রাষ্ট্রদ্রোহী সন্ত্রাস, বাঙালি হত্যা, আদিবাসী সমাচার
পার্বত্য চট্টগ্রাম রক্ষার উপায় কি?
৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মহান মুক্তিযুদ্ধের ফসল এই বাংলাদেশের এক- দশমাংশ অঞ্চল ৫ হাজার ৯৩ বর্গমাইল ঘিরে অবস্থান করছে চেঙ্গী, মাইনী, কাছালং বিধৌত প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের সুদর্শন ক্ষেত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের অনতিদূরে পাহাড়ঘেরা তিনটি জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। বিগত তিন যুগ ধরেই পাহাড়ে বিস্তার করছে দারুণ অস্থিরতা। জনসংখ্যার ৪৮% বাঙালি ও ৫২% উপজাতীয় সম্প্রদায়। তারা সবাই কতিপয় উপজাতীয় নেতার একগুঁয়েমি, হামবড়া মনোভাব, উচ্চাভিলাষ ও রাজনৈতিক দাবার ঘুঁটির শিকার। কিন্তু সাধারণ উপজাতি ও বাঙালি জনগোষ্ঠী ক্রমশই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ঐসব মতলববাজ নেতাদের কাছ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। তারা চায় দেশের অখন্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ় করতে, বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব পাহাড়ে চালুর মাধ্যমে মানবাধিকার ও নাগরিক সমঅধিকারই তাদের একমাত্র প্রত্যাশা।
রাষ্ট্রদ্রোহী সশস্ত্র সন্ত্রাস : পাহাড়ে ভিন্নমাত্রায় ছড়িয়ে আছে রাষ্ট্রদ্রোহী সশস্ত্র সন্ত্রাস। এতে তারা একঢিলে দুইটি করে পাখী মারছে। একদিকে খুন, ডাকাতি, সন্ত্রাস, মুক্তিপণ, বন্দুকযুদ্ধ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে জনমনে ত্রাস ও আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। বাঙ্গালীরা ভীত ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। পার্বত্যবাসী বাঙালি ও উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে আতঙ্কগ্রস্ত রাখা হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের পেশীশক্তি ও অর্থভান্ডার সমৃদ্ধ হচ্ছে। পাশাপাশি বাঙালি জনগোষ্ঠীকে তারা বরাবরই বলে আসছে বহিরাগত, মুসলিম অনুপ্রবেশকারী, রিফুজী, সেটেলার, দখলদার বাংলাদেশী সামরিক জান্তা ইত্যাদি নামে। বিভিন্ন সমাজবিরোধী তৎপরতার মাধ্যমে রাষ্ট্রদ্রোহী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নিজেদের অর্থবল ও জনবলকে সমৃদ্ধ করছে। অন্যদিকে চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ সন্ত্রাস ইত্যাদি আতঙ্কে থেকে বাঙালি জনগোষ্ঠী পাহাড়ে বসবাসের ঝুঁকিমুক্ত হতে সমতলে ফেরত যাবার মানসিকতা তৈরিও এর আরেকটি উদ্দেশ্য। পাহাড়ে বরাবরই জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ-এর অস্ত্রধারী ক্যাডাররা ভয়াবহ বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। এর মূল কারণ হলো আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজির স্পট দখলে নেয়া এবং নিজেদের দল ভারী করা। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হলেও এসব সন্ত্রাসী তথাকথিত জুমল্যান্ড নামে পৃথক রাষ্ট্র কায়েম ও বাঙালি বিদ্বেষী রোডম্যাপ বাস্তবায়নে দারুণভাবে ঐক্যবদ্ধ। নীতিগত কোন বিরোধ তাদের নাই, তাদের বিরোধ হল অর্থের লালসা ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য।
বাঙালি হত্যা : পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রদ্রোহী সন্ত্রাসীদের হাতে (শান্তিবাহিনী) এ যাবত প্রায় ৩৫ হাজার বাংলাদেশীকে জীবন দিতে হয়েছে। পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা রাতের অাঁধারে বাঙালিদের ঘরে ঘরে গিয়ে হুমকি দিচ্ছে। ‘তোরা সমতলে চলে যা, বাঙালি আর আর্মি হিলটেকে নো-থাকিব'। বাঘাইছড়ির শতাধিক বাঙালি কাঠুরিয়া হত্যাকান্ড (১৯৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর) তাদের বৃহত্তম হামলার অন্যতম। শুধুমাত্র সেদিনকার শেখ হাসিনার সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়টি রাজনৈতিক এজেন্ডায় অগ্রাধিকার প্রদান কর্মসূচিতে না নেয়াতে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে লংগদু থানায় বসবাসরত শতাধিক বাঙালি শ্রমিককে চাঁদা নির্ধারণের জন্য আলোচনার ফাঁদে ফেলে সেদিন নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তাদেরকে চোখ বেঁধে, দুইহাত পিছমোড়া করে পাকুয়াখালীর গহীন জঙ্গলে ৫ জন করে এনে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছিল সন্তু লারমা বাহিনী। পাহাড়ের নিচে বিশাল খাদে ফেলে দেয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত হাত-পা, চোখ কান, ছেঁড়া মরদেহ সেলাই করে লংগদু থানা পরিষদ মাঠে জানাযা করা হয়েছিল। তন্মধ্যে ৩৪টি লাশ ৩৪টি কবরে শায়িত করে লংগদু মাঠে গণকবর দেয়া হয়, যার জীবন্ত আলামত আজো সেখানে রক্ষিত আছে। এছাড়া আরো বহু বাঙালি হত্যাকান্ড ঘটেছে যার লোমহর্ষক বর্ণনা আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং রাষ্ট্রদ্রোহী সশস্ত্র সন্ত্রাসকে রিষ্ট-পুষ্ট করে।
আদিবাসী সমাচার : পাহাড়ে উচ্চমানের চক্রান্ত শুরু হয়েছে আদিবাসী নামকরণটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এজন্য সন্তু লারমা, দেবাশীষ রায় গং জাতিসংঘে পর্যন্ত গিয়ে ধর্ণা দিচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই। ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর বা দক্ষিণ সুদানের মতোই জাতিসংঘকে ব্যবহার করে বিনা রক্তপাতে গণভোটের মাধ্যমে জুমল্যান্ড হাসিল করা। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির কোথাও সন্তু লারমারা নিজেদের আদিবাসী বলে উল্লেখ করে নাই, বলেছে- উপজাতীয় অধ্যুষিত এলাকা বলে। যদিওবা সেটাও বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। সরকারের সাথে শান্তিচুক্তি করে এখনো যাবতীয় বে-আইনী অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, সশস্ত্র ক্যাডাররা আত্মসমর্পণ না করেই তারা সরকারি ১০০% সুযোগ সুবিধা লুটে নিচ্ছে। অথচ সরকারকে না জানিয়ে গোপনে তথাকথিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশনের সদস্যকে জাতিসংঘ আদিবাসী ফোরামের প্রতিনিধি বানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করানো হয়েছিল। তাদের মনগড়া একপেশে ফরমায়েশী রিপোর্ট জাতিসংঘে জমা দিয়ে কাকতালীয়ভাবে পাহাড়ের বাঙালি জনগোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীকে অভিযোগের কাঠগড়ায় এনে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক বাহিনী পাঠানোর আবদার করা হয়েছে ঐ রিপোর্টে। আজ আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাবির পেছনে সন্তু লারমাদের মূল উদ্দেশ্য যে কত জঘন্য ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আলামতের বিষয়, তা সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশী প্রতিনিধি ও আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি অাঁচ করে ইতোমধ্যেই যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা দেশবাসী ঈগল দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করেছে ও সাধুবাদ জানিয়েছে। বর্তমানে ইউরোপীয় ইকোনোমিক কমিশন (EEC), ইউএনডিপি, ডানিডা, একশন এইড, কতিপয় দূতাবাস ও এনজিও তথাকথিত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের একতরফা দাবি তুললেও তারা কখনো জেএসএস বনাম ইউপিডিএফ রক্তক্ষয়ী বন্দুকযুদ্ধ ও শান্তিচুক্তির বহুশর্ত লঙ্ঘনের জন্য সন্তু বাবুদের মোটেও জিজ্ঞাসাবাদ করে না। পার্বত্যাঞ্চলে শতাধিক খৃস্টান প্যাগোডা তৈরি হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের চেয়ে খৃস্টধর্মে দীক্ষিতকরণ প্রবণতা বেশি হলেও তা নিয়ে সন্তু লারমাদের কোন প্রতিবাদ নাই। বরং তারা মাঝে মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামাইজেশন করা হচ্ছে, জোর করে উপজাতীয়দের মুসলিম বানানো হচ্ছে ইত্যাদি ভুয়া ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে মিসগাইড করে আসছে। অন্যদিকে দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় খৃস্টানে দীক্ষিতকরণ প্রক্রিয়াকে ইউএনডিপি অধিকাংশ ইউরোপিয়ান দেশ ও এনজিও উৎসাহ দিয়ে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতোমধ্যেই স্বশাসনের আড়ালে বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে স্থানীয় প্রশাসন ক্রমশ সরে যাচ্ছে। তথাকথিত শান্তিচুক্তির কারণে অনেকগুলো সরকারি বিভাগ পাহাড়ের আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। সন্তু লারমা এখনো সেই পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদে থেকে, প্রজাতন্ত্রের লাভজনক যাবতীয় সুবিধাদি ভোগ করছেন এবং সকল অত্যাধুনিক তথ্য প্রযুক্তি, অর্থবল, জনবল ও সামগ্রিক শক্তি ব্যয় করছেন হীন স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে। সর্বশেষ জাতিসংঘে আদিবাসী ফোরামের মাধ্যমে, আইএলওকে ব্যবহার করে জাতি ও সরকারকে ঘুমন্ত রেখেই তারা লক্ষ্য পূরণের অপচেষ্টা করেছে। বর্তমানে পার্বত্যাঞ্চলে মূলত সরকারি প্রশাসন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সন্তু লারমা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সেখানকার সরকার বাংলাদেশ সরকার না হয়ে (Govt. of Santu Larma, By the Santu Larma, for the Santu Larma) বলেই কাজ চালাচ্ছে। শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর প্রশাসনই তাদের সীমিত শক্তি নিয়ে ও পাহাড়ে ঝুঁকির মধ্যে সিভিল প্রশাসনের অনুরোধে জনগণের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব পালন করে আসছে। এমতাবস্থায় যদি সমস্ত সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়, তবে ছলেবলে কৌশলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে হয়তো বা জুমল্যান্ডের ভাগ্যই বরণ করতে হতে পারে। তাই দেশের এক ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কবল থেকে রক্ষার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়াবলী বাস্তবায়নের আহবান জানাচ্ছি:
১। অবিলম্বে বৃটিশ হিলট্র্যাক্টস মেনুয়েল এক্ট ১৯০০ বাতিল ঘোষণা করতে হবে।
২। প্রথাগত ভূমি অধিকারের নীতি রহিত করে পাহাড়ে ভূমি জরিপ (Cadastral Survey) শুরু করতে হবে।
৩। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যেসব ধারা পবিত্র সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, সেগুলোকে সংশোধন/পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।
৪। পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদকে নতুনভাবে নির্বাচন দিয়ে নবতর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিতে হবে।
৫। পাহাড়ের সাজেক, পানছড়ি, নানিয়ারচর, দীঘিনালা, রাজস্থলী, কুতুবছড়ি, মানিকছড়ি, রামগড়, বরকল, থানছি, লামা, রুমা, কাউখালী, ঘাগড়া, জুরাছড়ি ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের স্থল থেকে চিহ্নিত পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের আটক ও সকল বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে।
৬। সকল বিদেশী দূতাবাস, রাষ্ট্রদূত, বিদেশী সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠন ইত্যাদির কাছে মাঝে মাঝে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক বাস্তব চিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলতে হবে এবং যারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে ভূ-সন্ত্রাসীদের বাঁচাতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে জোরদার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
মনিরুজ্জামান মনির : লেখক : পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক