দলীয়করণ কি কত প্রকার
সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথেই নতুন সরকারের কাছে আমরা শুনতে পাই ‘‘দলীয়করণ এমনভাবে করে গেছে আমরা এখন বড় হিমশিম খাচ্ছি’’। আবার বিরোধীদল বলে থাকে ‘‘বর্তমানে সব কিছুতেই দলীয়করণ করা হচ্ছে’’। আমরা যারা সাধারণ জনগণ ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথেই উপরের যে কোনো একটা বক্তব্য শুনতেই হবে। বর্তমান সরকার দলীয়করণ করছে আর পূর্বের সরকার কিছুই করেনি এমন কথায়ই বা পক্ষপাতী কেন হবে? ক্ষমতায় যিনিই যাবেন বা থাকবেন নিজের সুবিধার জন্য, কাজের পরিবেশ সুন্দর রাখার জন্য তার মনের মতো বা নিজ দলের আদর্শে বিশ্বাসী লোকদেরকে পছন্দমতো জায়গায় স্থান দেবে এটাই চলে আসা নিয়ম বা প্রথা। এ কাজটি করার যে মাধ্যম তাহলে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যারা কর্মরত তাদের অবসর দেয়ার, সিনিয়রকে বাদ দিয়ে জুনিয়রকে পদোন্নতি দান, বদলী করা, ক্লোজ করা এবং নতুন নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে দলীয় লোক নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি খেয়াল রাখা।
এ ব্যাপারে একটি সরকার পারদর্শী, অন্যরা তুলসীপাতা এমনটি বলার সুযোগ নেই। তবে কথা হচ্ছে কারা সীমা লংঘন করে নিয়ম-নীতি বিসর্জন দিয়ে এ কাজটি করেন। এ ব্যাপারে তর্ক করলে হয়তো তা কোনোদিনই শেষ হবার নয় তবে কিছু সময়ের জন্য বিবেকটাকে নিরপেক্ষ করলে বিষয়টি যে কোনো বিবেকবান লোকের বোধগম্য হওয়ার কথা। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক কথাই বলেন ‘‘জিয়ার মাযারে তার লাশ আছে কিনা’’ ‘‘আমি বেঁচে থাকলে সব হত্যার বিচার করে যাবো’’, ‘‘আগের সরকার এমনভাবে দলীয়করণ করে গেছে যে, আমরা কাজ করতে পারছি না’’। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে তাহলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কি আগের সে জঞ্জাল বিদায় করে প্রশাসনের সকলস্তরে নির্দলীয়করণ করছেন? তিনি যে নির্দলীয়করণ করছেন তা যে যেভাবে বুঝে বুঝতে পারে। যেমন তিনি মনে করছেন নির্দলীয়করণ করছেন তাহলে আগের লোকদের ওএসডি করে বর্তমানে যাদের বসাচ্ছেন তারা কারা। এ যাবত কতজন সচিব-উপসচিবকে ওএসডি করা হয়েছে হিসেব আছেতো। জনগণ মনে হয় তা দেখছে। শোনা যায়, বর্তমান সরকারি দল দলীয়করণ করছেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে যেন সাধারণ জনগণ বুঝতেই না পারে। এরপরেও যে কিছু লোক বুঝে ফেলছে তাও কিন্তু ঠিক। দৈনিক সংগ্রাম ৩১ জানুয়ারি ‘‘পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বরাবরে এমপির অভিযোগ’’ শিরোনামের খবরে বলা হয়েছে সরকার দলীয় শ্রমিক নেতৃবৃন্দের কাছে প্রশাসনও অসহায়, চাহিদামতো টাকা না পেলে রোগীর অযৌক্তিক অঙ্গচ্ছেদ। সেখানে বলা হয় কর্মচারীদের দাপটে সেখানে কোনো ডাক্তারও কাজ করতে পারছেন না।’’ এমনটি কিন্তু জোট সরকার কেন আর কোনো সরকারের সময় হয়নি। এ সরকারের দলীয়করণের মারাত্মক রূপ হচ্ছে নির্বাচন কমিশন ও বিচারপতিদের দলীয়করণ করা। সংসদে একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতা, নির্বাচন কমিশন পকেটে আবার বিচারপতি বা বিচার বিভাগ যদি হয় আস্থাভাজন ওদিকে সামরিক শক্তিও নাকি এখন তাদের প্রতি সুনজর রাখছে তাহলে দলীয়করণ করবে না নির্দলীয়করণ করবে এটা কেবল তাদেরই মতামতের উপর নির্ভরশীল অন্য কারোতো এ বিষয়ে নাক গলানোর কোনো অধিকারই থাকার কথা না। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য বর্তমান সরকারের যে কৌশল সে বিষয় দৈনিক সংগ্রাম ৩১ জানুয়ারি ২০১০ উপ-সম্পাদকীয়তে আসিফ আরসালান লিখেন ‘‘বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে ইসি ও উচ্চ আদালতকে ব্যবহার করতে চায় সরকার।’’ শিরোনামে বলা হয় আসলে কৃত্রিমভাবে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে একটি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা করা হচ্ছে। আসল মতলব হলো নিবন্ধনের নাম করে এসব নোক্তা বের করে জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধনের বাইরে রাখা। আর বাইরে রাখতে পারলেই জামায়াত স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আওয়ামী সরকার জামায়াতের বিরুদ্ধে দ্বিমুখী আক্রমণ চালিয়েছে। এক হাতে তাদের পঞ্চম সংশোধনীর ধারালো তলোয়ার। অন্যদিকে আরপিও নামক নির্বাচন কমিশনের উদ্ধ্যত খঞ্জর। কিন্তু কথা হলো এই সংকীর্ণ এবং হীন রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য সুপ্রিম কোর্ট এবং নির্বাচন কমিশনের মতো দু'টি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান করবে কেন? উপরের কথাগুলোর সাথে সচেতন নাগরিক বলতেই একমত হওয়ার কথা কারণ, নির্বাচন কমিশন এবং সুপ্রিম কোর্ট যদি কোনো পর্দার আড়ালের আঙ্গুলী ইশারায় পরিচালিত হয় তা একটি জাতির জন্য বড়ই পরিতাপের বিষয়। এখন কথা হলো আমাদের জনগণের সমগ্র অংশ যে একই মতের সাথে মিশে যাবে তেমনও নয়। ভিন্নমুখী চিন্তা ও ভিন্ন রকম বুঝ বোঝারও অধিকার রয়েছে। একটি গল্পের অবতারণা করতে হয়। এক রাজার মেয়ের বক্তব্য ছিল আমার কথার উত্তর যে দিতে পারবে তাকেই আমি বিবাহ করবো। কিন্তু কোনো যুবকই তার কথার উত্তর দিতে পারলো না। এক ছাগলের রাখাল বললো, যাই একটা ইন্টারভিউ দিয়ে আসি। ইন্টারভিউ শেষ হওয়ার পর রাজার মেয়ে বললো, তোমাকেই বিবাহ করবো। সকল মানুষ অধীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করলো এ ইন্টারভিউর মূল কথা কি ছিলো? রাজার মেয়ে বললো আমি ১টা আঙ্গুল দেখিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করেছি আল্লাহ কি এক যে ২ আঙ্গুল দেখিয়েছে অর্থাৎ বুঝিয়েছে আল্লাহ এক তবে রাসূলও একজন আছেন। রাজার মেয়ে আমি ৩টি আঙ্গুল দেখিয়ে বুঝাতে চেয়েছি তৃতীয় কেউ আছে কি? ও বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে বুঝিয়েছে, আর কেউ নেই। অতএব রাখাল পাস করেছে। অন্যদিকে রাখালকে জিজ্ঞেস করা হলো, তুমি কি বুঝিয়েছো? রাখাল বললো, যখন এক আঙ্গুল দেখিয়েছে আমি মনে করেছি রাজার মেয়ে বলছে আমাকে বিয়ে করতে হলে একটি ছাগল দিতে পারবে আমি দুই আঙ্গুল দেখিয়ে বুঝিয়েছি একটা কেন দুইটা দিবো। যখন ৩টি আঙ্গুল দেখিয়েছে আমি মনে করেছি ৩টি ছাগল চেয়েছে অমনি আমি বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে বলেছি আমার আর কোন ছাগল নেই।’’ গল্পটা বড় হলেও শিক্ষণীয়। যাকে আল্লাহ যেমন বুঝার ক্ষমতা দিয়েছেন সে তেমনিভাবেই বুঝবে। বর্তমান সরকার যা বুঝাতে চাচ্ছে মানুষ যে কেবল তাই গিলে ফেলবে বিষয়টি এমন নয়। দলীয়করণ করি না বরং আগের সরকারের দলীয়করণের জন্য কাজ করতে পারছি না এমন কথা এদেশের মানুষ বিশ্বাস করবে কি করে। আমার বাড়ির পাশের একটি মাদরাসায় একজন নাইট গার্ড নেয়া হবে তাও স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপির হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্ভব হয়নি এবং একজন আওয়ামী লীগ কর্মীর পক্ষেই সে চাকরিটা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। বিশ্বাস হচ্ছে না? হবে আস্তে আস্তে সবই বিশ্বাস হবে আর যখন বিশ্বাস হবে তখন হয়তো আমাদের করার কিছুই থাকবে না। বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগ কি করছে তা জাতি জানে তবুও সেদিন ছাত্র লীগ কেন্দ্রীয় সভাপতি টিভির এক টকশোতে সুন্দর করেই বললেন, ছাত্র লীগ কোন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি করে না তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে কিছু সুবিধাভোগীরা এটা করে থাকে। মুন্নি সাহার উপস্থাপনায় ঐ টকশো দেখে মনে হয়েছে এদের মতো ভালো ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশে কেন বিশ্বের বুকেও নেই। অথচ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের অভিভাবক থেকে সড়ে দাঁড়িয়েছিলেন কেন তার কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। তাদের বুদ্ধিজীবী আবদুল গাফফার চৌধুরী এক মিটিং-এ বক্তৃতায় বলেছেন, ‘‘নব্য আওয়ামী লীগদের যন্ত্রণায় দিশেহারা বর্তমান সরকার।’’ আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় ৩০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐ একই সুরে বলেছেন, ‘‘দলের সুবিধাবাদীদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।’’ তাহলে যত অপকর্ম ঘটায় তা সুবিধাবাদীদের উপর যত সন্ত্রাস তা ছাত্র লীগের নামে অন্য কেউ করছে আর ইসলামী দল নিষিদ্ধ করার অপচেষ্টা এগুলো সুপ্রিমকোর্ট আর নির্বাচন কমিশনের ঘাড়ে চাপাতে পারলে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ আর শ্রমিক লীগের তো কোন দোষ বলতে থাকে না। দলীয়করণের তো প্রশ্নই আসে না এটা তো কেবল আগের সরকারের করা দলীয়করণের সংস্কার মাত্র। তবে আর গলা ফাটিয়ে লাভ কি। এত পরিচ্ছন্ন একটি দলের মাধ্যমে পরিচালিত দেশের নাগরিক হওয়ার সৌভাগ্যে ভাগ্যবান আমরা এটা কম কিসের? তা হলে কি আবার নজরুলের সেই কথাই মনে করতে হবে ‘‘ দোহাই তোদের এবার তোরা সত্যি করে সত্যি বল।’’ এ বাক্য ভুলে গেলে আমরা হয়তো একদিন সত্য কথা বলতে যে কোন কথা আছে তাও ভুলে যাবো। সব শেষে বলতে হয় ক্ষমতার পালাবদল হয়। কেউ যদি মনে করে আজীবন ক্ষমতায় থাকবো এটা নিতান্তই বোকার স্বর্গে বাস- অবশ্য ক্ষমতায় থাকলে এমনটি ভাবতে ভালো লাগে। কোন যুবককে যদি বলা হয়, একদিন তুমি বৃদ্ধ হবে তখন সে কেবল মুচকি হাসে তারপরে কথাটা চরম সত্য এটা মানতে আমাদের কষ্ট হওয়া উচিত নয়।
No comments:
Write comments