Flickr

Saturday, 21 May 2011

এ কোন আজব দুনিয়ায় বাস করছি।

Posted by   on

আমরা বর্তমানে এমন এক আজব দুনিয়ায় বাস করছি সেখানে সব কিছুরই আগেকার সংজ্ঞা পাল্টে যাচ্ছে। গণতন্ত্র, মানবতা, মানবাধিকার সবকিছুই যেন একটা বিরাট জিজ্ঞাসা চিহ্নের সম্মুখীন। এতদিন আমরা জেনে এসেছি গণতন্ত্রে জনগণের রায়ই বড় কথা কিন্তু আলজেরিয়াতে আমরা কি দেখলাম? সেখানে কি জনগণের রায় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল? জনগণের রায়ের প্রতি কি গুরুত্ব দেখানো হয়েছিল? হয়নি। কারণ আলজেরিয়ার মুসলিম জনগণ সেদিন তাদের আদর্শের পতাকাবাহী দল ‘ইসলামী স্যালভেশন ফ্রন্টে'র পক্ষে রায় দিয়েছিল পরাশক্তির আজ্ঞাবহ শক্তিকে উপেক্ষা করে। পরাশক্তির কাছে সে রায় পছন্দ হলো না। অতএব, সারা দুনিয়ায় গণতন্ত্রের ডঙ্কা বাজিয়ে মহা মহা বুলি কপচালেও গণতন্ত্রের পরাশক্তি একচোখা দৈত্যের মতো জগদ্দল পাথর হয়ে আলজেরিয়ার মুসলিম জনগণের উপর চেপে বসেছিল। আলজেরিয়ার সামরিক নেতাদের সাথে বৈঠক করে বিদেশ থেকে নেতা হায়ার করে এনে স্যালভেশন ফ্রন্টের উপর চালানো হয়েছিল নির্যাতনের স্টীম রোলার। এসব কিছুই করা হয়েছিল কেবলমাত্র জনগণের রায়কে ব্যর্থ করে দেবার অসদুদ্দেশ্যে। এক কথায় বলে দেয়া হয়েছিল আলজেরিয়ার জনগণ ইসলামী মৌলবাদী শক্তির পক্ষে রায় দিয়েছে। প্রশ্ন এখানেই থেকে যায় যে, জনগণ ইসলামী আদর্শের পক্ষে রায় দিলে সেটা কি গণতন্ত্রসম্মত হবে না? গণতন্ত্রের সংজ্ঞাই কি তাহলে পাল্টে গেল?

এভাবে বর্তমান দুনিয়ায় মানবতা আর মানবাধিকারের সংজ্ঞাও আর টিকে থাকতে পারছে কই। বসনিয়া-হারজেগোভিনা জাতিসংঘের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে সার্বরা মুসলমানদের হত্যা করতে পারলো, নির্যাতন করতে পারলো, ধর্ষণ করতে পারলো। এতে মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হলো না একটুও, আর মানবতাও ম্লান হলো না। পক্ষান্তরে, হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার সে দেশের মুসলমানরা আত্মরক্ষার অধিকার পেলেই যেন মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হয়ে যেতো। তাই তো সভ্য জাতি বলে গর্বিত পশ্চিমা শক্তির ইঙ্গিতে মুসলমানদের উপরই চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা। এত কিছু করার পরও সেখানে মানবতা ও মানবাধিকার বিপণ্ণ হয়নি একটুও।
এক সময় বলা হয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে সমাজতন্ত্রের মৃত্যুডঙ্কা বাজার মধ্য দিয়ে আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা আর মানবাধিকারের বিজয় সূচিত হয়েছে। সেদিন জোর গলায় বলা হয়েছিল, বর্তমানে মানবতা এক মহান সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলো। কিন্তু বাস্তবে দুনিয়ার দিকে তাকালে দেখা যায়, কথাগুলো আদৌ সত্য নয়। কাশ্মীরের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায়, ভারতীয় নরখাদক সশস্ত্র বাহিনী কাশ্মীরের অসহায় মুসলমানদের চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। নির্যাতন-নিপীড়নের মত নতুন নতুন কলা-কৌশল তারা আবিষ্কার করে চলেছে। সোয়া কোটি কাশ্মীরবাসীকে নির্যাতন আর নিপীড়নে জর্জরিত করে যাবজ্জীবন ভারতীয় জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে রাখার লক্ষ্যে প্রতিদিন সেখানে অত্যাচারের মাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। জাতিসংঘ বসনিয়ায় মুসলমানদের জন্য যে ভূমিকা পালন করেছে সেই একই ভূমিকা পালন করছে কাশ্মীরের বেলায়ও। জাতিসংঘ বসনিয়ায় বিরোধীদের সহায়তা করেছে এবং নির্যাতিতদের উদ্ধারে বা আক্রমণকারীদের প্রতিহত করতে কোনো সন্তোষজনক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তেমনি ১৯৪৭ থেকে শুরু করে নিরাপত্তা পরিষদ কাশ্মীর সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে একাধিক প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। শেষ প্রস্তাবটি পাস হয় ১৯৪৯ সালে। তাতে কাশ্মীরের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কাশ্মীরের জনগণের উপর আরোপের কথা উল্লেখ করা হয়। ওই সময়ে ভারত প্রস্তাবটি মেনে নিলেও পরবর্তীতে প্রস্তাবটি ভারত এই বলে নাকচ করে দেয় যে, কাশ্মীর সমস্যা ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। জাতিসংঘের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরও জাতিসংঘ ভারতের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি। তার ফলে কাশ্মীরী যুবকরা মারা যাচ্ছে কিন্তু কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না, শিশুরা মারা যাচ্ছে কিন্তু কেউ সমবেদনা জানাচ্ছে না, নারীরা ধর্ষিতা ও নির্যাতিত হচ্ছে অথচ কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তবুও যেন সেখানে মানবতা ও মানবাধিকারের কিছুই হয়নি।

 পশ্চিমা দেশগুলো ও জাতিসংঘ মাঝে মাঝে মানবাধিকার প্রসঙ্গে লম্বা লম্বা কথা বলে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তারা ঠুলি পরে থাকেন, নাকি দেখেও দেখেন না। জাতিসংঘ তো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এজন্য যে, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা যেন ন্যায়নীতি ও সুবিচার থেকে বিচ্যুত না হয়। কেউ সুবিচার করুক আর নাই করুক, জাতিসংঘ সুবিচার করবে এখন ধারণা এক সময় দুনিয়াবাসীর ছিল। কিন্তু এখন আর সে ধারণা পোষণ করা হয় না। বাস্তবে জাতিসংঘ একটা বহুরূপী সংস্থায় পরিণত হয়ে পড়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘকে গোখরো সাপের মতো ফণা তুলতে দেখা গেলেও পশ্চিমা দেশগুলোও তাদের অনুগ্রহভাজনদের বেলায় সে যেন ধোড়া সাপ। ফণা তোলা ভুলে যায়। দংশন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। জাতিসংঘের এই বহুরূপী চরিত্রের কারণেই দেশে দেশে মুসলমানদের ওপর বিরোধী শক্তিগুলোর এত আস্ফালন।

 চেচনিয়ার ওপর রাশিয়ার নির্যাতনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৯২২ সালে ককেশীয় এ অঞ্চলের দিকে রাশিয়ার জার শাসকরা প্রথম হাত বাড়ায়। ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত ককেশীয় জনগণের সাথে রুশদের যুদ্ধ হয়। ১৪২ বছরের এ যুদ্ধে এই অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার একনায়ক যোশেফ স্টালিন এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষকে তুষার অঞ্চলে ও মরু অঞ্চলে নির্বাসন দেয়। এ নির্বাসনে পাঠানো হয় চেচনিয়ার শতকরা ৫০ ভাগ লোক।

 ১৯৯১ সালের ৩১ ডিসেম্বর সরকারিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত ঘোষিত হওয়ার পর সংবিধানের ৭২ ধারায় ঘোষণা করা হয় ‘জাতিসমূহের মধ্যে যারা স্বাধীনভাবে থাকতে ইচ্ছুক তাদের সে অধিকার দেয়া হবে।' ১৯৯১ সালে সমাজতন্ত্রের জিন্দানখানা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর চেচেনদের ভোটে দুদায়েভ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৯৪ পর্যন্ত তিন বছর রাশিয়া কিছু বলেনি। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসীন দুদায়েভের নিকট প্রেরিত এক চরমপত্রে বলেন, চেচনিয়া রুশ ফেডারেশনের একুশটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের একটি। মুজাহিদরা তাদের স্বাধীনতার দাবিতে অটল থাকায় রাশিয়ার সাথে চেচেনদের যুদ্ধ বেধে যায়। এই যুদ্ধে চেচেন নেতা দুদায়েভ শহীদ হলেও ১৯৯৬ সালে চেচেনরা বিজয়ী হন। রাশিয়া চেচনিয়ায় চরম মার খেয়ে ১৯৯৬ সালের ৩১ আগস্ট চুক্তি স্বাক্ষর করে। রাশিয়া চেচনিয়ার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ তুলে স্বাধীনতাকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য ১৯৯৯ সালের ৭ আগস্ট দাগেস্তানে মুজাহিদদের দমনের অজুহাতে বোমা ফেলে। চেচনিয়া ও আজারবাইজান সীমান্তে এ বোমা হামলায় বেসামরিক জনগণ শহীদ হয়। পরবর্তীতে প্রতিবেশী দাগেস্তানের মুজাহিদদের মদদ দেয়ার মিথ্যা অজুহাতে রাশিয়া চেচেনদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধে রাশিয়ার সৈন্যদের হাতে হাজার হাজার বেসামরিক লোক শহীদ হয়। নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউই রেহাই পায় নাই। শীতল আবহাওয়া ও চিকিৎসার অভাবে শরণার্থী শিবিরে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। তাতে মানবতা ও মানবাধিকারের ক্ষতি কি! কারণ তারা যে মুসলমান।

 কমিউনিস্ট শক্তির পতনের পর আমেরিকাসহ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ এবং রাশিয়া এখন প্রকাশ্যভাবেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। যে সমস্ত মুসলিম দেশ তাদের আনুগত্য স্বীকার করতে কুণ্ঠিত সেই দেশগুলোকে তারা চিহ্নিত করেছে কখনো সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে আবার কখনো মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে। তারপর তাদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অবরোধ শুরু করে দেয়। তাছাড়া দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের ইসলামী সংগঠনও তাদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এদের প্রচার প্রোপাগান্ডার ফলে দুনিয়ার কোন মুসলিম দেশ বা ইসলামী সংগঠন মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইলে তারা হয়ে যাচ্ছে মৌলবাদী। কিন্তু প্রাক্তন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘ইউরোপে কোন মুসলিম দেশ সহ্য করা হবে না'- তখন কিন্তু তিনি মৌলবাদী হন না। বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিলেও ভারতকে মৌলবাদী রাষ্ট্র বলে কেউ গালাগালি করে না। তাদের চোখে মুসলিম মাত্রই মৌলবাদী।

 আসলে চরমপন্থী সন্ত্রাসী কারা? ওকলাহোমায় বোমা বিস্ফোরণকারী টিমোথি মাইকেল ভিগ একজন খৃস্টান, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের হত্যাকারী ইগল আমীর একজন চরমপন্থী ইহুদী। মুসলমানরা তো এরকম কোন অপরাধ করেনি। তবুও পশ্চিমা শক্তি ও তাদের বরকন্দাজদের চোখে মুসলমানরাই শুধু মৌলবাদী, সন্ত্রাসী। বাংলাদেশেও আমরা এই প্রচারণাই লক্ষ্য করছি। তাদের ভাবখানা এমন যে, একবার মুসলিম মৌলবাদী বলে চিহ্নিত করতে পারলেই হলো তখন যেন তাদের ওপর সব রকম নির্যাতন বৈধ হয়ে যাবে। সত্যই আমরা এক আজব দুনিয়ায় বাস করছি।

 পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের ওপর যে অমানুষিক অত্যাচার-নিপীড়ন চলছে সে ব্যাপারে সভ্যতাগর্বী পশ্চিমা দেশগুলো অসম্ভব রকম নীরব। আমাদের দেশের একশ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাও নীরব। এরা কথায় কথায় বিবৃতি ঝাড়েন, লম্বা লম্বা বক্তৃতা করেন, কিন্তু হাল আমলের দুনিয়ার বর্বরতম ঘটনাগুলোর ব্যাপারে তারা পশ্চিমা দেশগুলোর মতোই নীরব। এই নীরবতা থেকেই পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে এদেশীয় বরকন্দাজদের যোগসূত্রের বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

 বর্তমানে মুসলমানদের আনুগত্য-অনুসরণ আর চরিত্রের বিচার-বিশ্লেষণ করলে মনে হবে মুসলমানদের সংজ্ঞাও যেন পাল্টে যাচ্ছে।
মোটকথা মানুষের পরিচয় মেলে তার সুসময়ে আর দুঃসময়ে। এই উভয় সময়ে বর্তমানে মুসলমানরা দুনিয়াতে বড়ই দুঃসময়ের সম্মুখীন। এখন মুসলমানদের ওপর হাতছানি দিচ্ছে কখনো আমেরিকা, কখনো রাশিয়া, কখনো ইহুদী চক্র, কখনো আধিপত্যবাদ আবার কখনো ভোগবাদ আর বিভ্রান্তি। আবার কখনো বা দেখা দেয় রক্তচক্ষু ও নির্যাতনের কালো হাত। লোভ-লালসার ছলনাও উঁকি মারে মাঝে মাঝে। এই অবস্থায় মুসলমানের সংজ্ঞাটাই পাল্টে যায় কি না সেটাই চিন্তার বিষয়। তাই বলছিলাম, আমরা এ কোন আজব দুনিয়ায় বাস করছি।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter