Flickr

Thursday, 14 August 2014

পানি নয়, ভারতের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করাই যদি লক্ষ্য হয়

Posted by   on

কবির ‘পথ পানে চেয়ে রই’ পর্যন্ত না যেতেই ‘খিরকি দুয়ার খুলে দিতে দিতেই’ মরা তিস্তায় ভরা যৌবন আবার হারিয়ে গেছে। হঠাৎ করে মরা গাঙে (তিস্তা নদী) ভরা যৌবন এসেছিল। সে যৌবনে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল উত্তরাঞ্চলের কিষাণ-কিষাণী। তিস্তায় পানি এসেছে; জমিতে ফসল ফলবে। ২৪ ঘণ্টায় উবে গেল সে স্বপ্ন।
এভাবে হঠাৎ পানি দেয়া বা বন্ধ রাখার পরিবর্তে এ বিষয়ে একটা স্থায়ী চুক্তি সম্পদনই অধিক শুফলদায়ক হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ ইস্যুতে দেশের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও সরকার কিছু করতে পারছে না। কারণ ভারত ব্যস্ত লোকসভা নির্বাচন নিয়ে। ফলে দিল্লির মনোভাব বোঝা যাচ্ছে না। ঢাকায় এক কূটনীতিক বলেন, ‘ভারতের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলা যাচ্ছে না। তারা নির্বাচন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘ভারতে নির্বাচন থাকায় তিস্তা চুক্তি নিয়ে কাজ করার এখন উপযুক্ত সময় নয়। নির্বাচনের পর এ বিষয়ে আরও প্রচেষ্টা চালানো হবে।’ (সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর ২২ এপ্রিল ২০১৪)
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন পূর্ববর্তী সরকারের আমলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দিপু মনি একবার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন যে, তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে দু’দেশের মধ্যে অচিরেই চুক্তি সম্পাদিত হচ্ছে।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর যথাসময়ে অনুষ্ঠিত ও সমাপ্ত হলেও সফরে দীর্ঘ প্রত্যাশিত তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত হয়নি। উভয় দেশ ২০ শতাংশ পানি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য ছেড়ে দিয়ে অবশিষ্ট পানি উভয় দেশ সমান ভাগে ভাগ করে নেয়ার লক্ষ্যে ১৫ বছর মেয়াদি অন্তর্বতী চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সে সফরে প্রত্যাশিত তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত না হওয়ার কারণ হিসেবে তখন বলা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ঐ চুক্তি স্বাক্ষরে উপস্থিত থাকার কথা ছিল, তিনি আসতে না পারায় চুক্তি সম্পাদিত হতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে মমতা ব্যানার্জি চুক্তির বিরোধিতা করায় তা সই হয়নি।
ইতোমধ্যে মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, তিস্তায় যে ‘জল’ আছে তাতে পশ্চিমবঙ্গেরই প্রয়োজন মেটে না, বাংলাদেশকে ‘জল’ দেব কিভাবে? এই বাহানায়ই বাংলাদেশকে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
তারপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ অধিবেশন, সার্ক সম্মেলনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে যোগদান করতে যেখানে গেছেন সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে তিস্তার পানির প্রসঙ্গ তুলেছেন। মনমোহন বিব্রতকর অবস্থায় তুলে ধরে তিস্তার চুক্তি নিয়ে আন্তরিকতার কথাও বলেছেন। যদিও সেটা বাস্তবে ঘটেনি।
তিস্তা বিষয়ে আওয়ামী লীগ প্রথম থেকেই ভারতের কাছে নতজানু নীতি গ্রহণ করেছে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ক্ষমতায় স্থায়ী হতে ভারত আওয়ামী লীগকে স্পষ্ট সমর্থন দিয়েছে। আর ক্ষমতাসীন দলটি এ কারণে ভারতের প্রতি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে বের হতে না পেরে তিস্তা বিষয়ে দেশটির প্রতি নতজানুমূলক নীতি নিয়েছে।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, তিস্তার পানি আদায়ের বিষয়ে দেশের মানুষ সচেতন। আর সে কারণেই তারা সম্প্রতি বিএনপির তিস্তা অভিমুখী লংমার্চের সঙ্গে একাতœতা প্রকাশ করেছেন। এ ইস্যুতে শুধু বিএনপি একা নয়, সিপিবি ও বাসদসহ বাম সংগঠনগুলোও তিস্তা অভিমুখে যাত্রাসহ অন্য কর্মসূচি পালন করেছে। আমি মনে করি, নাগরিক হিসেবে নিজেদের অধিকার রক্ষার খাতিরে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সদস্যরা এসব কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে নিজেদের কর্তব্য করছেন। তবে সরকারের উচিত এ কর্মসূচিকে ইতিবাচকভাবে ভারতসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরা। বৃহত্তর স্বার্থে সরকারের দলমত নির্বিশেষে তিস্তা চুক্তি সম্পর্কিত সব আন্দোলন-কর্মসূচিকে ‘ক্যাপিটালাইজ’ করা উচিত। একই সঙ্গে সরকারের উচিত দেশের খাতিরে এ আন্দোলনকে আরও বেগবান ও শক্তিশালী করে ভারতের কাছে উপস্থাপন করা।
আসিফ নজরুল বলেন, নিজেদের দাবি আদায়ে ১৯৭৬ সালে জননেতা মওলানা ভাসানী ফারাক্কা অভিমুখে মিছিল করেছিলেন। পরে জিয়াউর রহমান তিস্তা বিষয়ে চাপ তৈরি করেছিলেন। সেভাবে আবারও এখন তিস্তার অধিকার আদায়ে আমাদের চাপ তৈরি করতে হবে। তবে তিনি বলেন, অভিন্ন নদীর পানিপ্রাপ্তিতে আমাদের আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোয় বিষয়টি উপস্থাপন করা যেতে পারে।
আসিফ নজরুল বলেন, দেশের মধ্যে সব প্রধান রাজনৈতিক দলকে ভিন্ন প্লাটফর্ম থেকে হলেও তিস্তা চুক্তির বিষয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। আগের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে সব মহল থেকে এ বিষয়ে অভিন্ন দাবি করতে হবে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীরব থাকার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকুক ভারত তা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে। আর ভারতের এ ধরনের পক্ষপাতিত্ব আওয়ামী লীগকে ভারতের প্রতি আরও দুর্বল করে রেখেছে। সে কারণে ক্ষমতাসীন দলটি ভারতের কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে বের হতে পারছে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সঠিকভাবে দেশ চালাতে হলে ভারতের নয়, দেশের জনগণের চাহিদা ও সমর্থনকেই গুরুত্ব দিতে হবে। (সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৫ এপ্রিল ২০১৪)
ভারতের মনোভাব জানার জন্য বাংলাদেশের অপেক্ষার বিকল্প নেই। নিজেদের সেচ কাজে তিস্তায় পানি সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ অনড় অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বোরো মওসুমের কারণে ভারতের নির্বাচনের ফল পর্যন্ত পানির অপেক্ষায় থাকা কৃষকের পক্ষে সম্ভব নয়।  বর্তমান পরিস্থিতিতে বিকল্প হিসেবে অগভীর নলকূপ বসিয়ে সেচের কাজ চালানো হচ্ছে। তবে এতে সেচের ব্যয় বেড়ে গেছে ১০ গুণের বেশি। অগভীর নলকূপ বসিয়ে পানি সেচে একর প্রতি তিন হাজার টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। তিস্তায় পানি থাকলে প্রতি একরে সেচের ব্যয় ৩৫০ টাকা। কিন্তু নলকূপে একরে সেচের খরচ দাঁড়ায় ৩৬০০ টাকা।
তিস্তায় পানি সংকটে বাংলাদেশে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হলেও পশ্চিমবঙ্গ নিজেদের চাহিদা মেটানোর প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের সঙ্গে বিরোধের কারণেও মমতা ব্যানার্জি তিস্তা চুক্তি সই করার বিরোধিতা করছেন। ভারতকে বঞ্চিত করে নয়, বরং প্রাপ্ত পানি সুষম বণ্টন করে তিস্তায় সেচ কাজ চালানো যেতে পারে। পাশাপাশি, বাংলাদেশ ও ভারতে ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা বিবেচনা করে তিস্তায় পানি প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে দুই দেশকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। তিস্তার অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনাতেও যেতে হবে।
আগামী দিনে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নত করার পথে তিস্তা ইস্যু বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এতে যারা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক চান না তারাই লাভবান হবেন। তাই এ সমস্যার সমাধান জরুরি ভিত্তিতে করতে দুই দেশকে কাজ করতে হবে।
গজলডোবায় পানি প্রত্যাহারের পরও এ সময়ে প্রাকৃতিকভাবে চার থেকে পাঁচ হাজার কিউসেক পানি আসার কথা। ভারত একতরফাভাবে পানিপ্রবাহ কার্যত বন্ধ করেছে। এটা অনৈতিক কাজ। এ বিষয়ে রাজনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক লাভজনক সমাধানে পৌঁছতে হবে।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter