পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশেরই এক ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দেশের এক-দশমাংশ ভূমি ৫০৯৩ বর্গমাইলজুড়ে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান তিনটি জেলা। চেঙ্গী, মাইনী, কাছালং বিধৌত এবং বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আমাদের পার্বত্য তিন জেলা। অথচ পাহাড়ের মানুষের মাঝে নেই কোন শান্তি, নেই কোন স্বস্তি। দুর্গম পাহাড়ের প্রতিটি আনাচে-কানাচে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহী সশস্ত্র সন্ত্রাস। কোথাও চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি, এলাকার আধিপত্য ও দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতা। উপজাতি-বাঙালি প্রতিটি মানুষই আজ পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে। অথচ প্রশাসন কোনই ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কিন্তু, কেন? পাহাড়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা বেআইনী অস্ত্রধারী ও চাঁদাবাজি। জেএসএস, ইউপিডিএফ, ছদক, গুন্ডুস, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, সাজেক নারী কল্যাণ সমিতি, ভূমি রক্ষা কমিটি, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম ইত্যাদি নামে- বেনামে পার্বত্যবাসী জনগণের ওপর চালানো হচ্ছে চাঁদাবাজির স্টিম রোলার। এগুলো দেখারও যেন কেউ নেই।
বিগত ১৯৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, রাঙামাটি জেলার লংগদু থানার শতাধিক কাঠুরিয়াকে আলোচনার কথা বলে নেয়া হয়েছিল বাঘাইছড়ি থানার পাকুয়াখালীর গহীন অরণ্যে। ক্ষুধার্ত, অভুক্ত বাঙালি শ্রমিকরা কাজের আশায় সরল মনে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের কথায় বিশ্বাস করেছিল। চাঁদা নির্ধারণের জন্য আলোচনার ফাঁদে ফেলে এভাবে যে শতাধিক কাঠুরিয়াকে হত্যা করা হবেÑ সেই আশঙ্কাটিও ভেবে দেখার সুযোগ ছিল না।
৫ জন করে চোখ বেঁধে গহীন অরণ্যে নিয়ে তাদেরকে বেয়নেট চার্জ করে প্রথমেই গুরুতর আহত করা হয়। এরপর দা/ছুরি দিয়ে হাত-পা কেটে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টুকরা টুকরা করে পাহাড়ের তলদেশে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। এভাবে মোট কতজনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তারও কোন সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। তবে হত্যাকা- ঘটে যাবার পরও তৎকালীন সরকার ও রাঙামাটি জেলা প্রশাসন একে ¯্রফে গুজব(!) এবং উপজাতীয়দের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র(!) বলেও চালিয়ে দিতে মোটেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু স্বজনদের আহাজারি ও কান্নাকাটির পর প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। নিখোঁজ ও নিহত কাঠুরিয়াদের সন্ধান করতে পরে সেনাবাহিনীকে নামানো হয়। লংগদু ও বাঘাইছড়ির দুর্গম পাহাড় ও গহীন জঙ্গলে ব্যাপক খানা-তল্লাশি চালানো হয়। অবশেষে সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ প্রচেষ্টায় এবং স্থানীয় বাঙালিদের সক্রিয় সহযোগিতায় একে একে লাশের সন্ধান আসতে থাকে। পাহাড়ের গহীন তলদেশ থেকে এবং দুর্গম জঙ্গল থেকে কাটা-ছেঁড়া, ক্ষতবিক্ষত বিকৃত চেহারার লাশগুলো উদ্ধার করে আনা হয় লংগদু উপজেলা পরিষদের মাঠে। সেখানে মুচি ডেকে লাশগুলোর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সেলাই করে মানব আকৃতি দেয়া হয় এবং লংগদু মাঠে বিরাট জানাযা করে লাশগুলোকে সমাহিত করা হয়। ১৭ বছর পরও আজো ৩৫টি কবর লংগদু থানা পরিষদ মাঠের একাংশে সাজানো আছে। দেখলে মনে হবে ৩৫ জন বাঙালী ভাই যেন পাশাপাশি শুয়ে আছে। সেখানে অপর পাশে রয়েছে লংগদু উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশীদ সরকারের কবরস্থান। লংগদু গুলশাখালীতে ব্রাশফায়ার করে খুনি শান্তিবাহিনী হত্যা করেছিল উপজেলা চেয়ারম্যান আঃ রশিদ সরকারকে।
বাঘাইছড়ির পাকুয়াখালীর কাঠুরিয়া হত্যাকা- ঘটার পরও সরকারের শীর্ষপর্যায়কে ঘটনাটি জানানো হয় নাই। বরং একে নিয়ে নানারূপ গুজব ও বাঙালিবিদ্বেষী প্রচারও চালানো হয়। ফলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে লংগদু হত্যাকা- আদৌ ঘটেছে কি-না(?), তার তদন্তের জন্য উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি পাঠানো হয়েছিল।
তোফায়েল-আমু-রাজ্জাক- হাসনাত-দীপঙ্কর তালুকদারসহ সরকারের মন্ত্রী, এমপি ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছিল। নৃশংসতা ও বর্বরতা স্বচক্ষে দেখে তারাও বিস্মিত হয়ে যান। মানুষকে এভাবে কেউ হত্যা করতে পারে, এ যেন কল্পনাও করা যায় না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই বর্বর জঘন্য হত্যাকা-ের ঘটনায় চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন নাই। চীন ভ্রমণের প্রাক্কালে ১৯৯৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর অশ্রুসজল কণ্ঠে শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের কাছে বাঘাইছড়ি হত্যাকা-ের তদন্ত ও খুনীদের বিচারের ওয়াদা করেছিলেন। কিন্তু বিচারের বাণী আজও নীরবে-নিভৃতে কাঁদছে। জাতি আজও দীর্ঘ ১৭ বছর পরও খুনীদের বিচার দেখতে পেল না। সরকার একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করলেও সেসব তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজও প্রকাশ হয়নি।
বাঘাইছড়ি হত্যাকা-ের পর প্রচার মাধ্যমে তৎকালীন শান্তিবাহিনী এর দায়দায়িত্ব স্বীকার করেছিল এবং বলেছিল- তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারও আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই এই লোমহর্ষক হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে। অথচ তার পরেও সরকার খুনী শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনরূপ ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বরং ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর খুনী শান্তিবাহিনীর নেতা সন্তু লারমার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংসদীয় কমিটির নেতা আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। অতি উৎসাহী কেউ কেউ বলেন একে পার্বত্য শান্তিচুক্তি। অথচ শান্তিচুক্তির ১৬ বছর পরও পাহাড়ে আজও চলছে অবাধে চাঁদাবাজি ও বন্দুকযুদ্ধ। অথচ তারপরেও এর বিরুদ্ধে নেই কোন সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এই কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙ্গার জন্য নেই কোন বাস্তবসম্মত অত্যাধুনিক ব্যবস্থা।
দেশী ও বিদেশী চাপের মুখে আজও আটকে আছে পাহাড়ের সার্বিক ভাগ্য। পাহাড়ের মানুষ ভূমি, ভাত ও ভোটের অধিকার নিয়ে ঝুলে আছেন শান্তিচুক্তির বেড়াজালে।
৯ সেপ্টেম্বর এলেই স্মরণ করা হয় সেইসব হতভাগা কাঠুরিয়াদের। কিন্তু খুনীদের বিচারের দায়ভার যেন কেউই আর বহন করতে রাজি নয়। তাহলে কে করবে এই বিচার?
No comments:
Write comments