এটিএম শামসুল হুদা প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ২০০৭ সালে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদের শুরুর দিকে। তার এবং কমিশনের অন্য সদস্যদের নিয়োগে ক্ষমতার দাবিদার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছিল না। এ কমিশন ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থায় বেশ কিছু সংস্কার সাধন করতে সক্ষম হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান করতে পারা ছিল তাদের বড় সাফল্য। এরপর প্রায় তিন বছর কমিশন রাজনৈতিক দলীয় সরকারের আমলে দায়িত্ব পালন করে। সংবিধান অনুযায়ী কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংস্থা। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের আমলে এ সত্তা বজায় রাখা সহজ কাজ নয়। তবে বর্তমান কমিশন এ আমলেই জাতীয় সংসদের একাধিক আসনে উপনির্বাচন, দেশব্যাপী পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এবং চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছে। এ কাজে প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সার্বিক সহায়তাও ছিল লক্ষণীয়। এখন কমিশন তার পাঁচ বছর মেয়াদের শেষ প্রান্তে উপনীত এবং এ সময়ের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তারা কিছু সংস্কার প্রস্তাব সরকারের কাছে উপস্থাপন করতে আগ্রহী। কমিশনের সম্ভাব্য প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে : সংসদ নির্বাচনের প্রচার কাজে দলগুলোকে সরকারি তহবিল থেকে অর্থ প্রদান, নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহার, সিইসি ও নির্বাচনী কমিশনার নিয়োগ আইন এবং নির্বাচনী আসনের সীমানা নির্ধারণে আইন ও বিধিমালার সংস্কার, নির্বাচনে জামানত ও ব্যয়সীমার অঙ্ক বাড়ানো প্রভৃতি। কমিশন তাদের প্রস্তাব চূড়ান্ত করার জন্য রাজনৈতিক দল এবং সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। তবে তাদের জন্য সমস্যা হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আলোচনায় অংশ নিলেও সংস্কারের বিষয়ে কোনো লিখিত পরামর্শ কিংবা প্রস্তাব রাখেনি এবং বিএনপি আলোচনাতেই অংশ নেয়নি। অথচ সংস্কারের জন্য আইন প্রণয়ন হবে জাতীয় সংসদে এবং এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তদুপরি বর্তমান জাতীয় সংসদ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুমোদনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধান বাতিল করায় পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না হলে সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান দুরূহ হবে এবং হলেও তার বিশ্বাসযোগ্য দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হবে। অন্যদিকে বিএনপির দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্বহাল এবং এ ইস্যুতে তারা রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয়। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রশ্নেও তারা সরকারকে একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দিতে রাজি নয়। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব জাতীয় সংসদে অনুমোদন নিঃসন্দেহে বড় চ্যালেঞ্জ এবং তা অতিক্রমে রাজনৈতিক সমঝোতা অবশ্যই প্রধান শর্ত। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হবে প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান। নির্বাচন কমিশনের সংস্কারের প্রতিটি প্রস্তাব সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। কোনো কোনোটি হয়তো ভবিষ্যতের জন্যও তোলা রাখা থাকবে। কিন্তু জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য সর্বোত্তম পরিবেশ সৃষ্টির এ উদ্যোগ প্রশংসনীয় এবং তাতে সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের ইতিবাচক সাড়া দিতেই হবে।
Thursday, 29 December 2011
Tuesday, 27 December 2011

শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করার উদ্যোগে এখনও পর্যন্ত ইতিবাচক ফল মেলেনি
তারল্য সংকট দূর করে শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করার উদ্যোগে এখনও পর্যন্ত ইতিবাচক ফল মেলেনি। বাজারে পুঁজিও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়েনি। এতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া আতঙ্ক যেমন কাটছে না, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও এখনও পর্যন্ত নতুন বিনিয়োগে ইতিবাচক মনোভাব নেয়নি। শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিন ধরে চলা সংকটের জন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা পুঁজির জোগান বৃদ্ধির চেয়েও আস্থার সংকটকেই বেশি দায়ী করেছেন। গত সোমবার সিপিডি আয়োজিত এ সম্পর্কিত গোলটেবিল আলোচনায় আলোচকরা শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয় সে জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও রেখেছেন। ব্যাংকার ও শেয়ারবাজার সম্পর্কিত তদন্ত কমিটির প্রধান ইব্রাহিম খালেদ শেয়ারবাজারে এহেন অবস্থার জন্য দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় বাজারে আস্থার ভাব ফিরে আসছে না বলে মন্তব্য করেছেন। আমরাও তার বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। অধিকন্তু তদন্ত রিপোর্টে যাদের নাম দোষীদের তালিকায় রয়েছে তাদের কাউকে কাউকে দিয়ে বাজারকে স্থিতিশীল করার চেষ্টাটা অপরাধীকে পুরস্কৃত করার সমতুল্য। শেয়ারবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থাটাই পুঁজি সংগ্রহের এই আর্থিক ব্যবস্থার প্রধান শক্তি। যারা শেয়ারবাজার সংকটের জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে কি বাজারকে স্থিতিশীল করা যায়! এর আগেও একবার শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি হয়েছে। তখনও এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরপর দুটি সরকার চলে গেলেও অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পেরেছে। এবারও সে ধরনের অবস্থাই সৃষ্টি হচ্ছে বলে ধারণা করাটা অমূলক নয়। সরকার শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বাজারে আস্থার সংকট দূর করতে পারবে না। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কেউই সহসা বাজারে পূর্ণোদ্যমে ফিরবে না। এতে শিল্প ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য পুঁজি সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে শেয়ারবাজার তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারবে না। শেয়ারবাজারের ওপর ক্ষুদ্র ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য অবিলম্বে বাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ যাতে বক্তৃতা-বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ না থেকে সত্যি সত্যিই বৃদ্ধি পায়, তা নিশ্চিত করাও দরকার। আর বাজারে অহরহ হস্তক্ষেপ করার অভ্যাস ছাড়তে হবে। বাজারকে তার নিজস্ব নিয়মে চলতে দিতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি ও স্বচ্ছতাও নিশ্চিত করতে হবে।
Tuesday, 6 December 2011

মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ
মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ প্রসঙ্গে
দেশব্যাপী সন্ত্রাস নৈরাজ্য দুর্নীতি চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং অব্যাহত অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে সরকারি ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে মানুষ যখন দীর্ঘদিন ধরে যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা, নিষ্ঠা ও নিঃস্বার্থতার মানদন্ডে মন্ত্রিসভার পুনর্গঠন ও রদবদলের জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন তখন সরকার তার মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছেন। বলাবাহুল্য দীর্ঘদিন ধরেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই অযোগ্যতা, অদক্ষতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। এই অভিযোগ অনুযায়ী মন্ত্রিসভায় এমন অনেক মন্ত্রী আছেন যাদের কৃতিত্বের মাত্রা যেমন শূন্যের কোঠায় আবার এমন মন্ত্রীও আছেন যারা তাদের পদ পদবীর অপব্যবহার করে অনিয়ম দুর্নীতির পাহাড় গড়ার অপদৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অনেকে আবার অতি কথনের যেমন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন, তেমনি এটাও দেখা গেছে যে এক মন্ত্রী যা বলছেন আরেক মন্ত্রীর বক্তব্যে তার ঠিক উল্টো কথাও বেরিয়ে আসছে। সামগ্রিক বিশ্লেষণে এটাও প্রতীয়মান হয় যে, সার্বিকভাবে মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। তাদের অনেকেই এমন সব বিষয়ে বক্তব্য রাখেন যা তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত।
উল্লেখ্য যে, প্রধানমন্ত্রী সর্বপ্রথম যখন মন্ত্রিসভা গঠন করেন তখন এই সভায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অজ্ঞাত অখ্যাত ব্যক্তিদের অনেকেই এতে অন্তর্ভুক্ত হতে দেখে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিস্মিত হয়েছিলেন এবং এই নিয়ে পত্র-পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহে অনেক কথা বার্তা হয়েছে। তখন ক্ষমতাসীন দলের তরফ থেকে এই মর্মে সাফাই গাওয়া হয়েছিল যে, দলটি তরুণদের মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব দিয়ে দলে পরিবর্তন ও গতিশীলতা আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং এর সাথে সাথে পুরাতনদের মধ্যে অনিয়ম দুর্নীতির যে প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় অনভিজ্ঞ ও তরুণ মন্ত্রীরা তা থেকে মুক্ত থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভা গঠনের পাশাপাশি একটি উপদেষ্টা সভাও গঠন করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই যে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা গেল যে মন্ত্রিসভার কিছু তরুণ সদস্যের পাশাপাশি প্রবীণ উপদেষ্টাদের যোগ্যতা ও ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। আবার এই প্রশ্নটিও প্রকট হয়ে দেখা দেয় যে, মন্ত্রীরা নয় উপদেষ্টারাই দেশ চালাচ্ছেন যাদের দেশ ও দেশবাসীর সমস্যা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান নেই, এমনকি উপদেষ্টাদের কোন কোন সদস্য বিদেশী স্বার্থের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করার অভিযোগ উঠে। ক্ষমতাসীন দলের কোন কোন এমপি পার্লামেন্টে এই অভিযোগও তুলেছেন যে, মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি রয়েছে। এই নিয়ে সংশ্লিষ্ট এমপির মানসিক ভারসাম্যহীনতার প্রশ্ন তুলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হলেও গত প্রায় তিন বছরে এই মন্ত্রিসভার কার্যাবলী দেশবাসীকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কিছু কিছু মন্ত্রীর দুর্নীতি ও অপকীর্তি দেশ বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজ তথা ভাব-মর্যাদাকেও ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগ উঠেছে। একজন মন্ত্রীর দুর্নীতির দৃষ্টান্ত দেখিয়ে বিশ্বব্যাংক, জাইকা, আইডিবির মত আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। ঐ মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে সুশীল সমাজের তরফ থেকে ঈদের দিনে ঈদ অনুষ্ঠান বর্জন করে শহীদ মিনারে অবস্থান ধর্মঘটও পালন করা হয়েছে। দেশের মহাসড়কসমূহের দূরবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের ন্যায় ঐ সরকারের আমলে বাসমালিকরা ধর্মঘট পালন করেছেন। বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের এমপিরাই পার্লামেন্টেও সরকারের সমালোচনা করেছেন কিন্তু এতে কোন ফল হয়নি। বরং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দলীয় নেতারা দলীয় মন্ত্রীদের দুর্নীতির সমালোচনা করে শত্রুদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন বলে মন্তব্য করেছিলেন। দেশের মানুষ এতে হতবাক হয়েছে। তারা আরো হতবাক হচ্ছে এজন্য যে, মন্ত্রিসভা এমনসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন যার সাথে বাস্তব অর্থে জনগণের স্বার্থের সংশ্লিষ্টতা নেই বললেই চলে। অনেকে এও বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রীকে সঠিক উপদেশ দেয়ার মত ব্যক্তি বা মন্ত্রী কেবিনেটে নেই অথবা থাকলেও তাদের সাহস নেই। ফলে সরকার তার নির্বাচনী ওয়াদা ভুলে গিয়ে এমন সব কর্মতৎপরতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছেন যাতে মনে হচ্ছে যে, বাংলাদেশের বুকে এই সরকারই শেষ সরকার এবং তাদের পর আর কোন সরকার আসবে না। রাজনৈতিক দলন-নিপীড়ন, একনায়কসূলভ আচরণ এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রতিদ্বনদ্বী দলসমূহকে নিশ্চিহ্নকরণের প্রবণতা এবং দেশের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে প্রতিবেশীর স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া প্রভৃতি এরই অংশ। আমরা এর নিন্দা জানাই।
মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে সরকার বাবু সুরঞ্জিত দাসগুপ্ত এবং ওবায়দুল কাদেরকে কেবিনেটে অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ডা. হাসান মাহমুদকে পদোন্নতি দিয়ে পূর্ণ মন্ত্রী করেছেন। আমরা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে পর্যবেক্ষণযোগ্য বলে মনে করি। নতুন যে দু'জনকে মন্ত্রী করা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে এই দু'জন সরকারের মন্ত্রীদের কিছু কিছু কাজের সমালোচনা করতেন। তাদের মন্ত্রী করার ফলে তাদের মুখ বন্ধ হয়ে যায় কিনা তা দেখার বিষয়। সরকারের অভ্যন্তরে থেকে সরকারের অথবা তা কোন অর্গানের সমালোচনা করা কৃতিত্বের বিষয় নয়। বরং যারা সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সহায়তা করেন এবং নিজ নিজ মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সেবা তৎপরতাকে শক্তিশালী ও শানিত করে দেশের মানুষের উপকার করতে পারেন তারাই স্বার্থক বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশে বর্তমানে যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে তাতে সরকার দৈনিক প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ধার করে দেশ পরিচালনায় বাধ্য হচ্ছেন। এই অবস্থায় মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করে ব্যয়ের পরিসর আরও বৃদ্ধি করার মধ্যে আমরা কোন দূরদর্শীতা দেখতে পাই না। বরং সরকারের উচিত ছিল অথর্ব ও অযোগ্য এবং দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে অভিজ্ঞ, নিষ্ঠাবান এবং সৎ ব্যক্তিদের তাতে অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু তা হয়নি। এই অবস্থায় সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত কি পরিণাম বয়ে আনে তা দেখার জন্যই আমরা অপেক্ষা করতে চাই।
Sunday, 4 December 2011

সমাজতন্ত্র বিদায়ের কুড়ি বছর পরে
সমাজতন্ত্র বিদায়ের কুড়ি বছর পরে
ইতিহাস বলছে কোনও সাম্রাজ্য বা শাসন চিরস্থায়ী হয় না। আর শাসনটি যদি হয় শোষণ ও অত্যাচারে ভরপুর, তাহলে বিদায় বা পতন হয় অতি দ্রুত এবং সেই পতনটি নেমে আসে অতি লজ্জায়, অপমানে, রক্তাক্ত বিয়োগান্ত পরিণতিতে। বিশ্ব বরেণ্য ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন ইতিহাসে কোনও শাসন বা সাম্রাজ্যের গড়পড়তা আয়ু হিসাব করেছিলেন একশত কুড়ি বছর। এই হিসাবটি যান্ত্রিক মনে হতে পারে, কিন্তু এর মধ্যে যে সত্যটি পরিস্ফুট তা হলো, যে কোনও সাম্রাজ্যের কোনও-না-কোনও সময়ে মৃত্যু ও পতন অনিবার্য। বহুবিধ অত্যাচার ও পীড়নের মাধ্যমে কোনও কোনও পতন অগ্রিম চলে আসে; রক্তের বন্যায় ভেসে যায়; জনগণের ঘৃণায় ও প্রতিবাদে জীবন্তসমাধিপ্রাপ্ত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে, দক্ষিণ এশিয়ায়, বাংলাদেশে উত্থান-পতনের বহু ঘটনা সাম্প্রতিক ইতিহাসের অংশ বিশেষ। প্রবল স্বৈরাচারী দম্ভ, একদলীয় বর্বরতা, অতিজনপ্রিয়তা থেকে জনধিক্কার ইত্যাদি রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় পাতায় বিদায়, পতন ও অপমানের স্মারক হয়ে কলঙ্কের হরফে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ইবনে খালদুন বর্ণিত একশত কুড়ি বছরের পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার সৌভাগ্যও তখন সেইসব স্বৈরশাসনের হয় না; হয় বেদনাদায়ক ও অপমানের-লাঞ্ছনার পতন। ইতিহাসের সেইসব নির্মম পতনকে স্মরণ করে জনতা তাদের আশপাশে চিরস্থায়ী হয়ে ওঠার দিবাস্বপ্নে-বিভোর নব্য স্বৈরাচারী-একদলীয়-তা-বতার অপমানকর বিদায় আর আসন্ন পতনেরই অপেক্ষা করতে থাকে।
চলতি ২০১১ সাল ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে সমাজতন্ত্র-পতনের কুড়ি বছর পূর্তি উপলক্ষে। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে ১৯৯১ সালের ৭ আগস্ট ছিল সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের দিন। কতগুলো সম্প্রসারণবাদী অলীক স্বপ্নে কার্ল মার্ক্সের মানসপুত্র ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব করলেন; রাশিয়ার আশপাশের মধ্য এশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রসমূহসহ অন্যান্য দেশগুলো দখল করে তৈরি করলেন কল্পিত স্বর্গ: সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারপর সেই স্বর্গকে লৌহ প্রাচীরে আড়াল করে জোসেফ স্টালিন অত্যাচার, নিপীড়ন, হত্যা, নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের রামরাজ্য বানালেন সোভিয়েত দেশকে এবং আরও দখলদারিত্ব চালাতে লাগলেন বিশ্বের দেশে দেশে। পূর্ব ইউরোপের রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়ার তথাকথিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারাবাহিকতার নামে সামাজিক-সম্প্রসারণবাদেও দানব-ট্র্যাঙ্কে চেপে আগ্রাসন চলে আসে উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, চীনে। আগ্রাসী রক্তস্রোত গিয়ে পৌঁছেছিল সুদূর দক্ষিণ আমেরিকাতেও। হুগো শাভেজের ভেনেজুয়েলা বা নেপালের পুকমলদাহাল বা প্রচন্ডের মতোই কিউবাতেও সমাজতন্ত্র বৃদ্ধ-বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর অনুকরণে এখন মৃত্যুশয্যায়। ভিয়েতনামে টিমটিম করে জ্বলছে নিভু নিভু সমাজতান্ত্রিক বাতি। চীনে এক ধরনের ‘সিউডো কমিউনিস্ট' কাঠামোর মধ্যে এবং উত্তর কোরিয়ায় রাষ্ট্রভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শুধু কয়েকটি অক্ষরের সমাবেশে নামমাত্র নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে অন্তঃসারশূন্য-সমাজতন্ত্র। এমন কি, পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সুদৃঢ় ৩৪ বছরের কমিউনিস্ট সাম্রাজ্যের পতন দক্ষিণ এশিয়ায় সমাজতন্ত্রের বেঁচে থাকার ক্ষীণ সম্ভাবনাটিকেও এক ফুৎকারে নিভিয়ে দিয়ে গেল বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের পতনের কুড়ি বছর পূর্তির সময়ে।
এ যেন তাসের ঘরের মতো পতন, খোদ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে একে একে সবগুলো লাল দূর্গের ধ্বংস-এর মূল কারণ কি? আসলে মানুষ সমাজতন্ত্রের ফাঁকা বুলির মধ্যে এটুকু বুঝতে পেরেছে যে, সমাজতন্ত্র-কমিউনিজম-সাম্যবাদ ইত্যাদিতে অতি নাটকীয় রোমান্টিকতা আছে; আছে শিহরণ ও উত্তেজনা এবং এহেন স্বৈরতন্ত্রী-একদলীয় সমাজতন্ত্রের সঙ্গে মানুষের স্বাধীন মত ও বিশ্বাসের চর্চা ও প্রকাশের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এমন কি, সমাজতন্ত্রে কথিত প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার তত্ত্বের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিক, আদর্শিক, ধর্মীয়, মানবিক, আত্মিক স্বভাবের এক ধরনের তীব্র-বিরোধ আছে। যে পুঁজিবাদী, ভোগবাদী, বিলাসী, অপচয়ী, অমানবিক ব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের কথা বলা হলো, সেই সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদই অসৎ নেতৃত্বের হাতে পড়ে সুবিধাবাদে রূপান্তরিত হয়। (বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রীরা কি হয়েছেন সেটা আরও চমকপ্রদ গবেষণার বিষয়!) মানুষ তখন বাধ্য হয়েই পুঁজিবাদের মতো সমাজতন্ত্র থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেয়। সমাজতন্ত্রের খোলসে সুবিধাবাদের খেলা মানুষ শেষ পর্যন্ত আর দেখতে চায়নি বলেই সারা পৃথিবী জুড়ে সমাজতন্ত্রের এই পতন ও পলায়নী পরিণতি। সর্বশেষ বিয়োগান্ত ও লজ্জাজনক পতনচিহ্নিত বিদায়টি ঘটলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, গত ১৩ মে, ২০১১ সালে।
সমাজতন্ত্রের করুণ পতনে বা গণধিক্কারে সারা পৃথিবী লজ্জা পেলেও সোভিয়েত ইউনিয়নে কিংবা পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা বিন্দুমাত্র লজ্জিত বোধ করবার প্রয়োজনই মনে করলো না। পতনকালী সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ বেহায়ার মতো বলছিলেন, ‘এর নাম পতন নয়, এর নাম গ্লাসনস্ট, পেরেস্ত্রোইকা।' বাংলাদেশে গর্বাচেভপন্থী পেরেস্ত্রোইকা-গ্লাসনস্টিরা কমিউনিস্ট পার্টির অফিস ও সম্পদ ভাগ করে নিল। এই চক্রের যে তিন পালা, যাদেরকে সাধারণভাবে ডাকা হয় ঢাকা ও চট্টগ্রামের ‘কুচক্রী তিন ম' নামে, তারা সেই বাটোয়ারায় জেহাদি উত্তেজনায় অংশ নিয়েছিল। সর্বপ্রথম আলো জ্বেলে গর্বাচেভকে ‘সাধু-সাধু' ধ্বনি দিয়েছিল তারই। তারা সব সময়ই লাভ ও লোভের ক্ষেত্রে প্রথম হতে ভালোবাসে। গর্বাচেভিয় প্রথম আলোটি প্রথম ছড়ানোর মতোই তারা প্রথম সুযোগেই লাফ দিয়ে পশ্চিমা গোষ্ঠী, পুঁজিবাদ ও মাল্টিন্যাশনালের কোলে গিয়ে ওঠলো। তারপরের কাহিনী সকলেরই জানা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামকে নিয়ে ব্যঙ্গ-রসিকতা-কার্টুন আঁকা (নাউযুবিল্লাহ) থেকে শুরু করে ১/১১-এর যাবতীয় দেশ-জাতিবিরোধী শাঠ্য-ষড়যন্ত্রেও তারা প্রথম বা অগ্রগামী হয়ে রইলো এখন পর্যন্ত। হালে তাদের প্রতিদ্বনদ্বী এক মিডিয়া গ্রুপ অস্ত্র-জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের সঙ্গেও এই চক্রের নানা সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রচার করছে। চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় ‘কুচক্রী গ্রুপ'-এর যেমন সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, বাংলাদেশেও জাতি-ধর্ম-শিষ্টাচার বিরোধী সমাজতন্ত্রে আলখাল্লাধারী এই কুচক্রীদের সাম্প্রতিক সময়ে খুবই তৎপর দেখা যাচ্ছে। (এদের নিয়ে বিশদে লিখার সুযোগ ও প্রয়োজন রয়েছে, এখানে আজকের মূল বিষয়কে ব্যাখ্যা করার স্বার্থে সেদিকে আলোকপাত করা হচ্ছে না। ভবিষ্যতে আলাদাভাবে দেশ ও জাতিবিরোধী কুচক্রী গোষ্ঠীর চরিত্র ও কর্ম চিত্রণ করা হবে।)
সোভিয়েতের পতিত-সমাজতন্ত্রীদের মতোই সদ্য-পতিত পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজতন্ত্রীরা আরও এক ধাপ বেশি বেহায়াপনা করলো। পতনের সঙ্গে সঙ্গে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু নির্লজ্জের মতো বললেন: ‘কেউ হারলে যেমন তাকে সমবেদনা জানানোর কিছু নেই, তেমনই জিতলে তাকে নিয়ে উদ্বাহু নৃত্য করারও কিছু নেই!' তার মানে কি ? পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের এতো কা- কিংবা সোভিয়েতে ১৯১৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত ৭০ বছরেরও বেশি সময়ের কোনও দায়-দায়িত্বই নেই? সব খালাস? এরচেয়ে বড়ো দম্ভোক্তি ও অগণতান্ত্রিক হুঙ্কার আর হতে পারে না। যে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার জুজু দেখিয়ে সমাজতান্ত্রিক-সাম্প্রদায়িকতা প্রতিটি নির্বাচনে ‘সংখ্যালঘু কার্ড' ব্যবহার করেছে; মুসলিম সংখ্যালঘুদের ভীতি ও আতঙ্কের মধ্যে রেখে ভোট দিতে বাধ্য করেছে, সেটার কি হবে? সমাজতান্ত্রিক ধর্মহীনতায় মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতিকে ভাসিয়ে দিয়ে বিগত ৩৪ বছরে পশ্চিমবঙ্গের সমাজতন্ত্রীরা গণতন্ত্রের কোনও লাভ-ক্ষতি করুক বা না করুক, মুসলমানদের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। হিন্দু-মুসলিম বিবাহ, মুসলিম ধর্ম-সংস্কৃতি-মূল্যবোধকে ধর্মহীন বা ধর্মনিরপেক্ষ করার কাজটি তারা এতই যোগ্যতার সঙ্গে করেছে যে, ইসলাম এখন পশ্চিমবঙ্গে এক অতি কোনঠাসা, অতি প্রান্তিক, অতি কোণঠাসা ধর্ম। মাদ্রাসা শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ওয়াকফ ইত্যাদি ব্যবস্থাকেও তছনছ করে দিয়েছে সমাজতন্ত্রীরা। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মহাস্লোগান দিয়ে পুঁজিবাদের একটি লোমও ছিড়তে পারেনি তার। অথচ মুসলমানদের চরম ক্ষতিসাধন করেছে এই সমাজতন্ত্রীরা। (পশ্চিমবঙ্গের দাদাদের তাবেদার বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রী নামধারীরা পুঁজিবাদের কিছু করতে না পারলেও এদেশে ঠিকই ইসলামের বিরুদ্ধে বন্য মোষের মতো তেড়ে আসতে পারে!) একদা অবিভক্ত বঙ্গে যে মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, তার পশ্চিমবঙ্গ অংশে এখনও রয়ে গেছে মুসলিম ঐতিহ্য, শিক্ষা, শাসনের অনেক স্মৃতি ও প্রত্ন নিদর্শন; সেই পশ্চিমবঙ্গে সমাজতন্ত্রীরা মুসলমানদের পিষতে পিষতে তলানিতে নিয়ে গেছে। কমিউনিস্ট শাসনের ফলে বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে এমনই যে, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান মানেই দরিদ্র, পশ্চাৎপদ, অবহেলিত, বঞ্চিত, অনাদৃত এবং ধর্মীয় আচার-আচরণে শ্লথ। যদিও বামবাবুরা ধুতি-পাঞ্জাবী চাপিয়ে দিব্যি হিন্দু ধর্ম-কর্ম করছেন। কিন্তু মুসলমানদের বলছেন, ধর্ম মেনো না, ধর্ম পালন করলে সাম্প্রদায়িক (?) হয়ে যাবে!! (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী সুবিধাপ্রাপ্ত একজন সমাজতন্ত্রী অধ্যাপক সর্বদা পূজা কমিটির সভাপতি হয়ে বিশিষ্ট হিন্দু ভদ্রলোকের ধর্মনিষ্ঠ চরিত্র বজায় রেখেও নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল নামে পরিচিত করেন! তাদের ধর্মপালন প্রগতিশীলতা ও সেকুলারিজমকে ক্ষুণ্ণ করে না। ইসলাম ধর্ম প্রতিপালিত হলেই মুসলমান ব্যক্তিটি ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী হয়ে যায়! সেলুকাস আবার এসে দেখে যান, আসলেই কি বিচিত্র এই দেশ!)
সমাজতন্ত্রে ইসলাম ধর্ম কেবল পশ্চিমবঙ্গেই আক্রান্ত ও বিপদগ্রস্ত হয়নি। বিশ্বব্যাপী পুরো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই হয়েছে। খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নে মুসলমানরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হন। তাদের আত্মপরিচয় মিটিয়ে দেয়া হয়। এমন কি, তাদের নাম বদলিয়ে রাখা হয় করিমভ, রহিমভ ইত্যাদি। যে মধ্য এশিয়ায় ইমাম বোখারী, নকশবন্দিসহ শত-সহস্র অলিআল্লাহ-বুজুর্গের জন্ম হয়েছিল, সেই সমরকন্দ, বোখরা, তাসখন্দ, ফারগানা তথা উজবেকিদস্তান, কাজাকিস্তান, তুর্কিস্তান, আজারবাইজানের মসজিদগুলোতে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। পবিত্র কোরআন, হাদিস চর্চা করা হয় নিষিদ্ধ। প্রকাশ্যে আযান দিয়ে নামাজ আদায়কে বন্ধ করে দেয়া হয়। ইসলাম ধর্ম পালনের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট-সমাজতন্ত্রীদের মতো এতো বিরাট প্রতিবন্ধতা আর কেউই সৃষ্টি করতে পারেনি। জাগরণের জন্য ইসলাম তীব্র গণআন্দোলনে বার বার ফুঁসে ওঠলেও সাবেক সোভিয়েত স্বৈরশাসন রক্ত ও মৃত্যুর নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল অসংখ্য ইসলামী আন্দোলনকে। চেচনিয়া যার জ্বলন্ত উদাহরণ।
গত শতাব্দীর ইতিহাস তথাকথিত পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের নামে একটি সাজানো লড়াইয়ের নাটক দেখলেও প্রকৃত পক্ষে সেই ষড়যন্ত্রমূলক প্রহসনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসলাম ও মুসলমানগণ। পশ্চিমা সভ্যতার তাত্ত্বিকগণ সুকৌশলে জন্ম দিয়েছে তাদের দুইটি অবৈধ-জারজ সন্তান--- একটি পুঁজিবাদ, আর অন্যটি সমাজতন্ত্র। উদ্দেশ্য, সারা বিশ্বকে, বিশেষ করে মুসলিম জগতকে এমন ফাঁদে ফেলে দেয়া, যাতে তারা হয় পুঁজিবাদ, নয় সমাজতন্ত্রের দাসত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়; স্বাধীনভাবে ইসলাম চর্চা করতে না পারে।
যখন উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে পশ্চিমা খ্রিস্ট-ইহুদি জগৎ পুরো পৃথিবীকে অধীনস্ত করে রাখতে পারছিল না, সর্বত্র স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠছিল, তখন পুঁজিবাদের নকল-প্রতিপক্ষরূপে ইসলাম-ঠেকানোর লক্ষ্যে মাঠে ছেড়ে দেয়া হয় ইহুদি কালমার্ক্সের গর্ভজাত সমাজতন্ত্রকে। অর্থডক্স রুশিয় খ্রিস্টান লেনিন এবং স্টালিন সেই সমাজতন্ত্রকে ইসলামের বিরুদ্ধে আরও সূচারু ও কার্যকর হাতিয়াররূপে নির্মমভাবে ব্যবহার করে। ইসলাম হৃত-গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য আরব থেকে এশিয়ায়, সমগ্র মুসলিম জাহানে পুনরুত্থানের প্রাণাবেগ বেজে ওঠতে থাকলে সমাজতন্ত্রের নানা প্রলোভনের মিথ্যার জালে আটকে দেয়া হয় মুক্তিকামী মুসলিম গণমানুষকে। মুসলমানদের দেশে দেশে একদিকে পুঁজিবাদীরা ইসলামকে দমনের এজেন্ডা দিয়ে যেমনভাবে ইরানের শাহ, মিসরের আনোয়ার সাদাত, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, পাকিস্তানের আয়ুব খানের মতো পদলেহী তাবেদারদের বসিয়ে দেয়; অন্যদিকে তেমনিভাবে সমাজতন্ত্রীরাও বসিয়ে দেয় আলবেনিয়ায় আনভার হোসকা (আসলে আনোয়ার হোজ্জা, কিন্তু কমিউনিস্ট হয়ে ইসলামিক আনোয়ার হোজ্জা বদলে রাখেন সেক্যুলার আনভার হোসকা), আফগানিস্তানে নূর মোহাম্মদ তারাকি কিংবা বারবাক কারমালকে। ধূর্ত পশ্চিমা জগৎ এভাবে একহাতে পুঁজিবাদকে আর অন্য হাতে সমাজতন্ত্রকে ব্যবহার করে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ফলে সমাজতন্ত্র পতনের কুড়ি বছর পূর্তিতে এবং কুড়ি বছরের মাথায় পাশের পশ্চিমবঙ্গেও সমাজতন্ত্রীদের বিদায়ের ঐতিহাসিক ঘটনা ‘চুপ থাকা বা উল্লসিত হওয়ার' বদলে মুসলিম ব্যক্তি ও সমাজকে প্রবল আত্মসমালোচনা এবং কর্মকৌশল নির্ধারণের প্রেরণা দিচ্ছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই কালো ইতিহাস, যা অতীতে সমাজতন্ত্রের ভ্লাদিমীর ছদ্মাবরণে এবং বর্তমানে পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী শোষণের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলমানদের নিধন করতে উদ্যত। আফ্রিকা, এশিয়া, আরব কিংবা যেখানেই ইসলামের বিজয় ও উত্থানের সামান্যতম সুযোগ আর সম্ভাবনাও সৃষ্টি হচ্ছে, সেখানেই পশ্চিমা বিশ্বের সদস্যভুক্ত দেশসমূহ--- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি, ইতালি এবং তাদের গোপন-অবৈধ সন্তান ইসরায়েল এসে তীব্র বেগে হাজির হচ্ছে ইসলামি অভ্যুত্থানকে ঠেকাতে। অস্ত্রের জোরে, প্রচারণার কৌশলে, রাজনীতির মারপ্যাঁচে, অর্থাৎ যেভাবে সম্ভব সেভাবেই দমানো ও ঠেকানো হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানদের।
বিশেষ করে সমাজতন্ত্রের পতনের পর পুঁজিবাদী শোষণ-নিপীড়ণকে চ্যালেঞ্জ করে মানুষের মুক্তি ও প্রকৃত স্বাধীনতা আনয়নের একমাত্র বিশ্বব্যাপী শক্তিরূপে ইসলামকে স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়। আর তখনই নতুন করে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ নামক আরোপিত লেবেল দিয়ে দেয়া হয়েছে ইসলাম, ইসলামি আন্দোলন ও মুসলমানদের ওপরে। অতএব সমাজতন্ত্রের বিদায় বা পতনের কুড়ি বছরের প্রাক্কালে প্রতিটি মুসলমানের উচিত আত্মউপলব্ধির আলোয় নিজের কর্ম ও ভবিষ্যতকে নির্মাণ করা। ইসলামের সুমহান আহবানের সঙ্গে আত্মিক ও মানসিক একাত্মতার মাধ্যমে পশ্চিমা শক্তির আর্দশিক জিঞ্জির ছিন্ন করা। পৃথিবীর মানুষের সামনে মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রকৃত রাজতোরণ-ইসলামকে অনুসরণের মাধ্যমে আদিঅন্তহীন মুক্তির মিছিলে এসে সমবেত হওয়া।
মনে রাখা দরকার যে, ইসলামী পুনর্জাগরণ বা ইসলামী গণসচেতনতা কোনও মধ্যযুগীয় ঘটনা নয়। এটি পুরোপুরি সমকালীন বাস্তবতা। আধুনিক পরিস্থিতির ব্যর্থতাজাত সঙ্কটসমূহ এবং সমাজতন্ত্র-পুঁজিবাদ-সৃষ্ট সমস্যাসমূহ মোকাবিলার বৈজ্ঞানিক ও গণতান্ত্রিক বিকল্পরূপে ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই ইসলামী আদর্শ বিশ্ব মানবতার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের চরম ব্যর্থতার পর সাম্প্রতিক সময়ে অর্ধ-ব্যর্থ সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী চক্রের কবল থেকে বিশ্ব ও মানব সমাজকে রক্ষার জন্য প্রায়োগিকভাবে সবচেয়ে সফল, শক্তিশালী ও পূর্ণাঙ্গ মতাদর্শ হিসাবে ইসলামে উত্থান একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে। বস্তুতপক্ষে, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ ইত্যাদি সকল ধর্মনিরপেক্ষ বা সেক্যুলার মতাদর্শ বা ইডিয়লজির মতাদর্শিক ও প্রায়োগিক দুর্বলতা-ব্যর্থতা-অসারতা প্রকাশ পাবার পর সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের সামনে শ্বাশত সৌন্দর্য ও স্বক্ষমতায় কেবলমাত্র ইসলামই একটি প্রেরণা সৃষ্টিকারী পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শরূপে প্রতিভাত হয়েছে। এটি অবশ্যই একটি ধর্ম বিশ্বাস এবং সেই সঙ্গে জীবন বিশ্বাসও। এই বিশ্বাসের পেছনে রয়েছে ইতিহাসচেতনা, বিজ্ঞানবোধ, সাম্যের ভিত্তি, মানবিকতার জয়গান এবং মুক্ত মন; রয়েছে বৈজ্ঞানিক যুক্তি। ইসলাম কেবল স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণকর স্বপ্নের কথা ইসলাম বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করেছে মানুষের পৃথিবীতে, চোখে দেখা বাস্তবতার ও কর্মের মাটিতে। ইসলামের বাস্তব ভিত্তি, বৈজ্ঞানিক যুক্তি, সাম্য, মৈত্রী এবং কল্যাণধারার দিকে তাকিয়ে রয়েছে পতিত সমাজতন্ত্রের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত পৃথিবী ও পৃথিবীর মানবমন্ডলী; তাকিয়ে রয়েছে বর্তমানে ফণা-উদ্যত পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদের নিত্য ছোবলে রক্তাক্ত-জর্জরিত আজকের পৃথিবী ও পৃথিবীর মানববংশ। ইতিহাসের এই প্রত্যাশাকে সত্যে প্রতিপন্ন করে আজ এবং আগামীর প্রকৃত স্বাধীনতা ও মুক্তির বরাভয় নিয়ে ইসলাম আসবেই। প্রকৃতি, পৃথিবী ও মানুষের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের জন্য ইসলামকে আসতেই হবে।
Saturday, 3 December 2011

সন্ত্রাসীদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না
সন্ত্রাসীদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল দীর্ঘদিন ধরেই চরমপন্থীদের আশ্রয়স্থল, ঘাঁটি ও অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। কখনো কখনো তাদের দৌরাত্ম্য বাড়ে, কখনো কখনো কিছুটা কমে। তবে কখনোই অপতৎপরতা নিঃশেষ হয়ে যায় না। অন্তত ১২টি চরমপন্থী সংগঠন এ অঞ্চলে তৎপর রয়েছে। রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে কমিউনিজম বা মাওবাদ পরিত্যক্ত হলেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের কিছু এলাকায় কমিউনিজম বা মাওবাদের নামে এসব সংগঠন হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি ইত্যাদি চালিয়ে যাচ্ছে। এদের ভয় ও অত্যাচারে কখনো কখনো মানুষ দিশেহারা ও অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে।
আইন-শৃক্মখলা বাহিনী যখন তৎপর হয়, অভিযান চালায়, তখন তাদের অনেকে আত্মগোপন করে, অনেকে দেশের অন্যত্র কিংবা সীমান্তের ওপারে পালিয়ে যায়। আইনশৃক্মখলা বাহিনীর তৎপরতা ও অভিযান স্তিমিত হয়ে গেলে আবার তারা ফিরে আসে। এভাবে ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে বছরের পর বছর ধরে।
গত ছয় বছর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, গণপিটুনি ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রায় পাঁচশ' চরমপন্থী ও গ্রুপ লিডার নিহত হলেও পরিস্থিতির তেমন কোন উন্নতি ঘটেনি। অস্ত্র স্থানান্তরিত হয়েছে। নতুন গ্রুপ লিডার ও ক্যাডারের জন্ম হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষ নিহত গ্রুপ লিডারদের স্ত্রীরা সামনে চলে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, চরমপন্থীরা রাজনৈতিক শেল্টারও পাচ্ছে।
অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি চরমপন্থী সংগঠনগুলো ‘ক্যাডার' সংগ্রহেও তৎপর হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে তারা বেকার যুবক এবং বিশেষত মহিলাদেরই প্রাধান্য দিচ্ছে। এপারের চরমপন্থীদের সাথে ওপারের মাওবাদীদের একটা সম্পর্ক বরাবরই রয়েছে। তারা পরস্পরের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে।
বিপদাপদে তারা একে অপরকে আশ্রয় ও সহযোগিতা দিয়ে থাকে। নীতি-পদ্ধতির অনুসরণ ও পরস্পরের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। ওপারের মাওবাদীরা তাদের তৎপরতায় মহিলা ক্যাডারদের অনেক আগে থেকেই ব্যবহার করছে। এপারের চরমপন্থীরাও তাদের অনুসরণে মহিলা ক্যাডার সংগ্রহ ও ব্যবহারে প্রাধান্য দিচ্ছে। মেহেরপুরের রিক্তার ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর বিষয়টি প্রথমে নজরে এলেও পরে কুষ্টিয়ার অাঁখি, রানী, চুমকি, চম্পা, নাসরিন, কনা, পাবনার মোর্শেদা, যশোরের হাফিজা, মেহেরপুরের জ্যোৎস্না প্রমুখ মহিলা ক্যাডার আটক হওয়ার ঘটনায় প্রমাণিত হয়, চরমপন্থী গ্রুপগুলোর মধ্যে মহিলা ক্যাডারের সংখ্যা এখন দেড় শতাধিক, দিনে দিনে এই সংখ্যা বাড়ছে।
চরমপন্থীদের সঙ্গে ওপারের মাওবাদীদের সম্পর্ক আছে, নৌদস্যু ও বনদস্যুদের সঙ্গে মিতালী আছে, আছে তাদের অস্ত্রের নির্ভরযোগ্য উৎস। এই সঙ্গে আছে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়। এমতাবস্থায় চরমপন্থীদের দৌরাত্ম্য ও হুমকি থেকে এ অঞ্চলকে মুক্ত করা যে অত্যন্ত কঠিন, তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য এবং নেপালে মাওবাদীদের হত্যা, সন্ত্রাস ও নাশকতামূলক তৎপরতার কথা কারো অজানা নেই। আমাদের দেশের জন্য বিশেষভাবে বিচলিত হওয়ার বিষয় এই যে, ওপারের মাওবাদীদের সঙ্গে এপারের চরমপন্থীদের সম্পর্ক ও সহযোগিতা ক্রমাগত বাড়ছে।
র্যাব-পুলিশের অভিযানের মধ্য দিয়েও বেশ কিছুদিন স্তিমিত থাকার পর বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের আন্ডার ওয়ার্ল্ড আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রকাশ্যে চরমপন্থীরা হত্যা করে বিগত দিনের ন্যায় হত্যার দায় স্বীকার করে লিফলেট বিতরণ করেছে। চরমপন্থীদের নামে মোবাইল ফোনে চাঁদাবাজি চলছে অহরহ। চাঁদা না দিলে শিল্পপতিদের বাড়িতে বোমা হামলা হচ্ছে। জীবন ভয়ে চরমপন্থীদের তাই বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ লাখ লাখ টাকা প্রতিনিয়ত চাঁদা দিচ্ছে। এত কিছুর পর র্যাব-পুলিশ-গোয়েন্দারা যেন সন্ত্রাসের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। সন্ত্রাসের ভয়ঙ্কর জনপদ হিসেবে খ্যাত খুরনার নাম কোনভাবেই মোছা যাচ্ছে না।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চরমপন্থীরা ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, নতুন করে অস্ত্র সংগ্রহ ও নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করছে তারা। অস্ত্রের উৎস ভারত। এপার ও ওপারের মধ্যে চোরাচালানিদের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে তারা অস্ত্র সংগ্রহ করছে। অস্ত্র যে ব্যাপক হারে ভারত থেকে আসছে, তার প্রমাণ গত দেড় বছরে সহস্রাধিক অস্ত্র উদ্ধার। গত এপ্রিলে যশোরের চাচড়া থেকে পিস্তল ও গুলী উদ্ধার করা হয়। ক'দিন আগে যশোর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি ভারতীয় পিস্তল উদ্ধার করা হয়। এভাবে প্রায়ই ভারতীয় অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে।
চলতি বছরের ৬ মাসে শুধু খুলনায় শতাধিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে প্রায় ৩০টি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। সব মিলিয়ে চরমপন্থীরা এখন বেপরোয়া। বর্তমান সরকারের আমলে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল জুড়ে কোনো বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়নি। এসব হত্যাকান্ডের সাথে কিশোর সন্ত্রাসীরা বিশেষভাবে জড়িত বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে।
টপটেরর বা ‘দাদা'রা অনেকেই ক্রসফায়ারে খতম বা অব্যাহত অভিযানে দেশছাড়া। চরমপন্থী অস্ত্রবাজ ও খুনিদের একটি অংশ এখন জেলের ঘানি টানছে। তবুও হত্যা, চাঁদাবাজি, অপহরণ, সন্ত্রাসবাদ থামেনি। কারণ, আন্ডার ওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ এখন কিশোর সন্ত্রাসীদের হাতে। ডনদের কাছাকাছি থেকে এরা দেখেছে হত্যাযজ্ঞ ও সমাজকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাওয়ার সব অভিনব কলাকৌশল। অস্ত্র হাতেই এরা কথিত নিষিদ্ধ পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শ্রেণী শত্রু খতমের নামে পাখির মতো গুলী করে হত্যা করেছে রাজনীতিক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী ও সমাজের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষকে। দিন দুপুরে জীবনবাজি রেখে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করে এনে তুলে দিয়েছে ডনদের হাতে।
আজ তাদেরই সময়ের প্রয়োজনে দলের কান্ডারি হিসেবে সর্বময় দায়-দায়িত্ব তুলে নিয়েছে এরা। চাঁদাবাজি, হুমকি, হত্যা, বোমাবাজি প্রভৃতি অপরাধের বিষয়ে চরমপন্থীদের মুখপাত্র হিসেবে কিশোর সন্ত্রাসীরা এখন লাইমলাইটে।
জানা গেছে, খুলনা মহানগরীসহ বৃহত্তর খুলনার ৩ জেলায় এই কিশোর সন্ত্রাসীরা আন্ডার ওয়ার্ল্ডকে উত্তপ্ত করে তুলেছে।
এসব সন্ত্রাসীকে গ্রেফতারের জন্য র্যাব-পুলিশ প্রতিনিয়ত ঢিলেঢালা হলেও অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে উঠতি বয়সী সন্ত্রাসীদের ওপর র্যাব, পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নজরদারি শুরু করেছে। র্যাব-পুলিশ কৌশলগত কারণে এসব বিষয়ে মুখ খুলতে চাইছে না।
Friday, 2 December 2011

মাটির এই পৃথিবী দানবের জন্য নয়
মাটির এই পৃথিবী দানবের জন্য নয়
দেশ নিয়ে আমরা গর্ব করতে চাই, গর্ব করতে চাই সরকারের সাফল্য নিয়েও। কারণ সরকার সফল হলে দেশ এগিয়ে যায়, জনগণ সুখে থাকে। আর জনগণ যখন সুখে থাকে, তখন তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় সন্তুষ্টির কথা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জনগণ কি এখন তেমন কথা উচ্চারণ করছে? দেশকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী তার এই দায়িত্ব পালন করে থাকেন মন্ত্রী পরিষদের মাধ্যমে। যেহেতু সরকারের সফলতা-ব্যর্থতার মূল দায়িত্ব বর্তায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর, তাই মন্ত্রীদের ক্রিয়া-কর্মের ব্যাপারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন প্রধানমন্ত্রী। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই দৃষ্টিতে কখনো যে তারতম্য কিংবা রকমফের ঘটে না তা কিন্তু নয়। এমন কিছু ঘটলে যে শুধু নীতির লঙ্ঘন হয় তা নয়, এই পথে সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়, পতনও ঘটে। কিন্তু এই বিষয়টি সবসময় সরকার তথা মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী উপলব্ধি করতে সক্ষম হন না। এখানেই সরকারের জন্য সুপ্ত থাকে ট্র্যাজেডির বীজ।
দেশ এখন কেমন চলছে? এ বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলের বক্তব্যে মিল নেই। মিডিয়ায় উভয়পক্ষের বিপরীতমুখী বক্তব্য প্রতিদিনই শোনা যাচ্ছে। তবে জনগণ যাদের বক্তব্যে সায় দেবে আখেরে বিজয় তাদেরই হবে। জনগণ কখনো গণআন্দোলনের মাধ্যমে তাদের রায় প্রকাশ করে, আবার কখনো প্রকাশ করে ব্যালটের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলগুলো জনমত গঠনে কথার মারপ্যাঁচ ও প্রোপাগান্ডা কৌশলকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তবে এখানে বলে রাখা ভাল যে, দেশ কেমন চলছে প্রাত্যহিক জীবন-যাপনের মাধ্যমেই জনগণ তা উপলব্ধি করে থাকে। এই উপলব্ধিই জনমত গঠনের আসল নিয়ামক। শুধু কৌশলে জনসমর্থন পাওয়া যায় না, বরং তাতে হিতে বিপরীত হয়। অথচ এই বিষয়টি আমাদের রাজনীতিবিদরা, বিশেষ করে সরকারের মন্ত্রী বাহাদুররা বুঝতে চান না। পরিণামে যা হবার তাই হয়। তখন শত আফসোসেও কোনো কাজ হয় না।
প্রধানমন্ত্রী ২৮ নবেম্বর বললেন, তিন বছরে মন্ত্রীদের কাজে আমি সন্তুষ্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবার বঙ্গভবনে নতুন মন্ত্রীদের শপথ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের একথা বলেন। সরকারের তিন বছরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা দেশের উন্নয়নে কাজ করছি। তবে কেউ কেউ চোখ থাকিতে অন্ধ। তারা আমাদের অর্জন দেখতে পায় না। প্রধানমন্ত্রী গত তিন বছরে মন্ত্রীদের কাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন এবং সরকারের উন্নয়ন তৎপরতায়ও তিনি গর্ববোধ করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জনগণ কি দেশের উন্নয়ন কর্মে মন্ত্রীদের তৎপরতায় সন্তুষ্ট হতে পেরেছে? দেশের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের কী অবস্থা? শেয়ারবাজার ও অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন? বেকারদের জন্য কি চাকরি-বাকরির ব্যবস্থা হয়েছে? দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ কেন? আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতিতে জনগণ আতঙ্কিত কেন? সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে নানা বুলি আওড়ালেও স্বয়ং তাদের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে কেন? সরকারের কাছে এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব না থাকলে জনগণ কেমন করে ভাববে, দেশ ঠিকমত চলছে? জনগণ লক্ষ্য করছে, জনদুর্ভোগ দূর করার পরিবর্তে সরকার যেন হামলা-মামলা ও বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের কাজকেই তাদের মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। এমন তৎপরতায় তো জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবার নয়। তাইতো দেশ পরিচালনায় কিংবা মন্ত্রীদের তৎপরতায় প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করলেও জনগণ তাতে সায় দিতে পারছে না। এমন বক্তব্যকে সরকার বিরোধী দলের প্রোপাগান্ডা হিসেবে হয়তো উড়িয়ে দিতে চাইবে। কিন্তু বক্তব্য তো শুধু বিরোধী দলই রাখছে না, অন্যরাও রাখছে। এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের বিশ্লেষণ উল্লেখ করা যায়। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দৈনিক গালফ নিউজে প্রকাশিত এক লেখায় কুলদীপ নায়ার বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। দেশের সর্বত্র দুর্নীতি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে যে, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ভয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে তাদের সহায়তা তুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে পাঁচ দিন থাকার পর আমার মনে হয়েছে, হাসিনা শুধু যে তার কারিশমাই হারিয়েছেন তা নয়, এক সময় যাদের বিশ্বাস করতেন তাদেরও হারিয়েছেন তিনি। তিস্তার পানি চুক্তি এবং টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যু আগামী নির্বাচনে নিঃসন্দেহে প্রভাব ফেলবে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন কুলদীপ নায়ার। তিনি উল্লেখ করেন, জনপ্রিয়তা একটি দুর্লভ ব্যাপার। প্রয়োজনের সময় শাসকরা জনপ্রিয়তা পান না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। যখন তার জনপ্রিয়তা আসলেই দরকার তখন তিনি তা হারাচ্ছেন। বিপুল সংখ্যক মানুষ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অপশাসন না হলেও সুশাসনের অভাবে বাংলাদেশের মানুষের জীবন শুধু দুর্বিষহই হয়ে ওঠেছে। আর ক্ষমতায় বসার ৩ বছর পার হওয়ার পরও তিনি তা বুঝতে পারছেন না। জনগণ তার কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করেছিল কিন্তু বলার মতো কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ জনগণ দেখতে পাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে তিনি বিদ্যুৎ খাতের কথা উল্লেখ করেন। নায়ার বলেন, স্বল্প সম্পদ দিয়ে দারিদ্র্য হ্রাস করা সব সময়ই চ্যালেঞ্জের বিষয় কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এ বাস্তবতা মানতে নারাজ। তিনি যা করছেন তা নিয়ে তাকে বেশ সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে। তিনি একপক্ষীয়ভাবে ভারতের সাথে ট্রানজিটের বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছেন। নায়ার বলেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যার জায়গাটি হলো, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। বাংলাদেশ সরকার মনে করছে, নয়াদিল্লী এবং কলকাতার মধ্যকার রাজনৈতিক টানাপড়েনের কারণে চুক্তিটি হচ্ছে না। তবে ভারতের মনিপুরে বরাক নদীর উপরে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প যখন সামনে এলো তখন ঐ বিষয়টি আবারও পেছনে চলে গেলো। মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরের এক মাস পর ২৩ অক্টোবর মনিপুর সরকার এবং নয়াদিল্লীর সঙ্গে এই চুক্তিটি হয়। আর এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশ বাস্তবিক অর্থেই আঘাত পেয়েছে। কারণ এই চুক্তির ফলে প্রমাণ হয়, নয়াদিল্লী বাংলাদেশের সুবিধা-অসুবিধার কথা ভাবছে না। ভারতের এ পদক্ষেপে কোণঠাসা হাসিনার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ভারতের সঙ্গে হাসিনার বন্ধুত্বের চেষ্টা উপেক্ষিত হয়েছে। কুলদীপ নায়ার তার লেখায় আরো অনেক কথাই বলেছেন। সেখান থেকে কিছু নেয়ার আছে কি না তা শেখ হাসিনার সরকার ভেবে দেখতে পারে।
এতো গেলো প্রতিবেশী দেশ ভারতের এক প্রবীণ সাংবাদিকের বিশ্লেষণ। এবার দেশের লোকের বিশ্লেষণ শুনি। জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছেন, দেশে যে ধরনের গণবিস্ফোরণ ঘটতে যাচ্ছে তা অতীতে আমরা কেউ দেখিনি। পাপ চরম পর্যায়ে গেলে আল্লাহর তরফ থেকে গজব নেমে আসে। সামগ্রিকভাবে দেশে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে অচিরেই আমরা এক ভয়ঙ্কর অবস্থা প্রত্যক্ষ করবো। এ জন্য কোনো দল লাগবে না। সাধারণ মানুষই রাস্তায় নেমে আসবে। অন্যায়-অত্যাচার আজ মাথার তিন হাত উপরে উঠে গেছে। তিনি একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘মানুষের তরে মাটির এ পৃথিবী, দানবের তরে নহে।' গত রোববার রাজধানীতে এক সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদানকালে তিনি এসব কথা বলেন। জানি না সাবেক এ মন্ত্রীর বক্তব্য আওয়ামী লীগ সরকার কিভাবে নেবে। তবে একথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মাটির এই পৃথিবী মানুষের জন্যই দানবের জন্য নয়। মানুষ যখন অন্যায়-অত্যাচারের মাধ্যমে দানব চরিত্র অর্জন করে তখন তার বিরুদ্ধে চলে মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। মানব জাতির ইতিহাস আসলে এই মুক্তি সংগ্রামেরই ইতিহাস। বাংলাদেশের বিবেকবান মানুষ মাত্রই চান আমাদের এই সমাজ মানুষের বসবাসযোগ্য হয়ে উঠুক। তবে এ আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রয়োজন সরকার বিরোধী দল এবং নাগরিকদের যথা আচরণ। কারণ নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথা আচরণের বদলে কোনো সমাজের মানুষ যদি শুধু পরস্পরের বদনাম গেয়ে যায়, তবে তাতে প্রগতি অর্জিত হয় না, পাওয়া যায় না শান্তির নিবাসও। তবে এসব বিষয় উপলব্ধির জন্য নিজের সাথে কথা বলতে হয়, আত্মসমালোচনায় অভ্যস্ত হতে হয়। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে এখন এসব বিষয় লক্ষ্য করা যায় না। তাই দেশের অগ্রগতি ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে যে কর্ম-সংস্কৃতি প্রয়োজন তা এখনই লক্ষ্য করা যাবে কি না সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই। তবে এ বিষয়টি আমরা উপলব্ধি করি যে, আরো ক্ষতি থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে এবং জনগণের দুর্ভোগ হ্রাস করতে হলে সরকারের এখনই ভুলপথ পরিহার প্রয়োজন। এমন চিত্র লক্ষ্য করা গেলে বিরোধী দলের ভূমিকায়ও হয়তো পরিবর্তন আসবে। না আসলে তা দেখার জন্য তো দেশের জনগণ রয়েছেই। আর আখেরে রায় তো জনগণই দেবে।
Thursday, 1 December 2011

যুদ্ধাপরাধের বিচার
যুদ্ধাপরাধের বিচার
যুদ্ধাপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালের গঠন প্রক্রিয়া, বিচারের কার্যক্রম এবং উদ্দেশ্যের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে দেশের বিভিন্ন মহলে যেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বিভিন্ন লক্ষণের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠেছে। যেমন সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্ক সফরকালে যখন হিল্টন হোটেলে তার সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান চলছিল, তখন বিএনপি ও কোয়ালিশন ফর আমেরিকান এসোসিয়েশন হিল্টন হোটেলের পাশেই বিক্ষোভ করছিল। এসোসিয়েশনের ব্যানারে ২০টি সংগঠনের পাঁচ হাজার নেতা-কর্মী বিক্ষোভে মুখরিত করে তোলে পুরো এলাকা। তাদের অভিযোগ, সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে বিরোধী দলীয় নেতাদের নির্যাতন আর হয়রানি করছে এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করছে। সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নামে বিরোধী দল নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে নেমেছে। বিক্ষোভকারীরা অবিলম্বে বিরোধীদলের সব নেতার মুক্তি দাবি করেন। কোয়ালিশন ফর আমেরিকান এসোসিয়েশনের ব্যানারে অংশ নেয় বাংলাদেশ আমেরিকান প্রগ্রেসিভ ফোরাম, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ পরিষদ, সাঈদী মুক্তি আন্দোলন, বাংলাদেশ আমেরিকান প্রফেসরস এসোসিয়েশন, এসোসিয়েশন অব আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার্স ইন নর্থ আমেরিকা, এসোসিয়েশন অব আমেরিকান ব্যাংকার্স ইন নর্থ আমেরিকা, বাংলাদেশ বিজনেস এসোসিয়েশন, টিচার্স এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা, বাংলাদেশ আমেরিকান ক্যাবি এন্ড লিমো সোসাইটি, মহিলা কল্যাণ সংস্থা নিউইয়র্ক, ইমাম এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা, প্রবাসী কল্যাণ সংস্থা।
উক্ত ট্রাইব্যুনালের ব্যানারে তেমনি গত সোমবার (২৮/১১/১১ইং) যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র্যাপ দু'দিনের বাংলাদেশ সফরের শেষ পর্যায়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁর সুপারিশধর্মী ঐ বক্তব্যের মধ্য দিয়েও অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রকাশ ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র্যাপ আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে তাঁর ইতোপূর্বে দেয়া সুপারিশ পুরোপুরি গ্রহণ না করাতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। মি. স্টিফেন বলেন, ‘‘আমার ১০টি সুপারিশের ৫টি আংশিক গ্রহণ করা হয়েছে। আমি দুঃখের সাথে বলতে চাই যে, গত জুন মাসে বিচার কাজের ধারাসমূহে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছে তাতে আরও অনেক কিছু আনা সম্ভব ছিল।’’ বাংলাদেশে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ কি তার সঠিক সংজ্ঞায়নও হয়নি বলে স্টিফেন অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ থাকা উচিত। বিচারের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হয়েছে- যুক্তরাষ্ট্র এমনটি দেখতে চায়। ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ সরাসরি রেডিও-টিভিতে প্রচারের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বের সব মানুষের কাছে এ বিচারপ্রক্রিয়া উন্মুক্ত থাকতে হবে। যারা আগ্রহী তাদের এ বিচার কাজ সম্পর্কে জানতে দিতে হবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে আদালতের অধিবেশনে যোগ দেয়া সহজ ও সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সিয়েরালিয়নে যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্যে গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে প্রতিদিন যে কার্যক্রম হয়, তা ইংরেজি এবং সে দেশের ভাষায় বিস্তারিত লিখে ওয়েবসাইটে দিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশেও এটা করা উচিত। এমনভাবে বিচার কাজ পরিচালনা করা দরকার, যাতে তা স্বচ্ছ এবং বিশ্বের সবার জন্যে উন্মুক্ত হয়।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়ে যখনই কোথাও ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি ঘটে, সেখানেই অশান্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এজন্যে বিশ্বের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল দেশে সকল সমাজেই আবহমানকাল থেকেই ন্যায়বিচারের বিষয়টি যেমন সকলের কাঙ্ক্ষিত, তেমনি এর প্রতিষ্ঠার দাবি সর্বত্র অভিন্ন এবং এর চাহিদা সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তবে যে-কোন বিচারকার্যের মূল লক্ষ্যে যেমন বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও কার্যক্রমের দ্বারা সত্য উ ঘাটন ও সে অনুযায়ী ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণের জন্যে নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধস্পৃহা বর্জিত মানসিকতা অপরিহার্য, তেমনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বেলায় তা আরও বেশি অপরিহার্য। এক্ষেত্রে উল্লিখিত বিষয়াদির ব্যতিক্রম ঘটলে তা যেমন বিচারের নামে হবে প্রহসন, তেমনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোথাও তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। মাঝখানে জাতীয় ঐক্য-সংহতি বিনষ্ট হয়ে জাতীয় জীবনের অশান্তিই বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের উন্নতি অগ্রগতির পথে হবে প্রতিবন্ধক। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র্যাপ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও এর সুষ্ঠু কার্যক্রমের ব্যাপারে উত্থিত প্রশ্নাবলীর নিরসনকল্পে যেসব প্রস্তাব ও পরামর্শ দিয়েছেন, এসব প্রস্তাব-পরামর্শ অতীব গুরুত্বপূর্ণ, যা বিশ্বজনীন স্বীকৃত। দেশে-বিদেশে এ ট্রাইব্যুনালের বিচারের গ্রহণযোগ্যতার জন্যে স্টিফেন জে. র্যাপের প্রদত্ত প্রস্তাবাবলীর আলোকে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত ও সে অনুযায়ী এর কার্যক্রম নিশ্চিত করা উচিত। তাতে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধিই পাবে। এই সঙ্গে জামায়াতসহ অন্যায়ভাবে বিরোধী দলীয় যেসব নেতাকে গ্রেফতার ও এ মামলায় জড়ানো হয়েছে, তাদের আশু মুক্তিদান গণতন্ত্র, মানবতা ও মানবাধিকারের দাবি বলে আমরা মনে করি।
Subscribe to:
Posts (Atom)