Flickr

Sunday, 26 February 2012

একুশের চেতনা

Posted by   on

একুশের চেতনাকে কেন্দ্র করে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা এখন জরুরি এবং সেটাই আমাদের প্রকৃত মুক্তির পথ। বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করা মানে দেশমাতৃকাকে, নিজের মাকে অবহেলা করা, অমর্যাদার চোখে দেখা। সুতরাং কেবল ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পালন করলেই হবে না, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। কার্যকর করতে হবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটকে। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনও করতে হবে। পাশাপাশি সর্বত্র বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করাও সমান জরুরি। একুশের চেতনাকে সমুজ্জ্বল রাখতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনা প্রতিটি বাঙালি সত্তায় মিশে আছে। তারই আলোকে এবার পালিত হবে ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর। ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত পথ ধরেই এসেছে মহান মুক্তিযুদ্ধ। মাতৃভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির একটি গৌরবময় অধ্যায়, তেমনি মুক্তিযুদ্ধও বাঙালি জাতিসত্তার স্মারক। একমাত্র বাঙালি জাতি ছাড়া পৃথিবীর কোনো জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দেয়নি, এত প্রাণ যায়নি অন্য কোনো দেশের স্বাধীনতার জন্যও।

 পৃথিবীতে বেদনা ও গৌরবের আশ্চর্যজনক নানা ঘটনা ঘটেছে দেশে দেশে। আমাদের রয়েছে গৌরবময় দুটো ঘটনা_ যার মধ্যে শোক ও বেদনা নিহিত। একটা ভাষা আন্দোলন, ১৯৫২ সালে যার বিপুল স্ফুরণ ও আত্মত্যাগ হয়েছিল। আর একটা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম, ১৯৭১ সালে। বিপুল আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে পাওয়া। মূলত একাত্তরের সূচনাই হয়েছিল বায়ান্নতে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব মানুষ ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান রক্ষার জন্য একটি বিশেষ গোষ্ঠী মরিয়া হয়ে উঠেছিল। আর সে কারণে একুশে ভাষার জন্য যুদ্ধ এবং একাত্তরে স্বাধীনতা বা স্বাধিকার অর্জনের জন্য যুদ্ধ প্রকরণগতভাবে ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য ছিল একই।


বাংলা একটি আর্য ভাষা, যার বয়স অন্তত হাজার বছর। বাংলা ভাষা বর্তমানে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা রাজ্য, আসামের শিলচর, করিমগঞ্জ, গোয়ালপাড়া এবং বিহার, উড়িষ্যা ও ঝাড়খ-ের পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রচলিত। এর মধ্যে বাংলাদেশের বাইরে ভারতের যেসব অঞ্চলে বাংলাভাষা প্রচলিত সেসব অঞ্চলে তা হিন্দি বা স্থানীয় অন্যান্য ভাষার চাপে কোণঠাসা।

 কোনো কোনো প-িত বাংলাকে সংস্কৃত ভাষার 'দুহিতা' বলে অভিহিত করেন। কিন্তু একথা সত্য যে, আঞ্চলিক প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়। প্রাকৃতজনের তথা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা প্রাকৃত ভাষা। এই অর্থে গৌড় অঞ্চলের গৌড়ীয় প্রাকৃত বাংলাভাষার 'জননী'। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের আধুনিক ভাষাগুলো অনুরূপভাবে স্থানীয় প্রাকৃত থেকে জন্মলাভ করে, যেমন মাগধী প্রাকৃত থেকে হিন্দি, মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃত থেকে মারাঠি ভাষার উদ্ভব হয়। সংস্কৃত ছিল সর্বভারতীয় লেখ্য বা সাহিত্যিক ভাষা। প্রাকৃত ও আধুনিক ভাষার মাঝখানে 'অবহট্ট' নামে স্বল্পকাল স্থায়ী একটি স্তর ছিল।

 ভাষা আন্দোলনের অভিঘাতে আমরা কিছু সচেতন হলেও বারবার একই বিভ্রান্তির পথেই পা বাড়াচ্ছি। কোনো কোনো শিক্ষিত লোক বলেন বাংলা নয়, আমাদের শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে ইংরেজি। তারা যুক্তি দেখান, বিশ্বায়নের এই যুগে ইন্টারনেট, ফেসবুক, ই-মেইল-কম্পিউটার-ফ্যাক্সের যুগে ইংরেজির কোনো বিকল্প নেই। এ কথাগুলো যারা বলেন তারা সমাজের আধিপত্যশীল শ্রেণীর প্রতিনিধি এবং নিয়ন্ত্রক। এদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে। তাদের বাংলার প্রতি উন্নাসিকতা রয়েছে, রয়েছে ক্ষেত্রবিশেষে ঘৃণাও।

 মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে কেবল একটি স্বাধীন ভূখ- নয়, নৃতত্ত্ব-জাতিতত্ত্বের মতো ভাষাতত্ত্বের অনেক সম্পদ আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছি। আমাদের আজকের মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা সমগ্র জাতির শত-সহস্র বছরের সাধনার ফসল। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে যখন জাতিসত্তার বিকাশ ঘটতে থাকে তখন থেকেই আমরা একটা বৈরী পরিবেশের মধ্যে পড়ে যাই। যা আজো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। উপরন্তু ভাষা নিয়ে চলছে নানা ষড়যন্ত্র, চলছে বিজাতীয় ভাষার আগ্রাসন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। লক্ষ্য ছিল ওই রাষ্ট্রকে স্থায়ী করার উদ্দেশ্যে দেশের অভ্যন্তরে একটি সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখা। এ জন্য তার অধিপতিরা ধর্মকে খুব শক্ত করে অাঁকড়ে ধরেছিল। তারা স্বপ্ন দেখেছিল পাকিস্তান হবে ইসলামী রাষ্ট্র। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষেও তাদের যুক্তি ওই একটাই, উর্দু বাংলার তুলনায় অধিক ইসলামী। নইলে উর্দু পাকিস্তানের অধিকাংশ নাগরিকের ভাষাও ছিল না এবং বাংলার তুলনায় উন্নতও ছিল না। বাংলাকে তারা বলত পৌত্তলিক ভাষা। বাংলা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা নয়, তাদের মাতৃভাষা উর্দু এ সাংস্কৃতিক প্রচারণা পাকিস্তান হওয়ার আগেই শুরু করা হয়েছিল, পাকিস্তান হওয়ার পর জানা হলো যে বাংলার যোগ্যতা নেই পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়ার। বাংলাকে উর্দুর দ্বিতীয় স্তরে পরিণত করার অপচেষ্টা চলছিল_ যা বাঙালি রুখে দিয়েছে।

 ভাষা আন্দোলন সরাসরি আঘাত করল সামন্ত সংস্কৃতিকে জোরদার করার ওই রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের গোড়াতে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের জায়গায় সে নিয়ে এলো ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে। তবে ভাষার ব্যাপারে বাঙালি আগে থেকেই আপসহীন প্রতিবাদী ছিল। সতেরো শতকের কবি আবদুল হাকিম সুউচ্চ কণ্ঠে বলেন, বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে যে ব্যক্তি 'হিংসে বঙ্গ বাণী', সে ব্যক্তি যেন এ দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে চলে যায়। তিনি তার জাত তুলেও কটু মন্তব্য করেন। উনিশ শতকে মীর মশাররফ হোসেন বলেন, 'মাতৃভাষার প্রতি যাহার ভক্তি নাই, সে মানুষ নহে।' বিশ শতকে বিভিন্ন সময়ে সাধারণ মানুষ বাংলাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি কতিপয় তরুণ জীবন বিসর্জন দিয়ে প্রতিবাদের চূড়ান্ত প্রমাণ দিয়েছে। মাতৃভাষার জন্য এত বড় ত্যাগ পৃথিবীতে বিরল। সেদিনের শাসকশ্রেণী ও তার তাঁবেদার গোষ্ঠী এই ত্যাগের মূল্য বোঝেনি। কিন্তু পরবর্তীকালে বিশ্ববাসী এর মর্ম বুঝেছে ও সঠিক মূল্যায়ন করেছে।

 বিশ শতকের শেষ প্রান্তে জাতিসংঘের অঙ্গ-সংগঠন ইউনেস্কো বাংলার মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে উদযাপন করার ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণার ফলে বাংলা ভাষা পৃথিবীর সব ভাষার মধ্যে একটা দুর্লভ মর্যাদার অধিকারী হয়েছে। বলা যায়, সব ভাষার ওপর উঠে এসে একটা ঈর্ষণীয় স্থান দখল করে নিয়েছে। এখন প্রতিবছর ওই দিনটিকে স্মরণ করে বিশ্বের ১৯০টি দেশ বাংলা ভাষার কথা বলে এবং আপন মাতৃভাষার মমত্ব অনুভব করে। কেবল তাই নয়, বাংলা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অপেক্ষায়।

 এখন প্রশ্ন হলো, মাতৃভাষার এত বড় গৌরব ও অর্জনকে আমরা কি সঠিক উপলব্ধি করতে পেরেছি? ভাষার ব্যাপারে বাংলাদেশে আজ যা ঘটছে, তা প্রত্যক্ষ করে সহজেই বলা যায়_ না, আমরা পারিনি। আজকাল প্রবীণদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়_ স্কুল-কলেজে ছেলেমেয়েরা গোল্লায় গেছে। ইংরেজি বলা তো দূরের কথা, শুদ্ধ করে বানান পর্যন্ত বলতে পারে না। সরকারি-বেসরকারি উপরের মহল থেকে হরহামেশা বলা হচ্ছে_ বিশ্বায়নের যুগে আমাদের টিকে থাকতে হলে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে। বিশেষ করে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রবাহ, মুক্তবাজার অর্থনীতি ইত্যাদির কারণে ইংরেজি ভাষাজ্ঞান ও লিখন-কথনের দক্ষতা ছাড়া গত্যন্তর নেই। অতএব আমাদের ইংরেজি শিখতেই হবে। পরিস্থিতি এমন যে, ইংরেজি বিদ্যা অর্জন করতে না পারলে কোনো শিক্ষা আর শিক্ষা হয় না, সব বিফলে যায়। এ মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। পাশাপাশি রোধ করতে হবে বাংলা ভাষার বিকৃতিও।

 আমাদের ভাষা আন্দোলন কেবল অতীতের স্মৃতি নয়, ভবিষ্যতের জন্য প্রেরণা ও পথপ্রদর্শক। বাংলাভাষা সর্বস্তরে কতটা প্রচলিত হচ্ছে তার নিরিখে বিচার করলেই বোঝা যাবে গণতন্ত্রের দিকে আমরা কতটা এগিয়েছি, শিক্ষা মোটেই সর্বজনীন হয়নি এবং শিক্ষিতরাও বাংলা ভাষা চর্চায় যে অত্যন্ত অধিক আগ্রহ দেখাচ্ছেন তা নয়। যিনি ইংরেজি ভালো জানেন বাংলাদেশে তারই কদর বেশি।
প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রভাষা থেকে শিক্ষার মাধ্যম এবং জীবনের সর্বস্তরে বাংলাভাষা ব্যবহারের দাবি ছিল সর্বজনীন। যাকে সামনে নিয়ে আমরা এগিয়েছি অবিচল লক্ষ্যে, স্বাধীনতার ও স্বাধিকার অর্জনে।

 বর্তমানে সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহার দারুণভাবে উপেক্ষিত। এর ভবিষ্যৎ ফলাফল খুব খারাপ হতে বাধ্য। জাতীয় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা ঘোরতর অন্যায়। আসলে মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চাই জাতীয় অগ্রগতির চাবিকাঠি। চীন, জাপান, কোরিয়া ও জার্মান প্রভৃতি রাষ্ট্র মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে আত্মনির্ভরশীল হতে পারলে আমরা কেন ইংরেজিনির্ভর থাকব। ইংরেজি বা অন্য ভাষা শিক্ষার প্রতি আমাদের কোনো বিদ্বেষ নেই। বরং যারা পারবে তারা একাধিক ভাষা শিখে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও দর্শনের ক্ষেত্রে যদি মৌলিক অবদান রাখার মাধ্যমে বিশ্ব সভায় নিজের স্থান করে নিতে পারে।

 কিন্তু দেশের সব ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তনের জন্য চাই নিজ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা মাতৃভাষার মাধ্যমে নতুন জাতীয় বিজ্ঞানভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক এক শিক্ষাব্যবস্থা। দেশের সাংস্কৃতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত এ ধরনের শিক্ষার মাধ্যমেই শুধু সংস্কৃতিমনা আধুনিক ও আলোকিত মানুষ সৃষ্টি করা সম্ভব। জাতীয় অগ্রগতির জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।

 যে করেই হোক দেশজ ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চার দ্বারা বিদেশি অপসংস্কৃতি রোধ করতে হবে। আমাদের দেশপ্রেম, স্বজাতিপ্রীতি এবং সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে হবে। এর জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি ও মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে এসব অর্জন করা যাবে না।

 একুশের চেতনাকে কেন্দ্র করে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা এখন জরুরি এবং সেটাই আমাদের প্রকৃত মুক্তির পথ। বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করা মানে দেশমাতৃকাকে, নিজের মাকে অবহেলা করা, অমর্যাদার চোখে দেখা। সুতরাং কেবল ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পালন করলেই হবে না, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। কার্যকর করতে হবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটকে। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনও করতে হবে। পাশাপাশি সর্বত্র বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করাও সমান জরুরি। একুশের চেতনাকে সমুজ্জ্বল রাখতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter