গত ০৬ জুন ২০১৫ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। সাথে এসেছিলেন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের মেয়াদে বিদেশী কোন শক্তিধর রাষ্ট্র প্রধানের এটাই প্রথম সফর। গত ০৫ জানুয়ারী ২০১৪ জাতীয় নির্বাচনের পর আমেরিকা, ব্রিটেন, ইউরোপিয় ইউনিয়ন সহ সারা বিশ্ব যখন এ নির্বাচন নিয়ে নানা রকম আলোচনা ও সমালোচনায় মুখর, ঠিক তখনই বিশ্বের এই শক্তিধর প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর। আশা করা যায় আগামী এক বছরের মধ্যে আরোও বেশ কিছু শক্তিধর রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানও শ্রী নরেন্দ্র মোদির পথ ধরে বাংলাদেশ সফর করবেন।
যদিও ইতিমধ্যে চীনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী ও উপ-প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। এতে এটা পরিষ্কার বিশ্বের কয়েকটি রাষ্ট্র (যেমন: আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) তথাকথিত গণতন্ত্রের কথা বলে জনগণকে ডাইভার্ট করে তাদের স্বার্থে বাংলাদেশে সমালোচনা করলেও আবার অনেকেই এগুলোর যে ধার ধারেন না সেটা পরিষ্কার সম্প্রতি মোদি ও চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর।
যে বিএনপি তাদের জন্ম হতে সব সময় ভারত বিরোধী মনোভব প্রকাশ করে আসছিল, তারাও মোদির একটু দর্শনের আশায় কাঙ্গালের মত পিছু নিয়েছিল। এরপর অনেক দেন-দরবার করে সে সুযোগও মিলে গিয়েছিল। তাই বাংলাদেশের তিন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও একটি দলের প্রধান তথা ২০ দলীয় নির্বাচনী জোটের প্রধান হয়েও শুধু মোদির সাথে সাক্ষাত যেন ফসকে না যায় সে আশায় নির্ধারিত সময়ের ১ ঘন্টা আগেই মোদির দরজায় এসে অপেক্ষার প্রহর গুনতে দেখা গিয়েছে। যা তিনি বিএনপির বা ২০ দলীয় জোটের প্রধান হিসাবে করলেও মেনে নেয়া যেত, কিন্তু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পুরো বাংলাদেশীদের মাথা আরও একবার নত করিয়ে দিলেন। এটা জাতী হিসাবে বাংলাদেশীর জন্যে চরম অপমানেরও।
ভারত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তি একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী দেশ, এতে মোটেও সন্দেহ নেই। সংগত কারনেই তাদের সাথে আমাদের লেন-দেনটাও বেশী ও বিরোধপূর্ন। আর এ বিরোধ মিটানোর জন্যে আমাদেরকে অবশ্যই তাদের সাথে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখতেই হবে। যেমন: মালায়েশিয়ার সাথে সিঙ্গাপুরের এমন ঘনিষ্ট সম্পর্কের কারনেই আজ সিঙ্গাপুর উন্নত দেশগুলির একটি। পার্শ্ববর্তি দেশের সাথে বৈরিতা করে কোনদিনই কোন অঞ্চল বা দেশ উন্নতি করতে পারেনা বা করতে পারেনাই। সেই দিক হতে আমাদেরকে অবশ্যই ভারত, মায়ানমার, নেপাল ও শ্রীলন্কার সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। আর পাকিস্তানের সাথেও সার্ক দেশ হিসাবে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে ঠিকই, কিন্তু সতর্কতার সাথে অবশ্যই। কারন, ইতি মধ্যেই অনেক পকিস্তানী জঙ্গি নাগরিক ও পাকিস্তান সরকারের গুপ্তচর বাংলাদেশে ধরা পড়েছে, যা কোন মতেই সহজভাবে মেনে নেয়া যাবে না।
প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মোদির বাংলাদেশ সফর নিয়ে সরকার, আওয়ামীলিগ ও বিএনপির মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে এক অভিন্ন রুপ। আর যা হলো তারা মোদিকে যেন একজন প্রভু হিসাবে পেয়েছিল। সরকার হিসাবে পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখা এবং একটি বৃহৎ দেশের রাষ্ট্র প্রধানকে উন্নত সম্মান দিতেই পারেন, এতে দোষের কিছু নাই। কিন্তু দল হিসাবে আওয়ামীলিগ ও বিএনপির বাড়াবাড়িটা ছিল চোখে পড়ার মত এবং রীতিমত লজ্জারও।
মোদির সফর নিয়ে এর আগে বহু খবর প্রকাশিত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি সফরেও আসলেন। দিন-ক্ষণ ঠিক হবার পরই শুরু হয় আমাদের রাজনীতিবিদদের দেউলিয়াপনার প্রতিযোগীতা। সরকারী দল হিসাবে আওয়ামীলীগ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে বা ছিল এটাই ঠিক। কিন্তু সরকার ও সংসদের বাইরের একটি দল হিসাবে বিএনপির অবস্থান ছিল একেবারেই বিপরীত। তার উপড় জন্মগত ভারতবিরোধী শ্লোগানতো গায়ে লাগানো আছেই। বিএনপির এই ভারত বিরোধীতার মুখোশ পাল্টাতে থাকে ভারতে মোদির দল বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর পরই। যেমন: কোনরকম প্রোটকল না মেনেই তড়িঘরি করে মোদীকে আগাম শুভেচ্ছা বিএনপি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এবং সম্প্রতি বিজেপি প্রধানের খালেদাকে ফোন নিয়ে একটি মিথ্যা নাটক ইত্যাদি। এগুলো রাজনীতিতে দেউলিয়াপনারই একটি অংশ। বিএনপি ধরে নিয়েছিল, কংগ্রেস ক্ষমতা হারানোর পর আওয়ামীলীগ ও হাসিনার সরকার আর বেশীদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। আর এ সুযোগেই তারা বিজেপিকে এমন ভাবেই ব্যবহার করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। আর লবিং হিসাবে ড. ইউনুসকেও ব্যবহার করেছিল বিএনপি। আরও আছে ড. কামাল ও ভারতের অনেক ঘনিষ্ট মিত্ররা। কিন্তু ফল যে খুব একটা সুবিধা হয়নি তা সম্প্রতি মোদির বাংলাদেশ সফরই ইঙ্গিত দিয়ে গেল।
বিএনপি যখন, সব দিক হতে হতাশ তখনই মোদির সাক্ষাত পেতে মরিয়া হয়ে উঠল সম্পর্কের জোড়া-তালি লাগানোর জন্যে। গত দু-মাস ধরে লবিং ও দেন-দরবার করে শেষ পর্যন্ত মোদির সাথে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের দিন তারিখও ঠিক হলো। কিন্তু একটি দেশের গত তিন তিনবারের প্রধান মন্ত্রীর যে দেউলিয়াপনা আমরা বাংলাদেশীরা দেখেছি তা কি মেনে নেয়া উচিত ? তিনি মোদির সাক্ষাতের জন্যে কারওয়ান বাজারের প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স অফিসে এসে প্রায় এক-দেড়ঘন্টা আগেই বসে অপেক্ষা করছিলেন। মনে হয়, এ দেখা না হলে জীবন শেষ হয়ে যাবে। অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে ! সত্যিই কি তাই ? এরপর মোদির সাথে সাক্ষাতের সময় ছিল ২০ মিনিট। মোদির সাথে তিনি ওয়ান-টু-ওয়ান ওয়ে একান্ত সময় নিলেন ১৫ মিনিট ! কি এমন গোপন কথা ? যার জন্যে শুধু দু-জন ব্যক্তিই একান্ত গোপন বৈঠক ? বিষয়টি একটু ভাবার বৈকি ! এর আগে এই খালেদা জিয়া আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইউরোপিয় ইউনিয়নের সাথে এমন গোপন বৈঠক করেছিলন বহুবার। যার ফল আমরা দেখেছি গত আন্দোলনে শত শত মানুষকে জীবন্ত পুড়ে মারার পরও কোন মানবাধীকার সংস্থ্যা, আমেরিকা বা ব্রিটেন বা ইউরোপিয় ইউনিয়নের কেউ টু-শব্দটাও করেনি ঐ বিষয়টি নিয়ে। শুধুই নির্বাচন, নির্বাচন, নির্বাচন বলে চিৎকার করতে দেথেছি। যেন, মানুষ থাকুক বা না থাকুক, দেশ ও দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজুক, কিন্তু যে কোন উপায়ে নির্বাচন চাই, তারপর নির্বাচন ধুয়ে ধুয়ে পানি খাও। দেশকে স্বর্গ বানাও !
সাধারণ মানুষ তো বটেই, বিএনপি নেতাদের একাংশও মনে করছেন— মোদীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মুখ পুড়িয়েছেন খালেদা জিয়া, এবং এর জন্য তাঁর একগুঁয়ে মনোভাবই দায়ী। গত সাধারণ নির্বাচনে দলকে অংশগ্রহণ করতে না-দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এখন কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে বিএনপি। সংসদে কোনও প্রতিনিধি না-থাকায় সফরে আসা বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে বিএনপি ও তাঁর নেত্রী খালেদা জিয়ার কূটনৈতিক গুরুত্ব তলানিতে ঠেকেছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সেই অসহায় অবস্থাটিই হাটে হাঁড়ি ভাঙা হয়ে গিয়েছে মোদীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে। প্রোটোকল মেনে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে খালেদার আগে সময় পেয়েছেন জাতীয় পার্টির নেত্রী রওশন এরশাদ, জাসদ-এর হাসানুল হক ইনু এবং ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন। রওশন সংসদে বিরোধী নেত্রী, ইনু ও মেনন হাসিনা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। সরকারের শরিক হিসেবে সংসদে তাঁদের বেশ কয়েক জন করে প্রতিনিধি রয়েছেন। তাই খালেদাকে বসিয়ে রেখে তাঁর সামনেই ইনু-মেননদের ডাক পড়ে মোদীর সঙ্গে আলোচনার জন্য। সবার শেষে খালেদার জন্য তখন মিনিট দশেক সময় হাতে ছিল মোদীর।
সময় পাবেন না বুঝেই নিজের বক্তব্য একটি কাগজে নোট করে নিয়ে গিয়েছিলেন খালেদা। কিন্তু সেগুলির সব ক’টি তিনি পড়েও উঠতে পারেননি বলে কূটনৈতিক সূত্রের খবর। কিন্তু যে ভাবে সরকারের বিরুদ্ধে তিনি বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে নালিশ করেছেন, দেশে গণতন্ত্র নেই বলে অভিযোগ করেছেন, তাতেও প্রশ্ন উঠেছে।
যে কথা বলছিলাম। বিএনপি বরাদ্ধের ২০ মিনিট হয়ে গেল এখন ৪৫ মিনিট ! আর বিরোধী নেত্রীর বেলায় ২০ মিনিট ! বিষয়টা কি ? ব্যবসায়ীদের জন্যে মাত্র ১৫ মিনিট ! তাহলে খালেদার জন্যে ৪৫ মিনিট কেন ? কি প্রোটোকলে খালেদা ৪৫ মিনিট সময় পেল ? আর ঐ ১৫ মিনিট কি গোপন চুক্তি হলো ? সরকারের মধ্যে এ বিষয়ে কি কোন চিন্তা-ভাবনা আছে বলে তো মনে হয়না। সরকারকে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে দল যত বেশী সুবিধা দিবে ভারত তার সাথেই ঘর বাঁধবে। বিশেষ করে বিএনপির সাথে বিজেপি সরকার বাঁধতে পারে এটাই স্বাভাবিক। তাই ঐ ১৫ মিনিটের গোপন রহস্য উদঘাটন করাটা জরুরী। জাতীও জানতে চায়, কি আলোচনা ঐ ১৫ মিনিটে হয়েছে, কি দিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি খালেদা মোদিকে দিয়েছেন। সবাই জানি, বিএনপির একটাই লক্ষ্য যে কোন মূল্যে ও উপায়ে তাদের ক্ষমতা চাই। তাই ঐ ১৫ মিনিটে কি আলোচনা হয়েছে সেটাই হয়ত আমরা অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পাব।
অবশ্য খালেদা জিয়ার সঙ্গে মোদির একান্তে কথা ও বিএনপির প্রতিনিধি দলকে দীর্ঘ সময় দেওয়াকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তাঁরা মনে করছেন, মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠক যাতে না হয়, সে জন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে জোর তৎপরতা ছিল। এত কিছুর পর দীর্ঘ সময় বৈঠক হওয়াকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছেন নেতারা। তবে মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার একান্তে কী কথা হয়েছে, তা দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এখনো জানেন না। সংকট নিরসনের আড়ালে কোনো কথা চালাচালি হয়েছে কি না, তা-ও বলতে পারছেন না নেতারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোদির সঙ্গে বৈঠক করে হোটেল থেকে বাসায় ফেরা পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন এমন একজন নেতা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন পর খালেদা জিয়াকে খুবই প্রফুল্ল দেখা গেছে। আর বৈঠকে উপস্থিত থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানের ভাষায় ‘চমৎকার আলোচনা’। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘এ করডিয়াল অ্যাটমসফিয়ার’। প্রথম আলো ০৯.০৬.২০১৫
এদিকে, মোদির সফর নিয়ে আওয়ামীলীগের খুশিতে গদ-গদের শেষ নেই। যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছে ! রাজনীতিতে দেউলিয়াপনা এতটা হওয়া কি মানায় ? তাও আবার সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা ও সরকারী দল হিসাবে ? অবশ্যই না। তারা একটি বারও কি ভেবে দেখেছে যে কোন প্রোটোকল না মেনেই মোদি খালেদার সাথে গোপন বৈঠক করলেন কেন ? কি ঐ ১৫ মিনিটে হয়েছিল ? রাজনিতীতে মিত্র ও শত্রু চিরস্থায়ী নয়। তাই যে ভরসা ও শান্তনা নিয়ে আওয়ামীলীগ ও সরকার খুশিতে নাচা-নাচি শুরু করেছে, এটা বিপরীতও কিছু ঘটতে পারে অদূর ভবিষ্যৎ-এ এটাও মাথায় রাখতে হবে। কারন বিজেপি এমন একটি দল যারা দলের ও দেশের স্বার্থে যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত, আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মত দেউলিয়া না।
No comments:
Write comments