Flickr

Friday, 8 May 2015

সমকামিতা

Posted by   on

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখন আমি অন্ধবিশ্বাসমুক্ত, এবং অনেকখানি সংস্কারমুক্তও বলা যায়। বাংলাদেশীদের গণ্ডি পেরিয়ে প্রচুর অবাঙালির সাথে আমার বন্ধুত্ব। তাদের সাথে চলছিল আমার সাংস্কৃতিক দেওয়া-নেওয়াও। তখন আমার বিদেশী বন্ধুদের যেকোনো ধরনের অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের সঙ্গে দুইটা মেয়েকে দেখতাম সব সময়। বন্ধুবান্ধবদের অনুষ্ঠানাদিতে ওই ‘বিশেষ’ দুটি মেয়ের উপস্থিতি ও তাদের প্রতি অন্যান্য সবার স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আমার মনকে বিষিয়ে তুলতো। ওদের দেখলে আমার সমস্ত আনন্দ মাটি হয়ে যেতো, মনের ভেতর ঘিনঘিন করতো। কারণ, মেয়েদুটি সমকামী কাপল ছিল। ওদের নাম এমি এবং রক্সি। মনে মনে ভাবতাম, আমার এই বন্ধুবান্ধবগুলি মন-মানসিকতার দিক থেকে এত ভালো কিন্তু এরা দুটি সমকামী মেয়ের সাথে মেশে কেন? ওদের মধ্যে রক্সি আবার শুধু সমকামীই নয়, রূপান্তরকামীও। ও মেয়ে হয়েও ছেলেদের কাপড় পরে, ছেলেদের মত করে চুল কাটে, ছেলেদের মত করে হাঁটে। সামান্য দূর থেকেও বোঝার উপায় নেই যে, সে একটি মেয়ে। আমি নিজের মনে ভেবে কূল পেতাম না, কেন এমন দুটি মেয়েকে এরা পার্টিতে নিমন্ত্রণ করে, কেন এদের সাথে হেসে হেসে কথা বলে, এদের সাথে না মিশলেই কি নয়, পৃথিবীতে কি বন্ধুত্ব করার জন্য মানুষের অভাব আছে এদেরকে বাদ দিয়েও? সমলিঙ্গের দুটি মানুষ পরস্পরের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক করছে এবং লিভটুগেদার করছে কেমন বিচ্ছিরি ব্যাপার না! মনে মনে রাখতাম আমার এইসকল মনোভাব ও চিন্তাচেতনা। কাউকে বলার তো উপায় নেই।
আমি ভুলেও কোনোদিন এমি ও রক্সির সাথে কথা বলতাম না। এমি ও রক্সির একটি মেয়ে আছে। নাম তার লিলিয়েন। লেসবিয়েন কাপলের আবার সন্তান থাকে কীভাবে- এই কৌতূহলে এক বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করলাম, ওদের মেয়ে এলো কোত্থেকে? উত্তর পেলাম, এমির মেয়ে লিলিয়েন। এমি আগে সমকামী ছিল না। তার প্রেমিক ছিল। সেখানেই লিলিয়েনের জন্ম। শুধু লিলিয়েন নয়, এমির আরো একটি ছেলেও রয়েছে। এমি একসময় পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্কে আগ্রহ হারায়, সমলিঙ্গের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। কী হতচ্ছাড়া তাজ্জব ব্যাপার!
আমার পরিচিত এক মহিলা বেবীসিটিং করে। একদিন তার সাথে রাস্তায় দেখা। ছোট্ট একটা বেবীকে নিয়ে সে রাস্তায় ঘুরতে বেরিয়েছে। বেবীটাকে ও দেখাশোনা করে। ওর সাথে টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছিল আমার। কথায়-কথায় একসময় সে বললো, জানো, এই বেবীটার দুইটা মা আছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম শুনে। আরে, তা কিকরে সম্ভব? সে বললো, ওর মায়েরা সমকামী কাপল। জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে বাচ্চা হলো কিভাবে। ও বললো, ইনজেকশন দিয়ে বাচ্চা নিয়েছে। আরো কয়েকটা সমকামী কাপলকে চিনি যারা বাচ্চা দত্তক নিয়েছে। মনে মনে ভাবতাম, বাচ্চার এত শখ হলে এরা সমকামী হতে গেছে কেন?
বাইরে যখন দেখতে পেতাম, কোনো সমলিঙ্গের মানুষ পরস্পরের হাত ধরাধরি করে হাঁটছে কিংবা গভীর ভালোবাসায় চুমু খাচ্ছে; মনটা তেতো হয়ে যেতো, চোখ ফিরিয়ে নিতাম এক ঝটকায়।
অনেক আগে ‘An unexpected love’ নামে একটা মুভি দেখেছিলাম। তাতে একজন বিবাহিত ও দুই সন্তানের মায়ের প্রণয় হয়ে যায় তার নারী সহকর্মীর সাথে। এক পর্যায়ে ব্যাপারটি সে তার স্বামীকে জানায়। স্বামী বেচারা বলে, কী অসম্ভব কথা বলছ তুমি, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! এমন কি মহিলার মা, আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব কেউই মেনে নিতে পারে না এইরকম ব্যাপার। একসময় ওরা দুই প্রেমিকাতে একসঙ্গে বাস করতে শুরু করে। এজন্য অনেক বন্ধু ওদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। কিন্তু তার কন্যা মেনে নিয়েছিল মায়ের এই সম্পর্ক এবং সে তার বাবাকেও তা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল। মনে মনে ভেবেছিলাম, এটা কী মুভি বানালো? সমকামিতাকে সমর্থন করে কেন মুভি বানালো? সমকামিতা একটা সমর্থনযোগ্য ব্যাপার নাকি?
আমি মুক্তমনায় আসার পর সমকামিতা নিয়ে অভিদার সবগুলি লেখা পড়েছি। তারপর পড়লাম উনার লেখা ‘সমকামিতা’ বইটি। জানলাম অনেককিছু। কোনোকোনো মানুষ জন্মগতভাবেই সমকামী হয়। কেউ কেউ প্রয়োজনের তাগিদে হয়ে ওঠে সমকামী। যেমন, জেলখানায় ও যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে সমকামী হয়ে ওঠে। স্কুল-কলেজের হোস্টেলেও ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ কিংবা অনেকে প্রয়োজনে কিংবা কৌতূহলে সমকামী হয়ে ওঠে। দীপা মেহতার ‘Fire’ মুভিতে দু’টি জা’য়ের মধ্যে সমকামিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাধা বড় জা। তার স্বামী এক ধর্মগুরুর কাছে নিজের জীবন নিবেদন করে দিয়েছে। বৌয়ের সাথে তার শারীরিক সম্পর্ক নেই। কী করবে রাধা? তারও ত শরীর জাগে। পেটের খিদের মত তার শরীরেও ত খিদে জাগে। কষ্ট বুকে চেপে নিয়ে দিন কাটিয়ে যায় সে। ঘর-সংসারের সমস্ত কাজ করে যায় নিখুঁত ভাবে, বিনা অভিযোগে। সীতার নতুন বিয়ে হয়েছে। তার স্বামীর প্রেমিকা আছে। সে ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রেমিকা নিয়ে সময় কাটায়। রাধা ও সীতা দুই জা পরস্পরের সাথে সুখদুঃখের কথা বলে। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। একসময় শুরু হয় শরীরের সম্পর্ক। প্রণয় স্থাপিত হয় দু’জনের মধ্যে। দুজন দুজনার জন্য শরীর ও মনের টান অনুভব করে। আস্তে আস্তে জানাজানি হয় ব্যাপারটা। শুরু হয় গণ্ডগোল। রাধার স্বামী তাকে বাজে ভাষায় গালি দেয়, তাকে মারে। পরে রাধা ও সীতা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। দুটি নারীতে একসাথে বাস করার সিদ্ধান্ত নেয়। রাধা ও সীতা জন্মগতভাবে সমকামী ছিল না। প্রয়োজনে সমকামী হয়ে ওঠে ওরা। সমাজ, সংসার, মানুষের ঘৃণা সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দুটি নারী পরস্পরকে ভালোবেসে হাত ধরে বেরিয়ে আসে রাস্তায়। প্রয়োজন বা কৌতূহলে যারা সমকামী হয় তাদের এই অভ্যাস কারু ক্ষেত্রে সাময়িক থাকে তার পরে চলে যায়, কারুর ক্ষেত্রে স্থায়ী হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো মানুষ থাকে উভগামী। শুধু মানুষের মধ্যে নয়, অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যেও রয়েছে সমকামিতা ও উভগামিতা। সমকামিতার কারণে সারা পৃথিবীতে কত মানুষ যে খুন হয়েছে, অত্যাচারিত হয়েছে এবং হচ্ছে তার কোনো হিসেব নেই। কিন্তু কেন? বিষমকামিতা যদি অপরাধ না হয়, তাহলে সমকামিতা কেন অপরাধ হবে? সমকামিতার জন্য কেন মানুষকে এত মূল্য দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে?
অভিদার ‘সমকামিতা’ বইটি শুধু পড়ার জন্যই পড়তে শুরু করেছিলাম। এই বিষয়ে জানার কোনো আগ্রহ ছিল না আমার। কিছু না জেনেই সমকামিতা ও সমকামীদের প্রতি ছিল আমার অযৌক্তিক ঘৃণা। বইটি পড়ে আমি যার পর নেই উপকৃত হয়েছি। জেনেছি, এর বৈজ্ঞানিক ব্যাপারগুলি ও খুঁটিনাটি সব। এই ব্যাপারে আমার মনোভাব সম্পূর্ণ পালটে গেছে। যৌনতা প্রতিটা মানুষের একান্ত ব্যাপার। দুপক্ষের মধ্য (তারা যে লিঙ্গেরই হোক না কেন) স্বতঃস্ফূর্তভাবে যদি কোনো সম্পর্ক হলে সেখানে অন্য কারুর নাক গলানো অন্যায়।
সমকামিতা বইটি পড়ে আমার মত অনেকেই উপকৃত হয়েছেন। তেমনি বইটি লিখে অনেক সমালোচিত হয়েছেন অভিদা। অধিকাংশ সমালোচক ও নিন্দুকই বইটি না পড়েই গালমন্দ করেছে। তাদের ভাষ্য হলো, অভিজিৎ নিশ্চয়ই সমকামী, নইলে সে সমকামিতার পক্ষে কথা বলছে কেন। কেউ কেউ বলেছে সবাই সমকামী হয়ে যাক তাই অভিজিৎ চায় নাকি, হেনতেন। তাদের উদ্দেশ্যে আমার প্রশ্ন, ‘নারী’ বইটি লিখেছেন ব’লে কি হুমায়ূন আজাদকে লিঙ্গ পরিবর্তন করে নারী হয়ে যেতে হয়েছিল? পশুর অধিকার নিয়ে কথা বলতে হলে কি কোনো মানুষকে পশু হয়ে যেতে হবে? আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে হলে কি কাউকে আদিবাসী হয়ে যেতে হবে? দাস প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার কি শুধু দাসদেরই? ধর্ষণের বিচার চেয়ে কথা বলতে হলে ধর্ষণের শিকার হতে হবে আগে? এসব বিষয় নিয়ে, এসব মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতে হলে এদের মন ও মনোবেদনা উপলব্ধি করতে পারা প্রয়োজন। মনে এদের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা থাকা প্রয়োজন। বঞ্চিত, অত্যাচারিত, নিগৃহীত মানুষের ব্যথাকে নিজের ব্যথা হিসেবে অনুভব করার মত মন থাকা প্রয়োজন।
আজ সমকামিতা সম্পর্কে আমার সকল ভ্রান্ত ও কুৎসিত ধারণা এবং মনোভাব কেটে গেছে। আগের বিশ্রী মনোভাবের জন্য এখন আমার অপরাধবোধ হয়। দুটি বিপরীত লিঙ্গের মানুষ পরস্পরের হাত ধরে হাঁটছে কিংবা চুমু খাচ্ছে; এই দৃশ্য আমার কাছে যেমন অপরূপ সুন্দর, তেমনি দুটি সমলিঙ্গের মানুষও পরস্পরের হাত ধরে হাঁটছে বা চুমু খাচ্ছে পরস্পরকে- এই দৃশ্যও আমার কাছে সমান অপরূপ সুন্দর। দুজন মানুষ একে অপরকে ভালোবাসে মন দিয়ে ,শরীর দিয়ে – এটাই হলো আসল কথা, তারা যে লিঙ্গেরই হোক না কেন।
আজ আমেরিকার প্রতিটা স্টেটে সমকামীদের বিয়ের বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এই অধিকার এমনি-এমনি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যুগযুগান্তর ধরে লড়লে হয়েছে এর জন্য। এই লড়াইয়ে কত যে রক্তক্ষয় হয়েছে, কত যে প্রাণক্ষয় হয়েছে, কত নিগ্রহ, কত নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে মানুষরূপী মানুষের হাতে অন্য মানুষকে কোনো লেখাজোখা নেই। বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হয় না, আভিদা। আপনি সমকামিতা নিয়ে কত লিখেছেন। কত লোকের কত মন্দ কথা শুনেছেন, বাংলাভাষায় অনেকটা একা লড়েছেন। আজ আপনি কোথায়, অভিদা? দেখুন, আমেরিকায় আজ সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রংধনুর রঙে ছেয়ে গেছে সমস্ত আমেরিকা, রংধনুর রঙে ছেয়ে গেছে অন্তর্জাল, রংধনুর রঙ্গে ছেয়েছে আপনার মুক্তমনা।আপনি যদি এই সুসংবাদ শুনতেন, যদি এই আনন্দ উচ্ছ্বাসের রঙ দেখতেন কত খুশি হতেন! কত কি লিখতেন এই বিজয়ের আনন্দে।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter