বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক মান অর্জন
জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বলেছেন, আন্তর্জাতিক র্যাং কিং-এর ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ পিছিয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন কেবল পুঁুথিগত বিদ্যার সীমিত গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়, বরং সৃজনশীলতা বিকাশের সেরা অংগন। রাষ্ট্রপতি তাঁর বক্তব্যে এজন্য যেসব সমস্যা রয়েছে, তা চিহ্নিত করে তা নিরসনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহবান জানান।
আমরা মনে করি, রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্যে একটি উপেক্ষিত রূঢ় সত্যিকথা প্রতিফলিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় যে অবক্ষয় ও গ্রহণের সূচনা হয়েছিল, তা থেকে মুক্ত হতে জাতিকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। ঐ সময় বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী, সনদ আন্তর্জাতিক শিক্ষাজগতে অনুমোদন ও স্বীকৃতি পেতো না। ব্যাপক নকলবাজি এবং শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের যে অভিশাপের কালো ছায়া স্বাধীনতার পর সরকার দলীয় ক্যাডারদের সুবাদে দেশময় বিস্তৃত হয়েছিল, তার ধারা ১৯৭৫ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ১৯৭৫-এর পর থেকে পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থায় ধীরে ধীরে উচ্চ শিক্ষার মান পুনরুদ্ধারের প্রয়াস লক্ষণীয়। দলীয় রাজনৈতিক মাস্তানী, শিক্ষকদের রাজনৈতিক বিভাজন, সেশনজট সহ নন-একাডেমিক প্রবণতাগুলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সুষ্ঠু পরিবেশ বিনষ্ট করেছে। শিক্ষক ও ছাত্রদের মাঝে একাডেমিকেন্দ্রিক তৎপরতার বদলে রাজনৈতিক বিভাজন ও দলীয় দখলবাজির অভিশাপে আমাদের উচ্চ শিক্ষার পরিবেশ অস্থিরতা ও স্থবিরতায় ডুবে আছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে রাজনৈতিক সংঘাত এবং শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নানা মাত্রিক অব্যবস্থা-অনিয়মের ফলে বাংলাদেশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ কেবল কাগুজে সার্টিফিকেট অর্জনের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এর পাশাপাশি দেশে ব্যাপকভাবে প্রাইভেট সেক্টরে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'একটি বাদে অধিকাংশেরই প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ ও মান ছাড়াই গলাকাটা অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। উপযুক্ত পরিসরের ক্যাম্পাস, ভবন, শিক্ষক ও শিক্ষার উপকরণ ছাড়াই দেশে প্রাইভেট সেক্টরে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা তৈরীর আগেই এগুলো গড়ে উঠেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার সীমিত আসন সংখ্যার কারণে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অস্তিত্ব টিকে আছে। এরপরও উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিবছর হাজার হাজার বাংলাদেশী ছাত্র বিদেশের খ্যাত-অখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। এদের লেখাপড়ার মান ও সনদের গুরুত্ব যাই থাক না কেন, এতে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে। তাছাড়া বিদেশে উচ্চ শিক্ষার আকর্ষণে ভর্তি হয়ে অনেকে ভোগান্তি ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে। বৃটেনের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হবার পর শোনা যাচ্ছে, ঐসব বিশ্ববিদ্যালয় যথার্থ মানসম্মত নয় এবং কর্তৃপক্ষের অনুমোদনও নেই অনেকগুলোর। অথচ বিজ্ঞাপন ও ওয়েব সাইটের প্রচারণায় আকৃষ্ট হয়ে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য পঙ্গপালের মত বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষামন্ত্রণালয় তথা সরকারের একটা গাইডলাইন থাকা দরকার। অন্যদিকে বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মান সম্মত করে বিদেশী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে পারে। এতে যেমন দেশের মান বাড়বে, তেমনি এই খাত থেকে সরকার প্রচুর উপার্জনও করতে পারে। বিশ্বের বহুদেশ তাদের উচ্চশিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উত্তীর্ণ করে শিক্ষাখাতকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উপলক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে রাজনৈতিক কলুষতামুক্ত ও শিক্ষকদের অ-শিক্ষকসুলভ মানসিকতা থেকে মুক্ত করে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে এনে উচ্চ শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উত্তীর্ণ করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মানের বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সাথে মিলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যে অর্থের প্রয়োজন হবে, সরকারকে তা দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। উপযুক্ত শিক্ষক, শিক্ষার উপকরণ এবং শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায় ভারসাম্যমূলক সমন্বয় করতে পারলে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা তেমন কঠিন কাজ নয়। বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষকরা উন্নত দেশের খ্যাতিসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে সুনাম অর্জন করতে পারলে আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন দুর্নাম নিয়ে পেছনে পড়ে থাকবে, তা বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবীরা যাতে বিদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে দেশের উচ্চ শিক্ষাকে সমৃদ্ধ ও মানসম্মত করার ব্যাপারে আগ্রহী এবং উৎসাহী হন, সে ব্যাপারে তাদের বেতনভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করারও ব্যবস্থা রাষ্ট্র-সরকারকে করতে হবে।
আমরা আশা করবো, উচ্চ শিক্ষার আন্তর্জাতিক মানোন্নয়নে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ নিছক বক্তৃতার নীতিকথা হিসেবে ফাইলবন্দী না থেকে এর আলোকে একটি সুষ্ঠু ও সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিতে হবে। উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখীতা বন্ধ করা এবং দেশের দুর্নাম ঘুচানোর উদ্যোগ নিতে আর বিলম্ব করার সুযোগ নেই।
No comments:
Write comments