Flickr

Friday, 23 August 2013

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, খাদ্য সঙ্কটের অশনি সঙ্কেত

Posted by   on


পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপনের মধ্যদিয়ে দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনা শেষ হলো। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। আবার আমাদের সমাজেও বিভিন্ন শ্রেণী বিশেষ করে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মানুষের বাস। এসব মানুষের জীবনযাত্রা এক নয়। গ্রামের মানুষগুলো যারা গরিব অসহায় তাদের পুরো বছরই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে অনেক দুঃখ-কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়।
রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় প্রতি বছরই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে গ্রামের মানুষগুলো পবিত্র রমজান এ একটি মাস নিদারুণ কষ্টে দিনযাপন ও রোজা রেখেছে। আমরা মুসলমানরা নামাজ পড়ি, রোজা রাখি- সে কথা শুরুতেই বলেছি। কিন্তু একইভাবে সারা বছরতো বটেই; রমজান মাসেও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আমরা দ্রব্যমূল্য বাড়াই অধিক মুনাফা লাভের আশায়।
  
এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী আছেন, যারা বিভিন্ন কৌশল, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করে। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এবারের রমজানেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, রমজানের মধ্যে চাহিদা বেড়ে যায় এমন পণ্যের মজুদ পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। কিন্তু কোনো নজর রেখে লাভ হয়নি। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। পবিত্র রমজানে সাধারণত চিনি, সয়াবিন তেল, মসুর ডাল, ছোলা বুট, পেঁয়াজ ইত্যাদি পণ্যের চাহিদা থাকে বেশি। এক হিসাবে দেখা গেছে, এক চিনি ছাড়াও অন্য সব পণ্যের দাম বেড়েছে। আমাদের বড়ই দুর্ভাগ্য যে, আমরা এমন এক দেশে বাস করছি, যেখানে চিনির চেয়ে গুড়ের দাম বেশি। ইদানিং আবার লক্ষ্যণীয় যে, লবণের দামও ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। হয়তো এমন এক সময় আসবে যে, চিনির চেয়ে লবণের দামও বেড়ে যাবে। তখন অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। লবণের দাম এভাবে বেড়ে যাওয়ার পক্ষে সরকারের কোনো যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। যে লবণের দাম দু-তিন মাস আগে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের তারতম্য হিসাবে ছিল ১৫ থেকে ১৮ টাকা, সে লবণের দাম এখন প্রতি কেজি ৩০ টাকা। এতে করে শুধু নিম্ন আয়ের মানুষরাই নয়, মধ্য আয়ের মানুষগুলোও চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। একের পর এক অজুহাত দেখিয়ে বড় বড় ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের সরকারের সেদিকে কোনোই নজর নেই। মাঝে মাঝে হুঙ্কার ছাড়ে, দাম বেশি নিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আসলে এগুলো লোক দেখানো মাত্র, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

 শুধু নিত্যপণ্যেই নয়; দাম বেড়েছে মাছ, মাংস ও সবজির। এক সময় বাংলাদেশকে বলা হতো মাছে ভাতে বাঙালি। তখন গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ছিল। সময়ের ব্যবধানে ও ক্রমাগত জনসংখ্যাধিক্যের কারণে সেই গোলা আর নেই, সঙ্গে সঙ্গে পুকুর ভরা মাছও অনেক কমে গেছে। রমজানে মাংসের বাজার স্থিতিশীল রাখতে বড় বড় শহরে বিশেষ করে সিটিগুলোতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তেমন সুফল পাওয়া যায় না। সরকারের এক হিসাবে দেখা যায়, গত রমজানের চেয়ে এবারে কয়েকটি পণ্যের দাম বেশি। এ পণ্যসামগ্রীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আটা, তেল, পামওয়েল, মসুর ডাল, রসুন, লবণ ইত্যাদি। তবে এ বছরে ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া। সরবরাহ যথেষ্ট নয়। ইলিশকে বলা হয় মাছের রাজা। এক সময়ে হাটে-বাজারে প্রচুর ইলিশ আমদানি হতো। দামও কম ছিল, যা মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। কিন্তু কোথায় কী হয়ে গেল, সে ইলিশের আমদানি পর্যাপ্ত নয়, তেমনি দামও চড়া। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলতে চাই, পবিত্র রমজানের শেষের দিকে ছোট ছেলে বায়না ধরে বসলো, ইলিশ মাছ খাবে। সে বলে, আব্বা অনেকদিন হলো ইলিশ খাওয়া হয়নি, ইলিশ খাব। ছেলের বায়না পূরণ করতে দুপচাঁচিয়া বাজারে গিয়ে ইলিশের দাম শুনে মাথায় হাত। এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছের দাম এক হাজার টাকা। আর এক কেজির নিচে ৮০০-৮৫০ টাকা পর্যন্ত। দাম শুনে আমি হতবাক। এক কেজি মাছ কিনতে হিসাব করে দেখলাম, দুই মণ ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। কারণ, ধানের বাজার নেই। কিন্তু রুপালী ইলিশের বাজার ঠিকই রয়েছে। তবুও কষ্ট করে একজন পিতা হিসেবে ছেলের বায়না পূরণ করতে এক কেজি মাছ কিনলাম। এক দোকানি বলল, বর্তমানে ইলিশের আমদানি কম। কিন্তু ইলিশের আমদানিতো কম হওয়ার কথা নয়। সরকার তো পুরো রমজান মাসে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করেছে। সরকারি হিসাবে ২০১১-১২ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন হয়েছে আনুমানিক তিন লাখ ৪০ হাজার টন। আর গত মে মাস পর্যন্ত ইলিশ মাছ রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৭ হাজার টন। এ হিসাবে দেশে প্রায় তিন লাখ ৩০ হাজার টনের বেশি ইলিশ থাকার কথা। সরকারি হিসাবে ইলিশ উৎপাদনের এ চিত্রে এতো ইলিশ কোথায় যায়? সরকারের হিসাবের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ, রপ্তানি বন্ধ হলে কি হবে, অন্যান্য মাছের সঙ্গে ইলিশ পাচার হচ্ছে দেদারছে। ফলে আমদানি কমে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে দামও বেড়ে যায়। শুধু যে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে তা নয়, খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত পণ্য ছাড়া বিদ্যুৎ, বাসা ভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসা এবং শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতের খরচ বেড়েছে।

 যা হোক, একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে খাদ্য সঙ্কটের অশনি সঙ্কেত। এ দুইয়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে এ দেশের জনগণ। অতি সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও বলেছে, জুলাই মাসে বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্য ও চিনির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাপী যে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছিল তা আবারও হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এর নানাবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিরূপ আবহাওয়া। এ অস্বাভাবিক বা প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সঙ্কটের এক অশনি সঙ্কেত দেখা দিয়েছে। অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টির কারণে জুলাই মাসে সারাবিশ্বে খাদ্যের দাম বেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবার প্রচুর খরা, ব্রাজিলে অসময়ে বৃষ্টি। ফলে ভুট্টো, গম, চিনি উৎপাদন কম হওয়ায় এসব পণ্যের দাম বেড়েছে। অপরদিকে, ভারতে দেরিতে বৃষ্টিপাত, অস্ট্রেলিয়ায় খরার ফলে খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির এটিও একটি কারণ। সারাবিশ্বের মধ্যে একমাত্র আমেরিকা খাদ্য উৎপাদনে এগিয়ে। সেই আমেরিকায় এখন প্রচ- খরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৬২ শতাংশ এলাকায় এবার অনাবৃষ্টির কারণে প্রচ- খরায় এই সমস্ত অঞ্চলে খাদ্যশস্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বেকায়দায় পড়তে হবে সারাবিশ্বের মানুষকে। অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা ভালো নয়, সেখানেও খরা। ২০০৭-০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার খরার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছিল। সেবার আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল। এবারের অবস্থাও একই। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী 'দি ইকোনমিস্টে' খাদ্য নিরাপত্তা প্রতিবেদনে বলে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা সবচেয়ে দুর্বল। এমনকি উগান্ডা, কেনিয়া, নেপাল ও মিয়ানমারের চেয়েও নাজুক। অর্থাৎ খাদ্যের জন্য বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের এক ধরনের নির্ভরতা রয়েছে।

 সুতরাং, সারাবিশ্বের খাদ্য সঙ্কটের ঢেউ বাংলাদেশে পড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন যেহেতু গোটা বিশ্বে খাদ্য সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে, যার ফলে খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। এতে করে তার প্রভাব পড়বে নিম্নবিত্ত মানুষের ওপর। তাদের জীবনযাত্রাকে গভীর সঙ্কটে ফেলে দেবে। ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সঙ্কটে যে বিপুল জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যসীমায় ফেলে দিয়েছিল, তার অধিকাংশই দরিদ্র দেশের জনগোষ্ঠী।
গোটা বিশ্বের যে খাদ্য সঙ্কটের অশনি সঙ্কেত দেখা দিয়েছে, তার কতগুলো মৌলিক কারণ রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলোচ্ছ্বাস, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টিসহ বিভিন্ন কারণে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে বিশ্বের খাদ্য সঙ্কটের ঢেউ আঘাত হানে। আবার অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফলে বসতবাড়ি নির্মাণে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পায়। আবার পৃথিবীতে সব দেশের খাদ্য উৎপাদন এক ধরনের নয়। মাটি, জলবায়ু ও আবহাওয়ার ওপর ভিত্তি করে এর ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশের প্রধান খাদ্য ভাত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উৎপাদন বাড়ছে না। এ জন্য প্রতিবছর বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। এমতাবস্থায় সরকারকে পর্যাপ্ত চাল, গম আমদানি করে মজুদ রেখে আপদকালীন সময়ে জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া কৃষির ওপর গুরুত্ব, অধিক উৎপাদনে কোনো বিকল্প নেই। শুধু ধান নয়, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বা সঙ্কটের হাত থেকে রক্ষা পেতে ধানের পাশাপাশি গম, আলু, সরিষা, ভুট্টো, শাকসবজি বেশি উৎপাদন করে পুষ্টির অভাব পূরণ করতে হবে। কারণ, প্রকৃতপক্ষে খাদ্য সঙ্কট মানে ধান, চাল, গমের অভাব নয়, এর সঙ্গে জড়িত পুষ্টিগুণ শাক-সবজি।
যাহোক, প্রতিবছর আমরা দেখেছি রমজানকে সামনে রেখে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। এ বছরও পবিত্র রমজান মাসে তার ব্যতিক্রম হয়নি। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী আছে, যারা রমজান মাসেও দাম বাড়িয়ে দেয়। ভোজ্যতেল, আটা, ময়দা, ছোলা, বুট, মসুর ডালের দাম বেড়ে যায়। সরকারও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এক রমজান মাসেই মূল্যবৃদ্ধির যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছে সাধারণ ও অসহায় মানুষ। অপরদিকে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সঙ্কটের যে অশনি সঙ্কেত দেখা দিয়েছে, তাতে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশ গভীর সঙ্কটে পতিত হবে বলে খাদ্য বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter