অপার সম্ভাবনাময় হয়ে উঠা বাংলাদেশ আজ সব হারাতে বসেছে -ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
বিগত তিন বছরের ধারাবাহিক অপশাসনে এক অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ এখন ক্ষীয়মান নি্রাণ রাষ্ট্রে পরিণত হতে বসেছে। রাষ্ট্র যেন এখন লুটেরাদের চারণভূমি। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ এখন জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থনীতি। উৎপাদন নেই, বিনিয়োগ নেই, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ নেই। অবিরাম মিথ্যাচারে হতভম্ব মানুষ দিশেহারা। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী গলা চড়িয়ে যা ইস্যু নয়, সেটাকেই ইস্যু বানানোর জন্য শেয়ালের রা' তুলছে। তার সঙ্গে দায়িত্বহীন মিডিয়াও সুর তুলছে। আমরা শুনেছিলাম ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের নায়কদের ফাঁসিতে ঝুলাতে পারলে দেশের আর কোনো সমস্যা থাকবে না, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। তাদের ফাঁসিতে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। দেশের সমস্যার সমাধান হয়নি, বরং সঙ্কট আরও বেড়েছে। এখন শুনছি সকল উন্নযনের মূলমন্ত্র নিহিত আছে কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্যে। ফলে সরকারের একটাই চিন্তা। কী করে ঐ প্রহসনের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে (২০০১-০৬) আমরা দেশে বিনিয়োগ আর উৎপাদনের জোয়ার লক্ষ্য করেছিলাম। ঢাকার আশপাশে কাঁচপুর থেকে নরসিংদী, ঢাকা থেকে মুন্সীগঞ্জ, গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে দেখেছি। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ দেখেছি। বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কর্মকান্ড দেখেছি নিভৃত পল্লীতেই। সাধারণ মানুষ চাষাবাদ, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু পালন, নার্সারী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেদের জীবনমান বদলে নিচ্ছিল, দেখেছি। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে বাড়ছিল জীবনমান। শিক্ষা স্বাস্থ্যের প্রতি অধিক যত্নশীল হয়ে উঠছিল মানুষ। ভ্যানচালকের সন্তানেরাও যাচ্ছিল বই-খাতা হাতে স্কুলে। প্রবৃদ্ধি প্রায় সাত শতাংশে উন্নীত হয়েছিল।
এই যে এখন মিথ্যার বেসাতি শুনছি যে, জোট সরকারের আমলে এক মেগাওয়াটও বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়নি। পরিস্থিতি যদি তাই, তাহলে দেশী-বিদেশী এত বিনিয়োগকারী কেন শিল্পকারখানা স্থাপন করেছিল? আর সরকার দাবি করছে যে, বিগত এক বছরেই না কি তারা সাতশ' মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। তাহলে বিনিয়োগ নেই কেন? উৎপাদন বন্ধ কেন? কলকারখানা চালু রাখা যাচ্ছে না কেন? এসব প্রশ্নের জবাব মেলা ভার।
জোট সরকারের সময় বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল না। এমন কথা বলব না। তখনও চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়নি। তখনও লোডশেডিং ছিল। কিন্তু কেউ কি দিব্যি দিয়ে বলতে পারবে যে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৪ ঘণ্টাই তখন লোডশেডিং ছিল? অফিসে হাফ-শার্ট পরে যেতে হবে। পাঁচ ঘণ্টা এসি চালানো যাবে না। তখন কি সার-কারখানা বন্ধ করে সেচের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস দিতে হয়েছিল? নিশ্চয়ই নয়। তখন তো এমন কোনো নির্দেশ জারি করা হয়নি যে, গ্যাস দিয়ে জেনারেটর বয়লার চালু রাখা যাবে না, সিস্টেম বদলাতে হবে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসতে হাসতে বলেছিলেন যে, আল্লাহ তায়ালা জন বুঝে ধন দেন। তিনি বলেছেন তাদের আগের দফা শাসনকালে (১৯৯৬-২০০১) দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছিল। কিন্তু চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর সে উৎস শুকিয়ে যায়। এখন তাহলে শুকিয়ে ফেলা হচ্ছে কেন? আল্লাহ তায়ালা কি এ যাত্রা আর ধন দিচ্ছেন না?
এদিকে স্মরণাতীতকালের ভয়াবহ লোডশেডিং-এ গোটা দেশ পঙ্গু হতে বসেছে। শুধু যে কল-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, তাই নয়, সাধারণ মানুষের কর্মক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে। অফিস-আদালতে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের চার থেকে পাঁচ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকে না। ঐ সময় কোনো কাজও হয় না। ফলে সকল কাজে এসেছে ধীরগতি। একজন মানুষের সারাদিনে যতটুকু কাজ করার কথা, কাজ করতে পারছে তার অর্ধেক। ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা। পিছিয়ে পড়ছে গোটা জনপদ, গোটা সমাজ। কিন্তু বাগাড়ম্বর থামছে না কিছুতেই। বরং এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সরকার নির্বিকার। অর্থমন্ত্রী বলছেন, দেশে আশু বিনিয়োগের কোনো সম্ভাবনা নেই। কোনো কোনো মন্ত্রী বলছেন, বিদ্যুৎ সঙ্কট আরও দু'বছর চলবে। প্রধানমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ প্রগলভতায় বলছেন যে, সাত বছরের জঞ্জাল এক বছরে সাফ করা সম্ভব নয়। ধৈর্য ধরতে হবে। জনগণ অসহায় হয়ে পড়ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে- এটা দেখানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী ছ'মাস আগে চালু হওয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঘটা করে উদ্বোধন করছেন। যেন জনগণ বোঝে, বিদ্যুৎ এলো বলে।
কিন্তু জনগণ অতোটা বোঝে না। তারা কথার মারপ্যাঁচে ভোলে না। সেচের জন্য বিদ্যুৎ চাই, উৎপাদনের জন্য বিদ্যুৎ চাই, কারখানার জন্য বিদ্যুৎ চাই। তা না পেলে মিষ্টি কথা শুনে তাদের ফায়দা হয় না। ক্ষমতায় বসেছেন, বিদ্যুৎ দিন। সুতরাং চারদিকে বিক্ষোভ দানা বাঁধছে। ধানের জমি শুকিয়ে কাঠ। সেচ দেয়া যাচ্ছে না। স্থানে স্থানে মানুষ ঘেরাও অবরোধ, মিছিল-সমাবেশ করছে। আওয়ামী এমপিরাই বলছেন, এ সঙ্কটের সুরাহা না হলে জনবিস্ফোরণ ঘটবে। পুলিশ দিয়ে সে বিস্ফোরণ ঠেকানো যাবে না। কোনো দিন যায়নি। এখন নাগরিকরা টেলিফোনে কথাবার্তা শুরু করেন বিদ্যুৎ নিয়ে : আপনাদের ওদিকে বিদ্যুৎ আছে? সরকারকে এ বার্তা বুঝতে হবে।
জোট সরকারের অনেক সমালোচনা ছিল, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ না দিতে পারার জন্য। কিন্তু এই ভয়াবহ অবস্থা তখন ছিল না। আওয়ামী লীগের ডেকে আনা অসাংবিধানিক সরকার বিদ্যুৎ নিয়ে ভাবেনি। তাদের বদৌলতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। ক্ষমতায় বসেই বিরোধী দল নির্মূলে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। আর কোনো দিকে তাকাবার ফুরসত হয়নি। শাসন একেবারে তোঘলকি ভাবনা। রাষ্ট্র যেমন খুশি চলুক, জনগণ যা ভাবার ভাবুক। জনগণ তো ভোট দেয় না। তাদের নিয়ে ভাবনার কি আছে! ফলে বিদ্যুৎ নিয়েও কিছু ভাবা হয়নি। উৎপাদন ক্ষমতার সবটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় গ্যাসের উৎপাদন বাড়িয়ে। সেটাও করা যেত দু'এক মাসের মধ্যেই। কিন্তু তাও করা হয়নি।
আসলে আধুনিক পৃথিবী বিদ্যুৎ ছাড়া অচল। বিদ্যুৎ না থাকলে শিল্পে বিনিয়োগ হবে না। শিল্পে বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান হবে না। কর্মসংস্থান না হলে দারিদ্র্য বাড়বে, দারিদ্র্য বাড়লে সমাজে অস্থিতিশীলতা বাড়বে। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-রাহাজানি বাড়বে। আবার বিনিয়োগ না হলে ব্যাংকে পড়ে থাকবে অলস টাকা। অথচ ব্যাংকগুলোকে দিতে হবে জমাকারীর সুদ। ফলে ব্যাংকিং খাতও অস্থির হয়ে উঠবে। পুঁজি চলে যাবে দেশ ছেড়ে। ত্রিপুরার মন্ত্রী ঢাকা সফরে এসেছিলেন। বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের বলে গেছেন, ত্রিপুরায় বিনিয়োগ করলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়া হবে। বাংলাদেশে শিল্পে নতুন বিনিয়োগের কথা কেউ ভাবছে না। যা বিনিয়োগ করা হয়েছে, সেটা রক্ষা করা যায় কিনা, তাই নিয়ে ভাবছে। এ ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রফতানিমূখী শিল্পগুলো সময় মতো পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে বাজার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সে বাজার দখলে নিচ্ছে চীন-ভারত-ভিয়েতনাম। কারখানাগুলোতে অর্ধেক সময় কাজ হচ্ছে না। ২৫-৩০ ভাগে দাঁড়িয়েছে উৎপাদন। ফলে ব্যাংকগুলো আবার শঙ্কিত। তারা শিল্পপতিদের ঋণ দিয়েছে। উৎপাদন না হলে, কারখানা চালু রাখা না গেলে উদ্যোক্তারাই বা সে ঋণ শোধ দেবেন কোত্থেকে? ফলে এক হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে গোটা দেশ।
সরকার হয়ত ভাবছে, তাদের বিপুল জনসমর্থন রয়েছে। কে কি করতে পারে? কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি না থাকলে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের যেমন কষ্ট হয়, তেমনি কষ্ট হয় আওয়ামী সমর্থকদের মধ্যে। তখন ‘জয় বাংলা' বলে ধ্বনি তুললে সে কষ্ট লাঘব হয়ে যায় না। সমর্থন উঠে যেতে থাকে। ফলে বিস্ফোরণ যখন ঘটে, তখন সে বিস্ফোরণে তারাও শরিক হন। জনসমর্থনের কাল্পনিক নিরাপত্তা তখন অবশিষ্ট থাকে না। আর হাওয়াই বক্তব্যে তাদের মন ভেজে না। সরকার বলছে, বিদ্যুৎ আমদানি করবে ভারত থেকে। যেখান থেকে আমদানি করবে বলছে, সেখানে কেবল মেশিনপত্র বসছে। অর্থাৎ রসুনের বীজ রোপিত হচ্ছে। তার চেয়ে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের হাতে ছেড়ে দেন। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীর অভাব নেই। সরকারের ঢিলেমির ফলে তারা অনেক দ্রুত উৎপাদনে যেতে পারবেন। হাওয়াই আমদানি পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে।
কিন্তু আমদানির দিকে সরকারের বড় ঝোঁক। এখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাতে এক সময় ঘটি-বাটিও আমদানি করতে হবে। দেশের সকল শিল্প-কারখানা রফতানির লক্ষ্য নিয়ে স্থাপিত হয়নি। অধিকাংশ কলকারখানাই স্থাপিত হয়েছে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহের লক্ষ্যে। বিদ্যুৎ না থাকায় সেগুলোও উৎপাদনে থাকতে পারছে না। গ্যাস-বিদ্যুতে উৎপাদন খরচ কম। কিন্তু ডিজেল-ফার্নেসে খরচ অনেক বেশি। ডিজেল চালিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ দিয়ে পণ্য সামগ্রী উৎপাদন করতে চাইলে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ-তিনগুণে দাঁড়াবে। যে পণ্য কেনার সাধ্য থাকবে কারও। সরকারকে তখন ওসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। বন্ধ হয়ে যাবে কলকারখানা। বেকার বাড়বে। তারাও কম দামের জিনিস খুঁজবে। বাংলাদেশের পণ্য সরবরাহের জন্য ভারতে শিল্প-কারখানার প্রসার ঘটবে। কী মজাই না হবে!
কিন্তু আমদানি করবে কী দিয়ে? রফতানি খাত তো ইতোমধ্যেই স্থবির হয়ে গেছে। বেকার হয়েছে শুধু গার্মেন্টসেই দুই লাখ। সরবরাহ ঠিক না রাখতে পারলে ক্রেতারা ভিন দেশের দিকে মুখ ফেরাবে। শ'য়ে শ'য়ে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বন্ধ হবে। বৈদেশিক মুদ্রা আসবে না। আবার সরকারের ভারত-তোষক পররাষ্ট্রনীতির কারণে এখন তারা একেবারেই বন্ধুহীন। সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে বিদেশী শ্রমবাজার। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রম বাজার হাতছাড়া হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরও সৌদী আরব কুয়েত-কাতার আর বাংলাদেশ থেকে লোক নিচ্ছে না। বরং ফেরত পাঠাচ্ছে। ফলে প্রবাসীদের পাঠানো টাকাও ক্ষয়ে যেতে থাকবে। আমদানির মুরোদও থাকবে। তখন এই সরকারের মূল পরিচালক বিশ্বব্যাংকে আইএমএফ এডিবি আমদানির জন্য কঠিন শর্তে ঋণ দেবে। যে শর্ত দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকেও বিপন্ন করে তুলবে।
সরকার এমনি এক ভয়াবহ লক্ষ্যহীন গন্তব্যহীন পথে যাত্রা শুরু করেছে। এ থেকে উদ্ধারের পথ সকলকে একযোগে খুঁজতে হবে। সরকারকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, দেশ ও জনগণের ভাগ্য নিযে এমন ছিনিমিনি খেলা চলবে। সরকারের পথ ভুল। আর যে ভুল শুধরে দেয়ার জন্য শিল্পপতি-ব্যবসায়ী-কর্মজীবী-শ্রমজীবী কৃষক-মজুর সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। সে প্রতিরোধের পথেই সংশোধিত হতে পারে সরকার। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ বুঝি আর খোলা নেই।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে (২০০১-০৬) আমরা দেশে বিনিয়োগ আর উৎপাদনের জোয়ার লক্ষ্য করেছিলাম। ঢাকার আশপাশে কাঁচপুর থেকে নরসিংদী, ঢাকা থেকে মুন্সীগঞ্জ, গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে দেখেছি। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ দেখেছি। বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কর্মকান্ড দেখেছি নিভৃত পল্লীতেই। সাধারণ মানুষ চাষাবাদ, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু পালন, নার্সারী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেদের জীবনমান বদলে নিচ্ছিল, দেখেছি। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে বাড়ছিল জীবনমান। শিক্ষা স্বাস্থ্যের প্রতি অধিক যত্নশীল হয়ে উঠছিল মানুষ। ভ্যানচালকের সন্তানেরাও যাচ্ছিল বই-খাতা হাতে স্কুলে। প্রবৃদ্ধি প্রায় সাত শতাংশে উন্নীত হয়েছিল।
এই যে এখন মিথ্যার বেসাতি শুনছি যে, জোট সরকারের আমলে এক মেগাওয়াটও বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়নি। পরিস্থিতি যদি তাই, তাহলে দেশী-বিদেশী এত বিনিয়োগকারী কেন শিল্পকারখানা স্থাপন করেছিল? আর সরকার দাবি করছে যে, বিগত এক বছরেই না কি তারা সাতশ' মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। তাহলে বিনিয়োগ নেই কেন? উৎপাদন বন্ধ কেন? কলকারখানা চালু রাখা যাচ্ছে না কেন? এসব প্রশ্নের জবাব মেলা ভার।
জোট সরকারের সময় বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল না। এমন কথা বলব না। তখনও চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়নি। তখনও লোডশেডিং ছিল। কিন্তু কেউ কি দিব্যি দিয়ে বলতে পারবে যে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৪ ঘণ্টাই তখন লোডশেডিং ছিল? অফিসে হাফ-শার্ট পরে যেতে হবে। পাঁচ ঘণ্টা এসি চালানো যাবে না। তখন কি সার-কারখানা বন্ধ করে সেচের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস দিতে হয়েছিল? নিশ্চয়ই নয়। তখন তো এমন কোনো নির্দেশ জারি করা হয়নি যে, গ্যাস দিয়ে জেনারেটর বয়লার চালু রাখা যাবে না, সিস্টেম বদলাতে হবে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসতে হাসতে বলেছিলেন যে, আল্লাহ তায়ালা জন বুঝে ধন দেন। তিনি বলেছেন তাদের আগের দফা শাসনকালে (১৯৯৬-২০০১) দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছিল। কিন্তু চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর সে উৎস শুকিয়ে যায়। এখন তাহলে শুকিয়ে ফেলা হচ্ছে কেন? আল্লাহ তায়ালা কি এ যাত্রা আর ধন দিচ্ছেন না?
এদিকে স্মরণাতীতকালের ভয়াবহ লোডশেডিং-এ গোটা দেশ পঙ্গু হতে বসেছে। শুধু যে কল-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, তাই নয়, সাধারণ মানুষের কর্মক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে। অফিস-আদালতে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের চার থেকে পাঁচ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকে না। ঐ সময় কোনো কাজও হয় না। ফলে সকল কাজে এসেছে ধীরগতি। একজন মানুষের সারাদিনে যতটুকু কাজ করার কথা, কাজ করতে পারছে তার অর্ধেক। ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা। পিছিয়ে পড়ছে গোটা জনপদ, গোটা সমাজ। কিন্তু বাগাড়ম্বর থামছে না কিছুতেই। বরং এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সরকার নির্বিকার। অর্থমন্ত্রী বলছেন, দেশে আশু বিনিয়োগের কোনো সম্ভাবনা নেই। কোনো কোনো মন্ত্রী বলছেন, বিদ্যুৎ সঙ্কট আরও দু'বছর চলবে। প্রধানমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ প্রগলভতায় বলছেন যে, সাত বছরের জঞ্জাল এক বছরে সাফ করা সম্ভব নয়। ধৈর্য ধরতে হবে। জনগণ অসহায় হয়ে পড়ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে- এটা দেখানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী ছ'মাস আগে চালু হওয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঘটা করে উদ্বোধন করছেন। যেন জনগণ বোঝে, বিদ্যুৎ এলো বলে।
কিন্তু জনগণ অতোটা বোঝে না। তারা কথার মারপ্যাঁচে ভোলে না। সেচের জন্য বিদ্যুৎ চাই, উৎপাদনের জন্য বিদ্যুৎ চাই, কারখানার জন্য বিদ্যুৎ চাই। তা না পেলে মিষ্টি কথা শুনে তাদের ফায়দা হয় না। ক্ষমতায় বসেছেন, বিদ্যুৎ দিন। সুতরাং চারদিকে বিক্ষোভ দানা বাঁধছে। ধানের জমি শুকিয়ে কাঠ। সেচ দেয়া যাচ্ছে না। স্থানে স্থানে মানুষ ঘেরাও অবরোধ, মিছিল-সমাবেশ করছে। আওয়ামী এমপিরাই বলছেন, এ সঙ্কটের সুরাহা না হলে জনবিস্ফোরণ ঘটবে। পুলিশ দিয়ে সে বিস্ফোরণ ঠেকানো যাবে না। কোনো দিন যায়নি। এখন নাগরিকরা টেলিফোনে কথাবার্তা শুরু করেন বিদ্যুৎ নিয়ে : আপনাদের ওদিকে বিদ্যুৎ আছে? সরকারকে এ বার্তা বুঝতে হবে।
জোট সরকারের অনেক সমালোচনা ছিল, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ না দিতে পারার জন্য। কিন্তু এই ভয়াবহ অবস্থা তখন ছিল না। আওয়ামী লীগের ডেকে আনা অসাংবিধানিক সরকার বিদ্যুৎ নিয়ে ভাবেনি। তাদের বদৌলতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। ক্ষমতায় বসেই বিরোধী দল নির্মূলে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। আর কোনো দিকে তাকাবার ফুরসত হয়নি। শাসন একেবারে তোঘলকি ভাবনা। রাষ্ট্র যেমন খুশি চলুক, জনগণ যা ভাবার ভাবুক। জনগণ তো ভোট দেয় না। তাদের নিয়ে ভাবনার কি আছে! ফলে বিদ্যুৎ নিয়েও কিছু ভাবা হয়নি। উৎপাদন ক্ষমতার সবটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় গ্যাসের উৎপাদন বাড়িয়ে। সেটাও করা যেত দু'এক মাসের মধ্যেই। কিন্তু তাও করা হয়নি।
আসলে আধুনিক পৃথিবী বিদ্যুৎ ছাড়া অচল। বিদ্যুৎ না থাকলে শিল্পে বিনিয়োগ হবে না। শিল্পে বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান হবে না। কর্মসংস্থান না হলে দারিদ্র্য বাড়বে, দারিদ্র্য বাড়লে সমাজে অস্থিতিশীলতা বাড়বে। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-রাহাজানি বাড়বে। আবার বিনিয়োগ না হলে ব্যাংকে পড়ে থাকবে অলস টাকা। অথচ ব্যাংকগুলোকে দিতে হবে জমাকারীর সুদ। ফলে ব্যাংকিং খাতও অস্থির হয়ে উঠবে। পুঁজি চলে যাবে দেশ ছেড়ে। ত্রিপুরার মন্ত্রী ঢাকা সফরে এসেছিলেন। বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের বলে গেছেন, ত্রিপুরায় বিনিয়োগ করলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়া হবে। বাংলাদেশে শিল্পে নতুন বিনিয়োগের কথা কেউ ভাবছে না। যা বিনিয়োগ করা হয়েছে, সেটা রক্ষা করা যায় কিনা, তাই নিয়ে ভাবছে। এ ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রফতানিমূখী শিল্পগুলো সময় মতো পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে বাজার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সে বাজার দখলে নিচ্ছে চীন-ভারত-ভিয়েতনাম। কারখানাগুলোতে অর্ধেক সময় কাজ হচ্ছে না। ২৫-৩০ ভাগে দাঁড়িয়েছে উৎপাদন। ফলে ব্যাংকগুলো আবার শঙ্কিত। তারা শিল্পপতিদের ঋণ দিয়েছে। উৎপাদন না হলে, কারখানা চালু রাখা না গেলে উদ্যোক্তারাই বা সে ঋণ শোধ দেবেন কোত্থেকে? ফলে এক হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে গোটা দেশ।
সরকার হয়ত ভাবছে, তাদের বিপুল জনসমর্থন রয়েছে। কে কি করতে পারে? কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি না থাকলে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের যেমন কষ্ট হয়, তেমনি কষ্ট হয় আওয়ামী সমর্থকদের মধ্যে। তখন ‘জয় বাংলা' বলে ধ্বনি তুললে সে কষ্ট লাঘব হয়ে যায় না। সমর্থন উঠে যেতে থাকে। ফলে বিস্ফোরণ যখন ঘটে, তখন সে বিস্ফোরণে তারাও শরিক হন। জনসমর্থনের কাল্পনিক নিরাপত্তা তখন অবশিষ্ট থাকে না। আর হাওয়াই বক্তব্যে তাদের মন ভেজে না। সরকার বলছে, বিদ্যুৎ আমদানি করবে ভারত থেকে। যেখান থেকে আমদানি করবে বলছে, সেখানে কেবল মেশিনপত্র বসছে। অর্থাৎ রসুনের বীজ রোপিত হচ্ছে। তার চেয়ে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের হাতে ছেড়ে দেন। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীর অভাব নেই। সরকারের ঢিলেমির ফলে তারা অনেক দ্রুত উৎপাদনে যেতে পারবেন। হাওয়াই আমদানি পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে।
কিন্তু আমদানির দিকে সরকারের বড় ঝোঁক। এখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাতে এক সময় ঘটি-বাটিও আমদানি করতে হবে। দেশের সকল শিল্প-কারখানা রফতানির লক্ষ্য নিয়ে স্থাপিত হয়নি। অধিকাংশ কলকারখানাই স্থাপিত হয়েছে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহের লক্ষ্যে। বিদ্যুৎ না থাকায় সেগুলোও উৎপাদনে থাকতে পারছে না। গ্যাস-বিদ্যুতে উৎপাদন খরচ কম। কিন্তু ডিজেল-ফার্নেসে খরচ অনেক বেশি। ডিজেল চালিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ দিয়ে পণ্য সামগ্রী উৎপাদন করতে চাইলে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ-তিনগুণে দাঁড়াবে। যে পণ্য কেনার সাধ্য থাকবে কারও। সরকারকে তখন ওসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। বন্ধ হয়ে যাবে কলকারখানা। বেকার বাড়বে। তারাও কম দামের জিনিস খুঁজবে। বাংলাদেশের পণ্য সরবরাহের জন্য ভারতে শিল্প-কারখানার প্রসার ঘটবে। কী মজাই না হবে!
কিন্তু আমদানি করবে কী দিয়ে? রফতানি খাত তো ইতোমধ্যেই স্থবির হয়ে গেছে। বেকার হয়েছে শুধু গার্মেন্টসেই দুই লাখ। সরবরাহ ঠিক না রাখতে পারলে ক্রেতারা ভিন দেশের দিকে মুখ ফেরাবে। শ'য়ে শ'য়ে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বন্ধ হবে। বৈদেশিক মুদ্রা আসবে না। আবার সরকারের ভারত-তোষক পররাষ্ট্রনীতির কারণে এখন তারা একেবারেই বন্ধুহীন। সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে বিদেশী শ্রমবাজার। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রম বাজার হাতছাড়া হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরও সৌদী আরব কুয়েত-কাতার আর বাংলাদেশ থেকে লোক নিচ্ছে না। বরং ফেরত পাঠাচ্ছে। ফলে প্রবাসীদের পাঠানো টাকাও ক্ষয়ে যেতে থাকবে। আমদানির মুরোদও থাকবে। তখন এই সরকারের মূল পরিচালক বিশ্বব্যাংকে আইএমএফ এডিবি আমদানির জন্য কঠিন শর্তে ঋণ দেবে। যে শর্ত দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকেও বিপন্ন করে তুলবে।
সরকার এমনি এক ভয়াবহ লক্ষ্যহীন গন্তব্যহীন পথে যাত্রা শুরু করেছে। এ থেকে উদ্ধারের পথ সকলকে একযোগে খুঁজতে হবে। সরকারকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, দেশ ও জনগণের ভাগ্য নিযে এমন ছিনিমিনি খেলা চলবে। সরকারের পথ ভুল। আর যে ভুল শুধরে দেয়ার জন্য শিল্পপতি-ব্যবসায়ী-কর্মজীবী-শ্রমজীবী কৃষক-মজুর সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। সে প্রতিরোধের পথেই সংশোধিত হতে পারে সরকার। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ বুঝি আর খোলা নেই।
No comments:
Write comments