল সংগঠনটি। যে কোনো বিচারে সম্পূর্ণ গণতন্ত্রসম্মত হলেও হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিকে ভ-ুল করে দেয়ার জন্য সরকার নিষ্ঠুর দমন ও হত্যার অভিযান চালিয়েছে। এ ব্যাপারে এখনও পূর্ণাঙ্গ তথ্য যদিও জানা যায়নি তবু যেটুকু জানা গেছে তার ভিত্তিতেই বলা যায়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অকল্পনীয় নিষ্ঠুর হৃদয়বিদারক ঘটনা সেখানে ঘটেছে। একে কোনোভাবেই যুক্তিগ্রাহ্য করার উপায় নেই। নানা ব্যাখ্যা দিয়ে প্রচার চালানো হলেও ঘটনাপ্রবাহের কোনো পর্যায়েই হেফাজতে ইসলাম গণতন্ত্রসম্মত অবস্থান ও তৎপরতার বাইরে যায়নি। ঢাকা অবরোধের কর্মসূচিও নতুন ছিল না। অবরোধের এই কর্মসূচি হেফাজত ৬ এপ্রিল একই শাপলা চত্বরের সমাবেশে ঘোষণা করেছিল। সেই থেকে অবরোধের আগের দিন পর্যন্ত হেফাজতের নেতারা সারাদেশ সফর করেছেন, অসংখ্য সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন। প্রতিটি ভাষণে তারা শুধু শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির কথাই বলেননি, ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ে জড়িত হওয়ার বিরুদ্ধেও কর্মীদের সতর্ক করে দিয়েছেন। বড়কথা, অবরোধের কোনো পর্যায়েও হেফাজতের কাউকে কোথাও ধ্বংসাত্মক বা বেআইনি কোনো কর্মকা- চালাতে দেখা যায়নি। সুতরাং এমন অভিযোগ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয় যে, হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ে লিপ্ত হয়েছিলেন বলেই সরকারকে কথিত অ্যাকশনে যেতে হয়েছে। বাস্তবে প্রথম থেকে উস্কানি এসেছিল ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। শাপলা চত্বরগামী হেফাজতকর্মীদের বাধা দেয়া হয়েছিল। সংঘাত সেখান থেকেই শুরু। সন্ধ্যা থেকে ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে, তার সাথে হেফাজতকর্মীরা জড়িত নয় এটা প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিমত। কারা এর সাথে জড়িত সে বিষয়ে অনেক কথা বলা হলেও আমরা বলতে চাই না। তবে বিষয়টা বিতর্কিত তদন্ত সাপেক্ষ তাতে সন্দেহ নেই। এসব বিচারে রাতের হামলার যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। নিহতদের সংখ্যা নিয়ে জোর গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃত সংখ্যা কম-বেশি যতোই হোক না কেন, সরকারের এই কর্মকা-কে অনেকে এমনকি গণহত্যা হিসেবেও চিহ্নিত করেছে। বলা হচ্ছে, সরকার গণতন্ত্রের সীমা অতিক্রম করেছে।
উল্লেখ করা দরকার, এবারই প্রথম নয়, এর আগে গত ৬ এপ্রিল লংমার্চ কর্মসূচি এবং তার পরপর পালিত হরতাল উপলক্ষেও সরকার হেফাজতের বিরুদ্ধে একই ধরনের বাধা, নীতি ও ভূমিকা নিয়েছিল। লংমার্চকে ভ-ুল করার জন্য সরকার সারা দেশে হরতাল করিয়েছিল। ওদিকে হরতালের দিন দেশের এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসী-ক্যাডাররা সশস্ত্র হামলা না চালিয়েছিল। এসব হামলার শিকার হয়েছেন হেফাজতের নিরীহ নেতা-কর্মীরা। তাদের সঙ্গে পুলিশও যথারীতি যোগ দিয়েছিল। গুলীরও ব্যবহার হয়েছিল। সে নীতিরই ধারাবাহিকতায় সরকার এবার হত্যা পর্যন্ত চালিয়েছে। আমরা মনে করি, সরকারের উচিত ছিল বিষয়টিকে গণতান্ত্রিক সহনশীলতার দৃষ্টিতে দেখা। হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক দল নয়, শাহবাগে তৎপর নাস্তিক ব্লগারদের ইসলামবিরোধী প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর প্রধান উদ্দেশ্য নিয়েই হেফাজতে ইসলাম রাজপথে এসেছে। প্রথমে বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নেতারা ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। সরকার সে দাবি না মানায় পর্যায়ক্রমে এসেছিল ৬ এপ্রিল লংমার্চের এবং ৫ মে অবরোধের কর্মসূচি। কিন্তু শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হলেও সরকার নিয়েছে মারমুখী নীতি।
যাহোক, এই ঘটনা আমাদের রাজনীতি ও জাতীয় জীবনের এক দুঃসহ ঘটনা হয়েই থাকবে এবং তা আমাদেরকে আমাদের আত্মসম্বিত ফিরিয়ে আলোর দিকে নিয়ে যাবে, না আমাদের গণতন্ত্রকে অন্ধকারের পথ দেখাবে তা আমরা জানি না। আমরা ভালোটাই আশা করি।
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter