বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী উৎসবে যদি গ্রেনেড আতঙ্কের উপরে যৌনাতঙ্ক প্রতিষ্ঠা হয়ে যায় তা’হলেই তো কেল্লা ফতে। আর জমজমাট বৈশাখী মেলাও হবে না আবার ইসলামী খেলাফতও কায়েম হবার পথও সুগম হবে। এই ধরনের কাজ কারবার নির্বিঘ্নে করে যারা পার পেয়ে যায় তারাই দেশের আসল প্রভু? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছড়ানো হিজাব যদি দেশশুদ্ধ মেয়েদের ওপর চাপানো যায় তা’হলে কারা দেশ প্রভু? পথেঘাটে উৎসবে সভায় যদি মেয়েদের দাবড়ে, খামচে জামা কাপড় ছিড়ে মজা লুটা যায় বিনা বাধায় তা’হলে দেশ চালাচ্ছে কারা? পুলিশ যদি বলে এখনো বিবস্ত্র হয়’নি নারী; তা’হলে কোন দেশে বাস করে নারী? রাষ্ট্র কি বিবস্ত্র নারী দেখার পর বলবে মেয়েরা সামলে চলে না তাই এমন হয়; আমরা কি করব তখন? বেশিরভাগ মেয়েরা কবে বুঝবে পুরুষ সমর্থিত ধর্মের দেশে যৌনসন্ত্রাস কেন হয় নির্বিঘ্নে? কবে শিখবে নিজকে তুলে ধরতে হলে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ ছাড়া উপায় নেই? কবে জানবে অধিকার আদায় করে নিতে হয়? পহেলা বৈশাখে টিএসসি এলাকায় নারীদের ওপর পরিকল্পিত মৌলবাদী যৌন সন্ত্রাস চালানো হয়েছে। গত দু দিন ধরে বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখা নানান তথ্য দেখেশুনে বিশ্লেষণ করে মনে হয়েছে বাঙালির প্রানের উৎসব’কে অনৈসলামিক বলে দেশের সংস্কৃতিকে ত্রাসের সাগরে ডুবিয়ে দেবার জন্যই করা হয়েছে এসব।
সহজ সরল আনন্দোচ্ছল উৎফুল্ল রঙ্গপ্রিয় বাঙালি মানুষ। দেশ বিভাগের পর ক্রমান্বয়ে বাংলা হয়ে গেল আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। যদিও এর আগেই এলো আরবী প্রভাব। যে বাঙালি ছিল বাঙালি তিনি হয়ে গেলেন মোসলমান বাঙালি। তবু বাঙলা সংস্কৃতি আপন গতিতে প্রানের আবেগে ক্রমান্বয়ে হোল শক্তিশালী। দেশ স্বাধীনতার পর স্বাধীন বাঙালির প্রানের উৎসবগুলো আবার সগর্ব চর্চায় ফিরে পেলো বাঙালি। কিন্তু সেই কুচক্রী প্রতিক্রিয়াশীল খুনে বদমাশরা; যারা ৭১’এ খুন ধর্ষণ করেছিলো নিরীহ মা বোনেদের; তারা আবার দেশ দখল করলো মাত্র চার বছরেই। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজাকার উচ্চারণ নিষিদ্ধ হয়ে গেল। প্রায় দু যুগ লেগে গেল ছদ্মবেশী দেশপ্রেমিক খুনেদের হাত থেকে বেরুতে সেই সহজ সরল আনন্দোচ্ছল উৎফুল্ল রঙ্গপ্রিয় বাঙালির। কিন্তু মুক্তি নেই, হেরে যাওয়া প্রতিক্রিয়াশীল জামাত শিবির আর তাদের দোসররা এখন ধর্মের আবরণে বাংলাদেশের মানুষদের টুপি হিজাব পরিয়েছে। আর কারা পরছে সে’সব? সেই আমাদের সহজ সরল আনন্দোচ্ছল উৎফুল্ল রঙ্গপ্রিয় বাঙালি মানুষ। স্বেচ্ছায় না’কি আনমনে? চাপে পড়ে না’কি আনন্দে? তা’হলে তাদের স্ত্রী, কন্যা সন্তানদের ওপর যে যৌন সন্ত্রাস হয়েছে তা’কি দাঁড়ি, টুপি হিজাব হালাল পন্থী না’কি বাঙালির প্রানের আবেগ পরিপন্থী? কি জবাব তাদের? এবার কোন পথ ঠিক পথ? মেহেদী রঞ্জিত হিজাব মন্ডিত আরবি যৌন সন্ত্রাসের শরিয়া পথ না’কি হাজার বছরের প্রানের দাবির সহজ সুন্দর বাঙালি সংস্কৃতির পথ?
বাংলাদেশের মেয়েরা এখন বিদ্যান; স্বাবলম্বী, উপার্জনক্ষম এবং পরিবার প্রধানও বটে। দেশটি যখন নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রচন্ড শক্তিশালী হচ্ছে ঠিক সেই সময়ে দেশের শত্রুগুলো আবার শুরু করেছে নতুন তান্ডব। শুরু করেছে বাংলাদেশের মেয়েদের ঘরে পুরে যৌনদাসী বানাবার অপচেষ্টা। ওদের হিরো শফি মোল্লার মত ফতোয়াবাজরা, ওরা হয়েছে দেশের চোখের মনি। কিন্তু চিন্তার ব্যপার তেতুল শফি কিন্তু কোরান থেকে বুঝে শুনেই বলেছে, মেয়েদের ঘরে থাকবার কথা, তেতুল তেতুল কারণ বলেছে, আরো বলেছে পুরুষের মনোযোগ আকর্ষণ না করবার কথা, পর্দার কথা। আরো নানা ফতোয়াবাজ কোরান ঘেঁটেই বলেছে নারীদের ছোট করা আরো নানান ভয়ঙ্কর কথা। কিন্তু অন্যদিকে আবার সেই আমাদের সহজ সরল আনন্দোচ্ছল উৎফুল্ল রঙ্গপ্রিয় বাঙালি মানুষ তাদের স্ত্রী কন্যাদের বড় করছে হিজাবি বিদ্যালয়, আয় রুজির কার্য্যক্ষেত্র এবং বিউটি পার্লারে যেতে দিয়ে। আবার বৈশাখী মেলাতেও যেতে দিতে হচ্ছে প্রানের টানে। কি অদ্ভুত বাঙালি মুসলমান।
আজকের মা বাবা আর গুরুজনদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা হেফাজতে শফিদের পথ ধরে সফিপন্থী হয়ে নিরাপদ ইতর হবে; তাদের সন্তানদেরও নুরানী নির্দেশ মোতাবেক ঘরকুনো যৌনদাসী তেতুল বানাবে না’কি সন্তানদের বিদ্যাশিক্ষা অর্জন করে খোলামনে মুক্তবিশ্বে বড় হতে দেবে। কথায় কথায় আলহামদুলিল্লা বলবে না’কি ভালো আছি; আপনি কেমন আছেন ধরনের স্বাভাবিক কথা বলবে। তারা কি ওই সব যৌন সন্ত্রাসকে হালাল এবং ঠিক’ই আছে বলবে না’কি সুস্থ আচরণ করে বলবে এইসব চলবে না। সুস্থ ভাবনানির্ভর সিদ্ধান্ত না নিলে ধর্মের ওয়ান ওয়ে সুড়ঙ্গে সেঁধিয়ে গেলে ওখান থেকে বের হওয়া মুশকিল। প্রায় অসম্ভব। তাই বাঁচতে হলে গড্ডালিকা প্রভাবে গা ভাসাবার আগে, বাংলাদেশকে ফাকিস্তান আফগানিস্তান আইসিস বানাবার আগে আজকের মা বাবা সমাজকে, নারীকে মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে হবে; প্রজন্মকে সাহায্য করতে হবে প্রতিবাদ করতে। মেয়েদের দিতে হবে স্বাধীনতা, সম্মান এবং যথাযথ নিরাপত্তা। এটা সমাজকে করতে হবে। কঠোর আইন ও শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণ প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করুন। বিচার; কঠোর আইন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত পথ ছাড়বেন না। সু-নাগরিক, প্রয়োজনে সারা দেশের নারী এক হয়ে হুঙ্কার ছাড়ুন। নারী নির্যাতন, যৌন নিপীড়নের বিচারের জন্য নতুন কঠোর আইন না হওয়া পর্যন্ত নিজের রাস্তা ছাড়বেন না। নিজেদের অধিকার নিজেদের আদায় করে নিতে হবে। সরকার, পুলিশ বা রাষ্ট্রের সময় কোথায়? ওদের সময় যায় গদি বাঁচাতে; নাগরিক সেবার সময় তাদের নেই।
Thursday, 23 April 2015
Monday, 6 April 2015

‘রাষ্ট্র তুমি সংযত হও জনবান্ধব হও’
‘রাষ্ট্র তুমি সংযত হও জনবান্ধব হও’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে উল্লেখ করে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান এর কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, ‘রাষ্ট্র তুমি সংযত হও, জনবান্ধব হও।’ গত শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সেমিনারে পুলিশের সমালোচনা করে তিনি আরো বলেন, আপনারা যাকে আটক করেন তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করুন। ৪/৫ দিন আগে ধরে আটকের পর কাগজে-কলমে দেখাবেন যে, ২৪ ঘণ্টা আগে ধরা হয়েছে, এ তামাশা আপনারা করবেন না। এটা বন্ধ করুন। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান আরো বলেন, পেট্রোল বোমা কারা ফাটাচ্ছে তাদের আপনারা ধরতে পারেন না। এটা পুলিশের ব্যর্থতা। এদের বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তিনি আরো বলেন, সাম্প্রতিক সংঘাতকে কোনোভাবেই রাজনৈতিক সহিংসতা বলা যাবে না। এটা জঘন্যতম ফৌজদারি অপরাধ, সে বিবেচনায় একে নির্মূল করতে হবে। তা না হলে এটি রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান যে বক্তব্য রেখেছেন, তাতে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়ি এবং পেট্রোল বোমা- রাজনীতির সহিংস চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। আমরা জানি, গণতান্ত্রিক সমাজে বহুদল ও বহুমতের অস্তিত্ব খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। সে কারণে তর্ক-বিতর্ক, মতবিরোধ রাজনীতিতে হতেই পারে। দুঃখজনক হলেও কখনও কখনও রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনাও ঘটে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা পুলিশী অভিযানের নামে যে দমন-পীড়ন ও গুলীর ঘটনা লক্ষ্য করেছি, তা গণতান্ত্রিক সরকারের কর্মকা-ের সাথে যায় না। আবার লাগাতার হরতাল-অবরোধের সাথে পেট্রোল বোমার যে নিষ্ঠুরতা লক্ষ্য করেছি, তাও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে মানায় না। অবশ্য বিরোধী দল পেট্রোল বোমার দায়-দায়িত্ব স্বীকার করে না। তারা বরং বলছে, বিরোধী দলের আন্দোলনকে বিতর্কিত করার লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকেই ওইসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এসব বক্তব্যের পরেও আমরা স্পষ্টভাবেই বলতে চাই, পেট্রোল বোমা হামলা রাজনীতির কোনো উপাদান হতে পারে না, বরং এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ। এই অপরাধ যারাই করবে তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রসঙ্গত এখানে বলে রাখা ভাল যে, এসব অপরাধ দমন করতে হলে সত্যনিষ্ঠভাবে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো মোটিভ বা পূর্ব ধারণার ভিত্তিতে ঢালাওভাবে অভিযান চালানোর মাধ্যমে অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব নাও হতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধী দলের আন্দোলনের মোকাবিলায় সরকারকে কঠোর অবস্থানে লক্ষ্য করা গেছে। আলাপ-আলোচনার বদলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে বিরোধী দলকে শায়েস্তা করার কৌশল অবলম্বন করেছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্রয়ের বাতাবরণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অনেক ক্ষেত্রে পেশাগত মানদন্ড লঙ্ঘন করে বাড়াবাড়িমূলক তৎপরতা চালাতেও দেখা গেছে। এ কারণে দমন-পীড়নের পাশাপাশি বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গুলী করার ব্যাপারেও পুলিশকে বেশ নিঃশঙ্কচিত্ত মনে হয়েছে। এ কারণেই হয়তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৌরাত্ম্যকে চিহ্নিত করে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘রাষ্ট্র তুমি সংযত হও, জনবান্ধব হও’। আমরা মনে করি, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের ভূমিকাটাই প্রধান। আর এ কাজে রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করার জন্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। গুরুত্বপূর্ণ এ কাজে রাজনৈতিক বিদ্বেষ কিংবা অনুরাগ ও বিরাগের মনোভাব পরিত্যাজ্য। এ কাজে সাফল্য লাভ করতে হলে ন্যায়নিষ্ঠভাবে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সংযতভাবে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে অনেক ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত তেমন আচরণ লক্ষ্য করা যায়নি। এ কারণেই রাজনৈতিক অঙ্গনের মত নাগরিকদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও সমস্যার মাত্রা বেড়েছে। অনাকাক্সিক্ষত এমন পরিবেশ থেকে জনগণ মুক্তি চায়। তবে এর জন্য প্রয়োজন হবে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিরোধী দলের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল ও সংযত আচরণ। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাই উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান যে বক্তব্য রেখেছেন, তাতে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়ি এবং পেট্রোল বোমা- রাজনীতির সহিংস চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। আমরা জানি, গণতান্ত্রিক সমাজে বহুদল ও বহুমতের অস্তিত্ব খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। সে কারণে তর্ক-বিতর্ক, মতবিরোধ রাজনীতিতে হতেই পারে। দুঃখজনক হলেও কখনও কখনও রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনাও ঘটে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা পুলিশী অভিযানের নামে যে দমন-পীড়ন ও গুলীর ঘটনা লক্ষ্য করেছি, তা গণতান্ত্রিক সরকারের কর্মকা-ের সাথে যায় না। আবার লাগাতার হরতাল-অবরোধের সাথে পেট্রোল বোমার যে নিষ্ঠুরতা লক্ষ্য করেছি, তাও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে মানায় না। অবশ্য বিরোধী দল পেট্রোল বোমার দায়-দায়িত্ব স্বীকার করে না। তারা বরং বলছে, বিরোধী দলের আন্দোলনকে বিতর্কিত করার লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকেই ওইসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এসব বক্তব্যের পরেও আমরা স্পষ্টভাবেই বলতে চাই, পেট্রোল বোমা হামলা রাজনীতির কোনো উপাদান হতে পারে না, বরং এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ। এই অপরাধ যারাই করবে তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রসঙ্গত এখানে বলে রাখা ভাল যে, এসব অপরাধ দমন করতে হলে সত্যনিষ্ঠভাবে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো মোটিভ বা পূর্ব ধারণার ভিত্তিতে ঢালাওভাবে অভিযান চালানোর মাধ্যমে অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব নাও হতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধী দলের আন্দোলনের মোকাবিলায় সরকারকে কঠোর অবস্থানে লক্ষ্য করা গেছে। আলাপ-আলোচনার বদলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে বিরোধী দলকে শায়েস্তা করার কৌশল অবলম্বন করেছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্রয়ের বাতাবরণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অনেক ক্ষেত্রে পেশাগত মানদন্ড লঙ্ঘন করে বাড়াবাড়িমূলক তৎপরতা চালাতেও দেখা গেছে। এ কারণে দমন-পীড়নের পাশাপাশি বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গুলী করার ব্যাপারেও পুলিশকে বেশ নিঃশঙ্কচিত্ত মনে হয়েছে। এ কারণেই হয়তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৌরাত্ম্যকে চিহ্নিত করে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘রাষ্ট্র তুমি সংযত হও, জনবান্ধব হও’। আমরা মনে করি, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের ভূমিকাটাই প্রধান। আর এ কাজে রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করার জন্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। গুরুত্বপূর্ণ এ কাজে রাজনৈতিক বিদ্বেষ কিংবা অনুরাগ ও বিরাগের মনোভাব পরিত্যাজ্য। এ কাজে সাফল্য লাভ করতে হলে ন্যায়নিষ্ঠভাবে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সংযতভাবে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে অনেক ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত তেমন আচরণ লক্ষ্য করা যায়নি। এ কারণেই রাজনৈতিক অঙ্গনের মত নাগরিকদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও সমস্যার মাত্রা বেড়েছে। অনাকাক্সিক্ষত এমন পরিবেশ থেকে জনগণ মুক্তি চায়। তবে এর জন্য প্রয়োজন হবে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিরোধী দলের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল ও সংযত আচরণ। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাই উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।
Sunday, 5 April 2015

মানুষের আতঙ্ক দূর করতে হবে
মানুষের আতঙ্ক দূর করতে হবে
‘সাতক্ষীরায় বিরোধী দলের ওপর দমন অভিযান’ শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে দৈনিক সংগ্রামে। ৪ এপ্রিল মুদ্রিত খবরটিতে বলা হয়, আতঙ্কে আছে সাতক্ষীরার মানুষ। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চলছে হয়রানি ও নির্যাতন। সরকারদলীয় লোকজন পুলিশকে ব্যবহার করে বিরোধী দল দমনে মেতে উঠেছে। প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। একই সাথে চলছে গ্রেফতার বাণিজ্য। এমনকি আওয়ামী লীগের কোনো কর্মী-সমর্থকের সাথে ব্যবসায়িক লেনদেনে বাকবিত-া হলেও প্রতিপক্ষকে জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে। সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম। তিনি রড-সিমেন্টের ব্যবসা করেন। তার একমাত্র ছেলে নাইমুল ইসলামকে নিরাপদে রাখতে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। ঢাকায় পাঠানোর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাইফুল বললেন, ‘ছেলের বয়স ৩০ বছর। কখন কার সঙ্গে দেখে ওকেও পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। তারপর দেখা যাবে পায়ে গুলী খেয়ে পড়ে আছে’। সাতক্ষীরার এমন পরিবেশকে স্বাভাবিক পরিবেশ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।
আমরা জানি, যে কোনো দেশের সরকারের প্রধান দায়িত্ব জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান এবং শান্তিময় পরিবেশ রক্ষা। এ কাজ করতে গেলে প্রয়োজন হয় সুশাসন। আর সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে অনুরাগ ও বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকে প্রশাসন ও পুলিশকে আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখতে হয়। কিন্তু সাতক্ষীরায় তেমন পরিবেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করতে হলে তো সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ন্যায়নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে হয়। ঢালাওভাবে কোনো দল বা বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে দমন অভিযানকে আইনানুগ কাজ বলে বিবেচনা করা যায় না। পুলিশ ও প্রশাসনের এমন কাজকে সরকার প্রশ্রয় দিলে তার ফল হয় মারাত্মক। সাতক্ষীরায় এখন যে শুধু বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপরই জুলুম-নির্যাতন চলছে তা নয়, সাধারণ মানুষও এখন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। ফলে আতঙ্কের এক জনপদে পরিণত হয়েছে সাতক্ষীরা। আতঙ্ক সৃষ্টি তো পুলিশ, প্রশাসন কিংবা সরকারের কাজ হতে পারে না। বরং আতঙ্কের পরিবেশ দূর করে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাই সরকারের দায়িত্ব। আর সেই দায়িত্বে সহযোগিতা করাই পুলিশ ও প্রশাসনের কাজ।
সাতক্ষীরা জনপদে এখন একদিকে বিরাজ করছে হরতাল-অবরোধে নাশকতার আশঙ্কা, অন্যদিকে পুলিশী অভিযানে গ্রেফতার ও নির্যাতন ভীতি। রাজনীতিবিদরা তো এলাকায় থাকছেন না, কিন্তু গ্রেফতার আতঙ্কে দিন যাপন করতে হচ্ছে জেলার হাজার হাজার মানুষকে। তাদের অনেকেই এখন ঘর-বাড়ি ছাড়া। রাজনৈতিক সহিংসতা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গত দুই বছরে সাতক্ষীরা জেলায় নিহত হয়েছেন ৫৭ জন, গুম হয়েছেন ৫ জন। আর সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশী অভিযানে পায়ে গুলীবিদ্ধ হন ২৪ জন। গুলীবিদ্ধ দু’জনের পা কেটে ফেলতে হয়েছে। বাকিদের পক্ষেও স্বাভাবিক চলাফেরা সম্ভব হচ্ছে না। সাতক্ষীরায় পুলিশ ও প্রশাসনের যে রণমূর্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের চিত্র হতে পারে না। সভ্য দেশে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে পুলিশ ও প্রশাসন কিভাবে কাজ করে তা আমরা জানি। কিন্তু সাতক্ষীরায় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনায় পুলিশ যেন পেশাগত বিবেচনায় কাজ করার বদলে বিশেষ মহলের অনুকূলে অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কাজ করে চলেছেন। ফলে পুলিশের বিরাগের কারণে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা এখন ঘর বাড়ি ছাড়া। আর সাধারণ মানুষের বসবাস এক আতঙ্কজনক পরিবেশে। এমন পরিস্থিতির অবসান প্রয়োজন। সরকার তার সাংবিধানিক দায়-দায়িত্ব ও নির্বাচনী অঙ্গীকারের বিষয়গুলো বিবেচনায় আনলে সাতক্ষীরার পরিবেশ স্বাভাবিক হতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার এবং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের উচিত হবে গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমুন্নত রেখে নিজেদের কর্মকা-কে মূল্যায়ন করা। এর মধ্যেই রয়েছে সবার কল্যাণ।
আমরা জানি, যে কোনো দেশের সরকারের প্রধান দায়িত্ব জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান এবং শান্তিময় পরিবেশ রক্ষা। এ কাজ করতে গেলে প্রয়োজন হয় সুশাসন। আর সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে অনুরাগ ও বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকে প্রশাসন ও পুলিশকে আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখতে হয়। কিন্তু সাতক্ষীরায় তেমন পরিবেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করতে হলে তো সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ন্যায়নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে হয়। ঢালাওভাবে কোনো দল বা বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে দমন অভিযানকে আইনানুগ কাজ বলে বিবেচনা করা যায় না। পুলিশ ও প্রশাসনের এমন কাজকে সরকার প্রশ্রয় দিলে তার ফল হয় মারাত্মক। সাতক্ষীরায় এখন যে শুধু বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপরই জুলুম-নির্যাতন চলছে তা নয়, সাধারণ মানুষও এখন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। ফলে আতঙ্কের এক জনপদে পরিণত হয়েছে সাতক্ষীরা। আতঙ্ক সৃষ্টি তো পুলিশ, প্রশাসন কিংবা সরকারের কাজ হতে পারে না। বরং আতঙ্কের পরিবেশ দূর করে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাই সরকারের দায়িত্ব। আর সেই দায়িত্বে সহযোগিতা করাই পুলিশ ও প্রশাসনের কাজ।
সাতক্ষীরা জনপদে এখন একদিকে বিরাজ করছে হরতাল-অবরোধে নাশকতার আশঙ্কা, অন্যদিকে পুলিশী অভিযানে গ্রেফতার ও নির্যাতন ভীতি। রাজনীতিবিদরা তো এলাকায় থাকছেন না, কিন্তু গ্রেফতার আতঙ্কে দিন যাপন করতে হচ্ছে জেলার হাজার হাজার মানুষকে। তাদের অনেকেই এখন ঘর-বাড়ি ছাড়া। রাজনৈতিক সহিংসতা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গত দুই বছরে সাতক্ষীরা জেলায় নিহত হয়েছেন ৫৭ জন, গুম হয়েছেন ৫ জন। আর সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশী অভিযানে পায়ে গুলীবিদ্ধ হন ২৪ জন। গুলীবিদ্ধ দু’জনের পা কেটে ফেলতে হয়েছে। বাকিদের পক্ষেও স্বাভাবিক চলাফেরা সম্ভব হচ্ছে না। সাতক্ষীরায় পুলিশ ও প্রশাসনের যে রণমূর্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের চিত্র হতে পারে না। সভ্য দেশে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে পুলিশ ও প্রশাসন কিভাবে কাজ করে তা আমরা জানি। কিন্তু সাতক্ষীরায় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনায় পুলিশ যেন পেশাগত বিবেচনায় কাজ করার বদলে বিশেষ মহলের অনুকূলে অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কাজ করে চলেছেন। ফলে পুলিশের বিরাগের কারণে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা এখন ঘর বাড়ি ছাড়া। আর সাধারণ মানুষের বসবাস এক আতঙ্কজনক পরিবেশে। এমন পরিস্থিতির অবসান প্রয়োজন। সরকার তার সাংবিধানিক দায়-দায়িত্ব ও নির্বাচনী অঙ্গীকারের বিষয়গুলো বিবেচনায় আনলে সাতক্ষীরার পরিবেশ স্বাভাবিক হতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার এবং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের উচিত হবে গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমুন্নত রেখে নিজেদের কর্মকা-কে মূল্যায়ন করা। এর মধ্যেই রয়েছে সবার কল্যাণ।
Saturday, 4 April 2015

এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার
এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার
চিকিৎসাবিজ্ঞানের অবদান মানুষের জীবনকে সাবলীল ও দীর্ঘ করেছে এটা স্বীকার করতেই হবে। বিশেষ করে এন্টিবায়োটিক ওষুধ ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী জীবাণু বা ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণ থেকে মানুষ ও প্রাণিকে বাঁচিয়ে দীর্ঘজীবন দানে সক্ষম হয়েছে। তাই বলা যায়, সভ্যতার বিকাশে এন্টিবায়োটিকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এন্টিবায়োটিকসহ অন্যান্য ওষুধ আবিষ্কৃত না হলে যে মানুষ বা প্রাণি আজকাল ৭০ বা ৮০ বছর বেঁচে থাকছে, তা হয়তো শিশুকিশোর বয়সেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। এমনকি এর অভাবে সভ্যতার অহংকারও বহু আগে ধ্বংস হয়ে যেতো। অতএব এন্টিবায়োটিকের আবিষ্কার মহান আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতের মধ্যে অন্যতম বৈকি। সত্যি বলতে কি, সভ্যতা যেমন সামনে এগিয়ে চলছে, তেমনই সভ্যতার অন্যতম বাহন মানুষও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিদিন।
এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রোগজীবাণু বা ব্যাক্টেরিয়া বেশ ভয়াবহ ও জীবনঘাতী। এই ব্যাক্টেরিয়ার আগ্রাসী যাত্রা রুখে দিতেই আবিষ্কার হয়েছে এন্টিবায়োটিকের। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, কিছু অপরিণামদর্শী জীবনরক্ষাকারী এ ওষুধের অপব্যবহার করে মানবসভ্যতাকে আবারও হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে প্রতিদিন। তবে এমনটি কেউ সচেতনভাবে করছে তা হয়তো বলা যাবে না। কিছু অসচেতন বা বেখেয়াল মানুষ নিজেদের অজান্তেই জীবনরক্ষাকারী এ ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার করে সর্বনাশ ডেকে নিয়ে আসছে।
বিশ্বের বহুদেশে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রি একেবারেই নিষিদ্ধ। সামান্য মাথা ব্যথা বা সর্দি-কাশির ওষুধ কিনতেও চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র লাগে। কিন্তু আমাদের সব সম্ভবের এ দেশে বিস্ময়করভাবে জীবনরক্ষাকারী এন্টিবায়োটিক ওষুধও ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই বিক্রি হয়। আমাদের দেশে ক্রেতা যে কোনও ওষুধ চাইলেই বিক্রেতা তা দিয়ে দেন, যেমন লবণ, মরিচ আর শাক-সবজি আর কি। শুধু তাই না, কোনও ক্রেতা ওষুধের দোকানে এসে ‘মাথা ব্যথা, সর্দি, গা মেজমেজ করছে, ওষুধ দেন’ এমনটি বললেই বিক্রেতা ডাক্তার না হয়েও তা দিয়ে দেন অনায়াসেই। এমনকি লোকটির সামান্য সর্দি কাশির জন্য এন্টিবায়োটিকের দরকার না হলেও তা দিয়ে দেয়া হয়। এই হচ্ছে এদেশের ওষুধ বেচাকেনার বহুল প্রচলিত নিয়ম। অথচ ওষুধের এমন খোলামেলা বেচাবিক্রি উন্নত বিশ্বের কোথাও দেখা যায় না। কাঁচা বাজারের মতো বেচাকেনার ফলে মানুষ যেমন মুড়িমুড়কির মতো অপ্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করে অর্থের অপচয় করছে, তেমনই নানা জটিলতাও সৃষ্টি হচ্ছে। ওষুধের কার্যকারিতাও পাচ্ছে হ্রাস। ফলে প্রয়োজনের সময় সঠিক ওষুধটি প্রায় কাজই করছে না। এতে বদনাম হচ্ছে যেমন চিকিৎসকের, তেমনই ওষুধ কোম্পানিরও।
আসলে ওষুধ সেবন করতে হবে ওষুধের মতোই। মুড়িমুড়কির মতো ওষুধ খেলে অসুখ যেমন সারবে না, তেমনই সৃষ্টি হবে জটিলতাও। এমনকি চোখ নষ্ট, কিডনি বিকল, লিভার ডেমেজ, পরিশেষে জীবনবিনাশের মতো বেদনাদায়ক পরিসমাপ্তিও ঘটতে পারে ওষুধের অপ্রয়োজনীয় ও অপব্যবহারের দরুন। কাজেই যেকোনও ওষুধ সেবন করতে হবে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুসারে ও সতর্কতার সঙ্গে। অন্যথায় হবে হিতে বিপরীত। এ ব্যাপারে ডাক্তার, রোগী, ওষুধ বিক্রেতাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে যত্নবান ও দায়িত্বশীল হতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে জনসচেতনতা। উদ্যোগ নিতে হবে দেশ-পরিচালক ও প্রশাসনকেও। ওষুধ ব্যবহারে সচেতনতা বিষয়ক পাঠও সংযুক্ত করা যেতে পারে পাঠ্যতালিকায়।
এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রোগজীবাণু বা ব্যাক্টেরিয়া বেশ ভয়াবহ ও জীবনঘাতী। এই ব্যাক্টেরিয়ার আগ্রাসী যাত্রা রুখে দিতেই আবিষ্কার হয়েছে এন্টিবায়োটিকের। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, কিছু অপরিণামদর্শী জীবনরক্ষাকারী এ ওষুধের অপব্যবহার করে মানবসভ্যতাকে আবারও হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে প্রতিদিন। তবে এমনটি কেউ সচেতনভাবে করছে তা হয়তো বলা যাবে না। কিছু অসচেতন বা বেখেয়াল মানুষ নিজেদের অজান্তেই জীবনরক্ষাকারী এ ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার করে সর্বনাশ ডেকে নিয়ে আসছে।
বিশ্বের বহুদেশে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রি একেবারেই নিষিদ্ধ। সামান্য মাথা ব্যথা বা সর্দি-কাশির ওষুধ কিনতেও চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র লাগে। কিন্তু আমাদের সব সম্ভবের এ দেশে বিস্ময়করভাবে জীবনরক্ষাকারী এন্টিবায়োটিক ওষুধও ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই বিক্রি হয়। আমাদের দেশে ক্রেতা যে কোনও ওষুধ চাইলেই বিক্রেতা তা দিয়ে দেন, যেমন লবণ, মরিচ আর শাক-সবজি আর কি। শুধু তাই না, কোনও ক্রেতা ওষুধের দোকানে এসে ‘মাথা ব্যথা, সর্দি, গা মেজমেজ করছে, ওষুধ দেন’ এমনটি বললেই বিক্রেতা ডাক্তার না হয়েও তা দিয়ে দেন অনায়াসেই। এমনকি লোকটির সামান্য সর্দি কাশির জন্য এন্টিবায়োটিকের দরকার না হলেও তা দিয়ে দেয়া হয়। এই হচ্ছে এদেশের ওষুধ বেচাকেনার বহুল প্রচলিত নিয়ম। অথচ ওষুধের এমন খোলামেলা বেচাবিক্রি উন্নত বিশ্বের কোথাও দেখা যায় না। কাঁচা বাজারের মতো বেচাকেনার ফলে মানুষ যেমন মুড়িমুড়কির মতো অপ্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করে অর্থের অপচয় করছে, তেমনই নানা জটিলতাও সৃষ্টি হচ্ছে। ওষুধের কার্যকারিতাও পাচ্ছে হ্রাস। ফলে প্রয়োজনের সময় সঠিক ওষুধটি প্রায় কাজই করছে না। এতে বদনাম হচ্ছে যেমন চিকিৎসকের, তেমনই ওষুধ কোম্পানিরও।
আসলে ওষুধ সেবন করতে হবে ওষুধের মতোই। মুড়িমুড়কির মতো ওষুধ খেলে অসুখ যেমন সারবে না, তেমনই সৃষ্টি হবে জটিলতাও। এমনকি চোখ নষ্ট, কিডনি বিকল, লিভার ডেমেজ, পরিশেষে জীবনবিনাশের মতো বেদনাদায়ক পরিসমাপ্তিও ঘটতে পারে ওষুধের অপ্রয়োজনীয় ও অপব্যবহারের দরুন। কাজেই যেকোনও ওষুধ সেবন করতে হবে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুসারে ও সতর্কতার সঙ্গে। অন্যথায় হবে হিতে বিপরীত। এ ব্যাপারে ডাক্তার, রোগী, ওষুধ বিক্রেতাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে যত্নবান ও দায়িত্বশীল হতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে জনসচেতনতা। উদ্যোগ নিতে হবে দেশ-পরিচালক ও প্রশাসনকেও। ওষুধ ব্যবহারে সচেতনতা বিষয়ক পাঠও সংযুক্ত করা যেতে পারে পাঠ্যতালিকায়।
Thursday, 2 April 2015

গোয়েবলসীয় সভ্যতায় এখন আমাদের বসবাস
গোয়েবলসীয় সভ্যতায় এখন আমাদের বসবাস
গোয়েবলস-এর মত লোকদের অভাব কখনো পৃথিবীতে ছিল না। এখনো নেই। এরা মিথ্যাকে সত্যের মত প্রচার করে থাকে। নিজের দোষ কৌশলে অপরের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। এদের কারণে এই পৃথিবীতে সহজ-সরল লোকদের জীবন-যাপন কঠিন হয়ে ওঠে। বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে গোয়েবলস প্রজাতির লোকদের আধিক্য লক্ষ্য করার মতো। ফলে ভদ্রলোকেরা এখন আর রাজনীতিতে আসতে চান না। তবে আদর্শিক ও নৈতিক দিক থেকে যারা বলিষ্ঠ, তারা চ্যালেঞ্জগ্রহণ করেই রাজনীতিতে আসছেন- কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তারা কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পরিম-লে যে এখন গোয়েবলসদের দৌরাত্ম্য চলছে। বলা যেতে পারে, গোয়েবলসীয় সভ্যতায় এখন আমাদের বসবাস।
এই পৃথিবীতে মানুষের সমাজ একরকম নয়। ধর্ম-দর্শন তথা জীবন-দর্শনের কারণে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। তবে গোয়েবলস-প্রজাতির মানুষের কারণে এই বৈচিত্র্য কখনো কখনো মতবিরোধ, দ্বন্দ্ব সংঘাত ও হিংসাবিদ্বেষের রূপ পরিগ্রহ করে। সমাজে এর দায়-দায়িত্ব কেউ স্বীকার করতে চায় না। তবে কি ভিনগ্রহ থেকে এলিয়ানরা এসে ওই সব কর্মকা- করে যায়? ক্ষমতাসীনদের প্রভাব যে কোন সমাজেই লক্ষ্য করা যায়। আর সমাজে সংঘটিত ভাল-মন্দের দায়-দায়িত্ব ক্ষমতাসীন তথা সরকারের ওপর বিশেষভাবে বর্তায়। এ কারণে সরকারি ঘরনার লোকজন সব সময় ভাল ভাল কথা বলেন। কোন মন্দ কর্মের দায় তারা নিতে চান না। নিজেরা কোন মন্দ কাজ করলেও তার দায় এড়াতে রীতিমত গোয়েবলস-এর ভূমিকায় নেমে পড়েন। বিরোধী ঘরানার চতুর নেতারাও এমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এমন বাস্তবতা লক্ষ্য করা যায়। সরকারি ঘরানার লোকজন সংখ্যালঘু নিপীড়নসহ হিংসাত্মক কাজের দায় ঢালাওভাবে চাপিয়ে দেন বিরোধী দলের ওপর। আসল চিত্র কি তা-ই?
বরগুনার তালতলী উপজেলার চন্দনতলা গ্রামের ১৪টি হিন্দু পরিবারকে বসতবাড়ি ও ফসলি জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। যুবলীগের এক নেতা ও তার বড় ভাই সন্ত্রাসীদের দিয়ে এসব করিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৩০ মার্চ প্রথম আলো পত্রিকায় মুদ্রিত খবরে আরো বলা হয়Ñ ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৩ সালের শুরুতে সুমন্ত সরকার, রণজিৎ সরকার ও শ্যামল সরকার ভিটা ছেড়ে বরগুনা শহরে আশ্রয় নেন। ২০১৪ সালের শুরুর দিকে জিতেন সরকার ও বাবুল রায়ের পরিবার ভিটা ছাড়া হয়। গত ১২ মার্চ গ্রামের অন্য ৯ জনের পরিবারও এলাকা ছেড়ে চলে যায়। এরমধ্যে ৭টি পরিবার বরগুনা শহরে ও দুটি পরিবার তালতলীর ছোটবগীর আবাসন প্রকল্পে আশ্রয় নিয়েছে। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ১২ মার্চ রাতে ৯টি পরিবার বাড়ি-ঘর ছেড়ে যাওয়ার পর ১৩ মার্চ সকালে আব্দুর রশিদ, যুবলীগের নেতা জাকির হোসেন সরদার ও তার ভাই আব্দুস সালামের নেতৃত্বে প্রায় ৫০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল পরিবারগুলোর বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয় এবং সব মালামাল লুট করে। সন্ত্রাসীরা বাড়ির বড় বড় গাছও কেটে নিয়ে যায়।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, বরগুনা জেলার যুবলীগের সহ-সভাপতি পরিচয় দানকারী জাকির হোসেন ও আব্দুস সালাম এলাকার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আব্দুর রশিদ ও তার বাহিনীকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এসব হিন্দু পরিবারের সদস্যদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে আসছিল। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বরগুনা জেলা যুবলীগের সভাপতি কামরুল হাসান যুবরাজ প্রথম আলোকে বলেন, জাকির হোসেন আওয়ামী লীগের সমর্থক হলেও জেলা যুবলীগ কমিটির কেউ নন। এদিকে পচাকোড়ালিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম পাটোয়ারী বলেন, ‘জাকির সরদার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য। তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন সন্ত্রাসী। জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে। ওই নেতাদের সম্মানার্থেই জাকিরকে সদস্য পদ দিয়েছিলাম।’ ঘটনা প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ঘটনার মূলহোতাকে আমরা গ্রেফতার করেছি। প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পেয়েছি। এর পেছনে আরো কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারেন। পুলিশ সুপার আরো বলেন, হিন্দু পরিবারগুলোকে তাদের নিজ ভিটায় ফেরত আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
হিন্দু পরিবারগুলোকে তাদের নিজ ভিটায় ফেরত আনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছেন পুলিশ সুপার। নিজ ভিটায় বসবাসের অধিকার তো নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। কেউই ‘নাগরিকদের এই মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারে না। কিন্তু বরগুনার চন্দনতলা গ্রামের ১৪টি হিন্দু পরিবারের সেই মৌলিক অধিকার রক্ষিত হয়নি। তাদের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আর তাতে নেতৃত্ব দিয়েছে সরকারি ঘরানার লোকজন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, হিন্দু পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করার আগে দীর্ঘদিন ধরে তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। সেখানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং পুলিশ ও প্রশাসন থাকার পরও এমন জুলুম নির্যাতন ও উচ্ছেদের ঘটনা ঘটে কেমন করে? ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা তো সব সময় অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও প্রগতির বুলি উচ্চারণে সোচ্চার। কিন্তু তারা বর্তমান থাকা অবস্থায় এইসব হিন্দু পরিবারের ওপর তাদেরই লোকজন এমন জুলুম-নির্যাতন ও উচ্ছেদের কর্মকা- চালায় কেমন করে? কথা ও কাজে এমন গরমিলের দৃশ্য অবলোকন করে প্রশ্ন জাগে, তারা মুখে যা উচ্চারণ করেন বাস্তবে তা বিশ্বাস করেন কি? আর পুলিশ প্রশাসন বলছেন, উচ্ছেদ করা হিন্দু পরিবারগুলোকে তাদের ভিটায় ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, উচ্ছেদের আগে কিংবা উচ্ছেদের সময় তারা কী করেছেন? এই মজলুম মানুষের জন্য কি তাদের কিছুই করণীয় ছিল না? দীর্ঘদিন ধরেই তো সরকারি ঘরানার লোকজন ও সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে আসছিল। সরকারি ঘরানার লোকদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে পেশাগত দায়িত্ব পালনে কি কোনো বাধা আছে? নাকি নিজেদের স্বার্থ চিন্তায় সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের প্রশ্রয় দেয়াকে তারা এখন নিজেদের দায়িত্ব বলে বিবেচনা করছেন? বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নিষ্ঠুর আচরণ করতে তো বর্তমান সময়ে পুলিশ সদস্যরা মোটেও কুণ্ঠিত নন। এটাও কি পেশাগত দায়িত্ব ভুলে স্বার্থ চিন্তার কারণেই হয়ে থাকে? অথচ আমরা জানি যে- পুলিশ, প্রশাসন এবং সরকারের অনুরাগ ও বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকেই দায়িত্ব পালন করার কথা। আর তেমনটা হলেই তো দেশের জনগণ আইনের শাসন তথা সুশাসন পেতে পারে। এই সুশাসনের অভাবেই দেশের মানুষ এখন নির্যাতিত হচ্ছে এবং বরগুনার ১৪টি হিন্দু পরিবার উচ্ছেদের কারণও কিন্তু সেখানেই নিহিত। জানি না, আমাদের পুলিশ, প্রশাসন, রাজনীতিবিদ ও সরকার কখন বিষয়টি উপলব্ধি করবেন?’
সংখ্যালঘু কিংবা যে কোন মানুষের প্রতি মানবিক ও সঙ্গত আচরণের জন্য প্রয়োজন উন্নত আদর্শ ও নীতিবোধ। শুধু মুখের কথায় সঙ্গত আচরণ উপহার দেওয়া যায় না। চাতুর্যের মাধ্যমে রাজনীতি করা যায়, চাকরিতে পদোন্নতিও লাভ করা যায়- কিন্তু মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করা যায় না, আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করা যায় না। এমন কি পুণ্যার্থীদের স্নানোৎসবের মতো একটি পবিত্র অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থাপনায় ও সক্ষমতা প্রদর্শন করা যায় না। লাঙ্গলবন্দ, ট্যাজেডির কথা মানুষের অনেকদিন মনে থাকবে। সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুণ্যার্থীদের ঐতিহ্যবাহী অষ্টমী স্নানোৎসবটি এবার বিষাদে পরিণত হয়েছে। পদদলিত হয়ে নিহত হয়েছেন ১০ জন, আহত হয়েছেন বহু। এ ঘটনায় দুঃখ-কষ্ট ও ক্ষোভ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন পুণ্যার্থীরা। শুক্রবারের দুর্ঘটনাটিকে তারা প্রশাসনের চরম অব্যবস্থাপনা ও অবৈধ দখলদারদের আগ্রাসনের ফল বলে মনে করছেন। আগে থেকে সংশ্লিষ্টরা নজরদারি রাখলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতো না বলেও তারা মনে করেন।
২৮ মার্চ শনিবার শেষ হয়েছে নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে সনাতন হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্যবাহী অষ্টমী স্নানোৎসব। এই স্নানোৎসবে ১০ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি রোববার থেকে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করার কথা। ঘটনা প্রসঙ্গে পূজা উদযাপন কমিটি ও স্নানোৎসব কমিটির নেতৃবৃন্দ বলেছেন- তদন্তে যাই হোক না কেন, আগামীতে এমন দুর্ঘটনা এড়াতে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে স্নান ঘাটে পুণ্যার্থীদের স্নানোৎসব নির্বিঘ্ন করতে হবে। এছাড়া চলাচলের পথকেও করতে হবে প্রশস্ত। উল্লেখ্য যে, শুক্রবার সকাল পৌনে আটটার দিকে রাজঘাট ও বেইলি ব্রিজের মধ্যবর্তী স্থানে পদদলিত হয়ে ৭ নারীসহ ১০ জন নিহত হয়। শুক্রবার ভোর থেকে তিথি শুরু হওয়ার পরপরই ব্রহ্মপুত্র নদের ১৬টি ঘাটে স্নান করতে নামেন হাজার হাজার পুণ্যার্থী। মানিকগঞ্জের ঘিওর থেকে আসা মিনতি রাণী (৩২) ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এত চিকন রাস্তা দিয়ে হাজার হাজার পুণ্যার্থী আসা যাওয়া করতে পারে? ঘাটে যাওয়ার মধ্যেও কোনো শৃঙ্খলা নেই। তাছাড়া স্নানের জায়গাইবা কোথায়? কচুরিপানায় সয়লাব ছিল নদী। চরম অব্যবস্থাপনায় পুণ্যার্থীরা ঠিকমত স্নানোৎসব করতে পারেনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থেকে আসা রাখাল চন্দ্র শীল বলেন, প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতা ছিল। যেহেতু চলাচলের পথ মাত্র একটি, সেহেতু মাঝে দড়ি বা বাঁশ দিয়ে ওয়ান-ওয়ে করে দিলে চলাচলে সুবিধা হতো। সেটা করা হয়নি। ঘাটগুলোতেও ওয়ান ওয়ে করা হয়নি। ফলে বিশৃঙ্খলা ছিল চোখে পড়ার মতো। তাছাড়া নদীর কচুরিপানা পরিষ্কার না করায় কচুরিপানার মধ্যেই স্নান করতে হয়েছে পুণ্যার্থীদের। এদিকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিনারা নাজমীন সাংবাদিকদের জানান, বন্ধের দিন হওয়ায় স্নান ঘাটে ঢল নেমেছিল পুণ্যার্থীদের। গত বছর রাস্তাটি ১২ ফুট ছিল, এবার বাড়িয়ে ১৬ ফুট করা হয়েছে। শুক্রবারের ঘটনাটি একটি দুর্ঘটনা।
লাঙ্গলবন্দ ট্র্যাজেডির পর জনমনে নানা প্রশ্ন জেগেছে। পুণ্যার্থীদের বক্তব্যে প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবের কথা ফুটে উঠেছে। এছাড়া অবৈধ দখলদারদের কারণেও পুণ্যার্থীদের যাতায়াতের রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। এসব বিষয়ে প্রশাসন আগে থেকেই ব্যবস্থা নিলে এত বড় ট্র্যাজেডি নাও ঘটতে পারতো বলে পুণ্যার্থীরা মনে করেন। পূজা উদযাপন কমিটি স্নানোৎসব কমিটি আগামীতে এমন দুর্ঘটনা এড়াতে রাস্তার দু’পাশের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ ও চলাচলের পথকে আরো প্রশস্ত করার দাবি জানিয়েছেন। প্রশাসন অবশ্য বলেছে, গত বছরের ১২ ফুট রাস্তাটি প্রশস্ত করে এবার ১৬ ফুট করা হয়েছে। তবে তাদের উদ্যোগ যে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়, দুর্ঘটনার চিত্রে তা প্রমাণিত হয়েছে। আর ঐতিহ্যবাহী এ স্নানোৎসব তো প্রতিবছরই হয়ে থাকে। যে উৎসবটি প্রতিবছর হয়ে থাকে তা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য তো বাস্তবসম্মত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। লাখ লাখ মানুষের এই স্নানোৎসবে কাক্সিক্ষত ব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করা যায়নি। এ ব্যাপারে আমরা আগামীতে প্রশাসন এবং পূজা উদযাপন কমিটি ও স্নানোৎসব কমিটির পক্ষ থেকে যথাযথ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা আশা করছি। আর অষ্টমীর স্নানোৎসবে যেসব পুণ্যার্থী নর-নারী আগমন করে থাকেন, তাদের কাছ থেকেও আমরা আরো সতর্কতা ও সংযম কামনা করছি। সংশ্লিষ্ট সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাক্সিক্ষত দায়িত্ব পালন করলে আগামীতে এ ধরনের দুর্ঘটনা থেকে পুণ্যার্থীরা রক্ষা পেতে পারেন। দায়িত্বের বিষয়টি আমাদের রাজনীতিবিদরাও ভেবে দেখতে পারেন।
এই পৃথিবীতে মানুষের সমাজ একরকম নয়। ধর্ম-দর্শন তথা জীবন-দর্শনের কারণে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। তবে গোয়েবলস-প্রজাতির মানুষের কারণে এই বৈচিত্র্য কখনো কখনো মতবিরোধ, দ্বন্দ্ব সংঘাত ও হিংসাবিদ্বেষের রূপ পরিগ্রহ করে। সমাজে এর দায়-দায়িত্ব কেউ স্বীকার করতে চায় না। তবে কি ভিনগ্রহ থেকে এলিয়ানরা এসে ওই সব কর্মকা- করে যায়? ক্ষমতাসীনদের প্রভাব যে কোন সমাজেই লক্ষ্য করা যায়। আর সমাজে সংঘটিত ভাল-মন্দের দায়-দায়িত্ব ক্ষমতাসীন তথা সরকারের ওপর বিশেষভাবে বর্তায়। এ কারণে সরকারি ঘরনার লোকজন সব সময় ভাল ভাল কথা বলেন। কোন মন্দ কর্মের দায় তারা নিতে চান না। নিজেরা কোন মন্দ কাজ করলেও তার দায় এড়াতে রীতিমত গোয়েবলস-এর ভূমিকায় নেমে পড়েন। বিরোধী ঘরানার চতুর নেতারাও এমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এমন বাস্তবতা লক্ষ্য করা যায়। সরকারি ঘরানার লোকজন সংখ্যালঘু নিপীড়নসহ হিংসাত্মক কাজের দায় ঢালাওভাবে চাপিয়ে দেন বিরোধী দলের ওপর। আসল চিত্র কি তা-ই?
বরগুনার তালতলী উপজেলার চন্দনতলা গ্রামের ১৪টি হিন্দু পরিবারকে বসতবাড়ি ও ফসলি জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। যুবলীগের এক নেতা ও তার বড় ভাই সন্ত্রাসীদের দিয়ে এসব করিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৩০ মার্চ প্রথম আলো পত্রিকায় মুদ্রিত খবরে আরো বলা হয়Ñ ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৩ সালের শুরুতে সুমন্ত সরকার, রণজিৎ সরকার ও শ্যামল সরকার ভিটা ছেড়ে বরগুনা শহরে আশ্রয় নেন। ২০১৪ সালের শুরুর দিকে জিতেন সরকার ও বাবুল রায়ের পরিবার ভিটা ছাড়া হয়। গত ১২ মার্চ গ্রামের অন্য ৯ জনের পরিবারও এলাকা ছেড়ে চলে যায়। এরমধ্যে ৭টি পরিবার বরগুনা শহরে ও দুটি পরিবার তালতলীর ছোটবগীর আবাসন প্রকল্পে আশ্রয় নিয়েছে। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ১২ মার্চ রাতে ৯টি পরিবার বাড়ি-ঘর ছেড়ে যাওয়ার পর ১৩ মার্চ সকালে আব্দুর রশিদ, যুবলীগের নেতা জাকির হোসেন সরদার ও তার ভাই আব্দুস সালামের নেতৃত্বে প্রায় ৫০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল পরিবারগুলোর বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয় এবং সব মালামাল লুট করে। সন্ত্রাসীরা বাড়ির বড় বড় গাছও কেটে নিয়ে যায়।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, বরগুনা জেলার যুবলীগের সহ-সভাপতি পরিচয় দানকারী জাকির হোসেন ও আব্দুস সালাম এলাকার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আব্দুর রশিদ ও তার বাহিনীকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এসব হিন্দু পরিবারের সদস্যদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে আসছিল। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বরগুনা জেলা যুবলীগের সভাপতি কামরুল হাসান যুবরাজ প্রথম আলোকে বলেন, জাকির হোসেন আওয়ামী লীগের সমর্থক হলেও জেলা যুবলীগ কমিটির কেউ নন। এদিকে পচাকোড়ালিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম পাটোয়ারী বলেন, ‘জাকির সরদার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য। তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন সন্ত্রাসী। জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে। ওই নেতাদের সম্মানার্থেই জাকিরকে সদস্য পদ দিয়েছিলাম।’ ঘটনা প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ঘটনার মূলহোতাকে আমরা গ্রেফতার করেছি। প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পেয়েছি। এর পেছনে আরো কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারেন। পুলিশ সুপার আরো বলেন, হিন্দু পরিবারগুলোকে তাদের নিজ ভিটায় ফেরত আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
হিন্দু পরিবারগুলোকে তাদের নিজ ভিটায় ফেরত আনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছেন পুলিশ সুপার। নিজ ভিটায় বসবাসের অধিকার তো নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। কেউই ‘নাগরিকদের এই মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারে না। কিন্তু বরগুনার চন্দনতলা গ্রামের ১৪টি হিন্দু পরিবারের সেই মৌলিক অধিকার রক্ষিত হয়নি। তাদের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আর তাতে নেতৃত্ব দিয়েছে সরকারি ঘরানার লোকজন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, হিন্দু পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করার আগে দীর্ঘদিন ধরে তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। সেখানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং পুলিশ ও প্রশাসন থাকার পরও এমন জুলুম নির্যাতন ও উচ্ছেদের ঘটনা ঘটে কেমন করে? ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা তো সব সময় অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও প্রগতির বুলি উচ্চারণে সোচ্চার। কিন্তু তারা বর্তমান থাকা অবস্থায় এইসব হিন্দু পরিবারের ওপর তাদেরই লোকজন এমন জুলুম-নির্যাতন ও উচ্ছেদের কর্মকা- চালায় কেমন করে? কথা ও কাজে এমন গরমিলের দৃশ্য অবলোকন করে প্রশ্ন জাগে, তারা মুখে যা উচ্চারণ করেন বাস্তবে তা বিশ্বাস করেন কি? আর পুলিশ প্রশাসন বলছেন, উচ্ছেদ করা হিন্দু পরিবারগুলোকে তাদের ভিটায় ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, উচ্ছেদের আগে কিংবা উচ্ছেদের সময় তারা কী করেছেন? এই মজলুম মানুষের জন্য কি তাদের কিছুই করণীয় ছিল না? দীর্ঘদিন ধরেই তো সরকারি ঘরানার লোকজন ও সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে আসছিল। সরকারি ঘরানার লোকদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে পেশাগত দায়িত্ব পালনে কি কোনো বাধা আছে? নাকি নিজেদের স্বার্থ চিন্তায় সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের প্রশ্রয় দেয়াকে তারা এখন নিজেদের দায়িত্ব বলে বিবেচনা করছেন? বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নিষ্ঠুর আচরণ করতে তো বর্তমান সময়ে পুলিশ সদস্যরা মোটেও কুণ্ঠিত নন। এটাও কি পেশাগত দায়িত্ব ভুলে স্বার্থ চিন্তার কারণেই হয়ে থাকে? অথচ আমরা জানি যে- পুলিশ, প্রশাসন এবং সরকারের অনুরাগ ও বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকেই দায়িত্ব পালন করার কথা। আর তেমনটা হলেই তো দেশের জনগণ আইনের শাসন তথা সুশাসন পেতে পারে। এই সুশাসনের অভাবেই দেশের মানুষ এখন নির্যাতিত হচ্ছে এবং বরগুনার ১৪টি হিন্দু পরিবার উচ্ছেদের কারণও কিন্তু সেখানেই নিহিত। জানি না, আমাদের পুলিশ, প্রশাসন, রাজনীতিবিদ ও সরকার কখন বিষয়টি উপলব্ধি করবেন?’
সংখ্যালঘু কিংবা যে কোন মানুষের প্রতি মানবিক ও সঙ্গত আচরণের জন্য প্রয়োজন উন্নত আদর্শ ও নীতিবোধ। শুধু মুখের কথায় সঙ্গত আচরণ উপহার দেওয়া যায় না। চাতুর্যের মাধ্যমে রাজনীতি করা যায়, চাকরিতে পদোন্নতিও লাভ করা যায়- কিন্তু মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করা যায় না, আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করা যায় না। এমন কি পুণ্যার্থীদের স্নানোৎসবের মতো একটি পবিত্র অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থাপনায় ও সক্ষমতা প্রদর্শন করা যায় না। লাঙ্গলবন্দ, ট্যাজেডির কথা মানুষের অনেকদিন মনে থাকবে। সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুণ্যার্থীদের ঐতিহ্যবাহী অষ্টমী স্নানোৎসবটি এবার বিষাদে পরিণত হয়েছে। পদদলিত হয়ে নিহত হয়েছেন ১০ জন, আহত হয়েছেন বহু। এ ঘটনায় দুঃখ-কষ্ট ও ক্ষোভ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন পুণ্যার্থীরা। শুক্রবারের দুর্ঘটনাটিকে তারা প্রশাসনের চরম অব্যবস্থাপনা ও অবৈধ দখলদারদের আগ্রাসনের ফল বলে মনে করছেন। আগে থেকে সংশ্লিষ্টরা নজরদারি রাখলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতো না বলেও তারা মনে করেন।
২৮ মার্চ শনিবার শেষ হয়েছে নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে সনাতন হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্যবাহী অষ্টমী স্নানোৎসব। এই স্নানোৎসবে ১০ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি রোববার থেকে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করার কথা। ঘটনা প্রসঙ্গে পূজা উদযাপন কমিটি ও স্নানোৎসব কমিটির নেতৃবৃন্দ বলেছেন- তদন্তে যাই হোক না কেন, আগামীতে এমন দুর্ঘটনা এড়াতে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে স্নান ঘাটে পুণ্যার্থীদের স্নানোৎসব নির্বিঘ্ন করতে হবে। এছাড়া চলাচলের পথকেও করতে হবে প্রশস্ত। উল্লেখ্য যে, শুক্রবার সকাল পৌনে আটটার দিকে রাজঘাট ও বেইলি ব্রিজের মধ্যবর্তী স্থানে পদদলিত হয়ে ৭ নারীসহ ১০ জন নিহত হয়। শুক্রবার ভোর থেকে তিথি শুরু হওয়ার পরপরই ব্রহ্মপুত্র নদের ১৬টি ঘাটে স্নান করতে নামেন হাজার হাজার পুণ্যার্থী। মানিকগঞ্জের ঘিওর থেকে আসা মিনতি রাণী (৩২) ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এত চিকন রাস্তা দিয়ে হাজার হাজার পুণ্যার্থী আসা যাওয়া করতে পারে? ঘাটে যাওয়ার মধ্যেও কোনো শৃঙ্খলা নেই। তাছাড়া স্নানের জায়গাইবা কোথায়? কচুরিপানায় সয়লাব ছিল নদী। চরম অব্যবস্থাপনায় পুণ্যার্থীরা ঠিকমত স্নানোৎসব করতে পারেনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থেকে আসা রাখাল চন্দ্র শীল বলেন, প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতা ছিল। যেহেতু চলাচলের পথ মাত্র একটি, সেহেতু মাঝে দড়ি বা বাঁশ দিয়ে ওয়ান-ওয়ে করে দিলে চলাচলে সুবিধা হতো। সেটা করা হয়নি। ঘাটগুলোতেও ওয়ান ওয়ে করা হয়নি। ফলে বিশৃঙ্খলা ছিল চোখে পড়ার মতো। তাছাড়া নদীর কচুরিপানা পরিষ্কার না করায় কচুরিপানার মধ্যেই স্নান করতে হয়েছে পুণ্যার্থীদের। এদিকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিনারা নাজমীন সাংবাদিকদের জানান, বন্ধের দিন হওয়ায় স্নান ঘাটে ঢল নেমেছিল পুণ্যার্থীদের। গত বছর রাস্তাটি ১২ ফুট ছিল, এবার বাড়িয়ে ১৬ ফুট করা হয়েছে। শুক্রবারের ঘটনাটি একটি দুর্ঘটনা।
লাঙ্গলবন্দ ট্র্যাজেডির পর জনমনে নানা প্রশ্ন জেগেছে। পুণ্যার্থীদের বক্তব্যে প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবের কথা ফুটে উঠেছে। এছাড়া অবৈধ দখলদারদের কারণেও পুণ্যার্থীদের যাতায়াতের রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। এসব বিষয়ে প্রশাসন আগে থেকেই ব্যবস্থা নিলে এত বড় ট্র্যাজেডি নাও ঘটতে পারতো বলে পুণ্যার্থীরা মনে করেন। পূজা উদযাপন কমিটি স্নানোৎসব কমিটি আগামীতে এমন দুর্ঘটনা এড়াতে রাস্তার দু’পাশের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ ও চলাচলের পথকে আরো প্রশস্ত করার দাবি জানিয়েছেন। প্রশাসন অবশ্য বলেছে, গত বছরের ১২ ফুট রাস্তাটি প্রশস্ত করে এবার ১৬ ফুট করা হয়েছে। তবে তাদের উদ্যোগ যে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়, দুর্ঘটনার চিত্রে তা প্রমাণিত হয়েছে। আর ঐতিহ্যবাহী এ স্নানোৎসব তো প্রতিবছরই হয়ে থাকে। যে উৎসবটি প্রতিবছর হয়ে থাকে তা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য তো বাস্তবসম্মত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। লাখ লাখ মানুষের এই স্নানোৎসবে কাক্সিক্ষত ব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করা যায়নি। এ ব্যাপারে আমরা আগামীতে প্রশাসন এবং পূজা উদযাপন কমিটি ও স্নানোৎসব কমিটির পক্ষ থেকে যথাযথ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা আশা করছি। আর অষ্টমীর স্নানোৎসবে যেসব পুণ্যার্থী নর-নারী আগমন করে থাকেন, তাদের কাছ থেকেও আমরা আরো সতর্কতা ও সংযম কামনা করছি। সংশ্লিষ্ট সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাক্সিক্ষত দায়িত্ব পালন করলে আগামীতে এ ধরনের দুর্ঘটনা থেকে পুণ্যার্থীরা রক্ষা পেতে পারেন। দায়িত্বের বিষয়টি আমাদের রাজনীতিবিদরাও ভেবে দেখতে পারেন।
Wednesday, 1 April 2015

‘এইচ টি ইমাম ফরমুলা’ নিয়ে আতঙ্ক তিন সিটির নির্বাচনে
‘এইচ টি ইমাম ফরমুলা’ নিয়ে আতঙ্ক তিন সিটির নির্বাচনে
- নির্বাচনের সময় ‘আমাদের’ রিক্রুটেডদের সঙ্গে কথা বলেছি
- মোবাইল কোর্ট করিয়ে আমরা নির্বাচন করেছি
- হালনাগাদ সন্ত্রাসী তালিকায় ২০ দলীয় নেতাকর্মী
- এই তালিকা নিয়ে টার্গেট করে চলছে ব্লকরেইড
ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর তিনটি সিটি কর্পোরেশনের আসন্ন নির্বাচনে বহুল আলোচিত, বিতর্কিত ও নিন্দিত ‘এইচ টি ইমাম ফরমুলা’ প্রয়োগের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই ফরমুলায় নির্বাচন হলে তার ফলাফল হবে পূর্বনির্ধারিত। যা মহাজোট সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের বিশশ্বাসযোগ্যতাকে শেষ বারের মতো প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
বহুল আলোচিত এই ফরমুলায় “রিক্রুটেডদের দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে নির্বাচন’ করার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচন সংক্রান্ত কুট-কৌশল নির্ধারক এইচ টি ইমাম। গতবছর ১২ নবেম্বর ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের ‘ভেতরের কথা’ প্রকাশ করে দেন তিনি। তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের উপর নিজেদের দলীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করার কথাও প্রকাশ করেন। বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে নির্বাচন সম্পর্কে বিরোধীদলীয় অভিযোগকে সরকারি মহল উড়িয়ে দিয়ে আসলেও উপদেষ্টা ইমামের বক্তব্যে তা সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ পুলিশের, প্রশাসনের যে ভূমিকা; নির্বাচনের সময় আমি তো প্রত্যেকটি উপজেলায় কথা বলেছি। সব জায়গায় আমাদের যারা রিক্রুটেড তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে আমরা নির্বাচন করেছি। তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তারা বুক পেতে দিয়েছে। আমাদের যে ১৯ জন পুলিশ ভাই প্রাণ দিয়েছে, তোমাদের মনে আছে এরা কারা? সব আমাদের মানুষ।’ একই অনুষ্ঠানে দলীয় প্রার্থীদের চাকরি প্রদান প্রসঙ্গে এইচ টি ইমাম বলেন, ‘যখনই কারো বায়োডাটা নিয়ে যাই, বলি যে এরা সুযোগ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই জিজ্ঞেস করেন তারা কি ছাত্রলীগ করেছে? কোথায় পদধারী ছিল? তোমরা অনেকেই বল ছাত্রলীগের চাকরির কথা। দেখ, আমার চেয়ে, নেত্রীর চেয়ে অন্য কারো দরদ কী বেশি আছে? আমরা তো জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করি। নেত্রী বলেন, যেভাবেই হোক আমাদের ছেলেদের একটা ব্যবস্থা করে দাও। তোমাদের লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। তারপরে আমরা দেখব।”
কলঙ্কজনক ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যা ঘটে : ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ, সর্বনিম্ন ভোটার উপস্থিতি, জাল ভোটের মহোৎসব ও ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সেগুলো পূরণ করা, একেকজন শত শত ভোট দিয়ে উল্লাস প্রকাশ, সর্বাধিক সংখ্যক কেন্দ্রে ভোট স্থগিত হওয়া, বহুসংখ্যক প্রার্থীর ভোট বয়কটের ঘোষণা দেয়া প্রভৃতি ঘটনা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে চরমভাবে কলঙ্কিত করে। অন্তত ৪১টি কেন্দ্রে আদৌ কোনো ভোট পড়েনি- এমন ঘটনাও ঘটে। আবার বেলা ১টার মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ ভোট কাস্টিং হলেও বিকেল ৪টায় তা হয়ে যায় ৭০ ভাগের ওপরে। দলের একেকজন কর্মী ১শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ পর্যন্ত ভোট দেবার ‘গৌরব’ অর্জনে সক্ষম হয়। অনেক স্থানে পুরো একটি পরিবারের ভোট অন্যরা দিয়ে দেয়। বিভিন্ন কারণে সারা দেশে প্রায় সাড়ে ৫শ’ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করতে হয়। তিনশ’ আসনের মধ্যে অর্ধেকেরও কম আসনে ভোট করতে গিয়েও এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন অভিযোগ এনে ভোট গ্রহণের দিনে অন্তত ২০ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। তাদের মধ্যে মহাজোটের শরীক জাতীয় পার্টি, জাসদ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ছিলেন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রাণহানির ঘটনাও একটি রেকর্ড। শুধু নির্বাচনের দিনই ২১ জনের মতো লোক নিহত হবার খবর পাওয়া যায়। বিশ্লেষকদের মতে, এ নির্বাচনকে ঘিরে যে সহিংসতা হয়েছে তা অতীতের কোনো নির্বাচনে দেখেননি দেশবাসী। এদিকে গতবছর প্রথমদিকে কয়েক দফায় অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে অনিয়ম, কারচুপি ও সহিংসতা ঘটে ব্যাপক হারে। প্রথম দু’দফার নির্বাচনে বিরোধী জোটের প্রার্থীরা ব্যাপক বিজয় অর্জন করতে থাকায় নড়েচড়ে বসে সরকারি মহল। পরের উপজেলা নির্বাচনগুলোতে কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, জাল ভোট, পুলিশের গুলী, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ব্যাপক ঘটনা সংঘটিত হতে থাকে। এ সময় বিভিন্ন মহল থেকে নির্বাচন কমিশনকে বারবার সতর্ক করার পরও তারা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি নির্বাচনে আইনবহির্ভূত কর্মকা-ের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশন নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করে বলে অভিযোগ উঠে। ফলস্বরূপ বিরোধীজোটের প্রার্থীদের বিজয়ী হবার সংখ্যা কমতে থাকে।
নির্বাচন কমিশনকে অপব্যবহারের রেকর্ড : সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে অপব্যবহারের ক্ষেত্রে এবার এক নয়া রেকর্ডও স্থাপিত হয়। নির্বাচন কমিশন কার্যত সরকারের আজ্ঞাবহ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অভিযোগে প্রকাশ, সেই বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন অনেক ক্ষেত্রেই অনিয়মকে নিয়ম হিসেবে চালিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের ‘লাঙ্গল’ প্রতীক বরাদ্দ দেয়া, আ’লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমামের ‘বেআইনি’ চিঠিকেও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা, প্রার্থীতা প্রত্যাহারের শেষদিন বেশকিছু আসনের প্রার্থীর তালিকা বারবার রদবদল করা প্রভৃতি। আ’লীগের সঙ্গে শরিকদের সমঝোতা রক্ষা করতে গিয়ে তারা এই অনিয়ম করে। বিভিন্ন জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তারা ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ ডিসেম্বরের তারিখ দিয়ে অবৈধভাবে প্রার্থীদের কারো মনোনয়নপত্র বাতিল, আবার কারো মনোনয়নপত্র বৈধ দেখায়। যে কারণে জাপার বেশ কয়েকজন প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন জমা দেয়ার পরও তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। আ’লীগের নির্বাচনী জোটের অনুকূলে ‘নৌকা’ প্রতীক বরাদ্দের ক্ষেত্রেও কমিশন আইন মানেনি। জাতীয় পার্টি সরে পড়ায় অনেক আসনে প্রার্থীসংকট দেখা দিলে কমিশনের পরামর্শে রিটার্নিং কর্মকর্তারা অনেক প্রার্থীকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে মনোনয়নপত্র শুদ্ধ করে দেন। এ ছাড়াও, নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে সরকারি দল কোনো নিয়মেরই তোয়াক্কা করেনি। কিন্তু সেদিকে নির্বাচন কমিশন ঘুরেও দেখেনি। নবগঠিত বিএনএফকে নিবন্ধন দিতে চরম কূটচালের আশ্রয় নিতে দেখা যায়। যা ছিল একেবারে নগ্ন আচরণ।
এরই মধ্যে যা ঘটেছে : তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনেও আতঙ্ক তাড়া করে বিরোধী সমর্থক-প্রার্থীদের। গ্রেফতার আতঙ্কের কারণে বেশিরভাগ বিএনপি সমর্থক প্রার্থীই সরাসরি মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাননি। কেউ আইনজীবী কেউ-বা পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বিরোধী জোটের সম্ভাব্য প্রার্থীদের বেশিরভাগই একাধিক মামলার আসামী। বিরোধী নেতাদের অভিযোগ, সরকার ২০ দলকে বাইরে রেখে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে মেয়র পদসহ সব কয়টি কাউন্সিলর পদ দখলের পাঁয়তারা করছে। বিরোধী জোট যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সেই লক্ষ্যে গত তিন মাসে কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে থানা ও ওয়ার্ড নেতাদের বিরুদ্ধে ডজন ডজন মামলা দিয়ে রেখেছে। তারা বলছেন, নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে আসলে সবাই গ্রেফতারের শিকার হবেন এমন আশঙ্কা সত্যি হতে চলেছে পুলিশের কথায়। গত বৃহস্পতিবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি যুগ্ম কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। সন্ত্রাসী গ্রেফতারের লক্ষ্যে পুলিশ ইতোমধ্যে মহানগরীতে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। পুলিশের এ ঘোষণায় বিস্ময় প্রকাশ করে নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেন, কে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে আর কে পারবে না তা দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আগ বাড়িয়ে পুলিশের এই বক্তব্য আতঙ্ক ছড়ানোর জন্যই দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, সন্ত্রাসীদের যে হালনাগাদ তালিকা করা হচ্ছে তাতে ২০ দলীয় জোট নেতাকর্মীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে বলে অভিযোগে প্রকাশ। আর এই তালিকা নিয়ে টার্গেট করে চলছে ব্লকরেইড। সূত্রে জানা যায়, সিটি নির্বাচন সামনে রেখে সন্ত্রাসীদের যে হালনাগাদ তালিকা হচ্ছে সেই তালিকার পুরোটাই পূর্ণ হবে বিএনপি-ছাত্রদল, জামায়াত ও শিবিরসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের দিয়ে। তাদেরকে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, নাশকতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা মামলায় সংশ্লিষ্ট করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, এমনিতেই ২০ দলীয় জোট নেতাকর্মীরা পলাতক রয়েছেন। সেই সাথে এ অভিযান চললে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে আরো অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, সরকার সমর্থক প্রার্থীরা ইতোমধ্যে নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘন করে চললেও এ ব্যাপারে ইসি’র নির্লিপ্ত ভূমিকায় ক্ষোভ করেছেন জোটের বাইরের প্রার্থীরা।সরদার আবদুর রহমান
বহুল আলোচিত এই ফরমুলায় “রিক্রুটেডদের দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে নির্বাচন’ করার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচন সংক্রান্ত কুট-কৌশল নির্ধারক এইচ টি ইমাম। গতবছর ১২ নবেম্বর ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের ‘ভেতরের কথা’ প্রকাশ করে দেন তিনি। তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের উপর নিজেদের দলীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করার কথাও প্রকাশ করেন। বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে নির্বাচন সম্পর্কে বিরোধীদলীয় অভিযোগকে সরকারি মহল উড়িয়ে দিয়ে আসলেও উপদেষ্টা ইমামের বক্তব্যে তা সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ পুলিশের, প্রশাসনের যে ভূমিকা; নির্বাচনের সময় আমি তো প্রত্যেকটি উপজেলায় কথা বলেছি। সব জায়গায় আমাদের যারা রিক্রুটেড তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে আমরা নির্বাচন করেছি। তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তারা বুক পেতে দিয়েছে। আমাদের যে ১৯ জন পুলিশ ভাই প্রাণ দিয়েছে, তোমাদের মনে আছে এরা কারা? সব আমাদের মানুষ।’ একই অনুষ্ঠানে দলীয় প্রার্থীদের চাকরি প্রদান প্রসঙ্গে এইচ টি ইমাম বলেন, ‘যখনই কারো বায়োডাটা নিয়ে যাই, বলি যে এরা সুযোগ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই জিজ্ঞেস করেন তারা কি ছাত্রলীগ করেছে? কোথায় পদধারী ছিল? তোমরা অনেকেই বল ছাত্রলীগের চাকরির কথা। দেখ, আমার চেয়ে, নেত্রীর চেয়ে অন্য কারো দরদ কী বেশি আছে? আমরা তো জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করি। নেত্রী বলেন, যেভাবেই হোক আমাদের ছেলেদের একটা ব্যবস্থা করে দাও। তোমাদের লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। তারপরে আমরা দেখব।”
কলঙ্কজনক ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যা ঘটে : ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ, সর্বনিম্ন ভোটার উপস্থিতি, জাল ভোটের মহোৎসব ও ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সেগুলো পূরণ করা, একেকজন শত শত ভোট দিয়ে উল্লাস প্রকাশ, সর্বাধিক সংখ্যক কেন্দ্রে ভোট স্থগিত হওয়া, বহুসংখ্যক প্রার্থীর ভোট বয়কটের ঘোষণা দেয়া প্রভৃতি ঘটনা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে চরমভাবে কলঙ্কিত করে। অন্তত ৪১টি কেন্দ্রে আদৌ কোনো ভোট পড়েনি- এমন ঘটনাও ঘটে। আবার বেলা ১টার মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ ভোট কাস্টিং হলেও বিকেল ৪টায় তা হয়ে যায় ৭০ ভাগের ওপরে। দলের একেকজন কর্মী ১শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ পর্যন্ত ভোট দেবার ‘গৌরব’ অর্জনে সক্ষম হয়। অনেক স্থানে পুরো একটি পরিবারের ভোট অন্যরা দিয়ে দেয়। বিভিন্ন কারণে সারা দেশে প্রায় সাড়ে ৫শ’ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করতে হয়। তিনশ’ আসনের মধ্যে অর্ধেকেরও কম আসনে ভোট করতে গিয়েও এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন অভিযোগ এনে ভোট গ্রহণের দিনে অন্তত ২০ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। তাদের মধ্যে মহাজোটের শরীক জাতীয় পার্টি, জাসদ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ছিলেন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রাণহানির ঘটনাও একটি রেকর্ড। শুধু নির্বাচনের দিনই ২১ জনের মতো লোক নিহত হবার খবর পাওয়া যায়। বিশ্লেষকদের মতে, এ নির্বাচনকে ঘিরে যে সহিংসতা হয়েছে তা অতীতের কোনো নির্বাচনে দেখেননি দেশবাসী। এদিকে গতবছর প্রথমদিকে কয়েক দফায় অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে অনিয়ম, কারচুপি ও সহিংসতা ঘটে ব্যাপক হারে। প্রথম দু’দফার নির্বাচনে বিরোধী জোটের প্রার্থীরা ব্যাপক বিজয় অর্জন করতে থাকায় নড়েচড়ে বসে সরকারি মহল। পরের উপজেলা নির্বাচনগুলোতে কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, জাল ভোট, পুলিশের গুলী, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ব্যাপক ঘটনা সংঘটিত হতে থাকে। এ সময় বিভিন্ন মহল থেকে নির্বাচন কমিশনকে বারবার সতর্ক করার পরও তারা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি নির্বাচনে আইনবহির্ভূত কর্মকা-ের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশন নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করে বলে অভিযোগ উঠে। ফলস্বরূপ বিরোধীজোটের প্রার্থীদের বিজয়ী হবার সংখ্যা কমতে থাকে।
নির্বাচন কমিশনকে অপব্যবহারের রেকর্ড : সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে অপব্যবহারের ক্ষেত্রে এবার এক নয়া রেকর্ডও স্থাপিত হয়। নির্বাচন কমিশন কার্যত সরকারের আজ্ঞাবহ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অভিযোগে প্রকাশ, সেই বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন অনেক ক্ষেত্রেই অনিয়মকে নিয়ম হিসেবে চালিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের ‘লাঙ্গল’ প্রতীক বরাদ্দ দেয়া, আ’লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমামের ‘বেআইনি’ চিঠিকেও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা, প্রার্থীতা প্রত্যাহারের শেষদিন বেশকিছু আসনের প্রার্থীর তালিকা বারবার রদবদল করা প্রভৃতি। আ’লীগের সঙ্গে শরিকদের সমঝোতা রক্ষা করতে গিয়ে তারা এই অনিয়ম করে। বিভিন্ন জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তারা ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ ডিসেম্বরের তারিখ দিয়ে অবৈধভাবে প্রার্থীদের কারো মনোনয়নপত্র বাতিল, আবার কারো মনোনয়নপত্র বৈধ দেখায়। যে কারণে জাপার বেশ কয়েকজন প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন জমা দেয়ার পরও তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। আ’লীগের নির্বাচনী জোটের অনুকূলে ‘নৌকা’ প্রতীক বরাদ্দের ক্ষেত্রেও কমিশন আইন মানেনি। জাতীয় পার্টি সরে পড়ায় অনেক আসনে প্রার্থীসংকট দেখা দিলে কমিশনের পরামর্শে রিটার্নিং কর্মকর্তারা অনেক প্রার্থীকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে মনোনয়নপত্র শুদ্ধ করে দেন। এ ছাড়াও, নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে সরকারি দল কোনো নিয়মেরই তোয়াক্কা করেনি। কিন্তু সেদিকে নির্বাচন কমিশন ঘুরেও দেখেনি। নবগঠিত বিএনএফকে নিবন্ধন দিতে চরম কূটচালের আশ্রয় নিতে দেখা যায়। যা ছিল একেবারে নগ্ন আচরণ।
এরই মধ্যে যা ঘটেছে : তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনেও আতঙ্ক তাড়া করে বিরোধী সমর্থক-প্রার্থীদের। গ্রেফতার আতঙ্কের কারণে বেশিরভাগ বিএনপি সমর্থক প্রার্থীই সরাসরি মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাননি। কেউ আইনজীবী কেউ-বা পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বিরোধী জোটের সম্ভাব্য প্রার্থীদের বেশিরভাগই একাধিক মামলার আসামী। বিরোধী নেতাদের অভিযোগ, সরকার ২০ দলকে বাইরে রেখে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে মেয়র পদসহ সব কয়টি কাউন্সিলর পদ দখলের পাঁয়তারা করছে। বিরোধী জোট যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সেই লক্ষ্যে গত তিন মাসে কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে থানা ও ওয়ার্ড নেতাদের বিরুদ্ধে ডজন ডজন মামলা দিয়ে রেখেছে। তারা বলছেন, নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে আসলে সবাই গ্রেফতারের শিকার হবেন এমন আশঙ্কা সত্যি হতে চলেছে পুলিশের কথায়। গত বৃহস্পতিবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি যুগ্ম কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। সন্ত্রাসী গ্রেফতারের লক্ষ্যে পুলিশ ইতোমধ্যে মহানগরীতে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। পুলিশের এ ঘোষণায় বিস্ময় প্রকাশ করে নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেন, কে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে আর কে পারবে না তা দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আগ বাড়িয়ে পুলিশের এই বক্তব্য আতঙ্ক ছড়ানোর জন্যই দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, সন্ত্রাসীদের যে হালনাগাদ তালিকা করা হচ্ছে তাতে ২০ দলীয় জোট নেতাকর্মীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে বলে অভিযোগে প্রকাশ। আর এই তালিকা নিয়ে টার্গেট করে চলছে ব্লকরেইড। সূত্রে জানা যায়, সিটি নির্বাচন সামনে রেখে সন্ত্রাসীদের যে হালনাগাদ তালিকা হচ্ছে সেই তালিকার পুরোটাই পূর্ণ হবে বিএনপি-ছাত্রদল, জামায়াত ও শিবিরসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের দিয়ে। তাদেরকে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, নাশকতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা মামলায় সংশ্লিষ্ট করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, এমনিতেই ২০ দলীয় জোট নেতাকর্মীরা পলাতক রয়েছেন। সেই সাথে এ অভিযান চললে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে আরো অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, সরকার সমর্থক প্রার্থীরা ইতোমধ্যে নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘন করে চললেও এ ব্যাপারে ইসি’র নির্লিপ্ত ভূমিকায় ক্ষোভ করেছেন জোটের বাইরের প্রার্থীরা।সরদার আবদুর রহমান
Subscribe to:
Posts (Atom)