Flickr

Sunday, 8 November 2015

রক্ত মাড়িয়ে লাল গালিচায় ১

Posted by   on

রক্ত মাড়িয়ে লাল গালিচায়

আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে, যারা জেগে জেগে ঘুমায়, তাদের কখনো জাগানো যায় না। আমাদের মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতারা সত্যিই জেগে জেগে ঘুমাচ্ছেন। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের ডোন্ট কেয়ার ভাব। যেন এটিই স্বাভাবিক। একসময় একটা খুন হলে, সেই খুন নিয়ে বছরের পর বছর লেখা লেখি হতো। আইন আদালতের আঙ্গিনায় জবাবদিহিতা হত।
এখন খুন নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার। মনে হচ্ছে প্রতিদিন একটা খুন দিয়ে বাংলাদেশ তাঁর প্রাতরাশ শুরু করে। শুধু খুন করে ক্ষ্যান্ত নয়, সাথে সাথে খুনের দায়িত্ব নেওয়া একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘোষণা দিয়ে খুন করার প্রবণতাও ইদানিং লক্ষ্য করা যায়। তা ক্রমে ক্রমে বাড়ছেই বাড়ছে। এই দুঃসময়ে আমাদের মাননীয় প্রধান মন্ত্রী নেদারল্যান্ড সফর করেছেন, লাল গালিচা সংবর্ধনা পেয়েছেন। দেশের মানুষের রক্ত মাড়িয়ে লাল গালিচায়, সত্যিকারের দেশপ্রেমিকের অনুভূতি কি পেয়েছেন?

এই দেশে প্রথম মুক্তমনা আক্রমনের শিকার কবি দাউদ হায়দার।  স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তমনা কিংবা মুক্তচিন্তার উপর প্রথম আঘাত আসে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর আমলে। সেই সময় বঙ্গবন্ধুর সরকার কবি দাউদ হায়দারকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশ সরকারও তখন চায়নি আন্তর্জাতিকভাবে মুসলিম দেশ গুলোর সমর্থন হারাতে। ১৯৭৩ সালে কবিকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলেই কাস্টডিতে নেয়া হয়। ১৯৭৪ এর ২০ মে সন্ধ্যায় তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ২১শে মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটা রেগুলার ফ্লাইটে করে তাকে কলকাতায় পাঠানো হয়। ওই ফ্লাইটে তিনি ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিল না। তাঁর কাছে সে সময় ছিল মাত্র ৬০ পয়সা এবং কাঁধে ঝোলানো একটা ছোট ব্যাগ (ব্যাগে ছিল কবিতার বই, দু'জোড়া শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার আর টুথব্রাশ)। কবির ভাষায় –“আমার কোন উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। সরকারও হয়ত আমার মৃত্যু কামনা করছিল।কবি দাউদ হায়দারের সেই কথা সত্য প্রমাণিত হয়েছে বহু আগেই। কোন সরকারেই চান না মুক্তচিন্তার মানুষ গুলো বেঁচে থাকুক। কোন এক মনিষী বলেছেন, কোন জাতীকে ধ্বংস করতে চাইলে, আগে তাঁর শিক্ষা ধ্বংস করে দাও। ৭১ এ বুদ্ধজীবী হত্যা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সকল হত্যা কাণ্ডের পিছনে একটাই এজেন্ডা, বাঙ্গালী জাতীকে ধ্বংস করা। এই আগ্রাসন আমাদের রাজনীতিতে, সমাজে, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে সব জায়গায়। আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর বক্তব্য জঙ্গিদের অনুপ্রানিত করবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হল। লেখালেখির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, লেখার ব্যাপারে একটা কথা বলব-আমরা সেক্যুলার ডেমোক্রেসিতে বিশ্বাস করি। সংবিধান প্রত্যেক ধর্মের পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। আমি একটা ধর্ম পালন করি। আমি আল্লাহকে মানি, নবী করিমকে (স.) মানি। আমি আমার ধর্মকে মানি। কিন্তু আমার এ ধর্মকে নিয়ে কেউ যদি বিকৃত লেখা লেখে। যদি কেউ নোংরামি করে, নোংরা লেখা লেখে। তাহলে আমার সেন্টিমেন্টে লাগবে, আপনার সেন্টিমেন্টে লাগবে। বা কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে লিখলে তাদের লাগবে, খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের যিশুখ্রিষ্টের বিরুদ্ধে লিখলে তাদের লাগবে। কাজেই লেখালেখির বিষয়ে সতর্ক করা আর কিছু না; কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে যেন আঘাত না লাগে, এই ধরনের লেখা যেন প্রকাশ না করা হয়, কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এই ধরনের কথা যেন বলা না হয়।
আমি নিজের ধর্মকেও বিশ্বাস করি, অন্যের ধর্মকেও সম্মান করি। কারণ সেক্যুলারিজম মানে ধর্মহীনতা না। কেউ যদি ধর্ম মানতে না চায়, তাহলে সেটা তার ব্যাপার। তার সেই বিশ্বাস নিয়ে সে থাকবে। কিন্তু অন্যের ধর্মকে আঘাত দিতে পারবে না। এটাই হচ্ছে মানবিক গুণ। কিন্তু বিকৃত করে লেখা কোনো মানবিক গুণ না। এটা বিকৃত। এটা বিকৃতি লালসা চরিতার্থ করা। সেইগুলি বন্ধ করতে হবে। এটাই বলা হয়েছে। লিখতে কাউকে বন্ধ করতে বলা হয়নি। সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়নি। একটা কথা বলা হয়েছে, কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে যেন আঘাত না করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী নামাজ পড়েন এবং কোরআন তেলোয়াতের মাধ্যমে তাঁর দিন শুরু করেন বলেও জানান।কিন্তু তিনি কোন জঙ্গি উগ্রবাদিদের কোন প্রকার হুমকি দিলেন না, মিষ্টি কথায় ব্লগারদের এক হাত দেখিয়ে দিলেন। উনি চাইলে বলতে পারতেন, যদি আমার দেশের লোকের উপর আর একটি হামলা হয় তাহলে আমি তাদের দেখে নেব। এইটি উনি করেননি।

জনমনে ত্রাস ও ভয়ের সঞ্চার শুধু যে জঙ্গিরাই করে, তা কিন্তু নয়, এখন এই কাজে সরকার ও তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলোও জড়িত। এই দেশে জঙ্গি আক্রমনের কারনে যে পরিমান মানুষ প্রান হারিয়েছে, তাঁর চেয়েও কয়েকশ গুন বেশী মানুষ প্রান হারিয়েছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারনে। এই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও জঙ্গি আক্রমনে কোন তফাৎ নেই। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারামারি, খুনোখুনি করা এখন সরকারী দলের প্রতিদিনের রুটিন। এই আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিজ দলের কর্মীই নয়, সাধারণ জনগণও বলি হচ্ছেন। নিদারুণ অসহায়ত্বের মধ্যে দিন যাপন করছে সাধারণ মানুষ। এতো সব অপকর্মের পরেও তারা ধরাছোয়ার বাইরে। রাজনৈতিক গডফাদার সৃষ্টির কারনে জঙ্গিদের উত্তান। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যারা ত্রাসের সৃষ্টি করছে,প্রচণ্ড প্রতাপ গড়ে তুলতেই বলে-কয়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করছে, আবার খুনের পর তাঁর দায় স্বীকার করে নেওয়া, এ যেন রাষ্ট্রের মধ্যে ভিতরে থেকে আলাদা রাজত্ব কায়েম করার ঘোষণা।

এখন ত্রাসের দেশ বাংলাদেশ। ভয়ের দেশ বাংলাদেশ। বিদেশীরা এখন নিরপত্তাহীনতায় ভুগছে। রাজনৈতিক জঙ্গিদের সাথে ধর্মান্ধ জঙ্গিরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছে। ঠিক একাত্তরে যেমন করেছিলো, এখনো তাই। তফাত হল একাত্তরে এদের পৃষ্টপোষক ছিলো পাকিস্থানী হানাদার বাহিনি। আর এখন পৃষ্ঠপোষক হল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। একাত্তরে লিস্ট আর এখনকার লিস্ট কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু সময়। কোন এক মনিষী বলেছেন, কোন জাতীকে ধ্বংস করতে চাইলে, আগে তাঁর শিক্ষা ধ্বংস করে দাও। ৭১ এ বুদ্ধজীবী হত্যা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সকল হত্যা কাণ্ডের পিছনে একটাই এজেন্ডা, বাঙ্গালী জাতীকে ধ্বংস করা। এই আগ্রাসন আমাদের রাজনীতিতে, সমাজে, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে সব জায়গায়। এখন স্বাধীন দেশে নিজের ভাবনা, চিন্তা, চেতনা প্রকাশ করাই বড় অপরাধ। আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, আমরা হারিয়েছি আমাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা।

আজ পর্যন্ত যত সন্ত্রাস, খুন, রাহাজানি সৃষ্টি হয়েছে, প্রত্যেকটি ঘটনার পর দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা সাংবাদিক ডেকে কথা বলেছেন, এখনিই অপরাধী ধরে ফেলবেন, প্রয়োজনে মাটি খুঁড়ে সন্ত্রাসী বের করবেন, কেউ সময় দেন ৪৮ ঘণ্টারও। অথচ সন্ত্রাস বন্ধে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন এন্টি টেররিজম সেল গঠন করা। এখন পর্যন্ত সেই রকম কোন কিছু করা হয়েছে কিনা জানা নেই। আর দরকার জাতীয় ঐক্য।  সরকারের এই গুলোর প্রতি কোন আন্তরিকতা নেই কিংবা এই ইস্যু গুলো তারা কেন জানি কোন পাত্তাই দিতে চান না। অথচ ব্লগের উপর নজরদারির জন্য বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। যেন কেউ লেখা-লিখি করে সরকারকে বিব্রত করতে না পারে। তার উপর আইসিটি ৫৭ ধারার মত বর্বর, হীন একটা আইনকে শক্তিশালী করে মানুষের কন্ঠোরোধের আয়োজন সুসম্পন্ন করা হয়েছে। লিখলে চাপাতির কোপ, চাপাতির কোপে না পড়লেও, ৫৭ ধারায় কোপ। চাপাতি না থাকলেও অধিপতি আছেন। এই দেশে মানুষ মুক্ত চিন্তা করলে জঙ্গিদের চেয়ে বেশী সমস্যা রাজনীতিবিদদের।

একসময় এই দেশে বাংলা ভাই ছিল, এখন আছে তরিকত ভাই, ওলামা ভাই। তরিকত ভাই, ওলামা ভাইদের নিয়ে সরকারের উঠাবসা। সাথে আছেন কমরেড। এই দেশে একসময় সুশীল চিন্তা চেতনায় কমরেড গণ এগিয়ে ছিলেন। সময়ের বিবর্তনে কমরেড হয়ে গেছেন আলহাজ্ব কমরেড। আলহাজ্ব কমরেড গণ গণমাধ্যমে নিত্ত নতুন আইন তৈরি করছেন, আর তরিকত ভাই, ওলামা ভাই গণ মিলে মদিনা সনদে দেশ চালনার ফর্মুলা দিচ্ছেন। এই ফর্মুলা মুলা জনগণের সামনে ঝুলিয়ে, রাজনীতিবিদরা দিনের পর দিন জনগণের সাথে প্রতারনা করে যাচ্ছেন।

সরকারের ভিতর বাহির, যেখানে সেখানে মৌলবাদিদের পদচারনায় মুখর।   মন্ত্রী এম পি, মেয়রা তেঁতুল বাবাদের পদ লেহনে ব্যস্ত। আমরা যারা সাধারণ জনগণ আমাদের চাওয়া পাওয়া কিছুই নেই। আমরা চাই আটটা-পাঁচটা চাকুরী করে, দেশে-বিদেশে পড়াশুনা-কাজকর্ম করে সংসার নিয়ে হাসিখুশি জীবন কাটিয়ে দিতে। এই রকম জীবন যাপনে যখন দুঃখের অমানিশা নেমে আসে তখন কিছুই করার থাকে না। এই সময়ে আমাদের আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই। তাই কলম হাতে প্রতিবাদ জানাতে এসেছি। পৃথিবীর এক ক্রান্তিলগ্নে যখন মৌলবাদ মাথা-চাড়া দিয়ে উঠছে দিকেদিকে তখন আমরা সেই অন্ধকারের বিরূদ্ধে সোচ্চার হবার সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছি। হয়ত আমাদের সংগ্রাম কারো কারো স্বার্থে আঘাত হানতে পারে। কারো কারো কাছে আমাদের এই সংগ্রাম পাগলামি হতে পারে। কিন্তু এই দেশটাকে যারা মুক্ত করেছিলো সেইসব ছাত্র-জনতাকেও একসময় এমন অপবাদ শুনতে হয়েছে। জীবন দিতে হয়েছে। এই দেশটাকে গড়তে গিয়েও আমাদেরকে মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। চলবে 

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter