ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলীতে গত পাঁচ বছরে সীমান্তে ২১৪ জন বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৩২৩ জন। আর গত ছয় মাসে (২০ জুন পর্যন্ত) নিহত হয়েছেন ১৪ জন, আহত হয়েছেন ৩১ জন। গত ২৬ জুন এক সাংবাদিক সম্মেলনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ এসব তথ্য জানান। মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের ছয় মাস পূর্তি উপলক্ষে রাজধানীর পিলখানায় বিজিবির সদর দফতরে এই সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। বিজিবি মহাপরিচালক দাবি করেন, গরু ব্যবসাকে কেন্দ্র করে সীমান্তে হত্যাকা- সংঘটিত হচ্ছে। তিনি জানান, যে কারণেই হত্যাকা- হোক না কেন প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। চলতি বছরের ২৩ জুন পর্যন্ত সীমান্তের ঘটনায় বিএসএফ-এর কাছে ৪৫টি প্রতিবাদপত্র পাঠানো হয়েছে। তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত সম্পর্কের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। হতাহতের সংখ্যা কমে এসেছে। সীমান্তের পরিস্থিতি অনেক শান্ত ও ভালো। সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে বিজিবির মহাপরিচালক তার অবস্থান থেকে বক্তব্য প্রদান করেছেন। বিজিবির মহাপরিচালক তার পদে থেকে যে রকম বক্তব্য দেয়া সঠিক মনে করেছেন, সে রকম বক্তব্যই প্রদান করেছেন। এ ব্যাপারে আমরা বিশেষ কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে সীমান্ত পরিস্থিতি এবং ভারতীয় বিএসএফ-এর আচরণ প্রসঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে বিভিন্ন রিপোর্ট মুদ্রিত হয়ে আসছে। ঐসব রিপোর্টে বিএসএফ-এর গুলীতে হত্যাকা-ের ঘটনা ছাড়াও বাংলাদেশী নাগরিকদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন, বাংলাদেশী নাগরিকদের গরু-ছাগল-মৎস্য ও ফসল লুটে নেয়ার ঘটনা মুদ্রিত হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় এসব বিষয় নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হলে এবং প্রতিবাদ করা হলে তখন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়, এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে সে ব্যাপারে আমরা দেখছি। কিন্তু ঐসব কথা এবং আশ্বাস বাণীর বাস্তব কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। বিজিবি মহাপরিচালকও বলেছেন, প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়। চলতি বছরের ২৩ জুন পর্যন্ত বিএসএফের কাছে ৪৫টি প্রতিবাদপত্র পাঠানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব কড়া প্রতিবাদ ও প্রতিবাদপত্রকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো গুরুত্ব দেয় কি? গুরুত্ব দেয় না বলেই বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরও বিএসএফ হত্যাকা-, জুলুম, নির্যাতন ও আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে। বিজিবিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কোনো সমীহ করছে না। বাংলাদেশী জনগণের জানমালের প্রতিও কোনো সম্মান প্রদর্শন করছে না বিএসএফ। আমরা জানি, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব সরকারের। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে কূটনৈতিক তৎপরতাসহ সব ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। এমনকি মাথা উঁচু করে প্রতিবাদটুকুও করতে পারছে না। একটি স্বাধীন দেশের সরকারের এমন নতজানু ও অক্ষম ভূমিকা দেখতে নারাজ দেশের জনগণ। এসব দেখে পর্যবেক্ষক মহলে প্রশ্ন জাগেÑ বাংলাদেশ তো ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র, কিন্তু শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তানের তুলনায় বন্ধু রাষ্ট্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী এতো নিষ্ঠুর কেন? এর কারণ কি পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা? সামরিক বিশ্লেষকরা এমন পরিস্থিতিকে ‘ভীতির ভারসাম্য’ বলে অভিহিত করে থাকেন। অর্থাৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যদি অস্ত্র ও শক্তির একটা ভারসাম্য থাকে কিংবা পরস্পরকে ভয় করার মতো উপাদান থাকে, তাহলে সহজে কেউ কাউকে ঘাটাতে চায় না। অনেক সময় ছোট রাষ্ট্রও আশপাশের বড় রাষ্ট্রগুলোকে অস্ত্র ও সমরশক্তির দাপটে তটস্থ করে রাখে। যেমন-ইসরাইল। বাংলাদেশ শান্তিপ্রিয় একটি ছোট রাষ্ট্র। অস্ত্র ও সমরশক্তিতেও দেশটি দুর্বল। এ কারণে শান্তির নীতি গ্রহণ করেও দেশটি শান্তিতে থাকতে পারছে না। আবেদন-নিবেদন এবং প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হত্যা ও আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাচ্ছে না বাংলাদেশী নাগরিকরা। তাই এখন জনমনে প্রশ্ন জেগেছে, আমরা কি এভাবেই দিনের পর দিন মার খেয়ে যেতে থাকবো, নাকি আমাদেরও করণীয় কিছু আছে? পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় শান্তির বুলি আওড়ালেই শান্তি হাতে এসে ধরা দেয় না। শান্তি ও সমৃদ্ধির পরিবেশে বসবাস করতে চাইলে প্রয়োজনীয় যোগ্যতাও অর্জন করতে হবে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সমৃদ্ধ অর্থনীতি, সুশাসন, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং জাতীয় ঐক্য-সংহতির চেতনা বর্তমান বিশ্বে টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য গুণাবলী। এইসব গুণাবলীর ব্যাপারে কোনো দেশের সরকার এবং রাজনীতিবিদরা অবহেলা করলে সে দেশের প্রগতি, নাগরিকদের উন্নত জীবনযাপনের আকাক্সক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে না। বাংলাদেশে এখন যেন আমরা সেই চিত্রই লক্ষ্য করছি। সরকার ও রাজনীতিবিদরা পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ও ব্লেম গেমের যে সংস্কৃতি চালু রেখেছেন তাতে প্রতিদিনই তাদের মান-মর্যাদার পারদ অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এতে নাগরিকদের মধ্যেও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সমীহ করে চলার তেমন কোনো কারণ নেই। ফলে সহসাই যে বিএসএফ-এর আগ্রাসন বন্ধ হয়ে যাবে তেমনটি ভাবার কোনো যুক্তি নেই। এমন অবস্থায় জনগণ সময়ের কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালন করতে পারে। সেই ভূমিকার নাম গণজাগরণ। একমাত্র গণজাগরণের চাবুকই আমাদের রাজনীতিবিদদের এবং সমাজপতিদের শঠতা ও প্রতারণার রাজনীতি থেকে বিরত রাখতে পারে। আর গণজাগরণ প্রসঙ্গে চলে আসে যুবসমাজের কথা।
আমরা জানি, যে কোনো দেশের তরুণ-যুবকরাই জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে জাতির যোগ্যতাও। সংখ্যার দিক থেকেও আমাদের দেশের তরুণ ও যুবকরা গরিষ্ঠ। কিন্তু ট্রাজেডি হলো, দীর্ঘদিন ধরেই এই তরুণ ও যুবকদের ভুল পথে পরিচালিত করে আসছে দেশের রাজনৈতিক অভিভাবকরা। সরকারগুলোর দায়িত্ব ছিল দেশ ও জাতির স্বার্থে তরুণ ও যুবকদের বিনষ্টের হাত থেকে রক্ষা করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- কাক্সিক্ষত দায়িত্ব পালনের বদলে তারা তরুণ ও যুবকদের বিনষ্টের পথ আরো ব্যাপক করেছে। এ কারণেই হয়তো ‘ফোরাম অব ইয়ং প্রোফেশনালস’ নামক একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দেশের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক মন্তব্য করেছেন, ছাত্রলীগ ও যুবলীগে যারা আছে তারা হলো ‘গু-ালীগ ও টেন্ডারলীগ’। তারা গু-ামি ও টেন্ডারবাজিতে ব্যস্ত। যতক্ষণ পর্যন্ত তরুণরা দেশের উন্নয়ন ও পরিবর্তন নিয়ে কাজ না করে টেন্ডারবাজি ও গু-ামি করবে ততক্ষণ পর্যন্ত দেশের উন্নয়ন হবে না। আমরা জানি, ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক সরকারি দল কিংবা বিরোধী দলের রাজনীতি করেন না। সরকারি দলের ছাত্র-যুবকদের ভ্রষ্ট কর্মকা- লক্ষ্য করেই আক্ষেপের সুরে তিনি তার মন্তব্য করেছেন। ব্যারিস্টার রফিক কিংবা দেশের প্রবীণ কোনো নাগরিকই তরুণ ও যুবকদের নেতিবাচক বিশেষণে চিহ্নিত করতে চান না। বরং দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি ও মর্যাদার উন্নয়নে তারা তরুণ ও যুবশক্তির মেধা ও কর্মতৎপরতার উপর নির্ভর করতে চান। কিন্তু দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি আজ তাদের মধ্যে হতাশার মাত্রাই বৃদ্ধি করছে। হতাশার এমন বাতাবরণের জন্য দেশের রাজনীতিবিদরাই দায়ী এবং বর্তমান সময়ে যারা সরকারে আছেন তারা বিশেষভাবে দায়ী। কারণ তারা দেশের সংবিধান ও শপথের কাছে দায়বদ্ধ।
জনগণের ভোটে যখন রাজনীতিবিদরা সরকার গঠন করেন, তখন তাদের উপলব্ধিতে যে বিষয়গুলো থাকার প্রয়োজন, তা থাকে কি না সে ব্যাপারে এখন জনমনে সংশয় দেখা দিয়েছে। সরকার গঠন মানে তো ক্ষমতার দ-গ্রহণ করা নয়, বরং গণআকাক্সক্ষা পূরণের দায়িত্ব গ্রহণ। দায়িত্বের এই বিষয়টা উপলব্ধি করলে কোনো সরকার তথা সরকারের মন্ত্রী ও কর্তাব্যক্তিরা উদ্ধত হতে পারেন না, বরং দায়িত্বের চাপে তাদের বিন¤্র হওয়ার কথা। এ প্রসঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের পর পলিট ব্যুরোর এক সদস্যের একটি মন্তব্য স্মরণ করা যায়। তিনি তখন বলেছিলেন, নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনের বদলে আমরা পলিটব্যুরোর সদস্যরা কর্তৃত্বের ছড়ি ঘুরিয়েছিলাম, এ কারণেই আমাদের পতন হয়েছে। পতনের এই তত্ত্বটা সবার জন্যই প্রযোজ্য হতে পারে। জানি না আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা এই তত্ত্ব থেকে কতটা উপকৃত হতে সমর্থ হবেন।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকার সমর্থক প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। এই সব নির্বাচনে স্থানীয় বিষয়গুলোর চাইতেও অধিক গুরুত্ব পেয়েছে জাতীয় ইস্যুগুলো। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, সরকার জনগণের আস্থা হারিয়েছে। এখন সরকারের কর্তব্য আস্থা হারানোর কারণগুলো খতিয়ে দেখা। কিন্তু এর পরিবর্তে সরকার যদি যে কোনোভাবে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজয়ের রণকৌশল গ্রহণ করে ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে চায়, তাহলে সেটা হবে বড় ভুল। এমন ভুল তাদের আরো বড় পরাজয়ের দিকেই ধাবিত করবে। আসলে ভুলের সংশোধনই হলো ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায়। আর ভুলের ওপর দাঁড়িয়ে কৌশল ও দাপটের রণনীতি হলো চূড়ান্ত ধ্বংসের পথ। ইতিহাসের এই সত্য সবার জন্যই প্রযোজ্য। সরকার কিংবা বিরোধী দল কেউই ইতিহাসের অমোঘ এই রায়ের বাইরে থাকতে পারে না। জনগণ দেশের রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে। সরকারের দাম্ভিকতা ও খেয়ালিপনায় তারা সংক্ষুব্ধ। সময়ের আহ্বানে তারা সাড়া দিতে শুরু করেছে। জনগণের এই জাগরণ সামনের দিনগুলোতে হয়তো মহাজাগরণে পরিণত হবে। যার যা প্রাপ্য তা বুঝিয়ে দিতে জনগণ ভুল করবে না। অতএব সময় থাকতেই সাধু সাবধান।
No comments:
Write comments