Flickr

Thursday, 5 May 2011

শিক্ষক-কর্মচারীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং নির্বাচন কমিশনের নতুন কথা

Posted by   on

গত ১৯ এপ্রিল ২০১১ তারিখ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। আর ২১ তারিখ বিকালের কয়েকটি চ্যানেলের স্ক্রল বারে দেখা গেল ‘বোর্ডের অনুমোদনপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বা কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণাও করতে পারবেন না।' পরে খবরে জানতে পারা যায়, ১৯৬১ সালের নির্বাচন বিধিমালায় এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা আছে। শুধু তাই নয়, নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন আরো বলেছেন ‘প্রথম দফার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কেউ নির্বাচিত হয়ে থাকলে তারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।' প্রথমে ধন্যবাদ দিই নির্বাচন কমিশনার সাহেবকে এ ঘোষণার জন্য যে, এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে অস্থিরতা ও শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা অনেকাংশে দূর হবে। কারণ, অনেক শিক্ষকই দেশের রাজনীতির সাথে জড়িত। তাই যে কোন নির্বাচনে এক বিরাট অংশ শিক্ষকরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং নির্বাচিত হয়েও থাকেন। তাই এ ঘোষণায় শিক্ষকদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার একটি পথ তৈরি করা হবে, যদি এ আদেশ বহাল রাখা সম্ভব হয়।
অপরদিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের এই আইন জারীর প্রেক্ষিতে আমাদের গ্রামের মসজিদের একজন শ্রদ্ধেয় ইমাম সাহেব (মরহুম)- এর কথা মনে পড়ে গেল। কারণ, কেউ যদি কখনো বলেছেন যে, এটা সঠিক, তাই এ মসলাটি এমন হবে; তাহলে তিনি সহজ মনে বলে দিতেন এটা ঠিক। আবার কেউ পরে সেটি ঠিক নয় বললেই তিনি বলেছেন, হ্যাঁ, এটা হতে পারে। বলা বাহুল্য, তিনি রাজনীতি বা এ জাতীয় কোন কাজের সাথেই কখনোই জড়িত ছিলেন না। এমনকি ডানে-বামে না তাকিয়ে প্রায় নিচু মুখে পথ চলতেন এবং মসজিদের বাইরেতো কথা বলতেনই না, মসজিদের ভিতরেও প্রয়োজনের বেশি কথা বলতেন না। তাহলে তিনি যে অত্যন্ত সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন এবং সহজ মন নিয়েই মানুষের কথায় সমর্থন দিতেন এতে কোন সন্দেহ নেই। ইমাম সাহেবের কথা মনে পড়ার কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইন নিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন যে নতুন (যদিও আইনটি পুরোনো বা আগের) আইনের ঘোষণা দিয়েছেন সেটির সাথে এ স্মৃতির কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষ করে ‘প্রথম দফার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কেউ নির্বাচিত হয়ে থাকলে তারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে'-এ ঘোষণায় বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, আমার ইমাম সাহেব যে সব বিষয় নিয়ে ভাবতেন না, সেগুলো কেউ বলে দিলেই তার মনে হতো যে, এটা বুঝি প্রয়োজনীয়। তাই সেটা সঠিক বলতেন এবং সেভাবেই চলার বা বলার চেষ্টা করতেন। যেমন করে বলেছেন এই নির্বাচন কমিশনার। যদিও নির্বাচন কমিশনার একজন দক্ষ, বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি। এ কারণেই তিনি সরল মন নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন বলেই সম্প্রতি যে নির্বাচন হয়ে গেল সেদিন তার কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তাই হয়তো বাস্তবায়নেরও কথা ভাবেননি। কিন্তু শিক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেনকে জানিয়েছেন (পত্রিকা মারফত জানা) ‘দ্যা ইন্টারমিডিয়েট এন্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন অর্ডিনেন্স ১৯৬১ অধ্যাদেশ বলবৎ আছে।' আর এর ৩০(১) ধারার বলেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, ‘বোর্ডের অনুমোদনপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বা কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণাও করতে পারবেন না।' তিনি সেদিন শিক্ষা কর্মকর্তার পাঠানো তথ্যের কথা স্বীকার করে সাংবাদিকদের বলেছেন-‘১৯৬১ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নির্বাচন সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশ এখনো বলবৎ আছে বলে আমরা আজ (২২ এপ্রিল, দৈনিক বাংলাদেশ সময়) খবর পেয়েছি।'
আইন দেশের জন্য প্রয়োজন হোক আর প্রয়োজনের জন্যই আইন হোক, কোন আইন যদি মাঝে মাঝে বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে সেটি আর আইন থাকেনা, বরং বেআইনে পরিণত হয়। ১৯৬১ সালে নির্বাচন সংক্রান্ত এ আইন প্রণীত হয়েছিল এতে হয়তো কারো সন্দেহ নেই, কিন্তু গত অর্ধশতকে বহুবার অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ আইন কতবার মানা হয়েছে তা একবার নির্বাচন কমিশনের তলিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে এ ঘোষণার পর অনেকে মত পোষণ করেছেন। যদিও বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের জন্য হাস্যকর বলে অনেকের কাছে মনে হতে পারে। কারণ, নির্বাচন সংক্রান্ত আইন আর নির্বাচন অফিসে সেই আইন সংরক্ষিত নেই বা ছিল না বা নির্বাচন কমিশনাররা সেই আইন সম্পর্কে কিছুই জানেন না এটা ভাবার কোন অবকাশ নেই বলে জনগণ বিশ্বাস করছেন। আর তিনি বা নির্বাচন কমিশনাররা ১৯৬১ সালের আইন বা ২০০৯ সালের আইন কোনটি যে প্রয়োগ করবেন সে বিষয়েও অনেক দ্বিধা-দ্বনেদ্ব ভুগছেন বলে অনুমিত হচ্ছে। কারণ, গত ২০০৯ সালের পর থেকে ৩টি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়ে গেছে (একটি আংশিক)। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে যে কোন পদে থেকে সরকারি বেতন বা অনুদান গ্রহণ করে নির্বাচন করা যাবে না বলে ঘোষণা দেয়ায় অনেককে ইউপি চেয়ারম্যান পদ থেকে বা শিক্ষকতার পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। সম্ভবত এটি ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশ বলেই হয়েছে। কিন্তু এর পরেই আবার নির্বাচন কমিশন হয়তো অনুভব করলো যে, এ আইন থাকা উচিত নয়, তাই ২০০৯ সালে স্থানীয় সরকার আইন-২০০৯ নামে একটি অধ্যাদেশ জারী করা হয়। এতে প্রার্থীর যোগ্যতা ও অযোগ্যতা সংক্রান্ত ১৯ ধারায় বলা হয়েছে ‘এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা স্বীয় পদে বহাল থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বনিদ্বতা করতে পারবেন। এছাড়া সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা চাকরি থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ইস্তফা দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বনিদ্বতা করতে পারবেন।'
এ ধারার বলে প্রথমে গত জানুয়ারি মাসে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর এতে মেয়র বা কমিশনার পদে অনেকে অংশগ্রহণ করেছেন এবং অনেকে বিজয় অর্জনও করেছেন। আর দ্বিতীয় দফায় দক্ষিণাঞ্চলের ১২টি জেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতেও অনেক শিক্ষক অংশগ্রহণ করেছেন এবং বিজয় অর্জন করেছেন বলে শোনা গেছে। এসাথে আসছে ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য দেশের অনেক শিক্ষক-কর্মচারী প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে রয়েছেন এবং দীর্ঘ দিন থেকে শ্রম, অর্থ ও মেধা ব্যয় করে চলেছেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন যখন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের নির্বাচন থেকে বাদ দেয়ার আইনের কথা ঘোষণা দিয়েছেন, তখন তাদের মাথায় বাজ পড়েছে। পড়াটাই স্বাভাবিক। চাল, ডাল, তেল, নুন যোগাড় করে ভাত রান্না করিয়ে নেয়ার পর যদি বলা হয় যে, ভাত খেতে পাবে না, তখন খাওয়ার উদ্দেশ্যে রান্না করা ক্ষুধাতুর মানুষের মনে কি হতে পারে?
আমরা অনেকেই জানি বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন বলে আমাদের দেশে একটি আইন প্রচলিত আছে। সেটাও সম্ভবত ১৯৬১ সালের পাস করা। কিন্তু এই আইন দিয়ে বাল্য বিয়ে রোধ করা সম্ভব হয়নি। কারণ, আইনটি বাস্তবায়ন করা হয় না এবং এ জন্য দেশের মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিও হয়নি। তাই কোন মেয়ের বাল্য বিয়ে হয়ে গেলে এবং সেই মেয়ে এক সময় সন্তান প্রসব করার পর যদি জানা যায় যে, তার বাল্যবিয়ে হয়েছিল, তাহলে তার আর বিয়ে বাতিল করা সম্ভব নয়। এমনিভাবে নির্বাচনের সুযোগে কোন শিক্ষক যদি ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নির্বাচিত হয়ে থাকেন, তাহলে তাকে আর কিভাবে আগের স্থানে নিয়ে যাওয়া যাবে তা নিয়ে অনেকের মনে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। বরং ১৯৬১ সালের আইনটি জানার পর নির্বাচন অফিসের উচিত ছিল সরকারের সাথে ১৯৬১ সালের এবং ২০০৯ সালের আইন নিয়ে আলোচনা করে এ সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত নেয়া। অবশ্য আমরা জানি না যে, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সরকারের সাথে এ বিষয়ে কোন আলোচনা করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিনা বা নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছে কিনা? কারণ, ইতোমধ্যে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা অবশ্যই আইনের আশ্রয় নিবেন এবং আইনের কাছে আশ্রয় নিলে ন্যায় বিচার পাবেন বলে তারা মত প্রকাশ করেছেন। এমনি করে যারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে আছেন তাদের মধ্যেও অনেকে হয়তো এ সুযোগটি নেয়ার চেষ্টা করতে পারেন। আর সে চেষ্টা করুক বা না করুক এ মুহূর্তে অবশ্যই এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। কারণ, সরকারি দল, বিরোধী দলসহ সব দলেই শিক্ষকদের মধ্যে থেকে অনেক প্রার্থী তালিকাভুক্ত রয়েছেন। আর যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতির সাথে জড়িত তারা অবস্থানগত দিক থেকে অনেক উপরে রয়েছেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাই তারা অবশ্যই এক সময় হয়তো নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে আইন পাস করানোর কাজে সফল হতে পারেন। আর এ নির্বাচনে শিক্ষকদের প্রার্থী হতে দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে দেয়ার পরে যদি আবারও সেই উপজেলার পর পৌরসভার মতো আইন পাস হয়ে যায়, তাহলে উপজেলার মতো যারা বঞ্চিত হবেন, তাদের কাছে নির্বাচন কমিশন অপরাধী হয়ে থেকে যাবে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্নেরও সৃষ্টি হতে পারে।
আমার জানা মতে, একই বিষয়ে যখন নতুন কোন আইন হয়, তখন সে বিষয়ের পূর্বের আইন বিলুপ্ত হয়ে যায়। অবশ্য এ ব্যাপারে রেফারেন্স মূলক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন হতে পারে, যদিও সেটিকে অনেকেই প্রয়োজনীয় বিষয় মনে করেন না। কারণ, সময় ও বাস্তবতার প্রয়োজনের জন্যই আইন প্রণীত হয়ে থাকে। তাই ২০০৯ সালের আইন হওয়ার পর ১৯৬১ সালের আইনের আর কার্যকারিতা আছে কি না তা আইন বিশেষজ্ঞরা ভেবে দেখবেন এবং এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে একটি সঠিক নির্দেশনা দিবেন বলে আমি আশাবাদী।
বলা প্রয়োজন যে, দেশের শিক্ষকরা সমাজের আয়না, রাষ্ট্রের বিবেক, মানুষের বন্ধু, সর্বোপরি মানুষ গড়ার কারিগর। তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দানের বিষয়ে একবার ইতিবাচক আর একবার নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিলে শিক্ষকদের অবমাননা করা হয় বলে শিক্ষক সমাজ মনে করছেন। বরং তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের পর সমাজ সেবার কাজ কতটুকু করতে পারবেন বা আদৌ করতে পারবেন কি না বা তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে পাঠদানে কতটুকু ক্ষতিসাধিত হতে পারে তা বিচার বিশ্লেষণ করে একটি নতুন ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে শিক্ষক সমাজের একটি বড় অংশ মনে করছেন।
কাজেই কোন প্রশ্ন যেন সৃষ্টি না হয়, নির্বাচন কমিশন যেন সন্দেহাতীত ও সঠিকভাবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনসহ আগামী দিনের যে কোন নির্বাচন সমাপ্ত করতে পারে, সে বিষয়টি মাথায় রেখে ‘বোর্ডের অনুমোদনপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বা কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণাও করতে পারবেন না' এ সংক্রান্ত একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নেয়ার দাবি শুধু শিক্ষকদেরই নয়, সারাদেশের সচেতন জনগণের।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter