১। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দ্বিখন্ডিত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত ডমিনিয়ন নামে দু'টি স্বাধীন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে। যে সব হিন্দুর বাড়িঘর ও ভূ-সম্পত্তি পাকিস্তান ভূখন্ডে পড়ে তা হস্তান্তর করে অনেকে ভারতে চলে যেতে চায় এবং অনুরূপভাবে যে সব মুসলমানের বাড়িঘর, বিষয় সম্পত্তি ভারত ভূখন্ডে পড়ে তাদের মধ্যেও অনেকে তা হস্তান্তর করে পাকিস্তান চলে যেতে চায়। পাকিস্তানের হিন্দু নাগরিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যার হিন্দুরা পাকিস্তানকে স্বদেশ যেমন মনে করতো না; তেমনি ভারতের মুসলমানদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যার মুসলমানরাও ভাতরকে স্বদেশ মনে করতো না। এই মনোভাব অসন্তোষ ও আন্দোলন আকারে দেখা যায় বা বুঝা যায়।
২। উভয় রাষ্ট্রের জনগণের এই মনোভাব উভয় রাষ্ট্রের সরকার প্রধান বুঝতে পেরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নূন একত্রে মিলিত হয়ে একটা চুক্তি বা প্যাক্ট করেন; যা নূন-নেহরু প্যাক্ট নামে খ্যাত। এই প্যাক্টের ফলে ভারতের মুসলিম নাগরিকদের মধ্যে যারা তাদের বাড়িঘর ও বিষয় সম্পত্তি পাকিস্তানের হিন্দু নাগরিকদের সমমূল্যের বিষয় সম্পত্তির সাথে বিনিময় মূলে হস্তান্তর করতে পারবেন তা চুক্তি হয়। এই নূন-নেহরু প্যাক্টের ফলে পাকিস্তানের হাজার হাজার হিন্দু এবং ভারতের হাজার হাজার মুসলমান মহাজের হয়ে বা হিন্দু বিনিময়কারী ও মুসলিম বিনিময়কারী হয়ে নিজ নিজ সম্পত্তি বিনিময় করেন।
৩। ভারত সরকার এই বিনিময়কে স্বাগত জানালেও পাকিস্তান সরকার সেভাবে স্বাগত জানায়নি। ফলে বিনিময় আমমোক্তার নামা ও বিনিময় দলিল সম্পাদনে ভারত সরকার কোন বাধা সৃষ্টি করেনি। পাকিস্তানের হিন্দুরা ভারতে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট অথবা নোটারী পাবলিক অফিসে উপস্থিত হয়ে তাদের পাকিস্তানস্থিত বাড়িঘর ও বিষয় সম্পত্তি বাবদ বিনিময় আমমোক্তার নামা দলিল মুসলিম বিনিময়কারী বরাবর সম্পাদন করে দিয়েছেন এবং ঐ একই সময়ে ভারতীয় মুসলিম বিনিময়কারী তার ভারতীয় সম্পত্তির বিনিময় দলিল রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে হিন্দু বিনিময়কারীর বরাবর রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন। বিনিময়ের সব ঝামেলা একদিনেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু মুসলিম বিনিময়কারী হিন্দু বিনিময়কারীর নিকট হতে সম্পাদিত আমমোক্তার নামা নিয়ে এসে পাকিস্তানের জেলা প্রশাসকের অফিসে তা জমা দিয়ে তা ড্যালিড করার ও বিনিময় দলিল রেজিস্ট্রি করার জন্য আবেদন করেন। মুসলিম বিনিময়কারীর ডিসি অফিস ঘোরার যাত্রা শুরু হয়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ঘুরে ৩০-৪০ বছরেও পাকিস্তানের বা বাংলাদেশের ডিসি অফিস বিনিময় দলিল রেজিস্ট্রি করে দেয়নি অর্থাৎ মুসলমানদের কিছু বিনিময় দলিল রেজিস্ট্রি হয়েছে এবং কিছু বিনিময় দলিল এখনও রেজিস্ট্রি হয়নি। অনেক বিনিময়কারী নিজে মারা গেছে। অনেকের পুত্র পর্যন্তও মারা গেছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের দুর্নীতিবাজ ডিসি ও এডিসিরা মুসলিম বিনিময়কারীদের বিনিময় দলিল রেজিস্ট্রি না করে বছরের পর বছর তাদের উৎপীড়ন করেছে।
৪। পাকিস্তান সরকার হিন্দুদের সম্পত্তি হস্তান্তরের বিরুদ্ধে ১৯৬৪ সালে ১ নং অর্ডিন্যান্স জারি করে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইউব খান ০৬/০৯/১৯৬৫ ইং তারিখে পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন; যা ১৬/০২/১৯৬৯ ইং তারিখে প্রত্যাহার হয়। এই সময়ে যে সব হিন্দু পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে বসবাস করেছে তাদের ভূ-সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শত্রু সম্পত্তি আইনের যাত্রা এখান হতেই শুরু হয়। শত্রু সম্পত্তি আইন বলবৎ থাকা অবস্থায় ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান শত্রু সম্পত্তি আইনের অবসান না ঘটিয়ে বরং এক ধাপ এগিয়ে তিনি শত্রু সম্পত্তির মালিকানা সরকারের উপর ন্যস্ত করে শত্রু সম্পত্তি আইনের নামকরণ করেন ‘‘অর্পিত সম্পত্তি’’ বা "Vested Property"। শেখ মুজিবুর রহমান ইচ্ছা করলে এই শত্রু সম্পত্তি আইনের অবসান ঘটিয়ে ঘোষণা দিতে পারতেন যে ‘‘শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল করা হলো। দেশের প্রচলিত আইন ও আদালতের বিচারের মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তির মীমাংসা হবে।
৫। শেখ মুজিবুর রহমানের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং সরকার প্রধান হয়েছেন শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু কেউ এই সাধারণ মানুষ বা কৃষকদের দিকে ফিরে দেখেননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে যে সব অবাঙালি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল বা পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান নিয়েছিল তাদের বাড়িঘর, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ভূসম্পত্তিকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি বা Abandoned Property ঘোষণা করা হয়। অবাঙ্গালীদের এই পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে লুটপাট করতে উপর তলার মানুষের শ্যেনদৃষ্টি থাকায় এই পরিত্যক্ত সম্পত্তির শীঘ্র স্থায়ী সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু হিন্দু মুসলমান সাধারণ নাগরিকদের শত্রু সম্পত্তি বা অর্পিত সম্পত্তির মীমাংসা না করে তাকে আরো পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বা আরো যুগান্তর কাল ধরে প্রজা উৎপীড়ন করার জন্য রঙিন নাম দেয়া হয়েছে ‘‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন-২০১২।’’
৬। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের By Product হলো পরিত্যক্ত সম্পত্তি আইন এবং ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের By Product হলো শত্রু সম্পত্তি আইন বা অর্জিত সম্পত্তি আইন। ভারত সরকার ভারতীয় মুসলিমদের সম্পত্তি হস্তান্তরের বিরুদ্ধে কোন বাধা সৃষ্টির আইন যথা ১৯৬৪ সালের অর্ডিন্যান্স নং ১ বা ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে ‘‘শত্রু সম্পত্তি’’ এই ধরনের উৎপীড়নমূলক আইন পাস করেনি। কিন্তু পাক সরকার বা বাংলাদেশ সরকার করেছে। এই অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের আওতায় ১০ কোটি হিন্দু-মুসলমান Affected হবে বা হয়েছে। কারণ ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে পাক-ভারত উপমহাদেশের প্রায় ৮০% ভূসম্পত্তির মালিক ছিল মুসলমানরা। বৃটিশ শাসন আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং জমিদার বা জমিদারী সৃষ্টির কৌশলে হিন্দুরা ৮০% ভূসম্পত্তির মালিক হয়। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তানের মুসলমানরা জজ, ব্যারিস্টার, সচিব, জেলা প্রশাসক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, এসপি, কর্নেল, মেজর, ব্রিগেডিয়ার ইত্যাদি চাকরি করে ও ব্যবসা বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থ রোজগার করেছে এবং অর্থশালী হয়েছে। ভারত হতে অনেক মুসলমান তাদের ভারতীয় সম্পত্তি নূন নেহরু প্যাক্টের অধীনে বিনিময় সূত্রে এ দেশের বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক হয়েছে। এইভাবে মুসলমানরা পুনরায় ৮০% সম্পত্তির মালিক হয়েছে। সি. এস রেকর্ডে দেখা যাবে ৮০% জমির মালিক হিন্দু এবং আর. এস রেকর্ডে দেখা যায় ৮০% জমির মালিক মুসলমান। সুতরাং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের আওতায় ১০ কোটি হিন্দু-মুসলমান Affected হবে এবং ৫ কোটি মামলার জন্ম হবে। এই ৫ কোটি মামলার বিচার করতে হাজার হাজার বিচারক নিয়োগ করতে হবে। হিন্দু আইনে ‘‘রিভারসনার’’ নামে একটি শব্দ আছে। এই রিভারসনার আইনের আওতায় বাংলাদেশে বসবাসকারী অধিকাংশ হিন্দু ভারতে চলে যাওয়া হিন্দুদের অর্পিত সম্পত্তি ‘‘স্বার্থাধিকারী’’ হিসাবে প্রত্যর্পণ আইনে দাবিদার হতে পারবে। সুতরাং এই আইন অতীত কালের কলেরা বা বসন্ত রোগের মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়বে। লাশ দাফন করার লোকও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ও আদালতে এইসব জটিলতার বিচার হতে পারতো। এই আইন হিন্দু-মুসলমানের সুসম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারে। একটি ‘‘নিবর্তনমূলক আইন।’’
৭। যে মুসলমান তার স্বোপার্জিত অর্থ দিয়ে ষাট দশকে হিন্দুর নামীয় এস এ রেকর্ডের ভূমি বা বাড়ি খরিদ করেছেন বা যে ভারতীয় মুসলিম বিনিময়কারী ষাট দশকে হিন্দুর সম্পত্তির সাথে নিজের সম্পত্তির বিনিময় মূলে প্রাপ্ত হয়ে ৪০/৪৫ বছর ভোগ দখল করছে বা ঐ আমলের ৫০০/- টাকা মূল্যের সম্পত্তি বর্তমান আমলে ৫০,০০,০০০/- (পঞ্চাশ লাখ) টাকার সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে সেইসব সম্পত্তি এসএ এবং আরএস রেকর্ডের মালিকানার পরিবর্তনের কারণে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের কাঠামোতে পড়েছে। এই জটিলতা দূর করতে হবে। ৫ কোটি মামলার উদ্ভব। এই অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনে কোন হিন্দু বা কোন মুসলমানের লাভ নেই বা লাভ হবে না। শুধুমাত্র দুর্নীতির দুয়ার খুলে দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার ঘুষের টাকা ডিসি অফিসে, রাজস্ব অফিসে, তহসীল অফিসে দিতে হবে। জুতো ক্ষয় হবে। ডিসি অফিসে কতদিন ধরে ঘুরতে হবে তার হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। তাই হিন্দুর কপাল ও মুসলমানের কপাল একসাথে পোড়ার কাজ শুরু হয়েছে।
৮। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন এমনই বিষধর আইন যে, যুগান্তর কালের বিচারাধীন মামলার সম্পত্তির যদি খতিয়ান নং ও দাগ নং গেজেটে প্রকাশিত হয়; তবে সেইসব সম্পত্তির বিচারকার্য সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ বা স্থগিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ আদালতের বিচারাধীন মামলা বা আপিলের বিচার করার এখতিয়ার জজ সাহেব, অতিরিক্ত জজ সাহেব হারিয়ে ফেলবেন। অর্থাৎ এই আইন দ্বারা বিচারকের এখতিয়ার কেড়ে নেয়া হয়েছে। এই আইন মানুষের মৌলিক অধিকার, সম্পত্তি ভোগ দখলের অধিকার হরণ করেছে। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যকার সুসম্পর্ক বিনষ্ট করে দিবে। আদালতের বিচারকের বিচার ক্ষমতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তাই বাংলাদেশের মহামান্য প্রধানমন্ত্রী ও মহামান্য প্রধান বিচারপতির সদয় দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক এই অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনটি যদি জনকল্যাণকর না হয়ে জন নিবর্তনমূলক মনে হয় তবে তা বাতিল বা রদ, রহিত করার আহবান জানাচ্ছি।
No comments:
Write comments