Flickr

Thursday, 28 October 2010

আওয়ামী লীগের রাজনীতি এবং সংঘাতের পথে বাংলাদেশ

আদর্শিক বা সাংস্কৃতিক আধিপত্যের পথ ধরেই আসে রাজনৈতিক আধিপত্য। একবার আদর্শিক বা সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে রাজনৈতিক আধিপত্য-স্থাপনে শত্রুপক্ষের কাছে যুদ্ধ-লড়াটা তখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের স্ট্রাটেজী ছিল অন্যদেশের অভ্যন্তরে নিজেদের সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক দ্বীপ গড়া। তুরস্ক, মিশর, পাকিস্তানসহ অধিকাংশ মুসলিম সে দ্বীপগুলো হলো ক্যান্টনমেন্ট, অফিসপাড়া, আদালত, পতিতালয় ও ব্যাংকিং সেক্টর। এগুলোর সীমান্ত পাশ্চাত্য চেতনা ও মূল্যবোধের সাথে একাকার। ইসলামের হারাম-হালালের বিধান এসব জাগায় অচল। তারাই এখন পাশ্চাত্যের কাফের শক্তির একনিষ্ঠ মিত্র। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তাই আজ নিজ দেশে হাজার হাজার মুসলমান হত্যা করছে অতিশয় আনন্দ-চিত্তে। তুরস্কে দেশের সৈনিকরাই স্কুলের মেয়েদের মাথায় রুমাল বাঁধতে দিতেও রাজি নয়। মিসরে এরা রাজি নয় ইসলামপন্থীদের রাজনীতির ময়দানে আসতে দিতে। এখন পাশ্চাত্যের সেকুলারিস্টগণ সেরূপ অভিন্ন দ্বীপ গড়ছে রাজনীতির অঙ্গনেও। আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ হলো তাদের সে অভয় দ্বীপ। একজন পশ্চিমা দুর্বৃত্ত ব্যভিচারি বাংলাদেশের পতিতালয়ে বা মদের আসরে যে সমাদরটি পায় সেটি তো চেতনাগত অভিন্নতার কারণেই। তেমনি এক অভিন্নতার কারণেই ভারতীয় নেতারাও অতি আপনজন রূপে গৃহীত হয় আওয়ামী লীগ নেতাদের আসরে। আর ভারতের সাথে আওয়ামী লীগের সে গভীর সম্পর্কটি নতুন বিষয় নয়। ভারত বাংলাদেশের জন্য নেপালে যাওয়ার জন্য ২০-৩০ মাইলের করিডোর দিতে রাজি ছিল না, অথচ বাংলাদেশের মাঝখান দিয়ে ৫০০ মাইলের করিডোর চায়। ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভূটানে যাওয়ার করিডোর বাংলাদেশের যতটা অপরিহার্য সেরূপ অবস্থা ভারতের জন্য নয়। ভারত তার পূর্বাঞ্চলে যেতে পারে তার নিজ ভূমির মধ্য দিয়ে। অথচ এরপরও ভারত চাপ দিচ্ছে সে করিডোর আদায়ে এবং আওয়ামী লীগ সেটি বিবেচনাও করছে।
আওয়ামী লীগের বিজয়ে প্রতিবারেই বিপর্যয় এসেছে নানাভাবে। প্রচন্ড বিপর্যয় এসেছে সেনাবাহিনীর উপরও। মুজিব আমলে সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশী গুরুত্ব পেয়েছিল রক্ষিবাহিনী। আওয়ামী লীগের এবারের বিজয়ে দেশের রাজধানীতে নিহত হলো ৫৭ জন সেনা অফিসার। শত্রুতা সৃষ্টি হলো এবং অবিশ্বাস বাড়লো সেনাবাহিনী ও বিডিআরের মাঝে। পিলখানার রক্ত শুকালেও মনের মাঝে যে বিভক্তি ও ঘৃণা সৃষ্টি হলো সেটি কি দূর হবার? এতে কি দেশের প্রতিরক্ষা মজবুতি পায়? এখন কথা উঠছে বিডিআরের বিলুপ্তির। সরকার ভাবছে, বিডিআরের নাম ও লেবাস পাল্টিয়ে আরেকটি বাহিনী গড়ার। সরকারের ধারণা, সমস্যা শুধু বিডিআর নামটি ও পোশাকটি নিয়ে। ভাবটা যেন, ফাইলপত্র ও অফিস আদালতের গা থেকে ‘বিডিআর' নামটি বা তাদের লেবাসটি উঠে গিয়ে সেনা-অফিসারদের বুকে গুলী চালিয়েছে। তাই আওয়ামী লীগ সমাধান খুঁজছে ‘বিডিআর' নামটি ও তার লেবাসটি বিলুপ্তির মাঝে।
দুর্যোগ নেমেছে দেশের শিক্ষাঙ্গনেও। চরদখলের ন্যায় সেখানে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আওয়ামী ক্যাডার বাহিনীর। শুধু ভিসি বা প্রিন্সিপালের অফিসেই নয়, দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আবাসিক হলগুলোর সিটগুলোর উপরও। আওয়ামী ক্যাডার বাহিনীর অনুমতি ছাড়া সেখানে কেউ থাকতে পারবে না। দলীয় নিয়ন্ত্রণ আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও। লাশ হচ্ছে ছাত্ররা। ব্যাপক অবনতি ঘটেছে আইন-শৃক্মখলার। বাড়ছে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী ও খুনখারাবী। একই রূপে হাত পড়েছে দেশের কৃষি ও শিল্পাঙ্গনেও। সরকারের বাণিজ্যনীতির কারণে ভারত থেকে অবাধে ঢুকছে ভারতীয় নিম্মমানের সস্তা পণ্য। ফলে বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য। কিছুদিন আগে তাই বাংলাদেশের কৃষকগণ বাজার না পেয়ে রাস্তার উপর তাদের দুধ ঢেলেছে। সে ছবি টিভিতে দেখানো হয়েছে। দেশে বন্ধ হচ্ছে নিজস্ব সূতা তৈরীর কারখানা। হাত পড়েছে দেশের তাঁতীদের গায়েও। মুজিবামলেও এমনটিই ঘটেছিল। তখনও দেশী কারখানায় তালা লাগানো শুরু হয়েছিল। আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিল বহু পাটের গুদাম। বাজারে প্লাবন এসেছিল তখন ভারতীয় পণ্যের। শিল্প-কৃষি-বাণিজ্য এভাবে একের পর এক বিধ্বস্ত বা বেদখল হলে কি সে দেশের জনগণের কাছে ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা থাকে? কথা হলো এভাবে কি একটি দেশের প্রতিষ্ঠা বাড়ে? বাড়ে কি সম্মান?
দেশের বিপর্যয় বাড়াতে আওয়ামী লীগ আরেকটি আত্মঘাতী পথও বেছে নিয়েছে। আর সেটি হলো রাজনৈতিক বিভক্তি ও ঘৃণার রাজনীতির। ইতিহাস থেকে খুঁজে খুঁজে তারা বিভক্তির সূত্র গুলো রাজনৈতিক ময়দানে নিয়ে আসছে। যুদ্ধ-অপরাধের মত ৩৮ বছরেরও পুরনো বিষয়কে তারা রাজনীতিতে টেনে আনছে। যারা ক'দিন আগে দিনদুপুরে নিহত ৫৭ জন সেনা-অফিসার হত্যার একটি সুষ্ঠু বিচার করতে হিমসিম খাচ্ছে, এবং এখন কোন আশার আলো দেখাতে পারছে না তারা আবার ৩৮ বছর পুরনো অপরাধের বিচার করবে। কান্ডজ্ঞান আছে এমন কোন ব্যক্তি কি সেটি বিশ্বাস করতে পারে? শেখ মুজিবের ২০ টাকা মণ দরে চাল খাওয়ানো বা শেখ হাসিনার প্রতি পরিবারে একজনের চাকরিদানের ন্যায় নির্বাচনী ওয়াদার মতই এটি এক প্রকান্ড মিথ্যাচার। বিচার শুধু গলাবাজিতে হয় না, চাক্ষুষ প্রমাণ ও সাক্ষী-সাবুদও হাজির করতে হয়। অপরাধী কি অপরাধী রূপে প্রমাণের দায়িত্ব সরকারের। এবং বিচারকে গ্রহণযোগ্য করতে না পারলে নিজেদের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতাও যে আঁস্তাকুড়ে পড়বে সে খেয়াল কি তাদের আছে? ঘৃণার রাজনীতির শিকার হয়েছেন শেখ মুজিব নিজে ও তার পরিবার। সিরাজ সিকদারের হত্যার পর সংসদে তিনি ঘৃণা ও দম্ভ ভরে বলেছেন, ‘‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’’ কিন্তু সে কথা বলার পর তিনিও বেশী দিন বাঁচেননি। সিরাজ সিকদারের ন্যায় তিনিও লাশ হয়েছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ অতীতের ইতিহাস থেকে কোন শিক্ষাই নেয়নি। তারা রাজনীতিতে জোয়ার দেখেছে ভাটাও দেখেছে। ভাটার সময় মুজিবের লাশ সিড়িতে পড়ে থাকলেও সে লাশ কেউ তুলতে এগোয়নি। ঘৃণা পেট্রোলের চেয়েও বিস্ফোরক। একবার সেটি ছড়িয়ে পড়লে সহজে সেটি থামে না। লক্ষ লক্ষ মানুষকে সেটি সাথে নিয়ে যায়।।ইউরোপ এক সময় এ ঘৃণার কারণে দারুণভাবে বিধ্বস্ত ও জনশূন্য হয়েছিল। তাই তারা নানা জাতিতে বিভক্ত ইউরোপকে এখন এক করতে ব্যস্ত। আরেকটি ধ্বংসযজ্ঞ তারা এড়াতে চায়। ইতিহাস থেকে যারা শিক্ষা নেয় তাদের আচরণটি এমনই হয়। আজকের ইরাক হলো আরেক দৃষ্টান্ত। অতিশয় ঘৃণার কারণে মানুষ সেখানে নিজেই পরিণত হচ্ছে বোমায়। ফেটে পড়ছে রাজপথে, মসজিদে ও বাজারে। পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষের সেখানে মৃত্যু ঘটেছে। আরেক উদাহরণ আলজিরিয়া।
রাজনীতি হলো একতা ও সম্প্রীতি গড়ার নীতি। একমাত্র সে পথেই রাষ্ট্র সামনে এগোয়। দেশবাসীও নিজেদের মধ্যে সংহতি খুঁজে পায়। তাই যেদেশে রাজনীতি পরিপক্কতা পায় সেদেশের রাজনীতিতে একতা ও সম্প্রীতি গুরুত্ব পায়। এবং লোপ পায সংঘাত। হ্রাস পায় দল-উপদলের সংখ্যা। অন্য ভাষা, অন্য এলাকা ও অন্য নগরের মানুষকে রাজনৈতিক কর্মীরা তখন আপন করতে শেখে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা সে পথে চলতে রাজী নয়। শুরু থেকে ঘৃণা ও বিচ্ছিন্নতাই তাদের রাজনীতির মূল পুঁজি। মশামাছি যেমন নর্দমার নোংরা পানিতে বেঁচে থাকে, তেমনি এরাও বাঁচে ঘৃণার স্তূপে শিকড় ঢুকিয়ে। ফলে একতা, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির চর্চা তাদের হাতে বাড়বেই বা কেমনে? পাকিস্তান আমলে অবাঙ্গালীদের ঘৃণা করাই ছিল তাদের রাজনীতির মূল পুঁজি, যোগ্যতা নয়। তাদের যোগ্যতা তো আজও ইতিহাস। মানুষ সেটি মুজিব আমলে যেমন স্বচোখে দেখেছে তেমনি আজও দেখছে। তাদের এখনকার ঘৃণা দেশের ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে। তাছাড়া সাম্প্রতিক নির্বাচনী বিজয় প্রচন্ডভাবে তাদেরকে দাম্ভিকও করেছে। এতে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। পেট্রোল ছিটানোর ন্যায় তারা শুধু ঘৃণাই ছড়িয়ে যাচ্ছে। লগি-বৈঠা নিয়ে রাজপথে মুসল্লি হত্যা, যাত্রীভরা বাসে পেট্রোল বোমা মারা বা ইসলামপন্থিদের নির্মূলের হুমকি দেয়া-সে ঘৃণার রাজনীতিরই ফসল। কিন্তু ভুলে যাচ্ছে, ঘৃণার যে বীজগুলি তারা অবিরাম ছিটাচ্ছে এক সময় তা ফলবান বিশাল বৃক্ষে পরিণত হবে এবং সে বিষবৃক্ষে শান্তি নয়, একমাত্র ঘৃণার বোমাই ফলবে। আর ঘৃণার সে বোমাগুলো একবার ফাটা শুরু করলে তাদের রাজনীতিই শুধু অসম্ভব হবে না, হাত পড়বে তাদের অস্তিত্ত্বেও। সংঘাতটি আরো রক্তাক্ত হওয়ার নিশ্চিত কারণ হলো, এ পক্ষের কাছে সেটি পবিত্র জিহাদে পরিণত হবে। দেশ তখন আরেক ইরাক, আরেক আফগানিস্তান বা আলজিরিয়ায় পরিণত হবে। আওয়ামী লীগ কি জেনে-বুঝে দেশকে সে দিকেই ধাবিত করছে? -ফিরোজ মাহবুব কামাল

Monday, 11 October 2010

ডিজিটাল আওয়ামীলীগ, বামপন্থী রাজনীতি এবং আমাদের মিডিয়া

ডিজিটাল আওয়ামীলীগ, বামপন্থী রাজনীতি এবং আমাদের মিডিয়া
এক :
৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশ বাংলাদেশ। ১৫ কোটি মানুষের বসবাস এ বদ্বীপে। সামগ্রিক বিচারে বাংলাদেশের আম জনতা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় নিরন্তর সংগ্রামরত এক কর্মবীর সাহসী জনগোষ্ঠী। নিয়তিতে প্রচন্ডভাবে বিশ্বাস করে সাধারণ জনগণ। প্রতিটি দুর্যোগে ঘুরে দাঁড়িয়েছে আমাদের জাতি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বিপরীতে দেশের আপামর জনগণ সর্বদাই ছিলো সজাগ এবং প্রতিরোধ মুখর। নৃতাত্বিক জাতীয়তা বলুন আর অন্যের চাপিয়ে দেয়া মতবাদ এ সবই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর কাছে। দেশের বৃহৎ অংশ সর্বদাই লড়াই করতে হয়েছে আপন বোধ বিশ্বাস আর স্বাধীন স্বক্রিয়তার জন্য। আজও তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। জাতি হিসাবে আমরা যেমন উদার তেমন হাজার বছরের সম্প্রীতি নিয়ে বসবাস করা এক বন্ধুবৎসল জাতি। কিন্ত তার পর...শুরুটা ডিজিটাল দিয়ে।
বর্তমান ডিজিটাল সরকার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে শেখ মুজিবের দ্বিতীয় বিপ্লব নামের জগদ্বল পাথর ‘‘বাকশাল’’ কায়েম করতে। হাসিনা সরকার প্রায় ৭০ ভাগ সফল হয়েছেন আমার মতে। বাকি ৩০ ভাগের জন্য আন্তরিক চেষ্টা করছে গত ‘‘এনালগ উদ্দিন সরকারের এই প্রলম্বিত ডিজিটাল সরকার’’।
পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগের বাই প্রোডাক্ট আওয়ামী মুসলিম লীগ। জন্ম দাতারা হলেন পাকিস্তান আন্দোলনের তরুণ ও আধুনিক মনষ্ক নেতৃবৃন্দ। শেখ মুজিব, হোসেন সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী ছাত্র নেতা ছিলেন মাওলানা ভাসানীর একান্ত শাগরীদ ছিলেন শেখ মুজিব। যদিও পরবর্তীতে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক সাপে নেউলে পর্যায়ের হয়েছিলো। সে ইতিহাস যেমন করুণ তেমন আওয়ামীলীগের জন্য চরম গ্লানিকরও বটে।
আওয়ামী মুসলিম লীগ ক্ষমতার নেশায় আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয় ৫০ এর দশকে। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ ও বাংগালী জাতীয়তাবাদ দলীয় আদর্শ হিসাবে স্থান পায় স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে। ৭০ পূর্ব নির্বাচন বা তার পূর্বের গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ কখনো মুসলিম সেন্টিমেন্টের বিরুদ্ধে যায় এমন বক্তব্য বা দলীয় নীতি ঘোষণা করে নাই। এটাই ইতিহাস এবং এটাই তখকার বাস্তবতা। যদিও দলটি তার ৭০ পূর্ব দলীয় ঐতিহ্যকে খন্ডিত করে পেশ করে জাতির সামনে। নিজ দলের ইতিহাসকে বলাৎকার করার কারণ হলো, প্রতিষ্ঠাকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের লক্ষ্য আদর্শ থেকে অনেকটা বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে বর্তমান ডিজিটাল হাসিনা আওয়ামীলীগ।
কিন্ত হঠাৎ করে স্বাধীনতার পর গোটা জাতির বোধ বিশ্বাসের বিপরীত আদর্শ আওয়ামী লীগ কেন গ্রহণ করলো? কেনই বা সমকালীন ইতিহাসের সবচেয়ে জন নন্দিত নেতা শেখ মুজিব নিজ জাতির ও বিশ্ববাসীর কাছে চরম নিন্দিত হলেন? বাকশালী ভূত জাতির ঘাড়ে চাপাতে গিয়ে শেখ মুজিবকে বিয়োগান্তুক ঘটনার শিকার হতে হল কেন? কারা তাকে গণতন্ত্রী মুজিব থেকে স্বৈরাচার মুজিবে পরিণত করলো? কেনইবা তার দলের প্রথম সারির নেতারা ৭৫ পরবর্তী সরকারগুলোর মন্ত্রী মিনিস্টার হলেন? এবং আরো অনেক কিছু.... অনেক প্রশ্ন? সত্যি হলো আজকের বাংলাদেশে যারাই রাজনীতির নিয়ামক তারা প্রত্যেকেই এর জন্য কম বেশি দায়ী।
তবে অতি বামপন্থিরা শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিতর্কিত করেছে সবচেয়ে বেশি। আজকের সুরঞ্জিত সেন, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু সহ অতি ধর্মনিরপেক্ষ আর তথাকথিত কমিউনিস্ট নাস্তিকেরা শেখ মুজিবকে শান্তিতে দেশ শাসন করতে পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। যদিও তারা সময়ের পরিবর্তনে আজ শেখ মুজিবকে জাতির পিতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সেনাপতির ভূমিকা পালন করছেন। এটাও হলো এই রাজনৈতিক এতিমদের পূর্ব পাপের প্রায়শ্চিত্ব এবং রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব।
স্বাধীনতার পর তিনটি বছর বাংলাদেশের জনগণ অতিষ্ঠ ছিলো বামপন্থি তথা কমিউনিস্ট আদর্শ গলধকরণ করতে। ইনু মেনু খান সাহেবেরা শ্রেণী সংগ্রামের নামে নিরপরাধ মানুষ হত্যা করেছে নির্বিবাদে। যা তাদের ভাষায় বুর্জোয়া রাজনীতির বিরুদ্ধে মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মহান আন্দোলন। এদের বিপরীতে উদ্ভট সে আন্দোলনের টুটি চেপে ধরার জন্যে মুজিব সরকারকে ২৭ হাজার জাসদ কর্মীকে হত্যা করতে হয়েছিলো। তখনকার বিদেশি পত্রিকাগুলোতে যে রিপোর্ট ছাপে তাতে লেখা হয় ‘‘বাংলাদেশের চিরায়ত বোধ বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত রাষ্ট্রীয় আদর্শ গ্রহণ, রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর পৃষ্ঠপোষকতায় আত্মীয়করণ, উৎকট দলীয়করণ, সীমাহীন দুর্নীতি তথা লুটপাটের রাজনীতি বাংলাদেশের ভাগ্যে তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা জোটে।
ভারতপন্থী এবং মস্কোপন্থী অতি বামরা শেখ মুজিবকে যেমন প্রতারিত শাসন ব্যবস্থার দিকে ধাবিত করেছিলো তেমনই নেতিবাচক রাজনীতিরও প্রচলন করেছিলেন নব্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায়। জ্বালাও, পোড়াও, ভাংচুর, হত্যা, সন্ত্রাস এবং হরতালই ছিলো তাদের রাজনীতি। জাতিকে ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের দিকে ধাবিত করেছিলেন আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহান বাম নেতারা। শেখ মুজিব সরকারকে যারা ব্যর্থ, অথর্ব, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নির্ভর শাসন হিসাবে চিত্রিত করেছিলেন, তারাই আজ মুজিব তনয়া শেখ হাসিনার মহাজোটের অংশীদার হয়ে সরকারের ভিতর আরেকটি সরকার কায়েম করেছেন। সত্যিকার দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ছিলো বাংলাদেশের বাম অংগনের রাজনীতিবিদগণ। আজও তারা তাদের নেতিবাচক রাজনীতির ধারাবাহিকতার সাথে জাতিকে বিভক্ত করার রাজনীতিতে ব্যস্ত।
দেশ মাতৃকার প্রতি দায়বদ্ধ রাজনীতি বামপন্থী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ কখনো দেখাতে পারেননি। জন বিচ্ছিন্ন হওয়াই যেন তাদের রাজনীতির ভাগ্য। মিডিয়ার আনুকুল্যে বিবৃতিবাজ হিসাবে মোটামুটি প্রেস্টিজ রক্ষা করে চলেছেন এদের কেউ কেউ। আবার কেউ কেউ কলামিস্ট হয়ে রুজি রুটির ব্যবস্থা সংকুলান করছেন। বাম ঘরানার রাজনীতিবিদদের বর্তমান আদর্শ হল সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রিড়নক, করপোরেট এনজিও সংস্থাগুলোর স্বার্থ রক্ষা ও চরম বুর্জোয়া সুবিধাবাদী রাজনীতির তল্পিবাহক এবং বিভাজনের রাজনীতি করা। তবে বর্তমানে মিষ্টার বুশ ও টনিব্লেয়ারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন তথা মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত বিবৃতি, হুংকার দেয়া সবচেয়ে বড় কর্মসূচি বামপন্থী রাজনীতির পেটুয়া নেতাদের।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতি বাম ভারতপন্থী কমিউনিস্ট আর ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা মূল ধারার রাজনীতি থেকে ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগকে বরাবরই দূরে রাখতে চেয়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক আদর্শ বলতে যা বুঝে অর্থাৎ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ঈমান আকিদা তথা মৌলিক বোধ বিশ্বাসের বিপরীত ধারার রাজনীতি হল আওয়ামী রাজনীতি। এজন্য দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগকে হাতে তসবিহ মাথায় পট্টি বেঁধে জাতির কাছে অভিনয় করতে হয়েছিলো।
বাংলাদেশের বাস্তবতাকে শেখ হাসিনা যেভাবেই মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন অতীতে বর্তমান ডিজিটাল চুক্তিভিত্তিক ক্ষমতা গ্রহণে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অন্য কারোর হাতে বন্দী। বর্তমান মন্ত্রিসভায় প্রকৃত আওয়ামীলীগ কয়জন আর কমিউনিস্ট কয়জন তা হিসাব নিলেই পরিষ্কার হয় সরকার কারা চালাচ্ছে। মতিয়া আপার শাগরেদরা সরকারের পলিসি মেকার এবং মেনন সাহেবদের সচিব উপসচিবরা প্রশাসনে। সরকারের উদ্ভট সব সিদ্ধান্তগুলোর সাথে এরাই জড়িত। এজন্য শেখ হাসিনার সকল হম্বিতম্বি অরণ্যের রোদন।
তবে আমার বিশ্বাস শেখ হাসিনা এটা জানেন বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে হলে দেশের মৌলিক বোধ বিশ্বাসের বিপরীত কোন কাজ করা যাবেনা। বিশেষ করে ইসলাম ও মুসলিম সেন্টিমেন্টের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ যত আপোষের রাজনীতি করতে পারবে ততই দলটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারবে। শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের সাথে চুক্তি, মাথায় পট্টি, নির্বাচন মুখি ধর্মীয় আচার আচরণে অভ্যস্ত হওয়া যতই মৌলবাদী আচরণ হোক না কেন বাংলাদেশের কমিউনিস্টদেরকে তা মেনে নিয়েই মহাজোটে থাকতে হবে। নতুবা ক্ষমতার যা উচ্ছিষ্ট পাওয়া যাচ্ছে তা ও হারাতে হবে। ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট কাজে লাগানো যতই রাজনৈতিক ভনিতা বলুন আর দ্বৈতনীতি বলুন আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে তা করবে এটা আমার বিশ্বাস। শেখ হাসিনা এই কাজে সকলের চাইতে দক্ষ হিসাবে প্রমাণিত।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি তার জন্মলগ্ন থেকেই ক্ষমতামুখী আর কমিউনিস্টদের রাজনীতি হলো জনবিচ্ছিন্ন মিডিয়া ও বিবৃতিমুখী। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চেতনা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ইত্যাদি বিবৃতি আর টেলিভিশনের টকশোতে অবশ্যই রুচিদায়ক এবং ফলদায়ক। বর্তমান ডিজিটাল সরকারের আমলে তা আরো বেশি স্বাস্থ্যকর। তবে সরকারের অতি উৎসাহী বামদের সকল দায়দায়িত্ব নিতে হবে দলীয়ভাবে আওয়ামীলীগকে এবং ব্যক্তি হাসিনা ওয়াজেদকেই। আজ যারা প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে শেখ হাসিনার চাটুকারিতায় লিপ্ত সেই তারাই বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে সামনের দিনগুলোতে।
দুই :
মিডিয়াকে একটা সীমানার মধ্যে রাখতে পারা ছিলো ফখরুদ্দীন সরকারের বড় একটা সফলতা। বর্তমান সরকার সেই ধারাবাহিকতায় আরো বেশি সফলতা দেখিয়েছে। ডিজিটাল সরকার এখনো পর্যন্ত বিদেশী মুরুববীদের মেজাজ বুঝে কাজ করতে পারছে। বর্তমান বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান যুদ্ধাপরাধীকে লাল গালিচার আতিথেয়তা দিয়ে সরকার সকল জুলুম আর নির্যাতনের লাইসেন্স গ্রহণ করেছে। জাতিসংঘে শেখ হাসিনার মৌলবাদ বিরোধী বক্তব্য দিয়ে আবার সেই হাতিয়ারকে শাণিত করেছেন। তাই মিডিয়াকে স্পষ্ট একটি সীমানাতে ধরে রাখতে পারলে সরকারের আকাম কুকামগুলো নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। জনগণ নতুন করে শেখ মুজিবের এনালগ বাকশাল আর শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাকশালের মধ্যে তফাৎ করতে পারবে। তথ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে মিডিয়ার জন্য আরো এক ডিজিটাল হাত বের করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়া ও স্যাটেলাইট মিডিয়াতে যারা কাজ করেন তারা অবশ্যই সম্মানের। তারা জাতির জাগ্রতবিবেক। সমাজের অনেক কিছুই যা তাদের বদান্যতায় আমরা জানতে পারি। সমাজকে সচেতন করা, সামজের অসংগতিগুলো তুলে ধরার সফলতায় বাংলাদেশের সাংবাদিক জগত সত্যিই প্রশংসনীয়। সরকার ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যারা জাতীয় দ্বায়বদ্ধতা পূর্ণ করছেন তাদেরকে জাতি স্যলুউট করছে এবং করবে। কিন্তু সেইসব সাংবাদিকদের কী বলবো। তাদের কি পরিচয় হবে এই সরকার ক্ষমতার মসনদ থেকে সরে যাবার পর। দালাল সাংবাদিক না কোলাবোরেট সাংবাদিক? কি উপাধি দিয়ে জাতি তাদেরকে বরণ করবে। যারা সম্পূর্ণ দলীয় সিদ্ধান্তে সিন্ডিকেট রিপোর্ট করে জাতিকে প্রভাবিত করতে চায় এবং করছে। একই সাথে একই রিপোর্ট শুধু হেডলাইন পরিবর্তন করে স্টাফ রিপোর্ট করা হচ্ছে। আমি গত দুই মাসের পত্রিকাগুলোর প্রধান রিপোর্টগুলোর (ইন্টারনেট এডিশন) প্রধান শিরোনাম থেকে একটার সাথে আরেকটা মিলালাম। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও তার নেতাদের নিয়ে মোট ৩৩ দিনের সবগুলো রিপোর্ট এক জায়গায় করে পড়লাম। আবার পড়লাম। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি কি সত্যিই ইউরেকা আবিষ্কার করছি না হিম হয়ে যাওয়া বিবেকগুলোর ছবি দেখছি।
আমি মুর্ছা যাবার অবস্থা। কি ভয়ানক ষড়যন্ত্র এবং জঘন্য স্বার্থপরতা। নিজেদের প্রফেশনের প্রতি সামান্য দায়বদ্ধতা থাকলে এভাবে যৌথ অপরাধ করা মোটেই সম্ভব হতো না। পাঠক আমাকে মাফ করবেন আমি পত্রিকাগুলোর সকল সাংবাদিক বন্ধুদেরকে দায়ী করছিনা। এই পত্রিকাগুলোতে অবশ্যই সত্য মিথ্যা বুঝে বিবেকের দ্বারা পরিচালিত এবং সাংবাদিকতার সকল আইন মেনে চলেন এমন সাংবাদিকের সংখ্যাই বেশি। প্রথমআলো, জনকন্ঠ, যুগান্তর এবং নতুনভাবে ইনকিলাব, সমকাল, আমাদের সময়, ভোরের কাগজ সর্বশেষ কালের কন্ঠ এই পত্রিকাগুলোর মূল রিপোর্ট কী হবে তা সিন্ডিকেট করে জামায়াত ও তার নেতৃবৃন্দ নিয়ে স্টোরী রিপোর্ট ছাপে। অন্তত এই ৩৩ দিনের পত্রিকাগুলোর রিপোর্ট তাই প্রমাণ করে।
গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়া, স্যাটেলাইট মিডিয়াতে জামায়াত ও শিবিরের নেতিবাচক খবর পরিবেশনের প্রতিযোগিতা চলছে। কে কত বেশি রং লাগিয়ে, মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখতে পেরেছেন। সত্য মিথ্যা বা সাংবাদিকতার ইউনিভার্সাল মিথ এখানে সম্পূর্ণ পরিত্যজ্য। ডিজিটাল সরকারের চেতনা ধারণ করে যে সাংবাদিকতার রূপ বাংলাদেশের জনগণ অবাক হয়ে দেখছে তাতে সবচেয়ে ক্ষতিই হচ্ছে আমাদের মিডিয়া জগতই এবং তাদের বাসিন্দারা। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ কোন গোপন সংগঠন নয় অথবা সরকার এটাকে এখনো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নাই। তারপরও কেন এই একপেশে প্রচারণা।
বিএনপির ব্যাপারে একটু আধটু ব্যালেন্স করা হয়। পাশাপাশি শেখ হাসিনা যা করছেন তা সবই ভালো। তা গণতন্ত্রের জন্য, তা বাংলার ১৫ কোটি মানুষের জন্য। দলীয় বিবেচনায় আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে লেখা হয় পাঠকের গ্রহণযোগ্যতা পাবার জন্য। অপরদিকে চারদলীয় ঐক্যজোট যা করবে তা ষড়যন্ত্র-তা পাকিস্তান বানানোর-তা গণতন্ত্র হত্যার জন্য এবং তা সুশীল সমাজকে ধ্বংস করার জন্য। অবশ্য এখন মন্ত্রীসহ সকল ডিজিটাল কুলীনদের মুখে সবচেয়ে মুখরোচক বিষয় হলো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করতে চারদলীয় জোটের সকল আয়োজন। কোথায় কোন ক্রাইম করে ধরা পড়লো তাতে সবাই একযোগে হুক্কা হু শুরু করে। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে আপাতত যে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়েছে এবং সুশীল সমাজের মর্গে স্বাধীন মতপ্রকাশের অপারেশন চলছে তাতে মুজিবের বাকশালের আধুনিক রূপ ডিজিটাল বাকশালই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এখানে জামায়াত বড় ফ্যাক্টর নয় বরং ভারতের তাঁবেদারীতে যে বা যারা বাধা হতে পারে তাদের নির্মূল করাই লক্ষ্য। যুদ্ধাপরাধ, মানবতা বিরোধী অপরাধ ইত্যাদি বাহানা মাত্র। মিডিয়ার একটি অংশ পূজনীয় ভারতের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই জামায়াত এবং শিবিরের বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করছে।
তা না হলে জামায়াত শিবিরের ব্যাপারে সকল ভদ্রতা, শালীনতা, নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা সবকিছুই লোভ পায় কেন? ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যখন জানতে পারবে আমাদের কিছু সংখ্যক সাংবাদিক নামের দলবাজ কলম মাস্তানদের কুকর্মের ফিরিস্তি তখন কি মূল্যায়ন করবে? সরকারের অত্যাচারের মাত্রা স্বৈরাচার হিটলার মুসোলিনিকে ছাড়িয়ে গেছে। ক্লাস এইটে, নাইনে পড়ে এমন কিশোর ছেলেদেরকে ধরে যেভাবে শিবিরের ক্যাডার বানিয়ে প্রচার প্রপাগান্ডা করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসারের বাসায় যেভাবে পুলিশ এবং রামদা (ছাত্রলীগ ও যুবলীগ) বাহিনীর আক্রমণ করা হচ্ছে। জাতির জাগ্রত বিবেক মিডিয়ার একপেশে আচরণ এগুলো কোন সভ্য দেশে কল্পনা করা যায়? মিডিয়া এ কাজগুলো করে জামায়াত শিবিরের ক্ষতির পাশাপাশি আমাদের সামাজিক কি কি ক্ষতি হচ্ছে এবং হতে পারে তা একটু ভাবলে দেশ ও জাতির জন্য উপকার হয়। আজাদ ছোবহান আহমাদ

Sunday, 10 October 2010

সংসদকে পাশ কাটিয়ে দেশকে সেক্যুলার রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয় কিভাবে?

সংসদকে পাশ কাটিয়ে দেশকে সেক্যুলার রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয় কিভাবে?
পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর রায় নিয়ে আবার বিতর্ক শুরু হয়েছে। এবারের বিতর্কটি একটু ভিন্ন জাতের। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এবারের বিতর্কের উৎপত্তি হয়েছে মাননীয় প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের একটি উক্তি থেকে। দেশে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তিনি একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। একইদিন তিনি সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে গমন করেন এবং সেখানে পুস্তবক অর্পণ করেন। একাধিক জাতীয় দৈনিক মন্তব্য করেছে যে, দেশের ৪০ বছরে জীবনে কোনো প্রধান বিচারপতির জাতীয় স্মৃতিসৌধে গমন এবং পুস্তবক অর্পণের ঘটনা এবারই সর্বপ্রথম। ঐ সব জাতীয় দৈনিকে আরো বলা হয়েছে যে, কোন প্রধান বিচারপতি কর্তৃক সাংবাদিক সম্মেলন করার ঘটনাও এবারই প্রথম। যাই হোক, সাংবাদিক সম্মেলনে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন যে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল সম্পর্কে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ যেদিন রায় দিয়েছে, সেদিন থেকেই অর্থাৎ চলতি সালের ২রা ফেব্রুয়ারি থেকেই সেই রায় কার্যকর হয়ে গেছে। একজন সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন যে তাহলে তো বাংলাদেশ গত ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে গেছে। সেক্ষেত্রে ইসলামী রাজনীতিও কি দেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যায়নি? উত্তরে প্রধান বিচারপতি বলেন, 'You can draw your own conclusion’ অর্থাৎ আপনি নিজেই নিজের সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন। প্রধান বিচারপতি আরো বলেন যে, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর সুপ্রীম কোর্ট যে চূড়ান্ত রায় দিয়েছে, সেই রায়ের সংশ্লিষ্ট অংশগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এখন প্রয়োজন প্রতিস্থাপিত অংশগুলো সন্নিবেশ করে জনগণের কাছে সার্কুলেট করা। এজন্য সংবিধান নতুন করে মুদ্রণ করার জন্য তিনি আইন মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেন।
প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যের মাত্র চার দিন পর বিচারপতি শামছুদ্দিন এবং জনাব জাকির হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বোরখা পরিধান সম্পর্কে একটি রায় দেয়। ঐ রায়ে বলা হয় যে, পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই একটি ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুল্যার রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে কোনো মানুষকে বোরখা বা টুপি পরতে বাধ্য করা যাবে না।
প্রধান বিচারপতির আলোচ্য বক্তব্য এবং হাইকোর্টের ঐ বেঞ্চের আলোচ্য রায়ের পর সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার এবং কর্তৃত্ব নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। প্রধান বিচারপতির বক্তব্য সমর্থন করেছেন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। এর আগে অনুরূপ মন্তব্য করেছিলেন ড. কামাল হোসেন। গতকাল একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত নিবন্ধে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ঐ মতের প্রতিধ্বনি করেছেন। জাতীয় সংসদ সদস্য বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রধান বিচারপতির ঐ মন্তব্যের আগে নিয়মিত বলে যাচ্ছিলেন যে, সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র জাতীয় সংসদের, অন্য কারো নয়। তবে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের পর তিনি সুর পাল্টিয়েছেন। এখনও তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেননি যে সুপ্রীম কোর্টের রায় কিভাবে বাস্তবায়িত হবে-সেটি কি পার্লামেন্টে একটি বিল পাসের মাধ্যমে হবে, নাকি সুপ্রীম কোর্টের রায়টি সংবিধানে প্রতিস্থাপিত করলেই হয়ে যাবে। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং এলজিআরডি মন্ত্রী আশরাফুল ইসলাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, সংবিধান সংশোধন সম্পর্কে যা কিছুই করা হোক না কেন, সেটি পার্লামেন্টের মাধ্যমে করতে হবে। নৌকার টিকেটে নির্বাচিত ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন বলেছেন যে, সংবিধান সংশোধনের একক ক্ষমতা শুধুমাত্র পার্লামেন্টের রয়েছে। এই প্রশ্নে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মাঝে একটি বিরাট ঐকমত্য দেখা যাচ্ছে। বিএনপি'র মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন, জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত জেনারেল সেক্রেটারি আজহারুল ইসলাম, এরশাদপন্থী জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার এমপি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার রয়েছে কেবলমাত্র পার্লামেন্টের। এখানে আদালতের কোন এখতিয়ার নাই। একই মতের প্রতিধ্বনি করেছেন আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এবং সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রউফ, সুশীল সমাজের ড. মোজাফ্ফর আহমেদ, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, সুপ্রীম কোর্ট বার সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রমুখ।
দুই.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিতর্কে এখন পর্যন্ত নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছেন। এখন পর্যন্ত তিনি স্পষ্ট কোন মন্তব্য করেননি। তিনি কোন স্পষ্ট মন্তব্য না করলেও স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, সংবিধান সংশোধন সম্পর্কিত ১৫ সদস্যের বিশেষ কমিটি তিনি কেন গঠন করেছেন? বলা হয়েছে যে, সুপ্রীম কোর্টের রায়ের আলোকে সংবিধানের প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের লক্ষ্যেই ঐ কমিটি করা হয়েছে। এখন সুপ্রীম কোর্টের রায় সংবিধানে ছাপার অক্ষরে প্রতিস্থাপিত করলেই যদি সব কাজ হয়ে যায় তাহলে ঐ বিশেষ কমিটির জন্য করণীয় আর কিই বা থাকলো? এর বেশ কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে কিনা, সেটি ইলেকশন কমিশনের ব্যাপার। তার সরকার কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে না। কয়েকদিন আগে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদও একই কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী বা আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্য প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। হাইকোর্ট ও সুপ্রীমকোর্টের রায়ের আলোকে এবং প্রধান বিচারপতির বক্তব্য মোতাবেক ইসলামী রাজনীতি ইতোমধ্যেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। ঐ দিকে প্রধানমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে একমত নন নির্বাচন কমিশন। কমিশন সদস্য সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন যে, কোন দলকে নিষিদ্ধ করা না করা নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। তাদের কাজ হলো রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেয়া। তাদের হাতে রয়েছে আরপিও। কোনো দলের গঠনতন্ত্র যদি দেশের সংবিধানের সাথে সংগতিপূর্ণ না হয় তাহলে তারা সেই দলকে গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে বলবেন এবং দেশের সংবিধানের সাথে সংগতিপূর্ণ হতে বলবেন। এ ব্যাপারে ইসলামী দল বা অন্য কোন দল বলে তাদের কাছে কোন কথা নেই। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সুপ্রীমকোর্টের রায়, সংবিধান সংশোধন এবং ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, নির্বাচন কমিশন এবং উচ্চ আদালতের মাঝে রয়েছে বেশ বড় দূরত্ব। অনুরূপভাবে একই প্রশ্নে দেশের পলিটিশিয়ান এবং সুপ্রীমকোর্টের মাঝে রয়েছে বড় ব্যবধান। সম্ভবত এসব বিষয় টের পেয়ে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এবং সাবেক বিচারপতি গোলাম রববানীরা একটি কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তারা বলছেন যে, সুপ্রীমকোর্ট আসলে সংবিধান সংশোধন করেন। বরং অতীতের অবৈধ পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছে। এসব কথা বলে তারা সমগ্র বিষয়টিকে শুধুমাত্র তালগোলই পাকিয়ে ফেলছেন না, বরং নিত্যনতুন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন এবং ‘প্যান্ডোরার বাক্স' খুলে দিচ্ছেন। তারা বলতে চাচ্ছেন যে, মার্শাল ল' বলে সংবিধানে কোন আইন নাই। সামরিক শাসকরা নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। তাই সামরিক বিধি বেআইনী। সামরিক শাসনের বলে যারা ক্ষমতায় এসেছেন তারাও বেআইনী। পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ সামরিক বিধি এবং বেআইনী সামরিক শাসকের সৃষ্টি। তাই সেটি বেআইনী। বলা হয়েছিল যে, পঞ্চম সংশোধনী প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অনুমোদন করেছে পার্লামেন্ট। অতঃপর সেটি গণভোটে পাস হয়েছে। এই যুক্তির জবাবে বিচারপতি খায়রুল হক রায় দিয়েছেন যে, ঐ পার্লামেন্ট সৃষ্টি হয়েছিল অবৈধ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নির্দেশ বলে। জিয়াউর রহমান ছিলেন অবৈধ শাসক। তাই তার যে নির্দেশ বলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং পার্লামেন্ট গঠিত হয় সেটিও ছিল অবৈধ। সুতরাং সেই পার্লামেন্টও ছিল অবৈধ। এছাড়া '৭২-এর সংবিধানে গণভোটের কোন বিধান ছিল না। এটি যুক্ত করা হয় ১৯৭৭ সালে এবং পঞ্চম সংবিধান সংশোধনীতে সেটি অনুমোদন করা হয়।
তিন.
ঠিক এখানে এসেই প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যায়। যে সব যুক্তিতে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে তার একটি হলো এই যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কর্তৃক শাসিত হয়নি, শাসিত হয়েছে ডিকটেটর এবং ক্ষমতা দখলকারীদের দ্বারা। ফলে বাংলাদেশ তার সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রী চরিত্র হারিয়ে ফেলেছিল। একই সময় বাংলাদেশে ছিল না কোন পার্লামেন্ট। ফলে সে তার গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে ছিল। আরো বলা হয়েছে যে, পঞ্চম সংশোধনী সংক্রান্ত ফরমানে সংবিধানের মৌলিক চরিত্র ধ্বংস করা হয়েছিল। এসব মৌলিক চরিত্রের মধ্যে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, আদালতকে বাইরে রাখা ইত্যাদি। ঐ রায়ে আরো বলা হয়েছে যে, পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করতে পারে ঠিকই, কিন্তু সেটি হতে হবে সংবিধানের সাথে সংগতিপূর্ণ। এভাবে পঞ্চম সংশোধনীর খোল নলিচাকে অবৈধ ঘোষণা করেও ধারাবাহিকতার স্বার্থে এবং বিশৃক্মখলা এড়ানোর উদ্দেশ্যে পঞ্চম সংশোধনীর কতিপয় ব্যবস্থাকে Condone বা মার্জনা করা হয়েছে। এখানে উঠে আসে অনেকগুলো প্রশ্ন।
সেই প্রশ্নের অবতারণা করেছেন সুপ্রীম কোর্ট বার সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন। গত ৭ অক্টোবর ‘দৈনিক সংগ্রামকে' প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘আমি একটু পেছনে ফিরে দেখতে চাই। আমাদের সংবিধান সংশোধন নিয়ে সর্বত্রই যে আলোচনার ঝড় উঠেছে তার পেছনের খবর কিন্তু অনেকে জেনেও না জানার ভান করছেন। কারণ, ১৯৭০ সালের নির্বাচন কিন্তু এদেশে হয়েছে সামরিক ফরমানের ভিত্তিতেই। আর তারপরে আমাদের সংবিধানও রচনা হয়েছে সেই সামরিক ফরমানের ভিত্তিতেই। সব সামরিক ফরমান যদি অবৈধ হয়ে যায় তাহলে খোদ আওয়ামী লীগই তো রাজনীতি করার কোন সুযোগ পায় না। তাদেরকে আজো বাকশালেই থাকতে হতো।’’ খন্দকার মাহবুব হোসেন কোন কিছু বাড়িয়ে বলেননি। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান প্রধান সেনাপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা তুলে দেন এবং সারা পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি হয়। অথচ তার আগের দিনও পাকিস্তান শাসিত হযেছে ১৯৬২ সালে প্রণীত সংবিধানের অধীনে। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জাস্টিস হামুদুর রহমান ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরকে অবৈধ ঘোষণা করেন। জাস্টিস হামুদুর রহমান একজন বাঙালি। তিনি ঢাকা হাইকোর্টের বিচারক ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। তার রায়ে তিনি বলেন, ‘‘যেহেতু তখন পাকিস্তানে ছিল সাংবিধানিক শাসন, তাই সংবিধান মোতাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের উচিত ছিল পাকিস্তান পার্লামেন্টের স্পিকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।’’ এটি অনেকটা বাংলাদেশের ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্টের ঘটনার মত। সেদিনও দেশে সংবিধান চালু ছিল। সংবিধান মোতাবেক প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের অবর্তমানে স্পিকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়া উচিত ছিল।
যাই হোক, পাকিস্তানের অবৈধ সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ৩১ মার্চ ‘লীগাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডার' বা এল এফ ও জারি করেন। এই এল এফ ও'তে ছিল একটি নির্দেশনামূলক আইন। তাতে ছিল ২৭টি অনুচ্ছেদ এবং ৩টি তফসিল। এই এল এফ ও'র অধীনেই ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ঐ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদই বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন করে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের ফরমানে গঠিত বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ যদি অবৈধ হয় তাহলে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের ফরমান বলে গঠিত জাতীয় সংসদও কি অবৈধ হয়ে যায় না? বলা হয় যে, পঞ্চম সংশোধনীর রায় হয়েছে কঠোরভাবে আইনের দৃষ্টিতে। তাহলে সেই কঠোরভাবে আইনের দৃষ্টিতে বিচার করলে এল এফ ও'র অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বৈধ হয় কিভাবে?
পঞ্চম সংশোধনী বাতিল রায়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলো রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। আরো আছে চতুর্থ সংশোধনী বাতিলকে জায়েজ করা। আরো বলা হয়েছে যে, সংবিধানের মূল চরিত্রের বাইরে হলে পার্লামেন্টও কোন সংশোধন করতে পারবে না। তাহলে চতুর্থ সংশোধনীর ব্যাপারে ঐ রায় বিস্ময়করভাবে নীরব কেন? এসব প্রশ্ন এবং আরো অন্যসব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা রইল বাড়ান্তরে।

বিবেকের দংশন ও বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মন্তব্য

সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতির উপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন যে, দেশ এখন বাজিকরদের হাতে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দলবাজি, নিয়োগবাজি, মতলববাজি, দখলবাজি, ভর্তিবাজির মতো বিভিন্ন বাজির আস্ফালন দেখে দেশের মানুষ এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি প্রশ্ন তুলে আরো বলেছেন যে, যেখানে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী চাকরির জন্য তিন লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয় সেখানে মেধাভিত্তিক প্রশাসন গড়ে তোলার সম্ভাবনা কোথায়?
সাবেক এই বিচারপতি স্বাধীনতার প্রত্যাশা ধ্বংস করা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পদদলন এবং ক্ষমতায় যাবার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ধ্বংসাত্মক তৎপরতার আশ্রয় গ্রহণ ও জনগণের সাথে প্রতারণার বিরুদ্ধেও তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি পরিবারতন্ত্র এবং দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক হানাহানি ও প্রতিহিংসার সংস্কৃতিতে উষ্মা প্রকাশ করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সুশাসন ও জাতীয় সংহতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে বিবেকের দংশন তাকে এই মন্তব্যে উদ্বুদ্ধ করেছে বলে মনে হয়।
বিচারপতি হাবিবুর রহমানের উপরোক্ত অভিমত ও পরামর্শকে আমরা আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। দেশে সুশাসন, সহনশীলতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার এই মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আমাদের ধারণা। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় ব্যর্থতার মূলে রয়েছে লোভ-লালসা, একনায়কতান্ত্রিক প্রবণতা, ফ্যাসিবাদ এবং শাসকদলের দুর্বল জবাবদিহিতা। একটি দল দেশকে তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি বলে মনে করে। তারা আরো মনে করে যে, শাসন করার অধিকার একমাত্র তাদেরই, অন্য কোনও দল বা গোষ্ঠীর নয়। এই প্রবণতা তাদেরকে চরম ফ্যাসিবাদের দিকে ঠেলে দেয়, নির্বাচনে কারচুপি ও পেশীশক্তির ব্যবহার এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বনিদ্বদের নির্যাতনে অনুপ্রেরণা যোগায়। তারা যখন সরকারে থাকে তখন দেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হয়, দেশ তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়, মানুষের জীবন, সম্পত্তি ও সম্মানের নিরাপত্তা থাকে না, প্রতিদ্বনদ্বী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা হামলা, মামলা, হত্যা ও গুমের শিকার হয়। এ প্রেক্ষিতে বিচারপতি হাবিবুর রহমান যথার্থই বলেছেন যে, দেশ এখন বাজিকরদের অধীনে চলে গেছে। এই বাজিকররা হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহের চিহ্নিত চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ভর্তিবাজ, নিয়োগবাজ, দলবাজ, মতলববাজ ও দখলবাজ নেতাকর্মী, তাদের অত্যাচারে দেশের মানুষ এখন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। সরকার তার দলীয় সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে দেশব্যাপী সন্ত্রাসী জঙ্গি খুঁজে বেড়াচ্ছে। সততা, দেশপ্রেম ও নিষ্ঠা তথা আদর্শ দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিদ্বনিদ্বদের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে বানোয়াট অভিযোগে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে তাদের অভিযুক্ত করে বিচারের নামে প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের গত ২২ মাসের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে এক হতাশাব্যঞ্জক চিত্রই ফুটে ওঠে। পাঁচ বছর মেয়াদী এই সরকারের এক-তৃতীয়াংশ মেয়াদ পার হয়ে গেলেও বিরোধীদলের উপর নির্যাতন, লুটপাট এবং ধর্মবিরোধী তৎপরতা ছাড়া তার উল্লেখযোগ্য কোনও সাফল্য জনগণের দৃষ্টিতে পড়ে না। বলাবাহুল্য, বিগত নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করেছিল। এই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ক্ষমতায় গিয়ে তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাঁচটি কাজ করার কথা ছিল। এই কাজগুলো ছিল : এক. দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। সরকার গত ২২ মাসে এক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন জনসভায় দশ টাকা কেজি চাল এবং বিনামূল্যে সার দেয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তার দল এই প্রতিশ্রুতিটি অস্বীকার করেন। চাল, ডাল, তেল, নুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্য এখন সাধারণ মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, চারদলীয় জোট সরকারের আমলের তুলনায় পণ্য ভেদে শতকরা ১২৫ ভাগ থেকে ৩০০ ভাগ বেশি। তাদের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল দুর্নীতি রোধ। এক্ষেত্রে তারা সুনির্দিষ্টভাবে চাঁদাবাজি, ঘুষ, রিসওয়াত, টেন্ডারবাজি, চোরাকারবার প্রভৃতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এ কাজটিও তারা করতে পারেননি। নিজ দলের শীর্ষ নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে আদালতে বিচারাধীন সকল দুর্নীতি এমনকি খুনের মামলাও প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, দলীয় চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ ও দখলবাজদের হাতে দেশকে তুলে দিয়ে এক নৈরাজ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। ফলে দুর্নীতি বেড়েছে এবং দেশে এক অসহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের তৃতীয় অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং ২০১১ সালের মধ্যে ৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে লোডশেডিংকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা। এক্ষেত্রেও তাদের ব্যর্থতা প্রণিধানযোগ্য। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতো দূরের কথা, পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বিদ্যমান উৎপাদন লেভেলও তারা ঠিক রাখতে পারছেন না। বিদ্যুতের নতুন আবাসিক ও শিল্প সংযোগ বন্ধ রয়েছে এবং দেশব্যাপী লোডশেডিং মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এর সাথে যোগ হয়েছে গ্যাসসংকট। ফলে মানুষের জীবন এখন ওষ্ঠাগত।
দারিদ্র্যবিমোচন ও সমাজের অসাম্য দূরীকরণ ছিল ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির চার নম্বর অগ্রাধিকার। এক্ষেত্রেও তাদের ব্যর্থতা সর্বকালের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। খাদ্যসামগ্রীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর ঊর্ধ্বমূল্যের ফলে দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এখন বিরাট হুমকির মুখে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ায় দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধা সাংঘাতিকভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা আছে ক্ষমতাসীন দলের উৎপাতে সাধারণ মানুষ তার নাগাল পাচ্ছে না। ফলে দারিদ্যের মাত্রা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠা তাদের পঞ্চম অগ্রাধিকার ছিল এবং এই প্রতিশ্রুতিতে বলা হয়েছিল যে, তারা দেশে আইনের শাসন কায়েম করবেন, প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করবেন এবং বিচার বিভাগকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবেন এবং পুলিশ বিভাগ নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে। এছাড়াও তারা সন্ত্রাস, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ দমন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করবেন। তাদের প্রতিশ্রুত সুশাসন এখন দুঃশাসনে পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাস দমনের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দলীয় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, দখলবাজরা এখন দেশ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সরকারের সমস্ত সম্পদ এবং মনোযোগ এখন বিরোধীদল দমনের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে বলে মনে হয়। ধর্মীয় জঙ্গিবাদ দমনের নামে তারা এখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুশাসনগুলোকে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। নিরপরাধ আলেম-ওলামা, ইসলামী রাজনীতিবিদ ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা এখন তাদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছেন এবং নির্যাতিত হচ্ছেন। এই অবস্থার অবসান প্রয়োজন। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের অভিমত আমরা মনে করি সরকারকে তার নীতি ও কর্মপদ্ধতি সংশোধনে সহায়তা করবে। আর যদি না করে তাহলে দেশ এবং জাতির জন্য তা যেমন দুঃখজনক হবে তেমনি সরকারের জন্যও তা কল্যাণকর হবে বলে আমরা মনে করি না। কেননা ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে, যারা জনগণের কল্যাণে কাজ করেন না, ব্যক্তি ও দলীয় উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে গিয়ে নির্যাতনের আশ্রয় নেন এবং ইতিহাসের শিক্ষাকে উপেক্ষা করেন তারা ইতিহাসের অাঁস্তাকুড়েই নিক্ষিপ্ত হন।

Friday, 8 October 2010

কিছু ঘটনা ও একটি বিক্ষিপ্ত সংলাপ

কিছু ঘটনা ও একটি বিক্ষিপ্ত সংলাপ
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে বাংলাদেশের সামরিক বেসামরিক গোয়েন্দাদের দক্ষতা ও কার্যকারিতা সাম্প্রতিককালে বিরাট প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে পিলখানায় যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে ইতিহাসে তার নজির বিরল। এতে বাংলাদেশ সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী আমাদের ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ রাইফেলস-এর প্রধান ও উপ-প্রধানসহ সেনাবাহিনীর প্রায় পাঁচ ডজন মেধাবী ও চৌকষ কর্মকর্তা মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। এদের অনেকের স্ত্রী সন্তানরাও খুনীদের হত্যা ও পাশবিক লালসা থেকে রেহাই পাননি। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, সুপরিকল্পিত এই হত্যাযজ্ঞ ও বিদ্রোহের কোনও আভাস আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কেউই দিতে পেরেছেন বলে সরকারীভাবে আমরা জানতে পারিনি। আবার দিলেও হয়তো তা কাজে লাগানো হয়নি। আবার এই হত্যাযজ্ঞের তদন্তের জন্য গঠিত কমিটিগুলোর অভিযোগ অনুযায়ী তদন্ত কাজে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তাদের সহযোগিতাও করেনি। আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি এবং আর্মির তরফ থেকে গঠিত কমিটি উভয়েই বিদ্রোহ ও হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করার জন্য আরো সম্প্রসারিত তদন্তের সুপারিশ করেছে। সরকার তা না করে দেশব্যাপী বিডিআর জওয়ানদের বিচার শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে আবার অভিযুক্ত জওয়ানদের মধ্যে ৮০ জন জওয়ান রিমান্ডের নির্যাতনে নির্মমভাবে প্রাণ হারানোর অভিযোগও উঠেছে। এই অভিযোগ অনুযায়ী নিহত ব্যক্তিরা প্রকৃত ঘটনা জানতো এবং তারা জীবিত থাকলে বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাযজ্ঞের কুশীলবদের অনেকেরই নাম পরিচয় বেরিয়ে আসত, যার ফলে ক্ষমতাসীন অনেক রাঘব বোয়ালই ফেঁসে যাবার আশঙ্কা ছিল। বিচার বহির্ভূত এই মর্মান্তিক হত্যার দায় সরকারকেই বহন করতে হবে বলে দেশবাসী মনে করেন। এখানে যে প্রশ্নটি উঠেছে এবং বার বার আমাদের বিবেককে তাড়া দিচ্ছে তা হচ্ছে আমাদের সামরিক, বেসামরিক ও আধাসামরিক গোয়েন্দারা এই সময় কি করেছেন। বিডিআরকে ধ্বংস করে দেয়া হলো, আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রতীক সেনাবাহিনীকে পঙ্গু করে দেয়া হলো, গোয়েন্দারা টের পেলেন না এটা কেমন করে হয়? আবার তারা থাকতে ভারতীয় গোয়েন্দারা সার্বক্ষণিক ঘটনার অগ্রগতি অবনতি মনিটরিং করলো কিভাবে? জাতির প্রতি তাদের জবাবদিহিতা কি? সরকার তাদের কৈফিয়তও তলব করলেন না; দায়িত্বে অবহেলার জন্য তাদের কারোর চাকরি গেল না, জরিমানাও হলো না, এটা কি গ্রহণযোগ্য? মানুষের মনে দিন দিন এ ধরনের প্রশ্নের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেননা এই একটি ঘটনা (বা দুর্ঘটনা) শুধু আমাদের সরকারের কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকেও অনিশ্চিত করে তুলেছে। আমাদের বর্ডার এখন অরক্ষিত। প্রতিবেশী দেশের হার্মাদ বাহিনীর অত্যাচার, হামলা ও লুটপাট ও খুন, রাহাজানিতে সীমান্তবাসীদের জীবন ওষ্ঠাগত প্রায়। কেউ কেউ আবার মনে করছেন যে, সরকার আধিপত্যবাদী শক্তির আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পরিকল্পিতভাবে আর্মি বিডিআরকে অকার্যকর করে রাখছেন; ক্ষমতার স্বার্থে তাদের যতটুকু ব্যবহার করার করছেন, জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন যখন আসছে তখন তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন অথবা জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে অকার্যকর অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। আমি জানি না মানুষের এই ধারণা কতটুকু সত্য, তবে এটা বুঝি যে, এর শতভাগও যদি সত্য হয় তাহলে এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এই সরকারের কাছে নিরাপদ থাকতে পারে না। নিরাপদ যে নয়, তার লক্ষণও ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন যে, ইদানিংকালে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে ভাঙা এবং এসব দলের নেতাকর্মীদের নির্মূলের কাজে সরকার গোয়েন্দাদের এত ব্যস্ত রেখেছেন যে, তারা আসল কাজ ভুলে গেছেন।
রাষ্ট্রের কার্যকারিতা ও স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তা সংরক্ষণের জন্য কয়েকটি অপরিহার্য উপাদান প্রয়োজন। অগ্রাধিকার ক্রম অনুযায়ী এর প্রথমটি হচ্ছে আর্মি ও দেশরক্ষা বাহিনী, দ্বিতীয়টি জাতীয় সংহতি, তৃতীয় জাতীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় বিশ্বাস এবং চতুর্থ উপাদান হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ ও কার্যকর প্রশাসন। এই সরকার আমাদের আর্মি এবং দেশ রক্ষা বাহিনীকে যে অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছেন তাতে বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকানোর মত অবস্থানে তারা আছেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ সংশয় দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বিডিআর বিদ্রোহ ও সেনা কর্মকর্তাদের হত্যাযজ্ঞের পর পেশাগত দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও নিরাপত্তা নিয়ে তারা কাজ করতে পারছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। সীমান্তে বৈদেশিক হামলা প্রতিহত করার অধিকার তাদের নেই। বিদেশীরা আমাদের ভূখন্ড দখল করে সেখানে ট্রাক্টর-পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষাবাদ করে, ফসল লুট করে, মাছ ধরে নিয়ে যায়, বেসামরিক সীমান্তরক্ষীরা তাদের প্রতিরোধ করে, এলাকা পাহারা দেয়, আমাদের রক্ষীদের প্রতিরোধের হুকুম নেই। বিডিআর প্রধান অকুস্থলে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এর জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। এর অর্থ কি? আমাদের আর্মী ও সীমান্ত বাহিনীকে কি অকার্যকর করে দেয়া হয়েছে? বিদেশী আগ্রাসন প্রতিরোধের ক্ষমতাই যদি তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাওয়া হয়ে থাকে তাহলে তাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনই বা কি? হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়ন, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট তৈরি, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুত প্রভৃতিসহ অন্যান্য ত্রাণ ও পূর্ত কাজে তাদের সহযোগিতা মূল্যবান বিবেচিত হতে পারে কিন্তু তা তাদের মূল পেশার বিকল্প হতে পারে না। দলীয় রাজনীতির নোংরা ব্যবহার সেনাবাহিনীকে কলংকিত করুক এবং এভাবে তারা ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলুক এটা জাতির কাম্য নয়। তবে দুঃখজনক হচ্ছে, সরকার তাই করছেন এবং স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তাকে নাজুক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। দ্বিতীয়তঃ এই সরকার দেশব্যাপী হিংসা, বিদ্বেষ, বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক চেতনাকে উস্কিয়ে দিয়ে যে হানাহানির পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন তাতে খোদা না করুক দেশ ও জাতির উপর যদি কোনও হামলা আসে তা হলে ঐক্যবদ্ধভাবে তা মোকাবিলা করার সামর্থ্য ও সম্ভাবনা দিন দিন আমরা হারিয়ে ফেলছি। রাজনৈতিক প্রতিদ্বনিদ্বদের নির্মূল ও দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার যে মহোৎসব এখন চলছে আমার দৃষ্টিতে তার পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। এর সাথে এখন যুক্ত হয়েছে ‘যুদ্ধাপরাধ' বিচারের ফরমায়েসী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কসরত। সাধারণ মানুষ এতদিন এ ব্যাপারে নির্বিকার ছিল। এখন অনেকে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন বিষয়টি কি। যুদ্ধাপরাধ কি, নিজামী, মুজাহিদ, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা, মীর কাশেম আলী এরা যুদ্ধাপরাধী হয় কি করে? প্রশ্নকর্তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংখ্যাও কম নয়। তারা আইন পড়েননি। তারা মনে করেন, স্বাধীনতা অর্জন, ভূখন্ডের নিরাপত্তা রক্ষা, বিদেশী হামলা প্রতিরোধ অথবা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা কিংবা এলাকা দখল কিংবা পুনরুদ্ধারের জন্য দু'টি দেশের মধ্যে যে সংঘাত-সংঘর্ষ হয় তার নাম যুদ্ধ। এই যুদ্ধে দু'টি সেনাবাহিনী জড়িত থাকে এবং যুদ্ধরত সেনা বাহিনীর কেউ যদি মানবতা বিরোধী কোনও অপরাধ করে, বেসামরিক লোককে হত্যা করে, তাদের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয় অথবা তাদের বাড়ী ছাড়া করে কিংবা কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে আটকে রাখে, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন করে তাহলে তারা যুদ্ধাপরাধী বলে বিবেচিত হন। বাংলাদেশে যাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়েছে তারা যুদ্ধরত কোনও বাহিনীর কখনো কোনও সদস্য ছিলেন না এবং গত ৪০ বছরে তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অপপ্রচার ছাড়াও কোনও থানায় সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবেও কোনও মামলা হয়নি। আবার অপরাধী কখনো তার অপরাধী চরিত্রকে ঢেকে রাখতে পারে না। অভিযুক্ত এই নিরপরাধ রাজনীতিকরা যদি প্রকৃত অর্থে অপরাধীই হতেন তাহলে গত চার দশকে অবশ্যই তাদের কাজকর্মে এই অপরাধের অভিব্যক্তি দেখা যেতো। তারা তাদের স্ব স্ব এলাকায় নয় শুধু, সারাদেশে রাজনীতির পাশাপাশি সামাজিক কাজকর্ম করেছেন, জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, ভোট পেয়েছেন, অনেকে এমপি হয়েছেন, কেউ কেউ মন্ত্রীত্বও করেছেন। তাদের দীর্ঘ ও বিস্তৃত সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী কোনও অপরাধের অভিযোগ উঠেনি, প্রমাণিত হয়নি, স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি, দুর্নীতির অভিযোগও কেউ আনতে পারেনি, কেয়ারটেকার সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার তন্ন তন্ন করেও তার সন্ধান পায়নি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে কেন তারা ৪০ বছর আগের বানোয়াট অপরাধের জন্য তাদের অভিযুক্ত করছে? আমার এক সহকর্মী বন্ধু এককালে ছাত্রলীগের প্রথম সারির লাঠিয়াল ছিলেন। পরে তিনি রক্ষী বাহিনীর মেজর হয়েছিলেন। মেজর সৈয়দ কামালুদ্দিন। তিনি বলতেন আওয়ামী লীগ করলে মাথার বুদ্ধি হাঁটুতে চলে আসে। সম্ভবত যুদ্ধাপরাধের মামলার কারণও তাই। উদ্দেশ্য দু'টি, রাজনৈতিক প্রতিদ্বনিদ্বদের নির্মূল করা এবং ক্রমবিকাশমান ইসলামী আদর্শ এবং ইসলামী রাজনীতিকে নেতৃত্বশূন্য করে এদেশের বুকে ধর্ষক বাজিকরদের ভবিষ্যতকে নিষ্কণ্টক করা। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই সরকার দেশের ধর্মভীরু সকল হক্কানী আলেম ওলামা, মাদরাসা শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, রাজনীতিবিদ সকলকেই জঙ্গী যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। কোনও পুরোহিত পাদ্রী তাদের তালিকায় নেই। কারুর কাছে ইসলামী বইপত্র পেলেই বলা হচ্ছে জেহাদী বই পাওয়া গেছে এবং পুলিশ তা তুলে এনে অবমাননা করছে। বৃটিশরা যখন এদেশ শাসন করতো তখন এদেশে বিধর্মী শাসন প্রচলিত ছিল। তাদের আমলেও কুরআন হাদিস এবং আলেম উলামাদের এই এ ধরনের অবমাননা হতো কিনা সন্দেহ রয়েছে। ধর্ম ও আদর্শ মানুষের মানবিক মূল্যবোধকে বিকশিত করে। ধর্মছাড়া মূল্যবোধ সৃষ্টি ও চরিত্র গঠনের দ্বিতীয় কোনও পন্থা নেই। আর আদর্শ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা ছাড়া কোনও জাতি টিকে থাকতে পারে না। আমাদের সরকার ও সরকারি দল ধর্ম, ধর্মীয় মূলবোধ এবং নৈতিকতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। ছাত্রলীগ, যুবলীগ এর অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। জাতির বিবেক এখানে কন্ঠরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
একইভাবে জন প্রশাসনও আজ তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। নিরপেক্ষ মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তাদের ওএসডি করে রাখা হয়েছে। দলীয় আনুগত্য, নিয়োগ পদোন্নতি ও পদায়ন-পোস্টিং এর মুখ্য নিয়ামকে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনে জুনিয়রকে সিনিয়র এবং সিনিয়রকে জুনিয়র এবং মেধার স্থান দলীয় আনুগত্য দখল করায় সরকারি দফতরগুলো এখন কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুর পরিবর্তে বিশৃক্মখলা ও চক্রান্তের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। জনপ্রশাসন আর পুলিশ প্রশাসনই বলুন দলীয় ক্যাডারদের কথামতোই তাদের উঠবস করতে হয়। তাদের কথা না শুনলে পুলিশ কর্মকর্তা আর প্রশাসনিক কর্মকর্তা কেউই ক্যাডারদের নির্যাতন মারধর থেকে রক্ষা পান না। এর জন্য বিচারও নেই। ফলে উপজেলা থেকে সচিবালয় পর্যন্ত সর্বত্র হতাশা-অনিশ্চয়তার কালো ছায়া গ্রাস করে নিয়েছে। জনপ্রশাসন তার নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। অদক্ষতা ও দুর্নীতি দৈনন্দিন জীবনের অংশে পরিণত হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছে। ধর্ষণ, খুন, গুম, রাহাজানি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ আইন-শৃক্মখলার সীমাহীন অবনতি মানুষের জীবন, সম্পত্তি ও সম্মানের নিরাপত্তাকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। মানুষের সামনে এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারাণ্টিও নেই। আমি রাষ্ট্রের কার্যকারিতা এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য চারটি উপাদানের কথা বলেছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত: এই চারটি উপাদানই আজ হুমকির মুখে। এই অবস্থায় দেশের ভবিষ্যত নিয়ে দেশবাসী উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেন না। তাদের এই উদ্বেগ উৎকণ্ঠাকে প্রতিরোধে রূপান্তর করে দেশকে রাহুমুক্ত করার দায়িত্ব বিরোধীদল সরকারিদলের দেশপ্রেমিক অংশের। তারা যাতে তাদের সে দায়িত্ব পালন করতে না পারেন তার জন্য দেশব্যাপী হামলা-মামলা, খুন-নির্যাতন অব্যাহত রাখা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী ছাত্র সংগঠনের দলীয় কোন্দলে সংঘটিত একটি হত্যাকান্ডকে অছিলা করে দেশব্যাপী জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে ক্র্যাক ডাউন, বিএনপি উৎখাতের সরকারি পরিকল্পনা, বড়াইগ্রামের উপজেলা চেয়ারম্যান হত্যা, সিরাজগঞ্জের ট্রেন দুর্ঘটনা ও হাজার হাজার বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা এবং সর্বশেষ রূপগঞ্জের ঘটনাকে আমি একইসূত্রে গাঁথা বলে মনে করি। রূপগঞ্জের ঘটনায় ভূমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে সেনা ক্যাম্পে হামলা ও অগ্নিসংযোগ, হেলিকপ্টারযোগে সেনা কর্মকর্তাদের উদ্ধার রাতারাতি ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার অভিব্যক্তি হতে পারে না। একটা কথা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। সেনাবাহিনীর হাউজিং-এর জন্য জমি কিনতে দালালের দরকার হবে কেন? আবার এজন্য ২৪টি পরগনার জমি বিক্রি ও রেজিস্ট্রি বন্ধই বা করে দেয়া হবে কেন? ইতোপূর্বে ডিফেন্স অফিসার্স হাউজিং সোসাইটির জন্য জমি সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি আমি পুক্মখানুপুক্মখরূপে তলিয়ে দেখেছি। কোথাও এ ধরনের প্রক্রিয়া আমার নজরে পড়েনি। আরেকটি বিষয়ও এখানে আমার কাছে বিস্ময়কর ঠেকেছে। ডিজিডিএফআই ও অন্যান্য সেনা কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের সাথে এ ব্যাপারে মিটিং করতে গেলেন কেন এবং এই মিটিং-এর পরপরই এলাকাবাসীর ক্ষোভ বিক্ষোভে রূপান্তরিত হলো কেন? গোয়েন্দারা এর কোনো আভাস দিতে পারলো না কেন? এটা কি পরিকল্পিত? দৈনিক প্রথম আলোর অনুসন্ধানী রিপোর্ট অনুযায়ী রূপগঞ্জে জমির বর্তমান বাজার মূল্য বিঘাপ্রতি ৩০ থেকে ৭০ লাখ টাকা অথচ সেনাবাহিনী হাউজিং-এর জন্য এই জমি বিঘাপ্রতি ১৪/১৫ লাখ টাকা দরে বিক্রি করতে একটি মহল জমির মালিকদের বাধ্য করছিল। এই মহলটির পরিচয়ও তারা দিয়েছেন এবং বলেছেন যে কায়েতপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জায়েদ আলী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের আরেক নেতা তারেক হচ্ছে এই দালাল চক্রের হোতা। এ তথ্য থেকে রূপগঞ্জ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে পড়ে। তারা যে দালালী করে অর্থবিত্ত উপার্জনের একটি উৎস খুঁজে পেয়েছিলেন এতে সন্দেহ নেই। তবে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর রুদ্ররোষকে সেনাবাহিনী এবং বিএনপির দিকে ঠেলে দিয়ে তারা যে অপরাধ করেছেন তা অমার্জনীয়। ঘটনার সাথে সাথে আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল আলম হানিফ এর জন্য বেগম জিয়াকে দায়ী করে বিবৃতি দিয়েছেন। মামলার পর এখন হয়ত বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলসমূহের নেতাকর্মীদের ধর-পাকড় শুরু হবে। তাদের জেলে পুরে, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে সরকারি দল নিজের কু-কর্ম ও দুঃশাসন ঢাকা দিতে পারায় স্বস্তির ঢেকুর তুলবেন। এই ঢেকুর যে শেষ পর্যন্ত জীবন বিধ্বংসী বিষমে পরিণত হবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়? দেশের মানুষ আর বেশি ঘুমিয়ে থাকবেন বলে আমার মনে হয় না।
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter