Flickr

Thursday, 7 June 2012

শুধু বাঁচার জন্য মানুষ সমাজবদ্ধ হয়নি

Posted by   on

শুধু বাঁচার জন্য মানুষ সমাজবদ্ধ হয়নি
ক্ষুব্ধ মানুষ শুধু যে নিজের ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ভাবেন তা নয়, সমাজও তাদের নানাভাবে ভাবায়। পশুপাখির সাথে মানুষের একটা মৌলিক পার্থক্য হলো, শুধু জৈবিক চাহিদা মিটলেই মানুষের চলে না- মানুষের আরও গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা আছে, যা মানুষের মন ও আত্মার সাথে জড়িত। তাই মননশীলতা ও পবিত্রতার বিষয়গুলো মানব প্রসঙ্গেই আসে। পশুপাখির কাছে মানুষ ঐসব বিষয় আশা করে না। এই জন্যই হয়তো বলা হয়, পশুপাখি সহজেই পশুপাখি কিন্তু মানুষ সহজে মানুষ নয়। এই কথার অর্থ আবার এই নয় যে, জৈবিক চাহিদা মানুষের জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। বিষয়টি মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলেই তো মানুষ রুটি-রুজির জন্য সংগ্রাম করে এবং বিয়ের পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়। প্রকৃত মানুষ সীমালঙ্ঘন না করেই উদরে ক্ষুধা, যৌন চাহিদা মেটাতে চায় এবং চায় মন ও মেধার বিকাশ ঘটাতে। এই জন্যই তো মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে। সমাজের কাছে মানুষের চাওয়ার আছে অনেক কিছু, আবার মানুষের কাছেও সমাজের পাওয়ার আছে অনেক কিছু। চাওয়া-পাওয়ার এই অংকটা না মিললে ফলটা ভুল হয়। তখন সমাজ মানুষের কাছে গুরুত্ব হারায়। কিন্তু সমাজ থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ার কারণ যে খোদ মানুষই, তা আমরা কতটা ভেবে দেখি? আবার সব মানুষ দায়ী নয়, কিংবা একই মাত্রায় দায়ী নয় তেমন বিশ্লেষণেই বা আমরা কতটা মনোযোগী?
শুধু বাঁচার জন্য মানুষ সমাজবদ্ধ হয়নি, বরং ভালোভাবে বাঁচার জন্যই সমাজবদ্ধ হয়েছে। লিখিত ও অলিখিতভাবে তারা তাদের দায়-দায়িত্বও ভাগ করে নিয়েছে। কামার-কুমার, জেলে ও কৃষকরা তো তাদের পেশায় ব্যস্ত রয়েছেন। অফিস-আদালত ও কল-কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তারা। পেশাজীবী এইসব মানুষ কে কতটা কাজ করছেন এবং অধিকার পাচ্ছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়  আছে। সমাজে মানুষ কোন্ ধরনের বিধি-বিধান ও আইন-কানুনের আওতায় বসবাস করছেন, উৎপাদন-বণ্টন, পরিশ্রম ও ভোগে ন্যায্যতা আছে কী না? সমাজে মানুষ নিজস্ব বোধ-বিশ্বাস ও আশা-আকাঙ্ক্ষার আলোকে বিকশিত হতে পারছে কী না? ব্যক্তির স্বাধীনতা ও দেশের স্বাধীনতা অটুট আছে কী না? পার্লামেন্টে কী ধরনের আইন পাস হচ্ছে? বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদছে কী না? সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করেছে কী না? গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ আছে কী না? সমাজের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতি সেবী, বুদ্ধিজীবী, আলেম-উলামা ও মিডিয়া সচেতন আছে কী না? এইসব বিষয় অবজ্ঞা ও অবহেলা করে কোনো সমাজ কাঙ্ক্ষিত প্রগতির পথে এগুতে পারে না। বরং অবজ্ঞা ও অবহেলার মাত্রা বেড়ে গেলে, বিশেষ করে সরকার ও সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো বোধোদয় না ঘটলে দুর্ভাগা জাতির রাষ্ট্রটি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। এমন বিশ্লেষণের আলোকে আমরাও আমাদের সমাজের দিকে, রাষ্ট্রের দিকে তাকাতে পারি।
আমাদের পার্লামেন্ট যে ঠিকভাবে চলছে না তা আমরা জানি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদছে। আর প্রশাসন যেন একটি দলীয় আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। পুলিশের কর্মকান্ড সম্পর্কে কম বলাই ভালো। সরকারের মন্ত্রী বাহাদুররাই এতো ভুল কথা ও ভুল কাজে জড়িয়ে গেছেন যে, সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে বলে আর লাভ কী? সরকার তো অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী হয়ে কাজ না করার জন্য ওয়াদাবদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে সেই ওয়াদার চিত্রটা কেমন? দলীয়করণের অনুরাগ ও দাপটে শুধু বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরাই নন, সাধারণ মানুষও এখন অস্থির। এখানে আরও বলে রাখা ভালো যে, মানুষের মতো সরকারও কোনো ক্ষেত্রে ভুল করতে পারে। ভুলের পর অনুশোচনা, আত্মসমালোচনা তথা সংশোধনের চেতনা যেমন মানুষের মুক্তির পথ- সরকারের মুক্তির পথও এর চাইতে আলাদা কিছু নয়। কিন্তু আত্মসমালোচনা ও সংশোধনের বদলে সরকার যদি দলীয় স্বার্থে চাতুর্যের পথে চলেন, তখন ভুলের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এমন সংস্কৃতি সরকার ও দল কারো জন্যই কল্যাণকর হয় না, বরং দ্রুতপতন নিশ্চিত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ক্ষমতায় থাকাকালে সহজবোধ্য এই বিষয়টি যেন মানুষের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। বর্তমান সময়েও আমরা তেমন চিত্রই লক্ষ্য করছি।
দেশে একের পর এক এমন সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, যা সরকারের জন্য খুবই বিব্রতকর। বরং বলা যেতে পারে এসব ঘটনা সরকারের সুশাসন ও কার্যকারিতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকান্ড, সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের  এপিএস-এর অর্থ কেলেঙ্কারি, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম, সউদী কূটনীতিক খালাপ আল আলি হত্যা, ১৮ দলীয় জোট নেতাদের জেলে বন্দী, একের পর এক পুলিশী তান্ডবের ঘটনা জনমনে শুধু প্রশ্ন নয়, ক্ষোভেরও সৃষ্টি করেছে। এসব ঘটনা সরকারের সুশাসন ও যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কিন্তু ঘটনাগুলোর ব্যাপারে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর বক্তব্য মানুষকে বিস্মিত করেছে। চাতুর্যের পথে পা বাড়ানোর ফলে রহস্য উদঘাটনতো দূরের কথা, সরকার সুষ্ঠু তদন্তের কাজেও সফল হচ্ছে না। একের পর এক ইস্যু সৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু সরকার তার কোনো সমাধান দিতে পারছে না। তবে এসব ইস্যু নিয়ে বিরোধী দলের আন্দোলন যাতে দানা বাঁধতে না পারে সেই জন্য সরকার দমন-পীড়নে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এসব ঘটনা জনসম্মুখে নিয়ে আসেন সাংবাদিকরা। এমন কাজ যে সরকারের খুবই অপছন্দের তা উপলব্ধি করা যায় সাংবাদিকদের ওপর একের পর এক পুলিশী হামলার ঘটনায়। তবে এসব কাজে ঝাল মেটানো গেলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না। সমস্যা কমার বদলে বরং বাড়ে। জনগণের সমস্যার সমাধান হলেই তো সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ে। কিন্তু সরকারতো সে পথে হাঁটছে না। সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত তিন বছরের মধ্যে অর্থনীতির অবস্থা এখন সবচেয়ে খারাপ। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে এখন বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। সম্প্রতি উৎপাদন ও রফতানিতে প্রবৃদ্ধি কমেছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে বিরাজ করছে বেহালদশা। সরকারের আয়-ব্যয়ের ব্যবস্থাপনায়ও বড় ধরনের ত্রুটি রয়েছে। এতে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো বড় ধরনের চাপে পড়েছে। এসব বিবেচনাকে সামনে রেখে চলতি অর্থবছরকে সরকারের সবচেয়ে দুর্বল বছর হিসেবে চিহ্নিত করেছে সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সরকার সুশাসনে সফল হলো না, ব্যর্থ হচ্ছে অর্থনীতিতেও। অর্থাৎ দিনবদল আর হলো না। সরকার দিনবদলের অঙ্গীকার করেছিল বলেই ব্যর্থ সরকারের সমালোচনা করতে হয়। আগামীতে অন্য কোনো সরকার এভাবে ব্যর্থ হলে তাদেরও সমালোচনা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না সাংবাদিকদের। কিন্তু আমাদের সরকারগুলো ব্যর্থ হচ্ছে কেন, তা কি তারা একটু ভেবে দেখবেন? মানুষ যে জন্য সমাজবদ্ধ হয়েছে, রাষ্ট্র গঠন করেছে, সে সম্পর্কে উদাসীনতাই সরকারগুলোর ব্যর্থতার মূল কারণ। এই কারণ দূর করা না গেলে কোনো সরকারের পক্ষেই সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। যেমনটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে বর্তমান সময়েও।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter