গত কয়েকদিনের গরম খবর হল সার্নের LHC বিজ্ঞানীদের
হিগ্স্ কণা বা ঈশ্বর কণা আবিস্কারের ঘোষণা। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই রহস্যময়
কণার সন্ধানে পদার্থবিজ্ঞানীরা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন এবং এই দীর্ঘ যাত্রার সফল
পরিণতি হিসেবে গত ৪ঠা জুলাইএ ঘোষণা এল অবশেষে পাওয়া গেছে হিগ্স্ কণা।
নতুন কণা
আবিস্কারের সরকারী ঘোষণার যে ন্যূনতম শর্তাবলী পূরণ করতে হয় সেগুলি মেটানোর পরেই
এই ঘোষণা। যাতে আবিস্কারের কাজে নিয়োজিত বিজ্ঞানীদের দলে কোন পক্ষপাতিত্বের সুযোগ
না থাকে সেকারণে দুটো পৃথক বিজ্ঞানীদলের দ্বারা এই পরীক্ষার কাজ চালান হয়। একটা দল
হল ATLAS (A Toroidal LHC Apparatus), আর অন্যটা হল CMS (Compact Muon Solenoid)
উভয় দলই একই ফলাফলে উপনীত হয়। কোন দলই অন্য দলের কাজ কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জানতেন
না। আর এই দল দুটি আন্তর্জাতিক, কাজেই কোন বিশেষ দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে না কোন
দলই। CMS দলে আছেন এক ভারতীয় মহিলা – অর্চনা শর্মা। তা সত্ত্বেও সার্নের বিজ্ঞানীরা
বিজ্ঞানীদের চিরাচরিত সতর্কতার সাথে বলছেন যে “হিগ্স্ কণা সদৃশ” এক কণা বা হিগ্স্ কণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক
কণা পাওয়া গেছে। কিন্তু যেহেতু একমাত্র হিগ্স্ কণাই বর্তমান প্রমিত মডেল
(Standard Model) ভবিষ্যৎবাণী করে সেহেতু এটা যে আসলেই হিগ্স্ কণা তার
সম্ভাব্যতাই বেশী ( যদিও ১০০% নয়)।
হিগ্স্ কণা কে ঈশ্বর কণা বলা হয় কেন? ঈশ্বর কণা
পদার্থবিজ্ঞানের সরকারী পরিভাষায় নেই। নোবেল পদাথবিজ্ঞানী লীয়ন লেডারময়ান তাঁর
১৯৯৩ এর বই “The God
Particle: If the Universe Is the Answer, What is the Question?” তে হিগ্স্ কণা কে ঈশ্বর
কণা বলে উল্লেখ করায় সাধারণ্যের ভাষায় এই নামকরণ স্থান পেয়ে গেছে। বিজ্ঞানে কম
সচেতন বা অজ্ঞদের অনেকেই এই কারণে হিগ্স্ কণা আবিস্কারকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের
প্রমাণ বলে ভুল করছে। যেমনটা স্টিফেন হকিং এর “A brief history of Time” এর উপসংহারে “ঈশ্বরের মন জানার” কথা বলায় এটাকে অনেকে
হকিংএর ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের সাক্ষ্য হিসেবে দেখেছিল। কিন্তু হকিং,
লেডারম্যান এরা কেউ আস্তিক নন । হিগ্স্ কণার প্রবক্তা হিগ্স্ একজন নাস্তিক।
হকিং, লেডারম্যান উভয়ই রূপক অর্থে বা আলঙ্কারিকভাবে “ঈশ্বর” শব্দ ব্যবহার করেছিলেন।
ঈশ্বর কণার আবিস্কারের সাথে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্পর্ক একটা কমলার সাথে বুধবারের
যে সম্পর্ক সেরকম। হিগ্স্ কণাকে বিজ্ঞানে হিগ্স্ বোসন বলেই উল্লেখ করা হয়,
কারণ হিগ্স্ কণা একটি বোসন কণা। মৌলিক কণা দু প্রকারের (১) বোসন (২) ফার্মিওন।
বোসনের স্পিন বা কৌণিক ভরবেগ পূর্ণসংখ্যা(Integer) , আর ফার্মিওনের স্পিন
অর্ধপূর্ণ (Half-Integer)। পূর্ণসংখ্যা স্পিনের কণারা যে পরিসংখ্যান বা ব্যাপন
মেনে চলে তাকে বোস পরিসংখ্যান বলা হয়। আর অর্ধপূর্ণ স্পিনের কণারা যে পরিসংখ্যান
বা ব্যাপন মেনে চলে তাকে ফার্মী পরিসংখ্যান বলা হয়। বোস পরিসংখ্যানের ধারণা প্রথম
দিয়েছিলেন ছিলেন বাঙ্গালী পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস। বোসন নামকরণ তাঁর
নামেই করা হয়েছিল।
তো হিগ্স্ বোসন ব্যাপারটা কি? একটা স্পষ্ট কথা
বলে ফেলি। এটা শুনে অনেকে হতাশ বা মনক্ষুণ্ণ হতে পারেন। স্পষ্ট কথাটা হল এটা
প্রকৃত অর্থে বোঝা সাধারণ মানুষের (তাত্ত্বিক কণা/ উচ্চশক্তি পদার্থবিজ্ঞনী ও
বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ববিদ বা Cosmologist ব্যতীত বাকী সকল) পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। হিগ্স্
বোসন কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্বের (Quantum Field Theory) এর এক বিষয়। আমার নিজের
অভিমত হল এটা সন্তোষজনকভাবে বোঝার ন্যূনতম শর্ত হল কোন মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের
পদাথবিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট (মাস্টার্স বা পিএইচডি) প্রোগ্রামের কোয়ান্টাম ক্ষেত্র
তত্বের (Quantum Field Theory) তিন সিকোয়েন্সের কোর্স সফলভাবে সম্পন্ন করা।
স্বপাঠেও (Self Study) তা সম্ভব, কিন্তু তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়এর তিন সিকোয়েন্সের
কোর্সে যেসব পূর্বশর্ত পূরণ করতে হয় সেগুলোও স্বপাঠের দ্বারা মেটাতে হবে। আরো
উল্লেখ করি যে পদাথবিজ্ঞানের যে কোন শাখার পেশাদার ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানী
(Experimental Physicists) বা পদার্থবিজ্ঞানের কোন কোন শাখার তাত্ত্বিক
পদার্থবিজ্ঞানী হতে হলে তিন সিকোয়েন্সের কোয়ান্টাম ফিল্ড তত্ত্ব আবশ্যিক নয়। তাই
তাঁরা যে এটা সম্পূর্ণ বুঝবেন তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কেবল তাত্ত্বিক কণা/
উচ্চশক্তি পদার্থবিজ্ঞনী ও সৃষ্টিতত্ত্ববিদেরা এটা বোঝেন কারণ তাদের জন্য এই তিন
সিকোয়েন্সের পাঠ আবশ্যিক। আর তাঁদের মধ্য থেকেই এই বিষয়ের গবেষক তৈরী হয়।
কোয়ান্টাম ফিল্ড তত্ত্ব না পড়েও হিগ্স্ বোসন বা প্রক্রিয়া বোঝার অধ্যাস তৈরী করা
যায় (এটা যে কোন বৈজ্ঞানিক ধারণার বেলায় প্রযোজ্য)। বুঝেছি বলে নিজেকে প্রবোধ দেয়া
যায়। যাহোক কিছু কথা তবুও সাধারণভাবে বলতে হয়, বোঝার অধ্যাস তৈরী করার জন্য যাতে
নবীনদের অনেকে এটা নিয়ে উচ্চতর স্তরে পড়াশোনা করার প্রেরণা পায়, আর যাতে এটা তাদের
চিন্তা আর উৎসাহকে উস্কিয়ে দেয়।
তো কিভাবে হিগ্স্ বোসন বোঝার অধ্যাস তৈরী করা
যায়? বিজ্ঞানের ভাষা ব্যবহার না করে এটা বোঝান বেশ কঠিন। যুক্তরাজ্যের রক্ষণশীল
সরকারের বিজ্ঞান মন্ত্রী উইলিয়াম ওয়াল্ডারগ্রেভ ১৯৯৩ সালে বিজ্ঞানীদের জন্য
চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন সহজ ভাষায় কে সবচেয়ে ভাল ব্যাখ্যা দিতে পারেন হিগ্স্ নিয়ে।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড মিলার জিতে নেন
চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেঞ্ছিলেন, ধরুন মার্গারেট থ্যাচার রক্ষনশীল দলকর্মীদের এক
পার্টিতে যোগ দিতে গেছেন । দেখা যাবে যে তার সমর্থকরা তাঁর চারিদিকে জটলা পাকিয়ে
এক গোলাকার আবরণ সৃষ্টি করেছে। যার ফলে থ্যাচারের এগিয়ে যেতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে,
যেটা অন্যান্য সদস্যের বেলায় হচ্ছেনা। একজন অধিক ওজনের মানুষের যেমন নড়াচড়ায় বেশ
কষ্ট হয় হালকা পাতলা মানুষের চেয়ে, থ্যাচারের অবস্থাও তেমনই। তার ওজন তাঁর চারপাশে
দলা পাকান ভক্তদের কারণে বেড়ে গেছে বলে মনে হবে। হিগ্স্ বোসনও হচ্ছে ঐ রক্ষণশীল
দলকর্মীদের মত, যার কারণে ভরহীন কণা ভর অর্জন করে। আর থ্যাচারের চেয়ে কম জনপ্রিয়
কোন নেতা(নেত্রী) ঐ জায়াগায় থাকলে তাঁর চারপাশে কম ভক্ত জটলা করবে, ফলে সেই কম
জনপ্রিয় নেতার ভর থ্যাচারের চেয়ে কম মনে হবে । একইভাবে মৌলিক কণার সবগুলিই হিগ্স্
ক্ষেত্রের সাথে ক্রিয়া করে সমান ভর লাভ করে না, জনপ্রিয়তার মতই সবার ভর এক হয় না।
বলাই বাহুল্য এটা একটা স্থূল উপমা সঠিক বিচারে। এরপর আরো অনেক পদার্থবিজ্ঞানী এর
চেয়ে উন্নততর উপমামূলক ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হয়েছেন। থ্যাচারের বদলে কানাডিও পপ
তারকা জাস্টিন বীবারকে ব্যবহার করেছেন কেউ, কেউ বা গুড়ের মধ্যে পিংপং বলের চলন দিয়ে।
সব ব্যাখ্যাই একটা সান্ত্বনা ব্যাখ্যা আমার মতে।
এবার বৈজ্ঞানিকভাবে হিগ্স্ বোসন ও প্রক্রিয়ার
ব্যাখ্যার চেষ্টা (বা ব্যাখ্যার ভানের চেষ্টা) করা যাক। হিগ্স্ বোসন হল
পদার্থবিজ্ঞানের প্রমিত মডেল যেসব মৌলিক কণার উপর ভিত্তি করে গঠিত তার অন্যতম এবং
একমাত্র অসনাক্তকৃত বা অজানা কণা (৪ঠা জু্লাই ২০১২ এর আগ পর্যন্ত)। জানা কণাগুলো
হল ইলেক্ট্রন, কোয়ার্ক, লেপ্টন ইত্যাদি। প্রমিত মডেল বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞানের
সবচেয়ে সফল তত্ত্ব যার দ্বারা প্রকৃতির চারটি বলের স্বরূপ ব্যাখ্যা করা যায়, যে
বলের দ্বারা মহাবিশ্বের তাবৎ পদার্থ বা বস্তু গঠিত হয় মৌলিক কণাগুলির সমন্বয়ে।
প্রমিত মডেল অনুযায়ী হিগ্স্ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে (সেটা আরেকটা বোঝার বিষয়) ভরহীন
কণিকাগুলি ভর অর্জন করে। সব বোসন কণাই কোন না কোন ফিল্ড বা ক্ষেত্রের সাথে
সশ্লিষ্ট। হিগ্স্ বোসন যে ক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট সেটাকে বলা হয় হিগ্স্
ক্ষেত্র। ক্ষেত্র জিনিষটা কি? যেমন পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র বিরাজ করে পৃথিবীর সব
স্থান জুড়ে , যেমন সব জায়গা জুড়ে তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্র বিরাজ করে পৃথিবীর সব
স্থানে, ঠিক তেমনি সব বোসন কণার ক্ষেত্র বিরাজ করে সব স্থান জুড়ে। তবে হিগ্স্
বোসনের ক্ষেত্র খুব উচ্চশক্তিতে বিরাজ করে, শক্তির মাত্রা কমে গেলে হিগ্স্
ক্ষেত্র উবে যায়, আদৃশ্য হয়ে যায়। প্রমিত তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিস্ফোরণের ঠিক পর পরই
(এক সেকেন্ডের লক্ষ কোটি ভাগের এক ভাগ সময়ে) এরকম উচ্চশক্তি বিরাজ করেছিল। তখন
হিগ্স্ ক্ষেত্র বিরাজ করছিল। ঐ সময়ে হিগ্স্ বোসন ছাড়া বাকী সব মৌলিক কণাই
ভরহীন ছিল। কিন্তু তাপমাত্রা আরেকটু কমার পর শক্তির বা তেজের মাত্রা কমে যাওয়ায়
হিগ্স্ ক্ষেত্রও অদৃশ্য হয়ে গেল। অদৃশ্য হবার মুহূর্তে এক প্রতিসাম্যের ভাঙ্গন
ঘটে (Spontaneous Summetry Breaking)। এই প্রতিসাম্য ভঙ্গের কারণ হল হিগ্স্
ক্ষেত্র অদৃশ্য হয়ে গেলেও তার ন্যূনতম শক্তির প্রত্যাশিত মান (Vacuum Expectation
Value) শূন্য হয় না। পানি যেমন জমে বরফ হয়ে গেলে পানির অণুগুলির প্রতিসাম্য নষ্ট
হয়ে গিয়ে বরফের কেলাসের প্রতিসাম্যহীন (বা কম প্রতিসাম্যপূর্ণ) অণুতে পরিণত হয়,
তেমনি হিগ্স্ ক্ষেত্রের হিমায়নের ফলে যে প্রতিসাম্য নষ্ট হয় সেটা হলে ভরের
প্রতিসাম্য। সব ভরই শূন্য ছিল এর আগে, একটা প্রতিসাম্যময় অবস্থা অবশ্যই। হিগ্স্
ক্ষেত্রের সাথে ক্রিয়া করে একেক মৌলিক কণা একেক ভর লাভ করে, একটা প্রতিসাম্যবিহীন
অবস্থা। কি ভাবে হিগ্স্ ক্ষেত্রের সাথে ক্রিয়া করে ভর লাভের ধারণা পেলেন
পদার্থবিজ্ঞানীরা? কোয়ান্টাম ফিল্ড তত্ত্বের এর এক মূল সমীকরণ বা ধারণা হল গেজ
অপরিবর্তিতা (gauge invariance)। এই ধারণা অনুযায়ী সব বোসন মৌলিক কণাগুলির ভর
শূন্য হবারই কথা। কিন্তু তড়িৎ-ক্ষীন নিউক্লীয় বলের বাহক বোসন কণাগুলির ভর শূন্য
নয়, অথচ তড়িৎ-ক্ষীন নিউক্লীয় বলের তত্ত্বে গেজ অপরিবর্তিতা ধরে নেয়া হয় । তাহলে কি
করে এই গরমিলের সুরাহা করা যায়?। পদার্থবিজ্ঞানের আরেকটি ধারণা হল স্বতঃস্ফূর্ত
প্রতিসাম্য ভংগ(Sponatneous symmetry breaking)। গাণিতিভাবে দেখান যায় যে
স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিসাম্য ভঙ্গের ধারণা গেজ ফিল্ড তত্ত্বের সাথে সম্পৃক্ত করলে
ভরহীন বোসন কণিকা ভর অর্জন করতে সক্ষম। এটাকে হিগ্স্ প্রক্রিয়া (Higgs
Mechanism) বলে। সালাম-ওয়াইনবার্গের উদ্ভাবিত তড়িৎ-ক্ষীন বলের বাহক মৌলিক বোসন
গুলির (W+-,Z) ভর অর্জন ও এই হিগ্স্ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ঘটিত। বলা দরকার যে
হিগ্স্ প্রক্রিয়া ঘটার জন্য হিগ্স্ বোসনের অস্তিত্ব আবশ্যিক নয়। অন্যভাবেও এই
প্রক্রিয়া ঘটতে পারে। সালাম-ওয়াইনবার্গের তত্ত্বে হিগ্স্ প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেয়া
হয়েছিল, হিগ্স্ বোসনের অস্তিত্বকে ধরে নিয়ে নয়। তাই হিগ্স্ বোসনের অস্তিত্ব
প্রমাণ না হলেও সালাম-ওয়াইনবার্গের নোবেল পুরস্কার অবৈধ হয়ে যেত না। কারণ (W+-,Z)
এর হিগ্স্ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভরলাভ এর আগেই পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। এর
থেকেই আরেক ধাপ এগিয়ে পদার্থিবিজ্ঞানীরা (বিশেষ করে পিটার হিগ্স্) ষাট দশকের
মধ্যভাগে প্রস্তাব করেন যে এমন এক ক্ষেত্র থাকা সম্ভব যার দ্বারা সব ভরহীন কণাই ভর
লাভ করতে পারে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিসাম্য ভঙ্গের মাধ্যমে,যেটা হল হিগ্স্ ক্ষেত্র।
বলাই বাহুল্য এসবই ক্ষেত্র তত্ত্বের উচ্চতর গাণিতিক ভাষায় ব্যক্ত করা হয়।
কেন হিগ্স্ বোসন এত দেরীতে ধরা পড়ল? আগেই বলেছি
হিগস্ কণা তৈরী হয় অনেক উচ্চ শক্তিতে যা এযাবত কোন ল্যাবেই তৈরী সম্ভব হয় নি।
কেবল LHC তেই এই মাত্রার শক্তি উৎপাদন সম্ভব হয়েছে অধুনা। এই শক্তি হল
মহাবিস্ফোরণের (Big Bang) অব্যবহিত পরের শক্তির তুল্য। কেন হিগ্স্ বোসন এত
গুরুত্বপূর্ণ যার পিছনে দশ বিলিয়ন ডলার খরচ করে LHC গড়া হয়েছে? পদার্থবিজ্ঞানের
ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে হিগ্স্ বোসনর অস্তিত্বের উপর ভর করে। মহা বিশ্বের যাবতীয়
বস্তু, ছায়াপথ, নীহারিকা, গ্রহ নক্ষত্র সব কিছু সৃষ্টির মূলেই আছে এই হিগস্ কণা।
তাই মানব জাতির জন্য এর অস্তিত্বকে প্রমাণ করা এক বুদ্ধিবৃত্তীয় নৈতিক দায়িত্ব। এক
দেশের পক্ষে এই খরচ বহন করা সম্ভব নয়। তাই ইউরোপীয় দেশগুলির সমষ্টিগত
অর্থানুকূল্যে, বিশ্বের অনেক দেশের বিজ্ঞানীদের সহায়তায় গড়ে উঠেছে এই বিশাল
পরীক্ষাগার। আশা করা যায় হিগ্স্ বোসনের আবিস্কার মহাবিশ্বকে বোঝার জন্য এক
উল্লেখযোগ্য মাইল ফলক হয়ে দাঁড়াবে। তবে এটাও স্মরণ করে দেয়া উচিত যে হিগ্স্
বোসনের আবিস্কার নতুন কোন তত্ত্ব নয়। এটা কেবল বর্তমান তত্ত্বকেই পাকা পোক্ত করল।
তবুও এর গুরুত্ব অপরিসীম।
ঈশ্বর কণার আবিস্কার ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিতর্কের
সাথে এক অর্থে প্রাসঙ্গিক। সেটা হলে ঈশ্বর কণা আবিস্কারের আগে ঈশ্বর কণা আছে কি
নেই এটা একটা অর্থবহ প্রশ্ন ছিল। কেউ ঈশ্বর কণার অস্তিত্ব নেই বলে বিশ্বাস করলে সে
বিশ্বাসকে বিজ্ঞান বিরোধী বা অর্থহীন বলা যেত না। স্টিফেন হকিং হিগ্স্ বোসনের
অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন নি। এখন করেন। ঈশ্বর কণার একটা সুস্পষ্ট ধারণা আছে যেটা সব
ধর্মের পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে একই। ঈশ্বর কণা অস্তিত্ব প্রমাণের বা অপ্রমাণের
প্রক্রিয়া নিয়েও একমত সব বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সব ধর্মের পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে
ঈশ্বরের সংজ্ঞা এক নয় বা সুস্পষ্টও নয়। আর প্রমাণের বা অপ্রমাণের প্রক্রিয়া নিয়েও
একমত নন তারা। আসলে প্রমাণের বা অপ্রমাণের কোন প্রক্রিয়াই জানা নেই তাদের কাছে,
কারণ ধারণাটাই অস্পষ্ট/অর্থহীন। তাই ঈশ্বর আছে কি নেই এই প্রশ্নটা অর্থহীন এক
প্রশ্ন। ঠিক তেমনই ঈশ্বর আছেন বলাটা যেমন অর্থহীন ঈশ্বর নেই বলাটাও অর্থহীন। তবে
ঈশ্বর আছেন বলে যারা (ভুল) যুক্তি দেয়, তাদের যুক্তির ত্রুটি ধরিয়ে দেয়াটা অর্থহীন
নয়।
No comments:
Write comments