Flickr

Tuesday, 23 June 2015

লেখাপড়া নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন

Posted by   on

আমাদের লেখাপড়া নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো লেখাপড়ার মান কি পড়ে যাচ্ছে? মূল এ প্রশ্ন ঘিরে চলে আসছে আরও নানা কথা। যেমন মান পড়ে যাওয়ার কারণ কী? ব্যর্থতা কিসের বা কার? সমস্যা কি সিলেবাস-কারিকুলামে? ব্যর্থতা কি শিক্ষকের? প্রতিষ্ঠানের? সমাজের? রাষ্ট্রের? যদি লেখাপড়ার মান পড়ে না যাবে, তবে এ প্রশ্ন উঠছে কেন বারবার? তবে কি আস্থার সংকট? যদি আস্থার সংকট হয়ে থাকে, তা-ই বা কেন?
কয়েক বছর ধরে নতুন উপসর্গ যোগ হয়েছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস। অনেকেই দাবি করছেন, পরীক্ষার আগেই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে প্রশ্নপত্র। কর্তৃপক্ষ তা স্বীকার করছে না। কিন্তু জনমানসে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিশ্বাস দানা বাঁধছে। পরীক্ষার আগের দিন বা পরীক্ষার পূর্বমুহূর্তে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার প্রমাণ আছে। পরীক্ষার পূর্বমুহূর্তে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার প্রমাণ হাতেনাতে ধরা পড়েছে এ বছর। এক বোর্ডের সঙ্গে আরেক বোর্ডের ফলাফলে দুস্তর ফারাকে দিশা পাচ্ছেন না ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক কেউই। কেউ বলছেন, প্রশ্ন কঠিন বলে ফল খারাপ, কেউ বলছেন, নোট-গাইড থেকে প্রশ্ন না করায় কমন পড়েনি, তাই ফল খারাপ। ওদিকে ভর্তি নিয়ে বিপত্তি দিন দিন বাড়ছেই।
প্রশ্ন উঠছে শিক্ষকের যোগ্যতা নিয়ে। অভিযোগ, অযোগ্য লোকেরা শিক্ষক হচ্ছেন। কারণ, নিয়োগে সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর দলপোষণ। শিক্ষক অযোগ্য হলে লেখাপড়ার মান কমতে বাধ্য। শিক্ষায় দুর্নীতি এখন সর্বত্র। অভিযোগ, শিক্ষক ট্রেনিং ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। শিক্ষকেরা নতুন সৃজনশীল পদ্ধতি রপ্ত করতে পারেননি। সৃজনশীল প্রশ্ন নিয়েও ধাঁধা কম নয়। অভিযোগ উঠেছে, সৃজনশীলতার নামে নোট-গাইডের ব্যবসা রমরমা হয়েছে। তাহলে ‘সৃজনশীল সৃজনশীল’ বলে যে চেঁচামেচি, তা আসলে কী বস্তু?
লেখাপড়ার প্রথম শর্ত ভাষা শেখা। মানুষ ভাষা দিয়ে ভাবে। কিন্তু ভাষা শেখানোয় অবহেলা এখন চরমে। মায়ের ভাষা শেখার আগে ইংরেজি শেখানোর কসরতে শিশুর জীবন যায় যায়। শিশুর এখন খেলার সময় নেই, ঘুমানোর সময় নেই। তার সামনে বইয়ের পাহাড়। স্কুল-বাড়ি-কোচিং সেন্টারে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে সে পেরেশান। তার স্বপ্নের দুনিয়া বলে কিছু নেই। মা-বাবা-স্যার মিলে তার জীবন বিষিয়ে তুলছে।
আমরা জীবনের সব ব্যর্থতার দায় চাপাই সন্তানের ঘাড়ে। আমি যা পারিনি, আমার সন্তানকে তা পারতেই হবে। আমি কেন পারিনি, তার জন্য আমি হাজার অজুহাত খাড়া করি, কিন্তু আমার সন্তান কেন পারবে না? এমন দানবীয় দাবি আমরা করি আমাদের সন্তানদের কাছে। এ সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক বৈকল্যের কারণ কী? এ কি ভোগবাদী সমাজের স্বাভাবিক পরিণতি? আমার সন্তান আমার ভোগবাদী স্বপ্নের পুতুল?
ছেলেমেয়েরাও যেতে চায় না ল্যাবে, মা-বাবাও চায় না সন্তান ‘ল্যাবে সময় নষ্ট’ করুক। তাতে তার কোচিংয়ে যাওয়ার সময় নাকি নষ্ট হয়! তবে নম্বর তাকে ‘পঁচিশে পঁচিশ দিতেই হবে’
কোচিং সেন্টারের ব্যবসা এত রমরমা কেন? কোচিং-বাণিজ্যে যারা যুক্ত, তাদের সঙ্গে নাকি যোগাযোগ যেখানে ভর্তির লড়াই, সেখানকার কর্তাদের! তাই ভর্তির নিশ্চয়তা নাকি সেখানেই মেলে! সবাই তাই সন্তানকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে কোচিং সেন্টারে পাঠান। স্কুল কামাই করো, কিন্তু কোচিং কামাই করলে মা-বাবা মাফ করবেন না। শেখা নয়, ভর্তিই লক্ষ্য। কেন? পিছিয়ে পড়ার ভয়? তাহলে কি আমরা একটি ভয়ের নরক বানাচ্ছি?
এখানেই কোচিং চক্রের জন্মরহস্য। বেকার যেসব ছেলেমেয়ে কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত, তাদের বেকারত্বই তার প্রধান কারণ। আমাদের কোচিং-বাণিজ্যের অবসান ঘটাতে হলে হাত দিতে হবে বেকার সমস্যা সমাধানে। কাজের সুযোগ না বাড়ালে এ সমস্যা সমাধানের কোনো সোজা রাস্তা নেই। কিন্তু আমাদের কাছে সার্টিফিকেটের দাম এতই বেশি যে যেকোনো দামে আমরা তা কিনতে রাজি। পরীক্ষায় পাসের অবিশ্বাস্য উচ্চ হারের সঙ্গে এর সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ।
আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা সার্টিফিকেট-সর্বস্ব। তাই কারিগরি শিক্ষায় আমরা পাঠাই আমাদের স্বপ্নের দাঁড়িপাল্লায় সবচেয়ে নির্বোধ, অঘা ছেলেমেয়েকে। সেখানে চলে শিক্ষার নামে আরেক খেলা। সোনালি গ্রেডের সার্টিফিকেট মেলে, শিক্ষা হয় না। অথচ এ কারিগরি শিক্ষাই বদলে দিতে পারত দেশটা। লাখ লাখ বেকার তৈরির কারখানা বন্ধ হতে পারত। তা হচ্ছে না। এ দেশে আটটা সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, কারিগরি বোর্ড মাত্র একটা। উল্টোটাই উচিত ছিল। কারিগরি শিক্ষায় নজরদারি বাড়িয়ে কারিগরি শিক্ষার মান বাড়াতে পারলেই আমরা সঠিক পথে হাঁটতে শুরু করতাম। সেটাই আমাদের উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে দিতে পারত। কিন্তু আমরা সব সময় উল্টো পথের যাত্রী। আমরা সমাজের কারিগরদের অসম্মানের চোখে দেখি। পিয়ন হোক, ঝাড়ুদার হোক, তা-ও ভালো। কিন্তু কারিগর? তাঁতিদের আমরা কারিগর বলি, জোলা বলি, অবজ্ঞা করি। কারিগরি বিদ্যা তাই সম্মানের হয়নি আমাদের সমাজে।
আমরা বলি, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি ছাড়া কিছুই করতে পারব না। কথাটা সত্য। তবে আমরা শুধু মুখে বলি, বিশ্বাস করি না। এ দেশের ৯৫ ভাগ স্কুল-কলেজে ল্যাবরেটরি নেই, লাইব্রেরি নেই। থাকলেও তা তালাবন্ধ থাকে। একটা ব্যবহারিক ক্লাস হয় এমন স্কুল-কলেজ খুঁজে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ছেলেমেয়েরাও যেতে চায় না ল্যাবে, মা-বাবাও চায় না সন্তান ‘ল্যাবে সময় নষ্ট’ করুক। তাতে তার কোচিংয়ে যাওয়ার সময় নাকি নষ্ট হয়! তবে নম্বর তাকে ‘পঁচিশে পঁচিশ দিতেই হবে’। সে জন্য টাকা নিয়ে বসে আছেন অভিভাবক। টাকা দিলে যদি পঁচিশে পঁচিশ মেলে, তবে আদরের সন্তান ল্যাবে পেরেশান হবে কেন? বাংলাদেশে খুব কম প্রতিষ্ঠানের প্রধানের ঘাড়ে রাবণের মতো দশ মাথা আছে, যিনি বলবেন, ল্যাবে প্র্যাকটিক্যাল করতেই হবে। কথাগুলো নিষ্ঠুর, অপ্রিয়, কিন্তু সত্য।
সিলেবাস নিয়েও কেউই সন্তুষ্ট নন। সবার অভিযোগ, সিলেবাসের বোঝা বাড়ানো হয়েছে খেয়াল-খুশিমতো। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কয়েকবার প্রশ্নটা তুলেছেন, কমাতে বলেছেন সিলেবাসের বোঝা। কিন্তু কেউ কান দিচ্ছেন না।
কাজেই, শিক্ষা এখন এক গভীর সংকটে। তুকতাক চিকিৎসায় এ কঠিন ব্যামো যাওয়ার নয়।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter