Flickr

Tuesday, 9 October 2012

নারী ও ধর্মব্যবসায়ী পশ্চাৎগামী চিন্তা চেতনা

Posted by   on

ঐতিহাসিক ভাবেই পুরুষরা নারীদের সকল অধিকার খর্ব করে গৃহ অভ্যন্তরে নিরাপদ উৎপাদন যন্ত্র হিসাবে নারীর ভূমিকা সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছে চিরকাল। সে কূট উদ্দেশ্য অবশ্য সফল হয় নি। এসব কথা এখন ফেলে আসা নারী ইতিহাসের লোনা জলের নীরব স্বাক্ষি। মানুষের মনোজাগতিক চিন্তা চেতনা ক্রম বিবর্তনের হাত ধরে পশ্চিমা দেশগুলোতে নারী ইতিমধ্যে লাভ করেছে সমঅধিকার।উন্নত দেশগুলোতে নারীরা আস্বাদন করেছে সম অধিকারের পূর্ণ স্বাদ। ১৯২৩ সালে আমেরিকা এক আইন বলে নারী পুরুষ সমঅধিকার ধারনাটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। এর পরে পশ্চিমা দেশ গুলোতে নারীর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়ে যায় দ্রুত। কর্মক্ষেত্রেগুলোতে নারীরা পেয়ে যায় স্থান, দক্ষকর্মী হিসাবে নারী অবস্থান নিয়েছে দ্রুত, পেয়েছে সুখ্যাতি। বাস, ট্রাম রাস্তা ঘাট, সাগর পাড়, পার্ক সর্বত্রই দিনে রাতে নারীরা মুক্ত চলাফেরার স্বাধীনতা লাভ করে। সেসব দেশগুলোতে নারীরা আজ বিমান নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে সুনীল আকাশে, ডুবুরির পোষাক চেপে চষে বেড়াচ্ছে সাগর গর্ভে, বিজ্ঞানী হয়ে বুদ হয়েছে আবিষ্কারের নেশায়, ডাক্তার হয়ে সেবা দিচ্ছে, আইনজ্ঞ হয়ে করছে বিচার, তুলির আঁচড়ে আঁকছে ছবি, কাদামাটি দিয়ে তৈরী করছে ভাষ্কর্য, প্যরাসুট নিয়ে শূণ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে হাজার ফুট উপর থেকে, রাস্ট্র নায়ক হয়ে শাসন করছে দেশ। আর কি চাই!

এতো গেল পশ্চিমা নারীদের কথা। এবার আমাদের দেশের নারীদের ভূমিকা একটু খতিয়ে দেখি।
দুই দুইবার নির্বাচিত সরকার প্রধান শেখকন্যা একজন চটুল কথার বলিস্ট নারী, বিরোধী দলের অনমনীয় কান্ডারী যার ভান্ডারে সঞ্চিত আছে দুইবার ক্ষমতারোহনের টাটকা স্বাদ ভক্তকুলের নিকট তিনিও একজন আর্দশনারী, জৌলুসহীন প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন নারী, আবার বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী একজন উচ্চশিক্ষিত নারী, সফল কৃষিমন্ত্রী রাজপথের অগ্নিশিখা যার আছে স্বাধীনতাত্তর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তিনিও একজন ইস্পাত কঠিন নারী। একি সময়ে ক্ষমতার শীর্ষে এতগুলো নারীর উপস্থিতি বিশ্বের আর ২য় কোন দেশে আছে কিনা এই অধমের স্বল্প জ্ঞান পরিসীমায় সেই তথ্য এখনো অধরা। তাছাড়া বিরোধী দলের ডাকা হরতাল পালনের উছিলায় প্রায় রাজপথ দাপিয়ে বেড়াতে দেখি বেশ কিছু সাহসী নারীকে।


আমাদের নিতান্তই দূর্ভাগ্য সুজলা বঙ্গভূমির কলুষিত রাজনৈতিক অঙ্গনে একসঙ্গে এত ক্ষমতাধর নারী প্রতিনিধির অবস্থান থাকার পরেও অবাধ মুক্ত রাজনীতি চর্চার সুযোগ নিয়ে হু হু করে বাড়ছে পশ্চাৎমুখি ভাবধারার লোকজনের সংখ্যা যারা নারীদের ঘরের ত্রিসীমায় আটকে রাখতে বিশেষ পছন্দ করে। নিজেদেরকে দাবি করে ধর্ম রক্ষার সোল এজেন্ট। ধর্ম রক্ষার খাতিরে স্বপ্রণোদিত হয়ে সরকারের কাছে পেশ করেছে অত্যাধুনিক চিন্তাচেতনা সম্বলিত ১৩ দফা। যার মধ্যে অন্যতম- ‘ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা’।
বহু ঘাত প্রতিঘাত, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, অপমানের জ্বালা সহ্য করে যুগ যুগ ধরে নিরন্তর সংগ্রামের প্রতীক হয়ে আমাদের দেশের অবদমিত, অবহেলিত নারী সমাজ যখন সবে ঘোমটার আড়াল থেকে উঁকি মারতে শিখছে, নারী পুরুষ সমঅধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠার কন্ঠস্বর যে সময়ে ক্ষীণ থেকে জোড়ালো হচ্ছে ঠিক সেই মূহুর্তে ধর্ম রক্ষার আড়ালে- প্রকাশ্যে নারী পুরুষের অবাধ বিচরণ বন্ধ করা- এই অদ্ভুত দাবী চোখ কপালে ঠেকেছে প্রগতিশীল নারী সমাজের। মানসিক নির্যাতনের নতুন ধারালো খড়্গ তারা ঝুলতে দেখছে চোখের সামনেই। বিপরীত চিত্রও একেবারে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে না তা নয়, আমাদের দেশনেত্রী খালেদা ও তাঁর অনুসারীরা এই দাবীর বিপক্ষে টুশব্দ করতে হুঁশ যেন হারিয়ে ফেলেছেন। বেহুঁশ হয়ে ভাবছেন দানাই পানাই করে আগে ক্ষমতার মসনদে উঠি তারপর এই সব পশ্চাৎগামী স্বপ্নদ্রষ্টাদের রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ভাবা যাবে! তাঁর বোধ উপলব্ধিতে জাগ্রত হচ্ছে না ক্ষমতার লোভে এই সব গোষ্ঠিকে ব্যবহার করতে গিয়ে তিনি নিজেই ব্যবহৃত হচ্ছেন পুনঃপুনঃ এই চক্রের কাছে।
বি এন পির এই নীরব সমর্থনের অনুকূল্য পেয়ে অতীতে আমরা দেখেছি জঙ্গি আর্দশে উজ্জীবিত মধ্যযুগীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নেপথ্য নায়ক শায়ক আব্দুররহমান ও বাংলাভাইয়ের উত্থান পর্ব, রাজাকারদের দেশ শাসন, গো আজমের নাগরিকতা প্রাপ্তি।
ঋদ্ধ নিকট অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের এই শিক্ষা দেয় এখনি যদি এই সব ধর্মব্যবসায়ী পশ্চাৎগামী চিন্তা চেতনা স্বপ্ন দ্রষ্টাদের রাস টেনে ধরতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয় তাহলে নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট, অনুশোচনার সাথে সাথে অগুনিত প্রাণ যাবে মুক্তচিন্তা চর্চাকারী নারী-পুরুষ উভয় সম্প্রদায়ের। যার চিত্র আমরা দেখি পশ্চাৎমুখি ভাবনা সমৃদ্ধ পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, মিশর প্রভৃতি জাতি গোষ্ঠী ইতিহাস পর্যালোচনায়।
আমাদের দেশে নারী পুরুষের সম অধিকার প্রতিষ্ঠা এখনো কল্প কথায় সীমাবদ্ধ হলেও থেমে থাকেনি নারী অগ্রগতি। কিছু পরিসংখানে তার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস পোশাকশিল্প। যেখানে শ্রম দেয় প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক। এসব শ্রমিকের প্রায় ৮০ শতাংশই নারী। যারা রক্ত ঝরিয়ে বাংলাদেশকে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি। যাদের কল্যাণে বাংলাদেশ অর্জন করেছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রফতানিকারক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি। দেশ আয় করছে কোটি কোটি বৈদেশিক মূদ্রা।
তাঞ্জিন, সাভারের মত নিয়ত মৃত্যুঝুকি উপেক্ষা করে এসব নারী যদি পুরুষের সাথে অবাধে কাজ করার যুযোগ না পায় তাহলে পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে থমকে দাঁড়াবে? কে ঠেকাবে রপ্তানী আয়ের বিপর্যয়? কে দেবে এই সব হতদরিদ্র নারীদের ভাত, কাপড়, চিকিৎসার নিশ্চয়তা? কি ভাবে ঘুরবে তাদের সংসারের ভগ্ন চাকা?
জনশক্তি খাতে নারীর অবদান বিবেচনা করা যাক, এক হিসাব মতে বর্তমানে ৭৬ লাখ বাংলাদেশি বিশ্বের ১৪৩টি দেশে বৈধভাবে বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত রয়েছেন। এর মধ্যে ১ লাখ ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী। লেবাননে সবচেয়ে বেশি নারী প্রবাসী রয়েছেন। দেশটিতে বাংলাদেশি ৫৬ হাজার ৯৭ জন নারী বিভিন্ন পেশায় কাজ করছেন। তারপরই সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫০ হাজার ১৩৫ ও সৌদি আরবে ৩১ হাজার ৪৩৭ জন নারী কাজ করছেন। প্রয়োজনে তারা কিছু টাকা খরচ করলেও সিংহভাগ টাকা কিন্তু তারা দেশে পাঠিয়ে অবদান রাখছে বৈদেশিক মূদ্রার রির্জাভ বৃদ্ধিতে।
কৃষি ক্ষেত্র বিবেচনায় বিচার করি। কৃষিকাজও বলতে গেলে নারীর ভূমিকা ছাড়া প্রায় অচল। শস্য প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রায় সকল ধাপে রয়েছে নারীর কমবেশি স্পর্শ। শাখ সবজি ও ফলমূল উৎপাদন এবং গবাদিপশু যেমন- হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল প্রভৃতি লালন পালন ও দেখভালের নারীর ভূমিকা থাকে প্রায় ৪৫ থেকে ৮৫ শতাংশ। এর সুফল ভোগ করছে কাঠ মোল্লা থেকে মৌলবাদী নাস্তিক সকলেই।
বর্তমানে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখছে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প। যা গ্রামীন অর্থনীতিতে এনে দিয়েছে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ছোঁয়া। বিস্মকর হলেও সত্য ক্ষুদ্রঋণের প্রায় ৯০ শতাংশই গ্রাহক নারী। কারণ, ঋণদাতা সংস্থা গুলো নাকি নারী ছাড়া পুরুষকে ঋণ দিতে ঠিক ভরসা পায় না।
এসব ছাড়াও সারা দেশজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য নারী উদ্যেক্তা, রয়েছে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইন, চলচিত্র, মডেলিং, নাচ গান পেশার কর্ম জীবি মহিলারা যারা অনেকেই সংসারের হাল ধরেছেন, দূর করেছেন দারিদ্রের কালো থাবা, এনেছেন পারিবারিক স্বচ্ছলতা ও গৌরব।
এবার বলুন এত দূর দারিদ্র দূরীকরণের ডিঙ্গি ভাসিয়ে হঠাৎ যদি কেউ আবদার করে বসে নারী পুরুষের অবাধ কাজ করার সুযোগ রহিত করতে হবে। লোকালয় ছেড়ে নারীকে ফিরে যেতে হবে ঘরে। নইলে ক্ষমতায় থাকা যাবে না।
বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এমন উদ্ভট দাবী নিয়ে কেউ যদি গো ধরে বসে তাহলে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে নারী অগ্রগতির ধারক বাহকদের জোড়ালো প্রতিবাদ করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ কী খোলা আছে সামনে?

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter