Flickr

Saturday, 30 January 2010

ধর্মহীন রাজনীতি মানুষের কল্যাণ সাধন করতে পারে না

 বাংলাদেশে স্বাধীনতা উত্তর সমাপ্তিকাল পর্যন্ত জনমনে একটি সাধারণ ধারণা ছিল যে সুদ ও ঘুষ গ্রহণ করা, চুরি করা, পরধন আত্মসাৎ করাসহ অন্যান্য অন্যায় ও অবৈধ কাজের মাধ্যমে অর্থোপার্জন করার প্রবণতা শুধু নিম্ন আয়ভুক্ত জনগোষ্ঠীর মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ তাদের বেতন মজুরী বা আয় রোজগার ছিল সীমিত। কোন কারণে সাংসারিক খরচ বৃদ্ধি পেলেও তাদের বৈধ আয় বৃদ্ধির কোন উপায় ছিল না। একমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের অসৎ পথ অবলম্বন করতে হতো। ওয়ান ইলেভেনের পরে উন্মোচিত ঘটনাবলী জনমনের সে ধারণা পাল্টে দিয়েছে। জনগণ বুঝতে পেরেছে যে শুধু অভাবীরাই দুর্নীতির কাজ করে না। দুর্নীতি এখন আর অভাবের তাড়না নয়। দুর্নীতি এখন বিলাসীদের বিলাস বাসনা চরিতার্থ করার পন্থা। যাদের আছে অনেক তাদের চাই প্রচুর। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শতবর্ষ আগে বর্তমান প্রবহমান পরিস্থিতির আভাস দিয়ে গেছেন তাঁর কবিতায়, তিনি বলেছেন, ‘‘এ জগতে হায় সেই বেশী চায়, আছে যার ভুরিভুরি। রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।' অগাধ বিত্ত বৈভবের মালিক হওয়ার নেশাটাই আজ দুর্নীতির মূল কারণ।

দুর্নীতির মাধ্যমে যারা বিপুল বিত্ত বৈভবের মালিক হয়েছেন তাদের আইন আমলে আনা হচ্ছে, বিচারান্তে শাস্তির বিধানও হচ্ছে। এত ধর পাকড়, কঠোর শাস্তি প্রদান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ভয়ভীতি প্রদর্শন দুর্নীতি পরায়ণদের দুর্নীতির কাজ থেকে বিরত রাখতে পারছে না। ধৃত দুর্নীতিবাজদের করুণ পরিণতি চাক্ষুষ দেখেও দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতির কাজে পুনঃ লিপ্ত হচ্ছে এবং ধরা পড়ছে। এ ঘটনা দেশের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এতে প্রমাণিত হয় যে শাস্তিবিধান দুর্নীতি রোধের পন্থা নয়। যে নৈতিক পদস্খলন আমাদের হয়েছে তা থেকে পরিত্রাণ লাভ সহজ নয়। এ দুর্ভাগ্য যেন আমাদের নিয়তি। এ দুর্ভাগ্য থেকে উত্তরণের কোনো উপায়ই কি আমাদের নেই? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই এ দুর্ভাগ্য থেকে উত্তরণের একটা মাত্র পথই আছে এবং তা হলো সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (দ:) বিদায় হজ্জে সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য সে সরল পথের দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন ‘আমি তোমাদের জন্য দুটি নেয়ামত রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা সে দুটি অাঁকড়ে রাখবে ততদিন তোমাদের ভয় নেই। ততদিন তোমাদের অনুতাপের অনলে দগ্ধীভূত হতে হবে না। তার একটি হলো আল্লাহর পবিত্র কালাম ‘আল কুরআন' অন্যটি হলো আমার হাদিস।' আখেরি নবীর এ সতর্ক বাণী হয় আমরা ভুলে গেছি, নতুবা বিশ্বাস করছি না। তাই তো রাজনীতিতে আমরা ধর্মের সংযোগ ঘটাতে চাই না। অথচ মানুষের কাছে ধর্মের আবেদন মানবের কল্যাণ এবং রাজনীতিরও তাই। আসলে আমরা চাই না সৎ জীবনযাপন করতে, সৎ উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন করতে, সততার সাথে আইন প্রয়োগ করতে এবং জনগণকে সৎ জীবন যাপনে অভ্যস্ত করানোর কর্মসূচী গ্রহণ করতে।

ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনে যারা বিরোধিতা করেন তারা কি বলতে পারেন তাদের জন্ম ও মৃত্যু এবং কর্ম ও জীবন ধর্মকে বাদ দিতে। ধর্ম সাক্ষী রেখে ধর্ম নির্দেশিত বাক্য উচ্চারণ করে বিয়ের মাধ্যমে তারা কি তাদের সংসার জীবন শুরু করেন নি? তারা কি বোঝেন না প্রতিটি মুহূর্তের জন্য ধর্ম আমাদেরকে বর্মের মত ধারণ করে আছে?
সাংসারিক জীবনে আমরা কথায় কথায় আল্লাহ ভরসা, ইনশাআল্লাহ্, আল্লাহ হাফেজ, আলহামদুলিল্লাহ। সোবহান আল্লাহ প্রভৃতি ধর্মীয় কথাগুলি উচ্চারণ করি। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করিয়াই তো আমাদের দাদা দাদি, নানা-নানির বিয়ে হয়েছিল ধর্ম মতে, মৃত্যুর পরে সৎকার করা হয়েছিল ধর্ম মতে, আমাদের জন্ম ধর্মমতে আমরা বর্ধিত হই দেহ ও মনে ধর্মের অনুশাসনানুযায়ী আমাদের আহার বিহার, আমাদের আচার আচরণ, কথাবার্তা, শিক্ষা দীক্ষা ধর্ম মতে। অথচ রাজনীতি করতে পারবো না, দল গঠন করতে পারবো না ধর্ম ভিত্তিক কেমন যেন একটু বৈপরিত্ব মনে হচ্ছে না? ধর্ম উচ্ছৃক্মখল আরব জাতিকে কুসংস্কার আর বর্বরতা থেকে উদ্ধার করে সুশৃক্মখল ও সুসভ্য উন্নত জাতিতে পরিণত করেছে। ধর্ম আমাদেরকে বর্মের মত ধারণ করে সকল পঙ্কিলতা থেকে রক্ষা করে। ধর্মহীনতার জন্য আজ আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে অমানিশার ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে। ধর্ম আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। বরং জীবনের পরতে পরতে আমরা ধর্মকে অাঁকড়িয়ে ধরে সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই। আমরা কোন মতেই কোন অবস্থাতেই ধর্মহীনতায় আচ্ছাদিত হতে চাই না। কারণ ধর্মহীন জীবন পশুর জীবন। জীবনের সকল স্তরে যদি আমরা ধর্ম অনুসরণ করে উন্নত জীবনের অধিকারী হতে পারি, তবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারবো না কেন?
সমাজের যারা কর্ণধার, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থানে যারা উচ্চাসনে আসীন সেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যাদের কার্য সম্পাদনের ওপর নির্ভর করছে দেশ ও দেশবাসীর মাঙ্গলিক অবস্থান তাদের মধ্যেই যখন দেখতে পাই দুর্নীতি, দুরাচারকারীদের অবস্থান তখন আর কার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করবো? দেশের এই নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতি থেকে এ সমাজকে এ দেশকে উদ্ধার করার একমাত্র উপায় হচ্ছে কুরআন ও হাদিসকে দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধরার শিক্ষা গ্রহণ আর জনগণকে শিক্ষা প্রদান করার কার্যক্রম গ্রহণ। অন্যায় ও অসৎ কার্য সম্পাদনের জন্য জবাবদিহিতা তো আল্লাহ সমীপে করতেই হবে একদিন। এই বিশ্বাসের নামই ঈমান। কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তি জীবনে প্রয়োগ করে, অনুসরন করে ঈমানের অধিকারী হওয়া যায়। ব্যক্তি হোক, সমাজ হোক বা গোষ্ঠী হোক, ঈমানের বলে বলীয়ান হতে পারলে বিপদের আর কোন ভয় থাকে না।

সংবিধান সীমিত জ্ঞানের অধিকারী মানুষের তৈরি। মানুষের তৈরি সংবিধানে ভুলভ্রান্তি থাকতেই পারে। সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের ওপর যদি কোন বিধি-নিষেধ আরোপিত হয়ে থাকে তবে সে বিধি-নিষেধ সংশোধন করা আবশ্যক। কারণ এ দেশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের। তারা ধর্মহীনতায় বিশ্বাস করতে পারে না। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের স্থান নেই। কোন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে কোন মতবাদ প্রবর্তন বা বিলোপের জন্য সম্পদ বিনষ্ট বা মানুষ হত্যা করার অভিপ্রায় কোন আন্দোলন ইসলাম অনুমোদন করে না। যে কোন সন্ত্রাসী তৎপরতা ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী গর্হিত কাজ। ইসলামী নাম ব্যবহার করে কিছু কিছু পথভ্রষ্ট গোষ্ঠী বোমাবাজি, হত্যা, ধ্বংস ইত্যাদি অসামাজিক, অনৈতিক, অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ করছে, আর দায় পড়ছে মুসলমানদের ওপর। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালায় সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীরা। দুষ্কৃতকারীদের কোন জাত বা ধর্ম নেই। দুনিয়ার তাবৎ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য এক তরফাভাবে দায়ী করা হয় মুসলমানদের। অথচ মুসলমানরা আল কুরআনের নির্দেশানুযায়ী সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করে তাদের ধর্মে সন্ত্রাসের কোন স্থান নেই। ফাসাদ সৃষ্টিকারীরা গোনাহ ক্ষমার অযোগ্য কর্ম। যে দেশের জনসংখ্যার ৮৫% ভাগই ইসলাম ধর্মের অনুসারী সে দেশের রাজনীতি ইসলাম ধর্মানুসারী হবে এটাই তো স্বাভাবিক। ইসলামী রাজনীতি এ দেশে অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে ইতিহাসের এটাই তো সরল সমীকরণ। এদেশে ইসলাম ভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করার শক্তি কারো নেই। বরং যে রাজনীতি ও তার প্রবক্তাগণ ধর্মহীনতায় আচ্ছন্ন সে রাজনীতি ও তার ধ্বজাধারীরা সঙ্গত কারণেই একদিন না একদিন কালের গহবরে বিলীন হয়ে যাবে। পৃথিবীর ইতিহাসে এর ভুরিভুরি প্রমাণ রয়েছে।
আজ যারা রাষ্ট্রকে, সমাজকে এবং ব্যক্তি জীবনকে ধর্মহীনতায় আচ্ছন্ন করার অপচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছেন একদিন তাদের তৌহিদী জনতার মুখোমুখি হতেই হবে এবং সেদিন খুব দূরে নয়।

Tuesday, 12 January 2010

দুর্নীতির আর এক রূপ

দুর্নীতির আর এক রূপ
‘মুজিবনগর সরকারের আত্তীকৃত কর্মচারীদের বয়স কত ছিল?' শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে ‘দৈনিক সংগ্রামে।' খবরে বলা হয়, মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে বিশেষ কোটায় কাস্টমস এবং ইনকাম ট্যাক্সসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনস্ত বিভাগসমূহে যাদেরকে সরাসরি নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের বয়স ও এসএসসি পাস বিবেচনা করা, তারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কিনা বা মুজিবনগর সরকারে ৮ বছর বয়সে কাজ করার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এডভোকেট ফজলে রাববী মিয়া। ডেপুটি স্পীকার এ ব্যাপারে সংসদ সচিবালয়ের সচিব বরাবর নোটিশ দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন।
খবরটি সঙ্গত কারণেই বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে পত্রিকায়। দেশের মানুষ দুর্নীতির অবসান চায়। সরকারও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদও ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, দুর্নীতি হ্রাসে সমর্থ হচ্ছে না সরকার। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন কোটায় চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা গেছে দুর্নীতির বিস্তার। তাই প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয়েছে সংসদেও। এদিকে আবুল কালাম আজাদের এক প্রশ্নের জবাবে সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন, মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে বিশেষ বিবেচনায় আত্তীকৃত ৪৩ জনের একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। এতে দেখা গেছে, সহকারী কর কমিশনার প্রতাপ চন্দ্র পালের জন্ম তারিখ ১/২/৬২, অর্থাৎ '৭১ সালে তার বয়স ছিল ৯ বছর। এই বয়সে কী করে তিনি মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হয়েছিলেন? একইভাবে দেখা যায়, পংকজলাল সরকারের (সহকারী কর কমিশনার, অঞ্চল-৭) জন্ম তারিখ ১০/১০/১৯৬১)। দশ বছরের কম বয়সে কি করে সরকারের কর্মচারী হলেন তিনি। অনুরূপ প্রশ্ন উঠেছে লুৎফর রহমানের ক্ষেত্রেও। যার জন্ম তারিখ ২/৮/১৯৬২। এ তালিকায় বয়সের যোগ্যতা নেই এমন আরো অনেকের নাম রয়েছে। অথচ মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে ১৯৭১ সালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বয়স কমপক্ষে ১৬ বছর এবং সরকারী কর্মচারী হতে হলে বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অর্থমন্ত্রী যে তালিকা পেশ করেছেন তাতে দেখা গেছে, মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে যাদের আত্তীকরণ করা হয়েছে তাদের প্রায় সবারই বয়স ১৬ বছরের নীচে। আর বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তাদের অনেকেরই তখন বয়স ছিল ৭, ৮, ৯ ও ১০ বছর।
আমরা জানি, মুক্তিযোদ্ধা হওয়া কিংবা সরকারী কর্মচারী হওয়ার বিষয়টি খুবই সম্মানের। এই যোগ্যতার মাধ্যমে দেশ ও জনগণের সেবা করা যায়। কিন্তু যোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে যদি তথ্যগোপন করা হয় কিংবা মিথ্যা তথ্য দেয়া হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তো শুরুতেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে গেলেন। এমন দুর্নীতিবাজ মানুষ আত্মসেবায় পারঙ্গম হতে পারেন কিন্তু তার থেকে দেশ ও জনগণের পাওয়ার কিছু নেই। বরং এসব দুর্নীতিবাজ মানুষ নিজেদের অন্ধকার দিক ঢাকার জন্য সব সময় সক্রিয় ছিল চাটুকারিতায়, তুষ্টিবিধানে ও রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডায়। ফলে কখনো বসের প্রশ্রয়ে, কখনো বা রাজনৈতিক আশ্রয়ে তারা নিজেদের একটি মহল গড়ে তুলেছে। দেশ দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি না পাওয়ার এটিও একটি বড় কারণ। এবার তো মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীদের তালিকায় দুর্নীতির একটি চিত্র স্পষ্ট হলো। এ ব্যাপারে সরকার কি পদক্ষেপ গ্রহণ করে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

Sunday, 10 January 2010

কলংকমুক্ত' বাংলাদেশে আইনের শাসন কতদূর?

কলংকমুক্ত' বাংলাদেশে আইনের শাসন কতদূর?
‘বঙ্গবন্ধু হত্যা' মামলার দন্ডিত মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হবার পর শাসক মহলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে : ‘জাতি কলংকমুক্ত হয়েছে' এবং ‘দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে'। তবে আইনের শাসনের ধ্রুপদ ও সার্বজনীন যে সংজ্ঞা বিশ্বময় স্বীকৃত, সেই মানদন্ডকে সামনে রাখলে এটা যে কতবড়ো জঘন্য মিথ্যাচার, তা পরিষ্কার হবে। যারা একদা বলেছিলেন যে, ‘‘আইনের শাসন নয়, বঙ্গবন্ধুর শাসন চাই,’’ আইনের শাসনের জায়গায় তারা দলীয় দুঃশাসন ও ক্ষমতার রোমহর্ষক প্রদর্শনীকে প্রতিস্থাপন করবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শনে অনুপস্থিত, এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত সত্য। সুতরাং আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীরা যখন আইনের শাসনের দোহাই দেন, তখন সেটা জনমনে আরও আতংক সৃষ্টি করে। একদিকে শাসক মহল যখন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন, তখন জামিনপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মুক্তি পেতে এটর্নি জেনারেলের অফিসের অনাপত্তি ছাড়পত্র লাগবে বলে সরকার জেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন। ইংরেজী দৈনিক ‘নিউএজ'-এর খবর : "AG's nod needed to release people given bail by HC; [30.01.10] এতে বলা হয়েছে : "The Jail authorities need clearance from the Attorney General office's to release the convicts even after securing bail from the High Court." এ ব্যাপারে এটর্নি জেনারেল অফিস থেকে জেল কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর ফলে গত এক সপ্তাহে জামিনপ্রাপ্ত ৬৯ জন অভিযুক্তের মুক্তি আটকে গেছে। আইন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন, সরকারের রাজনৈতিক নির্দেশে এটর্নি জেনারেলের প্রদত্ত এই নির্দেশনা আইন, মানবাধিকার এবং স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত লংঘন। শুধু তাই নয়, ঘটা করে বিচার বিভাগের যে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করে বিচার বিভাগকে নির্বাহী কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, এটা তার আপাদমস্তক খেলাফ এবং বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে সরকারি ফ্যাসিবাদী দুর্বৃত্তপনার ভয়ংকর নজির।
গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক শাসন তথা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে দেশকে একটা আতংকের ভাগাড়ে পরিণত করার ক্ষেত্রে সব দেশেই ফ্যাসিস্ট শাসকরা প্রথমে দু'টি প্রতিষ্ঠানকে আঘাতের চানমারী বানায়। এর একটি হচ্ছে স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং অন্যটি মুক্ত সাংবাদিকতা। বিচারিক স্বাধীনতা ও আইনের শাসনকে সরকার কিভাবে দেখছে বা দেখতে চায়, তা অতি কুৎসিতভাবে বিগত এক বছর ধরে এটর্নি জেনারেল আদালতেই প্রদর্শন করেছেন। এটর্নি জেনারেলের সন্ত্রাসের মুখে বিচারকরা পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, সরকার চাইলে হাইকোর্ট বিলুপ্ত করে দিতে পারেন এবং সরকার তার ক্ষমতার হাত প্রশস্ত করে বিচারকদেরও গ্রেফতার করে পুলিশি রিমান্ডে নিতে পারেন। মাননীয় বিচারকদের এই শ্লেষাত্মক মন্তব্যে এটর্নি জেনারেল লজ্জিত না হয়ে বরং উদ্দীপ্ত ও পুলকিত হয়েছেন। ধারণা করা হয়, এসব করে তিনি সরকারের হাইকমান্ডের আস্থা অর্জনের পরীক্ষায় শতভাগ নাম্বার পেয়ে গেছেন এবং মৃদুভাষী ভদ্রলোক বর্তমান আইনমন্ত্রীর চেয়ার দখলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। এটর্নি জেনারেলের ফ্যাসিবাদী কদাচারে উত্ত্যক্ত হয়ে প্রবীণ আইনজীবী এবং সাবেক এটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক বলেছেন, তিনি তার অর্ধশতাব্দীর আইনজীবী জীবনে এমন নিচু রুচি ও স্বভাবের এটর্নি জেনারেল আর দেখেননি। তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, এই এটর্নি জেনারেল বেঁচে থাকলে হাইকোর্ট বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর এটা ঘটাতে পারলে পঁচাত্তরের মতো সংসদীয় ক্যু ঘটিয়ে আর একবার বাকশাল গঠনের দরকার হবে না।
হাইকোর্টের বিচারিক আদেশে জামিনপ্রাপ্তদের মুক্তি পেতে এটর্নি জেনারেলের অফিসের ছাড়পত্র লাগার নয়া বিধান জারির মাধ্যমে আক্ষরিক অর্থেই হাইকোর্ট অকার্যকর এবং ক্রমবিলুপ্তকরণ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। সংবিধান বিচারিক রায়ের কার্যকরী বাস্তবায়নে সরকারের নির্বাহী বিভাগকে যে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে, তা প্রতিপালনের বদলে এটর্নি জেনারেল অফিসের হাতে বিচারবিভাগকে জিম্মি করে তাঁবেদার বানানোর ফরমান জারি করা হয়েছে। জেল কর্তৃপক্ষের ওপর এটর্নি জেনারেলের প্রদত্ত নির্দেশনামাটি যে আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ও বিচারবিভাগের পৃথকীকরণের সাংবিধানিক সিদ্ধান্তের পরিপন্থী, সেটা প্রমাণ করতে হাইকোর্টে আর একটি রীট দাখিল করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তবে এক্ষেত্রেও বিচারকরা স্বাধীনভাবে রায় দিতে পারবেন কিনা, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এটর্নি জেনারেলের কর্তৃত্বের পরিধি যদি সর্বোচ্চ আদালতের বিচারিক এখতিয়ারকে স্পর্শ করে, তাহলে উচ্চ আদালতের বিচারকদের সরকার রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে অতীতের মতোই একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করবে। দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহও মনে করে যে, সরকারের শাসন-প্রক্রিয়ায় বাকশাল ধাঁচের ফ্যাসিবাদী প্রবণতাগুলো প্রকটভাবে দৃশ্যমান। ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার' দন্ডিতদের ফাঁসিদানের পর সরকারের হাতে আরও যে কয়টি বিচার প্রক্রিয়া পেন্ডিং আছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে তাদেরকে বিচারবিভাগকে শৃক্মখলিত করা এবং বিচারকদের আতংকিত করার ক্ষেত্রে এটর্নি জেনারেলের অফিসকে মাস্তান বানিয়ে রাজনৈতিক নিপীড়নের আইনগত অস্ত্র হিসেবে অপব্যবহারের প্রয়োজন আরও বাড়বে।
মুক্ত ও স্বাধীন সাংবাদিকতাকে শৃক্মখলিত ও সন্ত্রস্ত করার নানা প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। মাত্র এক বছরের মাথায়ই সরকার বুঝতে শুরু করেছে যে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সংজ্ঞাটাও তৈরি করে সেটা সাংবাদিকদের ওপর চাপাতে হবে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলায় গ্রেফতার করার বিধান বাতিল করে একদিকে চমক দেখাতে চাইলেও এ আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ প্রবণতায় সরকারের সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। পার্লামেন্টে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাই তাদের অপছন্দীয় সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে আইনের রক্ষাকবচ তৈরীর কথাও বলেছেন। বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারবিরোধী মিডিয়ার বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে বরং গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কয়েকদিন পরই আমরা দেখছি যে, পার্লামেন্টারি কমিটির মাধ্যমে প্রস্তাব এনে নতুন করে মিডিয়াকে শৃক্মখলিত করার প্রস্তুতি চলছে। সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান অলি আহমদ বলেছেন : গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য তারা নয়া আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছেন। ‘নিউএজ' গত ২৮ জানুয়ারি/১০ এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে : "A Parliamentary panel on Wednesday recommended formulation of a law to consider publishing of news items without accurate information a punishable offence while another committee questioned the Government's move to amend a law to stop harassment of Journalists." তথ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বদলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির এই উৎসাহ কেন সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, হয়রানি ও মানহানিমূলক খবর বা মন্তব্য প্রতিবেদনের সংজ্ঞা নতুন করে নিরূপণ করা হচ্ছে কেন? বিরাজমান প্রেস কাউন্সিল এ্যাক্টেই এর সংজ্ঞা নিরূপণ করা আছে। সরকার প্রেস কাউন্সিলকে ঠুঁটো জগন্নাথের দায় থেকে মুক্ত করে একে কার্যকর ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান বানাতে না চেয়ে নতুন করে আইনী প্রক্রিয়ায় মিডিয়াকে শৃংখলিত করতে চায় কেন? বস্তুনিষ্ঠ এবং সঠিক তথ্যসম্বলিত রিপোর্ট ছাপতে হলে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের তথ্য-সূত্রগুলো উন্মুক্ত করতে হবে এবং মিডিয়ার জন্য তথ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। ‘তথ্য অধিকার আইন' পাস হবার পর আশা করা হয়েছিল, মিডিয়ার জন্য সরকারি পর্যায়ের তথ্যপ্রাপ্তির সকল আইনগত, প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতাগুলো অপসারিত হবে। সংবাদপত্রের জন্য তথ্যপ্রাপ্তি সহজতর হবে। কিন্তু তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নকে সরকার অতীতের মতোই অকার্যকর করে রেখেছে। অথচ বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পূর্বশর্ত হচ্ছে অবাধ তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। সরকার যদি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা প্রত্যাশা করে, তাহলে অবাধ তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। যদিও এই সামর্থ্য ও সদিচ্ছা সরকারের নেই।
ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক ‘আমার দেশ' সম্পাদক-প্রকাশক ও প্রতিবেদকদের জামিন মুভ করতে গিয়ে আদালতে এটর্নী জেনারেলের কাছে যে অভব্য-অশোভনীয় আচরণ পেয়েছেন, তার উল্লেখ করে বলেছেন, ‘‘কিছুদিন আগে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হলো, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হলে গ্রেফতারী পরোয়ানা ইস্যু হবে না। অথচ মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি সামান্য ব্যাপারে পরওয়ানা ইস্যু করা হয়েছে। আর তার পক্ষে এটর্নী জেনারেলের পুরো অফিস গত দু'সপ্তাহ ধরে ভেংগে পড়েছে। জয়-এর নাম সাতবার বলে তারা জয়-এর পক্ষে লড়াই করছে। অথচ জয়-কিন্তু কোনো মামলা দায়ের করেননি। এটর্নী জেনারেল অভদ্রভাবে আদালতকে ভয় দেখান। ভদ্রলোক বিচারকরা কি আর করবেন? এখন যা দেখছি, তাতে বিচারকদেরও অভদ্র হতে হবে। তারা দলবল নিয়ে গিয়ে আদালতে হৈ-হুল্লোড় ও গালাগালি শুরু করেন। আজও যেভাবে বিচারকদের বিরুদ্ধে বলেছেন, তাতে বয়স থাকলে তাদের বিরুদ্ধে-আদালত অবমাননার মামলা করে দিতাম। (সাপ্তাহিক বুধবার, সাক্ষাৎকার, ৬ জানুয়ারি/১০)
একটি সরকার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে কতটা সমৃদ্ধ এবং আইনের শাসনের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল ও আস্থাশীল তার মেনিফেস্টেশনটা এটর্নী জেনারেলের অফিসের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। বর্তমানে এটর্নী জেনারেল আইনের শাসনের সংস্কৃতির বদলে যে ধরনের চন্ডাল নীতির চর্চা করছেন, তাতে সরকারের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাও প্রতিফলিত হচ্ছে। তবে এটর্নী জেনারেল রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পেলেও তিনি রাষ্ট্রের পক্ষে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, দলীয় সরকারের ক্যানভাসার নন। সাবেক সামরিক একনায়ক এরশাদের সময়ও এটর্নী জেনারেল তার সাংবিধানিক পদমযার্দা রক্ষা করেছেন। বিগত ১/১১-এর অবৈধ কেয়ারটেকার সরকার যখন বিচারবিভাগকে রিমোট কন্ট্রোল প্রক্রিয়ায় চালিয়েছে, তখনও এটর্নী জেনারেল অফিসের এতটা অবক্ষয় দেখা যায়নি। একজন সম্পাদক ও তার সহযোগী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য মামলায় জামিনের বিরোধিতা করে এটর্নী জেনারেল তার সরকারের ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতার প্রমাণ দিয়েছেন। বিগত জোট সরকারের সময় সুপ্রীম কোর্ট বারের প্রতিনিধি হিসেবে বর্তমান এটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলমের স্বল্পসময়ের সাহচর্য পেয়েছিলাম প্রেস কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে। সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি হিসেবে সম্পাদক-প্রতিনিধিদের সাথে মিলে প্রেস কাউন্সিলের তদানীন্তন চেয়ারম্যান বিচারপতি এমএ সাঈদের নয়া প্রেস কাউন্সিল এ্যাক্ট প্রণয়নে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েও অদৃশ্য অপশক্তি ও আমলাতান্ত্রিক চক্রের জন্য সেটা অনেক দূর এগিয়েও মুখ থুবড়ে পড়ে। বর্তমান এটর্নী জেনারেলও নয়া প্রেস কাউন্সিল এ্যাক্ট তৈরির বিরোধিতা করে দালিলিকভাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট' দিয়ে এসেছেন। প্রেস কাউন্সিলের ফাইলে সেটা লিপিবদ্ধ আছে। অপসাংবাদিকতা-তথ্য সন্ত্রাস বন্ধ এবং বস্তুনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা নিশ্চিত করতে সাংবাদিক সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা প্রেস কাউন্সিলের সাথে সহমত পোষণ করেও সেদিন মাহবুবে আলমদের মতো জ্ঞানপাপীদের অসহযোগিতায় এবং অদৃশ্য অশুভশক্তির বিরোধিতায় তা পূর্ণতা পায়নি। বস্তুনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য শক্তিশালী ও কার্যকর প্রেস কাউন্সিল অপরিহার্য। প্রেস কাউন্সিলকে ঠুঁটো জগন্নাথ রেখে এটা সম্ভব নয়। শুধু ‘ভৎর্সনা' করার প্রেস কাউন্সিলকে এখন আর কেউ সমীহ করে না। এমনকি প্রেস কাউন্সিলের নোটিশ পর্যন্ত তথাকথিত আলোকিত পত্রিকার সম্পাদকরা গ্রহণ করেন না। প্রেস কাউন্সিলের বিচারিক রায় পত্রিকার জন্য ছাপা বাধ্যতামূলকও নয়। উপরন্তু একইভাবে অনেক পত্রিকা উপর্যুপরি অপসাংবাদিকতা করে ভৎর্সনা শুনে শুনে ধাতস্থ হয়ে গেছে। অপসাংবাদিকতা, তথ্য সন্ত্রাস এবং প্রতিপক্ষের চরিত্র হননই এদের সাংবাদিকতার মটো হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ভিন্নমতের মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করতে চায় বলেই মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণে নয়া আইন চায়। জোট সরকারের আমলে এটা তারা হতে দেয়নি। ইতোমধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াকে কয়েক দফা এডভাইস দেয়া হয়েছে। এখন সংসদীয় কমিটির সুপারিশের ওপর ভর করে সরকার দলীয় বৃত্তে মিডিয়াকে ধরে রাখতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী, উপদেষ্টা পরিষদ, প্রধানমন্ত্রীর পরিবারকে কোন মিডিয়া ‘টাচ্' করুক, সেটা সরকার চায় না। তারা মিডিয়া ও আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে চান। সরকার গণতান্ত্রিকভাবে শুদ্ধ এবং রাজনৈতিকভাবে স্বচ্ছ নয় বলেই মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করা তাদের জন্য মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা শুধু অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনেই নয়, ভারতের সাথে বিতর্কিত ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী চুক্তিসমূহ বাস্তবায়ন করতে সরকার মিডিয়াকে শৃংখলিত করতে চাইবে। তারা ‘বন্ধুদেশের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করা' তথা ‘নেতিবাচক সাংবাদিকতা' বন্ধের ব্যাপারে সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের নয়া নিবর্তনমূলক আইন তৈরির প্রয়োজনের কথা ভাবছে। যা একদলীয় বাকশালের রাজনৈতিক পূর্ব-রাগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার আগে আইনের শাসন, মানবাধিকার ও মিডিয়ার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আইনজীবী-সিভিল সোসাইটি ও সাংবাদিকদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে জোরদার প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি। অন্যথায় শুধুমাত্র রাজনৈতিক আন্দোলনের পাঁচমিশালী দাবির মধ্য বিচারবিভাগ ও মিডিয়ার স্বাধীনতা হারিয়ে যাবে। এদিকে সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বড়াই করলেও নতুন করে পুলিশী হেফাজতে থাকা অবস্থায় তাদের নির্যাতনে ঢাকায় একজন জাসাস-নেতার মৃত্যু হয়েছে। ক্রসফায়ার নয়, এবার পুলিশী হেফাজতে মানুষ হত্যা করে হৃদরোগে মৃত্যুর কাহিনী প্রচার করার কৌশল নেয়া হয়েছে। এ মর্মে ডাক্তারী সার্টিফিকেট আদায় করে হত্যা মামলাও অচল করা হবে। চট্টগ্রামে আরো একটি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। এর আগেরবার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মতিঝিল থানায় ছাত্রদল কর্মীর হত্যাকে জুতার ফিতায় আত্মহত্যা বলে বর্ণনা করা হয়েছিল।
এ অবস্থায় সরকারের আইনের শাসনের ভয়ংকর নমুনা দেখে দেশের মানুষ আতঙ্কিত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং বিএনপি'র চেয়ারপারসনের বাড়িতে রাত ৩-২০ মিনিটে আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে পুলিশ সমন নিয়ে হাজির হয়ে আর একটি কলংকজনক নজীর তৈরী করেছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা সংক্রান্ত এ সমন। বেগম খালেদা জিয়া দুই পুত্র, পুত্রবধূ ও নাতিদের ছাড়া অনেকটা নিঃসঙ্গ অবস্থায় বসবাস করছেন। যেখানে একজন সাধারণ নাগরিকের বাড়িতেও গভীর রাতে পুলিশ সমন নিয়ে হাজির হয় না, সেখানে পুলিশ যে অভব্য ঔদ্ধত্য দেখালো, সেটা সদ্য ‘কলংকমুক্ত' দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষেই হয়তো সম্ভব।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে চাঁদা নেয়ার অভিযোগে একাধিক মামলা হয়েছিল এক-এগারোর সরকারের সময়। এর সত্যাসত্য যাচাইয়ের আগেই রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চাঁদাদাতা মামলাকারী ব্যক্তিরা শরমেন্দা হয়ে মামলা তুলে নিয়ে পৈতৃক জীবন বাঁচিয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও রাজনৈতিক বিবেচনায় একাধিক দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলা হয়েছে। তবে শেখ হাসিনার মতো চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট মামলা একটিও হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা ও ক্ষমতার সুবাদে ওইসব মামলার প্রায় সবগুলোই বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়াই প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। তবে বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধী দলের অন্যান্য নেতার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কমিটি কোনো সুপারিশ করেনি। ক্ষমতায় থাকার সুবাদে আইনের শাসনের এই দ্বৈত ব্যাখ্যা দেশকে কতটা কলংকমুক্ত করবে, সে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
‘বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার' করে বিচারাদালত যে ১২ জনকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন, তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের মধ্যে একজনও রাজাকার বা তথাকথিত স্বাধীনতাবিরোধী নেই। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থানকারী কোন দলের লোকজন ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি যায়নি। ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর সেনাবাহিনীর সমর্থনে আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতা এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় আসেন। ১৫ই আগস্টের ঘটনা যদি শুধুমাত্র হত্যাকান্ড হতো, তাহলে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে তখন কোর্টমার্শাল বা বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু না করে কেন তখনকার সেনাবাহিনীর তিনটি বিভাগের প্রধান (যার মধ্যে তদানীন্তন বিমানবাহিনী প্রধান এবং বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী এ.কে. খন্দকারও আছেন) এবং সিভিল ব্যুরোক্রেসী মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ঐ সরকারের সফলতার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিল? এমনকি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পেয়েও তাঁর জীবন রক্ষায় ব্যর্থ তদানীন্তন সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ রাষ্ট্রদূতের চাকরি নিয়ে নিরাপদে বিদেশে চলে যান। দেশে এসে আওয়ামী লীগের এমপি হন। ৮৩ দিনের মোশতাক সরকারে যাঁরা মন্ত্রী ছিলেন, তাঁরা সবাই ভ্যাটার্ন আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। এমনকি বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেবার পূর্ব পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের গোটা সংসদই বহাল ছিল। ‘বঙ্গবন্ধুর কোন সৈনিক' সেদিন প্রতিবাদস্বরূপ সংসদ থেকে পদত্যাগ পর্যন্ত করেননি। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট ঘটনাকে রাজনৈতিক ইতিহাসের ভাষ্যকাররা কেবলমাত্র হত্যাকান্ড হিসেবে দেখেননি। তবে বিচারিক প্রক্রিয়ায় এটাকে ‘সেনা বিদ্রোহ' হিসেবেও মেনে নেয়া হয়নি। ফলে ১৫ই আগস্টের ঘটনাকে বিচারিক বিবেচনায় শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের হত্যাকান্ড হিসেবে দেখা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে অন্তহীন রক্তের দায় নিয়ে। হত্যার রাজনীতির সূচনাটাও করেছে এদেশে আওয়ামী লীগ। সিরাজ সিকদারের রাজনৈতিক হত্যার আগেও আওয়ামী লীগ অসংখ্য রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। এ সংখ্যা ৩৭ হাজার থেকে ৪০ হাজার। এসব হত্যার বিচার কেন হবে না? নাকি এসব হত্যাকান্ড সাফল্য ও বিজয়ের স্মারক? সার্ক এসব হত্যাকান্ডে দেশ কলংকিত হয়নি? ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অনুপ্রবেশ না ঘটলে রক্তপাত ছাড়াই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটতে পারত বলেও অনেকে মনে করেন। ১৯৭৫-এর ঘটনার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগও একদলীয় বাকশাল-এর কলংকমুক্ত হয়েছে। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় নবরূপে আবির্ভূত হয়েছে। ১৯৭৫-উত্তর ঘটনাকে ভারতের ইন্দিরা সরকার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে তাৎক্ষণিকভাবে মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির ট্রাজেডির জন্য শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বা তাঁর সরকার আনুষ্ঠানিক শোক প্রকাশ করেনি। পঁচাত্তর-উত্তর দীর্ঘ অর্ধযুগ শেখ হাসিনা দিল্লীতে ভারতের আতিথ্যে অবস্থান করা সত্ত্বেও তাঁর হাতে ভারত সরকার কোন শোকবার্তা তুলে দিয়েছে বলেও কারও জানা নেই। পশ্চিম বাংলার খ্যাতিমান সাহিত্যিক অন্নদা শংকর রায় ‘মুজিব হত্যার' ওপর লেখা ছাপতে পারেননি ভারতের কোন মিডিয়ায়। পশ্চিমবাংলার কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় মোশতাক সরকারের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটার অজুহাত তুলে ঐ লেখা ছাপার অনুমতি দেননি এবং অন্নদা শংকরের সন্তুষ্টির জন্য লেখাটির ইংরেজী ভাষ্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সমীপে পাঠিয়ে দেন। মিসেস গান্ধী অন্নদা শংকরকে জানিয়ে দেন, রাজনৈতিক কারণে ঐ লেখা প্রকাশ করার অনুমতি দেয়া যাবে না। দিল্লীর ইন্দিরা সরকার মুজিব-মুক্ত বাংলাদেশে মোশতাক সরকারকে কতটা গভীরভাবে আগলে রেখেছিল, তার আর একটি প্রমাণ পাওয়া যায় তদানীন্তন ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনের খন্দকার মোশতাকের সাথে ঢাকায় হাস্যোজ্জ্বল করমর্দনের ঘটনায়।
ইতিহাস চলমান। তাছাড়া ইতিহাস রাজনীতি-শাসিত কোন জড় বিষয় নয় কিংবা ইতিহাস সমকালীন আইনী সীমাবদ্ধতায় রচিত বিচারিক রায়েরও প্রতিবিম্ব নয়। উপরন্তু রাজনীতিতেও কোন শেষ কথা নেই। রাজনীতির মহানায়ক-খলনায়ক উভয়ই ইতিহাসের অংশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন মহলের সফলতা-ব্যর্থতা তাদের অনেক ভূমিকার নির্ণায়ক মানদন্ড হবে। ‘মুজিব হত্যার' অর্ধেক বিচার এখনও অসমাপ্ত। পেছনের ঘটনার চিত্রও অনুদ্ঘাটিত। এরপর রয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জেল হত্যার বিচার, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার, কিবরিয়া হত্যার বিচার, ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার মামলা, জঙ্গিবাদ দমন অভিযান, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, বিডিআর বিদ্রোহ, পিলখানায় সেনা হত্যার বিচার। তবে এর চেয়েও বড়ো এজেন্ডা হচ্ছে বিরোধী দল নির্মূল অভিযান এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচনে বা নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার গোপন অভিলাষ বাস্তবায়ন। কিন্তু এসব করতে গিয়ে সুশাসন এবং অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারসহ জনগণের জীবনকে সংকটমুক্ত করার কাজে সরকারের লীপসার্ভিস দেয়া ছাড়া আর কোন সময় ও সামর্থ্য থাকবে না। ভারতের সাথে বিতর্কিত চুক্তি বাস্তবায়নে ভারত এ সরকারকে সময় দেবে না। তড়িঘড়ি করার বাধ্যবাধকতায় সরকার আরও সমস্যায় পড়বে। প্রতিরক্ষা নীতিহীন প্রতিরক্ষা বাহিনীর দিক থেকে জনগণ মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জাতি-রাষ্ট্র রক্ষার লক্ষ্যে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের মানসিক প্রস্তুতির সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে। প্রতিরক্ষার সার্বভৌমত্ব ভারতের হাতে তুলে দিয়ে নব্য মীরজাফর জেনারেল মইন জাতি-রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিনাশের যে সূচনা করে গেছেন, আওয়ামী লীগ তাকে পূর্ণতা দিতে চলেছে। মুজিব হত্যাকারী, তাদের সমর্থক এবং সরকারের বিরোধী মহলকে সরকার চানমারীর টার্গেট করে রাজনীতিকে ১৯৭৫-পূর্ব ও পঁচাত্তরপরবর্তী ধারায় ভাগ করে দিয়েছে। রাজনীতির এই নয়া মেরুকরণ আওয়ামী লীগেরই অবদান। এখান থেকে ইতিহাসের আর একটি মোড় পরিবর্তনের সূচনা হলো।
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter