সমাজ-উন্নয়ন কর্মীর আধ্যাত্মিক উন্নয়ন
ফাঃ বেঞ্জামিন কস্তা, সিএসসি
ভূমিকা: “আপনি কেমন আছেন?”Ñ এই প্রশ্নটির উত্তর আমরা সবাই খুব সহজভাবে দিয়ে থাকি। সম্ভবত: ৯৯% লোকই এমন উত্তর দিবে। তবে এত বেশি সংখ্যক লোকই যদি সত্যই ভাল থাকতো, তাহলে সমাজের অবস্থা এমন হওয়ার কারণ কি? মানুষের মাঝে কেন এত অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা, মানসিক যন্ত্রণা? মানুষের মাঝে কেন এত ভয়, দুশ্চিন্তা, নিরাপত্তার অভাব? সমাজে কেন এত অপরাধ: ঘুষ, দুর্নীতি, কাজে অবহেলা, সন্ত্রাস, শোষণ-নির্যাতন, পারিবারিক অশান্তি, বিচ্ছেদ, কলহ, শত্রুতা? এসব কি ভাল থাকার লক্ষণ? আপনি কিভাবে এত সহজ করে বলতে পারেন যে, আপনি ভাল আছেন?
আপনি বা আমি আসলে কেমন আছি, তা জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ, অসুস্থ মানুষকে দিয়ে ভাল কাজ করানো সম্ভব নয়। আর মানুষ যদি সত্যিই সুস্থ হতো, তাহলে সমাজটাও সুস্থ হতো, কেননা মানুষকে নিয়েই তো সমাজ। সুতরাং সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন যাপন করার উপায় জানা একান্ত দরকার। আর আমি যদি সত্যিই সুস্থ থাকি তবে আমি সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে পারব। আমার প্রকৃত সুস্থতা শুধুমাত্র আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তার প্রভাব আমার আদর্শ ও কাজের মধ্য দিয়ে সমাজের উপর পড়বেই। আধ্যাত্মিকতা প্রকৃতপক্ষে খাঁটি সুস্থতাÑ গোটা মানব-ব্যক্তির পরিপূর্ণ সুস্থতা।
১। মানুষ কে বা কি?
এই প্রশ্নটি মৌলিক। পশুপক্ষীর কোন আধ্যাত্মিকতা নেই, তার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু মানুষের আধ্যাত্মিকতা তার নিজের জন্যই অপরিহার্য। সুতরাং আমাকে জানতে হবে মানুষ কে বা কি? মানুষ সম্বন্ধে আমার নিজের সম্বন্ধে ধারণার উপরই নির্ভর করে মানুষের (আমার) আচরণ। সুতরাং এই ধারণাটাও সঠিক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব-দেহ, মন ও হৃদয়-আত্মা নিয়ে গড়া অখ- সত্তা। মানুষকে সৃষ্টিকর্তা মহান মর্যাদা দিয়ে নিজের প্রতিমূর্তিতে (প্রতিনিধি করে) সৃষ্টি করেছেন। দেহ ও আত্মার সমন্বয়েই মানুষ, তাই তাকে বলা যায় দেহময় আত্মা অথবা আত্মাময় দেহ। আর এই আত্মার কারণেই মানুষ অন্যান্য প্রাণী হতে শ্রেষ্ঠ। সুতরাং মানুষের মধ্যে অবশ্যই আত্মার প্রাধান্য থাকতে হবে, আর আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে আত্মা-সম্পর্কিত ব্যাপার।
ফুল স্বভাবতই ফুল, যদিও ফুলকেও বিকশিত হতে হয় প্রাকৃতিক নিয়মেই। মানুষকে কিন্তু শুধু আকৃতিগত দিক দিয়েই নয় বরং প্রকৃতিগত দিক দিয়েও বিকশিত হতে হয় সাধনাবলে। কেননা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা আছে, যা অন্যান্য প্রাণীর নেই।
মানুষকে মনুষ্যত্ব আপনা-আপনি বিকশিত হয় না তাকে সচেষ্ট সাধনাবলে বিকশিত হতে হয়। এই উদ্দেশ্যে নিজেকে জানা (আত্মানং বিদ্ধি) প্রয়োজন। এই আত্মাজ্ঞান লাভ করা একটি প্রক্রিয়া। যে ব্যক্তি নিজেকে যত ভাল করে জানবে সেই ব্যক্তির আচরণ তত উন্নত হবে।
নিজেকে জানার উপায়
১। মানব-প্রকৃতি বিশ্লেষণ/পর্যালোচনা করে। মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই তার প্রকাশ:
ক) মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী
খ) মানুষ স্বাধীন- তার স্বাধীন ইচ্ছাবলে সে ভাল-মন্দ বেছে নিতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বংশগত বা পারিপার্র্শ্বিকতার প্রভাব অনস্বীকার্য হলেও আমাদের মানতে হয় যে, মানুষ স্বাধীন, সে ক্রীতদাস নয়। পরিবেশ ও বংশগত প্রভাবের দোহাই দিয়ে মানুষ দায়মুক্ত হতে পারে না। এই কারণেই বলা হয়- জন্ম হোক যথাতথা, কর্ম হোক ভাল। মানুষ তার জন্মের জন্য দায়ী নয়; কিন্তু কর্মের জন্য দায়ী না হয়ে পারে না।
গ) ভালবাসার ক্ষমতা: সৃষ্টির মধ্যে একমাত্র মানুষই ভালবাসতে পারে। এই ভালবাসার পূর্বশর্ত হচ্ছে স্বাধীনতা। বলপূর্বক কারো কাছ থেকে ভালবাসা আদায় করা যায় না। আমাদের নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝি যে, আমাদের মধ্যে ভালবাসার ক্ষমতা আছে। আমরা ইচ্ছা করেই ভালবাসার অথবা ভাল-না-বাসার সিদ্ধান্ত নিতে পারি এই অর্থে, ভালবাসা হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত বা বেছে নেয়া। কেননা ভালবাসার সিদ্ধান্ত অপরের ‘কল্যাণে’ তাদের মঙ্গলের জন্য।
ঘ) দেহময় ব্যক্তিত্ব- দেহ আছে বলেই মানুষ বিশ্বের সমস্ত কিছুর সাথে সম্পর্ক গড়তে পারে, তার মধ্যে আবেগ, অনুভূতি, পছন্দ-অপছন্দ, আশা-আকাক্সক্ষা, স্পৃহা, ইত্যাদি উপস্থিত। এসব কিছু মিলেই আমাদের ব্যক্তি সত্তা।
ঙ) মানুষ সামাজিক জীব, কিন্তু অনন্য: আমি অনন্য, অর্থাৎ আমার মতো আর দ্বিতীয় কেউ নেই এই পৃথিবীতে। কিন্তু আমি সমাজে বাস করি, একা একা আমার পক্ষে বাস করা সম্ভব নয়। সুতরাং অপরের সাথে আমার সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
চ) মানুষ ঐতিহাসিকÑ ব্যক্তি মানুষের ও গোটা মানব-পরিবারের ইতিহাস আছেÑ অতীতের সাথে আমার একটি সম্পর্ক আছে যা আমার স্মৃতিতে বিদ্যমান।
২। শাস্ত্রবাণী: প্রতিটি ধর্মশাস্ত্রে মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছু বলা আছে। কিতাবী ধর্মের মানুষ বিশ্বাস করে যে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই পবিত্র শাস্ত্রের উৎস। সুতরাং শাস্ত্রে সৃষ্টিকর্তা নিজেই মানুষ সম্বন্ধে এমন সত্য প্রকাশ করেছেন যা মানুষ শুধুমাত্র তার বুদ্ধিবলে আবিষ্কার করতে পারে না। উদাহরণ স্বরূপ: বাইবেলে বলা হয়েছে যে, মানুষ ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে গড়া, মানুষের মধ্য শত মন্দতা থাকা সত্ত্বেও মূলত: উত্তম। মানুষ সৃষ্টিকর্তার সহকর্মী- তিনি মানুষকে সৃষ্ট বিশ্বের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার ও দায়িত্ব দিয়েছেন।
বাইবেলের নতুন নিয়মে বলা হয়েছে যে, মানুষ সবাই ঈশ্বরের সন্তান, পরস্পর ভাইবোন। ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে মানুষের মর্যাদা অসীম। প্রতিটি মানুষ ঈশ্বরের সন্তান বলে তাদের প্রতি বিশেষ করে সমাজের যারা দুর্বল, অসহায়, ‘ক্ষুদ্র’, তাদের প্রতি আমাদের বিশেষ দায়িত্ব আছে। আমাদের এসব ‘ক্ষুদ্রতম ভাইবোনদের’ প্রতি আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করা বা নাÑ করাই হবে আমাদের জীবনের চূড়ান্ত মূল্যায়নের মাপকাঠি।
৩। অনুধ্যান: নিজেকে জানার আর একটি মূল্যবান উপায় হচ্ছে অনুধ্যান বা অনুশ্চিন্তন। শাস্ত্রবাণীর আলোকে নিজের জীবন ও ঘটনাবলীকে বিশ্লেষণ করলে আমাদের আত্মজ্ঞান বৃদ্ধি পায়।
২) মানুষের জীবনের অর্থ এবং চরম ও পরম লক্ষ্য
আমার জীবনের অর্থ কি?Ñ এই প্রশ্নটি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা আমি মানুষ। আমার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য কি? মানুষের জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য ইহজীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, অমরত্বের আকাক্সক্ষা প্রতিটি মানব-সন্তানের অন্তরে বিদ্যমান। প্রকৃতপক্ষে অমরত্ব, অনন্তজীবন, পূর্ণতাÑ আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে এবং জীবনের গতিবিধি নির্দেশ করে। এই লক্ষ্যবোধই মানুষকে জীবনের সঠিকপথে চলতে অনুপ্রাণিত করে। এই লক্ষ্যকে বিভিন্ন ধর্মমত অনুযায়ী বিভিন্ন কথায় ব্যক্ত করা হয় যেমন, পরম মঙ্গল, ঈশ্বরোপলব্ধি, মোক্ষ, পরিত্রাণ, পূর্ণতা, ইত্যাদি।
এই প্রসঙ্গে স্মরণে রাখা কর্তব্য যে, সৃষ্টিকর্তার সাথে কোনরূপ ছলনা করা যায় না, কোন প্রকার চালাকি বা প্রবঞ্চনার আশ্রয় নেয়া যায় না। একমাত্র সত্যই মানুষকে মুক্ত করে, কেননা তিনি স্বয়ং সেই সৎ বা সত্য। তিনি নিজেই তো আমাদের পরিপূর্ণ মঙ্গল চান, তাই তাঁকে আমার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার কোন প্রয়োজন পড়ে না আর তা করা সম্ভবও নয়।
৩) আধ্যাত্মিকতা কি?
আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে সর্বাঙ্গীন সুস্থতা। আত্মিক শক্তিবলে মানুষ যখন তার দৈহিক প্রবৃত্তি-প্রবণতাকে, সপ্তরিপুকে বশে আনতে পারে তখনই সে আধ্যাত্মিক হয়ে ওঠে। অবশ্য এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, আজীবন সংগ্রাম। আধ্যাত্মিকতাকে আবার বলা সু-সম্পর্ক-¯্রষ্টার সাথে, নিজের সাথে, অপরের সাথে এবং বিশ্বসৃষ্টির সাথে এমতাবস্থায় মানুষ হয় পূর্ণাঙ্গ, অখ-, ভারসাম্য বিশিষ্ট। আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে একটি দৃষ্টিভঙ্গিÑ জগৎ ও জীবন সম্পর্কে, অন্য সবার সাথে আমার সম্পর্কে। দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতায় মানুষের সামনে যেমন চ্যালেঞ্জ আসে তার অর্থপূর্ণ ও সার্থক মোকাবিলা করার নামই আধ্যাত্মিকতা।
মানুষের মধ্যে দু’টি স্বভাব পরিলক্ষিত হয়: দৈহিক স্বভাব ও আত্মিক স্বভাব। এই দু’টি স্বভাব পরস্পর-বিরোধী, তাই এদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে প্রতিনিয়ত। মানুষকে তাই স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সে কোন স্বভাবের বশ্যতা স্বীকার করবে। সেই অনুযায়ী তার জীবনে ফল দেখা দিবে।
দৈহিক বা নি¤œতর স্বভাবের ফলগুলো হচ্ছে: ব্যভিচার, অশুচিতা, উচ্ছৃংখলতা, পৌত্তলিকতা, তন্ত্রমন্ত্রসাধন, শত্রুতা, বিষাদ, ঈর্ষা, ক্রোধ, রেষারেষি, দলাদলি, হিংসা, মাতলামি, বেসামাল ভোজ-উৎসব আর ওই ধরনের সমস্ত কিছু।
আর আত্মিক স্বভাবের ফলগুলো হচ্ছে: ভালবাসা, আনন্দ, শান্তি, সহিষ্ণুতা, সহৃদয়তা, মঙ্গলানুভবতা, বিশ্বস্ততা, কোমলতা আর আত্মসংযম।
আধ্যাত্মিকতা- জীবন সম্পর্কে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি
সবাই জীবনকে একভাবে দেখে না। আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে জীবনের অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে দেখাÑ একটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি। শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করা যায় না। পক্ষান্তরে গভীর অন্তর্দৃষ্টি মানুষের মনমানসিকতা, কাজ, সম্পর্ক, আচরণ, দায়িত্ব-কর্তব্য পালন, ইত্যাদি সবকিছুকেই প্রভাবিত করে।
আমরা প্রতিনিয়ত বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছি। আধ্যাত্মিক ব্যক্তি তার আধ্যাত্মিক শক্তিবলে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনÑ কোথায়, কখন, কিভাবে কি করতে হবে। এমনকি যখন বেছে নেয়ার উপায় থাকে না, তখন তিনি সেই অবশ্যম্ভাবী পরিস্থিতিতে বিশেষভাবে সাড়া দেন।
আধ্যাত্মিকতার প্রতিফলন আমরা ধর্মীয় কর্মকা-ে দেখতে পাইÑ যেমন, আমাদের প্রার্থনা, দয়ার কাজ, অপরাধীকে ক্ষমাদান, ইত্যাদি। এমনকি নিতান্ত সাধারণ ও তুচ্ছ ব্যাপারেও আধ্যাত্মিকতার প্রতিফলন ঘটেÑ টিকিটের লাইনে দাঁড়ানো, আগন্তুককে অভ্যর্থনা জানানো, একটি পাখিকে উড়ে যেতে দেখা, ইত্যাদি। এককথায়, আধ্যাত্মিকতা মানব-জীবনের সবদিক প্রভাবিত করে।
আধ্যাত্মিকতার ফলশ্রুতি
১। বিশ্বাসযোগ্যতা ২। নৈতিক ক্ষমতা ৩। আন্তরিক ও গভীরতা ৪। স্বচ্ছতা ৫। আত্মজ্ঞান ৬। নিজের সম্বন্ধে সঠিক ধারণা ও ৭। অন্তর্দৃষ্টি ৪ উন্নয়ন : উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য মানুষ নিজেই। মানুষ নিজে যদি সম্পদ হয়ে না ওঠে তবে তার হাজার সম্পদ থাকলেও তাতে তার কোনই লাভ হয় না। মানুষের উন্নয়ন বলতে বুঝায় তার দেহ-মন ও হৃদয়-আত্মার বিকাশ। এর মধ্যে প্রাধান্য থাকতে হবে আত্মার বিকাশের। মানুষের বিবেক গঠিত হলে প্রকৃত নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে না উঠলে সে তার দৈহিক ও মানসিক শক্তিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে অপরের ক্ষতি করতে বাধ্য- সে হয়ে উঠবে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক।
দ্বিতীয়ত : উন্নয়ন হতে হবে সবার জন্য। আমার দেহের কোন একটি অঙ্গের বিকাশকে সম্পূর্ণ দেহের স্বাস্থ্য বলা চলে না। ঠিক সেইভাবে, মুষ্টিমেয় কয়েকজনের উন্নতি হলেই তাকে প্রকৃত উন্নয়ন বলা যায় না। উন্নয়ন হতে হবে পারমার্থিক লক্ষ্যমুখী। জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্যের সাথে আমার জীবনাচরণ ও কর্মকা- সঙ্গতিপূর্ণ না হলে তা প্রকৃত উন্নয়ন হবে না।
দেহের যে অংশটি অসুস্থ থাকে, তারই চিকিৎসা আমরা করি। ঠিক সেভাবে প্রকৃত উন্নয়নের কাজ শুরু করতে হবে সমাজে যারা পিছিয়ে আছে, যারা দুর্বল, অসহায়, অবহেলিত তাদেরকে সাহায্য করার মধ্য দিয়েই প্রকৃত উন্নয়নের কাজ শুরু করতে হবে। কারণ সুস্থ মানুষের জন্য চিকিৎসকের প্রয়োজন নেই।
মানুষ নিজে যখন উন্নত হয়, অর্থাৎ তার দেহ-মন আত্মার বশে চলে, তখন অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মকা- সমাজের প্রকৃত মঙ্গল বয়ে আনবে।
সুতরাং, উন্নয়ন বলতে বুঝায় প্রতিটি ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ বা সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন এবং সমাজের সবার উন্নয়ন সবদিকের উন্নয়ন। সঠিক প্রাধান্যবোধ অবশ্যই থাকতে হবে। উন্নত সমাজ আমরা তাকেই বলব যেখানে মানুষের মাঝে আছে ন্যায্যতা, সমান অধিকার, স্বাধীনতা, শান্তি ও ভালোবাসা।
উন্নয়ন কর্মীর মৌলিক গুণাবলী
১. সঠিক জীবনবোধ ও জীবনদর্শন : আদর্শ সমাজের সুগভীর চেতনা।
২. ব্যক্তিগত জীবনে ও সমাজে সেই জীবনদর্শনের বাস্তবায়ন করার নিরলস প্রচেষ্টা।
৩. জীবনবোধ অপরের নিকট বোধগম্য করানোর এবং অপরকে তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জড়িত করার ক্ষমতা।
৫ আধ্যাত্মিক উন্নয়নের উপায় : আমাদের বিগত জীবনের ইতিহাস কম বেশি দীর্ঘ। ইতিমধ্যে পরিবার, স্কুল, সমাজ, ধর্মীয় অনুশাসন থেকে অনেক কিছু শিখেছি যা ভাল। আবার এমন অনেক কিছু আমাদের ব্যক্তিত্ব ও অভ্যাসের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে যা আমার ও অপরের জন্যে মোটেই মঙ্গলজনক নয়। আমাদের জীবন গতিশীল। আমরা স্বাধীন ইচ্ছা ব্যবহার করে আমাদের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারি। এর জন্য প্রয়োজন ঈশ্বরের অনুগ্রহ এবং আমার সাধনা। ঈশ্বরের অনুগ্রহের জন্য আমাদেরকে বিন¤্রভাবে প্রার্থনা করতে হবে এবং আমার দিক থেকে সাধনা করে সেই অনুগ্রহ গ্রহণ করতে হবে। এই সাধনার কয়েকটি উপায় এখানে তুলে ধরছি।
১. আত্মজ্ঞান বা নিজেকে জানা : আমার মধ্যে সবলতা ও দুর্বলতাÑ দুই আছে। এগুলো আবিষ্কার করতে হবে। এবং অকপটে স্বীকার করতে হবে। আমি যা নই তা মানুষকে দেখাতে চেষ্টা করার মধ্যে ভ-ামি থাকে। আবার ঈশ্বরপ্রদত্ত মর্যাদা ও গুণাবলী অস্বীকার করার মধ্যেও হীনমন্যতা থাকে। যা সত্য তাই স্বীকার করার মধ্যে প্রকৃত মঙ্গল নিহিত। সুতরাং নিজের সম্বন্ধে সঠিক ও অকৃত্রিম ধারণা থাকতে হবেÑ এর জন্য প্রয়োজন নিজেকে জানা।
২. আধ্যাত্মিক পরামর্শ : আমরা কেউই নিজের গুরু হতে পারি না। তাই আধ্যাত্মিকতায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ আমাদের জন্য অনেক উপকারী। সরল মন নিয়ে খোঁজ করলে আমরা অবশ্যই আধ্যাত্মিক গুরুর দেখা পাব।
৩. ধ্যানমূলক শাস্ত্র পাঠ ও অন্যান্য আধ্যাত্মিক পাঠ : পবিত্র শাস্ত্রগুলো হচ্ছে অধ্যাত্ম জ্ঞানের সারমর্ম, ঈশ্বরের অনুপ্রেরণায় আমাদের জন্য লিপিবদ্ধ। ধ্যানমূলকভাবে নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ নিয়মিত পাঠ করলে আমরা ঐশ্বরিক আলো ও শক্তি পাই। অন্যান্য আধ্যাত্মিক পুস্তক পাঠও আমাদেরকে আধ্যাত্মিকতায় বৃদ্ধি পেতে সহায়তা করে। তাবে এগুলো পাট করার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র তত্ত্ব বা তথ্য জানা নয়, তাতে বিশেষ উপকার হয় না। বিশ্বাস নিয়ে ধ্যানসহ এগুলো পাঠ করলে আমাদের জীবনে পরিবর্তন আসে।
৪. দৈনিক প্রার্থনা ও ধ্যান : প্রার্থনা হ’ল ঈশ্বরের সাথে আমার জীবনের বাস্তবতা নিয়ে সংলাপ। ঈশ্বর সবকিছুই দেখেন ও জানেন কিন্তু আমি জানি না। প্রার্থনা ও ধ্যানের মধ্য দিয়ে আমি নিজের সম্বন্ধে, ঈশ্বর ও মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সম্বন্ধে সচেতন হই। ধ্যান-প্রার্থনায় যে উপলব্ধি আসে তা মানুষের অন্তরের আসল ক্ষুধা ও পিপাসা মেটায়।
৫. আত্ম-পরীক্ষা : সাধারণত : দিনের শেষে ঈশ্বরের উপস্থিতিতে সারাদিনের কর্মকা-, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া মূল্যায়ন করলে আধ্যাত্মিক চেতনা বৃদ্ধি পায়। মূল্যায়ন শেষে ভাল কাজের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয়া এবং ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং সেগুলো সংশোধনের জন্য শক্তি প্রার্থনা করা খুবই লাভজনক।
৬. মাঝে মাঝে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় নিয়ে কিছুটা নির্জন স্থানে গিয়ে নিজের জীবন পর্যালোচনা ও ধ্যান প্রার্থনা করা আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধিতে খুবই সহায়ক।
সং-সঙ্গ : ভাল লোকের সংস্পর্শে আমরা ভাল হওয়ার প্রেরণা পাই। ভাল লোকের সাথে আলোচনা ও জীবনভিত্তিক সহভাগিতা আমার উন্নয়নের সহায়ক।
৮. পুনর্মিলন : আমরা অনেক সময় অপরের বিরুদ্ধে অপরাধ করি এবং আমাদের কথা, কাজ ও আচরণ দ্বারা তাদের মনে কষ্ট দেই। আবার অন্যেরাও আমার বিরুদ্ধে তাই করতে পারে। এভাবে সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর ক্ষত নিরাময় না হলে তা জমতে জমতে বিরাট আকার ধারণ করে। এই কারণে ক্ষমা দেয়া-নেয়া আমাদের অভ্যাস করতে হবে। ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষমা দেয়ার দুর্বলতার পরিচায়ক নয়; বরং ক্ষমা না চাওয়া ও না দেওয়াই সংকীর্ণতা ও দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ক্ষমা দেয়া-নেয়ার মধ্য দিয়ে পুনর্মিলন সাধিত হয়, আর পুনর্মিলনের আনন্দ একটি স্বর্গীয় অনুভূতি। কাথলিক খ্রীষ্টভক্তদের জন্য পাপ স্বীকার বা পুনর্মিলস সংস্কারের ব্যবস্থা আছে, যা আধ্যাত্মিকতায় বৃদ্ধি পাওয়ার একটি উৎকৃষ্ট পন্থা অনুতাপ, মনপরিবর্তন ও পাপ স্বীকারের মাধ্যমে হারানো পবিত্রতা ফিরে পাওয়া যায়, ভগ্ন সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, হৃদয়-মনের ক্ষত নিরাময় হয়।
আমাদের কর্মক্ষেত্রে ও পরিবারের নিয়মিত ক্ষমা দেয়া-নেয়ার অভ্যাস করতে হবে। মাঝে মাঝে বিশেষ উপলক্ষে পরিবারের সবাইকে নিয়ে পুনর্মিলনের ব্যবস্থা করলেও ভাল ফল পাওয়া সম্ভব।
৯. ইন্দ্রিয়দমন বা সংযম : আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ মাধ্যম। ইন্দ্রিয়গুলোকে ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে বশে রাখতে হবে।
১০. সমাজ কর্মীর জন্য বাড়তি উপায় : বাস্তব অভিজ্ঞতা, পর্যালোচনা/অনুধ্যান ও সচেতনতা। চক্রাকার এই পদ্ধতিকে বলে জীবনের পুনর্মিলন পদ্ধতি, যা আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।
সহভাগিতার জন্য প্রশ্ন
১. আপনার জীবনে আধ্যাত্মিকতার বৃদ্ধি পেতে কি সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে।
২. আপনি কি আপনার পরিবারের সবার সাথে বিদ্যমান সম্পর্ক নিয়ে সন্তুষ্ট? কেন? সহভাগিতা করুন।
৩. আপনার পরিবারের বিভিন্ন জনের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্যে এবং তা বজায় রাখার জন্যে কি কি পদ্ধতি অনুসরণ করেন? সহভাগিতা করুন।
৪. আপনার পরিবারে অথবা প্রতিবেশীর সাথে আপনার পুনর্মিলনের (ক্ষমা দেয়া-নেয়ার) অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করুন।
৫. আপনার ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের প্রধান চালিকা শক্তি কি? তার উৎস কোথায়?
লেখক . উপাচার্য, নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।
ভূমিকা: “আপনি কেমন আছেন?”Ñ এই প্রশ্নটির উত্তর আমরা সবাই খুব সহজভাবে দিয়ে থাকি। সম্ভবত: ৯৯% লোকই এমন উত্তর দিবে। তবে এত বেশি সংখ্যক লোকই যদি সত্যই ভাল থাকতো, তাহলে সমাজের অবস্থা এমন হওয়ার কারণ কি? মানুষের মাঝে কেন এত অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা, মানসিক যন্ত্রণা? মানুষের মাঝে কেন এত ভয়, দুশ্চিন্তা, নিরাপত্তার অভাব? সমাজে কেন এত অপরাধ: ঘুষ, দুর্নীতি, কাজে অবহেলা, সন্ত্রাস, শোষণ-নির্যাতন, পারিবারিক অশান্তি, বিচ্ছেদ, কলহ, শত্রুতা? এসব কি ভাল থাকার লক্ষণ? আপনি কিভাবে এত সহজ করে বলতে পারেন যে, আপনি ভাল আছেন?
আপনি বা আমি আসলে কেমন আছি, তা জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ, অসুস্থ মানুষকে দিয়ে ভাল কাজ করানো সম্ভব নয়। আর মানুষ যদি সত্যিই সুস্থ হতো, তাহলে সমাজটাও সুস্থ হতো, কেননা মানুষকে নিয়েই তো সমাজ। সুতরাং সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন যাপন করার উপায় জানা একান্ত দরকার। আর আমি যদি সত্যিই সুস্থ থাকি তবে আমি সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে পারব। আমার প্রকৃত সুস্থতা শুধুমাত্র আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তার প্রভাব আমার আদর্শ ও কাজের মধ্য দিয়ে সমাজের উপর পড়বেই। আধ্যাত্মিকতা প্রকৃতপক্ষে খাঁটি সুস্থতাÑ গোটা মানব-ব্যক্তির পরিপূর্ণ সুস্থতা।
১। মানুষ কে বা কি?
এই প্রশ্নটি মৌলিক। পশুপক্ষীর কোন আধ্যাত্মিকতা নেই, তার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু মানুষের আধ্যাত্মিকতা তার নিজের জন্যই অপরিহার্য। সুতরাং আমাকে জানতে হবে মানুষ কে বা কি? মানুষ সম্বন্ধে আমার নিজের সম্বন্ধে ধারণার উপরই নির্ভর করে মানুষের (আমার) আচরণ। সুতরাং এই ধারণাটাও সঠিক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব-দেহ, মন ও হৃদয়-আত্মা নিয়ে গড়া অখ- সত্তা। মানুষকে সৃষ্টিকর্তা মহান মর্যাদা দিয়ে নিজের প্রতিমূর্তিতে (প্রতিনিধি করে) সৃষ্টি করেছেন। দেহ ও আত্মার সমন্বয়েই মানুষ, তাই তাকে বলা যায় দেহময় আত্মা অথবা আত্মাময় দেহ। আর এই আত্মার কারণেই মানুষ অন্যান্য প্রাণী হতে শ্রেষ্ঠ। সুতরাং মানুষের মধ্যে অবশ্যই আত্মার প্রাধান্য থাকতে হবে, আর আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে আত্মা-সম্পর্কিত ব্যাপার।
ফুল স্বভাবতই ফুল, যদিও ফুলকেও বিকশিত হতে হয় প্রাকৃতিক নিয়মেই। মানুষকে কিন্তু শুধু আকৃতিগত দিক দিয়েই নয় বরং প্রকৃতিগত দিক দিয়েও বিকশিত হতে হয় সাধনাবলে। কেননা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা আছে, যা অন্যান্য প্রাণীর নেই।
মানুষকে মনুষ্যত্ব আপনা-আপনি বিকশিত হয় না তাকে সচেষ্ট সাধনাবলে বিকশিত হতে হয়। এই উদ্দেশ্যে নিজেকে জানা (আত্মানং বিদ্ধি) প্রয়োজন। এই আত্মাজ্ঞান লাভ করা একটি প্রক্রিয়া। যে ব্যক্তি নিজেকে যত ভাল করে জানবে সেই ব্যক্তির আচরণ তত উন্নত হবে।
নিজেকে জানার উপায়
১। মানব-প্রকৃতি বিশ্লেষণ/পর্যালোচনা করে। মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই তার প্রকাশ:
ক) মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী
খ) মানুষ স্বাধীন- তার স্বাধীন ইচ্ছাবলে সে ভাল-মন্দ বেছে নিতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বংশগত বা পারিপার্র্শ্বিকতার প্রভাব অনস্বীকার্য হলেও আমাদের মানতে হয় যে, মানুষ স্বাধীন, সে ক্রীতদাস নয়। পরিবেশ ও বংশগত প্রভাবের দোহাই দিয়ে মানুষ দায়মুক্ত হতে পারে না। এই কারণেই বলা হয়- জন্ম হোক যথাতথা, কর্ম হোক ভাল। মানুষ তার জন্মের জন্য দায়ী নয়; কিন্তু কর্মের জন্য দায়ী না হয়ে পারে না।
গ) ভালবাসার ক্ষমতা: সৃষ্টির মধ্যে একমাত্র মানুষই ভালবাসতে পারে। এই ভালবাসার পূর্বশর্ত হচ্ছে স্বাধীনতা। বলপূর্বক কারো কাছ থেকে ভালবাসা আদায় করা যায় না। আমাদের নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝি যে, আমাদের মধ্যে ভালবাসার ক্ষমতা আছে। আমরা ইচ্ছা করেই ভালবাসার অথবা ভাল-না-বাসার সিদ্ধান্ত নিতে পারি এই অর্থে, ভালবাসা হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত বা বেছে নেয়া। কেননা ভালবাসার সিদ্ধান্ত অপরের ‘কল্যাণে’ তাদের মঙ্গলের জন্য।
ঘ) দেহময় ব্যক্তিত্ব- দেহ আছে বলেই মানুষ বিশ্বের সমস্ত কিছুর সাথে সম্পর্ক গড়তে পারে, তার মধ্যে আবেগ, অনুভূতি, পছন্দ-অপছন্দ, আশা-আকাক্সক্ষা, স্পৃহা, ইত্যাদি উপস্থিত। এসব কিছু মিলেই আমাদের ব্যক্তি সত্তা।
ঙ) মানুষ সামাজিক জীব, কিন্তু অনন্য: আমি অনন্য, অর্থাৎ আমার মতো আর দ্বিতীয় কেউ নেই এই পৃথিবীতে। কিন্তু আমি সমাজে বাস করি, একা একা আমার পক্ষে বাস করা সম্ভব নয়। সুতরাং অপরের সাথে আমার সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
চ) মানুষ ঐতিহাসিকÑ ব্যক্তি মানুষের ও গোটা মানব-পরিবারের ইতিহাস আছেÑ অতীতের সাথে আমার একটি সম্পর্ক আছে যা আমার স্মৃতিতে বিদ্যমান।
২। শাস্ত্রবাণী: প্রতিটি ধর্মশাস্ত্রে মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছু বলা আছে। কিতাবী ধর্মের মানুষ বিশ্বাস করে যে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই পবিত্র শাস্ত্রের উৎস। সুতরাং শাস্ত্রে সৃষ্টিকর্তা নিজেই মানুষ সম্বন্ধে এমন সত্য প্রকাশ করেছেন যা মানুষ শুধুমাত্র তার বুদ্ধিবলে আবিষ্কার করতে পারে না। উদাহরণ স্বরূপ: বাইবেলে বলা হয়েছে যে, মানুষ ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে গড়া, মানুষের মধ্য শত মন্দতা থাকা সত্ত্বেও মূলত: উত্তম। মানুষ সৃষ্টিকর্তার সহকর্মী- তিনি মানুষকে সৃষ্ট বিশ্বের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার ও দায়িত্ব দিয়েছেন।
বাইবেলের নতুন নিয়মে বলা হয়েছে যে, মানুষ সবাই ঈশ্বরের সন্তান, পরস্পর ভাইবোন। ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে মানুষের মর্যাদা অসীম। প্রতিটি মানুষ ঈশ্বরের সন্তান বলে তাদের প্রতি বিশেষ করে সমাজের যারা দুর্বল, অসহায়, ‘ক্ষুদ্র’, তাদের প্রতি আমাদের বিশেষ দায়িত্ব আছে। আমাদের এসব ‘ক্ষুদ্রতম ভাইবোনদের’ প্রতি আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করা বা নাÑ করাই হবে আমাদের জীবনের চূড়ান্ত মূল্যায়নের মাপকাঠি।
৩। অনুধ্যান: নিজেকে জানার আর একটি মূল্যবান উপায় হচ্ছে অনুধ্যান বা অনুশ্চিন্তন। শাস্ত্রবাণীর আলোকে নিজের জীবন ও ঘটনাবলীকে বিশ্লেষণ করলে আমাদের আত্মজ্ঞান বৃদ্ধি পায়।
২) মানুষের জীবনের অর্থ এবং চরম ও পরম লক্ষ্য
আমার জীবনের অর্থ কি?Ñ এই প্রশ্নটি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা আমি মানুষ। আমার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য কি? মানুষের জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য ইহজীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, অমরত্বের আকাক্সক্ষা প্রতিটি মানব-সন্তানের অন্তরে বিদ্যমান। প্রকৃতপক্ষে অমরত্ব, অনন্তজীবন, পূর্ণতাÑ আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে এবং জীবনের গতিবিধি নির্দেশ করে। এই লক্ষ্যবোধই মানুষকে জীবনের সঠিকপথে চলতে অনুপ্রাণিত করে। এই লক্ষ্যকে বিভিন্ন ধর্মমত অনুযায়ী বিভিন্ন কথায় ব্যক্ত করা হয় যেমন, পরম মঙ্গল, ঈশ্বরোপলব্ধি, মোক্ষ, পরিত্রাণ, পূর্ণতা, ইত্যাদি।
এই প্রসঙ্গে স্মরণে রাখা কর্তব্য যে, সৃষ্টিকর্তার সাথে কোনরূপ ছলনা করা যায় না, কোন প্রকার চালাকি বা প্রবঞ্চনার আশ্রয় নেয়া যায় না। একমাত্র সত্যই মানুষকে মুক্ত করে, কেননা তিনি স্বয়ং সেই সৎ বা সত্য। তিনি নিজেই তো আমাদের পরিপূর্ণ মঙ্গল চান, তাই তাঁকে আমার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার কোন প্রয়োজন পড়ে না আর তা করা সম্ভবও নয়।
৩) আধ্যাত্মিকতা কি?
আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে সর্বাঙ্গীন সুস্থতা। আত্মিক শক্তিবলে মানুষ যখন তার দৈহিক প্রবৃত্তি-প্রবণতাকে, সপ্তরিপুকে বশে আনতে পারে তখনই সে আধ্যাত্মিক হয়ে ওঠে। অবশ্য এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, আজীবন সংগ্রাম। আধ্যাত্মিকতাকে আবার বলা সু-সম্পর্ক-¯্রষ্টার সাথে, নিজের সাথে, অপরের সাথে এবং বিশ্বসৃষ্টির সাথে এমতাবস্থায় মানুষ হয় পূর্ণাঙ্গ, অখ-, ভারসাম্য বিশিষ্ট। আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে একটি দৃষ্টিভঙ্গিÑ জগৎ ও জীবন সম্পর্কে, অন্য সবার সাথে আমার সম্পর্কে। দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতায় মানুষের সামনে যেমন চ্যালেঞ্জ আসে তার অর্থপূর্ণ ও সার্থক মোকাবিলা করার নামই আধ্যাত্মিকতা।
মানুষের মধ্যে দু’টি স্বভাব পরিলক্ষিত হয়: দৈহিক স্বভাব ও আত্মিক স্বভাব। এই দু’টি স্বভাব পরস্পর-বিরোধী, তাই এদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে প্রতিনিয়ত। মানুষকে তাই স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সে কোন স্বভাবের বশ্যতা স্বীকার করবে। সেই অনুযায়ী তার জীবনে ফল দেখা দিবে।
দৈহিক বা নি¤œতর স্বভাবের ফলগুলো হচ্ছে: ব্যভিচার, অশুচিতা, উচ্ছৃংখলতা, পৌত্তলিকতা, তন্ত্রমন্ত্রসাধন, শত্রুতা, বিষাদ, ঈর্ষা, ক্রোধ, রেষারেষি, দলাদলি, হিংসা, মাতলামি, বেসামাল ভোজ-উৎসব আর ওই ধরনের সমস্ত কিছু।
আর আত্মিক স্বভাবের ফলগুলো হচ্ছে: ভালবাসা, আনন্দ, শান্তি, সহিষ্ণুতা, সহৃদয়তা, মঙ্গলানুভবতা, বিশ্বস্ততা, কোমলতা আর আত্মসংযম।
আধ্যাত্মিকতা- জীবন সম্পর্কে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি
সবাই জীবনকে একভাবে দেখে না। আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে জীবনের অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে দেখাÑ একটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি। শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করা যায় না। পক্ষান্তরে গভীর অন্তর্দৃষ্টি মানুষের মনমানসিকতা, কাজ, সম্পর্ক, আচরণ, দায়িত্ব-কর্তব্য পালন, ইত্যাদি সবকিছুকেই প্রভাবিত করে।
আমরা প্রতিনিয়ত বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছি। আধ্যাত্মিক ব্যক্তি তার আধ্যাত্মিক শক্তিবলে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনÑ কোথায়, কখন, কিভাবে কি করতে হবে। এমনকি যখন বেছে নেয়ার উপায় থাকে না, তখন তিনি সেই অবশ্যম্ভাবী পরিস্থিতিতে বিশেষভাবে সাড়া দেন।
আধ্যাত্মিকতার প্রতিফলন আমরা ধর্মীয় কর্মকা-ে দেখতে পাইÑ যেমন, আমাদের প্রার্থনা, দয়ার কাজ, অপরাধীকে ক্ষমাদান, ইত্যাদি। এমনকি নিতান্ত সাধারণ ও তুচ্ছ ব্যাপারেও আধ্যাত্মিকতার প্রতিফলন ঘটেÑ টিকিটের লাইনে দাঁড়ানো, আগন্তুককে অভ্যর্থনা জানানো, একটি পাখিকে উড়ে যেতে দেখা, ইত্যাদি। এককথায়, আধ্যাত্মিকতা মানব-জীবনের সবদিক প্রভাবিত করে।
আধ্যাত্মিকতার ফলশ্রুতি
১। বিশ্বাসযোগ্যতা ২। নৈতিক ক্ষমতা ৩। আন্তরিক ও গভীরতা ৪। স্বচ্ছতা ৫। আত্মজ্ঞান ৬। নিজের সম্বন্ধে সঠিক ধারণা ও ৭। অন্তর্দৃষ্টি ৪ উন্নয়ন : উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য মানুষ নিজেই। মানুষ নিজে যদি সম্পদ হয়ে না ওঠে তবে তার হাজার সম্পদ থাকলেও তাতে তার কোনই লাভ হয় না। মানুষের উন্নয়ন বলতে বুঝায় তার দেহ-মন ও হৃদয়-আত্মার বিকাশ। এর মধ্যে প্রাধান্য থাকতে হবে আত্মার বিকাশের। মানুষের বিবেক গঠিত হলে প্রকৃত নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে না উঠলে সে তার দৈহিক ও মানসিক শক্তিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে অপরের ক্ষতি করতে বাধ্য- সে হয়ে উঠবে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক।
দ্বিতীয়ত : উন্নয়ন হতে হবে সবার জন্য। আমার দেহের কোন একটি অঙ্গের বিকাশকে সম্পূর্ণ দেহের স্বাস্থ্য বলা চলে না। ঠিক সেইভাবে, মুষ্টিমেয় কয়েকজনের উন্নতি হলেই তাকে প্রকৃত উন্নয়ন বলা যায় না। উন্নয়ন হতে হবে পারমার্থিক লক্ষ্যমুখী। জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্যের সাথে আমার জীবনাচরণ ও কর্মকা- সঙ্গতিপূর্ণ না হলে তা প্রকৃত উন্নয়ন হবে না।
দেহের যে অংশটি অসুস্থ থাকে, তারই চিকিৎসা আমরা করি। ঠিক সেভাবে প্রকৃত উন্নয়নের কাজ শুরু করতে হবে সমাজে যারা পিছিয়ে আছে, যারা দুর্বল, অসহায়, অবহেলিত তাদেরকে সাহায্য করার মধ্য দিয়েই প্রকৃত উন্নয়নের কাজ শুরু করতে হবে। কারণ সুস্থ মানুষের জন্য চিকিৎসকের প্রয়োজন নেই।
মানুষ নিজে যখন উন্নত হয়, অর্থাৎ তার দেহ-মন আত্মার বশে চলে, তখন অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মকা- সমাজের প্রকৃত মঙ্গল বয়ে আনবে।
সুতরাং, উন্নয়ন বলতে বুঝায় প্রতিটি ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ বা সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন এবং সমাজের সবার উন্নয়ন সবদিকের উন্নয়ন। সঠিক প্রাধান্যবোধ অবশ্যই থাকতে হবে। উন্নত সমাজ আমরা তাকেই বলব যেখানে মানুষের মাঝে আছে ন্যায্যতা, সমান অধিকার, স্বাধীনতা, শান্তি ও ভালোবাসা।
উন্নয়ন কর্মীর মৌলিক গুণাবলী
১. সঠিক জীবনবোধ ও জীবনদর্শন : আদর্শ সমাজের সুগভীর চেতনা।
২. ব্যক্তিগত জীবনে ও সমাজে সেই জীবনদর্শনের বাস্তবায়ন করার নিরলস প্রচেষ্টা।
৩. জীবনবোধ অপরের নিকট বোধগম্য করানোর এবং অপরকে তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জড়িত করার ক্ষমতা।
৫ আধ্যাত্মিক উন্নয়নের উপায় : আমাদের বিগত জীবনের ইতিহাস কম বেশি দীর্ঘ। ইতিমধ্যে পরিবার, স্কুল, সমাজ, ধর্মীয় অনুশাসন থেকে অনেক কিছু শিখেছি যা ভাল। আবার এমন অনেক কিছু আমাদের ব্যক্তিত্ব ও অভ্যাসের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে যা আমার ও অপরের জন্যে মোটেই মঙ্গলজনক নয়। আমাদের জীবন গতিশীল। আমরা স্বাধীন ইচ্ছা ব্যবহার করে আমাদের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারি। এর জন্য প্রয়োজন ঈশ্বরের অনুগ্রহ এবং আমার সাধনা। ঈশ্বরের অনুগ্রহের জন্য আমাদেরকে বিন¤্রভাবে প্রার্থনা করতে হবে এবং আমার দিক থেকে সাধনা করে সেই অনুগ্রহ গ্রহণ করতে হবে। এই সাধনার কয়েকটি উপায় এখানে তুলে ধরছি।
১. আত্মজ্ঞান বা নিজেকে জানা : আমার মধ্যে সবলতা ও দুর্বলতাÑ দুই আছে। এগুলো আবিষ্কার করতে হবে। এবং অকপটে স্বীকার করতে হবে। আমি যা নই তা মানুষকে দেখাতে চেষ্টা করার মধ্যে ভ-ামি থাকে। আবার ঈশ্বরপ্রদত্ত মর্যাদা ও গুণাবলী অস্বীকার করার মধ্যেও হীনমন্যতা থাকে। যা সত্য তাই স্বীকার করার মধ্যে প্রকৃত মঙ্গল নিহিত। সুতরাং নিজের সম্বন্ধে সঠিক ও অকৃত্রিম ধারণা থাকতে হবেÑ এর জন্য প্রয়োজন নিজেকে জানা।
২. আধ্যাত্মিক পরামর্শ : আমরা কেউই নিজের গুরু হতে পারি না। তাই আধ্যাত্মিকতায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ আমাদের জন্য অনেক উপকারী। সরল মন নিয়ে খোঁজ করলে আমরা অবশ্যই আধ্যাত্মিক গুরুর দেখা পাব।
৩. ধ্যানমূলক শাস্ত্র পাঠ ও অন্যান্য আধ্যাত্মিক পাঠ : পবিত্র শাস্ত্রগুলো হচ্ছে অধ্যাত্ম জ্ঞানের সারমর্ম, ঈশ্বরের অনুপ্রেরণায় আমাদের জন্য লিপিবদ্ধ। ধ্যানমূলকভাবে নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ নিয়মিত পাঠ করলে আমরা ঐশ্বরিক আলো ও শক্তি পাই। অন্যান্য আধ্যাত্মিক পুস্তক পাঠও আমাদেরকে আধ্যাত্মিকতায় বৃদ্ধি পেতে সহায়তা করে। তাবে এগুলো পাট করার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র তত্ত্ব বা তথ্য জানা নয়, তাতে বিশেষ উপকার হয় না। বিশ্বাস নিয়ে ধ্যানসহ এগুলো পাঠ করলে আমাদের জীবনে পরিবর্তন আসে।
৪. দৈনিক প্রার্থনা ও ধ্যান : প্রার্থনা হ’ল ঈশ্বরের সাথে আমার জীবনের বাস্তবতা নিয়ে সংলাপ। ঈশ্বর সবকিছুই দেখেন ও জানেন কিন্তু আমি জানি না। প্রার্থনা ও ধ্যানের মধ্য দিয়ে আমি নিজের সম্বন্ধে, ঈশ্বর ও মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সম্বন্ধে সচেতন হই। ধ্যান-প্রার্থনায় যে উপলব্ধি আসে তা মানুষের অন্তরের আসল ক্ষুধা ও পিপাসা মেটায়।
৫. আত্ম-পরীক্ষা : সাধারণত : দিনের শেষে ঈশ্বরের উপস্থিতিতে সারাদিনের কর্মকা-, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া মূল্যায়ন করলে আধ্যাত্মিক চেতনা বৃদ্ধি পায়। মূল্যায়ন শেষে ভাল কাজের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয়া এবং ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং সেগুলো সংশোধনের জন্য শক্তি প্রার্থনা করা খুবই লাভজনক।
৬. মাঝে মাঝে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় নিয়ে কিছুটা নির্জন স্থানে গিয়ে নিজের জীবন পর্যালোচনা ও ধ্যান প্রার্থনা করা আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধিতে খুবই সহায়ক।
সং-সঙ্গ : ভাল লোকের সংস্পর্শে আমরা ভাল হওয়ার প্রেরণা পাই। ভাল লোকের সাথে আলোচনা ও জীবনভিত্তিক সহভাগিতা আমার উন্নয়নের সহায়ক।
৮. পুনর্মিলন : আমরা অনেক সময় অপরের বিরুদ্ধে অপরাধ করি এবং আমাদের কথা, কাজ ও আচরণ দ্বারা তাদের মনে কষ্ট দেই। আবার অন্যেরাও আমার বিরুদ্ধে তাই করতে পারে। এভাবে সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর ক্ষত নিরাময় না হলে তা জমতে জমতে বিরাট আকার ধারণ করে। এই কারণে ক্ষমা দেয়া-নেয়া আমাদের অভ্যাস করতে হবে। ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষমা দেয়ার দুর্বলতার পরিচায়ক নয়; বরং ক্ষমা না চাওয়া ও না দেওয়াই সংকীর্ণতা ও দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ক্ষমা দেয়া-নেয়ার মধ্য দিয়ে পুনর্মিলন সাধিত হয়, আর পুনর্মিলনের আনন্দ একটি স্বর্গীয় অনুভূতি। কাথলিক খ্রীষ্টভক্তদের জন্য পাপ স্বীকার বা পুনর্মিলস সংস্কারের ব্যবস্থা আছে, যা আধ্যাত্মিকতায় বৃদ্ধি পাওয়ার একটি উৎকৃষ্ট পন্থা অনুতাপ, মনপরিবর্তন ও পাপ স্বীকারের মাধ্যমে হারানো পবিত্রতা ফিরে পাওয়া যায়, ভগ্ন সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, হৃদয়-মনের ক্ষত নিরাময় হয়।
আমাদের কর্মক্ষেত্রে ও পরিবারের নিয়মিত ক্ষমা দেয়া-নেয়ার অভ্যাস করতে হবে। মাঝে মাঝে বিশেষ উপলক্ষে পরিবারের সবাইকে নিয়ে পুনর্মিলনের ব্যবস্থা করলেও ভাল ফল পাওয়া সম্ভব।
৯. ইন্দ্রিয়দমন বা সংযম : আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ মাধ্যম। ইন্দ্রিয়গুলোকে ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে বশে রাখতে হবে।
১০. সমাজ কর্মীর জন্য বাড়তি উপায় : বাস্তব অভিজ্ঞতা, পর্যালোচনা/অনুধ্যান ও সচেতনতা। চক্রাকার এই পদ্ধতিকে বলে জীবনের পুনর্মিলন পদ্ধতি, যা আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।
সহভাগিতার জন্য প্রশ্ন
১. আপনার জীবনে আধ্যাত্মিকতার বৃদ্ধি পেতে কি সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে।
২. আপনি কি আপনার পরিবারের সবার সাথে বিদ্যমান সম্পর্ক নিয়ে সন্তুষ্ট? কেন? সহভাগিতা করুন।
৩. আপনার পরিবারের বিভিন্ন জনের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্যে এবং তা বজায় রাখার জন্যে কি কি পদ্ধতি অনুসরণ করেন? সহভাগিতা করুন।
৪. আপনার পরিবারে অথবা প্রতিবেশীর সাথে আপনার পুনর্মিলনের (ক্ষমা দেয়া-নেয়ার) অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করুন।
৫. আপনার ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের প্রধান চালিকা শক্তি কি? তার উৎস কোথায়?
লেখক . উপাচার্য, নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।
No comments:
Write comments