জনসভায় আমজনতার তালি কুড়াতে অনেক বক্তা ভাষার লাগাম টানতে আগ্রহী থাকেন না। 'মানি না, মানব না' রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অবশ্য এমন প্রবণতা বিরোধীদের মধ্যেই বেশি। কেউ যদি সরকারকে মেঘনায় নিক্ষেপ করে বাহবা পান তো আরেকজন বঙ্গোপসাগরে ফেলে না দিলে স্বস্তিবোধ করেন না। এ ধরনের অসংযমী ভাষা প্রয়োগে জনগণের মধ্যে প্রতিক্রিয়ায় বিরূপতার মাত্রা কতটা, তা নিয়ে তাদের মাথা না ঘামালেও চলে। শুধু মাঠে-ময়দানে নয়, ঘরোয়া অনুষ্ঠান এবং টিভির টক শো কিংবা সাংবাদিকদের সামনে কথা বলার সময়েও এমন বাকপটুতা আমরা লক্ষ্য করি। তাতে কেউ কৌতুকবোধ করেন, কেউবা আমোদিত হন। বিরক্তিবোধও ঘটে। তবে সরকারে যারা থাকেন তাদের এমনটি হলে চলে না_ এটিই দস্তুর ছিল। অর্থমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো পদে বসার সঙ্গে সঙ্গে মুখর বলে পরিচিতরাও মুখে কুলুপ এঁটে দিতেন। প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকরা তাদের কাছ থেকে কথা বের করতে গলদঘর্ম হতেন, এমনকি সাক্ষাৎ মেলাও ভার ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এক্ষেত্রে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ইলেকট্রনিক মিডিয়া, বিশেষ করে টেলিভিশনের রমরমা অবস্থা এর কারণ হতে পারে। দায়িত্বশীল পদে থেকে কেউ কেউ এখন একটু বেশিই যেন বলছেন এবং এতে জনমনে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা নিয়ে ভাবার সময় হয়তো মেলে না। কোন পদে থেকে কী বলা উচিত এবং কখন পেটে বোমা পড়লেও নির্বাক হয়ে যেতে হয়, তাও হয়তো তারা ভুলে যান। অপ্রিয় সত্যও সর্বদা বলতে নেই_ এ বাক্য প্রবাদসম। শেয়ারবাজারে আকৃষ্ট হয়ে লাখ লাখ মানুষ ম্যানিপুলেটরদের ফাঁদে পড়েছেন। কারা এ প্রতারণার সঙ্গে জড়িত এবং কীভাবে তারা কাজ করেছে তা সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি চার মাস আগেই অর্থমন্ত্রীকে তাদের প্রতিবেদনে জানিয়ে দিয়েছে। এ সময়কালে বাজারে কিছু সংশোধন হয়েছে, কিছু ইতিবাচক চিত্রও লক্ষণীয় এবং এর পেছনে অর্থমন্ত্রীর ভূমিকাও অস্বীকার করা যাবে না। বিনিয়োগকারীরা একটু আশার আলো দেখলেই ফের বাজারে ছুটে আসেন এবং অশুভ সংকেত দেখলে মুহূর্তে হয়ে পড়েন শঙ্কিত। তাদের ক্ষোভের প্রকাশও যথার্থ। আবার কি প্রতারিত হতে হবে_ এ প্রশ্ন দ্রুতই দুর্ভাবনায় ফেলে তাদের। রোববার অর্থমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, বিনিয়োগকারীদের সাবধানতা দরকার। প্রতিদিন লাভের হিসাব কষা এ বাজারের নিয়মের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু তাই বলে সূচকের অব্যাহত পতনে ক্ষুব্ধদের 'ফাটকাবাজ' আখ্যায়িত করা যায়? এটি তো কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়া বৈ কিছু নয়। ক্ষুদ্র বিনিয়াগকারীরা পুঁজিবাজারের প্রাণশক্তি। তাদের তথাকথিত বিনিয়োগকারী বলে দূরে সরে যেতে বলার আদৌ যুক্তি নেই। একইভাবে 'ব্যাগভর্তি অর্থ নিয়ে বাজারে গিয়ে পকেটভর্তি পণ্য' নিয়ে যখন ফিরতে হয় তখন বাণিজ্যমন্ত্রীর 'কম খাওয়া'র পরামর্শ শুধু আগুনে ঘৃতাহুতি দেয় না, সরকারের ভাবমূর্তিতেও চিড় ধরায়। আইন-শৃঙ্খলার অবনতির ক্ষেত্রে গুরুতর কোনো ঘটনার পরও শাক দিয়ে মাছ ঢাকার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেষ্টাকেও কেউ পছন্দ করে না। এমনকি এ ধরনের কথন-অতিকথন সরকারদলীয় লোকদেরও উদ্বেগে ফেলে। বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রকাশ্যেই বলেছেন, 'অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য বিব্রতকর।' আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদেরও তার ক্ষোভ গোপন রাখেননি। জনগণের প্রতিক্রিয়া কানে না যাক, এসব বার্তা কি বাক-অসংযমীদের সতর্ক করবে না? দেশের মানুষ বলুক আর দলীয় নেতাকর্মী, এমনকি বিরোধী পক্ষ বলুক, সবাই কিন্তু সরকারের কাছে কথা নয়_ কাজের প্রত্যাশাই করে। আর কাজে দক্ষতা দেখাতে পারুন আর না-ই পারুন, দয়া করে মানুষকে নিয়ে পরিহাস যেন না হয়।
No comments:
Write comments