Flickr

Saturday, 10 April 2010

প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভালো কিছু আশাই করা যায় না?

Posted by   on

প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভালো কিছু আশাই করা যায় না?
আওয়ামী লীগের ইতিহাস যাদের জানা নেই তাদের অনেকে এখনো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকারকে নিয়ে আশায় দিন কাটাচ্ছেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী কিন্তু তার স্বভাবের বাইরে এক পা-ও এগোননি। এ ব্যাপারে সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া গেছে জাতীয় সংসদে দেয়া ৪ এপ্রিলের ভাষণে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার গুণগত কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ‘নির্বাচিত' প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উচিত যেখানে ছিল নমনীয় ও সংযমী হওয়া, শেখ হাসিনা সেখানে মেঠো বক্তৃতার ঢঙে এবং পুরনো ধারাতেই আক্রমণ শাণিয়েছেন। চারদলীয় জোট সরকারের তথাকথিত দুর্নীতি ও লুটপাটের কাহিনী শুনিয়েছেন তিনি, প্রকৃতপক্ষে পুনরাবৃত্তি করেছেন। মাঝখানে তত্ত্বাবধায়ক নামের অন্য একটি সরকারও যে দু' বছর ধরে জাতির ওপর ‘ছড়ি' ঘুরিয়ে গেছে- তার উল্লেখই ছিল না প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায়। ফলে মনে হয়নি যে, বিরোধী দলের সঙ্গে সুস্থ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার, গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটানোর এবং নানামুখী সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তার নিজের এবং আওয়ামী লীগ সরকারের তেমন আগ্রহ রয়েছে। সে কারণে জনমনেও আস্থা তৈরি করতে পারেননি তিনি। তাছাড়া ক্ষমতায় আসার এক বছর তিন মাস পরও কেবলই জোট সরকারকে ধরে টানাটানি করায় জনগণ বরং বুঝে নিয়েছে, নানামুখী সমস্যার সমাধানে তার সরকার নিশ্চয়ই সফল হতে পারছে না। পারলে নিজেদের কৃতিত্বের ব্যাপারেই উচ্চকণ্ঠে জানান দিতেন প্রধানমন্ত্রী।
সেদিনের সংসদে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী থেকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য পর্যন্ত সকলের বেতন দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাহার করার দাবি জানানো হয়েছিল। বিরোধী দলের চিফ হুইপ বলেছিলেন, আগে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করুন। জবাবে শেখ হাসিনা বলে বসেছেন, এটা নাকি বিরোধী দলের ‘স্টান্টবাজি'! কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিরোধী দলের সদস্যরা তো পাঁচ বছর চুরি করেছেন। ছেঁড়া গেঞ্জি আর ভাঙা সুটকেস থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে এসেছে। তাদের তাই বেতন-ভাতার দরকার হয় না। কিন্তু সরকারি দলের সদস্যরা বেতন-ভাতার টাকায় চলেন (!)।- কথাটা আদৌ ঠিক কি না, সে প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে শেখ হাসিনা আরো বলেছেন, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস থেকে বিদ্যুৎ আর গ্যাসের সংকটও তারাই (বিরোধী দল) সৃষ্টি করে গেছেন।
শেখ হাসিনা অবশ্য অকারণে এতটা উত্তেজিত হননি। জাতীয় সংসদের সেদিনের অধিবেশনে বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, দেশে কোনো সরকার আছে বলে মনে হয় না। ব্যর্থ, অযোগ্য সরকার দিয়ে দেশ চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ মানেই দুর্ভিক্ষ। পিলখানা হত্যাকান্ডের প্রসঙ্গ টেনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিডিআরের ডিজি সেদিন তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য সেনাপ্রধানের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু সে আবেদনে কান না দিয়ে সেনাপ্রধান প্রধানমন্ত্রীর দফতরে গিয়ে বসে ছিলেন। অথচ আলাপ-আলোচনা করে এসব সমস্যার সমাধান হয় না। আমরা হলে আধাঘণ্টার মধ্যে সমাধান হতো। ৫৭ জন সেনা অফিসার বেঁচে যেতেন। প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমদ ও সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের বিচার দাবি করে খালেদা জিয়া বলেছেন, দুই বছরে তারাই সমস্যার পাহাড় তৈরি করে গেছেন। সরকারি দলের অনেক সদস্যও তাদের ওপর নির্যাতনের কথা বলেছেন। কিন্তু তারপরও কেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে না? খালেদা জিয়া জানতে চেয়েছেন, এত ভয় কিসের? ওই সরকারের সঙ্গে অাঁতাত করে ক্ষমতায় আসার অভিযোগ তুলে খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিতে পারে'- এ ভয়েই কি সরকার তাদের সঙ্গে আপস করে চলেছে?
বিরোধী নেত্রীর এসব কথা শুনেই তেড়ে উঠেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পিলখানা হত্যাকান্ড প্রসঙ্গে তিনি প্রশ্ন করেছেন, একটি কালো গ্লাসের গাড়িতে করে খালেদা জিয়া ওই সময় কোথায় গিয়েছিলেন? তিনদিন কোথায় ছিলেন? দেড় মাস কেন তিনি ক্যান্টনমেন্টের বাসায় ছিলেন না? তিনি তখন কোথায় কি করছিলেন এবং কি ষড়যন্ত্র করতে চেয়েছিলেন তার জবাব দিতে হবে। শেখ হাসিনা আরো বলেছেন, তার (খালেদা জিয়ার) কথা শুনে মনে হচ্ছে, ৭২টি লাশেও তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। নিজে ‘সেফ সাইডে' চলে গিয়ে তিনি লাশের স্তূপ দেখতে চেয়েছিলেন। ঘটনার পর আমরা সব দলের (?) সঙ্গে আলোচনা করে বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তখন তাকে (খালেদা জিয়াকে) খুঁজেও পাওয়া যায়নি (!)। ‘উদ্দিন' সাহেবদের বিচারের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মইন-ফখরুদ্দিনরা তো বিএনপিরই ‘সৃষ্টি'! বিরোধীদলের নেত্রী চাইলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। সরকার কোনো ‘ইন্টারফেয়ার' করবে না।
অন্য কিছু প্রসঙ্গেও টিপ্পনি কেটে ও খোঁচা মেরে কথা শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু জনগণের মধ্যে বেশি আলোচিত হয়েছে পিলখানা হত্যাকান্ড সম্পর্কিত খোঁচাটুকু। এবারই প্রথম নয়, এর আগেও প্রধানমন্ত্রী একই ধরনের কথা শুনিয়েছেন, খোঁচাও মেরেছেন। যেমন পিলখানা হত্যাকান্ডের পর পর, গত বছরের ১ মার্চের অধিবেশনেও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে তেড়ে উঠেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেদিনের বক্তৃতায় খালেদা জিয়া জানতে চেয়েছিলেন, সাড়ে ১১টার মধ্যে সব হত্যাকান্ড ঘটলেও দেড়টায় কেন বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী? বিরোধী দলকে কেন ডাকা হয়নি- সে কথাও জানতে চেয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েই মারমুখী হয়ে উঠেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। হত্যাকান্ডে বিরোধী দলের ‘রাজনৈতিক ইন্ধন' ছিল বলে গুরুতর অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘মিউটিনি' ঘটাতে সফল হতে পারেনি বলেই তাদের ‘অন্তর্জ্বালা'! এই ঘটনার সূত্র ধরে ‘অন্য কিছু' হয়নি বলেই বিরোধী দল ‘মনের দুঃখে' অন্যের দোষ খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছে! শেখ হাসিনা আরো বলেছিলেন, সেনাবাহিনীকে নিয়ে যারা বারবার খেলেছে সেই ‘খেলনেওয়ালারা'ই এবারও ‘খেলে' গেছে! বিরোধী দলকে কেন ডাকা হয়নি- এই অভিযোগের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এটা আমার ছেলে বা মেয়ের বিয়ে ছিল না যে, কাউকে ‘দাওয়াত' দিতে হবে! যারা দেশকে ভালোবাসেন তারা নাকি ‘মনের টানেই' ছুটে গিয়েছিলেন!
‘খেলনেওয়ালা' বলতে প্রধানমন্ত্রী ঠিক কাদের বুঝিয়েছিলেন, সে কথা বুঝতে কারো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এ ধরনের আক্রমণাত্মক বক্তৃতা মানুষকে নিরাশ করেছিল। কারণ, জাতির সেই দুঃসময়ে দরকার ছিল সমঝোতা ও জাতীয় ঐকমত্যের। ছেলে-মেয়ের বিয়েতে ‘দাওয়াত' দেয়ার কথা বলেও প্রধানমন্ত্রী জনগণকে স্তম্ভিত করেছিলেন। জনগণের সচেতন অংশের তখন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার কারগিল যুদ্ধের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। কারণ, সে সময় ভারতের সকল রাজনৈতিক দলের নেতারা এক সঙ্গে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। উপলক্ষ অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর ছেলে বা মেয়ের বিয়ে ছিল না (বাজপেয়ী বিয়ে-শাদিই করেননি!)। দেশের দুঃসময়ে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী সরকারের সমর্থনে দাঁড়ানোর আহবান জানিয়েছিলেন। নেতারাও এগিয়ে গিয়েছিলেন স্বতঃস্ফুর্তভাবে। বিডিআরের বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনাও একটি নজীর তৈরি করতে পারতেন। অন্যদিকে যথারীতি তিনি বাঁকা পথ ধরে হেঁটেছেন। ‘মনের টানে' ছুটে যাওয়ার কথা বলে খোঁচা দিলেও বিরোধী দলকে শেখ হাসিনা ‘খেলনেওয়ালা' বানিয়ে ছেড়েছিলেন। সুতরাং যেতে চাইলেও খালেদা জিয়াদের জন্য ‘ছুটে' যাওয়ার মতো কোনো জায়গাই তখন ছিল না।
উল্লেখ্য, জেনারেল (অব.) এরশাদ ছাড়াও একাধিক সাবেক সেনাপ্রধানসহ সামরিক বিশেষজ্ঞরা সে সময় বলেছিলেন, আলোচনার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী যদি সেনাবাহিনীকে অভিযান চালাতে দিতেন তাহলে কথিত বিদ্রোহীরা ১০ মিনিটও দাঁড়াতে পারতো না। এতগুলো জীবনও যেতো না। ঢাকা থেকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সাহায্যের জন্য বার্তা যাওয়া, জবাবে তাৎক্ষণিক সাড়া চলে আসা, ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্যারাস্যুট রেজিমেন্টকে রাতারাতি বাংলাদেশের সীমান্তে নিয়ে আসা, কলকাতা ও গৌহাটি বিমান বন্দরে যুদ্ধ বিমান প্রস্তুত অবস্থায় থাকা এবং ভারতীয় প্রচার মাধ্যমের বাড়াবাড়ির মতো কিছু তথ্যও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন পর্যবেক্ষকরা। হত্যাকান্ডের দু'দিন পর এদেশের কোনো এক বিশিষ্টজনের ‘সুপুত্র'কে যে দুবাই বিমান বন্দরে (মার্কিন ডলারে ভরা) খাম বিতরণ করতে দেখা গিয়েছিল সে কথাও অনেকের মনে পড়ে গেছে। সবচেয়ে বড়কথা, সত্যিই ‘খেলনেওয়ালা' হলে বিএনপি-জামায়াতকে অন্তত ‘ডিজিটাল' নির্বাচনের একটি মাত্র ধাক্কাতেই কুপোকাত হয়ে পড়তে হতো না!
মানুষ নিরাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব দেখে। এত বড় একটি হত্যাকান্ড নিয়েও সরকার আজ পর্যন্ত সংসদে কেন মুক্ত বিতর্কের আয়োজন করেনি- সে প্রশ্নও নতুন করে নাড়া দিয়েছে মানুষকে। অন্য কিছু বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী মানুষকে স্তম্ভিত করেছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে ‘উদ্দিন' সাহেবদের বিচারের প্রশ্ন। আসল কারণ বুঝতে অবশ্য সাধারণ মানুষের অসুবিধা হয়নি। ৪ এপ্রিলের ভাষণে ‘উদ্দিন' সাহেবদের বিচার দাবি করে খালেদা জিয়া জানতে চেয়েছিলেন, এত ভয় কিসের? ‘হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিতে পারে' বলেই কি সরকার তাদের সঙ্গে আপস করে চলেছে? ‘হাঁড়ি'র ভেতরে কি আছে সে সম্পর্কেও জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। বলেছেন, ওই সরকারের সঙ্গে অাঁতাত করেই ক্ষমতায় এসেছেন শেখ হাসিনা। শুনে একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতে দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রীকে। বক্তব্যের প্রথম অংশে তিনি ‘উদ্দিন' সাহেবদের বিএনপির ‘সৃষ্টি' বানিয়ে ছেড়েছেন। দ্বিতীয় অংশে বোঝাতে চেয়েছেন যেন তারাও ‘উদ্দিন' সাহেবদের বিচার চান! এ নিয়ে কথা বাড়ানোর আগে জানানো দরকার, ‘সৃষ্টি' বিষয়ক তত্ত্বটি শেখ হাসিনার এক লেটেস্ট ঢেঁকুড়। গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি প্রথমবারের মতো বলেছিলেন, জোট সরকারই ‘ষড়যন্ত্র' করে ১/১১ ঘটিয়েছিল! সেই থেকে উপলক্ষ পেলেই তিনি এ ঢেঁকুড়টিও উগলে দিয়ে চলেছেন। অথচ শুরু থেকে বেশি আলোচিত হওয়ায় কিশোর-কিশোরীরা পর্যন্ত জেনে বসে আছে, ‘উদ্দিন' সাহেবদের শেখ হাসিনারাই নিয়ে এসেছিলেন। নিয়ে আসার কারণও পরিষ্কারই ছিল : জোট সরকারের পাঁচ বছরে বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা কোনো ব্যাপারেই জাতির স্বার্থে সামান্য অবদান রাখতে পারেননি। নিজেদের এবং ‘বন্ধুরাষ্ট্রের' গোয়েন্দা সংস্থার জরিপেও দেখা গিয়েছিল, আওয়ামী লীগ অন্তত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারবে না। হতাশ হয়ে পড়া আওয়ামী লীগ তাই ‘নাচুনে বুড়ির' মতো ‘ঢোলের বাড়িতে' সাড়া দিয়েছিল। শুরু হয়েছিল লগি-বৈঠার তান্ডব, যা শেষ পর্যন্ত ১/১১-কে অনিবার্য করেছিল। শেখ হাসিনা নিজেও এ ব্যাপারে বুক ফুলিয়েই জানান দিয়েছেন। বলেছেন, ওই সরকার তাদেরই ‘আন্দোলনের ফসল!' সুতরাং এতদিন পর হঠাৎ করে ঢেঁকুড় তুললেও কোনো লাভ নেই। মানুষ যা জানার তা জেনে গেছে!
বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশ প্রসঙ্গেও বেশি বলার প্রয়োজন পড়ে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিশেষ করে প্রধান ‘উদ্দিন' মইন উ'র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি উঠেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী খুবই তাৎপর্যপূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করে এসেছেন। এরও কারণ বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারো। আসলেও খালেদা জিয়ার অভিযোগই সঠিক : অাঁতাত করেই ক্ষমতায় এসেছেন শেখ হাসিনা। ওই দিনগুলোতে মইন উ সব সময় শেখ হাসিনার দিকেই ঝুঁকে থেকেছেন। বিষয়টি জানাজানি হয়েছিল খালেদা জিয়া দেশ ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানানোর পর। মইন উ তখনই শেখ হাসিনার দিকে মৈত্রীর হাত বাড়িয়েছিলেন। ২০০৮ সালের মধ্য-মার্চে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে তার একটি ‘ডিল' বা সমঝোতা হয়েছিল। ‘ডিল' হওয়ার পর মইন উ সকল সেনা অফিসারকে আওয়ামী লীগের আর কোনো নেতার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নিয়ে অগ্রসর না হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মইন উ'র নির্দেশে ডিজিএফআই-এর দুই ডিজি মেজর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ও মেজর জেনারেল এটিএম আমিন ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার সকল বিষয়ে দেখাশোনা করেছেন। এটিএম আমিন নেত্রীর জন্য নিজেই খাবার নিয়ে গেছেন। তাকে টাঙ্গাইল শাড়ি উপহার দিয়েছেন। ঘটনাপ্রবাহের সে পর্যায়েই মেজর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদকে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক ও সাবেক আমলা এইচ টি ইমামের সঙ্গে দিনের পর দিন গোপন বৈঠকে অংশ নিতে এবং গভীরভাবে মেলামেশা করতে দেখা গেছে। এসবের পুরস্কারও পেয়েছেন এইচ টি ইমামসহ পাঁচজন সাবেক আমলা। তারা এখন শেখ হাসিনার উপদেষ্টা।
‘ডিল' হওয়ার পর খোলামেলাভাবেই আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখানো শুরু হয়েছিল। এ ব্যাপারে ডিজিএফআই-এর একজন সাবেক উচ্চপদস্থ অফিসার বলেছেন, ‘‘আমি চিফকে (মইন উ'কে) জিজ্ঞেস করলাম, ‘এসব কি হচ্ছে?' উত্তরে অনেকটা দার্শনিকের মতো তিনি বললেন, ‘যুদ্ধের মাঠে তোমরা কি পশ্চাদপসরণ এবং গ্রুপ পুনর্গঠন করো না? এটা ঠিক সেরকমই।’’ এর পেছনে মইন উ'র যে ইচ্ছা ও পরিকল্পনা ছিল তাও ফাঁস করে দিয়েছেন ওই অফিসার। ডিজিএফআই-এর ক্ষমতাধর অন্য দু'চারজন অফিসারও আওয়ামী লীগের সঙ্গে মইন উ'র ‘ডিল'-এর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এখানে অন্য একটি বিশেষ তথ্যেরও উল্লেখ করা দরকার। ‘নির্বাচিত' প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে এসে জানিয়েছেন, তার কাছে ‘মনোনীত' প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। জুলুমবাজির ওই বছর দুটিতে মইন উ ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এ ধরনের প্রস্তাব পাঠানো সম্ভব ছিল কি না, তা যে কেউ ভেবে দেখতে পারেন।
প্রসঙ্গক্রমে আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের একটি ‘মহাজনী' মন্তব্যও স্মরণ করা যেতে পারে। জাতীয় সংসদের ভাষণে অনেকটা গোপন তথ্য ‘ফাঁস' করে দেয়ার ঢঙে এরশাদ বলেছেন, সেনাবাহিনী ‘সহযোগিতা না করলে' আওয়ামী লীগের পক্ষে ‘জীবনেও' ক্ষমতায় আসা সম্ভব হতো না। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের কিছু কথাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। গত বছরের ২১ এপ্রিল সাংবাদিকদের কাছে আবদুল জলিল বলেছিলেন, ওয়ান-ইলেভেনে ডিজিএফআই-এর দালালি করে যারা সুবিধা নিয়েছিল, তারাই এখনো সুবিধা নিচ্ছে। বর্তমান মন্ত্রিসভার অনেকেই ডিজিএফআই-এর ‘পেইড এজেন্ট'। মন্ত্রীদের নাম না বললেও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের প্রতি ইঙ্গিত করে আবদুল জলিল বলেছিলেন, প্রথমে পালিয়ে লন্ডন চলে যাওয়ার পর কোন নিশ্চয়তা পেয়ে তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন তা কি দেশের মানুষ জানে না?
অর্থাৎ খালেদা জিয়া অযথা অভিযোগ করেননি। সুনির্দিষ্ট ‘ডিল'-এর ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। বিনিময়ে আওয়ামী লীগও ‘ঋণ' পরিশোধ করে চলেছে। এই সরকারের পক্ষে তাই মইন উ'কে অন্তত শাস্তি দেয়া সম্ভব নয়। ‘ডিল'-এর মধ্যে এটাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। একই কারণে মইন উ'র প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম থেকে ‘বন্ধুসলভ' অবস্থান নিয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিভিন্ন উপলক্ষে বলেছেন, মইন উ'কে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর পরিকল্পনা সরকারের নেই। সরকার মইন উ'কে রাষ্ট্রদূত বা জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি করেও পাঠাতে পারে। শুধু মইন উ কেন, সৈয়দ আশরাফুল সাফ জানিয়ে রেখেছেন : ওই সরকারের কারো বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে না। সুতরাং ‘পার' পেয়ে যাচ্ছেন মইন উ। ‘পার' পেয়ে যাবেনও তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর জবাবে বিস্মিত হওয়ার এটাই অবশ্য একমাত্র কারণ নয়। অন্য একটি কারণ হিসেবে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এমপি'র মামলা দায়েরের চেষ্টার তথ্য স্মরণ করা যেতে পারে। শেখ হাসিনাকে তিনি বোন মনে করেন। সে কারণে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে স্লো পয়জনিং-এর খবর জানার পর তিনি মইন উ'দের বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক কোন পর্যায়ের নির্দেশে তার মামলাটি আদালত আমলে নেয়নি সেকথা নিশ্চয়ই উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। ‘ডিল'-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত তো ছিলই, তাছাড়া মইন উ'র ‘খুঁটির জোর'ও অনেক। ওই ‘খুঁটি'ও আবার কোনো এক দেশের রাজধানীতে ‘পোঁতা' রয়েছে! সুতরাং মইন উ'র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রশ্ন উঠতে পারে না। খালেদা জিয়া চেষ্টা করে দেখতে পারেন। শেষ পর্যন্ত কি হবে তা জানা আছে বলেই প্রধানমন্ত্রী ‘ইন্টারফেয়ার' না করার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু রসিকতা করতে চাইলেও শেখ হাসিনা লক্ষ্য করেননি যে, এর মধ্য দিয়ে সাকা চৌধুরীরটাসহ বিচার বিভাগের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপের বিষয়টিই পরিষ্কার হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘ইন্টারফেয়ার' করেন বলেই ‘ইন্টারফেয়ার' না করার ঘোষণাটা মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে তার! এভাবে সব মিলিয়েই প্রধানমন্ত্রী আরো একবার বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘ডিজিটাল' নির্বাচনের ধাক্কায় ‘দিন বদল' হলেও তার নিজের স্বভাবে অন্তত ‘বদল' হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। জনগণেরও তাই প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে ভালো কিছু আশা করা উচিত নয়। -আহমদ আশিকুল হামিদ

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter