Flickr

Friday, 30 April 2010

অপার সম্ভাবনাময় হয়ে উঠা বাংলাদেশ আজ সব হারাতে বসেছে

অপার সম্ভাবনাময় হয়ে উঠা বাংলাদেশ আজ সব হারাতে বসেছে -ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
বিগত তিন বছরের ধারাবাহিক অপশাসনে এক অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ এখন ক্ষীয়মান নি্রাণ রাষ্ট্রে পরিণত হতে বসেছে। রাষ্ট্র যেন এখন লুটেরাদের চারণভূমি। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ এখন জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থনীতি। উৎপাদন নেই, বিনিয়োগ নেই, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ নেই। অবিরাম মিথ্যাচারে হতভম্ব মানুষ দিশেহারা। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী গলা চড়িয়ে যা ইস্যু নয়, সেটাকেই ইস্যু বানানোর জন্য শেয়ালের রা' তুলছে। তার সঙ্গে দায়িত্বহীন মিডিয়াও সুর তুলছে। আমরা শুনেছিলাম ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের নায়কদের ফাঁসিতে ঝুলাতে পারলে দেশের আর কোনো সমস্যা থাকবে না, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। তাদের ফাঁসিতে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। দেশের সমস্যার সমাধান হয়নি, বরং সঙ্কট আরও বেড়েছে। এখন শুনছি সকল উন্নযনের মূলমন্ত্র নিহিত আছে কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্যে। ফলে সরকারের একটাই চিন্তা। কী করে ঐ প্রহসনের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে (২০০১-০৬) আমরা দেশে বিনিয়োগ আর উৎপাদনের জোয়ার লক্ষ্য করেছিলাম। ঢাকার আশপাশে কাঁচপুর থেকে নরসিংদী, ঢাকা থেকে মুন্সীগঞ্জ, গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে দেখেছি। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ দেখেছি। বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কর্মকান্ড দেখেছি নিভৃত পল্লীতেই। সাধারণ মানুষ চাষাবাদ, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু পালন, নার্সারী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেদের জীবনমান বদলে নিচ্ছিল, দেখেছি। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে বাড়ছিল জীবনমান। শিক্ষা স্বাস্থ্যের প্রতি অধিক যত্নশীল হয়ে উঠছিল মানুষ। ভ্যানচালকের সন্তানেরাও যাচ্ছিল বই-খাতা হাতে স্কুলে। প্রবৃদ্ধি প্রায় সাত শতাংশে উন্নীত হয়েছিল।
এই যে এখন মিথ্যার বেসাতি শুনছি যে, জোট সরকারের আমলে এক মেগাওয়াটও বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়নি। পরিস্থিতি যদি তাই, তাহলে দেশী-বিদেশী এত বিনিয়োগকারী কেন শিল্পকারখানা স্থাপন করেছিল? আর সরকার দাবি করছে যে, বিগত এক বছরেই না কি তারা সাতশ' মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। তাহলে বিনিয়োগ নেই কেন? উৎপাদন বন্ধ কেন? কলকারখানা চালু রাখা যাচ্ছে না কেন? এসব প্রশ্নের জবাব মেলা ভার।
জোট সরকারের সময় বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল না। এমন কথা বলব না। তখনও চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়নি। তখনও লোডশেডিং ছিল। কিন্তু কেউ কি দিব্যি দিয়ে বলতে পারবে যে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৪ ঘণ্টাই তখন লোডশেডিং ছিল? অফিসে হাফ-শার্ট পরে যেতে হবে। পাঁচ ঘণ্টা এসি চালানো যাবে না। তখন কি সার-কারখানা বন্ধ করে সেচের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস দিতে হয়েছিল? নিশ্চয়ই নয়। তখন তো এমন কোনো নির্দেশ জারি করা হয়নি যে, গ্যাস দিয়ে জেনারেটর বয়লার চালু রাখা যাবে না, সিস্টেম বদলাতে হবে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসতে হাসতে বলেছিলেন যে, আল্লাহ তায়ালা জন বুঝে ধন দেন। তিনি বলেছেন তাদের আগের দফা শাসনকালে (১৯৯৬-২০০১) দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছিল। কিন্তু চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর সে উৎস শুকিয়ে যায়। এখন তাহলে শুকিয়ে ফেলা হচ্ছে কেন? আল্লাহ তায়ালা কি এ যাত্রা আর ধন দিচ্ছেন না?
এদিকে স্মরণাতীতকালের ভয়াবহ লোডশেডিং-এ গোটা দেশ পঙ্গু হতে বসেছে। শুধু যে কল-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, তাই নয়, সাধারণ মানুষের কর্মক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে। অফিস-আদালতে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের চার থেকে পাঁচ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকে না। ঐ সময় কোনো কাজও হয় না। ফলে সকল কাজে এসেছে ধীরগতি। একজন মানুষের সারাদিনে যতটুকু কাজ করার কথা, কাজ করতে পারছে তার অর্ধেক। ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা। পিছিয়ে পড়ছে গোটা জনপদ, গোটা সমাজ। কিন্তু বাগাড়ম্বর থামছে না কিছুতেই। বরং এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সরকার নির্বিকার। অর্থমন্ত্রী বলছেন, দেশে আশু বিনিয়োগের কোনো সম্ভাবনা নেই। কোনো কোনো মন্ত্রী বলছেন, বিদ্যুৎ সঙ্কট আরও দু'বছর চলবে। প্রধানমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ প্রগলভতায় বলছেন যে, সাত বছরের জঞ্জাল এক বছরে সাফ করা সম্ভব নয়। ধৈর্য ধরতে হবে। জনগণ অসহায় হয়ে পড়ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে- এটা দেখানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী ছ'মাস আগে চালু হওয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঘটা করে উদ্বোধন করছেন। যেন জনগণ বোঝে, বিদ্যুৎ এলো বলে।
কিন্তু জনগণ অতোটা বোঝে না। তারা কথার মারপ্যাঁচে ভোলে না। সেচের জন্য বিদ্যুৎ চাই, উৎপাদনের জন্য বিদ্যুৎ চাই, কারখানার জন্য বিদ্যুৎ চাই। তা না পেলে মিষ্টি কথা শুনে তাদের ফায়দা হয় না। ক্ষমতায় বসেছেন, বিদ্যুৎ দিন। সুতরাং চারদিকে বিক্ষোভ দানা বাঁধছে। ধানের জমি শুকিয়ে কাঠ। সেচ দেয়া যাচ্ছে না। স্থানে স্থানে মানুষ ঘেরাও অবরোধ, মিছিল-সমাবেশ করছে। আওয়ামী এমপিরাই বলছেন, এ সঙ্কটের সুরাহা না হলে জনবিস্ফোরণ ঘটবে। পুলিশ দিয়ে সে বিস্ফোরণ ঠেকানো যাবে না। কোনো দিন যায়নি। এখন নাগরিকরা টেলিফোনে কথাবার্তা শুরু করেন বিদ্যুৎ নিয়ে : আপনাদের ওদিকে বিদ্যুৎ আছে? সরকারকে এ বার্তা বুঝতে হবে।
জোট সরকারের অনেক সমালোচনা ছিল, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ না দিতে পারার জন্য। কিন্তু এই ভয়াবহ অবস্থা তখন ছিল না। আওয়ামী লীগের ডেকে আনা অসাংবিধানিক সরকার বিদ্যুৎ নিয়ে ভাবেনি। তাদের বদৌলতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। ক্ষমতায় বসেই বিরোধী দল নির্মূলে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। আর কোনো দিকে তাকাবার ফুরসত হয়নি। শাসন একেবারে তোঘলকি ভাবনা। রাষ্ট্র যেমন খুশি চলুক, জনগণ যা ভাবার ভাবুক। জনগণ তো ভোট দেয় না। তাদের নিয়ে ভাবনার কি আছে! ফলে বিদ্যুৎ নিয়েও কিছু ভাবা হয়নি। উৎপাদন ক্ষমতার সবটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় গ্যাসের উৎপাদন বাড়িয়ে। সেটাও করা যেত দু'এক মাসের মধ্যেই। কিন্তু তাও করা হয়নি।
আসলে আধুনিক পৃথিবী বিদ্যুৎ ছাড়া অচল। বিদ্যুৎ না থাকলে শিল্পে বিনিয়োগ হবে না। শিল্পে বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান হবে না। কর্মসংস্থান না হলে দারিদ্র্য বাড়বে, দারিদ্র্য বাড়লে সমাজে অস্থিতিশীলতা বাড়বে। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-রাহাজানি বাড়বে। আবার বিনিয়োগ না হলে ব্যাংকে পড়ে থাকবে অলস টাকা। অথচ ব্যাংকগুলোকে দিতে হবে জমাকারীর সুদ। ফলে ব্যাংকিং খাতও অস্থির হয়ে উঠবে। পুঁজি চলে যাবে দেশ ছেড়ে। ত্রিপুরার মন্ত্রী ঢাকা সফরে এসেছিলেন। বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের বলে গেছেন, ত্রিপুরায় বিনিয়োগ করলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়া হবে। বাংলাদেশে শিল্পে নতুন বিনিয়োগের কথা কেউ ভাবছে না। যা বিনিয়োগ করা হয়েছে, সেটা রক্ষা করা যায় কিনা, তাই নিয়ে ভাবছে। এ ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রফতানিমূখী শিল্পগুলো সময় মতো পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে বাজার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সে বাজার দখলে নিচ্ছে চীন-ভারত-ভিয়েতনাম। কারখানাগুলোতে অর্ধেক সময় কাজ হচ্ছে না। ২৫-৩০ ভাগে দাঁড়িয়েছে উৎপাদন। ফলে ব্যাংকগুলো আবার শঙ্কিত। তারা শিল্পপতিদের ঋণ দিয়েছে। উৎপাদন না হলে, কারখানা চালু রাখা না গেলে উদ্যোক্তারাই বা সে ঋণ শোধ দেবেন কোত্থেকে? ফলে এক হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে গোটা দেশ।
সরকার হয়ত ভাবছে, তাদের বিপুল জনসমর্থন রয়েছে। কে কি করতে পারে? কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি না থাকলে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের যেমন কষ্ট হয়, তেমনি কষ্ট হয় আওয়ামী সমর্থকদের মধ্যে। তখন ‘জয় বাংলা' বলে ধ্বনি তুললে সে কষ্ট লাঘব হয়ে যায় না। সমর্থন উঠে যেতে থাকে। ফলে বিস্ফোরণ যখন ঘটে, তখন সে বিস্ফোরণে তারাও শরিক হন। জনসমর্থনের কাল্পনিক নিরাপত্তা তখন অবশিষ্ট থাকে না। আর হাওয়াই বক্তব্যে তাদের মন ভেজে না। সরকার বলছে, বিদ্যুৎ আমদানি করবে ভারত থেকে। যেখান থেকে আমদানি করবে বলছে, সেখানে কেবল মেশিনপত্র বসছে। অর্থাৎ রসুনের বীজ রোপিত হচ্ছে। তার চেয়ে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের হাতে ছেড়ে দেন। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীর অভাব নেই। সরকারের ঢিলেমির ফলে তারা অনেক দ্রুত উৎপাদনে যেতে পারবেন। হাওয়াই আমদানি পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে।
কিন্তু আমদানির দিকে সরকারের বড় ঝোঁক। এখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাতে এক সময় ঘটি-বাটিও আমদানি করতে হবে। দেশের সকল শিল্প-কারখানা রফতানির লক্ষ্য নিয়ে স্থাপিত হয়নি। অধিকাংশ কলকারখানাই স্থাপিত হয়েছে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহের লক্ষ্যে। বিদ্যুৎ না থাকায় সেগুলোও উৎপাদনে থাকতে পারছে না। গ্যাস-বিদ্যুতে উৎপাদন খরচ কম। কিন্তু ডিজেল-ফার্নেসে খরচ অনেক বেশি। ডিজেল চালিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ দিয়ে পণ্য সামগ্রী উৎপাদন করতে চাইলে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ-তিনগুণে দাঁড়াবে। যে পণ্য কেনার সাধ্য থাকবে কারও। সরকারকে তখন ওসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। বন্ধ হয়ে যাবে কলকারখানা। বেকার বাড়বে। তারাও কম দামের জিনিস খুঁজবে। বাংলাদেশের পণ্য সরবরাহের জন্য ভারতে শিল্প-কারখানার প্রসার ঘটবে। কী মজাই না হবে!
কিন্তু আমদানি করবে কী দিয়ে? রফতানি খাত তো ইতোমধ্যেই স্থবির হয়ে গেছে। বেকার হয়েছে শুধু গার্মেন্টসেই দুই লাখ। সরবরাহ ঠিক না রাখতে পারলে ক্রেতারা ভিন দেশের দিকে মুখ ফেরাবে। শ'য়ে শ'য়ে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বন্ধ হবে। বৈদেশিক মুদ্রা আসবে না। আবার সরকারের ভারত-তোষক পররাষ্ট্রনীতির কারণে এখন তারা একেবারেই বন্ধুহীন। সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে বিদেশী শ্রমবাজার। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রম বাজার হাতছাড়া হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরও সৌদী আরব কুয়েত-কাতার আর বাংলাদেশ থেকে লোক নিচ্ছে না। বরং ফেরত পাঠাচ্ছে। ফলে প্রবাসীদের পাঠানো টাকাও ক্ষয়ে যেতে থাকবে। আমদানির মুরোদও থাকবে। তখন এই সরকারের মূল পরিচালক বিশ্বব্যাংকে আইএমএফ এডিবি আমদানির জন্য কঠিন শর্তে ঋণ দেবে। যে শর্ত দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকেও বিপন্ন করে তুলবে।
সরকার এমনি এক ভয়াবহ লক্ষ্যহীন গন্তব্যহীন পথে যাত্রা শুরু করেছে। এ থেকে উদ্ধারের পথ সকলকে একযোগে খুঁজতে হবে। সরকারকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, দেশ ও জনগণের ভাগ্য নিযে এমন ছিনিমিনি খেলা চলবে। সরকারের পথ ভুল। আর যে ভুল শুধরে দেয়ার জন্য শিল্পপতি-ব্যবসায়ী-কর্মজীবী-শ্রমজীবী কৃষক-মজুর সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। সে প্রতিরোধের পথেই সংশোধিত হতে পারে সরকার। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ বুঝি আর খোলা নেই।

Thursday, 15 April 2010

দুর্নীতি ব্যবসা ও রাজনীতি

দুর্নীতি ব্যবসা ও রাজনীতি
দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান জনাব গোলাম রহমান গত ৬ এপ্রিল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ, বর্তমান বাস্তবতা ও নাগরিক উদ্বেগ' শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, রাজনৈতিক ধারার পরিবর্তন এবং ব্যবসা ও রাজনীতিকে আলাদা করা না গেলে দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা যাবে না। তিনি বলেছেন যে, দুর্নীতি নির্মূল করার ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই, কিন্তু তারাও পারছে না। কারণ রাজনীতির সাথে এখন ব্যবসা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ব্যবসা ও রাজনীতির অাঁতাতের মধ্যে রয়েছে দুর্নীতির বীজ। বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি রোধ করতে হলে এই অাঁতাত ভাঙ্গা দরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলা প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেছেন যে, দোষী কি নির্দোষ তা প্রমাণের জন্য প্রধানমন্ত্রী বিচারিক আদালতে গিয়েছেন। তিনি দুদককে প্রভাবিত করছেন না। এটা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অঙ্গীকারের প্রমাণ।
দুদকের চেয়ারমানের এই বক্তব্যকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। তিনি দুর্নীতি দমনের জন্য রাজনৈতিক ধারার পরিবর্তনের কথা বলেছেন। বিষয়টি তিনি স্পষ্ট না করলেও এর অর্থ যদি রাজনৈতিক সহনশীলতা, সংযম, প্রতিদ্বনদ্বী নির্মূলের প্রবণতারোধ এবং অর্থবিত্ত আহরণে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার না করা বুঝায় তাহলে আমরা তার সাথে একমত। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি মামলা প্রসঙ্গে যে কথা বলেছেন তাতে তাকে প্রধানমন্ত্রীর মুখপত্র বলেই মনে হয়েছে, কমিশনের চেয়ারম্যান নয়। তার কথাকে আমরা সত্য বলে মেনে নিতে পারি না কেননা প্রধানমন্ত্রীর সরকার তিনিসহ তার দলের সকল নেতানেত্রীর দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্যই আদালতে গেছেন। তাদের উদ্দেশ্য যদি মহৎ হতো তাহলে ট্রায়ার কোর্টেই তারা অভিযোগ মোকাবিলা করতেন। আবার কমিশন চেয়ারম্যান ব্যবসা এবং রাজনীতিকে আলাদা করার যে কথা বলেছেন দুর্নীতি দমনের নিয়ামক হিসেবে তার গুরুত্ব আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। রাজনীতিকদের একটা পেশা দরকার সেটা ব্যবসা হলে আপত্তি থাকার কথা নয়। ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করবেন না, দেশের এমন কোন আইন নেই। এক্ষেত্রে আপত্তিকর যা তা হচ্ছে ব্যক্তি স্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার, ব্যবসা নয়। ব্যবসাকে দোষারোপ করলে সকল পেশাকে দোষারোপ করতে হয়, যা করা উচিত হতে পারে না। বলা বাহুল্য দুনিয়ার সব সমাজেই দুর্নীতি রয়েছে। এই দুর্নীতির ধরন প্রকৃতি ও ব্যাপকতা বিভিন্ন রকমের হলেও এর মূল কারণ এক এবং অভিন্ন বলে আমরা মনে করি। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব এবং দুর্নীতি নিরসনে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের অঙ্গীকারের অনুপস্থিতি ক্ষমতার মদমত্ততা, দলীয় নেতাকর্মীদের অতিরিক্ত সুবিধা প্রদানের প্রবণতা, বৈধ অবৈধ বা হালাল হারামের অনুভূতি হ্রাস ও আখেরাতের বিচারের প্রতি নির্লিপ্ততা ব্যক্তি ও দলকে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে উৎসাহিত করে। ধন সম্পদ আহরণে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা, বিশেষ করে যেন তেন প্রকারে অর্থবিত্ত সংগ্রহ এবং ভোগ বিলাসে সবাইকে টেক্কা দেয়ার মানসিকতাও দুর্নীতির অন্যতম কারণ। এর সাথে যদি সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণ কাঠামো এবং বিতর্কিত বিচার ব্যবস্থা যোগ হয় তাহলে সমাজে দুর্নীতিগ্রস্ততা আরো বৃদ্ধি পায়। এক এগারো উত্তর বিগত সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে দুর্নীতি নির্মূলের একটি স্বপ্নের সৃষ্টি হয়েছিল। দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স এক্ষেত্রে যে আবহের সৃষ্টি করেছিল তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন স্বস্তি এসেছিল তেমনি দুর্নীতিগ্রস্ততা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। দুর্ভাগ্যবশতঃ পরবর্তীকালে যখন সরকারের দুর্নীতি দমন অভিযান রাজনীতি দমন অভিযানে রূপান্তরিত হয় তখন মানুষের স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান হয়ে পড়ে। ক্ষমতাসীনরাই এক্ষেত্রে দুর্নীতির চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে। ওয়ান ইলেভেনের সামরিক বেসামরিক কিছু নায়ক আধিপত্যবাদের কাছে বিক্রি হয়ে যাবার অভিযোগ ওঠে এবং অাঁতাতের নির্বাচনে যারা ক্ষমতায় আসেন তারা দুর্নীতি দমন নয়, দুর্নীতিকে স্থায়িত্ব দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়। দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির দায়ে দায়ের করা সকল মামলা (এমন কি খুনের মামলাও) প্রত্যাহার করে তারা যে নজির সৃষ্টি করেছেন তা অনন্য। পক্ষান্তরে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একই কারণে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে মামলা রুজু করেছিলেন সেগুলো তারা প্রত্যাহার না করে এক যাত্রায় দুই ফলের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন এবং নতুন মামলাও দিচ্ছেন। এই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা দুর্নীতি প্রসারে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। সরকারি দল ও তার অংগ সংগঠনসমূহ দেশব্যাপী চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, দলীয়করণ স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাত্রা ছাড়িয়ে দুর্নীতি প্রসারের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন বলে আমরা মনে করি। আইনের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ প্রয়োগ থাকলে বিশেষ করে আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আখেরাতের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভয় থাকলে এই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে না। সকল প্রকার দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি নিজেদের জন্য যদি কোনো শাসকগোষ্ঠী হালাল ও অন্যদের জন্য হারাম মনে করে তা হলে সমাজ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা কখনো সম্ভবপর নয়। এ প্রেক্ষিতে সমাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনা, নিরপেক্ষতার সাথে দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রতিষেধক ব্যবস্থা হিসেবে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণ, নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি প্রভৃতি কাজ নিশ্চিত করার জন্য মানুষ একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ দুদক চেয়েছিল। মানুষের এই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায় যে দুদক কার্যতঃ ক্ষমতাসীনদের বশংবদ একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দুদকের মূল আইনকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের সুবিধা অনুযায়ী সংশোধন করে রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বীদের ঘায়েল করার জন্য এই প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবহার করছে। এই অবস্থায় দুদকের চেয়ারম্যানের বক্তব্যকে অক্ষমের অজ্ঞতা ও হতাশার অভিব্যক্তি বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে বলে আমরা মনে করি।

Monday, 12 April 2010

স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং সাংবাদিক নির্যাতন

স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং সাংবাদিক নির্যাতন
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেই বিরোধী দলীয় এবং তাদের অপছন্দনীয় সাংবাদিকতা হুমকির মুখে পড়ে। স্বাধীন, বস্তুনিষ্ঠ ও দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকদের ওপর হামলা-মামলা ও নির্যাতন চলে। তবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ১৪ মাসের শাসনামলে দল-মত-পত্র-পত্রিকার নীতি অবস্থান নির্বিশেষে যেভাবে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে, তার নজীর সভ্য দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুধু সংখ্যার দিক থেকেই নয়, সাংবাদিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে যে বেপরোয়া নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতম পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে, তা আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দুর্বৃত্তদের পক্ষেই হয়তো সম্ভব। হাতুড়িপেটা করে সাংবাদিকের হাত ভেঙ্গে দেয়া কিংবা মাথা ফাটানো, শরীর থেতলে দিয়ে সাংবাদিককে মৃতপ্রায় অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য করার যে সিলসিলা সরকারের প্রশ্রয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ তাদের অন্যান্য সংগঠনের ক্যাডাররা যেভাবে স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠু সাংবাদিকতার ধারা রুদ্ধ করতে হিংস্র ও মারমুখী আচরণ করতে শুরু করেছে, তাতে দেশকে আবারও অঘোষিত বাকশালের একদলীয় অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নেবার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এমনিই বলা হয়ে থাকে যে, আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যগতভাবে ফ্যাসিবাদী এবং রাজনৈতিকভাবে তারা বহুদলীয় গণতন্ত্র, মুক্ত ও স্বাধীন সাংবাদিকতার সাথে সহাবস্থান করতে পারে না। বিগত ২৯ ডিসেম্বরের ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন পরিচালিত পাতানো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে সরকার গঠন করার পর ক্ষমতা দলীয়করণের হিংস্রতা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সংসদে ও সংসদের বাইরে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিদের ভিন্নমত দলনের রাজনৈতিক কদাচার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ থেকে দলের সর্বত্র তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সাবেক কেয়ারটেকার সরকারের আমলে দায়ের করা রাজনৈতিক নেতাদের মামলাগুলোকে সরকার বাছাই করে নিজ দলের নেতা-নেত্রীদের শত শত মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিরোধী দলীয় নেত্রীসহ তাদের অন্যান্য নেতার মামলা বহাল রাখাই শুধু নয়, তাদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক নতুন নতুন মামলা দায়ের করা হচ্ছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৬০ হাজারের বেশি মামলা দিয়েছিল। বিরোধীদলের প্রতি সরকারের দমন-পীড়ন এবং ফ্যাসিবাদী আচরণের সূত্রেই ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ শাসকদলের ক্যাডাররা রাষ্ট্র-সরকারের আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে নিজেরাই এক একজন ক্ষুদে প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসেছেন। এই পটভূমিতেই দেশব্যাপী ছাত্রলীগের ক্যাডাররা সন্ত্রাস ও অপরাধে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। হল ও ক্যাম্পাস থেকে প্রতিপক্ষের ছাত্র সংগঠনকে বহিষ্কার করে ক্যাম্পাস ও হল দখলের নজীরবিহীন সন্ত্রাসে ছাত্রলীগকে সরকারি দলের শীর্ষ নেতারা আস্কারা দিয়ে এসেছেন। একই সাথে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের খয়ের খাঁ ধাঁচের অধ্যক্ষ ও ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ করার ফলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ছাত্র নিপীড়ন ও ভর্তি বাণিজ্যের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক অভিভাবকত্ব থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখার ঘোষণা এবং মৃদু ভৎর্সনা ছাত্রলীগের ক্যাডারদের অপরাধবৃত্তি থেকে বিরত রাখতে পারেনি। এই বেপরোয়া ও দুরন্ত ‘সোনার ছেলেদের' হাতেই সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বেশি। তবে এদের পেছনে সরকারি দলের কোনো কোনো দুর্নীতিবাজ নেতা, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় এমপিদের ইন্ধন থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সরকারের দমন-পীড়ন ও ফ্যাসিবাদী আচরণ থেকে সরকারি দলের ক্যাডারদের সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। শুধু সরকারি দলের রাজনৈতিক ক্যাডারই নয়, পুলিশ ও র্যা বের দ্বারাও সরাসরি নির্যাতিত ও প্রহৃত হচ্ছেন সাংবাদিকরা। সাংবাদিকরা নির্যাতিত হয়ে বা হত্যার হুমকি পেয়ে থানায় মামলা করতে গিয়েও অনেক সময় পুলিশ মামলা নেয় না। অন্যদিকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে শাসক দলের দায়ের করা মামলা গ্রহণ ও সমন জারির ব্যাপারে থানা ও আদালতের উৎসাহের অন্ত নেই। দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী, তার পুত্র ও প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টার বিরুদ্ধে আমেরিকান একটি তেল কোম্পানির সাথে চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট প্রকাশের দায়ে ঐ পত্রিকার সম্পাদক-রিপোর্টারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ২৭টি মামলা করা হয়েছে। সরকারি দলের দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে ঐ পত্রিকার সম্পাদককে প্রতিহত করার প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়ার পর তার ও রিপোর্টারের জীবননাশের লক্ষ্যে হামলা হয়েছে। এমনকি ঐ সম্পাদককে লন্ডনেও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে।
এদিকে এ পর্যন্ত সরকারি দলের ক্যাডারদের সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন সারাদেশে দু' ডজন মফস্বল সাংবাদিক। এর মধ্যে সরকারি ঘরানার পত্রিকার রিপোর্টারও রয়েছেন। রয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরাও। গত রোববারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রলীগের এক নেতার নেতৃত্বে তার ক্যাডাররা দু'জন সাংবাদিককে প্রহার করে গুরুতর জখম করেছে। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। আশঙ্কা ও লজ্জার কথা, শাহবাগ থানার পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগের ক্যাডাররা ঐ দুই সাংবাদিককে নির্যাতন করেছে। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল সভাপতির ওপর যখন ছাত্রলীগ ক্যাডাররা হামলা চালিয়েছিল, তখনও পুলিশ কোনো অ্যাকশন নেয়নি। থানা ও পুলিশ প্রশাসনকে সরকারের রাজনৈতিক পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বিধায় ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তপনা ও সন্ত্রাস নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। দেশব্যাপী সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিবাদে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে নির্যাতন বিরোধী মহাসমাবেশ থেকে আগত নির্যাতিত ও কর্মরত সাংবাদিকদের প্রায় দু'হাজার প্রতিনিধি সরকারের প্রতি সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। ১৫ জুনের মধ্যে সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিকার না হলে তারা ১৬ জুন সংবাদপত্র নিষিদ্ধকরণের কালো দিবসে নয়া কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। তবে সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বদলে প্রত্যাঘাতেরও চিন্তা করা হচ্ছে। বলা হয়েছে, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে একটা মামলা হলে মামলাকারীর বিরুদ্ধে ১০টি মামলা দিয়ে তার প্রতিশোধ নেয়া হবে। বিরুদ্ধ মতের সাংবাদিক এবং শাসকদলের অপছন্দের রিপোর্ট প্রকাশের জন্য ক্রুদ্ধ হয়ে সাংবাদিকদের হাতুড়িপেটা করে পঙ্গু করে দেয়ার বর্বর আচরণের বিরুদ্ধে শুধু সাংবাদিকদেরই নয়, গণতান্ত্রিক সমাজেরও সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত এবং সাংবাদিকরা হচ্ছেন জনমতের বাহন। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দানে যে সরকার উদাসীন কিংবা ব্যর্থ, সেই সরকারের ক্ষমতায় থাকার অর্থ হচ্ছে, গণতন্ত্রের কবর রচনার সুযোগ দেয়া। দেখা যাচ্ছে, সরকারি পেটোয়া বাহিনীর হাতে সাংবাদিক নির্যাতনের ব্যাপারে সরকারি ঘরানার সম্পাদক-সাংবাদিকরা প্রতিবাদে শামিল হতে অনিচ্ছুক। এদিকে সরকার ‘অসত্য' ও ‘অপছন্দনী'য় খবর প্রকাশের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপের পাঁয়তারা করছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের জন্য এটাই স্বাভাবিক। তবে এ অবস্থা চলতে থাকলে সরকারের পক্ষে যারা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা বর্জন করে তথ্য-সন্ত্রাস ও চরিত্র হননের গল্প রচনা করছে, তারাও জনরোষের শিকার হবেন। সাংবাদিকতার বস্তুনিষ্ঠতা ও দলনিরপেক্ষ ভূমিকা এবং পেশাগত অবস্থান থেকে নির্যাতনের বিরুদ্ধে সকলের সম্মিলিত প্রতিরোধই কেবল সরকারকে নির্বৃত্ত করতে পারে।

Saturday, 10 April 2010

প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভালো কিছু আশাই করা যায় না?

প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভালো কিছু আশাই করা যায় না?
আওয়ামী লীগের ইতিহাস যাদের জানা নেই তাদের অনেকে এখনো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকারকে নিয়ে আশায় দিন কাটাচ্ছেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী কিন্তু তার স্বভাবের বাইরে এক পা-ও এগোননি। এ ব্যাপারে সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া গেছে জাতীয় সংসদে দেয়া ৪ এপ্রিলের ভাষণে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার গুণগত কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ‘নির্বাচিত' প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উচিত যেখানে ছিল নমনীয় ও সংযমী হওয়া, শেখ হাসিনা সেখানে মেঠো বক্তৃতার ঢঙে এবং পুরনো ধারাতেই আক্রমণ শাণিয়েছেন। চারদলীয় জোট সরকারের তথাকথিত দুর্নীতি ও লুটপাটের কাহিনী শুনিয়েছেন তিনি, প্রকৃতপক্ষে পুনরাবৃত্তি করেছেন। মাঝখানে তত্ত্বাবধায়ক নামের অন্য একটি সরকারও যে দু' বছর ধরে জাতির ওপর ‘ছড়ি' ঘুরিয়ে গেছে- তার উল্লেখই ছিল না প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায়। ফলে মনে হয়নি যে, বিরোধী দলের সঙ্গে সুস্থ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার, গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটানোর এবং নানামুখী সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তার নিজের এবং আওয়ামী লীগ সরকারের তেমন আগ্রহ রয়েছে। সে কারণে জনমনেও আস্থা তৈরি করতে পারেননি তিনি। তাছাড়া ক্ষমতায় আসার এক বছর তিন মাস পরও কেবলই জোট সরকারকে ধরে টানাটানি করায় জনগণ বরং বুঝে নিয়েছে, নানামুখী সমস্যার সমাধানে তার সরকার নিশ্চয়ই সফল হতে পারছে না। পারলে নিজেদের কৃতিত্বের ব্যাপারেই উচ্চকণ্ঠে জানান দিতেন প্রধানমন্ত্রী।
সেদিনের সংসদে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী থেকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য পর্যন্ত সকলের বেতন দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাহার করার দাবি জানানো হয়েছিল। বিরোধী দলের চিফ হুইপ বলেছিলেন, আগে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করুন। জবাবে শেখ হাসিনা বলে বসেছেন, এটা নাকি বিরোধী দলের ‘স্টান্টবাজি'! কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিরোধী দলের সদস্যরা তো পাঁচ বছর চুরি করেছেন। ছেঁড়া গেঞ্জি আর ভাঙা সুটকেস থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে এসেছে। তাদের তাই বেতন-ভাতার দরকার হয় না। কিন্তু সরকারি দলের সদস্যরা বেতন-ভাতার টাকায় চলেন (!)।- কথাটা আদৌ ঠিক কি না, সে প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে শেখ হাসিনা আরো বলেছেন, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস থেকে বিদ্যুৎ আর গ্যাসের সংকটও তারাই (বিরোধী দল) সৃষ্টি করে গেছেন।
শেখ হাসিনা অবশ্য অকারণে এতটা উত্তেজিত হননি। জাতীয় সংসদের সেদিনের অধিবেশনে বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, দেশে কোনো সরকার আছে বলে মনে হয় না। ব্যর্থ, অযোগ্য সরকার দিয়ে দেশ চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ মানেই দুর্ভিক্ষ। পিলখানা হত্যাকান্ডের প্রসঙ্গ টেনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিডিআরের ডিজি সেদিন তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য সেনাপ্রধানের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু সে আবেদনে কান না দিয়ে সেনাপ্রধান প্রধানমন্ত্রীর দফতরে গিয়ে বসে ছিলেন। অথচ আলাপ-আলোচনা করে এসব সমস্যার সমাধান হয় না। আমরা হলে আধাঘণ্টার মধ্যে সমাধান হতো। ৫৭ জন সেনা অফিসার বেঁচে যেতেন। প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমদ ও সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের বিচার দাবি করে খালেদা জিয়া বলেছেন, দুই বছরে তারাই সমস্যার পাহাড় তৈরি করে গেছেন। সরকারি দলের অনেক সদস্যও তাদের ওপর নির্যাতনের কথা বলেছেন। কিন্তু তারপরও কেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে না? খালেদা জিয়া জানতে চেয়েছেন, এত ভয় কিসের? ওই সরকারের সঙ্গে অাঁতাত করে ক্ষমতায় আসার অভিযোগ তুলে খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিতে পারে'- এ ভয়েই কি সরকার তাদের সঙ্গে আপস করে চলেছে?
বিরোধী নেত্রীর এসব কথা শুনেই তেড়ে উঠেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পিলখানা হত্যাকান্ড প্রসঙ্গে তিনি প্রশ্ন করেছেন, একটি কালো গ্লাসের গাড়িতে করে খালেদা জিয়া ওই সময় কোথায় গিয়েছিলেন? তিনদিন কোথায় ছিলেন? দেড় মাস কেন তিনি ক্যান্টনমেন্টের বাসায় ছিলেন না? তিনি তখন কোথায় কি করছিলেন এবং কি ষড়যন্ত্র করতে চেয়েছিলেন তার জবাব দিতে হবে। শেখ হাসিনা আরো বলেছেন, তার (খালেদা জিয়ার) কথা শুনে মনে হচ্ছে, ৭২টি লাশেও তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। নিজে ‘সেফ সাইডে' চলে গিয়ে তিনি লাশের স্তূপ দেখতে চেয়েছিলেন। ঘটনার পর আমরা সব দলের (?) সঙ্গে আলোচনা করে বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তখন তাকে (খালেদা জিয়াকে) খুঁজেও পাওয়া যায়নি (!)। ‘উদ্দিন' সাহেবদের বিচারের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মইন-ফখরুদ্দিনরা তো বিএনপিরই ‘সৃষ্টি'! বিরোধীদলের নেত্রী চাইলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। সরকার কোনো ‘ইন্টারফেয়ার' করবে না।
অন্য কিছু প্রসঙ্গেও টিপ্পনি কেটে ও খোঁচা মেরে কথা শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু জনগণের মধ্যে বেশি আলোচিত হয়েছে পিলখানা হত্যাকান্ড সম্পর্কিত খোঁচাটুকু। এবারই প্রথম নয়, এর আগেও প্রধানমন্ত্রী একই ধরনের কথা শুনিয়েছেন, খোঁচাও মেরেছেন। যেমন পিলখানা হত্যাকান্ডের পর পর, গত বছরের ১ মার্চের অধিবেশনেও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে তেড়ে উঠেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেদিনের বক্তৃতায় খালেদা জিয়া জানতে চেয়েছিলেন, সাড়ে ১১টার মধ্যে সব হত্যাকান্ড ঘটলেও দেড়টায় কেন বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী? বিরোধী দলকে কেন ডাকা হয়নি- সে কথাও জানতে চেয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েই মারমুখী হয়ে উঠেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। হত্যাকান্ডে বিরোধী দলের ‘রাজনৈতিক ইন্ধন' ছিল বলে গুরুতর অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘মিউটিনি' ঘটাতে সফল হতে পারেনি বলেই তাদের ‘অন্তর্জ্বালা'! এই ঘটনার সূত্র ধরে ‘অন্য কিছু' হয়নি বলেই বিরোধী দল ‘মনের দুঃখে' অন্যের দোষ খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছে! শেখ হাসিনা আরো বলেছিলেন, সেনাবাহিনীকে নিয়ে যারা বারবার খেলেছে সেই ‘খেলনেওয়ালারা'ই এবারও ‘খেলে' গেছে! বিরোধী দলকে কেন ডাকা হয়নি- এই অভিযোগের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এটা আমার ছেলে বা মেয়ের বিয়ে ছিল না যে, কাউকে ‘দাওয়াত' দিতে হবে! যারা দেশকে ভালোবাসেন তারা নাকি ‘মনের টানেই' ছুটে গিয়েছিলেন!
‘খেলনেওয়ালা' বলতে প্রধানমন্ত্রী ঠিক কাদের বুঝিয়েছিলেন, সে কথা বুঝতে কারো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এ ধরনের আক্রমণাত্মক বক্তৃতা মানুষকে নিরাশ করেছিল। কারণ, জাতির সেই দুঃসময়ে দরকার ছিল সমঝোতা ও জাতীয় ঐকমত্যের। ছেলে-মেয়ের বিয়েতে ‘দাওয়াত' দেয়ার কথা বলেও প্রধানমন্ত্রী জনগণকে স্তম্ভিত করেছিলেন। জনগণের সচেতন অংশের তখন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার কারগিল যুদ্ধের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। কারণ, সে সময় ভারতের সকল রাজনৈতিক দলের নেতারা এক সঙ্গে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। উপলক্ষ অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর ছেলে বা মেয়ের বিয়ে ছিল না (বাজপেয়ী বিয়ে-শাদিই করেননি!)। দেশের দুঃসময়ে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী সরকারের সমর্থনে দাঁড়ানোর আহবান জানিয়েছিলেন। নেতারাও এগিয়ে গিয়েছিলেন স্বতঃস্ফুর্তভাবে। বিডিআরের বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনাও একটি নজীর তৈরি করতে পারতেন। অন্যদিকে যথারীতি তিনি বাঁকা পথ ধরে হেঁটেছেন। ‘মনের টানে' ছুটে যাওয়ার কথা বলে খোঁচা দিলেও বিরোধী দলকে শেখ হাসিনা ‘খেলনেওয়ালা' বানিয়ে ছেড়েছিলেন। সুতরাং যেতে চাইলেও খালেদা জিয়াদের জন্য ‘ছুটে' যাওয়ার মতো কোনো জায়গাই তখন ছিল না।
উল্লেখ্য, জেনারেল (অব.) এরশাদ ছাড়াও একাধিক সাবেক সেনাপ্রধানসহ সামরিক বিশেষজ্ঞরা সে সময় বলেছিলেন, আলোচনার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী যদি সেনাবাহিনীকে অভিযান চালাতে দিতেন তাহলে কথিত বিদ্রোহীরা ১০ মিনিটও দাঁড়াতে পারতো না। এতগুলো জীবনও যেতো না। ঢাকা থেকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সাহায্যের জন্য বার্তা যাওয়া, জবাবে তাৎক্ষণিক সাড়া চলে আসা, ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্যারাস্যুট রেজিমেন্টকে রাতারাতি বাংলাদেশের সীমান্তে নিয়ে আসা, কলকাতা ও গৌহাটি বিমান বন্দরে যুদ্ধ বিমান প্রস্তুত অবস্থায় থাকা এবং ভারতীয় প্রচার মাধ্যমের বাড়াবাড়ির মতো কিছু তথ্যও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন পর্যবেক্ষকরা। হত্যাকান্ডের দু'দিন পর এদেশের কোনো এক বিশিষ্টজনের ‘সুপুত্র'কে যে দুবাই বিমান বন্দরে (মার্কিন ডলারে ভরা) খাম বিতরণ করতে দেখা গিয়েছিল সে কথাও অনেকের মনে পড়ে গেছে। সবচেয়ে বড়কথা, সত্যিই ‘খেলনেওয়ালা' হলে বিএনপি-জামায়াতকে অন্তত ‘ডিজিটাল' নির্বাচনের একটি মাত্র ধাক্কাতেই কুপোকাত হয়ে পড়তে হতো না!
মানুষ নিরাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব দেখে। এত বড় একটি হত্যাকান্ড নিয়েও সরকার আজ পর্যন্ত সংসদে কেন মুক্ত বিতর্কের আয়োজন করেনি- সে প্রশ্নও নতুন করে নাড়া দিয়েছে মানুষকে। অন্য কিছু বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী মানুষকে স্তম্ভিত করেছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে ‘উদ্দিন' সাহেবদের বিচারের প্রশ্ন। আসল কারণ বুঝতে অবশ্য সাধারণ মানুষের অসুবিধা হয়নি। ৪ এপ্রিলের ভাষণে ‘উদ্দিন' সাহেবদের বিচার দাবি করে খালেদা জিয়া জানতে চেয়েছিলেন, এত ভয় কিসের? ‘হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিতে পারে' বলেই কি সরকার তাদের সঙ্গে আপস করে চলেছে? ‘হাঁড়ি'র ভেতরে কি আছে সে সম্পর্কেও জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। বলেছেন, ওই সরকারের সঙ্গে অাঁতাত করেই ক্ষমতায় এসেছেন শেখ হাসিনা। শুনে একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতে দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রীকে। বক্তব্যের প্রথম অংশে তিনি ‘উদ্দিন' সাহেবদের বিএনপির ‘সৃষ্টি' বানিয়ে ছেড়েছেন। দ্বিতীয় অংশে বোঝাতে চেয়েছেন যেন তারাও ‘উদ্দিন' সাহেবদের বিচার চান! এ নিয়ে কথা বাড়ানোর আগে জানানো দরকার, ‘সৃষ্টি' বিষয়ক তত্ত্বটি শেখ হাসিনার এক লেটেস্ট ঢেঁকুড়। গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি প্রথমবারের মতো বলেছিলেন, জোট সরকারই ‘ষড়যন্ত্র' করে ১/১১ ঘটিয়েছিল! সেই থেকে উপলক্ষ পেলেই তিনি এ ঢেঁকুড়টিও উগলে দিয়ে চলেছেন। অথচ শুরু থেকে বেশি আলোচিত হওয়ায় কিশোর-কিশোরীরা পর্যন্ত জেনে বসে আছে, ‘উদ্দিন' সাহেবদের শেখ হাসিনারাই নিয়ে এসেছিলেন। নিয়ে আসার কারণও পরিষ্কারই ছিল : জোট সরকারের পাঁচ বছরে বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা কোনো ব্যাপারেই জাতির স্বার্থে সামান্য অবদান রাখতে পারেননি। নিজেদের এবং ‘বন্ধুরাষ্ট্রের' গোয়েন্দা সংস্থার জরিপেও দেখা গিয়েছিল, আওয়ামী লীগ অন্তত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারবে না। হতাশ হয়ে পড়া আওয়ামী লীগ তাই ‘নাচুনে বুড়ির' মতো ‘ঢোলের বাড়িতে' সাড়া দিয়েছিল। শুরু হয়েছিল লগি-বৈঠার তান্ডব, যা শেষ পর্যন্ত ১/১১-কে অনিবার্য করেছিল। শেখ হাসিনা নিজেও এ ব্যাপারে বুক ফুলিয়েই জানান দিয়েছেন। বলেছেন, ওই সরকার তাদেরই ‘আন্দোলনের ফসল!' সুতরাং এতদিন পর হঠাৎ করে ঢেঁকুড় তুললেও কোনো লাভ নেই। মানুষ যা জানার তা জেনে গেছে!
বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশ প্রসঙ্গেও বেশি বলার প্রয়োজন পড়ে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিশেষ করে প্রধান ‘উদ্দিন' মইন উ'র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি উঠেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী খুবই তাৎপর্যপূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করে এসেছেন। এরও কারণ বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারো। আসলেও খালেদা জিয়ার অভিযোগই সঠিক : অাঁতাত করেই ক্ষমতায় এসেছেন শেখ হাসিনা। ওই দিনগুলোতে মইন উ সব সময় শেখ হাসিনার দিকেই ঝুঁকে থেকেছেন। বিষয়টি জানাজানি হয়েছিল খালেদা জিয়া দেশ ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানানোর পর। মইন উ তখনই শেখ হাসিনার দিকে মৈত্রীর হাত বাড়িয়েছিলেন। ২০০৮ সালের মধ্য-মার্চে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে তার একটি ‘ডিল' বা সমঝোতা হয়েছিল। ‘ডিল' হওয়ার পর মইন উ সকল সেনা অফিসারকে আওয়ামী লীগের আর কোনো নেতার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নিয়ে অগ্রসর না হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মইন উ'র নির্দেশে ডিজিএফআই-এর দুই ডিজি মেজর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ও মেজর জেনারেল এটিএম আমিন ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার সকল বিষয়ে দেখাশোনা করেছেন। এটিএম আমিন নেত্রীর জন্য নিজেই খাবার নিয়ে গেছেন। তাকে টাঙ্গাইল শাড়ি উপহার দিয়েছেন। ঘটনাপ্রবাহের সে পর্যায়েই মেজর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদকে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক ও সাবেক আমলা এইচ টি ইমামের সঙ্গে দিনের পর দিন গোপন বৈঠকে অংশ নিতে এবং গভীরভাবে মেলামেশা করতে দেখা গেছে। এসবের পুরস্কারও পেয়েছেন এইচ টি ইমামসহ পাঁচজন সাবেক আমলা। তারা এখন শেখ হাসিনার উপদেষ্টা।
‘ডিল' হওয়ার পর খোলামেলাভাবেই আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখানো শুরু হয়েছিল। এ ব্যাপারে ডিজিএফআই-এর একজন সাবেক উচ্চপদস্থ অফিসার বলেছেন, ‘‘আমি চিফকে (মইন উ'কে) জিজ্ঞেস করলাম, ‘এসব কি হচ্ছে?' উত্তরে অনেকটা দার্শনিকের মতো তিনি বললেন, ‘যুদ্ধের মাঠে তোমরা কি পশ্চাদপসরণ এবং গ্রুপ পুনর্গঠন করো না? এটা ঠিক সেরকমই।’’ এর পেছনে মইন উ'র যে ইচ্ছা ও পরিকল্পনা ছিল তাও ফাঁস করে দিয়েছেন ওই অফিসার। ডিজিএফআই-এর ক্ষমতাধর অন্য দু'চারজন অফিসারও আওয়ামী লীগের সঙ্গে মইন উ'র ‘ডিল'-এর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এখানে অন্য একটি বিশেষ তথ্যেরও উল্লেখ করা দরকার। ‘নির্বাচিত' প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে এসে জানিয়েছেন, তার কাছে ‘মনোনীত' প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। জুলুমবাজির ওই বছর দুটিতে মইন উ ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এ ধরনের প্রস্তাব পাঠানো সম্ভব ছিল কি না, তা যে কেউ ভেবে দেখতে পারেন।
প্রসঙ্গক্রমে আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের একটি ‘মহাজনী' মন্তব্যও স্মরণ করা যেতে পারে। জাতীয় সংসদের ভাষণে অনেকটা গোপন তথ্য ‘ফাঁস' করে দেয়ার ঢঙে এরশাদ বলেছেন, সেনাবাহিনী ‘সহযোগিতা না করলে' আওয়ামী লীগের পক্ষে ‘জীবনেও' ক্ষমতায় আসা সম্ভব হতো না। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের কিছু কথাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। গত বছরের ২১ এপ্রিল সাংবাদিকদের কাছে আবদুল জলিল বলেছিলেন, ওয়ান-ইলেভেনে ডিজিএফআই-এর দালালি করে যারা সুবিধা নিয়েছিল, তারাই এখনো সুবিধা নিচ্ছে। বর্তমান মন্ত্রিসভার অনেকেই ডিজিএফআই-এর ‘পেইড এজেন্ট'। মন্ত্রীদের নাম না বললেও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের প্রতি ইঙ্গিত করে আবদুল জলিল বলেছিলেন, প্রথমে পালিয়ে লন্ডন চলে যাওয়ার পর কোন নিশ্চয়তা পেয়ে তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন তা কি দেশের মানুষ জানে না?
অর্থাৎ খালেদা জিয়া অযথা অভিযোগ করেননি। সুনির্দিষ্ট ‘ডিল'-এর ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। বিনিময়ে আওয়ামী লীগও ‘ঋণ' পরিশোধ করে চলেছে। এই সরকারের পক্ষে তাই মইন উ'কে অন্তত শাস্তি দেয়া সম্ভব নয়। ‘ডিল'-এর মধ্যে এটাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। একই কারণে মইন উ'র প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম থেকে ‘বন্ধুসলভ' অবস্থান নিয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিভিন্ন উপলক্ষে বলেছেন, মইন উ'কে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর পরিকল্পনা সরকারের নেই। সরকার মইন উ'কে রাষ্ট্রদূত বা জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি করেও পাঠাতে পারে। শুধু মইন উ কেন, সৈয়দ আশরাফুল সাফ জানিয়ে রেখেছেন : ওই সরকারের কারো বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে না। সুতরাং ‘পার' পেয়ে যাচ্ছেন মইন উ। ‘পার' পেয়ে যাবেনও তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর জবাবে বিস্মিত হওয়ার এটাই অবশ্য একমাত্র কারণ নয়। অন্য একটি কারণ হিসেবে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এমপি'র মামলা দায়েরের চেষ্টার তথ্য স্মরণ করা যেতে পারে। শেখ হাসিনাকে তিনি বোন মনে করেন। সে কারণে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে স্লো পয়জনিং-এর খবর জানার পর তিনি মইন উ'দের বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক কোন পর্যায়ের নির্দেশে তার মামলাটি আদালত আমলে নেয়নি সেকথা নিশ্চয়ই উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। ‘ডিল'-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত তো ছিলই, তাছাড়া মইন উ'র ‘খুঁটির জোর'ও অনেক। ওই ‘খুঁটি'ও আবার কোনো এক দেশের রাজধানীতে ‘পোঁতা' রয়েছে! সুতরাং মইন উ'র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রশ্ন উঠতে পারে না। খালেদা জিয়া চেষ্টা করে দেখতে পারেন। শেষ পর্যন্ত কি হবে তা জানা আছে বলেই প্রধানমন্ত্রী ‘ইন্টারফেয়ার' না করার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু রসিকতা করতে চাইলেও শেখ হাসিনা লক্ষ্য করেননি যে, এর মধ্য দিয়ে সাকা চৌধুরীরটাসহ বিচার বিভাগের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপের বিষয়টিই পরিষ্কার হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘ইন্টারফেয়ার' করেন বলেই ‘ইন্টারফেয়ার' না করার ঘোষণাটা মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে তার! এভাবে সব মিলিয়েই প্রধানমন্ত্রী আরো একবার বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘ডিজিটাল' নির্বাচনের ধাক্কায় ‘দিন বদল' হলেও তার নিজের স্বভাবে অন্তত ‘বদল' হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। জনগণেরও তাই প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে ভালো কিছু আশা করা উচিত নয়। -আহমদ আশিকুল হামিদ
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter