Flickr

Sunday, 27 May 2012

মাঠ গরম দেশপ্রেম

আমাদের দেশটা স্বাধীন হয়েছে বটে, কিন্তু এর সামাজিক, অর্থনৈতিক মুক্তি তো দূরের কথা, যে নতুন মন-মানসিকতা মুক্তিযুদ্ধ শেষে একটা দেশে আসার কথা তার ধারেকাছে দিয়েও যেতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ পেলে তাতে যে পরিবর্তন আসার কথা তা তো হয়নিই, বরং পুরনো সেই বৃটিশ থেকে পাকিস্তানি আমলে যা যেমন চলছিল যেন অনেকটাই তেমনি রয়ে গেছে। দেশের জমিন পাল্টায়নি তবে দখলদার পাকিস্তানিদের পরাজিত করে দেশমাতৃকাকে পুনরুদ্ধার করেছি। কিন্তু ওদের ফেলে যাওয়া আইনকানুন, ফাইলপত্র সবাই তুলে নিয়েছি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে।
ঢাকা বিপর্যস্ত। জনজীবন বিপন্ন। গরম, অতিষ্ঠ গরমে। প্রাণ আইঢাই করছিল সারাক্ষণ। মাঝেমধ্যে দখিনা বাতাস বইছিল। কিন্তু ওই বাতাস তো সবখানে ঢোকে না। রাজধানী শহর তো দালান কোঠায় ভরা। বস্তিও আছে বেশ। বস্তি তো আর অট্টালিকায় হয় না, সে যে ঘিঞ্জি কুঁড়েঘরের মতো ঘরবাড়ির মহল্লা। কোনোটা ঝুপড়ি, আবার কোনোটা ছোট ছোট খোপের দালান। বহু আগে দখল করা জায়গায় ঘর তুলেছে মালিকরা কেবলমাত্র ঝি, বুয়া, ঠেলাচালক, রিকশাওয়ালা, মুটে-মজুর, কুলি কিংবা পিয়ন-দারোয়ানদের জন্য। এসব বাড়িঘরে একটা কামরায় মা-বাবা, ভাইবোন এমন কি পুত্রবধূ কিংবা জামাইদেরও নিয়ে বাস করতে হয় সেসব বস্তিতে। কুলায় না যা রোজগার করে তাতে। করপোরেশনের ঝাড়ুদার-ঝাড়ুদারনি, (পরিষ্কারকর্মী বলে যাদের জাতে তোলার মহানুভবতা দেখিয়েছে সরকার কিংবা পৌর কর্তৃপক্ষ) তারাও বাসিন্দা হন এসব বস্তিতে।

 আমাদের দেশটা স্বাধীন হয়েছে বটে, কিন্তু এর সামাজিক, অর্থনৈতিক মুক্তি তো দূরের কথা, যে নতুন মন-মানসিকতা মুক্তিযুদ্ধ শেষে একটা দেশে আসার কথা তার ধারেকাছে দিয়েও যেতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ পেলে তাতে যে পরিবর্তন আসার কথা তা তো হয়নিই, বরং পুরনো সেই বৃটিশ থেকে পাকিস্তানি আমলে যা যেমন চলছিল যেন অনেকটাই তেমনি রয়ে গেছে। দেশের জমিন পাল্টায়নি তবে দখলদার পাকিস্তানিদের পরাজিত করে দেশমাতৃকাকে পুনরুদ্ধার করেছি। কিন্তু ওদের ফেলে যাওয়া আইনকানুন, ফাইলপত্র সবাই তুলে নিয়েছি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে।
সংবিধান পেয়েছি বটে মুক্তিযুদ্ধের সস্নোগানে কিন্তু তাকে বদলে ফেলেছেন জিয়া আর এরশাদ দুই আর্মি জেনারেল। সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে শাসন ক্ষমতার অধিকারী হয়ে তারা তাদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া ট্রেনিং বাস্তবায়িত করতেই ব্যস্ত। আবার মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করেননি পাকিস্তানিদের সঙ্গেই থাকতে ভালোবেসেছিল তিনিও যেমন, এমনি রাজনৈতিক উত্তরাধিকারে সমৃদ্ধ হয়ে একাত্তরে বন্দিজীবন যাপন করে আরেকজনও কোনো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পরিবর্তন আনতে পারেননি। সেই সঙ্গে অবশ্য সমর কর্মকর্তা এরশাদ সাহেবও মিলেছেন রাজনীতির ক্ষেত্রে।

 এরা যারা দেশটাকে শাসন করছেন কালে কালে, আমলে আমলে তাদের কথার ফুলঝুরিতে জনগণ-দেশবাসী অতিষ্ঠ। প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভেসে যায় দেশটাই। শুনলে মনে হয় যেন বাংলাদেশটা সোনায় মোড়ানো। কেবল একজন আরেকজনকে দোষারোপ করেন অপরাজনীতির, নোংরামির অথচ নিজেরা সিদ্ধহস্ত ওই ব্যাপারেও সংসদীয় রাজনীতির এমনি ধারা। আমাদের পাশের পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম শাসনকে তুলোধুনো করে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কংগ্রেস ঘরকে ছেড়ে এসেছিলেন তাকেই সঙ্গে নিয়ে প্রভুদের হুকুমে এক হয়ে বামফ্রন্ট বিশেষ করে সিপিএমকে পরাজিত করার লক্ষ্যে নির্বাচনী অভিযানে নেমে গেলেন প্রতিশ্রুতির পাহাড় তৈরি করলেন। কিন্তু কি দেখছি মমতার কর্মকা-। যে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তিনি কমিউনিস্ট বিরোধিতার মাধ্যমে মার্কিনি মদদ পেয়েছিলেন তার সেই দাবি পূরণে সব প্রতিশ্রুতি গিলে খাচ্ছেন। তাই জনগণ আজ রুষ্ট। পশ্চিমবঙ্গের স্খলিত এক গুরু বুদ্ধিজীবী_ যারা মনে মনে নিজেদের জনগণের দাবির সমর্থক বলে ভাবেন, তেমন লেখক, চিত্রকর, নাট্যাভিনেতা-নির্দেশক, গায়ক, চলচ্চিত্রকার প্রমুখ মমতার প্রতি যে মমত্ব দান করেছিলেন তারাও মুখ ফেরাতে শুরু করেছেন। গিয়েছিলেন কেন মমতার বাগাড়ম্বরের পেছনে, সেটা অনেকেরই প্রশ্ন। যাকগে ওদের কথা, আমরা যে প্রতিশ্রুতি দি, তা কি আদৌ পূরণ করার চেষ্টা করি? যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ১৪ দল আর এরশাদদের নিয়ে গড়া মহাজোট, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর চার বছর চলছে সেসব নির্বাচনকালে দেয়া ও ছাপানো প্রতিশ্রুতি কি পরিপূর্ণভাবে পালন করতে পেরেছেন মহাজোট সরকার? আমার মনে হয় মানুষকে বা ভোটদাতা মানুষদের নিজেদের প্রতি প্রলুব্ধ করাটাই তখন উদ্দেশ্য থাকে। 'আগে তো জিতি, পরে দেখা যাবে' এমন মনোভাবই কাজ করে তখন। তাই ক্ষমতায় চড়ে বসেন আর সেই প্রতিশ্রুতি, ঐক্য, অঙ্গীকার_ কোনো কিছুই কেউ মনে রাখে না। তখন ক্ষমতাসীনরা ভাবেন, আমরা ক্ষমতার অধিকারী, এখন যা করব তাই জনসাধারণ সবাইকে মানতে হবেই। খানিকটা প্রতিশ্রুতি মোতাবেক কাজ করেন বটে কিন্তু বেশিরভাগই নিজেদের খামখেয়ালিপনার বহিঃপ্রকাশ কিংবা ক্ষমতার দাপট হিসেবে প্রতিভাত হতে থাকে। যার জাঁতাকলে পিষ্ট হন সাধারণ মানুষ।...ক্ষমতায় যাওয়ার পর রাজনীতিকরা যখন আমলাদের হাতে পড়েন তখন আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচ এবং আইন-কানুন-রীতি-পদ্ধতিগত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বাঁধা পড়ে যান। ফলে নির্বাচনের আগে উদারভাবে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। তখন কিন্তু আমলাদের কারসাজিতে রাজনীতিবিদ বা সংসদ সদস্যদের প্রতিশ্রুতি অনেকটা গিলে খেতে হয়। এমন পরিস্থিতি পড়লে রাজনীতিবিদ মন্ত্রিবর্গ আমলাদের ওপরই নির্ভর করতে বাধ্য হন। ফলে রাজনীতিকরা ক্ষমতা হাতে পেয়ে সবকিছু 'লেজে গোবরে' করে ফেলেন। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে যে কোনো সরকারকে আমলাতন্ত্র নির্ভরতা কমিয়ে জনকল্যাণের চিন্তায় নিবেদিত হতে হবে। অবশ্যই দলীয় প্রাধান্য দেখা চলবে না। নিজেকে জনগণের দুঃখ-কষ্টের অংশীদার ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সাধারণ মানুষের কথা মনে রাখতে হবে, কিন্তু নির্বাচিত ব্যক্তির ক্ষমতা কিংবা বিত্তের নিরিখে নয়, মানুষের প্রয়োজন চিন্তা করে। তারপর সরকারকে ভাবতে হবে কিভাবে জনগণের এই দুর্দশা দূর করা যায়।

 বিরোধী দলে থাকলে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর আশ্চর্য আচরণ দেশবাসীকে কিছুটা বিস্মিত করে। এখন যেমন দেখছি বিরোধী দলের 'কীর্তিনাশা' ভূমিকা। তারা সরকারের যা কিছু দেখছেন তারই বিরুদ্ধে কথা বলছেন গলা উঁচিয়ে। যে সিদ্ধান্তই নিক সরকার তা যদি তাদের পছন্দ না হয় তবে তার বিরোধিতাই নয় 'মুখের অমৃতবাণী'তে যেন ক্ষমতাসীনদের গায়ের চামরাই তুলে নেবে। প্রতি মুহূর্তে সরকারের সমালোচনা তো আছেই, তার সঙ্গে মাঝে মধ্যেই সরকারকে ফেলে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। ঠিক আছে, দিন। কিন্তু সেই সঙ্গে বিরোধী বা ক্ষমতা প্রত্যাশী দল হিসেবে দেশ ও দশের পক্ষে কল্যাণকর কাজগুলোও তো করতে পারেন। তা না করে যেসব কা-কারখানা করছেন এ দেশের দুই প্রধান দল, যা মানুষের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। জনগণ বাধ্য হয়ে এদের দুজনকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করছেন। হতাশ হয়ে বিরুদ্ধে যাচ্ছেন আবার অন্যদলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনছেন। এতে কি দেশের কোনো উন্নতি হচ্ছে, না ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতা প্রত্যাশীদের সুযোগ-সুবিধা বেড়ে যাচ্ছে? নাকি ওদের বিত্তবৈভব বেড়ে যাচ্ছে মানুষের চেয়ে।

 আজ যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের মধ্যে প্রধান শরিক হলো আওয়ামী লীগ। শক্তিশালী প্রবল রাজনৈতিক দল। জনপ্রিয় বলে দাবি করেন। তাদের নেতৃত্বে যে ১৪ দল এবং পরে এরশাদের অনুপ্রবেশ অথবা দলে ভিড়িয়ে যে মহাজোট গঠন করে যে বিপুল সম্ভাবনার আশ্বাস জনগণকে দেয়া হয়েছিল আজ তার কি অবস্থা? যে এরশাদকে দলে ভিড়িয়ে নির্বাচনী এবং সংসদীয় শক্তি বৃদ্ধি করার কৌশল অবলম্বন করেছিল আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দল আপত্তি করেছিল তাই আজ ফলপ্রসূ হচ্ছে। এরশাদের জীবন সায়াহ্নে আরেকবার রাষ্ট্রের নিয়ন্তা হওয়ার খায়েশ এবং আবদার শুনতে পাচ্ছি তা কি মহাজোট অনৈক্যের ঈঙ্গিতই করছে না। এরশাদ তো একা নির্বাচন করতে ঘোষণা দিয়েছে একাধিকার। তার বিরুদ্ধে যে মামলা সেটা অবশ্য আওয়ামী লীগ, বিএনপি দুই দলের হাতে তাকে কাজ করার হাতিয়ার। অনেক মামলা তো খতম করে মুক্ত হয়ে গেছেন জেনারেল এরশাদ। তারপরও বুঝি আছে মামলা, তার জন্য আবার এরশাদই পার্লামেন্টে বক্তৃতা দিয়ে হাসিনাকে তোষামোদ করে বলছেন আপনিই পারবেন। কথা বলার সময় গলার উচ্চস্বর শ্রোতাদের কি বোঝার সুযোগ দেয়? একবার এদিক, একবার ওদিক_ এই যে 'দোদেল বান্দা'র মতো আচরণ এসব কি জনগণের কোনো উন্নতি, কল্যাণ বয়ে আনতে পারে? নাকি ব্যক্তি স্বার্থ কেবল সার্ভ করে?

সরকারের মধ্যে কেন এমন দৈন্যদশা যে প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিদিনই খালেদা জিয়া বা তার বিএনপি দলের কটূক্তির জবাব দিতে হবে? এমন কেউ কি নেই এর জবাব দেয়ার মতো। প্রধানমন্ত্রী কেন অন্য কাউকে দিয়ে বিরোধী দলের জবাব দেয়ান না। প্রধানমন্ত্রী তো সরকার প্রধান, তার পক্ষে কি এতটা নিচে নামা উচিত। অবশ্য দুএকজন যে বলেন না, তা নয়। কিন্তু তার তো ওজন থাকতে হবে, গলাবাজি, বাকোয়াস অথবা বিরোধিতার জন্য সব বললে তো হবে না।

 মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এ কথা ঠিক অনেক কিছুই আপনার সরকার করেছে, যা অন্যরা এতদিনেও করতে পারেনি। কিন্তু নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার আশ্বাস ছিল। তা কিন্তু হয়নি। বাজার প্রচ- গরম। নানা পণ্যের কী যে দাম! সহ্য করা যায় না। যে পণ্য এই মাটিতেই জন্মায়, এ দেশেরই বীজে তার কেন এত দাম? অথচ উৎপাদক পর্যায়ের গরিব মানুষ ন্যায্যমূল্য পান না। ফরিয়া-দালাল, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, সিন্ডিকেট নামক বিষবৃক্ষের উৎপাতে মুনাফা লোভের শিকারে পরিণত হচ্ছেন দেশবাসী। এই সিন্ডিকেট কিংবা অসৎ ব্যবসায়ীদের মুনাফাখোরী মানসিকতা কি নির্মূল করার দায়িত্ব সরকারের নয়? এ ব্যাপারে আপনারা কেন জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক সরকার হয়েও ব্যর্থ হচ্ছেন? এই সঙ্কট সমাধানে যদি আত্মপ্রত্যয় না থাকে আত্মজিজ্ঞাসা করুন নিজেদেরই কেন করতে পারছেন না। আমদানিকারকরা ট্রাকের ভাড়া তেলের দাম এমনকি পথে পথে চাঁদাবাজির অভিযোগ তোলে এগুলো কি সরকারেরই নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব নয়? পুলিশ কি করে? যদি সর্ষেই ভূত থাকে তবে সারাবেন কি করে? এ কথা তো কেবল এখন প্রযোজ্য নয়, সব আমলেই একই যন্ত্রণা। কিন্তু মানুষের দুর্ভোগ যত সময় যাচ্ছে ততই বাড়ছে। এর কি কোনো সমাধান নেই। এই তো সেদিন আমাদের মান্যবর অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে জিনিসের দাম অনেক কম।... কথাটা সত্যি। কিন্তু অন্য দেশের তুলনায় আমাদের আয় কত, এ তো তিনিই জানেন।

 জ্বালানির দাম বাড়ছে, বিদেশে বেড়েছে বলে। কিন্তু পেয়ারা কি জ্বালানিতে ফলে, তবে এর দাম এ তো বেশি কেন? তরিতরকারির কথা ছেড়েই দিলাম, এমনকি চালের দামের কথা ছেড়েই দিলাম। আমরা ধন ধান্যে পুষ্প ভরা দেশ, কিন্তু চালের ঘাটতি পূরণে কেন অন্যের কাছে হাত পাততে হয়। যে ভিয়েতনাম মার্কিনি নাপাম বোমায় বিষাক্ত মাটিতে পরিণত হয়েছিল তার উৎপাদন ক্ষমতা এত বাড়ল কি করে আমাদের পরে পরাধীনতার নাগপাশ মুক্ত হয়ে। যদি বলি আমাদের দেশপ্রেমের অভাব। তবে অনেকে ধৃষ্টতা মনে করবেন। যদি দেশপ্রেম থাক তো তবে কেন আমাদের মুক্তির ৪০ বছর পরও কাঁদতে হয়? হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের কারণেই এমন ঘটছে। তাহলে কি প্রশ্ন করা যায় না, কেন এমন হলো? মুক্তিযুদ্ধের শেষে যে দেশ আমরা চেয়েছিলাম তা পেলাম না কেন? বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তিন বছর কিছু দিতে পারবেন না, সেটা তো জনগণও মেনে নিয়েছিলেন। কারণ দেশ তো যুদ্ধবিধ্বস্ত। কিন্তু যে জনগণ মুক্তিযুদ্ধে দেশমাতৃকাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করেছেন বুকের পাজরে লড়াই করে সেই মানুষকে কেন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অপশক্তি এবং পরাশক্তিকে মেনে নিতে হয়েছিল? তাইতো দেখি যে আমেরিকা মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করতে নৌবহর পাঠিয়েছিল বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়কে ঠেকাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিল ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা, মুক্তিফৌজের অদম্য দেশপ্রেম ও প্রবল যুদ্ধজয়ের আকাঙ্ক্ষা বুকে ধারণ করে নিপীড়িত মানুষের ঐক্যে যে মুক্তিযুদ্ধ জয় করেছি সেই রক্তোৎপল অর্জন এই বাংলাদেশ কেন আজ বিপন্ন ওই সাম্রাজ্যবাদী নেকড়ের কূটকৌশলী থাবায়?

তেল, গ্যাস আমাদের সম্পদ। আমরাই যোগ্য এবং দক্ষ এ উত্তোলনে। কেন বিদেশিদের ডাকা হচ্ছে? যে সহযোগিতাটুকু নেয়া দরকার তার বেশি কেন আনছি? কয়লা নিয়ে একই কেলেঙ্কারি। এসব জায়গায়ও মার্কিনি স্বার্থ জড়িত? জনগণ যেখানে উত্তোলন পদ্ধতি নিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করছেন, জান বিসর্জন দিতেও তারা প্রস্তুত তবে কেন সরকারের উপদেষ্টা সেটা চাইছেন না। তারা সেই সম্পদ অপহরণকারী মার্কিনিদেরই ডেকে আনছেন? দেখছেন তো পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ জোগান দেয়ার আশ্বাস তাদের ছিল। বাংলাদেশও আশান্বিত হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অজুহাতে অর্থায়ন না করার পথ বেছে নিয়েছে। আমরা কি এতদিন পর বুঝতে পারছি বিশ্বব্যাংক কিভাবে কব্জা করতে চায় আমাদের? যা তাজউদ্দীন আহমদ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেই বুঝতে পেরেছিলেন?

দেশে কী ঘটছে? আমেরিকার দূত আন্ডার সেক্রেটারি বা কর্তাব্যক্তি যেই আসুক দেশে তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপির দুই নেত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। এবারে তো জেনারেল এরশাদের সঙ্গেও দেখা করেছেন। ওরা যা বলছে তাই কি শুনতে হবে? যুদ্ধাপরাধীর বিচার স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ হওয়া চাই। দুই দলের আলোচনা চান ওরা। দেখলাম তারই বোধহয় প্রভাবে বিএনপি সরকারের সঙ্গে বসতে রাজি। এটা করতে হবে, ওটা এভাবে করুন ডিকটেট করছে মার্কিনিরা। কেন? আমরা কি ওদের কথায় ওঠবস করব? সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ না দিলে কি আমরা দক্ষ সৈনিক হতে পারি না? মার্কিনি দক্ষতা আমাদের দরকার নেই।

 এসব আবহাওয়ায় প্রকৃতির সঙ্গে তথাকথিত রাজনীতি গরম হয়ে উঠছে। কারণ ২০১৩-তে নির্বাচন। বিরোধী দল তিন বছর সংসদে কদিন ছিল দেশের মানুষের জন্য কি করেছে? কেবল মাঠ গরম করলেই চলবে না।

Sunday, 20 May 2012

জাতীয় শিক্ষানীতিতে কওমি মাদ্রাসা

কওমি মাদ্রাসাগুলোকে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার দাবি দীর্ঘদিনের। এ দাবি যেমন কওমি মাদ্রাসার অভ্যন্তরে, তেমনি বাইরেও। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে এ মাদ্রাসা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনুভব করেছেন_ তারা সমাজের উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নানা ক্ষেত্র থেকে যেমন, তেমনি পেশাগতভাবে পিছিয়ে পড়েছেন। ফলে কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতির দাবিটি বহুবার উচ্চারিত হয়েছে। অন্যদিকে, সমাজের নানা মহল থেকে কওমি মাদ্রাসার সংস্কারের প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু অতীতের সরকারগুলোর বিশেষ মনোযোগ পায়নি কওমি মাদ্রাসাগুলো। সেদিক থেকে কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতিদানের উদ্দেশ্যে একটি কমিশন গঠন প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এ জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সাধুবাদ জানাতে হয়। জাতীয় শিক্ষানীতিতে এ ধরনের একটি কমিশন গঠনের সুপারিশ ছিল। কওমি মাদ্রাসা-সংশ্লিষ্ট আলেমদের নিয়ে গঠিত কমিশন একটি ইতিবাচক দিকনির্দেশনা দিতে পারবে বলে সবাই আশা করেন। তবে কমিশনের সফলতা নিশ্চিত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দরকার। বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা অনেক। মোটামুটিভাবে প্রধান ৫টি বোর্ড ও ১৩টি আঞ্চলিক বোর্ডের মাধ্যমে মাদ্রাসাগুলো পরিচালিত হয়। মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষা পদ্ধতি, সিলেবাস, পরীক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন ইত্যাদিতে তারতম্য আছে। নানান ধারার মাদ্রাসার মধ্যে সমন্বয়ই হওয়া উচিত কমিশনের প্রধান কর্তব্য। এ কাজটি করতে হলে প্রতিনিধিত্বশীল আলেম ও ধর্মীয় শিক্ষাবিদদের কমিশনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে অথবা কমিশনের সুপারিশে তাদের মতামতের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। বর্তমানে মাদ্রাসাগুলোতে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে অনেক মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রমকেই সুপরিকল্পিত বলার উপায় নেই। ১৭ বছরের দরসে নিজামিয়া সম্পন্ন করতে কোনো কোনো মাদ্রাসা ৬ থেকে ১২ বছর মেয়াদি সিলেবাস গ্রহণ করেছে। ফলে শিক্ষার মানে অনেক তারতম্য ঘটছে। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রম স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভাগ করে স্কুল ও কলেজ পর্যায়কে আলাদা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনার কথা। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই গরিব। মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পন্ন করার পর শিক্ষার্থীরা যাতে সমাজের বোঝা হয়ে না দাঁড়ায় সেজন্য সিলেবাসে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিত, ইতিহাস, ইংরেজিসহ বিভিন্ন কোর্স যুক্ত হওয়া দরকার। বর্তমানে মাদ্রাসাগুলোর সিলেবাসে আরবি-ফার্সির পাশাপাশি উর্দুর ব্যবহার থাকলেও বাংলা ভাষার উপস্থিতি একেবারেই কম। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে আলেমদের ভাবতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষা একটি বিশেষায়িত ধর্মীয় শিক্ষা। বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থায় সাযুজ্য আনতে হলে একটি সমন্বিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা, শিক্ষক নিয়োগসহ মাদ্রাসা পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে স্বচ্ছ নীতি প্রণয়ন করা দরকার। সম্প্রতি বিভিন্ন মাদ্রাসা নিয়ে গণমাধ্যমে নানা বিতর্ক দেখা দিয়েছে। অভিযোগ এসেছে মাদ্রাসাগুলোর অর্থায়ন নিয়ে। ধর্মীয় শিক্ষার মতো একটি ক্ষেত্রে এমন অভিযোগ থাকা উচিত নয়। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অভিযোগ না ওঠে সেজন্য মাদ্রাসার আয়ের উৎসগুলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে উলি্লখিত হওয়া উচিত। পাশাপাশি ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ তদারকির ব্যবস্থা থাকা দরকার। সবচেয়ে বড় কথা, দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে কত মাদ্রাসা আছে, সেগুলোতে ছাত্রের সংখ্যা কত তার একটি সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের সহায়তায় তৈরি হওয়া দরকার। মহিলা মাদ্রাসাগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে সে বিষয়টিও কমিশনের বিবেচনায় থাকা উচিত। আমরা আশা করি, কমিশনের কার্যক্রমে বিভক্তির চেয়ে সমন্বয়ের বোধটাই প্রাধান্য পাবে। রাজনৈতিক ভেদাভেদ, দ্বিমত ভুলে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের দিকে কমিশনের মনোযোগ থাকলে সেটিই হবে আশার কথা।

Monday, 7 May 2012

সবগুলো বিরোধী দলকে ক্রাশ করার জন্য সরকারের সর্বাত্মক হামলা

সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন যে, ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনায় পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই জড়িত থাকতে পারে। তাছাড়া জামায়াত ও জঙ্গিরাও এই ঘটনার সাথে জড়িত থাকতে পারে। গত শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ‘‘সরকার সকল ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে অবগত। কিন্তু সরকারে থাকার কারণে আমরা অনেক কিছু বলতে পারি না।’’ (মানবজমিন : ০৫.০৫.২০১২)। ঘাদানিকের সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান থেকে এ দেশে গুম  ও হত্যার রাজনীতি আমদানি করেছে। ইলিয়াস আলীর ঘটনার পেছনেও এই জামায়াতে ইসলামীর হাত থাকতে পারে। এই বিষয়ে আমাদের মন্তব্য এই নিবন্ধের তৃতীয় পর্বে পেশ করব। তার আগে প্রায় দুই শতাধিক জাতীয় নেতার বিরুদ্ধে হামলা এবং মামলার বিষয়ে আলোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে।

হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু হয়েছিলো বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ইলিয়াস আলীর অপহরণের প্রেক্ষাপটে। সেই আন্দোলন শেষ হওয়ার আগেই সরকার এমন হঠকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করল যে আন্দোলন একটি নতুন ডাইমেনশন পেলো। ইলিয়াস আলী কেন্দ্রিক আন্দোলন দমাতে গিয়ে এখন সরকার শুধুমাত্র বিএনপি নয়, বরং ১৮ দলীয় জোটকে অর্থাৎ সমস্ত বিরোধী দলকেই নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। বিএনপি ও ১৮ দলের অন্তত ৫২ জন শীর্ষ নেতার মাথায় গ্রেফতারের খড়গ ঝুলছে। বিরোধী দলসমূহকে আওয়ামী লীগ জোর করে সংঘর্ষের পথে ঠেলে দিয়েছে। এখন পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে এখান থেকে বিরোধী দলের ফেরার আর কোনো পথ খোলা নেই।

আওয়ামী লীগের জয়েন্ট জেনারেল সেক্রেটারি মাহবুবুল আলম হানিফ এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহম্মদ নাসিম সেদিন যা বলছেন সেটি সামগ্রিকভাবে সরকারের আত্মতুষ্টিকে প্রতিফলিত করেছে। তারা একজন বলেছেন যে, এক মামলাতেই নাকি বিরোধী দলের আন্দোলন ঠান্ডা। আর নাসিম বলেছেন যে, মামলার ভয়ে যেখানে ৫০ নেতা পালিয়ে বেড়ান সেখানে তাদের দ্বারা আন্দোলন হয় না কি? মনে হচ্ছে যে তারা দু'জনই সরকারি মনোভাবের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এটাই যদি সরকারের সর্বশেষ মনোভাব হয়ে থাকে তাহলে তারা মারাত্মক ভুল করছেন। ১৮ দলের আন্দোলন থেমে যায়নি। প্রথম সারির সব নেতার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করার পর স্বাভাবিকভাবেই সেকেন্ড লাইন অব ডিফেন্স ঠিক করার প্রয়োজন ছিলো। এই জন্য বেগম খালেদা জিয়া গত বুধবার রাতে কয়েকজন নেতাকে ডেকেছিলেন। এদের বিরুদ্ধে এখনো গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়নি। তাদেরকে বলেছেন যে, যেসব নেতা এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন তারা আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বের হয়ে না আসা পর্যন্ত সেকেন্ড লাইন আন্দোলন পরিচালনা করবে। এই সেকেন্ড লাইনের সদস্যদের নিয়মিত অফিস করার জন্য এবং সারা মফস্বল জুড়ে তৃণমূল পর্যায়ে নেতা ও কর্মীদেরকে দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য বেগম জিয়া তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন।

 আওয়ামী নেতারা বলেন যে আন্দোলন নাকি শেষ হয়েছে। আন্দোলন যে শেষ হয়নি সেটা তারা দু'এক দিনের মধ্যেই টের পাবেন। গত ৩ মে থেকে ৬ মে পর্যন্ত বাংলাদেশে পৃথিবীর ৩টি গুরুত্বপূর্ণ দেশের ৩ জন অতীব গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্মানিত রাষ্ট্রীয় মেহমান হিসেবে বাংলাদেশে অবস্থান করেছেন। এরা হলেন জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী, ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জী এবং আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। আওয়ামী লীগের মতো ১৮ দলীয় জোট মারদাঙ্গা দায়িত্বহীন বিরোধী দল নয়। তাই বাংলাদেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই ৩ জন সম্মানিত বিদেশী মেহমানের প্রতি সম্মান দেখানোর উদ্দেশে বিরোধী দল মাত্র কয়েক দিনের জন্য আন্দোলনের সাময়িক বিরতি দিয়েছে। মেহমানরা চলে গেলেই আবার আন্দোলন শুরু হবে। এর মধ্যে যদি ইলিয়াস আলীকে জীবিত ফেরত দেয়া হয় এবং ১৮ দলীয় নেতৃবৃন্দের ওপর থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা  প্রত্যাহার করা হয় তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা।
দুই.
বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ মামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অথবা মামলার ভয়ে আন্দোলন ঠান্ডা বলে যে বক্রোক্তি করেছেন সেটা তাদের মজ্জাগত স্বভাব থেকে এসেছে। মামলাগুলো তো মিথ্যা। তারপরেও বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ সেই মিথ্যা মামলার মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই সরকার গণতন্ত্রের নামাবলী পরে যে চন্ডনীতি গ্রহণ করেছে সেটি স্পেন এবং পর্তুগালের স্বৈরশাসক ফ্রাঙ্কো এবং সালাজারকেও হার মানায়। বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ তো জামিনের জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করেছেন। জামিন নিতে গেলে স্বশরীরে হাজির হতে হয়। তারা সকলেই সশরীরে হাজির হতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে এবং বাইরে সরকার যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে সেটিকে যুদ্ধাবস্থা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। সুপ্রিম কোর্টের প্রতিটি গেটের সামনে শুধুমাত্র বিপুলসংখ্যক পুলিশই নয়, পুলিশ ছাড়াও সুপ্রিম কোর্টের ঐসব গেটে ১০/১৫টি প্রিজন ভ্যান মোতায়েন রাখা হয়েছে। মতলব অত্যন্ত পরিষ্কার। সুপ্রিম কোর্টে ঢোকার মুখেই তাদেরকে গ্রেফতার করা হবে এবং অদূরে অপেক্ষমান প্রিজন ভ্যানে তোলা হবে। সেজন্য হাইকোর্টে প্রবেশমান প্রতিটি গাড়ি চেক করা হচ্ছে এবং গাড়িতে উপবিষ্ট আরোহীদেরকেও পরীক্ষা করা হচ্ছে। এতো ব্যাপক পুলিশী প্রহরা সত্ত্বেও কেউ যদি পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কোর্টের মধ্যে ঢুকে পড়ে তাহলে তার জন্যও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কোর্টের মধ্যে গিজ গিজ করছে সাদা পোষাক পরা অসংখ্য পুলিশ। আদালতে যদি কারো জামিন মঞ্জুর না হয় তাহলে ঐ সাদা পোশাকধারীরা তৎক্ষনাৎ তাকে ধরে ফেলবে এবং বাইরে অপেক্ষমান প্রিজন ভ্যানে তুলবে। নাসিম সাহেবরা বুকে হাত দিয়ে বলুন, বাংলাদেশের এই ৪০ বছরে বিচার বিভাগের এমন অপব্যাবহার আর কোনো সরকার করেছে কি?

যেসব অভিযোগ তুলে এসব মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে সেসব যে কত ঠুনকো সেকথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গত ৪ মে দৈনিক ‘আমাদের সময়ে' বিষয়টি পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। পত্রিকাটির শেষ পৃষ্ঠায় এ সম্পর্কে যে খবরটি প্রকাশিত হয়েছে তার শিরোনাম ‘‘কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও কীভাবে পালিয়ে গেল মোটরসাইকেল আরোহীরা?’’ খবরের একস্থানে বলা হয়েছে, ‘‘প্রশ্ন ওঠেছে, গত হরতালের প্রথম দিনে বিস্ফোরণের কিছু আগেই সচিবালয়ের অফিস থেকে গণভবনে চলে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যাওয়ার পর র‌্যাব, আমর্ড পুলিশ, দাঙ্গা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ওই এলাকার দায়িত্বে ছিলেন। পাশাপাশি পুলিশের তৎপরতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। এছাড়া সচিবালয়ের চারপাশ জুড়ে ছিলো কঠোর নিরাপত্তা বলয়। এতো কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে কী করে একটি মোটরসাইকেলে দুজন অজ্ঞাত লোক ককটেল বহন করে? এছাড়া যেখানে বিস্ফোরণ ঘটেছে সেখানে একটি মোটরসাইকেল যেতে কমপক্ষে তিনটি স্থানে তল্লাশির প্রয়োজন হয়। বিস্ফোরণের পরপরই ওই মোটরসাইকেলটি এসব বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে পালিয়ে যায়?’’

আরেকটি হলো, তেজগাঁয়ে অবস্থিত প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনে বাসে অগ্নিসংযোগ। অতীতে সাধারণত ঐ স্থানে কোনো দুর্ঘটনা বা সহিংস ঘটনা ঘটেনি। কারণ এটি কোনো দিনও বিক্ষোভ, শোভাযাত্রা বা পিকেটিংয়ের স্থান ছিলো না, এখনও নেই। উত্তরে সেনানিবাসের জাহাঙ্গীর গেট, দক্ষিণে বিমানবাহিনীর অফিসার্স মেস এবং চৌরাস্তার মোড়। পূর্বে বিমান বাহিনীর রিক্রুটিং সেন্টার। এখানে কোনো বেসরকারি বাস ভবন নেই। তাই এখানে অতীতে কোনো দিন সভা ও শোভাযাত্রা হয়নি, কোনো পিকেটিংও হয়নি। এখানে তো হরতালকারীদের জন্য গাড়িতে অগ্নিসংযোগের কোনো প্রয়োজন নেই। আর আগুন লাগিয়ে কাকে তারা ভয় দেখাবে? এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর অফিসের গেটে রয়েছে কঠোর প্রহরা। উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্বে রয়েছে সেনা, বিমান ও পুলিশ বাহিনীর সার্বক্ষণিক উপস্থিতি। সেখানে বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয় কিভাবে? আর আগুন লাগিয়ে পালিয়েই বা যায় কিভাবে? সুতরাং এই স্থানে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনাটি রহস্যজনক।

তিন.
ইলিয়াস আলীর অপহরণের কোনো কুলকিনারা এই কলামটি লেখার সময় পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু এর মধ্যেই দেখা যাচ্ছে যে অপহরণের তদন্ত একটি বিশেষ খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চলছে। কাতার যাওয়ার আগের মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে, বেগম জিয়ার নির্দেশেই হয়ত ইলিয়াস আলীকে কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ পত্র-পত্রিকার পাতায় যেসব রিপোর্ট বেরিয়েছে সেইসব রিপোর্ট থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে সরকারি বাহিনী বা এজেন্সির লোকেরাই ইলিয়াস আলীকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। অথচ তদন্তে ঐসব  বিষয় মোটেই আমলে নেয়া হচ্ছে না। বরং তদন্তে বারবার এই বিষয়টির ওপর জোর দেয়া হচ্ছে যে ইলিয়াস আলীর এলাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো উপদল ছিলো কিনা? থাকলে তারা কারা? ইলিয়াস আলীর সহায়-সম্পদের হিসাব নেয়া হচ্ছে। তার জ্ঞাত আয়ের সূত্রের বাইরে তিনি সম্পদ অর্জন করেছেন কিনা? অর্থাৎ তদন্তকারীরা ধরেই নিয়েছেন যে উপদলীয় কোন্দল অথবা ব্যক্তিগত শত্রুতার শিকার হয়েছেন জনাব ইলিয়াস আলী।

এদিকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একজন ছাত্রকে গ্রেফতার করায় এবং রিমান্ডে নেয়ায় বিষয়টি আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। এই ছাত্রটি হলো তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি শাহীন। এই ছেলেটি নাকি খবর দিয়েছিলো যে, ইলিয়াস আলীকে পুবাইলে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, শাহীনের ঐ সংবাদের সূত্র ধরেই ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে নিয়ে র‌্যাব পুবাইলে অভিযান চালায়। কিন্তু সেই অভিযান ব্যর্থ হয়। এখন ঐ ছেলেটিকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তার কাছ থেকে কোন্ কথা আদায় করতে চায় পুলিশ? ইলিয়াসের শত্রুরা তাকে অপহরণ করেছে- মনে হচ্ছে তার মুখ দিয়ে আইন-শৃক্মখলা বাহিনী সেই কথাটি বের করতে চায়, যে কথাটি তারা প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে।
এদিকে সর্বশেষ পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে যে, আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, ইলিয়াস আলীর অপহরণের পেছনে পাকিস্তানের আইএসআই এবং জামায়াতে ইসলামী জড়িত থাকতে পারে। এই নিবন্ধের শুরুতেই আমরা সে কথা উল্লেখ করেছি। এখন পাঠক ভাইয়েরা দেখুন, খোদ সরকারের মন্ত্রীদের কথার মধ্যেই কত গরমিল। প্রধানমন্ত্রী বলছেন যে, বেগম জিয়ার নির্দেশে ইলিয়াস আলীকে লুকিয়ে রাখা হতে পারে। কামরুল ইসলাম বলছেন যে, পাকিস্তানের আইএসআই, জামায়াতে ইসলামী এবং জঙ্গিরা জড়িত থাকতে পারে। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী যখন প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন তখন প্রধানমন্ত্রী তাকে আশ্বাস দেন যে ইলিয়াস আলীকে তার পরিবারের নিকট ফেরত দেয়ার জন্য সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। আওয়ামী লীগের অন্যান্য মন্ত্রী এবং একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বলছেন যে, বিএনপির সিলেট জেলা শাখার উপদলীয় কোন্দলে ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হয়েছেন। সরকার নিজেই যেখানে ৩ রকম কথা বলছেন সেখানে ইলিয়াস আলীর উদ্ধারের ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রয়াস পরিহাসের মতো শোনায়। অন্যদিকে ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করার সময় যে ৪ ব্যক্তি ঘটনাটি সচক্ষে দেখেছে সেই ৪ জন প্রত্যক্ষদর্শীও হঠাৎ করে গায়েব হয়ে গেছে। এখন আবার সরকারের তরফ থেকে আইএসআই'র ধুয়া তোলা হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে ইলিয়াস আলীর অপহরণকে সুপরিকল্পিত এবং ষড়যন্ত্রমূলক মনে হচ্ছে।
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter