Flickr

Saturday, 28 May 2011

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্য

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্য
 
দেশে ক্রমশ প্রশাসনিক নৈরাজ্যের কালোছায়া বিস্তৃত হতে শুরু করেছে। দলীয় সন্ত্রাসীদের প্রতি রাজনৈতিক প্রশ্রয় ও মমত্ববোধ প্রশাসনিক শৃক্মখলা ও আইনের শাসনকে বিকল করে দিতে শুরু করেছে। দেখা যাচ্ছে, সরকার প্রশাসনিক পর্যায়ে বা রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায় সন্ত্রাসের দানবদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নিতে পারছে না। সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের বিস্তার শুধু সামাজিক ও প্রশাসনিক শৃক্মখলাকেই বিকল করে দেয়নি। এর কালোথাবা শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষা-প্রশাসনকেও গ্রাস করে নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ‘দৈনিক সংগ্রাম' গত মঙ্গলবার ‘শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে মুখোমুখি ছাত্রলীগের দু'গ্রুপ যেকোন মুহূর্তে সংঘর্ষের আশঙ্কা' শীর্ষক একটি উদ্বেগজনক খবর প্রকাশ করেছে। এদিকে মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজের শিক্ষক নিয়োগের ঘটনায় ক্ষমতাসীন শাসকদল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ হস্তক্ষেপ করার ফলে ওই কলেজে তিনদিন ধরে ক্লাস বন্ধ রয়েছে। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের তান্ডবে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্রলীগের তান্ডব এখন আর প্রতিপক্ষের ছাত্র সংগঠনসমূহের ওপর আধিপত্য বিস্তারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ছাত্রলীগ চাঁদাবাজি, হল দখল, মাদক ব্যবসা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং টেকনিক্যাল-মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর তাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে শুরু করেছে। শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজ, সাধারণ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা ও ফলাফল ছাত্রলীগের ক্যাডারদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এসব ক্যাডার ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কমান্ডে চলছে। অন্যদিকে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়োগে পেশাগত দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতার বদলে দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য দেয়ায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অধ্যক্ষ-ভিসি কিংবা শিক্ষা-প্রশাসক সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ সদস্যদের বিরুদ্ধে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন শৃক্মখলাভঙ্গের ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। কেননা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ব্যক্তি যেভাবে তার রাজনৈতিক নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য পোষণ করেন, একইভাবে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী ক্যাডাররাও সরকারের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের প্রশ্রয় ও আস্কারা পেয়ে থাকে।

 উল্লেখ্য, ঢাকার মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজে উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ নিয়ে ছাত্রলীগের দু'গ্রুপ সংঘর্ষের অবস্থায় উপনীত হয়েছে। যদিও এসব কোন ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের এখতিয়ারে পড়ে না। ছাত্ররা সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার জন্য যায়। সেখানে তাদের সুষ্ঠুভাবে একাডেমিক ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে অধ্যয়নকেই একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান করা উচিত। কিন্তু কোন শিক্ষার্থী যখন রাজনৈতিক মাস্তানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে পদদলিত করে নিজেরাই বিকল্প প্রশাসক হয়ে ওঠে, তখন সেখানে শিক্ষার কোন পরিবেশ থাকে না। মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজের উপ-অধ্যক্ষের পদে কে বসবেন সেটা নির্ধারণ করবে কলেজের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ। এজন্য চলমান বিধি অনুযায়ী ন্যায়ত ও আইনত যার নিযুক্তি পাওয়া উচিত, সেটাই কার্যকর হওয়া দরকার। কিন্তু এক্ষেত্রে শুধু ছাত্রলীগ ক্যাডাররা হস্তক্ষেপেই করছে না। একপক্ষ অন্যপক্ষের ওপর তাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে সংঘাতময় অবস্থা তৈরি করেছেন বলে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোন মেডিকেল কলেজ ছাত্রদের সন্ত্রাস ও গুন্ডামী করার স্থান হতে পারে না। সরকার প্রশ্রয় না দিলে মেডিকেল কলেজের মতো স্পর্শকাতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা তাদের শিক্ষাজীবনের ওপর কলঙ্কিত ঝুঁকি নেবার মতো অরাজকতায় লিপ্ত হতে পারে না। মিটফোর্ড হাসপাতালে উপ-অধ্যক্ষ নিয়োগকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দু'গ্রুপের মাঝে সংঘাতের আশঙ্কা আইনের শাসন ও প্রশাসনিক শৃক্মখলার চরম অবনতির ইঙ্গিত।

 উল্লেখ্য, এর আগে সরকারের লালিত ছাত্রলীগ ক্যাডারদের সন্ত্রাসের তান্ডবে বহু ছাত্রের জীবনহানি ছাড়াও শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে করে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে মূল্যবান শিক্ষাবর্ষ খসে পড়েছে। অনেকে মনে করেন, বড় বড় কলেজ, মেডিকেল, টেকনিক্যাল কলেজসহ পাবলিক ইউনিভার্সিটিসমূহে অশান্তি ও নৈরাজ্য জিইয়ে রাখা সরকারের অশুভ ইচ্ছার পরিণতি। শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য জিইয়ে রেখে সরকার তাদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য গণআন্দোলন থেকে ছাত্রদের দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও টেকনিক্যাল শিক্ষাক্ষেত্রে একটা নৈরাজ্যকর অবস্থা তৈরি করে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য বিদেশে, বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতে যেতে বাধ্য করতে চায়। তবে কোনভাবেই এই নৈরাজ্যকর অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। এই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে শান্তিকামী সাধারণ শিক্ষার্থীদেরই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ছাত্রলীগের ক্যাডাররা নিজেরাও যেমন পড়াশোনা করে ডাক্তার হতে চায় না, তেমনি মেধাবী শিক্ষার্থীদেরও অধ্যয়ন করে নিজস্ব যোগ্যতায় ডাক্তার হতে দিতে চায় না। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েও যারা সরকারি ছাত্রসংগঠনের ক্যাডার-লাঠিয়াল পরিচয়ে পড়াশোনা ছাড়াই ডিগ্রি অর্জন করে ভালো পদ-পদবী পাবার আশা করতে পারে, তবে তারা পড়ালেখা বাদ রেখে কেন হাঙ্গামা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে না? আওয়ামী লীগ সরকারের প্রকট দলবাজি ইতোমধ্যে দেশকে একটা দুঃসহ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব না হলে জাতির আর একটি জেনারেশন ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সামাজিক শক্তি ও বুদ্ধিজীবীদের সচেতন হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এগিয়ে আসতে হবে।

Saturday, 21 May 2011

এ কোন আজব দুনিয়ায় বাস করছি।

আমরা বর্তমানে এমন এক আজব দুনিয়ায় বাস করছি সেখানে সব কিছুরই আগেকার সংজ্ঞা পাল্টে যাচ্ছে। গণতন্ত্র, মানবতা, মানবাধিকার সবকিছুই যেন একটা বিরাট জিজ্ঞাসা চিহ্নের সম্মুখীন। এতদিন আমরা জেনে এসেছি গণতন্ত্রে জনগণের রায়ই বড় কথা কিন্তু আলজেরিয়াতে আমরা কি দেখলাম? সেখানে কি জনগণের রায় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল? জনগণের রায়ের প্রতি কি গুরুত্ব দেখানো হয়েছিল? হয়নি। কারণ আলজেরিয়ার মুসলিম জনগণ সেদিন তাদের আদর্শের পতাকাবাহী দল ‘ইসলামী স্যালভেশন ফ্রন্টে'র পক্ষে রায় দিয়েছিল পরাশক্তির আজ্ঞাবহ শক্তিকে উপেক্ষা করে। পরাশক্তির কাছে সে রায় পছন্দ হলো না। অতএব, সারা দুনিয়ায় গণতন্ত্রের ডঙ্কা বাজিয়ে মহা মহা বুলি কপচালেও গণতন্ত্রের পরাশক্তি একচোখা দৈত্যের মতো জগদ্দল পাথর হয়ে আলজেরিয়ার মুসলিম জনগণের উপর চেপে বসেছিল। আলজেরিয়ার সামরিক নেতাদের সাথে বৈঠক করে বিদেশ থেকে নেতা হায়ার করে এনে স্যালভেশন ফ্রন্টের উপর চালানো হয়েছিল নির্যাতনের স্টীম রোলার। এসব কিছুই করা হয়েছিল কেবলমাত্র জনগণের রায়কে ব্যর্থ করে দেবার অসদুদ্দেশ্যে। এক কথায় বলে দেয়া হয়েছিল আলজেরিয়ার জনগণ ইসলামী মৌলবাদী শক্তির পক্ষে রায় দিয়েছে। প্রশ্ন এখানেই থেকে যায় যে, জনগণ ইসলামী আদর্শের পক্ষে রায় দিলে সেটা কি গণতন্ত্রসম্মত হবে না? গণতন্ত্রের সংজ্ঞাই কি তাহলে পাল্টে গেল?

এভাবে বর্তমান দুনিয়ায় মানবতা আর মানবাধিকারের সংজ্ঞাও আর টিকে থাকতে পারছে কই। বসনিয়া-হারজেগোভিনা জাতিসংঘের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে সার্বরা মুসলমানদের হত্যা করতে পারলো, নির্যাতন করতে পারলো, ধর্ষণ করতে পারলো। এতে মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হলো না একটুও, আর মানবতাও ম্লান হলো না। পক্ষান্তরে, হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার সে দেশের মুসলমানরা আত্মরক্ষার অধিকার পেলেই যেন মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হয়ে যেতো। তাই তো সভ্য জাতি বলে গর্বিত পশ্চিমা শক্তির ইঙ্গিতে মুসলমানদের উপরই চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা। এত কিছু করার পরও সেখানে মানবতা ও মানবাধিকার বিপণ্ণ হয়নি একটুও।
এক সময় বলা হয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে সমাজতন্ত্রের মৃত্যুডঙ্কা বাজার মধ্য দিয়ে আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা আর মানবাধিকারের বিজয় সূচিত হয়েছে। সেদিন জোর গলায় বলা হয়েছিল, বর্তমানে মানবতা এক মহান সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলো। কিন্তু বাস্তবে দুনিয়ার দিকে তাকালে দেখা যায়, কথাগুলো আদৌ সত্য নয়। কাশ্মীরের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায়, ভারতীয় নরখাদক সশস্ত্র বাহিনী কাশ্মীরের অসহায় মুসলমানদের চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। নির্যাতন-নিপীড়নের মত নতুন নতুন কলা-কৌশল তারা আবিষ্কার করে চলেছে। সোয়া কোটি কাশ্মীরবাসীকে নির্যাতন আর নিপীড়নে জর্জরিত করে যাবজ্জীবন ভারতীয় জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে রাখার লক্ষ্যে প্রতিদিন সেখানে অত্যাচারের মাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। জাতিসংঘ বসনিয়ায় মুসলমানদের জন্য যে ভূমিকা পালন করেছে সেই একই ভূমিকা পালন করছে কাশ্মীরের বেলায়ও। জাতিসংঘ বসনিয়ায় বিরোধীদের সহায়তা করেছে এবং নির্যাতিতদের উদ্ধারে বা আক্রমণকারীদের প্রতিহত করতে কোনো সন্তোষজনক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তেমনি ১৯৪৭ থেকে শুরু করে নিরাপত্তা পরিষদ কাশ্মীর সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে একাধিক প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। শেষ প্রস্তাবটি পাস হয় ১৯৪৯ সালে। তাতে কাশ্মীরের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কাশ্মীরের জনগণের উপর আরোপের কথা উল্লেখ করা হয়। ওই সময়ে ভারত প্রস্তাবটি মেনে নিলেও পরবর্তীতে প্রস্তাবটি ভারত এই বলে নাকচ করে দেয় যে, কাশ্মীর সমস্যা ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। জাতিসংঘের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরও জাতিসংঘ ভারতের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি। তার ফলে কাশ্মীরী যুবকরা মারা যাচ্ছে কিন্তু কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না, শিশুরা মারা যাচ্ছে কিন্তু কেউ সমবেদনা জানাচ্ছে না, নারীরা ধর্ষিতা ও নির্যাতিত হচ্ছে অথচ কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তবুও যেন সেখানে মানবতা ও মানবাধিকারের কিছুই হয়নি।

 পশ্চিমা দেশগুলো ও জাতিসংঘ মাঝে মাঝে মানবাধিকার প্রসঙ্গে লম্বা লম্বা কথা বলে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তারা ঠুলি পরে থাকেন, নাকি দেখেও দেখেন না। জাতিসংঘ তো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এজন্য যে, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা যেন ন্যায়নীতি ও সুবিচার থেকে বিচ্যুত না হয়। কেউ সুবিচার করুক আর নাই করুক, জাতিসংঘ সুবিচার করবে এখন ধারণা এক সময় দুনিয়াবাসীর ছিল। কিন্তু এখন আর সে ধারণা পোষণ করা হয় না। বাস্তবে জাতিসংঘ একটা বহুরূপী সংস্থায় পরিণত হয়ে পড়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘকে গোখরো সাপের মতো ফণা তুলতে দেখা গেলেও পশ্চিমা দেশগুলোও তাদের অনুগ্রহভাজনদের বেলায় সে যেন ধোড়া সাপ। ফণা তোলা ভুলে যায়। দংশন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। জাতিসংঘের এই বহুরূপী চরিত্রের কারণেই দেশে দেশে মুসলমানদের ওপর বিরোধী শক্তিগুলোর এত আস্ফালন।

 চেচনিয়ার ওপর রাশিয়ার নির্যাতনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৯২২ সালে ককেশীয় এ অঞ্চলের দিকে রাশিয়ার জার শাসকরা প্রথম হাত বাড়ায়। ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত ককেশীয় জনগণের সাথে রুশদের যুদ্ধ হয়। ১৪২ বছরের এ যুদ্ধে এই অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার একনায়ক যোশেফ স্টালিন এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষকে তুষার অঞ্চলে ও মরু অঞ্চলে নির্বাসন দেয়। এ নির্বাসনে পাঠানো হয় চেচনিয়ার শতকরা ৫০ ভাগ লোক।

 ১৯৯১ সালের ৩১ ডিসেম্বর সরকারিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত ঘোষিত হওয়ার পর সংবিধানের ৭২ ধারায় ঘোষণা করা হয় ‘জাতিসমূহের মধ্যে যারা স্বাধীনভাবে থাকতে ইচ্ছুক তাদের সে অধিকার দেয়া হবে।' ১৯৯১ সালে সমাজতন্ত্রের জিন্দানখানা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর চেচেনদের ভোটে দুদায়েভ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৯৪ পর্যন্ত তিন বছর রাশিয়া কিছু বলেনি। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসীন দুদায়েভের নিকট প্রেরিত এক চরমপত্রে বলেন, চেচনিয়া রুশ ফেডারেশনের একুশটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের একটি। মুজাহিদরা তাদের স্বাধীনতার দাবিতে অটল থাকায় রাশিয়ার সাথে চেচেনদের যুদ্ধ বেধে যায়। এই যুদ্ধে চেচেন নেতা দুদায়েভ শহীদ হলেও ১৯৯৬ সালে চেচেনরা বিজয়ী হন। রাশিয়া চেচনিয়ায় চরম মার খেয়ে ১৯৯৬ সালের ৩১ আগস্ট চুক্তি স্বাক্ষর করে। রাশিয়া চেচনিয়ার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ তুলে স্বাধীনতাকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য ১৯৯৯ সালের ৭ আগস্ট দাগেস্তানে মুজাহিদদের দমনের অজুহাতে বোমা ফেলে। চেচনিয়া ও আজারবাইজান সীমান্তে এ বোমা হামলায় বেসামরিক জনগণ শহীদ হয়। পরবর্তীতে প্রতিবেশী দাগেস্তানের মুজাহিদদের মদদ দেয়ার মিথ্যা অজুহাতে রাশিয়া চেচেনদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধে রাশিয়ার সৈন্যদের হাতে হাজার হাজার বেসামরিক লোক শহীদ হয়। নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউই রেহাই পায় নাই। শীতল আবহাওয়া ও চিকিৎসার অভাবে শরণার্থী শিবিরে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। তাতে মানবতা ও মানবাধিকারের ক্ষতি কি! কারণ তারা যে মুসলমান।

 কমিউনিস্ট শক্তির পতনের পর আমেরিকাসহ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ এবং রাশিয়া এখন প্রকাশ্যভাবেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। যে সমস্ত মুসলিম দেশ তাদের আনুগত্য স্বীকার করতে কুণ্ঠিত সেই দেশগুলোকে তারা চিহ্নিত করেছে কখনো সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে আবার কখনো মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে। তারপর তাদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অবরোধ শুরু করে দেয়। তাছাড়া দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের ইসলামী সংগঠনও তাদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এদের প্রচার প্রোপাগান্ডার ফলে দুনিয়ার কোন মুসলিম দেশ বা ইসলামী সংগঠন মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইলে তারা হয়ে যাচ্ছে মৌলবাদী। কিন্তু প্রাক্তন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘ইউরোপে কোন মুসলিম দেশ সহ্য করা হবে না'- তখন কিন্তু তিনি মৌলবাদী হন না। বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিলেও ভারতকে মৌলবাদী রাষ্ট্র বলে কেউ গালাগালি করে না। তাদের চোখে মুসলিম মাত্রই মৌলবাদী।

 আসলে চরমপন্থী সন্ত্রাসী কারা? ওকলাহোমায় বোমা বিস্ফোরণকারী টিমোথি মাইকেল ভিগ একজন খৃস্টান, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের হত্যাকারী ইগল আমীর একজন চরমপন্থী ইহুদী। মুসলমানরা তো এরকম কোন অপরাধ করেনি। তবুও পশ্চিমা শক্তি ও তাদের বরকন্দাজদের চোখে মুসলমানরাই শুধু মৌলবাদী, সন্ত্রাসী। বাংলাদেশেও আমরা এই প্রচারণাই লক্ষ্য করছি। তাদের ভাবখানা এমন যে, একবার মুসলিম মৌলবাদী বলে চিহ্নিত করতে পারলেই হলো তখন যেন তাদের ওপর সব রকম নির্যাতন বৈধ হয়ে যাবে। সত্যই আমরা এক আজব দুনিয়ায় বাস করছি।

 পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের ওপর যে অমানুষিক অত্যাচার-নিপীড়ন চলছে সে ব্যাপারে সভ্যতাগর্বী পশ্চিমা দেশগুলো অসম্ভব রকম নীরব। আমাদের দেশের একশ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাও নীরব। এরা কথায় কথায় বিবৃতি ঝাড়েন, লম্বা লম্বা বক্তৃতা করেন, কিন্তু হাল আমলের দুনিয়ার বর্বরতম ঘটনাগুলোর ব্যাপারে তারা পশ্চিমা দেশগুলোর মতোই নীরব। এই নীরবতা থেকেই পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে এদেশীয় বরকন্দাজদের যোগসূত্রের বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

 বর্তমানে মুসলমানদের আনুগত্য-অনুসরণ আর চরিত্রের বিচার-বিশ্লেষণ করলে মনে হবে মুসলমানদের সংজ্ঞাও যেন পাল্টে যাচ্ছে।
মোটকথা মানুষের পরিচয় মেলে তার সুসময়ে আর দুঃসময়ে। এই উভয় সময়ে বর্তমানে মুসলমানরা দুনিয়াতে বড়ই দুঃসময়ের সম্মুখীন। এখন মুসলমানদের ওপর হাতছানি দিচ্ছে কখনো আমেরিকা, কখনো রাশিয়া, কখনো ইহুদী চক্র, কখনো আধিপত্যবাদ আবার কখনো ভোগবাদ আর বিভ্রান্তি। আবার কখনো বা দেখা দেয় রক্তচক্ষু ও নির্যাতনের কালো হাত। লোভ-লালসার ছলনাও উঁকি মারে মাঝে মাঝে। এই অবস্থায় মুসলমানের সংজ্ঞাটাই পাল্টে যায় কি না সেটাই চিন্তার বিষয়। তাই বলছিলাম, আমরা এ কোন আজব দুনিয়ায় বাস করছি।

Tuesday, 10 May 2011

আমাদের ‘অনুভূতিগুলো' কি ‘ভোঁতা' হয়ে যাচ্ছে?

মানুষের এখন আর কোথাও কোনো নিরাপত্তা নেই। চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। রাস্তা-ঘাটে, গাড়িতে, বাড়িতে, ফ্ল্যাটে, বাজারে, শিক্ষাঙ্গনে প্রতিনিয়ত মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। সমাজ ও রাষ্ট্র যেন অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। কোনো পদক্ষেপেই অস্বাভাবিক মৃত্যুর হার কমছে না। দিন দিন বেড়েই চলেছে। খুন-খারাবি, রাহাজানি, ছিনতাই-এর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। অথচ একটি সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপন করে মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ সাধন এবং কল্যাণকামী রাষ্ট্রের জন্য জীবনের নিরাপত্তা একান্ত অপরিহার্য। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতি মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারলে সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুদায়িত্ব পালন শেষ হয়ে যায় না। এসব চাহিদা প্রাপ্তির সাথে সাথে মানুষ যাতে নিরাপত্তার সাথে জীবনযাপন করতে পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করাও আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না থাকলে সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিকাশ সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। কিন্তু আজকে আমরা যে সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস করছি তার সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, সমাজের সর্বত্র নিরাপত্তাহীনতা ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি কোথাও নেই। সকালে যে লোকটি বাসা থেকে কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে সে আবার ফিরে আসতে পারবে কিনা এ ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। এমনকি যে মেয়েটি কলেজে ক্লাস করার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়েছে সে আবার মান-সম্মান নিয়ে বাসায় আসতে পারবে কি-না সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। একজন শিক্ষক যাকে আমরা মানুষ গড়ার কারিগর বলে মুখে ফেনা তুলি সেই শিক্ষক তার প্রতিষ্ঠানে পৌঁছাতে পারবেন কি-না তাও অনিশ্চিত। হতভাগ্য কলেজ শিক্ষক মিজানুর রহমান প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন- পথে-ঘাটেও শিক্ষকরা নিরাপদ নন। ফরিদপুরের চাপা রাণী মেয়েকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেই নিহত হয়েছেন। নিহত, আহত কিংবা চরমভাবে অপমানিত হয়ে আত্মহত্যার অসংখ্য উদাহরণ আমাদের চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা এবং সন্ত্রাসী তান্ডবের ব্যাপকতা এতই বেড়েছে যে, এগুলো এখন আর মানুষকে আগের মতো বিচলিত করে না।
মানুষের যান্ত্রিক ব্যস্ততা, অন্যের প্রতি উদাসীনতা, শ্রদ্ধা, ভক্তি, আন্তরিকতা, সহানুভূতিশীলতা প্রভৃতি মানবীয় গুণাবলীর চর্চার অভাবে মানুষের নিকট এখন অতি অস্বাভাবিক ঘটনা স্বাভাবিক ঘটনার মতো মনে হয়। প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি হত্যাকান্ডের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি কতিপয় সন্ত্রাসী প্রকাশ্য দিবালোকে শ্রেণীকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের সামনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে একজন স্কুলশিক্ষিকাকে কুপিয়ে হত্যা করে। স্কুলশিক্ষিকা আরিফা খাতুন (২৬)কে এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা বীরদর্পে এলাকা ত্যাগ করে। ঘটনাটি ঘটেছে পাবনার সাঁথিয়ায়। আরিফা সাঁথিয়া উপজেলার ভায়নাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ছিলেন। অন্যান্য দিনের মত হতভাগ্য আরিফা স্কুলে যান এবং শ্রেণীকক্ষে ক্লাস নিতে থাকেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কয়েকজন সন্ত্রাসী শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করে আরিফাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে চলে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে। কত অমানবিক, কত হৃদয়বিদারক এ দৃশ্য! একটি সভ্য সমাজে এতটা নৃশংসতা কি কল্পনা করা যায়? শ্রেণীকক্ষে পাঠদানকালে একজন শিক্ষিকাকে রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে দেয়া হলো! অথচ তার বিরুদ্ধে কতটা প্রতিবাদ হলো! আদৌ কোনো প্রতিবাদ হয়েছে কি?
রাষ্ট্রের যারা কর্ণধার যারা খেলার মাঠে কারো বিরুদ্ধে কোনো রকমে একটা জয় পেলে মুহূর্তের মধ্যে অভিনন্দনের বার্তা পাঠাতে ভুল করেন না তারা কিন্তু আরিফার জন্য এতটুকু সহানুভূতি প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। শিক্ষামন্ত্রী যিনি শিক্ষা ও শিক্ষকদের কল্যাণে প্রতিনিয়ত বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে চলেছেন তিনি কিন্তু আরিফার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে তার আত্মাকে ও তার পরিবারকে সান্ত্বনা দেয়ার সুযোগ পাননি! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি একজন মহিলা তিনি একথাটিও বলেননি যে, অন্য একজন মহিলা শিক্ষিকাকে তিনি এমনকি শ্রেণীকক্ষেও নিরাপত্তা দিতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশে বাহারী নামের যে শিক্ষক সংগঠনগুলো রয়েছে তাদের কোনো নেতাও ছুটে যাননি সাঁথিয়ার ভায়নাপাড়ায়।
নারীদের অধিকার নিয়ে যাদের তৎপরতার (!) শেষ নেই সেই সংগঠনগুলোও কি কোনো জোরালো প্রতিবাদ করেছে? এ হলো আমাদের মানবিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ! খুন, জোড়া খুন, হালিতে (২ জোড়া) খুন- এগুলো আমাদের বিবেককে এখন আর তাড়িত করে না! জহির রায়হানের ভাষায় : ‘প্রথম প্রথম কাউকে মারতে দেখলে ব্যথা পেতাম। কেমন যেন একটু দুর্বল হয়ে পড়তাম। কখনো চোখের কোণে একফোঁটা অশ্রুও হয়তো জন্ম নিত। এখন অনেকটা সহজ হয়ে গেছি। কী জানি, হয়তো অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে।' সময়ের প্রয়োজনে কিংবা নৃশংসতার ভয়াবহতায় জহির রায়হানের মানবিক অনুভূতি হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য ‘ভোঁতা' হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা, আমাদের সমাজ এবং আমাদের রাষ্ট্র-সবাই কি একসাথে অনুভূতিশূন্য হয়ে যাচ্ছি? আমাদের সকলের ‘অনুভূতিগুলো' কি ‘ভোঁতা' হয়ে যাচ্ছে?

Thursday, 5 May 2011

শিক্ষক-কর্মচারীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং নির্বাচন কমিশনের নতুন কথা

গত ১৯ এপ্রিল ২০১১ তারিখ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। আর ২১ তারিখ বিকালের কয়েকটি চ্যানেলের স্ক্রল বারে দেখা গেল ‘বোর্ডের অনুমোদনপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বা কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণাও করতে পারবেন না।' পরে খবরে জানতে পারা যায়, ১৯৬১ সালের নির্বাচন বিধিমালায় এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা আছে। শুধু তাই নয়, নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন আরো বলেছেন ‘প্রথম দফার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কেউ নির্বাচিত হয়ে থাকলে তারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।' প্রথমে ধন্যবাদ দিই নির্বাচন কমিশনার সাহেবকে এ ঘোষণার জন্য যে, এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে অস্থিরতা ও শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা অনেকাংশে দূর হবে। কারণ, অনেক শিক্ষকই দেশের রাজনীতির সাথে জড়িত। তাই যে কোন নির্বাচনে এক বিরাট অংশ শিক্ষকরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং নির্বাচিত হয়েও থাকেন। তাই এ ঘোষণায় শিক্ষকদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার একটি পথ তৈরি করা হবে, যদি এ আদেশ বহাল রাখা সম্ভব হয়।
অপরদিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের এই আইন জারীর প্রেক্ষিতে আমাদের গ্রামের মসজিদের একজন শ্রদ্ধেয় ইমাম সাহেব (মরহুম)- এর কথা মনে পড়ে গেল। কারণ, কেউ যদি কখনো বলেছেন যে, এটা সঠিক, তাই এ মসলাটি এমন হবে; তাহলে তিনি সহজ মনে বলে দিতেন এটা ঠিক। আবার কেউ পরে সেটি ঠিক নয় বললেই তিনি বলেছেন, হ্যাঁ, এটা হতে পারে। বলা বাহুল্য, তিনি রাজনীতি বা এ জাতীয় কোন কাজের সাথেই কখনোই জড়িত ছিলেন না। এমনকি ডানে-বামে না তাকিয়ে প্রায় নিচু মুখে পথ চলতেন এবং মসজিদের বাইরেতো কথা বলতেনই না, মসজিদের ভিতরেও প্রয়োজনের বেশি কথা বলতেন না। তাহলে তিনি যে অত্যন্ত সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন এবং সহজ মন নিয়েই মানুষের কথায় সমর্থন দিতেন এতে কোন সন্দেহ নেই। ইমাম সাহেবের কথা মনে পড়ার কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইন নিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন যে নতুন (যদিও আইনটি পুরোনো বা আগের) আইনের ঘোষণা দিয়েছেন সেটির সাথে এ স্মৃতির কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষ করে ‘প্রথম দফার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কেউ নির্বাচিত হয়ে থাকলে তারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে'-এ ঘোষণায় বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, আমার ইমাম সাহেব যে সব বিষয় নিয়ে ভাবতেন না, সেগুলো কেউ বলে দিলেই তার মনে হতো যে, এটা বুঝি প্রয়োজনীয়। তাই সেটা সঠিক বলতেন এবং সেভাবেই চলার বা বলার চেষ্টা করতেন। যেমন করে বলেছেন এই নির্বাচন কমিশনার। যদিও নির্বাচন কমিশনার একজন দক্ষ, বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি। এ কারণেই তিনি সরল মন নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন বলেই সম্প্রতি যে নির্বাচন হয়ে গেল সেদিন তার কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তাই হয়তো বাস্তবায়নেরও কথা ভাবেননি। কিন্তু শিক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেনকে জানিয়েছেন (পত্রিকা মারফত জানা) ‘দ্যা ইন্টারমিডিয়েট এন্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন অর্ডিনেন্স ১৯৬১ অধ্যাদেশ বলবৎ আছে।' আর এর ৩০(১) ধারার বলেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, ‘বোর্ডের অনুমোদনপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বা কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণাও করতে পারবেন না।' তিনি সেদিন শিক্ষা কর্মকর্তার পাঠানো তথ্যের কথা স্বীকার করে সাংবাদিকদের বলেছেন-‘১৯৬১ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নির্বাচন সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশ এখনো বলবৎ আছে বলে আমরা আজ (২২ এপ্রিল, দৈনিক বাংলাদেশ সময়) খবর পেয়েছি।'
আইন দেশের জন্য প্রয়োজন হোক আর প্রয়োজনের জন্যই আইন হোক, কোন আইন যদি মাঝে মাঝে বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে সেটি আর আইন থাকেনা, বরং বেআইনে পরিণত হয়। ১৯৬১ সালে নির্বাচন সংক্রান্ত এ আইন প্রণীত হয়েছিল এতে হয়তো কারো সন্দেহ নেই, কিন্তু গত অর্ধশতকে বহুবার অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ আইন কতবার মানা হয়েছে তা একবার নির্বাচন কমিশনের তলিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে এ ঘোষণার পর অনেকে মত পোষণ করেছেন। যদিও বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের জন্য হাস্যকর বলে অনেকের কাছে মনে হতে পারে। কারণ, নির্বাচন সংক্রান্ত আইন আর নির্বাচন অফিসে সেই আইন সংরক্ষিত নেই বা ছিল না বা নির্বাচন কমিশনাররা সেই আইন সম্পর্কে কিছুই জানেন না এটা ভাবার কোন অবকাশ নেই বলে জনগণ বিশ্বাস করছেন। আর তিনি বা নির্বাচন কমিশনাররা ১৯৬১ সালের আইন বা ২০০৯ সালের আইন কোনটি যে প্রয়োগ করবেন সে বিষয়েও অনেক দ্বিধা-দ্বনেদ্ব ভুগছেন বলে অনুমিত হচ্ছে। কারণ, গত ২০০৯ সালের পর থেকে ৩টি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়ে গেছে (একটি আংশিক)। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে যে কোন পদে থেকে সরকারি বেতন বা অনুদান গ্রহণ করে নির্বাচন করা যাবে না বলে ঘোষণা দেয়ায় অনেককে ইউপি চেয়ারম্যান পদ থেকে বা শিক্ষকতার পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। সম্ভবত এটি ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশ বলেই হয়েছে। কিন্তু এর পরেই আবার নির্বাচন কমিশন হয়তো অনুভব করলো যে, এ আইন থাকা উচিত নয়, তাই ২০০৯ সালে স্থানীয় সরকার আইন-২০০৯ নামে একটি অধ্যাদেশ জারী করা হয়। এতে প্রার্থীর যোগ্যতা ও অযোগ্যতা সংক্রান্ত ১৯ ধারায় বলা হয়েছে ‘এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা স্বীয় পদে বহাল থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বনিদ্বতা করতে পারবেন। এছাড়া সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা চাকরি থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ইস্তফা দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বনিদ্বতা করতে পারবেন।'
এ ধারার বলে প্রথমে গত জানুয়ারি মাসে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর এতে মেয়র বা কমিশনার পদে অনেকে অংশগ্রহণ করেছেন এবং অনেকে বিজয় অর্জনও করেছেন। আর দ্বিতীয় দফায় দক্ষিণাঞ্চলের ১২টি জেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতেও অনেক শিক্ষক অংশগ্রহণ করেছেন এবং বিজয় অর্জন করেছেন বলে শোনা গেছে। এসাথে আসছে ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য দেশের অনেক শিক্ষক-কর্মচারী প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে রয়েছেন এবং দীর্ঘ দিন থেকে শ্রম, অর্থ ও মেধা ব্যয় করে চলেছেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন যখন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের নির্বাচন থেকে বাদ দেয়ার আইনের কথা ঘোষণা দিয়েছেন, তখন তাদের মাথায় বাজ পড়েছে। পড়াটাই স্বাভাবিক। চাল, ডাল, তেল, নুন যোগাড় করে ভাত রান্না করিয়ে নেয়ার পর যদি বলা হয় যে, ভাত খেতে পাবে না, তখন খাওয়ার উদ্দেশ্যে রান্না করা ক্ষুধাতুর মানুষের মনে কি হতে পারে?
আমরা অনেকেই জানি বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন বলে আমাদের দেশে একটি আইন প্রচলিত আছে। সেটাও সম্ভবত ১৯৬১ সালের পাস করা। কিন্তু এই আইন দিয়ে বাল্য বিয়ে রোধ করা সম্ভব হয়নি। কারণ, আইনটি বাস্তবায়ন করা হয় না এবং এ জন্য দেশের মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিও হয়নি। তাই কোন মেয়ের বাল্য বিয়ে হয়ে গেলে এবং সেই মেয়ে এক সময় সন্তান প্রসব করার পর যদি জানা যায় যে, তার বাল্যবিয়ে হয়েছিল, তাহলে তার আর বিয়ে বাতিল করা সম্ভব নয়। এমনিভাবে নির্বাচনের সুযোগে কোন শিক্ষক যদি ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নির্বাচিত হয়ে থাকেন, তাহলে তাকে আর কিভাবে আগের স্থানে নিয়ে যাওয়া যাবে তা নিয়ে অনেকের মনে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। বরং ১৯৬১ সালের আইনটি জানার পর নির্বাচন অফিসের উচিত ছিল সরকারের সাথে ১৯৬১ সালের এবং ২০০৯ সালের আইন নিয়ে আলোচনা করে এ সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত নেয়া। অবশ্য আমরা জানি না যে, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সরকারের সাথে এ বিষয়ে কোন আলোচনা করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিনা বা নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছে কিনা? কারণ, ইতোমধ্যে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা অবশ্যই আইনের আশ্রয় নিবেন এবং আইনের কাছে আশ্রয় নিলে ন্যায় বিচার পাবেন বলে তারা মত প্রকাশ করেছেন। এমনি করে যারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে আছেন তাদের মধ্যেও অনেকে হয়তো এ সুযোগটি নেয়ার চেষ্টা করতে পারেন। আর সে চেষ্টা করুক বা না করুক এ মুহূর্তে অবশ্যই এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। কারণ, সরকারি দল, বিরোধী দলসহ সব দলেই শিক্ষকদের মধ্যে থেকে অনেক প্রার্থী তালিকাভুক্ত রয়েছেন। আর যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতির সাথে জড়িত তারা অবস্থানগত দিক থেকে অনেক উপরে রয়েছেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাই তারা অবশ্যই এক সময় হয়তো নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে আইন পাস করানোর কাজে সফল হতে পারেন। আর এ নির্বাচনে শিক্ষকদের প্রার্থী হতে দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে দেয়ার পরে যদি আবারও সেই উপজেলার পর পৌরসভার মতো আইন পাস হয়ে যায়, তাহলে উপজেলার মতো যারা বঞ্চিত হবেন, তাদের কাছে নির্বাচন কমিশন অপরাধী হয়ে থেকে যাবে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্নেরও সৃষ্টি হতে পারে।
আমার জানা মতে, একই বিষয়ে যখন নতুন কোন আইন হয়, তখন সে বিষয়ের পূর্বের আইন বিলুপ্ত হয়ে যায়। অবশ্য এ ব্যাপারে রেফারেন্স মূলক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন হতে পারে, যদিও সেটিকে অনেকেই প্রয়োজনীয় বিষয় মনে করেন না। কারণ, সময় ও বাস্তবতার প্রয়োজনের জন্যই আইন প্রণীত হয়ে থাকে। তাই ২০০৯ সালের আইন হওয়ার পর ১৯৬১ সালের আইনের আর কার্যকারিতা আছে কি না তা আইন বিশেষজ্ঞরা ভেবে দেখবেন এবং এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে একটি সঠিক নির্দেশনা দিবেন বলে আমি আশাবাদী।
বলা প্রয়োজন যে, দেশের শিক্ষকরা সমাজের আয়না, রাষ্ট্রের বিবেক, মানুষের বন্ধু, সর্বোপরি মানুষ গড়ার কারিগর। তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দানের বিষয়ে একবার ইতিবাচক আর একবার নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিলে শিক্ষকদের অবমাননা করা হয় বলে শিক্ষক সমাজ মনে করছেন। বরং তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের পর সমাজ সেবার কাজ কতটুকু করতে পারবেন বা আদৌ করতে পারবেন কি না বা তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে পাঠদানে কতটুকু ক্ষতিসাধিত হতে পারে তা বিচার বিশ্লেষণ করে একটি নতুন ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে শিক্ষক সমাজের একটি বড় অংশ মনে করছেন।
কাজেই কোন প্রশ্ন যেন সৃষ্টি না হয়, নির্বাচন কমিশন যেন সন্দেহাতীত ও সঠিকভাবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনসহ আগামী দিনের যে কোন নির্বাচন সমাপ্ত করতে পারে, সে বিষয়টি মাথায় রেখে ‘বোর্ডের অনুমোদনপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বা কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণাও করতে পারবেন না' এ সংক্রান্ত একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নেয়ার দাবি শুধু শিক্ষকদেরই নয়, সারাদেশের সচেতন জনগণের।
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter