Flickr

Tuesday, 23 March 2010

গার্মেন্টস কারখানা কেন মৃত্যু-ফাঁদ হবে?

Posted by   on

গত বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার অদূরে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তার ভোগড়া এলাকার একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে ভয়াবহ অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ২১ শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। আগুনে পড়ে এবং আগুনের উত্তাপ ও ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এসব শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১৩ জন মহিলা রয়েছেন। আগুন লাগার খবর পেয়ে দমকল হেড কোয়ার্টার, কুর্মিটোলা, মিরপুর, গাজীপুর ও টঙ্গী ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা চেষ্টার পর রাত ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ঘটনাস্থলে বা কাছাকাছি পর্যাপ্ত পানি না থাকায় ফায়ার সার্ভিসের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়। এছাড়া বিদ্যুৎ না থাকায় পুরো এলাকা ছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত। আহতদের আর্তচিৎকার এবং নিহত ও আটকেপড়া শ্রমিকদের স্বজন এবং সাধারণ মানুষের আহাজারীতে এলাকার পরিবেশ অসহনীয় বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায়। প্রাণহানি ছাড়াও সোয়েটার ফ্যাক্টরির মালামাল ও অবকাঠামোর বিপুল ক্ষতি হয়েছে।

 প্রত্যক্ষদর্শী ও দমকল সূত্রের খবর : গাজীপুর সদরের ভোগড়া এলাকার গরিব এ্যান্ড গরিব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে অবিরাম উৎপাদন কাজ চলছিল। এ সময় সাততলা ভবনের দোতলায় স্যুইং সেকশনে রাত ৮টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর আগুন কারখানার অন্যান্য তলায়ও ছড়িয়ে পড়ে। এতে কারখানার ভেতরে আটকা পড়ে এবং অগ্নিকান্ড-উৎসারিত ধোঁয়ায় বন্ধ হয়ে শ্রমিকরা মৃত্যুবরণ করেন। অগ্নিকান্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা কেউ কেউ মনে করেন, বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিট থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত ঘটতে পারে। তবে অগ্নিকান্ডের কারণ যাই থাক, এতে বেশ কয়েকটি মূল্যবান জীবনের অবসান ঘটেছে। অর্ধশতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছেন এবং কারখানার মালিকপক্ষ বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এর পাশাপাশি বিদেশী বায়ারদের কাছে কারখানার মালিক শর্ত অনুযায়ী সোয়েটার সরবরাহ করতে ব্যর্থ হবেন এবং কারখানাটি আবার কবে উৎপাদনক্ষম হবে, তা-ও বলা যাচ্ছে না।

 গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকান্ড আতংকজনক নিয়মিত দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এর আগেও শ্রমঘন গার্মেন্টস কারখানায় একাধিক অগ্নিকান্ডে বিপুল প্রাণহানি ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি ঘটতে দেখা গেছে। অনেক সময় ‘অন্তর্ঘাতী তৎপরতায়ও গার্মেন্টস শিল্পে অগ্নিকান্ড ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর পেছনে বিদেশী শক্তির মদদপুষ্ট দুষ্কৃতকারীদের অন্তর্ঘাত থাকার আশংকাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে ঈর্ষাগ্রস্ত একটি বিদেশী শক্তি গার্মেন্টস শিল্পে নৈরাজ্য ও অন্তর্ঘাত চালানোর অপকৌশলের সাথে জড়িত বলে নানা মহল মনে করেন। হরতাল-বিক্ষোভ, ভাংচুর-নৈরাজ্য সংঘটনকারীদের ধরাপড়ার ভয় থাকে। এ কারণেই দুর্বৃত্তরা চুপিসারে অগ্নিকান্ড ঘটানোর মতো অন্তর্ঘাত চালাতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। গার্মেন্টস শিল্পের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ‘শিল্প পুলিশ' গঠনের যে প্রস্তাব সকল মহল সমর্থন করেছেন, সরকার আজও তা বাস্তবায়ন করেনি। ফলে গার্মেন্টস শিল্প দুর্বৃত্ত ও অন্তর্ঘাতকদের জন্য এক প্রকার অরক্ষিত হয়ে আছে। শিল্প-মালিকদের পক্ষ থেকেও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দুর্ভেদ্য করে গড়ে তোলা হয়নি। ফলে অগ্নিসংযোগ থেকে গার্মেন্টস-এ হামলা, ভাংচুর ইত্যাদি ঘটনাগুলো একপ্রকার বিনা বাধায়ই ঘটতে পারছে। বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিট থেকে যাতে কারখানায় আগুন লাগতে না পারে এবং লাগলেও যাতে স্থানীয় পর্যায়ে তাৎক্ষণিক আগুন নিভিয়ে ফেলা যায় প্রতিটি কারখানায় সে জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষিত জনশক্তি এবং বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক অবকাঠামো থাকা দরকার। কেননা স্থানীয় বা আঞ্চলিকভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে দ্রুত আগুন নেভানোর কোন ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিটি অগ্নিকান্ডেই বিপুল প্রাণহানি ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি ঘটছে। অগ্নিকান্ড ঘটার সাথে সাথে বিকল্প সিঁড়ি দিয়ে যাতে দ্রুত শ্রমিকরা নীচে নেমে আসতে পারেন, তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। গার্মেন্টস শিল্পে একাধিক দুর্ঘটনার পটভূমিতে দুর্ঘটনা এড়াতে এবং ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বিশেষজ্ঞ মহল ও আইন-শৃংখলা রক্ষাবাহিনী গার্মেন্টস মালিকদের যেসব ব্যবস্থা নিতে বলেছেন, তা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, সেটা দেখভাল করার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক পর্যায়ে দায়িত্ব প্রতিপালিত হয় না বলেই গার্মেন্টস শিল্পে অগ্নিকান্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটছে। এব্যাপারে সরকার গার্মেন্টস শিল্প-মালিক সমিতির সাথে মিলে সমন্বিত কর্মসূচি নিতে পারেন। অগ্নিকান্ড ঘটলে শ্রমিকরা কিভাবে তা থেকে আত্মরক্ষা করবেন এবং নীচে নেমে আসবেন, তার প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত। এছাড়া প্রতিটি গার্মেন্টস কারখানায় ফার্স্ট এইড ব্যবস্থা থাকা দরকার। তার চেয়েও বেশি দরকার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির প্রতিতলা ভবনে প্রাথমিক পর্যায়ে আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতি।

 আমরা লক্ষ্য করছি, গাজীপুরের সংশ্লিষ্ট ফ্যাক্টরী কর্তৃপক্ষ বা শ্রমিকরা প্রাথমিক পর্যায়ে স্থানীয়ভাবে আগুন নেভানোর উদ্যোগ নিতে পারেননি। এটা দুঃখজনক। যদিও গার্মেন্টস শিল্প মালিক সমিতি নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে ২ লাখ টাকা করে অনুদান দেবার ঘোষণা দিয়েছে। তবে এটা প্রাথমিকভাবে অপ্রতুল নয়। তবে এই সাথে সরকারেরও সহযোগিতার হাত নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। একটি দরিদ্র পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তির আয় থেকে পরিবারটি যখন বঞ্চিত হয় তখন তাদের জীবনে নতুন করে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে গার্মেন্টস মালিককে গ্রেফতার করে বিচার ও ক্ষতিপূরণ দাবী করা হয়েছে। আমরা আশা করি, উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে অগ্নিকান্ডের প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। একই সাথে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক পক্ষ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কোন গাফিলতি থাকলে তাও নিরূপণ করে প্রতিকার করা উচিত।

 আমরা আশা করবো, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে আর যাতে অগ্নিকান্ড না ঘটতে পারে, সে জন্য সরকার ও শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে সমন্বিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নিহত শ্রমিকদের পরিবারসমূহকে যাতে পথে বসতে না হয়, সে জন্য উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ ছাড়াও তাদের পরিবারকে পুনর্বাসনে আরও কি করা যায়, মানবিক দিক বিবেচনা করে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। আহত শ্রমিকদের উপযুক্ত চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। ২১ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন মর্মান্তিকভাবে। এটাকে নিছক দুর্ঘটনা বলে কোন পক্ষই এই মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না। আমরা নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক ও সহানুভূতি জানাচ্ছি এবং আহত শ্রমিকরা নিরাময় হয়ে উঠুক, আন্তরিকভাবে সে কামনাই করি।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter