আত্মজিজ্ঞাসা ও মুসলিম বিশ্বে আগ্রাসন
১.
আফ্রিকা, আরব, উপমহাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান প্রকাশ্য ও গুপ্ত আগ্রাসন। কেউ বলতে পারবে না, ২০১৪ সালে ঈদ-উল-ফিতর কতজন মুসলিম শান্তিতে পালন করতে পেরেছেন গাজার মুসলমানরা জীবন বাঁচাতেই পারেনি; ঈদ করার তো প্রশ্নই আসে না। ফিলিস্তিনের অন্যান্য স্থানেও একই করুণ চিত্র। কাশ্মীর বা আরব বিশ্বের নানা স্থানেও অভিন্ন নিবর্তনমূলক পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। আগ্রাসন আর আক্রমণের অক্টোপাসের জালে আক্রান্ত আজকের মুসলিম বিশ্ব। এই হলো সাম্প্রতিক আগ্রাসনের সর্বশেষ কাহিনী।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সিরিয়া আত্মকলহে নিঃশেষ হওয়ার দিকেই ধাবমান। দেশটি এখন বিভক্তির শেষ পর্যায়ে। ইয়েমেন পরিণত হয়েছে ওবামার ড্রোন হামলার সর্বব্যাপী ক্ষেত্ররূপে। তিউনিসিয়াকেও বিপজ্জনক স্থানে পরিণত করা হয়েছে। বিপর্যয়ের পরেও লিবিয়া এমন একটি সরকার গঠন করতে পারেনি, যা সেনাদের নিয়ন্ত্রণ ও দমন করতে পারবে। মিসরসহ অধিকাংশ আরব দেশে পশ্চিমের মদদে সামরিক বাহিনী চরম নৃশংসতামূলক-অগণতান্ত্রিক ও মানবতা-মানবাধিকার বিরোধী কার্যক্রম চালাচ্ছে। ইরাকে মার্কিন-ব্রিটিশ আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট সংঘাত দেশটিকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। আত্মকলহের দুষ্টক্ষত সশস্ত্রভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র অঞ্চলে। আফ্রিকার পশ্চিম-সাহারার মুসলিম দেশগুলো এখন এই আধুনিক সময়েও উপনিবেশরূপে রয়েছে। তাদের স্বাধীনতার আন্দোলনকে অতিশয় নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে। স্বাধীনতাকামী জনগণকে পর্যুদস্ত করা হয়েছে। আন্দোলন এখন সেসব দেশে বিস্মৃত বিষয়। পাশেই ফিলিস্তিনে স্বাধীনতার প্রাচীন আন্দোলনকে বার বার ইসরাইল রক্তাক্ত করছে। গাজায় যে নৃশংসতম হত্যাকা- চালানো হচ্ছে, তা ইতিহাসের বিরলতম গণহত্যা। হিটলারের ইহুদী নিধনের চেয়ে বর্বর রূপ ধারণ করেছে মুসলিম হত্যা। বস্তুতপক্ষে, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ ও অঞ্চলসমূহ এবং সেখানকার মানুষজন প্রবল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্রে নাস্তানাবুদ হচ্ছে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বিশৃঙ্খলায় ডুবিয়ে দেয়া হচ্ছে সেসব মুসলিম জনপদ। স্বাধীন মানুষরূপে স্বাধীন জনপদের জন্য দাঁড়াতেই পারছে না তারা। আত্মকলহ ও আদর্শহীন লড়াইয়ে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। অন্তর্ঘাত ও আত্মকোন্দলের পথে বিদেশী শক্তি, উপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদীরা মুসলিম বিশ্বকে আগ্রাসনে জর্জরিত করার যে সুযোগ পাচ্ছে, বর্তমানে সেটা আরো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসলাম ও মুসলমানদের বিপদ এখন কেবল বাইরে থেকেই নয়, ভিতর থেকেও গুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসে ওঠছে। যার পরিণতিতে শত্রু এবং ভ্রাতৃরূপী শত্রুর হাতে আহত-নিহত হয়ে হাজার হাজার মুসলিম আরবের, আফ্রিকার পথে পথে পড়ে রয়েছে। ইতিহাসের এ এক বড়ই করুণ অধ্যায়। নির্মম পরিস্থিতি। বিশ্ব মুসলিম মরোক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত এখন এমনই সকরুণ অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন গুজরান করছে। বাংলাদেশের মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থাও এই নির্মমাতার বাইরে নেই। বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলমানগণ একটি চলমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই এগিয়ে চলেছে। আশার কথা হলো, শত চাপ ও হামলার মধ্যেও ইসলামী আন্দোলন ক্রমেই জনসম্পৃক্ততা, জনসমর্থন অর্জন করে এগিয়ে চলেছে। মানুষের মধ্যে ক্রমেই এই ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে যে, একমাত্র ইসলামভিত্তিক আদর্শবাদী আন্দোলনই কেবল বাংলাদেশের অন্ধকার বর্তমানকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতে পরিণত করতে পারবে।
২.
আগ্রাসন বা সমস্যার চিত্র দূরের মতো নিকট বা কাছেও কম নেই। এখানেও আগ্রাসনের প্রকাশ্য বা গোপন তৎপরতার বিরাম নেই। বরং আরব বিশ্বের মতোই দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশেও সুপ্তভাবে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী আগ্রাসন ধীরে ধীরে বাড়ছেই। পানি ও নদী বিষয়ক আগ্রাসনের বিষয় আলোচনা করলেই সেটা স্পষ্টভাবে দেখা যাবে।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে গেলে এ অঞ্চলের আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ব্যবহার নিয়ে আঞ্চলিক সঙ্কট দেখা দেয়। তখন বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচীতে ভারত ও পাকিস্তানের সরকার প্রধানরা সিন্ধু অববাহিকার নদীগুলোর পানি ব্যবহার নিয়ে ‘ইনডাস ওয়াটার ট্রিটি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী পাঞ্জাবের রাভি, সাটলেজ ও বিয়াস নদীর পুরো প্রবাহ ভারতকে এবং সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব নদীর পুরো প্রবাহ পাকিস্তানকে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। ‘ইনডাস ওয়াটার ট্রিটি’ সম্পাদনের পর ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের সময়ও তারা কিন্তু পানি-চুক্তি ভঙ্গ করেনি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পর বাংলাদেশের ৫৪টি নদী ভারতের সঙ্গে অভিন্ন রূপে চিহ্ণিত হয়। ভারত ষাটের দশকে গঙ্গা নদীতে ফারাক্কার উপর যে ব্যারেজ নির্মাণ শুরু করে, তা কিন্তু পাকিস্তান আমলে চালু করতে পারেনি; চালু করেছে বাংলাদেশ আমলে ১৯৭৫ সালে। ভারত তখন একটি সংযোগ খালের মাধ্যমে ৪০,০০০ কিউসেক পানি হুগলি নদীতে প্রত্যাহার করতে শুরু করে। এর ফলে হঠাৎ করে বাংলাদেশ অংশে গঙ্গার পানি প্রবাহ কমে যায় এবং গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে উত্তেজনা ও সমস্যা সৃষ্টি হয়। ১৯৭৭ সালে ভারত ও বাংলাশে প্রথমবারের মতো গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করে। ঐ চুক্তিতে যে কোনো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে ন্যূনতম ৩৪,৫০০ কিউসেক পানি দেয়ার গ্যারান্টি ছিল। পাঁচ বছর মেয়াদী ঐ চুক্তির সময় উত্তীর্ণ হলে ভারত ইচ্ছামাফিক পানি আটকাতে থাকে। এর ফলে একসময় গঙ্গা নদীর পানি প্রবাহ বাংলাদেশ অংশে ১০,০০০ কিউসেকে নেমে আসে। পরে ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে ত্রিশ বছর মেয়াদী দ্বিতীয় গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি হয়। এ চুক্তিতে ন্যূনতম ২৭,৬৩৩ কিউসেক পানি দেয়ার কথা থাকলেও এ ব্যাপারে কোনো গ্যারান্টি নেই।
এদিকে, বাংলাদেশের ভেতরে ভারত থেকে আসা গঙ্গা, তিস্তাসহ ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর নায্য প্রবাহ অব্যাহত রাখার বিষয়টি বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ, ফসল ও অর্থনীতি এবং জীব ও জনজীবনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। চীন ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করেছে। সেই সঙ্গে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের জনগণ ও প্রকৃতি বহুবিধভাবে বিপর্যয় ও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নদী প্রসঙ্গে এ অঞ্চলের উজানের দেশগুলোর কর্মকা- ভাটির দেশ বাংলাদেশের জন্য বিরাট বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের প্রতিবাদ নতুন নয়। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ করেছিলেন। রংপুরে তিস্তা নদী অভিমুখেও সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক লংমার্চ হয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সব জায়গার সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। বিভিন্ন নদীর মরণদশা দেখে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। শুধু গঙ্গা, তিস্তা বা টিপাইমুখ নয়, আগে-পরের আরো অনেক পানি আগ্রাসী ঘটনা এই ক্ষোভের বিস্তার ঘটাচ্ছে। সম্প্রতি ফেসবুকে এক তরুণের সংক্ষুব্ধ ভাষ্য এভাবেই প্রকাশিত হয়েছে : ‘ভারত উজানে স্থায়ীভাবে গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তায় গজলডোবা বাঁধ, মনু নদীতে নলকাথা বাঁধ, যশোরের কোদলা নদীর উপর বাঁধ, খোয়াই নদীর উপর চাকমাঘাট বাঁধ, বাংলাবন্ধে মহানন্দা নদীর উপর বাঁধ, গোমতি নদীর উপর মহারানী বাঁধ এবং মুহুরি নদীর উপর কলস বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করছে বছরের পর বছর। এছাড়াও আরো কমপক্ষে ১৫টি সীমান্ত নদীর উপর অস্থায়ী ভিত্তিতে কাঁচা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বর্ষায় অস্থায়ী বাঁধ কেটে দেয়া হয়। ভারতের এ রকম পানি আগ্রাসী নীতির কবলে পড়ে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশের প্রায়-সকল নদ-নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ে। আর বর্ষায় বাংলাদেশকে ভাসানো হয় বন্যার পানি দিয়ে। এছাড়াও সীমান্ত নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ভারত পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে বাংলাদেশ অংশে ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি করছে। ভারতের এমন নীতির কবলে পড়ে প্রতি বছর বাংলাদেশের শত শত কোটি টাকার সম্পদ, ফসল নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে।’
এমনই আগ্রাসী পরিস্থিতিতে ভারত বা ভারতের তৎপরতা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব কেমন হতে পারে, সেটা আঁচ করা কঠিন নয়। অতএব, রামপাল প্রকল্প, সীমান্ত হত্যা, ট্রানজিট নিয়ে গোপন চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তাসহ যথাযথভাবে নদী চুক্তি নিয়ে টালবাহানা, অসম বাণিজ্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের মানুষের সামনে কার্যকরী প্রতিবাদ ছাড়া অন্য কোনো পথ ও পন্থা খোলা নেই। বস্তুত বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামনেই এখন আত্মমর্যাদা, অধিকার ও স্বাধিকার রক্ষায় সর্বাত্মক ও সর্বমুখী প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। ঘুম বা উৎসবমগ্ন হয়ে এখন যারা রয়েছেন, তাদের কর্তব্য হলো, চোখ বন্ধ করে গাজা, আরব বিশ্ব, কাশ্মীরের বোমার শব্দ আর বীভৎসতাকে উপলব্ধি করা। সেখানকার রক্ত, মৃত্যু, যন্ত্রণার আহাজারীকে বুঝবার চেষ্টা করা। কেবল নিজের আনন্দে মদমত্ত হয়ে থাকা এখন কতটুকু বাঞ্ছনীয়, সেটাও বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আত্মজিজ্ঞাসায় জারিত করা দরকার।
আফ্রিকা, আরব, উপমহাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান প্রকাশ্য ও গুপ্ত আগ্রাসন। কেউ বলতে পারবে না, ২০১৪ সালে ঈদ-উল-ফিতর কতজন মুসলিম শান্তিতে পালন করতে পেরেছেন গাজার মুসলমানরা জীবন বাঁচাতেই পারেনি; ঈদ করার তো প্রশ্নই আসে না। ফিলিস্তিনের অন্যান্য স্থানেও একই করুণ চিত্র। কাশ্মীর বা আরব বিশ্বের নানা স্থানেও অভিন্ন নিবর্তনমূলক পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। আগ্রাসন আর আক্রমণের অক্টোপাসের জালে আক্রান্ত আজকের মুসলিম বিশ্ব। এই হলো সাম্প্রতিক আগ্রাসনের সর্বশেষ কাহিনী।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সিরিয়া আত্মকলহে নিঃশেষ হওয়ার দিকেই ধাবমান। দেশটি এখন বিভক্তির শেষ পর্যায়ে। ইয়েমেন পরিণত হয়েছে ওবামার ড্রোন হামলার সর্বব্যাপী ক্ষেত্ররূপে। তিউনিসিয়াকেও বিপজ্জনক স্থানে পরিণত করা হয়েছে। বিপর্যয়ের পরেও লিবিয়া এমন একটি সরকার গঠন করতে পারেনি, যা সেনাদের নিয়ন্ত্রণ ও দমন করতে পারবে। মিসরসহ অধিকাংশ আরব দেশে পশ্চিমের মদদে সামরিক বাহিনী চরম নৃশংসতামূলক-অগণতান্ত্রিক ও মানবতা-মানবাধিকার বিরোধী কার্যক্রম চালাচ্ছে। ইরাকে মার্কিন-ব্রিটিশ আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট সংঘাত দেশটিকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। আত্মকলহের দুষ্টক্ষত সশস্ত্রভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র অঞ্চলে। আফ্রিকার পশ্চিম-সাহারার মুসলিম দেশগুলো এখন এই আধুনিক সময়েও উপনিবেশরূপে রয়েছে। তাদের স্বাধীনতার আন্দোলনকে অতিশয় নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে। স্বাধীনতাকামী জনগণকে পর্যুদস্ত করা হয়েছে। আন্দোলন এখন সেসব দেশে বিস্মৃত বিষয়। পাশেই ফিলিস্তিনে স্বাধীনতার প্রাচীন আন্দোলনকে বার বার ইসরাইল রক্তাক্ত করছে। গাজায় যে নৃশংসতম হত্যাকা- চালানো হচ্ছে, তা ইতিহাসের বিরলতম গণহত্যা। হিটলারের ইহুদী নিধনের চেয়ে বর্বর রূপ ধারণ করেছে মুসলিম হত্যা। বস্তুতপক্ষে, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ ও অঞ্চলসমূহ এবং সেখানকার মানুষজন প্রবল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্রে নাস্তানাবুদ হচ্ছে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বিশৃঙ্খলায় ডুবিয়ে দেয়া হচ্ছে সেসব মুসলিম জনপদ। স্বাধীন মানুষরূপে স্বাধীন জনপদের জন্য দাঁড়াতেই পারছে না তারা। আত্মকলহ ও আদর্শহীন লড়াইয়ে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। অন্তর্ঘাত ও আত্মকোন্দলের পথে বিদেশী শক্তি, উপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদীরা মুসলিম বিশ্বকে আগ্রাসনে জর্জরিত করার যে সুযোগ পাচ্ছে, বর্তমানে সেটা আরো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসলাম ও মুসলমানদের বিপদ এখন কেবল বাইরে থেকেই নয়, ভিতর থেকেও গুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসে ওঠছে। যার পরিণতিতে শত্রু এবং ভ্রাতৃরূপী শত্রুর হাতে আহত-নিহত হয়ে হাজার হাজার মুসলিম আরবের, আফ্রিকার পথে পথে পড়ে রয়েছে। ইতিহাসের এ এক বড়ই করুণ অধ্যায়। নির্মম পরিস্থিতি। বিশ্ব মুসলিম মরোক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত এখন এমনই সকরুণ অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন গুজরান করছে। বাংলাদেশের মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থাও এই নির্মমাতার বাইরে নেই। বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলমানগণ একটি চলমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই এগিয়ে চলেছে। আশার কথা হলো, শত চাপ ও হামলার মধ্যেও ইসলামী আন্দোলন ক্রমেই জনসম্পৃক্ততা, জনসমর্থন অর্জন করে এগিয়ে চলেছে। মানুষের মধ্যে ক্রমেই এই ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে যে, একমাত্র ইসলামভিত্তিক আদর্শবাদী আন্দোলনই কেবল বাংলাদেশের অন্ধকার বর্তমানকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতে পরিণত করতে পারবে।
২.
আগ্রাসন বা সমস্যার চিত্র দূরের মতো নিকট বা কাছেও কম নেই। এখানেও আগ্রাসনের প্রকাশ্য বা গোপন তৎপরতার বিরাম নেই। বরং আরব বিশ্বের মতোই দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশেও সুপ্তভাবে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী আগ্রাসন ধীরে ধীরে বাড়ছেই। পানি ও নদী বিষয়ক আগ্রাসনের বিষয় আলোচনা করলেই সেটা স্পষ্টভাবে দেখা যাবে।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে গেলে এ অঞ্চলের আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ব্যবহার নিয়ে আঞ্চলিক সঙ্কট দেখা দেয়। তখন বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচীতে ভারত ও পাকিস্তানের সরকার প্রধানরা সিন্ধু অববাহিকার নদীগুলোর পানি ব্যবহার নিয়ে ‘ইনডাস ওয়াটার ট্রিটি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী পাঞ্জাবের রাভি, সাটলেজ ও বিয়াস নদীর পুরো প্রবাহ ভারতকে এবং সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব নদীর পুরো প্রবাহ পাকিস্তানকে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। ‘ইনডাস ওয়াটার ট্রিটি’ সম্পাদনের পর ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের সময়ও তারা কিন্তু পানি-চুক্তি ভঙ্গ করেনি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পর বাংলাদেশের ৫৪টি নদী ভারতের সঙ্গে অভিন্ন রূপে চিহ্ণিত হয়। ভারত ষাটের দশকে গঙ্গা নদীতে ফারাক্কার উপর যে ব্যারেজ নির্মাণ শুরু করে, তা কিন্তু পাকিস্তান আমলে চালু করতে পারেনি; চালু করেছে বাংলাদেশ আমলে ১৯৭৫ সালে। ভারত তখন একটি সংযোগ খালের মাধ্যমে ৪০,০০০ কিউসেক পানি হুগলি নদীতে প্রত্যাহার করতে শুরু করে। এর ফলে হঠাৎ করে বাংলাদেশ অংশে গঙ্গার পানি প্রবাহ কমে যায় এবং গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে উত্তেজনা ও সমস্যা সৃষ্টি হয়। ১৯৭৭ সালে ভারত ও বাংলাশে প্রথমবারের মতো গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করে। ঐ চুক্তিতে যে কোনো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে ন্যূনতম ৩৪,৫০০ কিউসেক পানি দেয়ার গ্যারান্টি ছিল। পাঁচ বছর মেয়াদী ঐ চুক্তির সময় উত্তীর্ণ হলে ভারত ইচ্ছামাফিক পানি আটকাতে থাকে। এর ফলে একসময় গঙ্গা নদীর পানি প্রবাহ বাংলাদেশ অংশে ১০,০০০ কিউসেকে নেমে আসে। পরে ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে ত্রিশ বছর মেয়াদী দ্বিতীয় গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি হয়। এ চুক্তিতে ন্যূনতম ২৭,৬৩৩ কিউসেক পানি দেয়ার কথা থাকলেও এ ব্যাপারে কোনো গ্যারান্টি নেই।
এদিকে, বাংলাদেশের ভেতরে ভারত থেকে আসা গঙ্গা, তিস্তাসহ ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর নায্য প্রবাহ অব্যাহত রাখার বিষয়টি বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ, ফসল ও অর্থনীতি এবং জীব ও জনজীবনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। চীন ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করেছে। সেই সঙ্গে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের জনগণ ও প্রকৃতি বহুবিধভাবে বিপর্যয় ও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নদী প্রসঙ্গে এ অঞ্চলের উজানের দেশগুলোর কর্মকা- ভাটির দেশ বাংলাদেশের জন্য বিরাট বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের প্রতিবাদ নতুন নয়। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ করেছিলেন। রংপুরে তিস্তা নদী অভিমুখেও সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক লংমার্চ হয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সব জায়গার সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। বিভিন্ন নদীর মরণদশা দেখে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। শুধু গঙ্গা, তিস্তা বা টিপাইমুখ নয়, আগে-পরের আরো অনেক পানি আগ্রাসী ঘটনা এই ক্ষোভের বিস্তার ঘটাচ্ছে। সম্প্রতি ফেসবুকে এক তরুণের সংক্ষুব্ধ ভাষ্য এভাবেই প্রকাশিত হয়েছে : ‘ভারত উজানে স্থায়ীভাবে গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তায় গজলডোবা বাঁধ, মনু নদীতে নলকাথা বাঁধ, যশোরের কোদলা নদীর উপর বাঁধ, খোয়াই নদীর উপর চাকমাঘাট বাঁধ, বাংলাবন্ধে মহানন্দা নদীর উপর বাঁধ, গোমতি নদীর উপর মহারানী বাঁধ এবং মুহুরি নদীর উপর কলস বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করছে বছরের পর বছর। এছাড়াও আরো কমপক্ষে ১৫টি সীমান্ত নদীর উপর অস্থায়ী ভিত্তিতে কাঁচা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বর্ষায় অস্থায়ী বাঁধ কেটে দেয়া হয়। ভারতের এ রকম পানি আগ্রাসী নীতির কবলে পড়ে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশের প্রায়-সকল নদ-নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ে। আর বর্ষায় বাংলাদেশকে ভাসানো হয় বন্যার পানি দিয়ে। এছাড়াও সীমান্ত নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ভারত পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে বাংলাদেশ অংশে ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি করছে। ভারতের এমন নীতির কবলে পড়ে প্রতি বছর বাংলাদেশের শত শত কোটি টাকার সম্পদ, ফসল নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে।’
এমনই আগ্রাসী পরিস্থিতিতে ভারত বা ভারতের তৎপরতা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব কেমন হতে পারে, সেটা আঁচ করা কঠিন নয়। অতএব, রামপাল প্রকল্প, সীমান্ত হত্যা, ট্রানজিট নিয়ে গোপন চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তাসহ যথাযথভাবে নদী চুক্তি নিয়ে টালবাহানা, অসম বাণিজ্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের মানুষের সামনে কার্যকরী প্রতিবাদ ছাড়া অন্য কোনো পথ ও পন্থা খোলা নেই। বস্তুত বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামনেই এখন আত্মমর্যাদা, অধিকার ও স্বাধিকার রক্ষায় সর্বাত্মক ও সর্বমুখী প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। ঘুম বা উৎসবমগ্ন হয়ে এখন যারা রয়েছেন, তাদের কর্তব্য হলো, চোখ বন্ধ করে গাজা, আরব বিশ্ব, কাশ্মীরের বোমার শব্দ আর বীভৎসতাকে উপলব্ধি করা। সেখানকার রক্ত, মৃত্যু, যন্ত্রণার আহাজারীকে বুঝবার চেষ্টা করা। কেবল নিজের আনন্দে মদমত্ত হয়ে থাকা এখন কতটুকু বাঞ্ছনীয়, সেটাও বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আত্মজিজ্ঞাসায় জারিত করা দরকার।
No comments:
Write comments