রাজনীতির সৌজন্য শিষ্টাচার এবং একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ
হিন্দু ঘোষদের বানানো খাঁটি গাওয়া ঘি নিশ্চয়ই পাঠকরাও অনেক খেয়েছেন। ওই ঘি-এর কথাটা সম্প্রতি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি তাই বলে সরাসরি বলেননি, বলেছেন একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। সুদূর ব্যাংককে বসে বিএনপির নেতাদের ‘নেড়ি কুত্তার মতো’ পেটানোর হুমকি দিয়েছেন এই ‘সোনার ছেলে’। খবরটি পড়েই খাঁটি গাওয়া ঘি-এর কথা মনে পড়ে গেলো। কারণ, প্রবাদ রয়েছে বলে শুধু নয়, আসলেও কুকুরের পেটে ঘি হজম হয় না। কোনো কুকুরকে খাওয়ানো হলে কিংবা ভুল করে কুকুরটি নিজেই খেয়ে ফেললে তার শরীরের সব লোম ঝরে যায়। এ রকম মাদী বা মেয়ে কুকুরকেই নেড়ি কুকুর বলা হয়। বিশেষ গোষ্ঠী ও শ্রেণীর লোকজন অবশ্য কুকুরের চাইতে ‘কুত্তা’ শব্দটিকে বেশি পছন্দ করেন। গালাগাল করার ও হুমকি দেয়ার জন্য বেছেও নেন।
কথা উঠেছে একটি বিশেষ কারণে। ক’দিন আগের এক নিবন্ধে রাজনীতির ভাষা সম্পর্কে লিখেছি। উদাহরণ দেয়ার জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য উল্লেখ করতে হয়েছিল, যেগুলোর মাধ্যমে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে তুলোধুনো করেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বলেছেন, আপনার ‘কুপুত্র’কে জিভ সামাল দিয়ে কথা বলতে বলবেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালের স্লোগান ‘ওরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি’- স্মরণ করিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ইয়াহিয়া খান ছিল একটা জানোয়ার। তারেক রহমানের কথায়ও ইয়াহিয়ার সুর শুনতে পাচ্ছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জানোয়ারকে কিভাবে শিক্ষা দিতে হয় তা দেশের মানুষ জানে। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রের টাকায় পুত্রদের মানুষ না বানিয়ে ‘বড় চোর’ বানিয়েছেন এবং লেখাপড়া শিখলে ‘সে’ (তারেক রহমান) মানুষের মতো কথা বলতো। পশু হত্যার আহ্বান, বিনাশকালীন পাকিস্তানের ঘাতক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে ‘জানোয়ার’ বলা এবং তার সঙ্গে তারেক রহমানকে তুলনা করার মতো প্রতিটি বিষয়ই যথেষ্ট অর্থপূর্ণ বলে মনে করা যেতে পারে। এগুলোর উদ্দেশও অতি ভয়ংকর। তাছাড়া দেশের মানুষের দোহাই দিয়ে প্রধানমন্ত্রী কিন্তু একথাও জানিয়ে রেখেছেন, জানোয়ারকে কিভাবে শিক্ষা দিতে হয় তা দেশের মানুষ জানে। ধরে নেয়া যায়, শিক্ষাটা প্রধানমন্ত্রী নিজেই দিতে চান!
এ পর্যন্ত এসে থেমে গেলেও হয়তো রুচি, শিক্ষা ও পারিবারিক পরিবেশ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বাড়াতে হতো না। অন্যদিকে গুনে গুনে ঠিক নয়দিন পর, গত ২৭ ডিসেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় মরহুম পিতার কবর জিয়ারত করতে গিয়ে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যারা ‘বঙ্গবন্ধু’কে নিয়ে কটূক্তি করে তারা ‘কুলাঙ্গার’। তাদের রেহাই দেয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তিনি। ‘কুলাঙ্গার’ শব্দটির অর্থ জানার জন্য বাংলা একাডেমির ডিকশনারি খুলতে হলো। এতে বলা হয়েছে, এমন কাউকেই ‘কুলাঙ্গার’ বলা হয়, যে তার পরিবারের সম্মান নষ্ট করে। আমরা জানি না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ‘কুপুত্র’ এবং ‘বড় চোর’ তারেক রহমান নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য নয়। কারণ, ‘সে’ অর্থাৎ তারেক রহমান তো লেখাপড়াই শেখেননি! আর শেখেননি বলেই তিনি ‘মানুষের মতো’ কথা বলতে জানেন না! একই কারণে তার মতো কাউকে অন্তত উচ্চ শিক্ষিত ও উন্নত রুচিসম্পন্ন কোনো পরিবারের সদস্যের মর্যাদা দেয়ারও প্রশ্ন উঠতে পারে না। শুনে ‘বেচারা’ তারেক রহমান আফসোসে একেবারে কাহিল হয়ে পড়বেন কি না সে প্রশ্নে না গিয়ে এখানে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে অন্য একটি তথ্য জানানো দরকার। তথ্যটি হলো, এবারও মন্ত্রীরা পাল্লা দিয়েই ময়দানে হাজির হয়েছেন। তারাও বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে গিয়ে ‘উন্নত’ রুচিরই পরিচয় দিয়েছেন। বিএনপি নেত্রীর নাম উচ্চারণ করতেও রাজি নন জানিয়ে একজন মন্ত্রী তো তাকে ‘মহিলা’ই বলে বসেছেন। ‘মহিলা’র আগে ‘ভদ্র’ শব্দটি যোগ করার মতো উদারতাও দেখাননি এই ‘উচ্চ শিক্ষিত’ মন্ত্রী মহোদয়। তার মুখ থেকেই বেরিয়েছে ভয়ংকর ‘ডাইনি’ শব্দটি। ‘ডাইনি’ বলেছেন তিনি খালেদা জিয়াকে। অন্য সকলেও কমবেশি একই রুচি ও মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন- যাদের মধ্যে একজন ‘ড.’যুক্ত মন্ত্রীও রয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপি নেতাদের ‘নেড়ি কুত্তার মতো’ পেটানোর হুমকি দিয়েছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। এজন্য তাকে আদৌ দোষ দেয়া যায় কি না পাঠকরা তা ভেবে দেখতে পারেন। কারণ, আওয়ামী লীগের সকলেই তো এ ধরনের- এমনকি তার চাইতেও খারাপ শব্দ ও ভাষায় বলে চলেছেন! সে শিক্ষাটুকুই আবার ছাত্রলীগের এই সোনার ছেলেটা পেয়েছে।
আজকের নিবন্ধ কিন্তু এসব নোংরা বিষয়ে বলার বা জবাব দেয়ার উদ্দেশে পরিকল্পিত হয়নি। নিবন্ধের উদ্দেশ আসলে সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের প্রতি সহানভূতি জানানো। কারণ, অন্য অনেক বিখ্যাতজনের মতো তিনিও মরে গিয়ে বেঁচে যেতে পারেননি। লক্ষ্য করলে দেখবেন, বিএনপি যেহেতু এখনো, এত দমন-নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের পরও দেশের প্রধান ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের অবস্থানে রয়ে গেছে সেহেতু দলটির পাশাপাশি জিয়াউর রহমানকে ধরেও টানাটানি চলছে বিরামহীনভাবে। এই যে এত কথা ও আক্রমণ- সবকিছুর পেছনে মূল কারণ কিন্তু জিয়াউর রহমানই। কেন- সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে ছোট্ট কিন্তু খুবই তাৎপর্যপূর্ণ দুটি ঘটনা শুনুন। এক বিখ্যাতজনার কীর্তিমান ‘সুপুত্র’ গভীর রাতে গুলশান এলাকায় অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়েছিলেন- শোনা যায়, মদ্যপ অবস্থায়। পুলিশ তাকে থানায় নিয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে রাজনীতির আসর জমানোর মতো উৎসাহী লোকজনের অভাব ছিল না। অন্যজন তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। খবর পাওয়া মাত্র তিনি ওই ‘সুপুত্র’কে সসম্মানে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। বিষয়টিকে পত্রিকার খবরও হতে দেননি তিনি। কারণ, এর সঙ্গে প্রথমজনার তথা প্রধান একজন রাজনৈতিক নেত্রীর এবং তার পরিবারের সম্মান জড়িত ছিল। এর পরের ঘটনা ওই প্রধানমন্ত্রীর কথিত ‘কুপুত্র’কে নিয়ে। সেখানে অবশ্য থানা-পুলিশের ব্যাপার ছিল না। কথিত ‘কুপুত্র’ নিজের বিয়ের আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দিতে প্রথমজনার বাসভবনে গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন ‘মায়ের মতো’ নেত্রী যাতে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং বর ও কনেকে দোয়া করেন- সে অনুরোধ জানানোর জন্য। কিন্তু আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যাওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর ‘কুপুত্র’কে এক ঘণ্টারও বেশি সময় নিচের তলায় বসিয়ে রাখা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত প্রথমজন অনুগ্রহ করে মিনিট তিন-চারেকের জন্য সাক্ষাৎ দিয়েছিলেন সত্য কিন্তু তার ব্যবহারে আন্তরিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়নি। বিয়ের অনুষ্ঠানেও যাননি তিনি। পরবর্তীকালে ছেলের বয়সী ওই ‘কুপুত্র’কেই রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে ছেড়েছেন প্রথমজনা!
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগে আছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের গণতন্ত্রসম্মত বিরোধিতা যদি উদ্দেশ্য হতো তাহলে এই লেগে থাকাকে স্বাগত জানানো মানুষের কর্তব্য হতো। কিন্তু প্রমাণিত হয়েছে, উদ্দেশের মধ্যে গণতন্ত্রের কোনো উপাদান নেই, আগেও কখনো ছিল না। তিনি নেমে আছেন ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে। নেমেছেনও একেবারে ‘আদাজল’ খেয়ে। তার অতি সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন বক্তব্য আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম যে মহাকম্ম তিনি করেছিলেন তার উল্লেখও না করলেই নয়। এখানে মহাকম্ম বলতে বেগম খালেদা জিয়াকে তার ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উৎখাত করার পদক্ষেপের কথা বোঝানো হচ্ছে। বহুল আলোচিত বলে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে না। মূলকথা হলো, সেনানিবাসে শহীদ মইনুল রোডের বাসভবনটি চেয়ে-চিন্তে কিংবা বেআইনীভাবে নেননি খালেদা জিয়া- যেমনটি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে নিজের নামে ‘গণভবন’ লিখিয়ে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
বাস্তবে ১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বেদনায় আপ্লুত হয়ে পড়া জাতি ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাসভবনটি খালেদা জিয়াকে উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছিল। ওই বাসভবনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্মৃতি জড়িত ছিল- যিনি রেডিওতে হলেও স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান থাকার সময় বাসভবনটিতে উঠেছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। পরবর্তীকালে তিনি সেনা প্রধান হয়েছেন কিন্তু ‘সেনাভবনে’ গিয়ে ওঠেননি। প্রেসিডেন্ট হয়েছেন কিন্তু ‘বঙ্গভবনে’ গিয়ে বসবাস করেননি। এজন্যই খালেদা জিয়াকে ওই ভবনটি দেয়া হয়েছিল। এটা এক ধরনের ক্ষতিপূরণ ছিল, অভ্যুত্থানে নিহত প্রেসিডেন্টের স্ত্রী হিসেবে এটা খালেদা জিয়ার প্রাপ্যও ছিল। চুক্তির সকল শর্ত মেনেই তিনি সেখানে বসবাস করে আসছিলেন। সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েও প্রমাণ করা যায়নি যে, কোনো একটি প্রশ্নে খালেদা জিয়া চুক্তি লংঘন করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাকে ওই বাসভবন থেকে উৎখাত করার তৎপরতা চালানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আদালতের মাধ্যমে তাকে উৎখাতও করে ছেড়েছেন সরকার। পরিষ্কার হয়েছে, সবকিছুর পেছনে প্রতিশোধ নেয়ার উদ্দেশ্য ও মানসিকতাই কাজ করেছে। অন্তরালের আসল কারণটিও এখানে উল্লেখ করা দরকার। তাকে যেহেতু ‘গণভবনে’র মালিক বনতে দেয়া হয়নি সেহেতু খালেদা জিয়াকেও তিনি শহীদ মইনুল রোডের বাসভবনটিতে থাকতে দেবেন না। দুটির মধ্যে যত আকাশ-পাতাল ফারাকই থাকুক না কেন, খালেদা জিয়াকে ওই বাসভবন থেকে উৎখাত না করে ছাড়েননি! এখানেই আসলে দু’জনের মন ও মানসিকতার পার্থক্য। বেগম খালেদা জিয়া যেখানে যথাযথ সম্মান দেয়ার পাশাপাশি শেখ হাসিনার সঙ্গে গণতন্ত্রসম্মতভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মতো ব্যবহার করেছেন। এখানে অন্য একটি তথ্যেরও উল্লেখ করা দরকার। সেটা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদান বিষয়ক। খালেদা জিয়াই প্রথম নন, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও শেখ হাসিনার প্রতি উদার মনোভাবই দেখিয়েছিলেন। মূলত প্রেসিডেন্ট জিয়ার সদিচ্ছা ও উদারতার কারণেই শেখ হাসিনা ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছিলেন, আওয়ামী লীগের নেত্রী হতে পেরেছিলেন। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত এবং ‘বঙ্গবন্ধু ভবন’ হিসেবে পরিচিত পৈত্রিক বাসভবনটিও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
এটা ১৯৮১ সালের ঘটনা। তখনও চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের ক্ষত সেরে ওঠেনি, জনগণের মধ্যে বাকশালী শাসনবিরোধী ক্ষোভও ছিল প্রচণ্ড। তা সত্ত্বেও দেশকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্দেশে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। একই আওয়ামী লীগ নাম নিয়ে সে সময় ব্র্যাকেটবন্দী খান তিনেক দলের আবির্ভাব ঘটেছিল। আবদুল মালেক উকিলের নেতৃত্বাধীন উপদলটি মূল আওয়ামী লীগের অবস্থান অর্জন করেছিল। কিন্তু সেখানে সভাপতির পদ নিয়ে সংঘাত মারাত্মক হয়ে ওঠে। আপস ফর্মুলা হিসেবে শেখ হাসিনাকে সভানেত্রী বানানো হয়। শেখ হাসিনা তখন ভারতের আশ্রিতা হিসেবে নয়াদিল্লীতে বসবাস করছিলেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হওয়ার পর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রশ্ন ওঠে। একটি মহল বিষয়টি নিয়ে পানি ঘোলা করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা অবাধে দেশে ফিরে আসতে এবং বসবাস করতে পারেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের এই ঘোষণার পরই নয়াদিল্লী থেকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল (১৭ মে, ১৯৮১)। সবকিছুর পেছনে ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সদিচ্ছা ও উদারতা। তিনি শুধু শেখ হাসিনাকেই ফিরিয়ে আনেননি, নিজে উদ্যোগী হয়ে তাকে তার পৈত্রিক বাসভবনটিও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার নির্দেশে বাসভবনের প্রতিটি জিনিসের বিস্তারিত তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। সে তালিকায় শেখ মুজিবের ‘ঐতিহাসিক’ পাইপ ও চশমা, শেখ কামাল ও শেখ জামালের সোনার মুকুট, অলংকার, নগদ টাকা, মার্কিন ডলার, ভারতীয় রুপি, ব্রিটিশ পাউন্ড এবং কাপড়-চোপড় ও আসবাবপত্র যেমন ছিল, তেমনি ছিল লাইসেন্সবিহীন কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র, সেগুলোর গুলী। কয়েকটি গ্রেনেডও ছিল। শেখ হাসিনা প্রতিটি জিনিস তালিকার সঙ্গে একটি একটি করে মিলিয়ে ও যাচাই করে তারপর লিখিতভাবে বুঝে নিয়েছিলেন। স্বর্ণকার দিয়ে সোনার মুকুট ও প্রতিটি স্বর্ণালংকার পরীক্ষা ও ওজন করিয়ে এবং রীতিমতো ‘বাজিয়ে বাজিয়ে’ নিয়েছিলেন। তিনি শুধু আগ্নেয়াস্ত্রগুলো বুঝে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। এর ক’দিন পরই চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া (৩০ মে, ১৯৮১)। পাঠকরা ১৭ মে এবং ৩০ মে- এই তারিখ দুটির মধ্যকার ব্যবধান মিলিয়ে দেখতে পারেন। প্রথম তারিখে প্রেসিডেন্ট জিয়ার উদারতায় শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছিলেন, দ্বিতীয় তারিখে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে মৃত্যু ঘটেছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সদিচ্ছা ও উদারতায় যিনি দেশে আসার ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, ফিরে পেয়েছিলেন ধানমন্ডির পৈত্রিক বাসভবন, তিনি দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্ত্রী ও সন্তানদের ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উৎখাত করেছেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান কিন্তু শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও স্নেহভরা চমৎকার মনেরই পরিচয় দিয়ে গেছেন। ইতিহাস কেন স্মরণ করিয়ে দিতে হলো, পাঠকরা নিশ্চয়ই তার কারণ নিয়ে চিন্তা করে দেখবেন।
কথা উঠেছে একটি বিশেষ কারণে। ক’দিন আগের এক নিবন্ধে রাজনীতির ভাষা সম্পর্কে লিখেছি। উদাহরণ দেয়ার জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য উল্লেখ করতে হয়েছিল, যেগুলোর মাধ্যমে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে তুলোধুনো করেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বলেছেন, আপনার ‘কুপুত্র’কে জিভ সামাল দিয়ে কথা বলতে বলবেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালের স্লোগান ‘ওরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি’- স্মরণ করিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ইয়াহিয়া খান ছিল একটা জানোয়ার। তারেক রহমানের কথায়ও ইয়াহিয়ার সুর শুনতে পাচ্ছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জানোয়ারকে কিভাবে শিক্ষা দিতে হয় তা দেশের মানুষ জানে। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রের টাকায় পুত্রদের মানুষ না বানিয়ে ‘বড় চোর’ বানিয়েছেন এবং লেখাপড়া শিখলে ‘সে’ (তারেক রহমান) মানুষের মতো কথা বলতো। পশু হত্যার আহ্বান, বিনাশকালীন পাকিস্তানের ঘাতক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে ‘জানোয়ার’ বলা এবং তার সঙ্গে তারেক রহমানকে তুলনা করার মতো প্রতিটি বিষয়ই যথেষ্ট অর্থপূর্ণ বলে মনে করা যেতে পারে। এগুলোর উদ্দেশও অতি ভয়ংকর। তাছাড়া দেশের মানুষের দোহাই দিয়ে প্রধানমন্ত্রী কিন্তু একথাও জানিয়ে রেখেছেন, জানোয়ারকে কিভাবে শিক্ষা দিতে হয় তা দেশের মানুষ জানে। ধরে নেয়া যায়, শিক্ষাটা প্রধানমন্ত্রী নিজেই দিতে চান!
এ পর্যন্ত এসে থেমে গেলেও হয়তো রুচি, শিক্ষা ও পারিবারিক পরিবেশ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বাড়াতে হতো না। অন্যদিকে গুনে গুনে ঠিক নয়দিন পর, গত ২৭ ডিসেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় মরহুম পিতার কবর জিয়ারত করতে গিয়ে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যারা ‘বঙ্গবন্ধু’কে নিয়ে কটূক্তি করে তারা ‘কুলাঙ্গার’। তাদের রেহাই দেয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তিনি। ‘কুলাঙ্গার’ শব্দটির অর্থ জানার জন্য বাংলা একাডেমির ডিকশনারি খুলতে হলো। এতে বলা হয়েছে, এমন কাউকেই ‘কুলাঙ্গার’ বলা হয়, যে তার পরিবারের সম্মান নষ্ট করে। আমরা জানি না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ‘কুপুত্র’ এবং ‘বড় চোর’ তারেক রহমান নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য নয়। কারণ, ‘সে’ অর্থাৎ তারেক রহমান তো লেখাপড়াই শেখেননি! আর শেখেননি বলেই তিনি ‘মানুষের মতো’ কথা বলতে জানেন না! একই কারণে তার মতো কাউকে অন্তত উচ্চ শিক্ষিত ও উন্নত রুচিসম্পন্ন কোনো পরিবারের সদস্যের মর্যাদা দেয়ারও প্রশ্ন উঠতে পারে না। শুনে ‘বেচারা’ তারেক রহমান আফসোসে একেবারে কাহিল হয়ে পড়বেন কি না সে প্রশ্নে না গিয়ে এখানে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে অন্য একটি তথ্য জানানো দরকার। তথ্যটি হলো, এবারও মন্ত্রীরা পাল্লা দিয়েই ময়দানে হাজির হয়েছেন। তারাও বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে গিয়ে ‘উন্নত’ রুচিরই পরিচয় দিয়েছেন। বিএনপি নেত্রীর নাম উচ্চারণ করতেও রাজি নন জানিয়ে একজন মন্ত্রী তো তাকে ‘মহিলা’ই বলে বসেছেন। ‘মহিলা’র আগে ‘ভদ্র’ শব্দটি যোগ করার মতো উদারতাও দেখাননি এই ‘উচ্চ শিক্ষিত’ মন্ত্রী মহোদয়। তার মুখ থেকেই বেরিয়েছে ভয়ংকর ‘ডাইনি’ শব্দটি। ‘ডাইনি’ বলেছেন তিনি খালেদা জিয়াকে। অন্য সকলেও কমবেশি একই রুচি ও মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন- যাদের মধ্যে একজন ‘ড.’যুক্ত মন্ত্রীও রয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপি নেতাদের ‘নেড়ি কুত্তার মতো’ পেটানোর হুমকি দিয়েছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। এজন্য তাকে আদৌ দোষ দেয়া যায় কি না পাঠকরা তা ভেবে দেখতে পারেন। কারণ, আওয়ামী লীগের সকলেই তো এ ধরনের- এমনকি তার চাইতেও খারাপ শব্দ ও ভাষায় বলে চলেছেন! সে শিক্ষাটুকুই আবার ছাত্রলীগের এই সোনার ছেলেটা পেয়েছে।
আজকের নিবন্ধ কিন্তু এসব নোংরা বিষয়ে বলার বা জবাব দেয়ার উদ্দেশে পরিকল্পিত হয়নি। নিবন্ধের উদ্দেশ আসলে সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের প্রতি সহানভূতি জানানো। কারণ, অন্য অনেক বিখ্যাতজনের মতো তিনিও মরে গিয়ে বেঁচে যেতে পারেননি। লক্ষ্য করলে দেখবেন, বিএনপি যেহেতু এখনো, এত দমন-নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের পরও দেশের প্রধান ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের অবস্থানে রয়ে গেছে সেহেতু দলটির পাশাপাশি জিয়াউর রহমানকে ধরেও টানাটানি চলছে বিরামহীনভাবে। এই যে এত কথা ও আক্রমণ- সবকিছুর পেছনে মূল কারণ কিন্তু জিয়াউর রহমানই। কেন- সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে ছোট্ট কিন্তু খুবই তাৎপর্যপূর্ণ দুটি ঘটনা শুনুন। এক বিখ্যাতজনার কীর্তিমান ‘সুপুত্র’ গভীর রাতে গুলশান এলাকায় অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়েছিলেন- শোনা যায়, মদ্যপ অবস্থায়। পুলিশ তাকে থানায় নিয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে রাজনীতির আসর জমানোর মতো উৎসাহী লোকজনের অভাব ছিল না। অন্যজন তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। খবর পাওয়া মাত্র তিনি ওই ‘সুপুত্র’কে সসম্মানে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। বিষয়টিকে পত্রিকার খবরও হতে দেননি তিনি। কারণ, এর সঙ্গে প্রথমজনার তথা প্রধান একজন রাজনৈতিক নেত্রীর এবং তার পরিবারের সম্মান জড়িত ছিল। এর পরের ঘটনা ওই প্রধানমন্ত্রীর কথিত ‘কুপুত্র’কে নিয়ে। সেখানে অবশ্য থানা-পুলিশের ব্যাপার ছিল না। কথিত ‘কুপুত্র’ নিজের বিয়ের আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দিতে প্রথমজনার বাসভবনে গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন ‘মায়ের মতো’ নেত্রী যাতে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং বর ও কনেকে দোয়া করেন- সে অনুরোধ জানানোর জন্য। কিন্তু আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যাওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর ‘কুপুত্র’কে এক ঘণ্টারও বেশি সময় নিচের তলায় বসিয়ে রাখা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত প্রথমজন অনুগ্রহ করে মিনিট তিন-চারেকের জন্য সাক্ষাৎ দিয়েছিলেন সত্য কিন্তু তার ব্যবহারে আন্তরিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়নি। বিয়ের অনুষ্ঠানেও যাননি তিনি। পরবর্তীকালে ছেলের বয়সী ওই ‘কুপুত্র’কেই রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে ছেড়েছেন প্রথমজনা!
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগে আছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের গণতন্ত্রসম্মত বিরোধিতা যদি উদ্দেশ্য হতো তাহলে এই লেগে থাকাকে স্বাগত জানানো মানুষের কর্তব্য হতো। কিন্তু প্রমাণিত হয়েছে, উদ্দেশের মধ্যে গণতন্ত্রের কোনো উপাদান নেই, আগেও কখনো ছিল না। তিনি নেমে আছেন ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে। নেমেছেনও একেবারে ‘আদাজল’ খেয়ে। তার অতি সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন বক্তব্য আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম যে মহাকম্ম তিনি করেছিলেন তার উল্লেখও না করলেই নয়। এখানে মহাকম্ম বলতে বেগম খালেদা জিয়াকে তার ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উৎখাত করার পদক্ষেপের কথা বোঝানো হচ্ছে। বহুল আলোচিত বলে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে না। মূলকথা হলো, সেনানিবাসে শহীদ মইনুল রোডের বাসভবনটি চেয়ে-চিন্তে কিংবা বেআইনীভাবে নেননি খালেদা জিয়া- যেমনটি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে নিজের নামে ‘গণভবন’ লিখিয়ে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
বাস্তবে ১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বেদনায় আপ্লুত হয়ে পড়া জাতি ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাসভবনটি খালেদা জিয়াকে উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছিল। ওই বাসভবনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্মৃতি জড়িত ছিল- যিনি রেডিওতে হলেও স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান থাকার সময় বাসভবনটিতে উঠেছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। পরবর্তীকালে তিনি সেনা প্রধান হয়েছেন কিন্তু ‘সেনাভবনে’ গিয়ে ওঠেননি। প্রেসিডেন্ট হয়েছেন কিন্তু ‘বঙ্গভবনে’ গিয়ে বসবাস করেননি। এজন্যই খালেদা জিয়াকে ওই ভবনটি দেয়া হয়েছিল। এটা এক ধরনের ক্ষতিপূরণ ছিল, অভ্যুত্থানে নিহত প্রেসিডেন্টের স্ত্রী হিসেবে এটা খালেদা জিয়ার প্রাপ্যও ছিল। চুক্তির সকল শর্ত মেনেই তিনি সেখানে বসবাস করে আসছিলেন। সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েও প্রমাণ করা যায়নি যে, কোনো একটি প্রশ্নে খালেদা জিয়া চুক্তি লংঘন করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাকে ওই বাসভবন থেকে উৎখাত করার তৎপরতা চালানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আদালতের মাধ্যমে তাকে উৎখাতও করে ছেড়েছেন সরকার। পরিষ্কার হয়েছে, সবকিছুর পেছনে প্রতিশোধ নেয়ার উদ্দেশ্য ও মানসিকতাই কাজ করেছে। অন্তরালের আসল কারণটিও এখানে উল্লেখ করা দরকার। তাকে যেহেতু ‘গণভবনে’র মালিক বনতে দেয়া হয়নি সেহেতু খালেদা জিয়াকেও তিনি শহীদ মইনুল রোডের বাসভবনটিতে থাকতে দেবেন না। দুটির মধ্যে যত আকাশ-পাতাল ফারাকই থাকুক না কেন, খালেদা জিয়াকে ওই বাসভবন থেকে উৎখাত না করে ছাড়েননি! এখানেই আসলে দু’জনের মন ও মানসিকতার পার্থক্য। বেগম খালেদা জিয়া যেখানে যথাযথ সম্মান দেয়ার পাশাপাশি শেখ হাসিনার সঙ্গে গণতন্ত্রসম্মতভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মতো ব্যবহার করেছেন। এখানে অন্য একটি তথ্যেরও উল্লেখ করা দরকার। সেটা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদান বিষয়ক। খালেদা জিয়াই প্রথম নন, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও শেখ হাসিনার প্রতি উদার মনোভাবই দেখিয়েছিলেন। মূলত প্রেসিডেন্ট জিয়ার সদিচ্ছা ও উদারতার কারণেই শেখ হাসিনা ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছিলেন, আওয়ামী লীগের নেত্রী হতে পেরেছিলেন। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত এবং ‘বঙ্গবন্ধু ভবন’ হিসেবে পরিচিত পৈত্রিক বাসভবনটিও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
এটা ১৯৮১ সালের ঘটনা। তখনও চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের ক্ষত সেরে ওঠেনি, জনগণের মধ্যে বাকশালী শাসনবিরোধী ক্ষোভও ছিল প্রচণ্ড। তা সত্ত্বেও দেশকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্দেশে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। একই আওয়ামী লীগ নাম নিয়ে সে সময় ব্র্যাকেটবন্দী খান তিনেক দলের আবির্ভাব ঘটেছিল। আবদুল মালেক উকিলের নেতৃত্বাধীন উপদলটি মূল আওয়ামী লীগের অবস্থান অর্জন করেছিল। কিন্তু সেখানে সভাপতির পদ নিয়ে সংঘাত মারাত্মক হয়ে ওঠে। আপস ফর্মুলা হিসেবে শেখ হাসিনাকে সভানেত্রী বানানো হয়। শেখ হাসিনা তখন ভারতের আশ্রিতা হিসেবে নয়াদিল্লীতে বসবাস করছিলেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হওয়ার পর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রশ্ন ওঠে। একটি মহল বিষয়টি নিয়ে পানি ঘোলা করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা অবাধে দেশে ফিরে আসতে এবং বসবাস করতে পারেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের এই ঘোষণার পরই নয়াদিল্লী থেকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল (১৭ মে, ১৯৮১)। সবকিছুর পেছনে ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সদিচ্ছা ও উদারতা। তিনি শুধু শেখ হাসিনাকেই ফিরিয়ে আনেননি, নিজে উদ্যোগী হয়ে তাকে তার পৈত্রিক বাসভবনটিও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার নির্দেশে বাসভবনের প্রতিটি জিনিসের বিস্তারিত তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। সে তালিকায় শেখ মুজিবের ‘ঐতিহাসিক’ পাইপ ও চশমা, শেখ কামাল ও শেখ জামালের সোনার মুকুট, অলংকার, নগদ টাকা, মার্কিন ডলার, ভারতীয় রুপি, ব্রিটিশ পাউন্ড এবং কাপড়-চোপড় ও আসবাবপত্র যেমন ছিল, তেমনি ছিল লাইসেন্সবিহীন কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র, সেগুলোর গুলী। কয়েকটি গ্রেনেডও ছিল। শেখ হাসিনা প্রতিটি জিনিস তালিকার সঙ্গে একটি একটি করে মিলিয়ে ও যাচাই করে তারপর লিখিতভাবে বুঝে নিয়েছিলেন। স্বর্ণকার দিয়ে সোনার মুকুট ও প্রতিটি স্বর্ণালংকার পরীক্ষা ও ওজন করিয়ে এবং রীতিমতো ‘বাজিয়ে বাজিয়ে’ নিয়েছিলেন। তিনি শুধু আগ্নেয়াস্ত্রগুলো বুঝে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। এর ক’দিন পরই চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া (৩০ মে, ১৯৮১)। পাঠকরা ১৭ মে এবং ৩০ মে- এই তারিখ দুটির মধ্যকার ব্যবধান মিলিয়ে দেখতে পারেন। প্রথম তারিখে প্রেসিডেন্ট জিয়ার উদারতায় শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছিলেন, দ্বিতীয় তারিখে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে মৃত্যু ঘটেছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সদিচ্ছা ও উদারতায় যিনি দেশে আসার ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, ফিরে পেয়েছিলেন ধানমন্ডির পৈত্রিক বাসভবন, তিনি দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্ত্রী ও সন্তানদের ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উৎখাত করেছেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান কিন্তু শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও স্নেহভরা চমৎকার মনেরই পরিচয় দিয়ে গেছেন। ইতিহাস কেন স্মরণ করিয়ে দিতে হলো, পাঠকরা নিশ্চয়ই তার কারণ নিয়ে চিন্তা করে দেখবেন।
No comments:
Write comments