Flickr

Thursday, 11 April 2013

ভারতের অমানবিকতার আগ্রাসন

Posted by   on

বাংলাদেশের মানুষের ওপর একটি মনস্তাত্তি্বক চাপ সৃষ্টির জন্য ভারত এটা করছে। ভারতের ধারণা এভাবে একের পর এক হত্যার পর একদিন বাংলাদেশের মানুষ মনে করবে সীমান্তে যা হচ্ছে তা আমাদের নিয়তি। আর তাহলে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সবকিছুর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হবে বাংলাদেশ। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্যে এ সম্ভাবনা আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কারো দয়া বা করুণার দান নয়। তাই আজকের এই কঠিন দুর্বিসহ পরিস্থিতিতে সচেতন দেশপ্রেমিক জনসাধারণকে ঐকমত্য প্রদর্শন করে দৃঢ় মনোবল নিয়ে সব ধরনের অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।


অবজ্ঞা-অবহেলা আর ভীতি-অনুকম্পা এই চারটি শব্দের বাস যেখানে সেখানে বন্ধুত্ব হয় না। এক পক্ষের অবদানের ফলে সুসম্পর্কও বজায় থাকে না। বিশেষত সম্পর্কের বিশ্বস্ততায় ভারসাম্য রক্ষা করা অবশ্যম্ভাবী। পৃথিবীর মানচিত্রে ভারত নামক বৃহৎ দেশটি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে তিন দিক দিয়ে বেষ্টিত করে রেখেছে। একদিকে শুধু বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত। ধরনীর সীমারেখায় বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন দেশে অভ্যুত্থান হয়েছে সেও চার দশক পূর্ণ হয়েছে। তবে এই স্বাধীন সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে আমাদের তিরিশ লাখ শহীদের আত্মদান আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত লুটিয়ে দিতে হয়েছে। সে কারণেই বিশ্ব দরবারে এ জাতি আত্মমর্যাদাশীল, দেশপ্রেমিক এক বীরের জাতি বলে গৌরব অর্জন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সৃষ্টির লগ্ন থেকেই ভারতের সাথে আমাদের রয়েছে অমীমাংসিত কিছু রাষ্ট্রীয় সমস্যা। যার কল্যাণকর সুষ্ঠু সমাধান আজো হয়নি। এমনি একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হলো সীমান্তবর্তী এলাকা কর্তৃক বাংলাদেশের সামরিক/বেসামরিক মানুষকে অকারণে, অকাতরে নির্যাতন করা এবং গুলি চালিয়ে হত্যা করা। মানবতা পরিপন্থী ওই ক্রিয়ার মাত্রাটি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বর্বরতা সব সীমা-পরিসীমা ছাড়িয়ে গেছে। নিছক তুচ্ছ ঘটনার কারণেও নিরীহ গ্রামবাসী তাদের নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার হাত থেকে রক্ষা পায় না। শান্তির সীমান্ত প্রতিষ্ঠার সব প্রত্যাশা গুঁড়িয়ে দিয়ে ভারতীয় রক্ষীবাহিনীর বর্বরতায় দুই দেশের সীমানা হচ্ছে রক্তাক্ত। প্রতিনিয়ত হত্যা নির্যাতনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গত বছর ৭ জানুয়ারি ফেলানি নামের চৌদ্দ বছরের এক কিশোরীকে গুলি করে হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখা। ওই দিন তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বিএসএফের দ্বারা এমন চরম নিষ্ঠুরতায় বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝর উঠেছিল। গত ৯ ডিসেম্বর ওই জওয়ানদের দ্বারা অভূতপূর্ব পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সতররশিয়া গ্রামের হাবিব। উৎকোচ দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে তাকে উলঙ্গ করে বাঁশ বেঁধে অমানসিকভাবে পিটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এমনকি তার যৌনাঙ্গেও পেট্রোল ঢেলে অভিনব কায়দায় নিপীড়ন করেছে। তাদের নির্মম অসভ্যতার দৃশ্য আবু গারিব কারাগারের মার্কিন বাহিনীদেরও হার মানিয়েছে।
গত ১৮ জানুয়ারি ভারতীয় টেলিভিশন এনটিভি মধ্যযুগীয় বর্বরতার সঙ্গে তুলনীয় ওই চিত্র প্রচার করার পর শুধু বাংলাদেশ ও ভারতেই নয়, বিশ্বব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ভারত সরকারের তরফ থেকে 'বিষয়টিকে বড় করে না দেখার' অনুরোধ দেশপ্রেমিক জনসাধারণকে বিস্মিত করেছে। বিস্ময় আর উৎকণ্ঠা তখনই চরমসীমা অতিক্রম করেছে যখন বাংলাদেশের প্রভাবশালী মন্ত্রীর কণ্ঠে জীবন সম্মান সম্পর্কে উদাসীন তাচ্ছিল্যভরা উক্তি প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, 'সীমান্তে যা কিছু ঘটছে তা নিয়ে রাষ্ট্র চিন্তিত নয়। সীমান্তে হত্যা অতীতে ঘটেছে, এখনও ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। সব কাজ ফেলে রেখে শুধু এদিকে দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজন আছে বলেও সরকার মনে করে না।' এটা কেমন মন্তব্য?


হাবিবকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের মাত্র কয়েকদিন পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্তে বর্ডার গার্ড অফ বাংলাদেশের (বিজিপি) হাবিলদার লুৎফর রহমানকে অপহরণ করে নির্যাতনের পর ফেরত দিয়েছে। একইভাবে বেনাপোলের গরু ব্যবসায়ী রাশেদুলকে হত্যা করেছে। মূলত ওই মন্ত্রীর উস্কানিমূলক বক্তব্যে ভারত সীমান্তরক্ষীরা আরো উৎসাহ ও নির্ভয়ে নাশকতামূলক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষ হত্যা করে ভারত আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করছে, যা ভারতকে দিয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের আন্তর্জাতিক নিষ্ঠুরতার খেতাব। অথচ উলি্লখিত ওই দেশটির সঙ্গে আরো পাঁচটি দেশের সীমান্ত থাকলেও তারা শুধু বাংলাদেশ সীমান্তেই এই পৈশাচিক আগ্রাসন চালায়। যা বাংলাদেশের দুর্বলত পররাষ্ট্রনীতি আর সরকারের পক্ষপাতিত্বেরই ফল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০১০ সালের ডিসেম্বর এক রিপোর্টে হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বিএসএফ সদস্যদের বিচার হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছে। ওই বছর প্রায় এক হাজার বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অধিকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী ২০০২ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ১০ বছরে সহস্রাধিক নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে তাদের দ্বারা। নতুন বছরে এসেও গত ৩ সপ্তাহে ৩ জনকে হত্যা করেছে ভারত।

 ২০১১ সালে ৩৪ জন, ২০১০ সালে ৭৪ জন, ২০০৯ সালে ৯৬ জন, ২০০৮ সালে ৬২ জন, ২০০৭ সালে ১২০ জন, ২০০৬ সালে ১৪৬ জন, ২০০৫ সালে ১০৪ জন, ২০০৪ সালে ৭৬ জন এবং ২০০৩ সালে ৪৩ জন, ২০০২ সালে ১০৫ জন, ২০০১ সালে ৯৪ জন এবং ২০০০ সালে ৩৯ জন সাধারণ মানুষ বিএসএফ কর্তৃক নিহত হয়েছে মোটকথা, প্রতি মাসে ৭ থেকে ৮ জন গরিব কৃষক শ্রমিক ভারতীয় সীমান্তরক্ষী দ্বারা অকাল প্রাণ বিয়োগ ঘটছে। পরিসংখ্যানের চিত্রটি অত্যন্ত ভয়াবহ।

 সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল পোস্ট নামে একটি গণমাধ্যমের এক খবরে বাংলাদেশি সীমান্তকে মৃত্যুর দেয়াল বলে চিহ্নিত করে উল্লেখ করেছে, ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্ত, ইসরাইল ও ফিলিস্তিন সীমান্তের চেয়েও, ভয়ঙ্কর। এমনকি, ভারতের বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক 'দ্য হিন্দু' পত্রিকার এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বিএসএফের হাতে বাংলাদেশের নাগরিক হাবিরের অমানবিক নির্যাতনের ঘটনায় নয়াদিলি্লর নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া উচিত বলেও মতপ্রকাশ করেছে। ছয়টি দেশের সঙ্গে সীমান্ত সংগঠন ভারত বেষ্টিত। শুধু বাংলাদেশ ছাড়া বাকি পাঁচটি দেশের সীমান্ত সর্বদা স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান এবং মিয়ানমার সীমান্তে একটি হত্যাকা-ও ঘটেনি। ভারতের সবচেয়ে বৈরী প্রতিবেশী পাকিস্তান সীমান্তেও গত ১০ বছরে কোনো বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় হাইকমিশনারের সাফাই গাওয়া মন্তব্য হচ্ছে 'সীমান্তে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গরু চোরাচালানকে উৎসাহিত করায় এ ঘটনা ঘটছে আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনি সহজ সাবলীল ভাষায় বলেছেন, 'আমরা এই ঘটনাগুলোর প্রতিবাদ করে যাচ্ছি।' সরকারের দুর্বল কূটনীতি আর নতজানু পররাষ্ট্র নীতি এজন্য কম দায়ী নয়।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে, ২০০২ সাল পর্যন্ত বিরোধপূর্ণ কাশ্মির সীমান্ত অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। কিন্তু ২০০২ সালে দুই দেশ অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হওয়ার পর কাশ্মির সীমান্তে আর কোনো গোলাগুলির ঘটনা ঘটেনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং একাধিকবার সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। বর্তমানে বিএসএফ কর্তৃক নাশকতামূলক কর্মকা- রীতিমতো অনিয়ন্ত্রিত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আলম ফজলুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে আসলে একটি মৃত্যুপ্রাচীর। এটি বিদেশি পত্রিকার ভাষ্য। ভারত সরকারের সম্মতিতেই সীমান্ত হত্যা চলছে।

 বাংলাদেশের মানুষের ওপর একটি মনস্তাত্তি্বক চাপ সৃষ্টির জন্য ভারত এটা করছে। ভারতের ধারণা এভাবে একের পর এক হত্যার পর একদিন বাংলাদেশের মানুষ মনে করবে সীমান্তে যা হচ্ছে তা আমাদের নিয়তি। আর তাহলে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সবকিছুর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হবে বাংলাদেশ। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্যে এ সম্ভাবনা আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কারো দয়া বা করুণার দান নয়। তাই আজকের এই কঠিন দুর্বিসহ পরিস্থিতিতে সচেতন দেশপ্রেমিক জনসাধারণকে ঐকমত্য প্রদর্শন করে দৃঢ় মনোবল নিয়ে সব ধরনের অমানবিকতা নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter